Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অমৃতের মৃত্যু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

অমৃতের মৃত্যু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

বৈকালবেলা ছেলেরা আসিয়া আমাদের গ্রামে লইয়া গেল। রেল-লাইনের ধার দিয়া যখন গ্রামের নিকট উপস্থিত হইলাম তখন গ্রামের সমস্ত পুরুষ অধিবাসী আমাদের অভ্যর্থনা করিবার জন্য লাইনের ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে‌, ছেলে-বুড়া কেহ বাদ যায় নাই। সকলের চোখেবিস্ফারিত কৌতুহল। ব্যোমকেশ বক্সী কীদৃশ জীব তাহার স্বচক্ষে দেখিতে চায়।

মিছিল করিয়া আমরা গ্রামে প্রবেশ করিলাম। পটল অগ্রবর্তী হইয়া আমাদের একটি বাড়িতে লইয়া গেল। কাঁচা-পাকা বাড়ি‌, সামনের দিকে দু’টি পাকা-ঘর‌, পিছনে খড়ের চাল। মৃত অমৃতের মামার বাড়ি।

অমৃতের মামা বলরামবাবু বাড়ির সামনের চাতালে টেবিল-চেয়ার পাতিয়া চায়ের আয়োজন করিয়াছিলেন‌, জোড়হস্তে আমাদের সংবর্ধনা করিলেন। লোকটিকে ভালোমানুষ বলিয়া মনে হয়‌, কথাবলার ভঙ্গীতে সঙ্কুচিত জড়তা। তিনি ভাগিনার মৃত্যুতে খুব বেশি শোকাভিভূত না হইলেও একটু যেন দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছেন।

চায়ের সরঞ্জাম দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এসব আবার কেন?’

বলরামবাবু অপ্রতিভভাবে জড়াইয়া জড়াইয়া বলিলেন‌, ‘একটু চা-সামান্য—’

পটল বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি আমাদের গ্রামের পায়ের ধুলো দিয়েছেন আমাদের ভাগ্যি। চা খেতেই হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, সে পরে হবে‌, আগে জঙ্গলটা দেখে আসি।’

‘চলুন।’

পটল আবার আমাদের লইয়া চলিল। আরও কয়েকজন ছোকরা সঙ্গে চলিল। বলরামবাবুর বাড়ির সম্মুখ দিয়া যে কাঁচা-রাস্তাটি গিয়াছে তাঁহাই গ্রামের প্রধান রাস্তা। এই রাস্তা একটি অসমতল শিলাকঙ্করপূর্ণ আগাছাভিরা মাঠের কিনারায় আসিয়া শেষ হইয়াছে। মাঠের পরপারে একটিমাত্র পাকা বাড়ি; সদানন্দ সুরের বাড়ি। তাহার পিছনে জঙ্গলের গাছপালা। আমরা মাঠে অবতরণ করিলাম। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এই মাঠে বসে তোমরা সেদিন গল্প করছিলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ঠিক কোন জায়গায় বসেছিলে?’

‘এই যে–’ আরও কিছুদূর গিয়া পটল দেখাইয়া বলিল‌, ‘এইখানে।’

স্থানটি অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন‌, আগাছা নাই। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখান থেকে অমৃত যো-পথে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। সেই পথে নিয়ে চল।’

‘আসুন।’

সদানন্দ সুরের দরজায় তালা ঝুলিতেছে‌, জানালাগুলি বন্ধ। আমরা বাড়ির পাশ দিয়া পিছ= দিকে চলিলাম। পিছনে পাঁচল-ঘেরা উঠান‌, পাঁচিল প্ৰায় এক মানুষ উঁচু‌, তাহার গায়ে একটি খিড়কি-দরজা। জঙ্গলের গাছপালা খিড়কি-দরজা পর্যন্ত ভিড় করিয়া আসিয়াছে।

বাড়ি অতিক্রম করিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিলাম। জঙ্গলে পাতা-ঝরা আরম্ভ হইয়াছে‌, গাছগুলি পত্রবিরল‌, মাটিতে স্বয়ংবিশীর্ণ পীতপত্রের আস্তরণ। বাড়ির খিড়কি হইতে পাঁচিশ-ত্রিশ গজ দূরে একটা প্রকাণ্ড শিমুলগাছ‌, স্তম্ভের মতো স্থূল গুড়ি দশ-বারো হাত উঁচুতে উঠিয়া শাখা-প্রশাখাত্ত বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। পটল আমাদের শিমুলতলায় লইয়া গিয়া একটা স্থান নির্দেশ করিয়া’ বলিল‌, ‘এইখানে অমৃত মরে পড়ে ছিল।’

স্থানটি ঝরা-পাতা ও শিমুল-ফুলে আকীর্ণ‌, অপঘাত মৃত্যুর কোনও চিহ্ন নাই। তবু ব্যোমকেশ। স্থানটি ভালো করিয়া খুঁজিয়া দেখিল। কঠিন মাটির উপর কোনও দাগ নাই‌, কেবল শুকনা পাতার নিচে একখণ্ড খড়ি পাওয়া গেল। ব্যোমকেশ খড়িটি তুলিয়া ধরিয়া বলিল‌, ‘এই খড়ি দিয়ে অমৃত গাছের গায়ে ঢেরা কাটতে এসেছিল। কিন্তু গাছের গায়ে খড়ির দাগ নেই। সুতরাং–’

পটল বলিল‌, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ‌, দাগ কাটবার আগেই–’

এখানে দ্রষ্টব্য আর কিছু ছিল না। আমরা ফিরিয়া চলিলাম। ফিরিবার পথে ব্যোমকেশ। বলিল‌, ‘সদানন্দ সুরের খিড়কির দরজা বন্ধ আছে কিনা একবার দেখে যাই।’

খিড়কির দরজা ঠেলিয়া দেখা গেল ভিতর হইতে হুড়কা লাগানো। প্ৰাচীন দরজার তক্তায় ছিদ্র আছে‌, তাহাতে চোখ লাগাইয়া দেখিলাম‌, উঠানের মাঝখানে একটি তুলসী-মঞ্চ‌, বাকী উঠান সুপ্রিয় ভরা। একটা পেয়ারাগাছ এককোণে পাঁচিলের পাশে দাঁড়াইয়া আছে‌, আর কিছু চোখে পড়িল না।

অতঃপর ব্যোমকেশ পাঁচিলের ধার দিয়া ফিরিয়া চলিল। তাহার দৃষ্টি মাটির দিকে। পাঁচিলের কোণ পর্যন্ত আসিয়া সে হঠাৎ আঙুল দেখাইয়া বলিল‌, ‘ও কি?’

অনাবৃত শুষ্ক মাটির উপর পরিষ্কার অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি চিহ্ন; তাহার আশেপাশে আরও কয়েকটা অস্পষ্ট আকাবাঁকা চিহ্ন রহিয়াছে। ব্যোমকেশ ঝুকিয়া চিহ্নটা পরীক্ষা করিল‌, আমরাও দেখিলাম। তারপর সে ঘাড় তুলিয়া দেখিল পাঁচিলের পরপারে পেয়ারাগাছের ডালপালা দেখা যাইতেছে।

বলিলাম‌, ‘কি দেখছি? কিসের চিহ্ন ওগুলো?’

ব্যোমকেশ পটলের দিকে চাহিয়া বলিল‌, ‘কি মনে হয়?’

পটলের মুখ শুকাইয়া গিয়াছে; সে ওষ্ঠ লেহন করিয়া বলিল‌, ‘ঘোড়ার খুরের দাগ মনে হচ্ছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হুঁ‌, ঘোড়া-ভূতের খুরের দাগ। অমৃত তাহলে মিছেকথা বলেনি।’

ফিরিয়া চলিলাম। ব্যোমকেশের ভূ সংশয়ভরে কুঞ্চিত হইয়া রহিল। তাহার মনে ধোঁকা লাগিয়াছে‌, ঘোড়ার খুরের তাৎপর্য সে পরিষ্কার বুঝিতে পারে নাই। চলিতে চলিতে মাত্র দুএকটা কথা হইল। ব্যোমর্কেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘সদানন্দ সুর কতদিন হল বাইরে গেছেন?’

পটল বলিল‌, ‘সাত-আট দিন হল।’

‘কবে ফিরবেন বলে যাননি?’

‘না।’

‘কোথায় গেছেন তাও কেউ জানে না?’

‘না।’

বলরামবাবুর বাড়িতে পৌঁছিয়া চেয়ারে বসিলাম। দর্শকের ভিড় কমিয়া গিয়াছে‌, তবু দু’চারজন অতি-উৎসাহী ব্যক্তি ব্যোমকেশকে দেখিবার আশায় আনাচে কানাচে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। বলরামবাবু আমাদের চা ও জলখাবার আনিয়া দিলেন। পটল দাশু গোপাল প্রভৃতি ছোকরা কাছে দাঁড়াইয়া আমাদের তত্ত্বাবধান করিতে লাগিল।

চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলরামবাবুকে সওয়াল আরম্ভ করিল

‘অমৃত আপনার আপন ভাগনে ছিল?

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘ওর মা-বাপ কেউ ছিল না?’

‘না। আমার বোন অমর্তকে কোলে নিয়ে বিধবা হয়েছিল। আমার কাছে থাকত। তারপর সেও মারা গেল। অমর্তর বয়স তখন পাঁচ বছর।’

‘আপনার নিজের ছেলে।পুলে নেই?

‘একটি মেয়ে আছে। তার বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘অমৃতের কত বয়স হয়েছিল?’

‘একুশ।’

‘তার বিয়ে দেননি?’

না। বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন ছিল না‌, ন্যালাক্ষ্যাপা ছিল‌, তাই বিয়ে দিইনি।’

‘কাজকর্ম কিছু করত?

‘মাঝে মাঝে করত‌, কিন্তু বেশিদিন চাকরি রাখতে পারত না। সান্তালগোলার বড় আড়তদার ভগবতীবাবুর গদিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম‌, কিছুদিন কাজ করেছিল। তারপর বদ্রিদাস মাড়োয়ারীর চালের কলে মাসখানেক ছিল‌, তা বদ্রিদাসও রাখল না। কিছুদিন থেকে বিশু মল্লিকের চালের কলে ঘোরাঘুরি করছিল‌, কিন্তু কাজ পায়নি।’

ব্যোমকেশ কিয়ৎকাল নীরবে নারিকেল-লাড়ু চিবাইল‌, তারপর এক ঢোক চা খাইয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিল, ‘গ্রামে কারুর ঘোড়া আছে?’

বলরামবাবু চক্ষু বিস্ফারিত করিলেন,–ছোকরারাও মুখ তাকাতাকি করিতে লাগিল। শেষে বলরামবাবু বলিলেন, ‘গাঁয়ে তো কারুর ঘোড়া নেই।’

‘কারুর বন্দুকের লাইসেন্স আছে?’

‘আজ্ঞে না।’

নাদু নামে এক ছোকরার কথা শুনেছি‌, তার ভালো নাম জানি না। তাকে পেলে দুএকটা প্রশ্ন করতাম।’

বলরামবাবু ছোকরাদের পানে তাকাইলেন‌, তাহারা আর একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিল; তারপর পটল বিলল‌, ‘নাদু কাল বৌকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে।’

‘শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’

কৈলোসপুরে। ট্রেনে যেতে হয়‌, সান্তালগোলা থেকে তিন-চার স্টেশন দূরে।’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে চায়ের পেয়ালা শেষ করিল। নাদু হয়তো নিরপরাধ‌, কিন্তু সে পলাইবে কেন? ভয় পাইয়াছে? আশ্চর্য নয়; এরূপ একটা খুনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট হইয়া পড়িলে কে না শঙ্কিত হয়?

এই সময়ে একটি ছোকরা বলিয়া উঠিল‌, ‘ওই সদানন্দদা আসছে?’

সকলে একসঙ্গে ঘাড় ফিরাইলাম। রাস্তা দিয়া একটি ভদ্রলোক আসিতেছেন। চেহারা গ্ৰাম্য হইলেও সাজ-পোশাক গ্ৰাম্য নয়; গায়ে আদির পাঞ্জাবি এবং গরদের চাদর‌, পায়ে কালো বার্নিশ অ্যালবার্ট‌, হাতে একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ।

একটি ছোকরা চুপিচুপি অন্য এক ছোকরাকে বলিল‌, ‘সদানন্দদার জামাকাপড়ের বাহার দেখেছিস! নিশ্চয় কলকাতায় গেছিল।’

সদানন্দবাবু সামনা-সামনি আসিলে পটল হাঁক দিয়া বলিল, ‘সদানন্দদা, গাঁয়ের খবর শুনেছেন?’

সদানন্দবাবু দাঁড়াইলেন‌, আমাকে এবং ব্যোমকেশকে লক্ষ্য করিলেন‌, তারপর বলিলেন‌, ‘কী খবর?’

পটল বলিল‌, ‘আমরা মারা গেছে।’

সদানন্দবাবুর চোখে অকপট বিস্ময় ফুটিয়া উঠিল‌, ‘মারা গেছে! কী হয়েছিল?’

পটল বলিল‌, ‘হয়নি কিছু। বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে। কে মেরেছে। কেউ জানে না।’

সদানন্দবাবুর মুখখানা ধীরে ধীরে পাথরের মত নিশ্চল হইয়া গেল‌, তিনি নিষ্পলক নেৱে চাহিয়া রহিলেন। পটল বলিল‌, ‘আপনি এই এলেন‌, এখন বাড়ি যান। পরে সব শুনবেন।’

সদানন্দবাবু ক্ষণেক দ্বিধা করিলেন‌, তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে প্রস্থান করিলেন।

তিনি দৃষ্টিবহির্ভূত হইয়া যাইবার পর ব্যোমকেশ পটলকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘সদানন্দবাবু যখন গ্রাম থেকে গিয়েছিলেন তখন তাঁর হাতে ক্যাম্বিসের ব্যাগ আর স্টীলের ট্রাঙ্ক ছিল না?’

পটল বলিল‌, ‘ঠিক তো‌, হীরু মোড়ল তাই বলেছিল বটে। সদানন্দদা তোরঙ্গ কোথায় রেখে এলেন!’

এ প্রশ্নের সদুত্তর কাহারও জানা ছিল না। ব্যোমকেশ এদিক ওদিক চাহিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল‌, ‘সন্ধ্যে হয়ে এল‌, আজ উঠি। সদানন্দবাবুর সঙ্গে দু’ একটা কথা বলতে পারলে ভালো হত। কিন্তু তিনি এইমাত্র ফিরেছেন–’

ব্যোমকেশের কথা শেষ হইতে পাইল না‌, বিরাট বিস্ফোরণের শব্দে আমরা ক্ষণকালের জন্য হতচকিত হইয়া গেলাম। তারপর ব্যোমকেশ একলাফে রাস্তায় নামিয়া সদানন্দ সুরের বাড়ির দিকে দৌড়াইতে আরম্ভ করিল। আমরা তাহার পিছনে ছুটিলাম। শব্দটা ওই দিক হইতেই আসিয়াছে।

সদানন্দ সুরের বাড়ির সম্মুখে পৌঁছিয়া দেখিলাম, বাড়ির সদর দরজার কবাট সামনের চাতালের উপর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে‌, সদানন্দ সুর রক্তাক্ত দেহে তাহার মধ্যে পড়িয়া আছেন। খানিকটা কটুগন্ধ ধূম সন্ধ্যার বাতাস লাগিয়া ইতস্তত ছড়াইয়া পড়িতেছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *