Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অলক ঘরে ফেরেনি || Prabir Chowdhury

অলক ঘরে ফেরেনি || Prabir Chowdhury

অলোক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মরণপণ বাজির খেলা দেখিয়ে আর রোজগার করবে না। আগে কিন্তু খুব আত্মবল ও আত্মবিশ্বাসের সাথেই এই দুঃসাহসিক খেলা দেখাত সে ।এমন একটা সময় এসেছিল অলোকের ওস্তাদ পর্যন্ত সাবাসি দিতেন। শেষে অলোককেই এই খেলার দায়িত্ব দিয়ে তিনি অন্য হাত সাফাইয়ের খেলা দেখাতেন। অলোকের এই অবাক করা খেলা দেখে দর্শকরা এতো রোমাঞ্চিত হতেন টাকা -পয়সায় মেঝেতে পাতা চট ভরে যেত , তুলে তুলে হাত ব্যাথা হয়ে যেত লক্ষীর।
অলক অম্লান বদনে মোটা বাঁশ ধরে তরতর উঠে যেত শক্ত বাঁশের মাথায়, তারপর গলায় মোটা পাটের দড়িটার ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তো। দর্শকরা শিউরে উঠতো ভয়ে,বিহ্বলতায়। সবার চোখ বড়,বড় হয়ে যেত আতংকে। মিনিট পাঁচেক পর নিজেই ফাঁস খুলে দড়ি হাতে নেমে আসতো দড়ি হাতে হাসতে ,হাসতে। অলোকের এই তাজ্জ্যব খেলা দেখে অনেক সার্কাস কোম্পানি থেকেও ডাকও এসেছিল তার কিন্তু লক্ষীর করুন আবেদনে আর পিতৃতুল্য ওস্তাদের কথা ভেবে ওদের ছেড়ে যেতে পারিনি সে। লক্ষী ওস্তাদের একমাত্র ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে যাকে অলক নিজের প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো।, ওস্তাদও জানতো তাদের ভালোবাসার কথা তাই একদিন আনন্দ করেই ওদের চারহাত একসঙ্গে করে দিয়েছিলেন।
বিয়ের পরপরই অভিশাপের মতো ঝড় উঠলো ওদের নতুন সংসারে।। দমকা বাতাসে লন্ডভন্ড হয়ে গেল জীবন- যাপন । কেমন যেন বোবা আর্তনাদে ওদের দিশাহারা অবস্থা। মা-বাবা মরা অনাথ অলোককে নিজের ছেলের মতো করেই বড় করেছিলেন ওস্তাদ নিজের কাছে রেখে। খালপারের বস্তির দেড়খানা ঘরেই থাকতো তিনটে প্রাণী পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে । বেশ কিন্তু সুখেই দিন কাটছিল ওদের হেসে-খেলে আজ এখানে কাল ওখানে মাদারির খেলা দেখিয়ে দেখিয়ে বানজারার মতোন । হটাৎ মাত্র কয়েকদিনের জ্বরেই ওস্তাদ ওদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
দুটো মানুষের মাথার উপরের বটগাছটি যেন অকালেই কাল বৈশাখীর প্রচন্ড ঝরে ভেঙে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। লক্ষী আর অলক সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো দুচোখে। কি ভীষণ অসহায় ।নিঃস্বতা,রিক্ততা দুটি মনকে দলে ,পিষে একাকার করতে লাগলো। নব দাম্পত্য জীবনের অজানা নতুন পথে চলতে,কিংকর্তব্যবিমূঢ়,দিশাহারা,শঙ্কিত অবস্থা ।
বেশ কিছুদিন লাগলো অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে। ক্রমেই সাহসে ভর করে একদিন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বেড়িয়ে পড়লো। পাড়ায়, পাড়ায় খেলা দেখিয়ে সামান্য রোজগারে দিনাতিপাত করতে শুরু করলো। বছর খানেক কেটে গেল অবস্থার বেশি উন্নতি হলো না। খাওয়াপড়া জুটে যায় কিন্তু স্বচ্ছলতা আসলো না।
কালের নিয়মে লক্ষী গর্ভবতী হলো। দশমাস, দশদিন পর এক সকালে লক্ষী প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেলো নিজ সন্তানের মুখে আপন বুকের অমৃতসমান স্তনদুগ্ধ পান করিয়ে। মনের আনন্দে, নতুন জীবনের আলোকে পিতৃত্বের স্বাদ বুকে নিয়ে অলক একা একাই বেরিয়ে পড়ল নব উৎসাহে খেলা দেখাতে । সন্তানবুকে নিয়ে বাইশ বছরের মা-লক্ষী ঘর গৃহিস্থলী সামলায়।স্বপ্ন আঁকে নিজের দুচোখে।
অলোকের ছেলেটা হওয়ার পর থেকেই একটু একটু পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ছেলেটার যখন আড়াই বছর বয়স তখন আমূল বদলে গেল ।সঙ্গের ছেলেটারও চোখেও পড়েছে ব্যাপারটা আজকাল তার গা-হাত- কাঁপতে থাকে খেলা দেখাবার সময়। খেলা দেখানোর সময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বারবার কচি ছেলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। খেলায় ভুল হয়ে যায়। সঙ্গী ছেলেটা চিৎকার করে সাবধান করে। বাড়ি থাকলে সারাদিনে শিশুটা কত কথা বলে বড়-বড় দুটি চোখ মেলে,ছোট, ছোট হাতে গলা জড়িয়ে ধরে ছেলেটা । কত আবদার করে – বাবা হামি দাও,বাবা বেরু নিয়ে চলো।লক্ষী একটা শ্লেট-পেন্সিল কিনে দিয়েছে সারাদিন ধরে মনের ইচ্ছা মতো আঁক টানে আর আপন মনে বক বক করে পড়ে।এই কাক যা যা। বক মামা টি দিয়ে যা। বাবা লজেন কিনে দেবে ? আমি মাছ দিয়ে ভাত খাবো,কাউকে দেবো না। শুধু আমার বাবা- মা …..। দূর থেকে বসে বসে অলক দুচোখ ভরে ছেলের কান্ড দেখে।
বুকটা আনন্দে,উৎফুল্ল্যে ভরে ওঠে। একসময় দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েও আশ আর মেটে না। বারান্দায় রান্না করতে করতে লক্ষী দেখতে পেয়ে ঘরে এসে দুজনকেই জড়িয়ে ধরে পরম তৃপ্তিতে চোখবুজে সেই স্বর্গীয় আনন্দের আস্বাদন উপভোগ করে। সেইসব দৃশ্য গুলো ঠিক কাজের সময় মনে পড়ে যায় আর সে বারংবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। অলোক বুঝতে পারে দড়িতে ভর করে প্রতি মুহূর্তে বিপদ এগিয়ে আসছে পায়ে-পায়ে। একটু এদিক ওদিক হলেই আর রক্ষে নেই। স্বয়ং মৃত্যু কোলে তুলে নেবে। একদিন বাড়ি ফিরে চিন্তিত ভাবে স্ত্রীকে বলে, লক্ষীও সব শুনে শিউরে ওঠে,তার গায়ে কাঁটা দেয়। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতরে একেবারে ঠিক হৃদয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চায়।অজানা ভয়ে চোখ বিস্ফারিত করে বলে – ” আর তোমারি যাতি দেবনা। কোনদিন কি বিপদ ঘটাবা তার কি কোন ঠিক আছে । তাপর ছাবালটারে নি গাছতলায় দাঁড়াবো ” ? তুমি ছাড়া আমাদের আর কেডা আছে বলতি পারো ? দুচোখের কোল বেয়ে হুহু করে জলের ধারা নেমে আসে গন্ড থেকে বুক অবধি। আমাদের বড়নোক হতি যাওয়ার দরকার নি। চাড্ডি ডাল-ভাত জুটলি হলো। তার চে চলো দুজনে মিলি কাজ করবানে , ঠিক চলি যাবে । বাঁচিতো থাকবানে । লক্ষী দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকায় ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আর মনে,মনে স্বামীর কল্যাণের প্রার্থনা করে।
মাঝরাত অবধি দুজনে নানা ধরণের পরিকল্পনা করে আগামী দিনের জন্যে। কিন্তু কোন চিন্তাই সার্থক রূপ নেয় না। কারণ তাদের নেই লোকবল, অর্থবল কিংবা কারিগরি কাজের কোন দক্ষতা । রোজ সকাল-বিকেল শুধু চিন্তা করে করেই লক্ষীর ভাঁড়ে জমানো টাকা কটাও শেষ হলো, মুদির দোকানে কমাসের ধারের টাকা জমে গেল। এখন মুদির দোকানের মালিক রোজ এসে বাড়ি এসে তাগাদা দেয় আর নানাভাবে অপমান করে অলোককে। শেষে লক্ষীর একভরির মধ্যে তার বাবার দেওয়া সোনার ফিনফিনে চেন,দুগাছা চুরি,কানের দুল,আংটি বাঁধা পড়লো মাত্র কুড়ি হাজার টাকায়। মুদির দোকানের ধার শোধ করার পর যা অবশিষ্ট রইলো তা দিয়ে মাস খানেক চললো । ওদের সংসারের চরম দৈনতা ও দুর্দশা দেখে শেষমেশ পাশের ঘরের ভাড়াটে স্বপনদা একদিন অলোক কে নিয়ে গেল তার এক বন্ধুর ধূপের ফ্যাক্টরিতে । মালিক বন্ধুকে অলোকের দুরাবস্থার কথা জানিয়ে তাকে কিছু ভালো সুগন্ধি ধুপ অলোকের হাতে তুলে দিয়ে বললো যতদিন না অন্য কোন কাজ জোগাড় করতে পারছ তত দিন এই ধুপ বিক্রি করো । বিক্রি করে,করে ধূপের টাকা শোধ কর আবার নাও। একেবারে ঘরে বসে থাকবে কেন ? একটু খাটতে পারলে ডাল-ভাতের টাকাটা জোগাড় হয়ে যাবে।সেই সঙ্গে এক হাজার টাকা ধার দিলো কিছুদিন সংসার চালানোর জন্যে। এই দুঃসময়ে স্বপনদাকে যেন ঈশ্বরের মতো মনে হলো। অলোকের কৃতজ্ঞতায় চোখদুটি জলে ভরে উঠলো।স্বপনের হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বললো – আপনি আজ আমার নিজের দাদার মতো কাজ করলেন।
স্বপনদা আপনার এ ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারবো না।অলোক সত্যি স্বপনকে পেয়ে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলো। ধুপকাঠির বাক্সগুলো হাতে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরে এলো অলোক।
পরদিন থেকেই নব উদ্যমে আশায় বুক বেঁধে অলক রাস্তায় বেরোতে শুরু করলো ধুপকাঠি বিক্রি করতে। চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে জীবনে বাঁচার সাধ হারিয়ে ফেলেছিল ওরা। চাট্টি আলু সেদ্ধ ভাত খেয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে দুপুর বেলায় আজকাল পাশের ঘরের স্বপনদার বৌয়ের সঙ্গে সময় কাটায় লক্ষী। বড় ভালো মানুষ নয়ন বৌদি কালোর মধ্যে বেশ মুখশ্রী ।টিকলো নাক,বড় বড় চোখদুটোতে কি সুন্দর মন ভোলানো হাসি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেনয়ন বৌদি। নিজের ক্লাস ওয়ানের মেয়েকে রোজ সন্ধ্যা বেলায় নিজেই পড়ায়। ওদের মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন,অনেক আশা।শুনতে শুনতে লক্ষীরও ছেলেকে ঘিরে স্বপ্ন তৈরি হতে থাকে শেষে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ঝড়ে পরে ঘরের ল্যাংটো মেঝেতে। দুদিনের মধ্যেই এতই আপনজন হয়ে উঠলো নয়ন বৌদি যে লক্ষীর দিদির আসন গ্রহণ করতে দেরি হলো না। মনের দুঃখের সব কথা উগড়িয়ে কিছুটা শান্তি পায় লক্ষী। নয়ন বৌদিও সমবেদনা জানায়, তারও অতীতের চরম দৈন্যদশার কথা বলে ।।নয়ন বৌদিও একদিন কয়েকটা বাড়িতে বাসন মাজার ঠিকে ঝিয়ের কাজ করেছে সেদিন স্বপনদাও বেকার ছিল। রাস্তায় রাস্তায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন কাজের জন্যে।আজ স্বপনদা নিজের মেহনতের ফল হিসাবে নিজের অটো চালায়। নিজের তিনটে রিক্সা ভাড়ায় খাটে। লোকের বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে নয়ন বৌদি বস্তির ছোট ছোট নীচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ঘরে বসে পড়ায় এবং পাঁচ-ছয় হাজার টাকা রোজগার করে। দুজনের রোজগারে সংসারটা ভালোভাবেই চলে যায়। নয়ন বৌদি আরও বললো সোনারপুরের ভিতরের দিকে আড়াপাচঁ না নাটাগাছি বলে একটা জায়গায় দুকাঠার মতো জায়গাও কিনে রেখেছে ভবিষ্যতে সেখানেই বাড়ি করে চলে যাবে।তাদের পাঁচবছরের মেয়েটাকে সকালের স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছে। তাই সকাল বেলায় দুঘন্টা বাড়িতে টিউশনি করতে অসুবিধা হয়না। দুপুরে পর্যাপ্ত অবসর তাই রোজ লক্ষীর সাথে গল্প করে সময় কাটায়।
লক্ষীও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় সেও কোন কাজ নেবে । সেকথা প্রকাশ করতে নয়ন বৌদিকে বলে। বেশ তো কোরোনা, খুব ভালো হবে তো। তাঁতী পাড়ায় ব্লাউজের কারখানায় তো বাড়িতে ব্লাউজের হাতায় হেমফোর ও হুক লাগানোর জন্যে দেয়। বোধহয় ডজন হিসাবে পারিশ্রমিক দেয়। তুমি তো সারাদিন অনেক সময় পাও। ভালোভাবেই কাজ করতে পারবে। আসলে কি জানো লক্ষী আজকের দিনে সংসারে দুজনে মিলে রোজগার না কিরলে স্বচ্ছলতা আসেনা। আর সৎ পথে রোজগারের অনেক পথ আছে। শুধু একটু খুঁজে নিতে হবে। আচ্ছা তোমার স্বপনদাকে বলবো খোঁজ নিতে।
অচিরেই দুই ঘরের মধ্যে আত্মীয়তা গড়ে উঠলো।এমন কি অনেক ব্যক্তিগত গোপনিয়তাও চলে গেল উভয় পরিবারের মধ্যে। আজ স্বপনদার সঙ্গে লক্ষীর কথা বলতেও সঙ্কজ হয় না।
অলক সকাল বেলায় দুটো ডাল-ভাত খেয়ে বেরিয়ে সেই সন্ধ্যার ঘরে ফেরে। সাথে নিয়ে যায় লক্ষীর হাতে গড়া কটা রুটি সাথে কোনদিন তরকারি কোনদিন চিনি কিংবা বাতাসা।
বস্তির স্বভাব অনুযায়ী অলোক ঘরে না থাকার সুযোগে ভাড়াটে বস্তিবাড়ির কিছু লোকের কামুক দৃষ্টি লক্ষীর দেহ খুবলাতে শুরু করলো। যাওয়া আসার পথে তাদের কু -ইঙ্গিত কানে আসতে লাগলো। একদিন নয়ন বৌদিকে বলায় বৌদি হেসে বলল – এটা বস্তির একটা গোপন রোগ। এটাকে নিয়েই এখানে থাকতে হবে ভাই। তবে নিজেকে ঠিক ও সংযত রাখতে হবে। প্রশ্রয় দিলে চলবে না। অতিরিক্ত দেখলেই রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাকেও প্রথম প্রথম এধরণের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। আমি কিন্তু মাথা নত করিনি। একদিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতেই ঘরের আঁশবটি নিয়ে তাড়া করেছিলাম একজনকে। আরেকদিন দুপুরে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিল একজন , এক কামড়ে তার দাবনার মাংস তুলে নিয়েছিলাম সাতদিন ঘর থেকে বেরোতে পারিনি সে। তার বউ আজও আমার সাথে কথা বলে না আর সে ব্যাটা এখন আমায় দেখলে মাথা নিচু করে থাকে।
বস্তির কিছু নোংরা চরিত্রের মেয়ে-বউও আমার অভাবী মনে লোভের খিদে জাগাবার চেষ্টাও করেছিল। আমার বর সারাদিন ঘরে থাকেনা আর আমি ঘরে একা মেয়েমানুষ তখনও আমার মেয়ে হয়নি।সেসময় আমাদের খাওয়া-পড়াও ঠিক মতো জোটেনা দেখে ভেবেছিল খুব দুর্বল। টোপ দিলেই লাইনে চলে আসবে। ভেবেছিল ঘরে লোক ঢুকিয়ে ওরা দালালি খাবে। কিন্তু আমি যে অন্য ধাতের ওরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। এখন খুব হাসি জানো সেদিনগুলোর কথা মনে পড়লে। পুরুষেরা আমাদের কি ভাবে বলতো,আমরা খুব দুর্বল?খুব লোভী? খাবার হাতে তুতু করবে আর আমরা দৌড়ে যাবো ? আমাদের কোন মূল্যই নেই, মেয়েরা কি শুধু দাসত্ব ,পুরুষের মনোরঞ্জন,দেহের ক্ষিদে আর গর্ভ ধারণ করার জন্যই জন্মেছে ? আমি মনে করি তার থেকে মরে যাওয়াই ভালো। দেহে শক্তি আছে খেটে খাবো , বেশ্যা হতে যাবো কেন ? যদিও এ বস্তির অনেক বউ এভাবেই লুকিয়ে চুরিয়ে মাঝে মাঝে এ ধরণের কাজ করে কিছু টাকা রোজগার করে । তাদের স্বামীরা কাজের জন্য দুএকদিনের জন্যে বাইরে গেলেই এসব ঘটনা ঘটে। তুমিও চোখ -কান খোলা রাখলেই দেখতে,শুনতে পাবে। এখন ওসব আমাদের গা -সওয়া হয়ে গেছে। সব শুনে আতঙ্কে লক্ষীর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
মাঝে কয়েকদিনের জন্যে অলক দূরে একটা মেলায় গেল ধুপ বিক্রি করতে স্বপনদার বুদ্ধিতে। গ্রামের মেলায় নাকি কম দামের ধুপ প্রচুর বিক্রি হয়। সঙ্গে বড়বাজার থেকে কিছু সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিষ নিয়ে দুটো বড় ব্যাগ ভর্তি করে নিলো অলোক তারপর লক্ষীর হাতে দুশো টাকা দিয়ে খুব সাবধানে থাকতে বলে রওনা দিলো অনেক লাভের কথা চিন্তা করতে করতে খুশি মনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
তিনদিন কেটে যাওয়ার পর লক্ষীর দুশো টাকাও শেষ হয়ে গেল।
ঘরে কয়েকমুঠো চাল ছাড়া আর কিছুই নেই। এদিকে নয়ন বউদিও নেই যে তার কাছে হাত পাতবে। বৌদি বাবার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি ছুটেছে ,কবে আসবে জানা নেই। লক্ষী নিরুপায় হয়ে স্বপনদার কাছে গিয়ে কিছু টাকা ধার চাইতে বাধ্য হলো। ছেলেটার খিদের জ্বালায় চিৎকার করছে নিজেও অসহ্য খিদেয় কষ্ট পাচ্ছে। এ সময় লজ্যা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না মনে। এই চরম মুহূর্ত্বে বাঁচার জন্যে মানুষ খুনও পর্যন্ত করতে পারে। পৃথিবীতে যত ক্রাইম ঘটছে তার কারণ অনুসন্ধ্যান করলে দেখা যাবে সবার মুলেই আছে নয় দেহের খিদে ,নয় পেটের খিদে নতুবা মনের খিদে। ঈশ্বর কেন যে মানুষকে এতো খিদে দিলেন ?
স্বপনদা হাসতে হাসতে বললো – আসলে কি জান লক্ষী অলোক টাকা নেয় আর শোধ করে না। আগের টাকাটাতো দেয়নি উপরন্তু মেলায় যাওয়ার আগে পাঁচ হাজার টাকা আমার থেকে নিয়ে বড়বাজার থেকে মাল কিনলো। রাগ করো না তোমাদের ভালোবাসি না করতে পারি না কিন্তু আমারও তো পরিশ্রমের টাকা ।এর বদলে তুমি বা তোমরাতো আমায় কিছু দেবে না… বলে স্বপন দা কেমন ভাবে ভাবে তাকিয়ে থাকে। লক্ষী থতমত খেয়ে যায়।সে দৃষ্টির কোন তালগোল খুঁজে পায়না।
আচ্ছা আমার কাছে এখন তো কিছু তো নেই ,রাতে এসে দেবো। নিরাশ হয়ে লক্ষী ঘরে ফিরে আসে।
অনেক রাতে স্বপনদা যখন আসে তখন বস্তির সকলেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেটা অনেক আগেই খিদেতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। লক্ষী শুয়েছে কিন্তু ঘুমাইনি।দুচোখে দুশ্চিন্তায় তার যে ঘুম নেই। হটাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হতেই ভাবলো অলোক ফিরলো তাই ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো স্বপনদা হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে দরজায় গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষীকে দেখে জড়ানো গলায় বললো -আমি খুব দুঃখিত। একটা কাজে আটকে গিয়ে ফিরতে দেরি হলো। আমি তোমাদের জন্যে খাবার কিনেই নিয়ে এসেছি,ধর। আর এই পাঁচশো টাকা রেখে দাও। লক্ষীর মনে হলো স্বপনদাকে একটা সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে। এমন দেবতুল্য মানুষ এ যুগে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। মানুষটার প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করে। কতই বা বয়স হবে ,অলোকের থেকে দু-এক বছরের বড়। কিন্তু কতো বিবেক,বুদ্ধি, বিচক্ষণতা,। নিজ পরিশ্রমে কোথা থেকে আজ কোথায় উঠে এসেছে।নয়ন বৌদিকে এই মুহূর্তে হিংসে করতে ইচ্ছা করে। লক্ষীর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সেটা স্বপনও অনুভব করে বলে – চিন্তা করোনা একদিন সুদিনের মুখ নিশ্চই দেখবে। তোমাকে কেন যেন ভীষণ ভালো লাগে লক্ষী। লজ্জা করোনা কোন অসুবিধা হলে জানিও। আমি পাশে আছি। নাও দরজা বন্ধ কর। তোমার খেয়ে নাও।
অনেক রাতে আবার দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতে এবারেও ভাবলো নিশ্চই অলোক এসেছে। দরজা খুলতেই টলতে টলতে স্বপন ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে বললো – আর পারলাম না লক্ষী নিজেকে সংযত রাখতে। নিজের সাথেই নিজে অনেক যুদ্ধ করলাম শেষে পরাজয় মেনে নিতে হলো। আমি তোমাকে ভালোবাসি লক্ষী। তারপর লক্ষীকে দুহাতের বজ্রবেষ্টনে করে নগ্ন মেঝেতেই ফেলে লক্ষীর শরীর নিরাবরণ করতে করতে শুরু করলো পাশবিক দেহখিদের আস্ফালন। লক্ষী কতবার অনুনয়,বিনয় করলো। এমনকি তার পিরিয়ডের কথা বললো কিন্তু স্বপন তার কোন কথাই কানে তুললো না।
একসময় লক্ষীকে পরাজয় মেনে সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে সমর্পণ করতে হলো। বোধহয় ক্ষুধার্ত সব মানুষই এই পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
লক্ষী সারারাত চোখের জলে ভাসলো। একসময় ভাবলো আর বেঁচে কি লাভ ? আজ যা ঘটলো তাতো মুখ ফুটে কারুর কাছে প্রকাশ করতে পারবে না এমন কি নিজের স্বামীকেও না । ভাবলো এমন অপদার্থ স্বামীকে বলেই বা কি লাভ সে তো আগেই তার মাথাটা বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে। আত্মহত্যার কথা ভাবতে ভাবতেই ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মৃত্যু চিন্তা নিমেষের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল। ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে এইমুহূর্তে ভীষণ ভাবে বাঁচতে সাধ জাগলো লক্ষীর। একমাত্র এই ছেলেটার জন্যেই তাকে বাঁচতে হবে পাপ বুকে চেপে, শুধু মা হওয়ার জন্যেই।
পাপের টাকাটা আঁচলে বাঁধা তখনও। হটাৎ যেন ভীষণ ভারী বোধহল আঁচলটা। লক্ষী ছেলেকে নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরলো যেন সাত রাজার ধন এক মানিক। কান্না ভেজা গলায় বলে উঠলো পরম মমতায় – সূর্য জাগিছে সুনা , উঠি পর বাবা, ভাত খাবা না, ওঠ মানিক,সোনা আমার । তোমারে নে বাজারে জাতি হবে যে , মাছ দিয়ে ভাত দেবানে বাপ। এখন উঠ, ও আমার গুপাল …… মরতি পারলাম কই তোমারি ছাড়ি বাপ ……।

Pages: 1 2
Pages ( 1 of 2 ): 1 2পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress