Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

নতুন বাসস্থান

শফি ভাবছিল, কে রোজি আর কে রুকু, সেটা আয়মনি চিনতে পারে কী ভাবে? দুজনের পরনে একই রঙের তাঁতের শাড়ি এবং তারা জামাও পরেছে একই রঙের। স্নান করে ওদের মুখের রঙে চেকনাই ফুটেছে বলেও নয়, দুই বোনের গায়ের রঙ ফরসা। সাইদা বেগমের মতো ফ্যাকাসে ফরসা নয়, একটু লালচে। চাষীবাড়ির মেয়েদের গায়ে কখনও জামা দ্যাখেনি শফি। তা ছাড়া চাষীবাড়ির মেয়েদের গলার স্বরের সেই রুক্ষতাটাও রোজ-রুকুর গলার স্বরে নেই। শফির সন্দেহ জাগছিল এতক্ষণে, এরা নিশ্চয় মিয়াঁবাড়ির মেয়ে।

কিন্তু মিয়াঁবাড়ির শাড়ি পরা মেয়েরা দীঘির ঘাটে স্নান করতে বা জল আনে যাবে, এটাও ভাবা যায় না। শফি ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল।

এদিকে রুকু অনর্গল কথা বলছিল। সে জানতে চাইছিল কিছু। আয়মনি ভাত খেয়ে রোজিকে নিয়ে এ বারান্দায় এলে শফির আড়ষ্টতা কেটে গেল। আর সেই সময় রুকু আয়মনিকে বলল, তোমাদের পিরসায়েবের ছেলে বোবা, আয়মনির খালা! রুকু হাসতে লাগল। একটা কথারও জবাব দেয় না। খালি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে যে!

আয়মনি বারান্দার মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসে পানের বাটা থেকে পান সাজতে থাকল। আর ঠোঁটের কোনায় চাপা হাসি। রোজি বুকুর পাশে বসে বলল, পির সায়েবের ছেলে আমাদের ওপর রেগে কাঁই হয়ে আছে।

আয়মনি বলল, ক্যানে? তখন ঘাটে সেই ছড়াটা বলেছিলাম। ‘ফরাজিদের নামাজ পড়া/টেঁকির মতন..’

রুকু রোজির মুখ চেপে ধরে বলল, বড্ড বেহায়া তুই! আবার কেন রাগাচ্ছিস ওকে?

আয়মনি সন্দিগ্ধদৃষ্টে তাকালে শফি এতক্ষণে একটু হাসল। আস্তে বলল, এবার কিন্তু তোমাদেরই টেকির মতন মাথা নাড়তে হবে। আব্বার পাল্লায় পড়েছ, দেখবে কী হয়?

রুকু দ্রুত বলল, কী হবে বলো তো?

রোজি বলল, আমি বলছি শোন্ না। আর কেউ বেরুতে পারব না বাড়ি থেকে। সবচেয়ে বিপদ হবে আয়মনির খালার।

আয়মনি পান গালে ঢুকিয়ে বলল, আমার কিছু হবে না। তোমরা নিজেদেরটা সামলে চলো। এই যে হুট করতেই দুজনে বেরিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়াও, বড়োবাড়ির মেয়ে সব– বিয়ে দিলে অ্যাদ্দিন ছেলেপুলের মা হয়ে যেতে? সে কপট ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে চোখ পাকিয়ে ফের বলল, তোমাদের পায়ে বেড়ি পরাতে। বলছি দরিবুবুকে। থামো একটু!

রুকু ঠোঁট বাঁকা করে বলল, ইশ! অত সোজা! আমি ফরাজি হবোই না!

রোজি বলল, শুনলি না? সন্ধ্যাবেলা আমাদের বাড়ি আসবেন পিরসায়েব। সব মেয়েকে তওবা করাবেন।

তার মানে? রুকু হকচকিয়ে গেল। সে শফির দিকে ঘুরল। এই ছেলেটা, বলো না তওবা জিনিসটা কী?

ব্যাপারটা আয়মনি বুঝিয়ে দিল। সে তার শ্বশুরগাঁয়ে একবার মেয়েদের তওবা অনুষ্ঠান দেখেছিল। পর্দার আড়ালে মেয়েরা মৌলবিসায়েবের পাগড়ির ডগাটা ধরে রেখেছিল। মৌলবিসায়েব একবার করে একটা কথা আওড়াচ্ছিলেন আর মেয়েরাও চাপা গলায় সেটা আওড়ে যাচ্ছিল। তবে সে মৌলবিসায়েব হানাফি মজহাবের। ফরাজি মজহাবে কী হয়, আয়মনির জানা নেই। আয়মনি গল্পটা খুব রসিয়ে বর্ণনা করে শফিকে বলল তোমাদের মজহাবে কী হয় বলো না ভাই?

শফি বলল, একইরকম।

রোজি বলল, পিরসায়েব মেয়েদের মুখ চিনে রাখেন না?

শফি অবাক হয়ে বলল, না তে।

বা রে! মেয়েদের তওবা করিয়ে জনে-জনে ডেকে মুখ চিনে রাখবেন, তবে তো রোজ কেয়ামতের পর হাশরের ময়দানে পিরসায়েব ওদের মুরিদ বলে চিনতে পারবেন! তখন আল্লাকে আর নবিসায়েবকে বলবেন, এদের দোজখে নিয়ে যাবেন না যেন। এরা আমার মুরিদ।

শফি হাসল।…বাজে কথা। আব্বা শুনলে খেপে যাবেন।

কেন? তোমার আব্বাও তো পিরসায়েব।

রুকু রোজির কথার ওপর বলল, খয়রাডাঙার পিরের থান ভেঙেছেন। পির কখনও পিরের থান ভাঙে?

রোজি অবিশ্বাসে মুখ বাঁকা করে বলল, বাজে কথা! হাত ঝলসে যাবে না থানে হাত দিলে?

শফি বলল, আব্বার হাত ঝলসায়নি।

আয়মনি কৌতুক করে বলল, মসজিদের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে এসো না হাতখানা।

রোজি কথায় না করে বলল, এই তো হাটতলার কাছে খোঁড়াপিরের থান আছে। একবার হাত দিয়ে দেখুক না কেউ। কাজিসায়েবের কী হয়েছিল মনে নেই? থান থেকে লুকিয়ে পয়সা তুলতে গিয়েছিল, বাস! একটা হাত নেতিয়ে গেল।

শফি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি থানে হাত দেব, চলো। দেখবে,আমার কিছু হবে না।

রোজি তার স্পর্ধা দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। রুকু একটু হেসে বলল, তোমার কেন হবে? তুমি যে পিরসয়েবের ছেলে।

শফির গর্ববোধটা ফুটে উঠল। রুকুকে তা ভালো লাগছিল। এসেই বলেছে, তুমি কি রাগ করেছিলে– তখনই শফির তাকে ভালো লাগার শুরু। তার মনে মাঝে মাঝে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই কথাটা। এখন আবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। রুকুকে দীঘির ঘাটে তেজী মেয়ে মনে হয়েছিল। অথচ আসলে শান্ত, বুদ্ধিমতীও। শফি বসে পড়ল আবার।

কিন্তু নিজের স্মৃতি ও ধারণার সঙ্গে এই অভিজ্ঞতাটা সে মেলাতে পারছিল না। অনাত্মীয় মেয়েদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ তার কখনও হয়নি। সবখানে মৌলানা বদিউজ্জামানের ছেলে হিসেবে সে যেন একটা পর্দার অন্যপাশে থেকেছে। মৌলাহাটে ব্যাপারটা যেন অন্যরকম। এখানকার মেয়েরা বাইরে চলাফেরা করে, সেটা নতুন কিছু নয় তার কাছে। কিন্তু তার সঙ্গে মুখোমুখি মেয়েরা বসে কথা বলবে, তর্ক করবে, এটা বড্ড বেশি নতুন।

রোজি গুম হয়ে বসে ছিল। একটু পরে হঠাৎ উঠে চলে গেল। রুকু তাকে ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে ডাকছিল। কিন্তু রোজি ফিরল না দেখে সে মুখটা একটু করুণ করে বলল, চলি আয়মনিখালা। তারপর শফির দিকে ঘুরে একটু হেসে বলল, চলি। রাতে আমাদের বাড়ি খেতে যাবে, তখন দেখা হবে।

আয়মনি বলল, জেয়াফৎ নাকি রে রুকু?

রুকু মাথাটা সামান্য দুলিয়ে চলে গেল। শফির মনে হল একটা আশ্চর্য আর সুন্দর স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ। হঠাৎ সেটা ভেঙে গেল যেন। বাড়িটা একেবারে শূন্য আর আগের মতো রুক্ষ হয়ে পড়ল।

আয়মনি বলল, ‘যামা বোন তো! দুঘড়ি আগে-পরে জন্মো। আগে রোজি, তারপর রুকু। তাই একলা-একলা কেউ থাকতে পারে না। ওই যে রোজি বেরিয়ে গেল –তুমি ভাবছ, সে চলে গেছে? কক্ষনো না। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কোথায়। রুকু যাবে, তবে তার সোয়াস্তি। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না।

শফি আনমনে বলল, ওরা কি মিয়াঁবাড়ির মেয়ে?

তুমি ঠিকই ধরেছ। আয়মনি হাসতে লাগল। তবে দো-আঁশলাও বলতে পারো।

দো-আঁশলা মানে?

আয়মনি চাপাস্বরে বলল, ওদের বাপ ছিল মিয়াঁসাহেব। ম আমার মতো চাষীবাড়ির মেয়ে। নানগাঁ-কনকপুরে বাড়ি। সেখানে ইস্কুল আছে। সেই ইস্কুলে পড়তে গিয়েছিল চৌধুরির ছেলে। পড়াটড়া ফেলে দরিবুবুকে নিয়ে চলে এসেছিল। সে অনেক খিটকেলের কথা। আমার তখন বয়স কম। সব কথা মনে নাইকো । তাছাড়া তোমাকে বলিই বা কী করে?

শফি একটু চুপ করে থেকে বলল, ওরা বুঝি বড়লোক?

তা বলতে পারো। মৌলাহাটের মিয়াঁ বলতে ওই দুঘর। চৌধুরিসায়েবরা আর। কাজিসায়েবরা। কাজিরা ফতুর হয়ে গেছে। চৌধুরিরাও যেত। দরিবুবু চাষীর মেয়ে। মাটি চেনে কিনা। মাটির মর্ম বোঝে। দুহাতে আগলে রেখেছে।

রোজি-রুকুর আব্বা বেঁচে নেই?

না। আয়মনি পানের পিক ফেলে এসে বলল, ওরা এ তল্লাটের সেরা বড়লোক ছিল। বাপজির কাছে শুনেছি, মৌলাহাটের যে বানুক আছে –মানে রেশমের কুঠি, তা জানো তো? সেই বানুকের মালিক ছিল ওরা। জোলাদের দাদন দিত। আবার তাঁতও বসিয়েছিল। একশো তাঁত –সহজ কথা নয়কো । তুমি একবার ভেবে দ্যাখো ভাই, দিনরাত একশো তাঁতের একশো মাকু চলছে খটাখট…. খটাখট…. খটাখট।

আয়মনি তাঁদের মাকু চালানোর ভঙ্গি করল। তবে সে সেইসব মাকুর শব্দও শোনেনি নিজের কানে। তখন তার জন্মও হয়নি। চৌধুরিদের রেশমের কারবার কীভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তখন মাঠের জমিজমাই ভরসা। রোজি-রুকুর বাবা তোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরি ছিলেন খরুচে আর শৌখিন মানুষ। বাউরিপাড়ায় গোপনে গিয়ে তাড়ি-মদ গিলতেন। দরিয়াবানু ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে আসত প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে। দুই বোনের জন্মের পর কে জানে কেন একটু শায়েস্তা হয়েছিলেন তোফা চৌধুরি। মসজিদের কাছে আবু ওস্তাজি নামে একটা ভবঘুরে লোক এসে মক্তব খুলেছিল। তার কাছেই দুই মেয়েকে পড়তে দিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ ওস্তাজি রাতারাতি কোথায় উধাও হয়ে যায়। আয়মনির মতে, আসলে ওস্তাজি লোকটা ছিল এক সাধক পুরুষ। কোন ছলে মৌলাহাটে চরতে এসেছিল আর কী!

আয়মনি মৌলাহাটের গল্প বলছিল। আর শফি ভাবছিল, মৌলাহাটে যদি তাদের থাকা হয়, তার ভালো লাগবে। কিন্তু আব্বাকে সে ভালোই জানে। যেখানে-সেখানে উনি ডেরা পাততে চাইবেন কি? সেকেড্ডায় যাব বলে সংসার নিয়ে রওনা নিয়েছেন। যতক্ষণ না সেখানে পৌঁছান, ততক্ষণ তার শান্তি থাকবে না।

গল্প করতে করতে আয়মনি মাঝেমাঝে উঠে যাচ্ছিল। মুরগিগুলোকে বিকেলের দানা খাইয়ে আসছিল। উঠোনে শুকোতে দেওয়া কাপড় তুলে আনছিল। শফি বুঝতে পারছিল, খুব কাজের মেয়ে এই আয়মনি। একবার শফিকে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল। তারপর ফিরে এল কচি বটের ডাল নিয়ে । ছাগলটাকে খেতে দিল। আদর করল। ছগলটা কবে বিয়োবে, সেই হিসেব সে করে রেখেছে। তাই শুনে শফি তার মায়ের প্রিয় ছাগল কুলসুম আর গাইগোরু মুন্নির কথা তুলল।

আয়মনি দীঘির ঘাটে মুন্নি ও কুলসুমকে লক্ষ করেছিল। বলল, বাপজি যখন গেছে, তখন কোনো চিন্তা নাইকো। এতক্ষণ ওরাও খেয়েদেয়ে পেট ঢোল করেছে। মৌলাহাটে এয়ে পড়েছে। আর ওদের খাওযার অভাব হবে না। ক্যান জানো তো?

শফি জানে না।

আয়মনি চোখে ঝিলিক তুলে বলল, দীঘি। দীঘির চড়ায় ঘাসের অভাব নাইকো। আর ওই নদী। নদীর দুধারেও কত ঘাস। বাছারা খাবে-দাবে। চিতা কোরো না।

শফি হাসল।…আমরা তো সেকেড়া যাব।

আয়মনি ভুরু কুঁচকে বলল, সেকেচ্ছা? সেখানে ক্যানে গো?

আমি জানি না কিছু। আব্বা জানেন।

যাওয়াচ্ছে! আয়মনি বলল। তোমাদের আব্বাকে গাঁওলা আটকে দিয়েছে। রোজি বলে গেল না? ওমরের বাড়িটা খালি পড়ে আছে। সেই বাড়িতে তোমরা থাকবে। তারপর জায়গা-জমি দিয়ে ঘর বানিয়ে দেবে।….

.

স্তম্ভ ও এক নারী

তখন মৌলাহাটের মসজিদের ভেতর সেইসব কথাবার্তাই হচ্ছিল। মৌলানা বদিউজ্জামানের মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব শোনার জন্য দম বন্ধ করে বসে ছিল লোকেরা। আর মৌলানা বলেছিলেন, আশরের বৈকালিক) নামাজ পড়ে নিই। তারপর বলছি।

নমাজ পড়ে শেষ হলেও জবাব দেননি বদিউজ্জামান। কেউ-কেউ কেঁদে ফেলেছিল হুজুরের ভাবগতিক দেখে। এমন প্রশান্ত, দিব্য অথচ এমন উদাসীন, কঠিন মুখ তারা কখনও দ্যাখেনি। মৌলাহাটে অনেক মৌলবি-মৌলানা এসেছেন। তাঁদের হাতে দফায়-দফায় তওবা করে তারা মুরিদ (শিষ্য) হয়েছে। কিন্তু পাকাপাকিভাবে চিরজীবন মুরিদ হয়ে থাকার মতো গুরু তারা পায়নি। সব গুরুর আগমন ঘটে শীতের ধান ওঠার পর। গাড়ি ভরতি ধান আর পয়সা-কড়ি নিয়ে তাঁরা চলে যান। শিষ্যরা টের পায়, যেন ধানের জন্য ওইসব গুরুর আগমন। দৈবাৎ বেমরশুমে যে কেউ না এসেছেন, এমন নয়। কিন্তু তিনিও অভাবী গুরু। পয়সাকড়ি নিতেই আসা। তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়নি কোনও দিব্যছটা ওখানে ঝিলিক তুলেছে। অথচ বদুপিরের মুখে যেন ঝলমল করছে দূর আসমান থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি। ঈষৎ গম্ভীর ওই মুখে যখনই মৃদু হাসি দেখা যাচ্ছে, তখনই বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে –কী এক মোজেজার (দিব্যশক্তির) নিদর্শন মনে হয়।

আশরের নমাজের পর হজুর বলেছিলেন, মগরেবের (সন্ধ্যা) নামাজের পর যা বলার বলবেন। তারপর মসজিদ থেকে প্রাঙ্গণে বেরিয়ে এসেছিলেন। হাতে ময়ূরমুখো কাঠের ছড়িটি ধরা। খয়রাডাঙার অসিমুদ্দিনকে মৃদুস্বরে কিছু বলেছিলেন। অসিমুদ্দিন সেই বার্তাটি ঘোষণার জন্য প্রাঙ্গণের ইঁদারার ধারে একটুকরো পাথরে উঠে দাঁড়িয়েছিল।….মৌলাহাটের মোমিন-মোছলমান ভাইসকল! হুজুরকে এবার আপনারা একলা থাকতে দিন। আর হুজুর বলেছেন কী একবার সেই পিরের সাঁকোয় যাবেন– ওনার ইচ্ছে হয়েছে। মেহেরবানি করে কেউ যেন ওনাকে বিরক্ত করবেন না। আপনারা মগরেবের সময় আবার মসজিদে আসুন।

তারপর মৌলানা বদিউজ্জামানকে একা বাদশাহি সড়ক ধরে হেঁটে যেতে দেখা গয়েছিল। চৈত্রের উষর মাঠে শেষ বিকেলের রোদে কালো হয়ে দাঁড়িয়েছিল কয়েকটা প্রাচীন স্তম্ভ। স্তম্ভগুলো পাথরে তৈরি। নদী একটু তফাতে সরে গেছে। পাথরের স্তম্ভগুলো বালির চড়ায় কিছুটা ডুবে রয়েছে। সড়কও তফাতে সরে গেছে। বদিউজ্জামান সড়ক থেকে নেমে স্তম্ভগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। গ্রাম থেকে অনেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে ব্যাপারটা দেখছিল। তারা আশা করেছিল অলৌকিক কিছু ঘটতে চলেছে, তাই দেখে তাদের জীবন ধন্য হবে এবং বংশপরম্পরা সেই কাহিনী চালু হয়ে যাবে। অসিমুদ্দিনও মসজিদের প্রাঙ্গণের পাঁচিলে ভর করে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল।

আসলে বদিউজ্জামান নির্জনে একবার ভেবে দেখতে চেয়েছিলেন, কী করবেন। মৌলাহাটে থাকবেন, নাকি সেকেচ্ছা চলে যাবেন। প্রথম-প্রথম এমন উদ্দাম খাতির সবাই করে থাকে। তারপর থিতিয়ে আসে সব উচ্ছ্বাস। তার চেয়ে বড়ো কথা, মৌলাহাটের হালচাল তিনি কিছুটা জানতেনও। এখানকার মেয়েরা নাকি বড্ড বেশি স্বাধীনচেতা। ফৈজু মৌলবি তাঁকে মৌলাহাটের কথা বলেছিলেন একবার। তিনি নাকি একবেলা থেকেই চলে গিয়েছিলেন ব্যাপার-স্যাপার দেখে। ফৈজুদ্দিন হানাফি মজহাবের মৌলবি। তাঁর বেলা যদি এই হয়, বদিউজ্জামানের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে? ফৈজুদ্দিন বলেছিলেন, মেয়েগুলান বড়ই বেহায়া ভাইসাব! বে-আবরু হয়ে গোসল করে। মৌলবি-মৌলানাদের নিয়ে ছড়া বাঁধে। এমন ঠাই ভূভারতে নেই।

বালির চড়ায় পাথরের স্তম্ভগুলোর কাছে গিয়ে বদিউজ্জামান থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। একটা স্তম্ভের গোড়ায় ঝুঁকে একটি মেয়ে কিছু করছিল। সে তাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার ভিজে চুল, পরনের শাড়িও ভিজে। নদীতে স্নান করে এসে পিরের সাঁকোয় মানত করছিল। বদিউজ্জামান ব্যাপারটা দেখামাত্র খাপ্পা হয়েছিলেন। গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন, কে তুমি? এখানে এসব কী করছ?

মেয়েটি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিল, মানত দিচ্ছি।

তুমি কোথায় থাকো? কী নাম?

ক্যানে? নামে আপনার কী দরকার?

তুমি মুসলমান, না হিন্দু?

মেয়েটি বেজায় তেজী। বলেছিল, যাই হই, তাতে আপনার কী?

বদিউজ্জামান তার স্পর্ধায় অবাক। দেখলেন, সে স্তম্ভের গোড়ায় একটা পিদিম জ্বেলে দিল। কয়েকটা খুদে মাটির ঘোড়া রাখল। তারপর মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। তার প্রণামের ভঙ্গি দেখে বদিউজ্জামানের মনে হল, মেয়েটি নিশ্চয় হিন্দু। তাই আর তার সঙ্গে কথা বললেন না। অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

প্রণাম শেষ করে মেয়েটি আবার নদীর দিকে গেল। নদীতে তত জল নেই। বালির চড়ার মধ্যে একহাঁটু জল বয়ে যাচ্ছে। সেই জলে সে পা ছড়িয়ে বসে আপন মনে জল নিয়ে খেলতে থাকল। মেয়েটির বয়স কুড়ি-বাইশের মধ্যে। তার সিঁথিতে সিঁদুর নেই দেখে মৌলনা বদিউজ্জামান তাকে অবিবাহিতা ভাবলেন। একটু পরে সে তার পাশ দিয়ে চলে গেলে তিনি লক্ষ্য করলেন, মৌলাহাটের দিকেই চলেছে। মৌলাহাটে কি হিন্দু আছে?

সে বাদশাহি সড়কে পৌছুঁলে বদিউজ্জামান সেই স্তম্ভটার কাছে গেলেন। চটিজুতোর ডগা দিয়ে জ্বলন্ত পিদিমটা উলটে দিলেন। মাটির ঘোড়াগুলোকে যথেচ্ছ লাথি মারলেন। তারপর স্তম্ভের গায়ে সিঁদুরের ছোপ চোখে পড়ল। সেখানে জুতো ঘষে তবে তাঁর রাগ পড়ল। স্তম্ভটা ভেঙে ফেলার কথা ভাবতে ভাবতে গ্রামের দিকে পা বাড়ালেন বদিউজ্জামান।

তখন তিনি মৌলাহাটে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে স্থির। মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছলে অসিমুদ্দিন এবং আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা করল। বদিউজ্জামান মৃদুস্বরে মৌলাহাটের একজনকে জিগ্যেস করলেন, ওই সাঁকোর থামে হিন্দুরা পুজো করে নাকি?

জি, মোছলমানেরাও মানত-টানত করে।

একটু আগে একজন জেনানকে দেখলাম পুজো করছে। এ গায়ে হিন্দু আছে নাকি?

জি হুজুর, কয়েকঘর বাউরি আছে। বাদবাকি সব মোছলমান।

অন্য একজন একটু হেসে বলল, একটু আগে ভিজে কাপড়ে গেল তো? হুজুর, ও হল আবদুলের বউ।

স্তম্ভিত বদিউজ্জামান বললেন, কী?

জি হুজুর। খুব হারামজাদি মেয়ে। বড়-ছোটো মানে না। এমন ওর তেজ।

আবদুল কোথায়? ডাকো তাকে।

অপর একজন বলল, আবদুল হুজুর চলাফেরা করতে পারে না। কুবরাগী।

কাজিবাড়ির বড় কাজিসায়েব সন্ধ্যার নামাজে আসছিলেন। তাঁকে দেখে এগিয়ে গেলেন বদিউজ্জামান। মৌলাহাটের প্রধান মুরুব্বি বলতে তিনিই। পিরের সাঁকোর ব্যাপারটা তাঁর কাছেই তুলবেন মৌলানা।….

.

আকস্মিক বার্তা

সে রাতে রোজি-রুকুদের বাড়ি শফি যখন খেতে এসেছে, সাইদা বেগম বললেন, কোথায় ছিলি রে তুই? কতবার কতজনকে খবর পাঠালাম।

জবাব রুকু দিল।….ও তো আয়মনি খালার বাড়িতে ছিল। আমরা আবার গিয়ে ডেকে নিয়ে এলাম।

আয়মনি? সে কে?

কাসেমের বেটি। জানেন আম্মা? আয়মনি খালা স্বামীর বাড়ি–

রোজির চিমটি খেয়ে চুপ করে গেল বুকু। রোজি ফিসফিস করে বলল, এসেছে। আম্মার কাছে গল্প করছে।

দরিয়াবানু ওরফে দরিবিবি ডাকছিলেন মেয়েদের। দুজনে চলে গেলে সাইদা ছেলের পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করলেন, দুপুরে খেলি কোথায়?

আয়মনিখালার বাড়িতে।

হাসলেন সাইদা।…খালা পাতিয়ে ফেলেছিস এরি মধ্যে?

শফি আস্তে বলল, আব্বা কী ঠিক করলেন জানেন আম্মা?

মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে-খুঁটতে সাইদা বললেন, সেকেচ্ছা যাওয়া হবে না। দরি-আপা বলছিল, মসজিদে মগরেবের নমাজের সময় কথা হয়েছে। একটা খালি বাড়ি আছে নাকি।

দুইবোন তাপোশে খাওয়ার জন্য দস্তরখান নিয়ে এল। বিছিয়ে দিয়ে চলে গেলে সাইদা চাপা স্বরে বললেন, নুরুর বাড়ি আসার কথা ছিল। খয়রাডাঙায় গেলে দেখবে আমরা চলে এসেছি। ও যদি সেকেড্ডা চলে যায়, হয়রান হবে!

শফি বলল,বড় ভাই আসবে নাকি?

আসবে। তুই জানিস না?

আমাকে বলেছ? বলো কোনো কথা?

সাইদা ছেলেকে একটু টেনে আদর দিতে-দিতে বললেন, ওদিন নকি মৌলবি এলেন দেওবন্দ শরিফ থেকে। ওনার হাতে খত ভেজেছিল নুরু। দেওবন্দ কি। এখানে? রেলগাড়ি, স্টিমার, তারপর ঘোড়ার গাড়ি। দশটা দিনের রাস্তা। তবে এবার নুরু এলে আর ওকে যেতে দেব না। তোর আব্বা যা করেন, করবেন।

আয়মনি এল। মুখ টিপে হেসে বলল, বিবিজি, সালাম! আপনার ছেলে বড় লক্ষি । কতকথা হল সারাবেলা। মনে হয় যেন কতকালের মায়ের পেটের ভাই। তো বলে কী, আম্মাও রোজি-রুকুর মতো তোমাকে খালা (মাসি) বলব। বেশ, তাই বলল– মন যদি চায়।

সাইদা আয়মনিকে দেখছিলেন। একটু পরে বললেন, খোকা-খুকু কটা গো মেয়ে?

জি? খোকাখুকু? আয়মনি মুখে আঁচল চাপা দিল হাসির চোটে।

রোজি-রুকু খাঞ্চা বোঝাই করে পোলাওয়ের থালা, কোর্মার বাটি এনে রাখল। রুকুর কানে কথাটা গিয়েছিল। বলল, আয়মনিখালার খোকা-খুকু কিছু নেই জানেন আম্মা? কেন নেই ওকে জিগ্যেস করুন না।

সাইদা জিগ্যেস করলেন, কেন গো মেয়ে?

আয়মনির মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল। মুখে হাসি এনে বলল, সেসব দুঃখের কথা একদিন বলব বিবিজি। ছেলের সামনে ওসব কথা থাক। রোজি-রুকু, বড্ড বেশরম পু তোমরা।

দুই বোন ওকে ভেংচি কেটে চলে গেল। শফি উজ্জ্বল মুখে বলল, খালা! আমরা সত্যি তোমাদের গায়ে থেকে গেলাম, জানো?

থাকবে বৈকি! তুমি এত ভালো ছেলে! তোমাকে কি যেতে দিতাম ভাবছ? সাইদা একটু হেসে বললেন, কে ভালো ছেলে? শফি? চেনো না তো৷ দেখবে।

শফি ঘাড় গোঁজ করে খেতে থাকল। সাইদা আয়মনিকে তার দুষ্টুমির কথা বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে মসজিদ থেকে খবর এল, মৌলানা বদিউজ্জামান আজ রাতে মসজিদেই থাকবেন।

খবরটা শুনেই সাইদা চমকে উঠলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress