Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অমৃতা || Bani Basu » Page 15

অমৃতা || Bani Basu

অমৃতা (Amtrita) – ১৫

অরিন্দম ঘোষ অনেকক্ষণ বেরিয়ে এসেছে। এবার অফিস যাবে। মনটা কেন কে জানে কেমন খিঁচড়ে আছে। আকাশটারই মতো। এমনিতে সে খুব রসিক, সরল-তরল লোক। কিন্তু মেজাজ একবার খিঁচড়ে গেলেই তার চেহারা অন্যরকম হয়ে যায়। তার মা বলেন—‘তুই হলি গুমো রাগী। রাগলি যদি তো গুম হয়ে গেলি একেবারে।’ এখন অরিন্দমের সেই অদ্ভূত বিরল রাগটা হয়েছে। মুখটা ফুলে গেছে। কালো দেখাচ্ছে পুরো মানুষটাকে, বিশেষত মুখটা। গাড়িটা যখন তার অফিসের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল, নামতে নামতে সে শুনতে পেল কে যেন বলছে—‘ঘোষ এল।’ আরও খিঁচড়ে গেল মনটা। কেতাদুরস্ত অফিস। দারোয়ান গাড়ির দরজা খুলে সেলাম করে। এয়ার কন্ডিশন্‌ড, বিরাট হলে কর্মরত করণিককুল। কাচে ঢাকা নিজস্ব অফিসে বসে সে ড্রাফ্‌টসম্যানদের করা নকশা দেখে, ভুলগুলো দাগায়, কিছু বদলাতে হলে কম্পিউটার চলে। তার নিজস্ব স্টেনো আছে। টেবিলে দুটো ফোন। এমত অবস্থায় একটু দেরি করে অফিসে এলে কোনও অচেনা-অজানা কণ্ঠ যদি সাবেক কলকাতাই কায়দায় বলে—‘ঘোষ এল।’ তাহলে মেজাজ খিঁচড়ে যাবে না!

এইরকম খিঁচড়োনা মেজাজ নিয়েই সে বিকেলবেলা লাবণিদের বাড়ির পথ ধরল। ইচ্ছে ছিল না। ইচ্ছে ছিল বাড়ি গিয়ে জামাকাপড় জুতো সুদ্ধু মায়ের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। মা বাড়ি ফিরে ব্যাপারটা দেখবে। জ্বলে যাবে একেবারে।—আবার তুই জুতো পরে আমার বিছানায় শুয়েছিস।

—সিগারেটও খেয়েছি। চারদিকে ছড়ানো সিগারেটের টুকরোগুলো আঙুল দিয়ে দিয়ে সে দেখিয়ে দেবে।

ব্যস লেগে যাবে তুমুল ঝগড়া মায়েতে-ছেলেতে। একটু পরেই আসবে বাবা, বলবে—তুমিই তো লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ। এখন বোঝো!

—তাই বলে ও বৃষ্টিভেজা জুতো পরে আমার বিছানায় শোবে? শুতে পারত নিজের বিছানায়। ফুঁকত নিজের ঘরে। আমাকে কেন প্যাসিভ স্মোকিং করানো!

বাবা জানলাগুলো খুলে দিতে দিতে বলবে—এই তো ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে, নিকোটিন, ক্যাডমিয়াম সব, স-ব। কেন যে এগুলো করিস লালটু?

—করো তো সবে, গোঁফ গজানো ফুলটুসদের পড়ানোর চাকরি। আমাদের রেসপন্সিবিলিটির তোমরা কী বুঝবে?—আরও কালো মুখে সে মায়ের বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলবে—রাতদিন তো খবরের কাগজগুলো তোমাদের ফাঁকিবাজির নিন্দে করছে। তবু তো তোমাদের শিক্ষা হয় না?

—তুই, তুই এ কথা আমাদের বললি? —‘আমাদের’টার ওপর জোর দিয়ে বলবেন তার লেকচারার বাবা-মা, না, বাবা আবার রিডার হয়েছেন। ভীষণ আহত তাঁদের গলা।

—বলবে না কেন? গোল্লায় গেছে যে! এক কথায় অমন সোনার চাকরি যে ছেড়ে চলে আসে তার আবার রেসপন্সিবিলিটির গুমোর!

এইরকম একটা সিন হলে তার ভেতরকার চাপা ক্রোধের বজ্রাগ্নি মুক্তি পেত।

কিন্তু তা হবার নয়। আজ আবার সেই ফাজিল ছোকরা, কী যেন নাম! অবন না পবন। লাবণির ভাই—ঢলো ঢলো লাবণি অঙ্গে অবন বহিয়া যায়! সেই ছোকরার জন্মদিন। সে গেলেই ফিচ ফিচ করে হাসবে—‘জামাইবাবু, আপনি অরিন্দমদা হবেন কবে?’ ফক্কড় ফড়নবিশ কোথাকার। তার জন্য আবার একটা ‘সেরা সন্দেশ’ কিনে নিয়ে যাচ্ছে সে। জন্মোদিনের উপহার। পছন্দ হলে হয় এখন। বড় হয়েছে তো যত্ত বাজে কমিক্‌স্ পড়ে, আর টিভি দেখে। হয়তো আশা করবে লেটেস্ট হিন্দি ছবির ভিডিও, কিংবা ‘জীবনমুখী’র সিডি। করলে করুক, সে মনে করেছে একটা চোদ্দো বছরের ছেলের জন্য ‘সেরা সন্দেশ’ একটা সেরা উপহার। কত ঘটাপটা আবার করছে এরা একটা চোদ্দো বছরের দামড়ার জন্যে কে জানে! হয়তো বেলুন আর শিকলি ঝুলিয়েছে অবিকল ক্রিশ্চান কায়দায়, আর সেই ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গাইতে গাইতে কেক-কাটা? উঃ হরিব্‌ল।

গোয়াবাগানে গোড়ালির ওপর অবধি জল দাঁড়িয়েছে। হয়ে গেল! ফিরে যাওয়া যাক। টেলিফোন করে জানিয়ে দেওয়া যাবে জলের জন্যে যেতে পারা যায়নি। বর্ষাকালে জন্মাও কেন বাবা? যদি জন্মালেই তবে উঁচু রাস্তায় বাস করলে না কেন? গাড়িটা ঘোরাবার চেষ্টা করছে, প্রায় বনেটের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই ছোকরা, যার নাম অবন।

—গামবুট এনেছি আপনার জন্যে অরিন্দমদা, রামধনিয়া তখন থেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে বসে পরে নিন। গাড়িটা কর্নওয়ালিসেই থাকুক।

—প্রাণ জল করে দিলে একেবারে। গামবুট নিয়ে কেউ কারও জন্য দাঁড়িয়ে থাকে জীবনে এই প্রথম দেখল শুনল অরিন্দম। মনে হল ‘সেরা সন্দেশে’র প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে—এই নাও হে ক্ষৌণীশ গামবুটে এটা জড়িয়ে নিয়ে বাড়ি যাও।

বলল না অবশ্য। প্যান্ট হাঁটু অবধি গুটিয়ে ঝপাস করে জলে নামল।

—এই এই কী করছেন কী করছেন…বলতে বলতে তার নিষ্ক্রমণ ও গঙ্গাবতরণ হয়ে গেছে।

—গাড়িটা থাকবে তো?

—থাকবে না তো যাবে কোথায়?

—কোথায় যাবে আমি কি জানি! তোমাদের গোয়াবাগান পাড়া তোমরা জানো।

—ইস্‌স অরিন্দমদা, আপনি বকুলবাগানের ছেলে বলে গোয়াবাগানকে এমন ‘দূর ছাই’ করছেন? ভেবে দেখতে গেলে কিন্তু গোয়া অর্থাৎ গো মানে গোরু, বকুলের থেকে অনেকগুণ উপকারী।

মনে হল ছোকরা একটি আস্ত গোরুর রচনাই তাকে শোনাবার যোগাড় করছে।

—চলো, চলো, নিজে তো দিব্যি গামবুট পরেছ।

—বা রে! আপনাকেও তো এনে দিলুম একজোড়া। আমাদের বাড়িতে মোট পাঁচ জোড়া আছে। ব্যাঙে ইয়ে করলেও জল দাঁড়িয়ে যায় কি না।

ছোকরার শালীনতা জ্ঞানে আপ্যায়িত হওয়া গেল। সে জিজ্ঞেস করল—পাঁচ জোড়া কে পরে?

—কেন? আমি, বাবা, দিদি, বড়দি এলে বড়দি আর মা।

—মা-ও গামবুট পরেন?

—পরতে হলে হয় বইকি!

হবু-শাশুড়ির গামবুট-পরা চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই অরিন্দমের এতক্ষণের গুমো রাগ হাসির তোড় হয়ে বেরিয়ে এল। এবং হবু-জামাই-শালা এইভাবে হাসতে হাসতেই বাড়ি ঢুকল। হবু-শাশুড়ি উদ্বিগ্ন হয়ে সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন

—এত হাসি কীসের?

উত্তরে অরিন্দম জিজ্ঞেস করল—আপনিও গামবুট পরেন?

প্রথমটা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেননি ভদ্রমহিলা। তারপর দমকা হাসির তোড়ে তিনিও হাসতে হাসতে কাশতে আরম্ভ করে দিলেন। লাবণি ছিল এসব থেকে দূরে। সে নিজেকে সহজলভ্য করে তুলতে চায় না। বিয়ের আগে অরিন্দমের বাড়ির একজন হয়ে যাওয়াটাও তার খুব পছন্দ নয়। কেন? তা সে বলতে পারে না। বিয়ের আগে থেকেই শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে মাইডিয়ার সম্পর্ক, শালার সঙ্গে গলাগলি—এসব থেকে লোকটা যেন কেমন সস্তা হয়ে যাচ্ছে না? খুব বড় নাকি চাকরি করে, প্রথম দিকের সিঙ্গাপুরি চাকচিক্যে আর একেবারে প্রাথমিক সৌজন্য-বিনিময়ের সময়ে তেমনটাই লেগেছিল। অভিজাত, দূরের মানুষ, দামি মানুষ। নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ কি না এটা নিয়ে ভয়-ভাবনা শুরু হল অমৃতার ব্যাপারটার পরে। কিন্তু ওই ব্যাপারটায় অরিন্দমের স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতি, তার সক্রিয়তা, সপ্রতিভ সংবেদনশীল আচার-আচরণ তাকে একেবারে মুগ্ধ, অভিভূত করে দিয়েছিল। কিন্তু সে আরও কিছু চেয়েছিল। সকলকে এড়িয়ে একটা গোপন চাউনি, একটু হাসি যেটা লাবণি, শুধু লাবণিরই জন্য, এমন কিছু কথা যা তাকে রোমাঞ্চিত করবে, যা তাকে জানাবে অরিন্দমের কাছে সে কত দামি, কত বিশেষ! মধ্যযুগীয় বা রোমান্টিক কায়দার প্রেমনিবেদন সে সম্বন্ধ করে বিয়ের মধ্যে আশা করেনি। কিন্তু তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়বার উদ্দেশ্য নিয়ে যে লোকটা সিঙ্গাপুর থেকে এল, সে হঠাৎ যেন দুম করে সবার হয়ে গেল। তিলকের, চঞ্চলের, নিলয়ের, দোলার, শর্মিষ্ঠার এবং তার বাবার, মা’র, অবনের, বড়দি আর সুজিতদা যখন বাঙ্গালোর থেকে আসবে তখন হয়তো এমনি সাবলীলভাবে তাদেরও হয়ে যাবে। এটাই তার নতুন ভাল-লাগায় কেমন একটা স্যাঁতা ধরিয়ে দিয়েছে।

লাবণি একটা উজ্জ্বল হলুদ লাল সাদা কালোর নতুন বাঁধনি পরেছিল। অবন তার জন্মদিনে নতুন জামাকাপড় পরুক না পরুক, তার দিদি পরবেই। চুলে সে সাধারণত দুটো বিনুনি করে, কাঁধ ছাড়িয়ে আর একটু পর্যন্ত তার ঘন চুলে বেশ মোটা মোটা দুটো বিনুনিই হয়। আজ কিন্তু সে একটা ক্লিপ দিয়ে আলগাভাবে চুলটা আটকে রেখেছে। চোখে কাজলটানা, ওপর পাতায় ম্যাসকারা, আই শ্যাডো, অথচ ন্যাচারাল রঙের লিপস্টিক মেখেছে। আয়নায় নিজেকে দেখে তার মনে হয়েছিল সে খুবই মূল্যবান, দামি মণিমুক্তোর মতো। তারপর জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। না অরিন্দমের জন্য নয়। বৃষ্টি দেখতে। নিজের বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে তার ভীষণ ভাল লাগে। সব বাড়িঘর রাস্তা বৃষ্টির প্রাবল্যে ধোঁয়া-ধোঁয়া, হাওয়ার তোড় অনুভব করা যায় জানলার ভেতর থেকেও। লোকেদের ছাতা বেঁকে যাচ্ছে, উল্টে যাচ্ছে, ছোট ছেলেমেয়েরা পেছনের বস্তি থেকে এসে জমা জলে ঝাঁপাই ছুড়ছে।

এমন সময়ে অবন এসে বলল—কই রে দিদি, অরিন্দমদা তো এখনও এল না?

—এত বৃষ্টিতে কী করে আসবে?—বলে জানলা থেকে সরে এল লাবণি।

—তোর সাজগোজ যে বৃথা যাবে রে!

—ফর ইয়োর ইনফর্মেশন আমি গতবার তোমার জন্মদিনেও এমনি বা এর চেয়েও বেশি সেজেছিলুম। তখন তোমার ওরিন্দমদা পিকচারে ছিল না।

—ফর ইয়োর ইনফর্মেশন দিদি—গত ঘণ্টাখানেক কি তারও বেশি তুই জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছিস।

—ফর ইয়োর ইনফর্মেশন বৃষ্টি হলেই বাড়ি থাকলে আমি এমনি জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখি। বরাবর।

—ঠিক আছে তুই নয়, আমিই ওয়েট করছি। কী আনবে বল তো ওরিন্দমদা আমার জন্য? নিশ্চয়ই ভেবেছে আমরা খুব লোকজন নেমন্তন্ন করেছি, একদিকে উপহার রাখবার টেবিল। বাবা-মা সাজুগুজু করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হিন্দি সিনেমার মতো আসুন বসুন হালুম হুলুম করছে। আর আমি নতুন সাফারি-স্যুট পরে এক হাতে বেলুন আর এক হাতে এয়ারগান নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হেভি সাজগোজ করে আসবে ব্যাটা, দেখিস! ঘিয়ে রঙের শার্ট, চিকিমিকি টাই, নেভি ব্লু, না না গ্রে স্যুট, চকচকে জুতো, সবসুদ্ধ হুড়ুম করে জলে পড়ে যাবে। কেন বল তো? আমি পাশ থেকে একটু ছোট্ট করে ল্যাং মারব।

—এই অবন, ভাল হবে না বলছি—লাবণি চড় তোলে।

তার কথায় কান না দিয়ে অবন বলল—তারপর কাদা মাখামাখি প্যান্তা-খ্যাচাং সেই পান্তভূতকে আমি তোর সামনে কলার ধরে দাঁড় করিয়ে দোব। বলব—সেলাম ঠোকো মেমসাবকো…আভভি ঠোকো!

এইসব বদমায়েশি করতে করতে অবন ঘর থেকে চলে গেল এক সময়ে। লাবণির কানে তখনও লেগে আছে—‘সবসুদ্ধ হুড়ুম করে পড়ে যাবে জলে, কেন বল তো? আমি পাশ থেকে ছোট্ট করে একটু ল্যাং মারব।’ তারপরে নাকি ও কাদামাখা সেই পান্তভূতকে কলার ধরে দাঁড় করিয়ে দেবে তার সামনে, সেলাম ঠুকতে বলবে। ‘সেলাম ঠোকো মেমসাবকো’

ঠাট্টাই। কিন্তু বিশুদ্ধ ইয়ার্কি কী? অবন কি তাহলে বোঝে তার আশা আর আশাভঙ্গ? সে কী চায়, কী চাইতে পারে তা বুঝে ফেলল চোদ্দো বছরের একটা ছেলেমানুষ যে এখনও স্কুলের গণ্ডিই পেরোয়নি, অথচ একত্রিশ বত্রিশ বছরের ওই ধাড়ি বিদেশে চাকরি করা লোকটা বুঝল না! আশ্চর্য!

তবে লোকটা যখন ঝপাস ঝপাস করে এক গোড়ালি জল ঠেঙিয়ে শেষ পর্যন্ত এল, অবনের কাঁধে হাত দিয়ে, প্রবল হাসতে হাসতে, দৃশ্যটা তার ভালই লাগল, নিজেকে অবশ্য সে বলল—দেখো কাণ্ড, আসছে যেন পাশের বাড়ির গুইরাম, হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা, কোনও একটা ইয়ে নেই। এই লোকের সামনে অত বাঁধনি-টাঁধনি ম্যাসকারা-টারার দরকারটা কী? ভূশণ্ডির মাঠের পেত্নীর মতো তলায় একটা গামছা ওপরে একটা গামছা পরে চলে গেলেও ও ওই রকমই হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা করবে। ডিফারেন্সটা ধরতে পারবে না। এই সময়ে সে শুনতে পেল নীচের সেই অট্টহাসি, অবন আর ওই লোকটা তো আছেই, তার ওপরে মা তার সেই বিখ্যাত প্লেন টেক-অফ করার মতো হাসিটা হাসছে। সম্মিলিত হাসির মধ্যে থেকে প্রত্যেকটি স্বর, প্রত্যেকটি হাসির আলাদা স্টাইল চেনা যাচ্ছে। হাঁচির মতো হাসিও খানিকটা ছোঁয়াচে। তাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও সে খানিকটা হেসে ফেলল, তারপরে গোপন চোখের জল মোছার মতো করে হাসিটুকু মুছে ফেলল।

অরিন্দমের পা ধোওয়া, গোটানো প্যাণ্ট নামানো, ভিজে জবজবে জুতো মোজা পাখার তলায় দাঁড় করিয়ে শুকোতে দেওয়া, এক দফায় শরীর ওম্‌ করার চা খাওয়া, এ সমস্ত হয়ে যাবার পরও যখন লাবণি নামল না, লাবণির মা বনানী তখন মনে মনে একটু শঙ্কিত হলেন। বেশিরভাগ মা-ই তাঁদের মেয়েদের চেনেন। পড়া বইয়ের মতো আগাপাশতলা চেনা নয়, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো চেনা। লাবণি যে সম্প্রতি অরিন্দমের ওপর একটু বিরূপ এটা তিনি কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু কেন সে সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না। অরিন্দম ছেলেটিকে তিনি যতটা প্রত্যাশা করেছিলেন, তার চেয়েও বেশি ভাল লেগে গেছে তাঁর। এত নেটিপেটি, ঘরের ছেলের মতো আচার-আচরণ, সবচেয়ে চমৎকার হল তার রসবোধ, এখনই সে তাঁদের নিজস্ব পারিবারিক রসিকতাগুলোতে দিব্যি যোগ দিতে পারছে। হবু-শ্বশুরবাড়ির মধ্যবিত্ত পুরনো পাড়ার পুরনো পরিবেশে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে। মনেই হয় না এই ছেলে এখান থেকে সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি করে আবার আমেরিকার ডিগ্রি নিয়েছে, সেখানে কিছুদিন চাকরি করে সিঙ্গাপুরে চলে এসেছে। অবশ্য, একটা জিনিস থেকে ছেলেটির মনটা বোঝা যায় খুব। বাবা-মা দুজনেই অধ্যাপক। এবং এই এক ছেলে তাঁদের। বাবা-মা’র কাছাকাছি, কলকাতার কাছাকাছি থাকবার জন্যে ও সিঙ্গাপুরে চাকরি নিয়েছিল। বাবা-মা’র জন্যে যে ছেলের এত টান, অন্যদের জন্যও তার টান থাকা স্বাভাবিক। অবশ্য এক ছেলের বউয়ের অনেক সমস্যা হয়, এটাও তাঁর জানা আছে, কিন্তু থাকবে তো সিঙ্গাপুরে। তাঁর বড় জামাইও এমনি এক ছেলে, কিন্তু থাকে বাঙ্গালোরে। সিঙ্গাপুরের চাকরিটা অরিন্দম ছেড়ে দেওয়ায় তিনি একটু ঘাবড়ে গেছেন। মেয়েকে তা হলে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতে হবে! কে জানে তাঁরা কেমন লোক! বাইরে থেকে তো অতি ভদ্র সজ্জন বলে মনে হয়। এই যে বিয়ের আগেই লাবণিদের পরিবারের সঙ্গে অরিন্দমের এত মাখামাখি, এটা কি ওঁদের সায় ছাড়া সম্ভব ছিল? ওঁদের সঙ্গে খুব একটা আসা-যাওয়া না থাকলেও ফোনে কথা হয়। ওঁরাও নিজেদের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে ছেলের ওপর খবরদারি করবার ইচ্ছে বা উপায় কোনওটাই নেই মনে হয়।

কিন্তু দুঃখটা এই, বেশিরভাগ সময়েই মায়ের পছন্দে মেয়ের পছন্দে মিল হয় না। মা চান ছেলে, মেয়ে চায় পুরুষ। মা দেখেন শীল, মেয়ে দেখে রূপ৷ নিজের মায়ের অনুগত একটি অতি ভদ্র বিনয়ী অমায়িক ছেলেকে যে একটি মেয়ের পছন্দ হবেই তার কোনও মানে নেই। বেশিরভাগ সময়েই হয় না। কেন কে জানে! কী স্বপ্ন, কী প্রত্যাশা থাকে মেয়ের মনে যা তার নিজের মায়ের অনুগত পুরুষ পূরণ করতে পারে না?

বনানী বুঝছিলেন—অরিন্দম যত তাঁদের কাছাকাছি হচ্ছে, লাবণি তত দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু বুঝছিলেন হৃদয়ের একটা অস্পষ্ট বোধ দিয়ে। মগজ দিয়ে নয় মোটেই। তাই তিনি একটু উদ্বিগ্ন, উদ্‌ভ্রান্ত বোধ করছিলেন। কী করে অরিন্দম তাঁর মেয়েকে সন্তুষ্ট করবে তার জন্য অরিন্দমের থেকে তিনিই বেশি ব্যাকুল। আরে বাবা, আজকালকার দিনে একটা ভাল ঘরের ভাল রোজগেরে, স্বাস্থ্যবান, ডিগ্রিমান ছেলেকে জামাই পাওয়া কি সোজা কথা? আর এ তো আশার অতীত পাওয়া। বড় জামাই সুজিতকে তো তাঁর মোটেই পছন্দ নয়। মুখের কাছটা কেমন বাঁদর-বাঁদর। মাথার চুল এখনই পাতলা হয়ে এসেছে। তার ওপরে এত গম্ভীর, এত অন্যমনস্ক যেন তার চেয়ে পণ্ডিত আর পৃথিবীতে কেউ নেই, শ্রাবণীর ক্রেডিট আছে এই লোকের সঙ্গে সে বারো মাস তিরিশ দিন ঘর করে। একেক সময়ে তাঁর মনে হয় অরিন্দমকে দেখলে, তার সঙ্গে মিশলে শ্রাবণীর যদি অভিমান হয়? আমার বেলা এক টাক-মাথা পণ্ডিতকে জুটিয়ে দিলে, কী না মস্ত বিদ্বান, য়ুনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর! অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নিয়ে কি ধুয়ে খাব? বোনের বেলায় বেশ রূপবান, সুরসিক, চমৎকার পছন্দসই জামাই জোগাড় হল। হতেই পারে। বনানীরও আসলে এমনি হয়েছিল। তাঁর স্বামী একটু বেঁটে, কালো, তাঁর তো শুভদৃষ্টির সময়ে কান্নাই পেয়ে গেছিল। পরের দুই বোনের বেলা বাবা-মা দিব্যি ফুটফুটে জামাই খুঁজে নিয়ে এলেন। অভিমানও নয়, রীতিমতো রাগই হয়েছিল তাঁর সে সময়টায়। মেজ বোনের বিয়ের বউভাত বা ফুলশয্যায় তিনি যানইনি, হিংসায়। ছোট বোনের বেলায় অবশ্য আরও একটু পরিণত হয়েছিলেন, কাজেই রাগ ঝাল অভিমান কাউকে বুঝতে দেননি। তবে এখন তো তাঁর মা-বাবার তিন জামাই এ বলে আমায় দ্যাখ ও বলে আমায় দ্যাখ। মেজ ভগ্নিপতির সে রং কবে জ্বলে গেছে, মাথাটি ডিমের মতো। এত চকচকে যে তাতে মুখ দেখা যায়, লম্বা হলে কী হবে একটু কোলকুঁজো মতো হয়ে গেছে এখনই, ছোট জনের টাব্বুশ ভুঁড়ি, বেখাপ্পা বেমানান, তার বউই তার নাম দিয়েছে ভুঁড়িদাস৷ সে তুলনায় তাঁর স্বামী অনেক ভাল আছেন, শক্তপোক্ত গাঁটাগোট্টা, মাথায় পাকা চুল খুঁজতে হয়, এখনও ব্রাশ দিয়ে চুল টানতে হয়। আসলে যার ভাগ্য তার তার।

তিনি অরিন্দমকে খুব যেন হালকা সুরে বললেন—কী? একবার ওপরে গিয়ে দেখবে না কি! লাবুটার কত দেরি আর?

অরিন্দম একটু ইতস্তত করছে, অবনের দিকে তাকাচ্ছে দেখে তিনি এ-ও বললেন—যাও না, ওপরে ওদের ঠাকুমাও রয়েছেন, একটু দেখা করে আসবে অমনি। অবন তুই একবার তোর বাবাকে ফোন কর তো—কেন এত দেরি করছে? কাকিমাকেও করবি—বলবি জল নেমে গেছে। আর যেন দেরি না করে ওরা।

অর্থাৎ অবনকে তিনি ব্যস্ত করে দিলেন। ফোনটা একতলার বৈঠকখানা ঘরে আছে। ঠাকুমার উল্লেখে দোতলায় একা লাবণির কাছে একা অরিন্দমের যাত্রাটাও নির্দোষ দেখাল বেশ।

অরিন্দম যেতে যেতে বলে গেল—কী আর করবে, গামবুট পরছে বোধহয়।

আর একটু হাসি হল।

লাবণি অবশ্যই গামবুট পরছিল না। সে খুব যত্ন করে, অশেষ মনোযাগ দিয়ে নেল ফাইল করছিল। একবার এদিকে, আবার ওদিকে। নখগুলোকে আজ এই মুহূর্তেই ওকে সুগোল চিকন করে ফেলতে হবে যেন।

—কী ব্যাপার, লাবণি?

দোতলায় উঠলেই লাবণি-অবনের ঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়। দুদিকে দুটো সিঙ্গল খাট, মাঝখানে একটা ড্রেসিং টেব্‌ল। সম্ভবত লাবণির মায়ের বিয়ের যৌতুক, এখন মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ায়, সাজুনি মেয়ের ঘরে ট্রান্সফার্ড হয়েছে জিনিসটা। এই ড্রেসিং-টেব্‌লের সামনেই একটা টুলে বসে লাবণি নেল ফাইল করছিল।

—কী আবার ব্যাপার হবে?

—অনেকক্ষণ এসেছি। নামছ না! নীচে কত মজা হয়ে গেল।

—তা মজা করুন না। থামলেন কেন?

—আরে তুমি না এলে মজা হয়?

—কেন? আমি কি ক্লাউন? আপনার ইয়ার্কির পাত্র?

—রাগ হয়েছে মনে হচ্ছে! কার ওপর? আমি কিন্তু কিছু করিনি, আমার ওপর নিশ্চয়ই নয়। অবন ঠাকুরের আজ জন্মদিন, তার ওপরও রাগ করা যায় না। তা হলে? তা হলে বাকি রইলেন মা বাবা আর ঠাকুমা। ঠাকুমা বেচারি নিজের ঘরে নিজের মনে আছেন, চোখে ভাল দেখতে পান না। তাঁর ওপর আর কে রাগ করবে? তবে কি বাবা? উঁহুঃ, আমার এক্সপিরিয়েন্স বলে বাবাদের সঙ্গে ঝগড়া হয় না।—এইবার ধরেছি ঠিক। মা, নয়?

—যান না, যান, আপনি আমার মাকেই বিয়ে করগে যান।—মুখ ফসকে রাগটা বেরিয়ে গেল। কথাটা বলেই লাবণি মনে মনে জিভ কামড়েছে। ছোঁড়া তীর আর বলা কথা তো ফেরানো যায় না, কী করে লাবণি? কী করে? একটা অত্যন্ত অভব্য, অমার্জিত, গর্হিত কথা বলে ফেলেছে একজন অল্প আলাপি ভদ্রলোককে। সে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

অরিন্দম একটা মস্ত ধাক্কা খেয়েছিল। এ কি রে বাবা? এ কী ধরনের কথা! এ তো একটা নেহাত বাচ্চা ছেলেমানুষ! য়ুনিভার্সিটি ক্যান্টিনে যে লাবণিকে দেখেছিল একটি সহপাঠিনী মেয়ের জন্য উদ্বিগ্ন, অনেক নির্ভরযোগ্য, অনেক পরিণত মানুষের মতো লেগেছিল তাকে। আর আজ এ কাকে সে দেখল? নীচে মায়ের সঙ্গে বেশি গল্প করেছি বলে ঈর্ষা? এ তো সাঙ্ঘাতিক গোলমেলে ব্যাপার!

সে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল! লাবণি চোখ মুছতে মুছতে বলল,

—সরি, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

—কিন্তু লাবণি তোমার এ রকম অদ্ভূত রি-অ্যাকশান হল কেন?

—আই ডিডন’ট মীন ইট। প্লিজ ও কথা আর তুলবেন না। আসলে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে কদিন।

—কেন?

—অমৃতার জন্য—লাবণির অন্তরাত্মা বুঝে নিয়েছে একটা অভব্য, অযৌক্তিক আচরণকে কাউন্টার করতে একটা খুব মানবিক, ভব্য, যুক্তিপূর্ণ কিছু বলতে হবে। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো আপনা-আপনিই হয়ে যায়। এটাকে বলা যায় স্বতঃক্রিয়া। অমৃতার জন্যে এই মুহূর্তে তার কোনও দুর্ভাবনা নেই। অমৃতার ব্যাপারটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে এখন। সয়ে গেছে। কিন্তু তবু সে কেমন করে যেন বুঝে গেল এই মুহূর্তে এই কথাটা বলা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই।

অরিন্দম বলল—কেন শুধু শুধু মন খারাপ করছ? অমৃতা ভাল আছে। এই তো আজই গিয়েছিলাম। দেখলাম খুব পড়ছে। পড়ে পড়ে ক্লান্ত একেবারে।

ও, ইনি আজই অমৃতার কাছে গিয়েছিলেন? কথার ধরন শুনলে মনে হয় প্রায়ই যান। অমৃতার কাছে যাওয়াটাই এঁর দস্তুর। নিয়মিত অতিথি একজন। বাঃ! অফিস ছিল না? অফিস কেটে অমৃতার কাছে গিয়েছিলেন? তারা যেমন ক্লাস-কেটে সিনেমা যায় কি বয় ফ্রেন্ড গার্ল ফ্রেন্ডদের সঙ্গে মিলতে যায়? তা হলে এই জন্যেই ইনি সিঙ্গাপুরের চাকরিটা ছেড়েছেন? অমৃতার কাছে ফ্রম টাইম টু টাইম যাবেন বলে? অমৃতার ব্যাপারটাতে ইনি আগ্রহী হলেন তার জন্য, সে লাবণি ভয় পেয়েছিল বলে, তাকে বোঝাতে যে ইনি একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ, আর এক অরিসূদন নন। তো সবাই মিলে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, মোটামুটি জানা গেছে যে অমৃতা এখন নিরাপদ। শিগগিরই তার কেস উঠবে। অরিসূদনের করা কেস। ব্যস, মিটে গেল। ইনি কেন নিয়মিত সেখানে যান? এঁর তো লাবণির কাছেই নিয়মিত আসার কথা!

কী আছে অমৃতার? ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্রী শর্মিষ্ঠা, সবচেয়ে সুন্দরী লাবণি, সবচেয়ে মজাদার ভাল লাগবার মতো মেয়ে দোলা। অমৃতা কে? অমৃতা কী? কেন প্রোফেসররা বেশির ভাগই অমৃতা-অমৃতা করেন? লম্বা, ফর্সা, কাঠ কাঠ চেহারা, তিন কোনা মুখ, চোখ মুখের এমন কিছু শ্ৰী-ছাঁদ নেই। হ্যাঁ এখন এটাই বলা যায় ক্লাসের সবচেয়ে দুর্ভাগা মেয়ে অমৃতা। এইটাই তার বিশিষ্টতা। তো এই দুর্ভাগ্যকে তো সে ভালই ব্যবহার করছে দেখা যাচ্ছে। একজন নামকরা ডাক্তার-সুদ্ধু একটা গোটা নার্সিংহোম, একটি বহুজাতিক সংস্থার এঞ্জিনিয়ার, কোথায় কার কাছে রয়েছে এখন, তাকেও, অনেককেই পাকড়েছে দুর্ভাগ্যের টোপ ফেলে।

এত রাগ, এত নৈরাশ্য, এত বিদ্বেষ হচ্ছিল তার যে বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছিল। রগগুলো দপদপ করছিল। মনে হচ্ছিল ড্রেসিং টেব্‌লে সাজানো তার প্রসাধন দ্রব্যগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, যেন সেগুলো সব গিয়ে পড়ে অমৃতা আর তার সো-কল্‌ড্‌ দুর্ভাগ্যের ওপর। ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে অরিন্দমের গাল কি বুক কি যে কোনও খোলা জায়গা হাঁউ-মাউ করে কামড়ে দিতে যাতে তার ষোলো-ষোলো বত্রিশটা দাঁতের দাগ বসে যায় সেখানে।

এমন তার কখনও হয়নি, কক্ষনো না। সুন্দরী বলে, বরাবরই সে স্কুল-কলেজ-য়ুনিভার্সিটি, বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন সব জায়গাতেই খুব প্রশ্রয় পেয়েছে। নিজের চেহারা সম্পর্কে তার অহঙ্কার থাকলেও সে এত বোকা নয় যে নিজেকে নিজের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মনে করবে। সৌন্দর্য নিয়ে সত্যি কথা বলতে কি তার আকাঙক্ষারও শেষ নেই। অন্যদের দেখে খালি মনে হয় ইস্‌স্‌ ওর ওইটে কী ভাল! যদি হত দোলার মতো রঙ। অমৃতার মতো ফিগার! যদি হত সুদীপার মতো টোল, অণিমার মতো চুল… নিজেকে নিয়ে মোটেই সে সন্তুষ্ট ছিল না। তাই সে ভাবে অহঙ্কারও সে কোনওদিন অনুভব করেনি, কিন্তু সচেতনভাবে কাউকে ঈর্ষা করার জায়গায়ও ছিল না সে। নিজের ভেতরের এই ক্রোধ-হিংসা-দ্বেষের প্রাবল্যও তার একেবারে অচেনা।

কিন্তু, তাই বলে তো সে সত্যিই প্রসাধন দ্রব্যগুলো, ময়শ্চারাইজার, নারিশিং ক্রিম, ট্যালকাম পাউডার, লিপস্টিক এগুলো ছুড়ে ছুড়ে ফেলতে পারে না, পারে না অরিন্দম ঘোষকে কামড়ে দিতেও। তাই সে মুখে বলল—ঠাকুমা আপনার সঙ্গে কথা বলবে বলে বসে আছে। যান না। আমি একটু পরে যাচ্ছি।

আর, লাবণির ঠাকুমার ঘরের দিকে যেতে যেতে অরিন্দমের আবার ফিরে এল সেই বদমেজাজ। সেই কালো ভিমরুলের চাকের মতো মুখ। এতই গম্ভীর, এত অস্বাভাবিক যে সে যখন নীচে নেমে এল, তার মুখ দেখে লাবণির মা তো বটেই, লাবণি নিজেও ভয় পেয়ে গেল। দুজনেই মনে করল লাবণির ব্যবহারের জন্যই এই গাম্ভীর্য, রাগ। কিন্তু তা নয়, লাবণির কাকা-কাকিমা আর তাঁদের একটি ছেলে একটি মেয়ে এল, ভাল করে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারল না অরিন্দম। বনানী আগেই জাকে বলে রেখেছিলেন খুব হাসিখুশি, মিশুকে, হুল্লোড়ে তাঁর হবু ছোট জামাই। জা যাবার সময়ে বলে গেলেন—কই দিদি তুমি যে বলেছিলে হাসিখুশি? এ তো দেখছি রামগরুড়ের আরেক অবতার, মনে কিছু করো না দিদি, লাবু তো অমন গম্ভীর লোকের সঙ্গে থাকতে গেলে হাঁপিয়েই মরে যাবে।

বনানী আমতা আমতা করে বললেন—না রে সত্যিই ও খুব হাসিখুশি, আজকে এলও তো খুব হাসতে হাসতে অবনকে জিজ্ঞেস কর।

লাবণির বাবা বললেন—মাথার ওপর কত দায়িত্ব এই বয়সেই। হঠাৎ হয় তো অফিসের কোনও প্রবলেম মনে পড়েছে…

বাবা যা-ই বলুন লাবণিকে তার মা সে রাতে শুধু মারতে বাকি রাখলেন।

—হাসতে হাসতে এল ছেলেটা, মুখে যেন আলো জ্বলছে। কী এমন তুমি বলেছ যে মুহূর্তে তার মেজাজ পাল্টে যায়! সুন্দরী-সুন্দরী করে লোকে মাথায় তুলেছে, মনে কোরো না তুমি দারুণ একটা কিছু। তোমার মতো চটকদার মেয়ে এখন কলকাতার রাস্তায় হুদো হুদো ঘুরছে। ওর কাছে তুমি কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, শুনে রাখো আমার এই কথা, আমি মা হয়ে তোমাকে বলছি—এমন বর তুমি ভূ-ভারতে আর কোথাও পাবে না। তোমার অনেক ভাগ্য যে আকাশের চাঁদ আমাদের হাতে ধরা দিয়েছে। তোমার অসভ্যতায় ও যদি চলে যায় তা হলে একটা মর্কট ছাড়া কিচ্ছু জুটবে না তোমার।

এত সব কড়া কড়া প্রাণ বিঁধোনো কথাও লাবণি কোনওদিন তার মায়ের কাছ থেকে শোনেনি। কিন্তু সে জানে সে কী করেছে, কী বলেছে। কেন অরিন্দম অমন পাল্টে গেল৷ সে দোষী, নিঃসন্দেহে। কী কথায় অরিন্দম রাগ করল তা তো সে কোনওদিন মাকেও বলতে পারবে না! মায়ের তিরস্কারের উত্তরে সে শুধু নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।

অবশেষে অবনই বলল—দিদি আর কাঁদিসনি। তোর চোখ মুখ ফুলে গেছে। অরিন্দমদাটা একটা আস্ত পাগল!

অরিন্দম জানে না তার মেজাজ কেন হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। লাবণি একটা বিশ্রী কথা বলেছিল সত্যি, কিন্তু তারপর তো সে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে। লাবণিকে সে সান্ত্বনাও দিয়েছিল। তখনও লাবণি চুপ করে ছিল, তার মন খারাপ যায়নি, কিন্তু সেটা কোনও ব্যাপার না। তাতে তো তার রাগ করবার কিছু থাকতে পারে না। আর ওইরকম খারাপ মেজাজ! লাবণির কাকা-কাকিমার সঙ্গে আজ তার প্রথম দেখা হল, অথচ সে ভাল করে একটা কথাও বলতে পারল না। ওঁদের ছেলেমেয়ে দুটিকে তো স্রেফ ইগনোর করল। ভাল ভাল রান্না করেছিলেন লাবণির মা,—সে তো একটু নাড়াচাড়া করে উঠে এল। নিজে ওঁদের সঙ্গে অভদ্রতা করেছে বলে দ্বিগুণ তিক্ততায় তার মন ভরে আছে।

স্টিয়ারিং-এ হাত, আপনাআপনি যান্ত্রিকভাবে ঘুরছে, গিয়ার চাপছে, মন অন্যত্র, খুঁজছে, খুঁজছে, সকালের বদমেজাজ আর এই রাতের বদমেজাজ একই জাতের। কেন? কেন? কী? তারপর হঠাৎ সে লাবণির সঙ্গে তার কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে পিছু হাঁটতে হাঁটতে কারণটা পেয়ে গেল। অমৃতা। অমৃতার প্রসঙ্গ। সকালে সে অমৃতার কাছে তার বাবা-মায়ের পাঠানো চিঠি নিয়ে গিয়েছিল। আশা করেছিল কত খুশি হবে অমৃতা, কত কৃতজ্ঞতা জানাবে তাকে, বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলবে, সে দুঃখ আর বিষাদ থেকে অমৃতার মন অন্য দিকে ফেরাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু না, সে সব কিছুই ঘটেনি। সামান্য কিছু কথাবার্তা, অমৃতার নিঃশব্দ কান্না, তার পর অমৃতা এমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল যে সে একটা মানুষ যে অতক্ষণ ধরে চুপচাপ তার সামনে বসে আছে, এটা পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে গেল। সে যখন—‘আজ আসি। অফিস যেতে হবে’ বলে উঠে পড়ল তখন অমৃতা ঠিক সেইরকম অন্যমনে যান্ত্রিকভাবে ঘাড় নাড়ল। তার যাওয়া অথবা আসা কোনওটাই অমৃতার মনে বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারেনি। তাই, তাই তার অমন অমানুষিক মেজাজ খারাপ হয়েছিল। ইগো কী? ইগো আহত হয়েছে বলে? না, না, না বোধহয়। তারপর সে সেই ভয়ানক উপলব্ধির সম্মুখীন হল। সে ভালবাসে। না লাবণিকে না, আর কাউকেই না, শুধু অমৃতাকে, শুধু অমৃতা, শুধু অমৃতা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress