অম্বরবাবুর অসুস্থ মা
অম্বরবাবুর অসুস্থ মাকে বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না, তাই আমরা আপাতত পাম এভিনিউ-এর পাট শেষ করে সেনেদের অ্যামবাসডরে চলে গেলাম গঙ্গার ধারে। গে রেস্টোরান্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার বিলাসবাবু বললেন, এইখান থেকে স্যার হাঁটতে আরম্ভ করে সোজা দক্ষিণ দিকে গিয়ে ঠিক এক ঘণ্টা বাদে আবার ফিরে আসতেন। একেবারে ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়।
আপনি গাড়িতেই বসে থাকতেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কদ্দিন ড্রাইভারি করছেন সেন-বাড়িতে?
নাইন ইয়ারস।
তার মানে অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা আপনি জানেন না?
অ্যাক্সিডেন্ট?
অম্বরবাবু বছর বারো আগে একবার একটি লোককে গাড়ি চাপা দিয়ে মারেন।
সেন সাহেব?
কেন, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
উনি যে কোনওদিন নিজে ড্রাইভ করেছেন সেইটেই জানতুম না।
ওই ঘটনার পরেই ড্রাইভিং ছেড়ে দেন।
তা হবে। ড্রাইভারের তো দোষ দেওয়া যায় না। সব সময়! রাস্তার লোকে যেভাবে চলাফেরা করে, আরও বেশি লোক মরে না কেন সেইটেই তো ভাবি। ড্রাইভারের আর কী দোষ?
অম্বরবাবু যেদিন আর ফিরলেন না, সেদিনের ঘটনাটা একটু বলবেন?
সেদিন উনি আসছেন না দেখে আমি হেস্টিংস পর্যন্ত গিয়ে তল্লাশ করেছিলাম। পথে লোক ধরে ধরে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করছি। গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে রাস্তায় নেমে খুঁজেছি যদি কোথাও পড়ে-টড়ে গিয়ে থাকেন। হার্টটা তেমন মজবুত ছিল না তো।
লোকজন কেমন ছিল রাস্তায়?
সিকালে এদিকটা লোক মন্দ থাকে না। সব হাঁটতে আসে। তবে নিউ হাওড়া ব্রিজের সাইডটায় লোক থাকে না বললেই চলে। স্যার তো। ওদিকেই যেতেন। ফস করে যদি গাড়িতে কটা জোয়ান লোক এসে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে যায়, কেউ টেরও পাবে না।
আমরা গাড়িতে করেই দশ মাইল স্পিডে চালিয়ে হেস্টিংস পর্যন্ত ঘুরে এলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলাম না।
এরপর দুদিন পাম এভিনিউ থেকে কোনও খবর নেই। বিষ্যদবার বিকেলে লালমোহনবাবু এসেই বললেন, ঘটনা এগোল? অম্বর সেন উধাও শুনে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেল। বললেন, আপনার একটি কেসও গেজে যেতে দেখলুম না। ধন্যি আপনার লাক!
আপনার গ্রেট স্কলার প্রতিবেশী মৃত্যুঞ্জয় সোমের কী খবর?
দূর দূর! স্কলার না মুণ্ডু!
সে কী মশাই, এর মধ্যে আবার কী হল? সেদিন তা সুপারলেটিভ ছাড়া কথাই বলছিলেন की।
আর বলবেন না মশাই।
কেন, কী হল?
বলতেও লজ্জা করে।
আমার কাছে আবার লজ্জা কী? বলে ফেলুন।
ব্যাপারটা কী জানি না, কিন্তু সেটা যে লালমোহনবাবু চেপে যেতে চাইছেন সেটা বুঝতেই পারছি। এদিকে ফেলুদাও ছাড়বার পাত্র নয়। শেষটায় পীড়াপীড়িতে ভদ্রলোক বলেই ফেললেন।
আরো মশাই, ভাবতে পারেন, ভদ্রলোক প্রদোষ মিত্তিরের নাম শোনেননি। আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিতে গিয়ে একেবারে ভেড়া বনে গেলুম! বলে কিনা-হুইজ প্রদোষ মিত্ৰ?
তাতে আর কী হল, এত বড় স্কলার, হার্বার্টের ডবল এম এ, আমিও তো তাঁর নাম শুনিনি।
কথাটা বোধহয় লালমোহনবাবুকে কিছুটা আশ্বস্ত করল। বললেন, তা যা বলেছেন। এত বড় দুনিয়ায় কটা মানুষকে আর কাটা মানুষ চেনে! আর ভদ্রলোক বোধহয় বেশির ভাগ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন। কাজেই এক্সকিউজ করে দেওয়া যায়-কী বলেন?
আমাদের কথার মাঝখানেই পাম এভিনিউ থেকে ফোন এল। অম্বুজ সেন। একটা বেনামি চিঠি এসেছে ভদ্রলোকের নামে। টেলিফোনে সেটা পড়ে শোনালেন ভদ্রলোক।
আগামীকাল শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছাঁটায় ১০০ টাকার নোটে ২০০০০ টাকা ব্যাগে পুরে প্রিনসেপঘাটের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের থামের ধারে রেখে যাবেন। অম্বর সেনকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাবার এই একমাত্র উপায়। পুলিশ বা গোয়েন্দার সাহায্য নিলে ফল হবে মারাত্মক।
ফেলুদা ফোনে বলল, এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নেবার দরকার নেই, মিঃ সেন। আরও চব্বিশ ঘণ্টা সময় আছে। এর মধ্যে আমার কয়েকটা কাজ আছে। আপনাদের দিক থেকে কী করণীয় সেটা আমি কাল দুপুর দুটাের মধ্যে আপনাদের বাড়ি গিয়ে বলে আসব। তবে হ্যাঁ, টাকার ব্যবস্থােটা করে রাখবেন। ওটা খুবই জরুরি।
কিন্তু গোয়েন্দার ব্যাপারে শাসিয়ে রেখেছে যে মশাই, ফেলুদা ফোন রাখার পর লালমোহনবাবু বললেন।
ফেলুদা উত্তরে শুধু বলল, জানি।
রকেটের বেগে ঘটনা এগিয়ে চলেছে। এই টাকাটা না দিয়ে উপায় কী আছে সেটা আমিও ভেবে পেলাম না।
লালমোহনবাবু, কাল আপনার গাড়িটা একটু পাওয়া যাবে কি? প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে থেকে অবশেষে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
এনি টাইম, বললেন জটায়ু। কখন চাই বলুন।
সকলে একবার বেরোিব। সাড়ে নটা নাগাত পেলেই চলবে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আমার কাজ হয়ে যাবে। তারপর বিকেল পাঁচটা নাগােত আপনি যদি গাড়িটা নিয়ে চলে আসেন তো খুব ভাল হয়।
ভেরি গুড।
এরপর ফেলুদা আর কোনও কথাই বলল না।
পরদিন লালমোহনবাবুর গাড়িতে করে ফেলুদা বেরোল। একই বেরোল, কাজেই কোথায় গেল কী করল জানার উপায় নেই। বারোটা নাগাত ফিরে আসার পর দেখলাম তার মুখের ভাব বদলে গেছে।
কী ঠিক করলে ফেলুদা৷ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
টাকাটা দিতেই হবে, বলল ফেলুদা। তবে গোয়েন্দা সম্পর্কে হুমকিটা মানা চলবে না।
মানে? তুমি নিজেও থাকবে সেখানে?
ফেলুমিত্তির অত সহজে ঘাবড়াবার লোক নয় রে তোপ্সে।
আমার আমরা? আমরা কোথায় থাকব?
তোরাও থাকিবি কাছাকাছির মধ্যে, কারণ হেলপ দরকার হতে পারে।
আমি তো শুনে থা।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে আমরা গেলাম পাম এভিনিউ।
অম্বুজবাবু স্বভাবতই বাড়িতে ছিলেন, ফেলুদাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
কাল রাত্তিরে চোখের পাতা এক করতে পারিনি মশাই! দেখতে দেখতে কী যে হয়ে গেল! ফেলুদা গম্ভীরভাবে বলল, টাকাটা আপনাদের খসবেই, মিঃ সেন। অম্বরবাবুকে ফিরে পাবার আর কোনও রাস্তা নেই।
তুমি ধরতে পারনি এখনও? রুনা হঠাৎ ঘরের দরজা থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল।
অনেকটা ধরে ফেলেছি, রুনা, বলল ফেলুদা।খুব চেষ্টা করছি। যাতে বাকিটা আজ বিকেলের মধ্যেই ধরতে পারি।
ব্যাস, ঠিক আছে।
রুনাকে ভীষণ নিশ্চিন্ত বলে মনে হল। ফেলুদা ব্যর্থ হবে এটা যেন তার কাছে ভয়ানক একটা দুঃখের ব্যাপার।
তা হলে কী করা উচিত বলে মনে হয়? জিজ্ঞেস করলেন অম্বুজবাবু।
টাকার ব্যবস্থা হয়েছে?
সেটা করে ফেলেছি। বাড়িতে তো অত ক্যাশ থাকে না, তাই আজ সকালেই সমরেশকে দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়ে নিয়েছি।
সেই টাকা, এবং যে ব্যাগে করে সেটা দেওয়া হবে—এই দুটো জিনিস আমি একবার দেখতে চাই!
টাকা এবং ব্যাগ এসে গেল। এত টাকা। এর আগে একসঙ্গে দেখেছি কি? মনে তো পড়ে না।
ফেলুদার সামনেই কুড়িটা করে একশো টাকার নোট রাবার ব্যান্ড দিয়ে গোছ করে দশ ভাগে ব্যাগের মধ্যে পুরে দেওয়া হল। তার ফলে ব্যাগের চেহারা হয়ে গেল কচ্ছপের পিঠের মতো।
ভেরি গুড, বলল ফেলুদা। তা হলে আমরা বেরিয়ে পড়ছি পৌনে ছটা নাগাত।
অম্বুজবাবু চমকে উঠলেন।
সে কী, আপনি যাবেন?
অপরাধীকে ধরার চেষ্টা আমাকে করতেই হবে, মিঃ সেন। আপনি টাকা রেখে আসবেন, আর সে লোক দিব্যি এসে সেটা তুলে নিয়ে চলে যাবে, এ তো হতে দেওয়া যায় না। অম্বরবাবুকে ফেরত পাওয়াটাই বড় কথা সেটা জানি, কিন্তু সেই সঙ্গে এই গুণ্ডাদেরও সাজা হওয়া উচিত নয় কি? না হলে তো তারা এই ধরনের কুকীর্তি করেই চলবে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। সাবধানতা অবলম্বন না করে আমি কখনও কিছু করি না।
তা হলে—
আমি বলছি, আপনি মন দিয়ে শুনুন। আপনি আপনার গাড়িতে করে যাবেন টাকা নিয়ে। নিউ হাওড়া ব্রিজের দিকটা দিয়ে আসবেন। ওদিকটা মোটামুটি নিরিবিলি। গাড়ি প্রিনসেপঘাট থেকে অন্তত দুশো গজ আগে দাঁড় করিয়ে আপনার ড্রাইভারকে বলবেন টাকাটা যথাস্থানে রেখে আসতে। আমি কাছাকাছির মধ্যেই থাকব। কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেটা আমি দেখতে পাব। আমরা মিট করব ঘটনার পর। গে রেস্টোরান্টের সামনে। আপনি টাকা রেখে সোজা ওখানে চলে আসবেন। আমিও তাই করব। অপরাধীকে যদি ধরতে পারি তা হলে তিনিও আমার সঙ্গেই থাকবেন, বলাই বাহুল্য।
অম্বুজবাবুকে মনে হল যিনি তিনি বেশ নার্ভাস বোধ করছেন। সেটা অস্বাভাবিক নয়। টাকার অঙ্কটা তো কম নয়। আর গুণ্ডারা কী করবে না-করবে। কে জানে?
বিকেলে সাড়ে চারটের সময় লালমোহনবাবু এলে পর ফেলুদার প্রথম কথা হল, মশাই, এমন অভিনব কেস আর আমি কোনওদিন পাইনি।
অবিশ্যি আমাকে জিজ্ঞেস করলে পরে আমি এখনও বলতে পারব না। এর বিশেষত্বটা কোথায়।
তা হলে আমরা কী করছি? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
শুনে নিন। মন দিয়ে, বলল ফেলুদা।তুইও শোন, তোপ্সে। সাড়ে পাঁচটার সময় আপনার গাড়ি নিয়ে আপনি আর তোপ্সে চলে যাচ্ছেন গে রেস্টোরান্টে। সেখানে আপনাদের অভিরুচি অনুযায়ী পানাহার সেরে ঠিক সোয়া ছাঁটায় রেস্টোরন্ট থেকে বেরিয়ে সটান চলে যাবেন দক্ষিণে প্রিনসেপঘাট লক্ষ্য করে। গাড়ি রেখে যাবেন রেস্টোরান্টের সামনে। থামওয়ালা ঘাটটার কাছে পৌঁছনোর কিছু আগেই দেখবেন ডানদিকে একটা গম্বুজওয়ালা বসার ঘর রয়েছে। দুজনে সেখানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসে পড়বেন। ভাবটা এমন হওয়া চাই যেন সান্ধ্যভ্রমণ আর বায়ুসেবন ছাড়া আপনাদের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। ঘাটের দিকে আড়দৃষ্টি রাখবেন, তবে যেন মনে না। হয় যে, ওটাই আপনাদের লক্ষ্য। তারপর সাড়ে ছাঁটার দশ মিনিট পর ওখান থেকে উঠে পড়ে নিজের গাড়িতে ফিরে আসবেন। আমিও সেখানেই আপনাদের মিট করব।