অলৌকিক গর্ত
তার মুখে খুব ঘন ঘন থুথু এসে যায়। প্রায়শই তিনি মুখের ভেতরে জমানো থুথু জিহ্বার ডগা থেকে এটা সেটা তাক করে থুপ্ করে ছুঁড়ে মারেন। রাস্তায় হাঁটা চলা করার সময়ই তিনি এই কাজটা একটু বেশি করেন। বিশেষ করে চলার পথের আশে পাশে কোনো গর্ত দেখতে পেলে থুথু নিক্ষেপের খেলায় তিনি বিশেষ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। কখনো কখনো থুথুর দলাটি ঠিকমত তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুলো কিনা তা আবার খুব নিবিড় ভাবে পরখ করেন। মুখের ভেতরে ঘন ঘন থুথু এসে যাওয়ার ব্যাপারটি এখন আর কোনো বিড়ম্বনা নয়। রাস্তায় চলাফেরার সময় বিভিন্ন বস্তুকে টার্গেট করে থুথু নিক্ষেপের বিষয়টি বলা যায় এখন তার একটি প্রিয় অভ্যেস।
মফস্বল শহরের এই এলাকাটা এখনও অনেকটাই ফাঁকা এবং নীরব। রাস্তায় কিছু হালকা পাতলা যান চলাচল আছে। খুব ধীরে কিছু জনপদ দোকানপাট গড়ে উঠলেও তেমন জমাট বাঁধেনি শহর এখানে। অকেজো অলস এক পড়ন্ত বিকেলে ফুটপাত ধরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটছিলেন তিনি। একটি চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে রাস্তার পাশে তিনি একটি গর্ত তাঁর নজরে এলো। গর্তটির পাশেই কিছু খুচরো মাটি স্তূপ করে রাখা। এই সময় তাঁর মুখের মুখের ভেতরে কিছু থুথু জমে যায়। গর্তের তলদেশের মধ্যিখানটা তাক করে তিনি পিস্তলের গুলির মত থুথুর দলাটি ছুঁড়ে মারলেন। তারপর গর্তের উপর ঝুঁকে পড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে তিনি থুথুর দলাটিকে খুঁজতে লাগলেন। কোথায় গেলো থুথু! টার্গেট কি মিস হয়ে গেল? তিনি আরও ঝুঁকে অনেকক্ষণ ধরে থুথুর দলাটি খুঁজে পেতে চেষ্টা করলেন। আশ্চর্য কাণ্ড! কোথাও নেই! হারিয়ে গেছে থুথুর দলা। তিনি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন তাঁর অদুরেই দু’পাশে দু’জন লোক উৎসাহ ভরে তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
– অত নজর দিয়ে কী দেখছিলেন ভাই সাহেব?
তাদের একজন জানতে চাইল। সুরুজ্জামান সাহেব কোন জবাব দিলেন না। যেন কোন নিগূঢ় রহস্য যতনে লুকোচ্ছেন চোখে মুখে এমনি একটি চতুরতার হাসি ঝুলিয়ে রেখে আগের মতই গভীর মনোযোগে গর্তের ভেতরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। ইতিমধ্যে গর্তের অপর পাশে আরও তিনজন নবাগত এসে দাঁড়িয়েছে। আগের লোকটি আবারও জানতে চাইল,
– বলেন না ভাই, কী আছে ওখানে? মূল্যবান কিছু নাকি?
নুরুজ্জামান সাহেব দেখতে নিরীহ ভদ্র গোছের মানুষ হলেও স্বভাবে কিছুটা পোংটা ধরনের। প্রেক্ষাপটটি যতই তাৎপর্যহীন হোক, অকারণে অনুসন্ধিৎসু বে-আক্কেলে এই পাবলিককে ভেড়া বানাবার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। লোকটির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
– আছে রে ভাই আছে। জব্বর গরম জিনিস আছে। তবে অদৃশ্য অবস্থায় আছেন তিনি।
এবার পাঁচজনই একযোগে ঝুঁকে পড়ল গর্তের উপরে। ঠেলাঠেলির চাপে সুরুজ্জামান সাহেব ছিটকে পেছনে সরে এলেন। গর্তের চারপাশে জমে যাওয়া ভিড়টা খুব দ্রুত ফুলে ফেঁপে উঠছে। ততক্ষণে গর্তকে ঘিরে একটা বলয়ের মধ্যে উদগ্রীব মানুষের তুমুল ধস্তাধস্তি ও শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। লোকজন একে অপরের সাথে ঝগড়া করছে। ভিড় ঠেলতে ঠেলতে একজনকে বলতে শোনা গেল—
– একটু সরেন না ভাই। শুধু আপনারাই দেখবেন নাকি? আমাদেরও তো দেখার অধিকার আছে।
কী দেখার অধিকার সে সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই। কেউ এসে বলছেওনা কী আছে ওখানে। তবুও সবাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যেতেই হবে গর্তের কাছে। দেখতে হবে কী আছে ওখানে।
না যেতে পারলে বুঝি দারুণ কিছু একটা মিস হয়ে যাবে। দেখতে দেখতে বিশাল এক জনারণ্যে ছেয়ে গেল পুরো জায়গাটা। ফুটপাথ বেয়ে রাস্তার উপর আছড়ে পড়ল উদ্ধৃত্ত জনতার ঢেউ। সুরুজ্জামান সাহেব পুলকিত বোধে কিছুক্ষণ জায়গাটার আশেপাশে ঘরাঘুরি করলেন। তারপর আপন মনে হাসতে হাসতে চলে গেলেন নিজের পথে।
গর্তের জায়গাটা থেকে অল্প দূরে একটি চায়ের দোকানে বসে সাকরেদদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল এলাকার শীর্ষ মাস্তান জগু শিকদার। প্রথম থেকেই চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা সে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। জগু শিকদার সুরুৎ সুরুৎ করে কাপ থেকে গরম চা গিলছে আর সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছে। এখন তার মস্তিষ্কের চিন্তার বৈদ্যুতিক বাল্বটি নিয়ন বিজ্ঞাপনের মত জ্বলছে আর নিভছে। ইদানিং পুলিশ আর র্যা ব বাহিনীর দিগ্দারিতে জগু শিকদারদের দৈনন্দিন ধান্দাবাজী প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছে। রুজি রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আজকের এই পড়ন্ত বিকেলে সামান্য একটি মাটির গর্তকে ঘিরে শহরের আম জনতার এই অর্থহীন ব্যাকুলতা কি তার জন্য নতুন কোনো সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে না? কোনো নিপুণ কৌশলের গ্যাঁড়াকলে এই ক্ষণজন্মা পটভূমিই কি হয়ে উঠতে পারে না মুনাফাময় কোনো উদ্যোগের সুলভ পুঁজি? জগু শিকদারের চিন্তা প্রবাহে এবার রেসের ঘোড়ার দাপাদাপি। ঠিক তখনই তার উর্বর মস্তিষ্কে ধেয়ে এসে নোঙ্গর করলো এক সরেস মতলব। সাকরেদদের আড়ালে ডেকে সে দ্রুত কিছু পরামর্শ সেরে নিল। তারপর তোরা এখানে থাক বলে তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় জনতার ভিড়ে মিশে গেল। একটু পরেই আবার ফিরে এলো। তার এক হাতে একটি টিনের চোঙ্গা অন্য হাতে ফুটবলের রেফারীর হুইসেল। আপাতত এটুকুই পুঁজি। ঘন ঘন হুইসেল বাজিয়ে আর উচ্চৈস্বরে চোঙ্গা ফুকিয়ে খুব দ্রুত সেই বিশাল জনতার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নিল জগু শিকদারের লোকেরা।
– লাইন ধইরা আসেন ভাইসব। নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। কতৃর্পক্ষের বিশেষ বিবেচনায় এই আসমানী হাদিয়া কুদরতী কূপ দর্শন আইজ রাইতের জন্য ফ্রি। আইজ কোনো টিকেট লাগবো না। হেলায় সুযোগ হারাবেন না। দলে দলে আসিয়া অশেষ ছওয়াব হাছেল করেন। রোগ বালাই দূর করেন। মনের বাসনা পূরণ করেন। লাইন ধইরা আসেন ভাইয়েরা, লাইন ধইরা আসেন!
জগু শিকদারের সাকরেদদের ক্ষীপ্র তৎপরতায় বিক্ষিপ্ত জনতাকে অচিরেই পোষ মানিয়ে ফেলা হলো। সুরসুর করে তারা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। জগু শিকদারের আসমানি কূপের পাশে ঘন হয়ে ভিড় জমে রইল অনেক রাত অবধি। গভীর রাতে মাইকে ঘোষণা হলো আজকের মত আসমানি কূপ বন্ধ হলো। আগামীকাল সকাল নয় ঘটিকায় আবার তা দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
জগু শিকদার তার বিশাল বাহিনী নিয়ে সারারাত দৌড়াদৌড়ি করে অনেক কাজকর্ম সেরে ফেলল। গর্তের এক পাশ থেকে লম্বা বাঁশের মাথায় উড়িয়ে দেওয়া হলো একটি বিশাল লাল সালুর ঝাণ্ডা। ঝাণ্ডাটি ত্রিকোণাকৃতি যার ঠিক মধ্যিখানে শোভিত বৃহৎ এক সোনালী তারকা। শহরের ঘাড়ের উপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে পৎ পৎ করে উড়তে লাগল অলৌকিক কূপের লাল ঝাণ্ডা। গর্তের আশেপাশের পরিবেশে রাতারাতি অনেক কিছু সংস্কার সাধিত হলো। গর্তটিকে আরও গভীর এবং খোলসা করে পুননির্মাণ করা হলো। গর্তের পাড় আর ভেতরের দেওয়াল ঢেকে দেওয়া হলো লাল সালু কাপড়ে। গর্তের চারপাশ ঘিরে দেওয়া হলো কাল কাপড়ের বেষ্টনীতে। বেষ্টনীর দুই প্রান্তে নির্মিত হলো প্রবেশ এবং নির্গমনী দ্বার। চারপাশের খালি জমির পুরোটাই ঘিরে ফেলা হলো মুলি বাঁশের বেড়ায়। পেছনে দিকে স্থাপিত হলো অলৌকিক কূপ কতৃর্পক্ষের অফিস ঘর। কূপ এলাকার প্রবেশ পথের মুখে দু’পাশে বাসস্ট্যান্ডের ধাঁচে নির্মিত হলো টিকিট ঘর। রাস্তা পর্যন্ত বিছানো হলো লাল রংয়ের দীর্ঘ কার্পেট। এই লোহিত কার্পেট মারিয়ে দলে দলে দর্শনার্থীরা আসবেন অলৌকিক কূপ দর্শনে। দর্শনীর বিনিময়ে দর্শন।
একদিন সুরুজ্জামান সাহেব ঘুরতে ঘুরতে সেই জায়গাটিতে এসে পড়লেন। এসে দেখেন সে এক এলাহী কাণ্ড। দারুণ জমে গেছে অলৌকিক কূপের ব্যবসা! তার অছিলায় এত লোক এত পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে! অথচ তিনি তার কোনো ভাগ পাচ্ছেন না। মনে মনে লোভী হয়ে উঠলেন সুরুজ্জামান। এক সময় জগু শিকদারের সামনে গিয়ে চোটে পাটে বলেই ফেললে- এই কূপের সব রহস্য আমি জানি। এই কূপের আয়ের শেয়ার আমারেও তো কিছু দেওয়া লাগে ভাই!
জণ্ড শিকদার ঠাণ্ডা মাথায় সুরুজ্জামানের সব কথা শুনলো। তার পর বললো—
– এসব আলোচনা সাইটে বইসা হয় না মিয়া বাই। আমাদের হেড অফিসে আসেন। সেখানেই আপনার সাথে ভাগ বাঁটোয়ারার বিষয়ে আলোচনা হবে।
তারপর জগু শিকদার মোবাইলে কার সাথে যেন কিছু কথা সেরে নিল।
– শোন খাদেম বক্স। অলৌকিক কূপের পার্টনার হাজির অইছে। কূপের রহস্য নাকি সব তার জানা আছে। এই ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করতে চায়। হেড অফিসে আলোচনা হবে। পার্টিরে সাথে লইয়া আইতাছি। তুমি নথিপত্রের যোগাড় রাখ।
অনেক পথ ঘুরে জগু শিকদার সুরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে হাজির হল পুরানো ঢাকার ঘুপচি গলির একটি বাড়ির ভেতরে। সেখানে খাদেম বক্স ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। খাদেম নামক লোকটির গায়ের রং ঝিম কালো। তার পরণে শাদা লুঙ্গি আর গায়ে কাল ফতুয়া। তার মাথায় গুচ্ছের বাবড়ি চুল ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে আছে। সে সুপারী গাছের একটি সরু তক্তায় বালু ঢেলে এক মনে চাপাতিতে শান দিচ্ছে। তার পাশে আরও রাখা আছে একটি রাম দা ও একটি ভুজালী। ওগুলোতে শান দেওয়া হয়ে গেছে। লাইটের আলোয় চক চক করছে তাদের দুইপাশ। জগু শিকদার একগাল হেসে সুরুজ্জামান সাহেবের কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল,
– এই সব জিনিষের ব্যবহার আপনার জানা আছেনি মিয়া বাই ?
সুরুজ্জামান সাহেব সেই কথায় মনোযোগ না দিয়ে কিছুটা নির্বিকার কন্ঠে বললেন,
– এই সব জিনিসের ব্যবহার তো আমার জাইনা দরকার নাই। কামের কথা কন। গর্তের ব্যাপারে আলোচনা করেন।
সাথে সাথে ঝিম কাল লোকটি হুংকার ছেড়ে সুরুজ্জামান সাহেবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হকচকিয়ে যাওয়া সুরুজ্জামান সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি তার চুলের মুঠি চেপে ধরে হাতের চাপাতি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলতে উদ্যত হলো। মাথা ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে সুরুজ্জামান সাহেবের দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো।
— কর কী খাদেম বক্স ? একটু সবুর কর ! মিয়া বাইয়ের কল্লাডা অহনই কাইট্টালাইয়োনা !
জগু শিকদারের কথায় খাদেম বক্স বাধ্য ছেলের মত সুরুজ্জামান সাহেবের চুলের গোছা ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে এক মনে চাপাতি ধার দিতে থাকলো। একটু পর সুরুজ্জামান সাহেব চোখ মেলে চাইলেন। তার বুক গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঘন ঘন ঢোক গিলে সে শুকনো গলা ভেজাবার চেষ্টা করছে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। তিনি ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। ঘামে ভেসে যাচ্ছেন তিনি। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি বললেন,
– আমারে পানি দ্যান বাই। আমি মুতু করব।
– আর কত মুতু করবেন মিয়া বাই? কাপড় চোপড় তো ভাসাইয়া ফালাইছেন।
– আমি বাইত যামু।
– বাইত যাবেন? গর্তের রহস্য নিয়ে আলোচনা হবে না তাহলে?
– আমিকে মাফ কইরা দ্যান। আমি পানি খামু। আমি পেশাব করুম। অ বাইগো আমারে মাইর না গো। জীবনে আর কোনদিন ঐ গর্তের কাছে যামু না গো বাই রে!
– কথা দিলেন তো মিয়া ভাই? কথা না রাখলে কিন্তু মনে বড় কষ্ট পামু। আমরা ব্যবসা বাণিজ্যের লোক। খুন খারাবী বড় ঝামেলার কাম। দরকার না অইলে করি না।
– হ কথা দিলাম গো বাই।
– অ্যাই কুরবাইন্না! যা। মিয়া ভাইরে চোখ বাইন্দা নদীর পাড়ে রাইখা আয়।
জগু শিকদারের উর্বর মস্তিষ্ক বাণিজ্যিক বুদ্ধিতে ঠাসা। অলৌকিক কূপের ব্যবসার প্রসারের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমান্বয়ে সংযোজিত হয়েছে আনুষাঙ্গিক কিছু বাড়তি আকর্ষণ। একদিন তার হঠাৎ মনে পড়ল তার গ্রামের বাজারের ক্ষ্যাপা পাগলার কথা। ক্ষ্যাপা পাগলা বাজারের আর্বজনার স্তূপে পয়সা খুঁজে বেড়ায়। দোকানে দোকানে চেয়ে চিন্তে খায়। রাতের বেলা একটি শতচ্ছিন্ন নোংরা কম্বল মুড়ি দিয়ে এখানে সেখানে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। ক্ষ্যাপা পাগলার আসল নাম কেউ জানে না। কবে কোথা থেকে এসে এই বাজারে বসত গেড়েছিল সেই খবরও কেউ রাখে না। লম্বা লিকলিকে হাড্ডিসার দেহ। ময়লা চুল দাড়িতে ঢাকা মুখের ছিরি ভাল করে বুঝাও যায় না। থেকে থেকে সে বাজারের অলি গলি দিয়ে অকারণে দৌড়াদৌড়ি করে। মাঝে মাঝে দুচোখ উল্টিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে আপনে কোথায় আপনে কোথায় বলে চিৎকার করে। জগু শিকদার লোক পাঠিয়ে দিয়ে ক্ষ্যাপা পাগলাকে ধরে নিয়ে এলো অলৌকিক কূপ প্রকল্পে। পেটে নিয়মিত দানা পানি পড়ায় কিছুদিনের মধ্যেই তার চেহারায় একটা জেল্লা ভাব দেখা দিল। অলৌকিক কূপের একটি বিশেষ প্রদর্শনীর জন্য তৈরি করা হোল তাকে। ক্ষ্যাপা পাগলার প্রদর্শনীটা অনেকটা এই রকম। সুরমা শোভিত ড্যাবডেবে দুচোখে মায়াবী দৃষ্টি ছড়িয়ে সে কিছুক্ষণ গর্তটির দিকে চেয়ে বলতে থাকে,
– তিনি তো এসেই চলে গেছে রে। তোরা বদনছিব বেওকুফ কমবখতের দল! তোরা তাকে দেখতে পারলি না, চিনতে পারলি না! তোরা হুজুরের দিলে আঘাত দিয়ে ফিরিয়ে দিলি!
তারপর আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে,
– হুজুর আপনে আসেন। আমরা অগা মগা পাপী তাপী অবোধ নাবালেক। আমাগো লগে গোস্বা কইরা উপরে বইসা থাইকেন না হুজুর! আপনে গর্তের আরামে ফিরিয়া আসেন।
তারপর গর্তের পাশ দিয়ে চক্রাকারে দৌড়াতে দৌড়াতে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গিয়ে চোখ উল্টিয়ে নাক মুখ দিয়ে ফেনা গড়িয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে। সঙ্গে একদল খাদেম দৌড়ে এসে তাকে চ্যাংদোলা করে ভিতরে নিয়ে যায়। ভেতরে নিয়ে তাকে এক গ্লাস দুধ পান সহ কিঞ্চিত বিশ্রাম দেওয়া হয়। দর্শনার্থীদের ভিড় জমে উঠতেই খাদেমরা আবার তাগিদ দেয়,
– যান হুজুর। আপনের ডিউটির সময় অইয়া গেছে।
ক্ষ্যাপা বাবার এই রুটিন প্রদর্শনী দিনভর চলতে থাকে দফায় দফায়।
অলৌকিক কূপের আরেক আকর্ষণ একদল সাধু সন্ন্যাসীর সাধন ভজন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধু সন্তের আখড়া থেকে বেছে বেছে তাদের রিক্রুট করা হয়েছে। তারা সবাই গড়াপেটা শরীরের তাম্র বর্ণের মানুষ। তাদের স্কন্ধ অবধি লম্বিত ঝাঁকড়া কেশদাম। পরনে লাল সালুর জোব্বা। মাথায় ঝালর লাগানো উঁচু ফেজ টুপি। নাভি পর্যন্ত ঝুলানো বাদামী দাঁড়ি। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কব্জিতে লৌহ বালা। চোখে সুরমা। তারা সকলে গোল হয়ে বসে গঞ্জিকা সেবন যোগে সমস্বরে জিকির করেন। ভক্তরা তাদের ঘিরে রেখে শ্রদ্ধাভরে মুদিত আঁখিতে জিকির শ্রবণে বুঁদ হয়ে থাকে। কেউ কেউ করে নীরবে অশ্রু বিসর্জন। কেউ কেউ একে অপরকে ভক্তির আবেগে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাখে দীর্ঘ সময়।
সারাদেশে অলৌকিক কূপের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে। দূর দূরান্ত থেকে দলে দলে দর্শনাথীরা আসেন। সমাজের উঁচু তলার রাজনীতিবিদ আমলা ব্যবসায়ীরাও বাদ যান না। তাদের জন্য মজুদ থাকে বিশেষ ভিআইপি সেবার ব্যবস্থা। জগু সিকদাররা অলৌকিক কূপের জমির মালিক ইউসুফ মৃধার সাথে একটা স্বল্প মূল্যের রফা করে নিয়েছিল। শুরুতে অবশ্য ইউসুফ মৃধা খুব লম্ফঝম্ফ করেছিলেন। জমি লীজ দিতে রাজি ছিলেন না। মামলা মোকদ্দমার ভয় দেখিয়েছিলেন। অতঃপর এক সন্ধ্যায় জগু শিকদারদের হেড অফিস ঘুরে আসার পর তিনি এ ব্যাপারে আর কোনো ওজর আপত্তি করেন নি।
কালে কালে অলৌকিক কূপ প্রকল্প এক লাভজনক তীর্থ বিশেষে পরিণত হয়েছে। হাত বদলের পালাক্রমে এখন তা প্রবল প্রতাপী মধ্যরাতের ঘোড় সওয়ারীদের দখলে। জগু শিকদাররা সেই কবে বিদায় নিয়েছে সেই ইতিহাস কেউ জানে না। অলৌকিক কূপের প্রধান আকর্ষণ ক্ষ্যাপা পাগলা শেষের দিকে লাগাতার প্রদর্শনের তোড়ে অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। চোখ উল্টিয়ে আকাশের দিকে হাত পা ছুঁড়ে উচ্চগ্রামে চিৎকার করার খেলাটা তিনি খুব সুন্দর রপ্ত করেছিলেন। একদিন দীর্ঘক্ষণ চক্রাকারে দৌড়াদৌড়ির সময় ভিরমি খেয়ে অলৌকিক কূপের পার্শ্বের একটি ইটের পাজার সাথে ঠোক্কর লেগে তার মাথা ফেটে যায়। অত্যধিক রক্তক্ষরণের ফলে ঘটনাস্থলেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ক্ষ্যাপা পাগলার পতনের স্থানটির লাগোয়া জায়গাটিতেই তাকে সমাহিত করা হয়। ক্ষ্যাপা পাগলার আত্মোৎসর্গের এই ঘটনা অলৌকিক কূপকে আরও প্রখ্যাত ও মহিমান্বিত করে তোলে। তাহার কবরখানি কালক্রমে ক্ষ্যাপা পাগলার মাজার নামে সবিশেষ খ্যাতি লাভ করে।