অমূলক কাহিনি নয়
ছেলে এসে ষষ্ঠীচরণকে ধরল—‘পড়ানো শুরু হয়ে গেছে বাবা, এখনও তুমি আমার বইগুলো কিনে দিলে না? পড়াশোনার ভারি ক্ষতি হচ্ছে কিন্তু।’
‘দে তো। দেখি তোর বইয়ের লিসটি।…নেসফিল্ডের গ্রামার, ট্রানস্লেশন ম্যানুয়াল, যাদব চক্কোত্তির পাটীগণিত, কে পি বোসের অ্যালজেবরা, ব্যাকরণ কৌমুদী…ও, এইসব? এসব তো আমার জানা রে! আমাদের সময়েও ছিল। কেবল একটা বই নতুন দেখছি—বাঙালি জাতির ইতিহাস। আচ্ছা, লিসটিটা থাক আমার কাছে।’ বলে বাবা বইয়ের তালিকাটা হাতের তেলোয় রাখেন।
‘কবে দিচ্ছ কিনে?’ ছেলে তাগাদা লাগায়।
‘দেব রে দেব, এত তাড়া কীসের? এমন ব্যস্ত কেন? এই স্কুলের ফাংশনটা হয়ে যাক-না। তারপরে দিলেই হবে।’
‘ওব বাবা! সেযে অনেক দেরি।’ ব্যয়কুন্ঠিত বাবাকে সেঅব্যয়রূপ প্রয়োগ করে।
‘আহা, তাতেও ফের আমায় একগাদা বই দিতে হবে যে! ইশকুল কমিটি ধরেছে। আমি হচ্ছি ইশকুলের প্রেসিডেন্ট, আর আমার একটা প্রাইজ থাকবে না? ছেলেরা সবাই আশা করে রয়েছে? তাদের কি আমার কাছে কোনো দাবি নেই? কথাটা আমি ভেবে দেখেছি—’
‘তুমি—তুমিও তাহলে প্রাইজ দিচ্ছ বাবা?’ বরদা বাবার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।—‘দেবে তাহলে এবার?’
‘দিতেই হবে। না দিলে ছাড়বে না।’ ক্ষুব্ধ কন্ঠ শোনা গেল বাবার—‘সবাই বলছে গোবিন্দপুর হাই স্কুলের সভাপতি শ্রীষষ্ঠীচরণ ধাড়ার কোনো পুরস্কার নেই এ কী কথা? এ কেমন সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার? আমি যত বলি যে সভাপতি হয়ে আপনাদের সেবা করছি—সেবা করার এই সুযোগ পেয়েছি এই তো আমার পুরস্কার। চরম পুরস্কার। কিন্তু তারা তা শুনছে না। মোটেই না। বলছে, এ তো গেল আপনার পুরস্কার—কিন্তু আ-প-না-র পুরস্কার কই? তার মানে, আমাদের পুরস্কার কোথায়? আমাদের, মানে, তাদের পুরস্কার! নাও ঠেলা!’
‘তুমি কী পুরস্কার দেবে শুনি?’
‘দ্যাখ-না, বইয়ের তালিকা দিয়েছে একখানা। এইসব আমায় দিতে হবে। একটা পুরস্কারেই এই গাদা খানেক বই। দ্যাখ-না।’ এই বলে তালিকা দেখে তিনি আওড়াতে থাকেন—আম আঠির ভেঁপু, খাই খাই—এ আবার কী বাই রে বাবা! এ ছাড়াও ছেলেবেলার গল্প, আবোল তাবোল—তা ছেলেদের গপপো যে আবোল তাবোল হবে তা কে না-জানে!— তা কি আবার বই লিখে বলতে হয়? তারপরে ফের এই দ্যাখ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেরা গল্প, অচিন্ত্যকুমারের সেরা গল্প, আধসেরা একটাও না, সব সের সের ওজনের—ভারী ভারী বই—বেশ দামিই হবে মনে হয়। এরপর পোয়াটেক, এক ছটাকি, কাচ্চা বাচ্চা আরও বিস্তর আছে। তালিকার মধ্যে তারা বিস্তারিত থাকে—সেগুলির উল্লেখ তিনি বাহুল্য বোধ করেন।
‘দেবে তুমি এসব?’ বরদাচরণের চোখ বড়ো বড়ো হয়। এমন বাবাকে সেকখনো দেখেনি। বাবার এহেন বরদাতা রূপ তার কল্পনারও অতীত। স্বপ্নেও সেভাবতে পারে না।
‘দিতেই হবে। না দিলে কি রেহাই আছে?’ দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে বাবার।—‘ছাড়ান আছে নাকি আমার?’
‘দাও-না, বেশ তো। দিলে খুব নাম হবে তোমার। তা, আমার পড়ার বইগুলো তুমি না-হয় প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের পরেই দিয়ো।’ পৈতৃক খ্যাতিলাভের খাতিরে ছেলে নিজের স্বার্থত্যাগ করতে দ্বিধা করে না। অম্লানবদনে নিজের দাবিকে দাবিয়ে রাখে।
‘হ্যাঁ রে বদু, আবৃত্তি-টাবৃত্তি আসে তোর?’ বাবা জিজ্ঞেস করেন একসময়। —‘রেসিটেশন করতে পারিস?’
‘কেন বাবা?’
‘তাই জিগেস করছি। আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কারটাই দেব কিনা আমি। তাই ভাবছিলাম, তুই যদি ওই প্রতিযোগিতায় নাম দিস, নামতিস যদি, তাহলে ঘরের জিনিসগুলো ঘরেই আসত—বেঘোরে মারা যেত না। বইগুলো তুই-ই পেতিস তাহলে। বেহাতে যেত না নেহাত।’
‘প্রথম হতে পারলে তো? সেআর আমায় হতে হয় না। সোমনাথ আছে, চিত্রক আছে, মানস, কৈলাস এরা রয়েছে। তাদের সঙ্গে আবৃত্তিতে পারবে কে? তারা সব পয়লা নম্বরের!’
বাবার কথায় বরদা তেমন উৎসাহ পায় না।
‘আরে, প্রাইজ তো দেব আমি। আমার পুরস্কার আমিই দেব। বিচার করবার ভার আমার। আমি যদি তোকে দিই—কে আটকায়? তুই তাহলে আবৃত্তিতে নামছিস, নামছিস তো? কেমন?’
নামছিস বললেই নামা যায় না। এ কিছু নামতা আবৃত্তি নয় যে, দুয়েক্কে দুই, দু-দুগুণে চার। ধারাপাত আওড়ানো না। শ্রীমান বরদাচরণ ধাড়াকে পাত করলেও তার গলা থেকে সে-বস্তু গলানো যাবে কি না সন্দেহ। আবৃত্তি মানেই তো একটা একটানা বক্তৃতা, কিংবা লম্বাচওড়া কবিতা একখানা। গেলানোর পরের কথা, ওগলানো; কিন্তু তার আগে গেলানোই দায়। বক্তৃতা কি কবিতা সেমুখস্ত করতে পারলে তো? মুখের বার করা তো তার পরের ধাক্কা।
বাবা কিন্তু নাছোড়বান্দা। উৎসাহদানে তাঁর কার্পণ্য নেই—‘যেমন-তেমন করে শুধু তুই আউড়ে যাবি তাহলেই হবে। আওড়ানো নিয়ে কথা। বিচারের ভার তো আমার ওপর। আমার প্রাইজ আমি যাকে খুশি দেব। কে কী বলতে পারে? নিজের ছেলে বলে কি রেয়াত করতে হবে না কি? তুই কিচ্ছু ভাবিসনে, মুখ বুজে শুধু বলে যাস, আমি চোখ বুজে দিয়ে দেব। চক্ষুলজ্জা রাখলে, কি, মুখচোরা হয়ে থাকলে—কখনো কোনো কাজ করা যায় না। তা, বড়ো কাজ, মেজো কাজ আর ছোটো কাজ—যে কাজই বল তুই!’
বরদাচরণ ভাবে ওর আবৃত্তি, আর ওর বাবার প্রবৃত্তি। এই দুয়ের যোগে, অযোগ্য হলেও, প্রাইজগুলো ওর কপালে লাগতে পারে। এমন অঘটন কি হয় না? যেমন করে ঠাণ্ডা লাগে, সর্দি লাগে, খিদে লাগে, তেমনি করে—অভাবিত ভাবে—প্রাইজ লাগা কি এতই অসম্ভব? আর ওই বইগুলোর—অমন সব বইয়ের কথা ভাবলে লোভ হয় সত্যিই!
বরদাচরণ বাবার কথামতো আচরণে রাজি হয়। এ বছর ষষ্ঠীচরণ ধাড়া প্রাইজ দিচ্ছেন এ-সংবাদে সাড়া পড়ে গেল ইশকুলে। শুধু ইশকুলে নয় সারা তল্লাটে। তস্যপুত্র শ্রীবরদাচরণও আবৃত্তিতে এবার নাম দিয়েছে, এ খবরও জানতে বাকি থাকল না কারও। সেই সঙ্গে, ষষ্ঠীচরণের পুরস্কার যে বরদাচরণের মাঠেই মারা যাবে—এই গুপ্তকথাও কানাকানি হয়ে রটে গেল কীরকম করে।
সোমনাথ, চিত্রক, কৈলাস এদের কানেও গেল কথাটা। তারাও কিছু চিত্রপুত্তলিকার মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার ছেলে নয়। সোমনাথ বললে—‘দাঁড়াও। দেখাচ্ছি মজা। দেওয়াচ্ছি পুরস্কার।’
‘দাঁড়াতে হবে না। ষষ্ঠীচরণের ঠ্যাং ভেঙে দেব। তবে আমার নাম কৈলাস। পিটিয়ে যদি লাশ না বানাই ওকে তো কী বলেছি।’
মানস বললে—‘না না, ওসব নয়। মারধরের মধ্যে আমি নেই বাবা। আমি অন্য মতলব ঠাউরেছি। শোন বলি—’ বলে নিজের মনের কথাটা জানায়।
পুরস্কার বিতরণের দিন।
বরদাচরণ চন্দ্রগুপ্ত বই হাতে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার মতো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, বাড়ির পাশে আসতেই মানস তাকে ডাকল।
‘শুরু হবার এখনও ঢের দেরি, আয়, চারটি মুড়ি খেয়ে যা।’
‘না ভাই, এখনও আমার মুখস্থই হয়নি ভালো করে।’
‘হয়ে যাবে ক্ষণ। আমি তোকে পেছন থেকে প্রম্পট করব না-হয়। আর, তোর বাবাই তো পুরস্কার দেবে রে, তোর আবার ভাবনা কীসের?’ মানস অভয় দেয়।
‘তা বটে। তবে দে দুটি মুড়ি, খাই। তেলমাখা মুড়ি খেতে বেশ লাগে।’ বরদা মুড়ির সঙ্গে লাগে।
‘তার সঙ্গে দ্যাখ আবার এই মুলো।’ মানস আরও দেখায়—‘মুলোর কুচি দিয়ে মুড়ি খেয়েছিস কখনো? খেয়ে দ্যাখ, ভুলতে পারবি না জীবনে।’
সত্যি কথাই মানসের। আমূল সত্যি। মুলো দিয়ে তেলমাখা মুড়ির তুলনা হয় না। বেশ লাগে বরদার। মানস একটু ভেতরে গেছল, সেই ফাঁকে আদ্ধেক মুলো আর এক ধামা মুড়ি একাই সেশেষ করে—ওর বন্ধুকে ফাঁকি দিয়ে।
মুড়ি ফুরোতে না ফুরোতেই ইশকুলের ঘণ্টা শোনা যায়। সভা শুরু হবার ঘোষণা। বই ফেলে মুলো চিবোতে চিবোতে বরদা দৌড়োয়।
ইশকুলের প্রাঙ্গণে বিরাট সভা। ছেলেরা বসেছে সারি দিয়ে। ছেলেদের অভিভাবকরাও এসেছেন। সামনের সারিতে বসেছেন শিক্ষকরা আর মহকুমার মান্যগণ্য যত অতিথি। প্রধানশিক্ষকের পাশের আসনে সভাপতি শ্রীষষ্ঠীচরণ ধাড়া। কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে নামজাদা এক সাহিত্যিকও এসেছেন—সেই ধাবধাড়া গোবিন্দপুরে। প্রধান অতিথিরূপে তিনিও শোভা পাচ্ছেন সভায়।
বইয়ের গাদা বগলে নিয়ে সভাপতিমশাই বসেছেন। একগাদা বই—রংচঙে কাগজের মোড়কে পরিপাটি প্যাক-করা। বইগুলি দেখবার কৌতূহল প্রকাশ করেছিল কেউ কেউ। কিন্তু ষষ্ঠীবাবু বাধা দিয়েছেন—‘চমৎকার করে বঁাধা রয়েছে, থাক-না! কী হবে প্যাকিং খুলে? কী আর দেখবেন? দেখবার কিছু নেই মশাই। যত সব আবোল-তাবোল! আজে বাজে! আম আঁঠির ভেঁপু। ভেঁপু, কিন্তু বাজে না। বাজনা নয়, বই! যাসসে তাই!’
বলতে বলতে শুরু হয়ে গেছে প্রতিযোগিতার উদ্যোগ। সভার পুরোভাগে বঁাশ বেঁধে স্টেজের মতন খাড়া করা হয়েছিল, তাতেই একটার পর একটা ছেলে এসে মুখ বাহির করে—গলা জাহির করে। হাত-পা নেড়ে নিজের নিজের গুণপনা দেখাতে লাগে।
আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পালা ছিল সব শেষে। সভার শেষ দিকে। আর, সবার শেষে বরদার পালা।
‘স-স-সত্য সেলুকাস…’ বলে বরদা আরম্ভ করে। করেই তার মনে হয় তিন সত্যি দিয়ে শুরু করাটা কি ঠিক হল? দোনোমনায় পড়ে সেগোড়া ধরে টান মারে আবার—
‘স-সত্যি সে-সে-সেলু-লু-লু-লু-লু—’ আওড়াতে গিয়ে তার চোখ কপালে উঠে যায়, কিন্তু লুকাস যে কোথায় লুকায়—তার পাত্তা মেলে না।
‘ইস, ছেলেটা যে লু বইয়ে দিল দেখছি।’ আপন মনে হু হু করেন ষষ্ঠীচরণ—‘দিল্লির লু এনে ফেললে আমাদের গোবিনপুরে।’ কিন্তু লুতাতন্তু ভেদ করে বরদা বেরোয়—‘সেলুকাস—কী—কী—কী-কীক…’ (ও কিন্তু দায়ী নয়, ওর পেটের ভেতর থেকে কে যেন kick মারে—আচমকা মারটা খেয়ে সেথতোমতো খায়—নতুন করে ফের তার সত্যগ্রহ শুরু হয়।)
‘স—স—সত্য সে—সে—সে—লুকাস—কী—কী—বি—বি—বি—বি—হিক…’
কিক নয়, হিক। হিকই বটে এবার। হিক্কাই ঠিক, কিন্তু এর তো একটা বিহিত করতে হয়। কিন্তু কী করবে, হিকিয়ে-ঢিকিয়ে চলতেই হয় তাকে—
‘…বিহিক—চি-চি—চিহিকত্র এ দেশ—হি—হিক!’ হিক করে সেদেশে এসে দাঁড়ায়। না, তার সন্দেহ অমূলক নয়, হতভাগা মানসই এই অমানুষিকতার জন্যে দায়ী। সে-ই এ কান্ডের মূল। তার উসকানিতে অতগুলো মুলো খাওয়া তার ঠিক হয়নি। সেই জন্যেই এখন এই হেঁচকি উঠচে—হেঁচকির সঙ্গে মুলোর ঢেঁকুর মিশে হিক্কার-ধ্বনি তার কানে ধিক্কার-ধ্বনির মতোই লাগে। আর তার চারধারে সভাসুদ্ধ সবার অট্টহাসি ভেঙে পড়ে। দেশ-এর নিকটে আসা হেঁচকি নিরুদ্দেশে না যেতেই সারা রাজ্যের হাসি টেনে আনে—হ্যাঁচকা টানে।
প্রতিযোগিতার পালোয়ানির পর পুরস্কার দানের পালা। পালাক্রমে এক-একটি ছেলে সভাপতির সামনে এসে দাঁড়ায়, এসে তাঁর হাত থেকে নিজের পুরস্কার নেয়, নিয়ে পালায়। আবৃত্তি পুরস্কারটা বরদাই পায়। ষষ্ঠীচরণের অপত্যস্নেহে বা সভাপত্য-স্নেহে বাধা দেওয়া যায় না। শুধু প্রধান অতিথিমশায় একটু আপত্তি তোলেন। তিনি বলেন—‘এটা কী করলেন? এটা কি ঠিক হল? এ কেমন ধারা?’
সভাপতি ভরাট গলায় জবাব দিয়েছেন—‘বরদাচরণ ধাড়া। তা ছাড়া কে? শ্রীষষ্ঠীচরণ ধাড়ার ছেলে। আপনি কলকাতার লোক, ইদানীং আমদানি, এ অঞ্চলে এই প্রথম আসচেন, এখানকার ধাড়াদের কী জানবেন? কিন্তু চমৎকার করেছে মশাই এই ছেলেটা, কী বলেন? খালি একটু তোতলামি তুলে আর তার সঙ্গে সামান্য হেঁচকি মিশিয়ে একেবারে নতুন ধারায় রেসিটেশন বানিয়েছে। নয় কি? এরকমটি আর কখনো শোনা যায়নি। গুরুগম্ভীর বিষয়কে এমন বিসদৃশ করে তোলা কি বাহাদুরি নয়? প্রতিভার পরিচয়ই বলতে হয়। হাসির দৃষ্টিকোণ থেকে তাকিয়ে, এত সহজে দেশের বৈচিত্র্যকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে এর আগে আর কাউকে আমি দেখিনি। আর ভেবে দেখুন, সত্যি বলতে, দেশ তো এখন হোঁচট খেতে খেতেই চলেছে। আবৃত্তিটা খুবই রিয়্যালিসটিক, কী বলেন?’
প্রধান অতিথি কিছু বলেন না। গোবিন্দপুরে এসে গোঁয়ারতুমি করার মানে হয় না। কামারশালে ছুঁচ বিক্রি, ধানবাদে গিয়ে চাল মারার মতোই বেকুবি। পুরো গোঁয়ার-গোবিন্দুমি।
চকচকে কাগজে পরিপাটি করে মোড়া বইয়ের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফেরে বরদা। ঝকঝকে বইগুলোর স্বপ্নে বিভোর হয়। এখুনি সেবইগুলোর মধ্যে ডুব মারবে, হাবুডুবু খাবে গল্পের অথইয়ে। চিলকোঠায় গিয়ে খিল এঁটে সেমোড়ক খোলে। বুক তার দুরদুর করে আশায়—আনন্দে—উত্তেজনায়।
বইয়ের ঘোমটা খুলতেই সেচমকে ওঠে। অ্যাঁ? এ কী বই? হ্যাঁ, বই-ই বটে। তারই বই যে, তাতেও কোনো ভুল নেই। কিন্তু এই কি বই? বই হয়েও যেন বই নয়—বইয়ের মতো নয়। এসব বই তো সেআশা করেনি। অবশ্যি—এসবও—এর সবই সেচেয়েছিল বটে—তার চাওয়া বই-ই—আর তার বাবার কাছ থেকে পাওয়ার কথাও বটে। পেলে সুখের কথাই বই কী! কিন্তু সুখের সঙ্গেও যেন দুঃখ মেশানো। এমন অবাঞ্ছিতভাবে এদের আবির্ভাব যেন তার আকাঙ্ক্ষিত নয়।
হতাশ হয়ে সেশুয়ে পড়ে—চিলকুঠুরির ভুঁয়ে—ধুলো-মাটির ওপরেই। আর, বইগুলি তার হাত থেকে গড়িয়ে পড়ে ছড়িয়ে থাকে—নেসফিলডের গ্রামার, যাদব চক্কোত্তির পাটীগণিত, কে পি বোসের অ্যালজেবরা, জিয়োমেটরি, ত্রিকোনমেট্রি, ব্যাকরণ-কৌমুদী, আর—আর—
আর, বাঙালি জাতির ইতিহাস। এইমাত্র প্রকাশিত এক ইতিহাসের ওপরে আরেকখানা!