Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অমৃতের মৃত্যু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 8

অমৃতের মৃত্যু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর সঙ্গে আলাপ করিয়া কিন্তু সুখ হইল না।

মাড়োয়ারীদের মধ্যে প্রধানত দুই শ্রেণীর চেহারা দেখা যায়; এক‌, পাতিহাসের মত মোটা আর বেঁটে; দুই‌, বকের মত সরু আর লম্বা। বদ্রিদাসের আকৃতি দ্বিতীয় শ্রেণীর। তাঁহার চালের কলটি আকারে প্রকারে বিশুবাবুর মিল-এর অনুরূপ; সেই ধান শুকাইবার মেঝে‌, সেই পুকুর‌, সেই ইঞ্জিন-ঘর‌, সেই ফটকের সামনে গুখ দারোয়ান। পৃথিবীর সমস্ত চাল কলের মধ্যে বোধ করি আকৃতিগত ভ্রাতৃসম্বন্ধ আছে।

বদ্রিদাসের বয়স পয়ত্ৰিশ হইতে চল্লিশের মধ্যে। নিজের গদিতে বসিয়া খবরের কাগজ হইতে তেজি-মন্দার হাল জানিতেছিলেন‌, আমাদের দেখিয়া এবং পরিচয় শুনিয়া তাঁহার চক্ষু দুইটি অতিমাত্রায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। তিনি গলা উচু করিয়া ঘরের আনাচে-কানাচে চকিত ক্ষিপ্র নেত্রপাত করিতে লাগিলেন‌, কিন্তু আমাদের সঙ্গে পলকের তরেও দৃষ্টি বিনিময় করিলেন না। ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তরে তিনি যাহা বলিলেন তাহাও নিতান্ত সংক্ষিপ্ত এবং নেতিবাচক। পুরা সওয়াল জবাব উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নাই‌, নমুনাস্বরূপ কয়েকটির উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে।–

‘আপনি অমৃতকে চিনতেন?’

‘নেহি।’

সদানন্দ সুরকে চিনতেন?’

‘নেহি।’

‘বেনামী চিঠি পেয়েছেন?’

‘নেহি।’

‘আপনার কলো রঙের ঘোড়া আছে?’

‘নেহি।’

আরও কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তরের পর ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল‌, কঠিন দৃষ্টিতে বদ্রিদাসকে বিদ্ধ করিয়া বলিল‌, ‘আজ চললাম‌, কিন্তু আবার আসব। এবার ওয়ারেন্ট নিয়ে আসব‌, আপনার মিল সার্চ করব।’

বদ্রিদাস এককথার মানুষ‌, দুরকম কথা বলেন না। বলিলেন‌, ‘নেহি‌, নেহি।’

উত্ত্যক্ত হইয়া চলিয়া আসিলাম। ফটকের বাহিরে পা দিয়াছি‌, একটি শীর্ণকায় বাঙালী আসিয়া আমাদের ধরিয়া ফেলিল; পানের রসে আরক্ত দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল‌, ‘আপনি ব্যোমকেশবাবু? বদ্রিদাসকে সওয়াল করছিলেন?’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘আপনি জানলেন কি করে? ঘরে তো কেউ ছিল না।’

রক্তদন্ত আরও প্রকট করিয়া লোকটি বলিল‌, ‘আমি আড়াল থেকে সব শুনেছি। বদ্রিদাস আগাগোড়া মিছে কথা বলেছে। সে অমৃতকে চিনত‌, সদানন্দ সুরকে চিনত‌, বেনামী চিঠি পেয়েছে‌, ওর কালো রঙের একটা ঘোড়া আছে। ভারি ধূর্ত মাড়োয়ারী‌, পেটেপেটে শয়তানি।’

ব্যোমকেশ লোকটিকে কিছুক্ষণ শান্তচক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আপনি কে?’

‘আমার নাম রাখাল দাস। মাড়োয়ারীর গদিতে কাজ করি।’

‘আপনার চাকরি যাবার ভয় নেই?’

‘চাকরি গিয়েছে। বদ্রিদাস লুটিস দিয়েছে‌, এই মাসের শেষেই চাকরি খালাস।’

‘নোটিস দিয়েছে কেন?’

‘মুলুক থেকে ওর জাতভাই এসেছে‌, তাকেই আমার জায়গায় বসাবে। বাঙালী রাখবে না।’ আমরা চলিতে আরম্ভ করিলাম। লোকটা আমাদের পিছন পিছন আসিতে লাগিল‌, ‘মনে রাখবেন ব্যোমকেশবাবু্‌, পাজির পা-ঝাড়া ওই বদ্রিদাস। ওর অসাধ্যি কৰ্ম্ম নেই। জাল জুচ্চুরি কালাবাজার–‘

ব্যোমকেশ পিছন ফিরিয়া চাহিল না‌, হাত নাড়িয়া তাহাকে বিদায় করিল।

বিশ্রান্তিগুহে ফিরিয়া ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় লম্বা হইল‌, ঊর্ধ্বে চাহিয়া বোধকরি ভগবানের উদ্দেশে বলিল‌, ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি?

আমি জামা খুলিয়া বিছানার পাশে বসিলাম; বলিলাম, ব্যোমকেশ, অনেক লোকের সঙ্গেই তোতো মুলাকাৎ করলে। কিছু বুঝলে?’

সে বলিল‌, ‘বুঝেছি। সবই। কিন্তু লোকটিকে যতক্ষণ নিঃসংশয়ে চিনতে না পারছি ততক্ষণ বোঝাবুঝির কোনও মানে হয় না।’

‘কালো ঘোড়ার ব্যাপারটা কি? বদ্রিদাসের যদি কালো ঘোড়া থাকেই তাতে কী?’

ব্যোমকেশ কতক নিজ মনে বলিল‌, ‘খাট্‌কা লাগছে। বদ্রিদাসের কালো ঘোড়া-খট্‌কা লাগছে!’

‘তোমার ধারণা হত্যাকারী কালো ঘোড়ায় চড়ে সদানন্দ সুরকে খুন করতে গিয়েছিল। কিন্তু কেন? ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে লাভ কি?’

‘লাভ আছে‌, কিন্তু লোকসানও আছে। তাই ভাবছি—। যাক।’ সে আমার দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল‌, ‘বিশ্বনাথ মল্লিককে কেমন দেখলে?’

বলিলাম‌, ‘জিকি ছিলেন‌, কুকুরের চেয়ে ঘোড়া ভালবাসেন; এ থেকে ভালোমন্দ কিছু বুঝলাম না। কিন্তু ওঁকে হাঁড়ির খবর দেওয়া কি উচিত হয়েছে? মনে করো‌, জঙ্গল সার্চ করার কথাটা যদি বেরিয়ে যায়! আসামী সাবধান হবে না?’

ব্যোমকেশ একটু বিমনাভাবে বলিল‌, ‘হুঁ। কিন্তু আমি তাঁকে চেতিয়ে দিয়েছি‌, আমার বিশ্বাস তিনি কাউকে বলবেন না।’

‘কিন্তু যদি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়!’

‘তাহলে ভাবনার কথা বটে।–যাক‌, নীলকণ্ঠ অধিকারীকেও বেশ সরল প্রকৃতির লোক বলে মনে হয়। ভারি প্রভুভক্ত‌, কী বলো?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু রাখাল দাস?’

‘ও একটা খুঁচো। বদ্রিদাস তাড়িয়ে দিয়েছে‌, তাই গায়ের ঝাল মেটাতে এসেছিল।’

‘কিন্তু ওর কথাগুলো কি মিথ্যে?’

‘না‌, সব সত্যি।’

দুপুরবেলা আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া লইলাম। ব্যোমকেশের মুখখানা সারাক্ষণ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হইয়া রহিল। উদ্বেগের হেতুটা কিন্তু ঠিক ধরিতে পারিলাম না।

বেলা সাড়ে চারটের সময় রামডিহি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বাহির হইলাম। পৌঁনে-পাঁচটায় গাড়ি‌, পাঁচটা বাজিয়া দশ মিনিটে রামডিহি পৌঁছিবে। প্রাণকেষ্ট পালের সহিত সদালাপ করিয়া ফিরিতে বেশি রাত হইবে না।

টিকিট কিনিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করিলাম। ফটকে মনোতোষ টিকিট চেক করিয়া মিটমিটি হাসিল‌, ‘ফিরছেন কখন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘নটা-দশটা হবে।’

প্ল্যাটফর্মে কিছু যাত্রী সমাগম হইয়াছে। ট্রেন আসিতে মিনিট পাঁচেক দেরি আছে। এদিক ওদিক দৃষ্টি ফিরাইতে চোখে পড়িল ক্ষীণাঙ্গ স্টেশনমাস্টার হরিবিলাসবাবুর অফিসের সামনে পীনাঙ্গ দারোগা সুখময়বাবু তাঁহার সহিত সতর্কভাবে কথা বলিতেছেন। সুখময়বাবু আমাদের দেখিতে পাইয়া হাত নাড়িলেন এবং অল্পক্ষণ পরেই আসিয়া হাজির হইলেন। তাঁহার চোখে অনুসন্ধিৎসার ঝিলিক।

‘কোথাও যাচ্ছেন নাকি?’

‘রামডিহি যাব‌, একটু কাজ আছে। আপনি?’

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘আমি কোথাও যাব না। একজনকে এগিয়ে নিতে এসেছি। এই ট্রেনেই তিনি আসছেন। হো-হে।’ বলিয়া ভ্রূ নাচাইলেন।

ব্যোমকেশ একটু বিস্মিতম্বরে বলিল‌, ‘কে তিনি?’

সুখময়বাবু বলিলেন‌, ‘তাঁর নাম নফর কুণ্ডু। তাঁর কয়েক বস্তা চাল রেলে চালান যাচ্ছিল‌, একটা বস্তা ট্রেনের ঝাঁকানিতে ফেটে গিয়ে ভেতর থেকে দু’সের আফিম বেরিয়েছে। নফর কুণ্ডুও ধরা পড়েছেন। এই ট্রেনে তিনি আসছেন।’ বলিয়া ভ্রূ নাচাইতে নাচাইতে স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে প্রস্থান করিলেন।

ব্যোমকেশ ললাট কুঞ্চিত করিয়া চৌকা-পাথর-ঢাকা প্ল্যাটফর্মের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি বলিলাম‌, ‘ওহে‌, বদ্রিদাস মাড়োয়ারীও এসেছেন।’

ব্যোমকেশ চকিতে চোখ তুলিল। মালগুদামের দিক হইতে বকের মত পা ফেলিয়া শনৈঃ শনৈঃ বদ্রিদাস আসিতেছেন। তাঁহার ভাবভঙ্গী হইতে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি আমাদের দেখিতে পাইয়াছেন। কিন্তু তিনি আমাদের দিকে চক্ষু ফিরাইলেন না‌, ধীর মন্থর পদে প্ল্যাটফর্ম হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

ব্যোমকেশের ভূ-কুঞ্চন আরও গভীর হইল।

মিনিটখানেক পরে আমি বলিলাম‌, ‘ওহে‌, বিশুবাবুও উপস্থিত। কী ব্যাপার বলে দেখি?

যোধপুরী ব্রিচেস পরা বিশুবাবু ফটক দিয়া প্রবেশ করিলেন‌, আমাদের দেখিতে পাইয়া স্মিতমুখে আগাইয়া আসিলেন।

নমস্কার। কোথাও যাচ্ছেন?’

‘রামডিহি যাচ্ছি।’

‘ওহো-সদানন্দ সুরের ভগিনীপতি।’

‘হ্যাঁ। দশটার মধ্যেই ফিরব। আপনি?’

‘একটা চালান আসবার কথা আছে‌, তারই খোঁজ নিতে এসেছি। দেখি যদি এসে থাকে।’ অস্থিসার মুখে একটু হাসিয়া তিনি মাল-অফিসের দিকে চলিয়া গেলেন।

ইতিমধ্যে ট্রেনের ধোঁয়া দেখা দিয়াছিল। অবিলম্বে প্যাসেঞ্জার গাড়ি আসিয়া পড়িল। গাড়িতে উঠিবার আগে লক্ষ্য করিলাম‌, একটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরা হইতে পুলিস-পরিবৃত একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি অবতরণ করিলেন। অনুমান করিলাম ইনি আফিম-বিলাসী নফর কুণ্ডু। মনে পাপ ছিল বলিয়াই বোধহয় বেনামী চিঠি পাইয়া গা-ঢাকা দিয়াছিলেন।

দুই তিন মিনিট পরে গাড়ি ছাড়িয়া দিল। ব্যোমকেশের মুখে সংশয়ের ভ্রূকুটি গাঢ়তার হইয়াছে‌, যেন সে হঠাৎ কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হইয়া মানস্থির করিতে পারিতেছে না। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘হল কি? ঠেকায় পড়েছি মনে হচ্ছে।’

সে উত্তর দিবার আগেই ঘ্যাঁচ করিয়া গাড়ি থামিয়া গেল। জানোলা দিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিলাম ডিস্টান্ট সিগনাল না পাইয়া গাড়ি থামিয়াছে। তারের বেড়ার ওপারে বাঘমারি গ্রাম দেখা যাইতেছে।

যেন সমস্ত সমস্যার সমাধান হইয়াছে এমনিভাবে লাফাইয়া উঠিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ভালোই হল। অজিত‌, আমি এখানে নেমে যাচ্ছি‌, তুমি একই রামডিহি যাও। প্রাণকেষ্টবাবুকে সব কথা জিগ্যেস করবে। সদানন্দবাবু তাঁর কাছে তোরঙ্গ রেখে গিয়েছিলেন। কিনা এ-কথাটা জানতে ভুলো না।–আচ্ছা।’

গাড়ি সিটি মারিয়া আবার গুটিগুটি চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল‌, ব্যোমকেশ নামিয়া পড়িল। আমি হতবুদ্ধি হইয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিলাম। সে তারের বেড়া পার হইয়া আমার উদ্দেশে একবার হাত নাড়িল‌, তারপর বাঘমারি গ্রামের দিকে চলিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *