Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

তারপর সেই স্থানের জঙ্গল পরিষ্কৃত করিবার জন্য লোক লাগিয়া গেল। বড় বড় পুরাতন বৃক্ষ কাটিয়া ভূমি সমতল করা হইতে লাগিল। হস্তীসকল ভূপতিত বৃক্ষকাণ্ড টানিয়া বাহিরে লইয়া ফেলিতে লাগিল। বৃক্ষপতনের মড়মড় শব্দে, মানুষের কোলাহলে, হস্তী ও অশ্বের নিনাদে দিকপ্রান্ত প্ৰকম্পিত হইয়া উঠিল। যেন বহু-যুগব্যাপী নিদ্রার পর অরণ্যানী কোন দৈত্যের বিজয়নাদে চমকিয়া উঠিল।

সমস্ত দিন এইরূপ পরিশ্রমের পর রাত্ৰিতে আহারাদি শেষ করিয়া বিশ্রামের উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় দিঙ্‌নাগ আসিয়া উপস্থিত হইল। বলিল, “নায়ক, রাত্রি দ্বিপ্রহর সমাগত; আজ দুৰ্গারম্ভের পূর্বে দৈবকার্য করিতে হইবে।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিরূপ দৈবকার্য?”

দিঙ্‌নাগ বলিল, “ইহারই মধ্যে ভুলিয়া গেলেন? সেই ভণ্ড তপস্বী— আজি তাহাকে জীবন্ত পুঁতিয়া ফেলিতে হইবে।”

তখন সকল কথা স্মরণ হইল। বলিলাম, “ঠিক কথা, তাহাকে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। তা বেশ, তাহাকে যখন বধ করিতেই হইবে, তখন এক কার্যে দুই ফল হউক। শত্রু নিপাত ও দেবতুষ্টি একসঙ্গেই হইবে। কিন্তু এই সকল দৈবকার্যের কি কি অনুষ্ঠান তাহা কি তোমাদের জানা আছে?”

দিঙ্‌নাগ বলিল, “অনুষ্ঠান কিছুই নহে। বলিকে সূরাপান করাইয়া যখন সে অচৈতন্য হইয়া পড়িবে, তখন তাহার কানে কানে বলিতে হইবে, “তুমি চিরদিন প্রেতদেহে এই দুর্গ রক্ষা করিতে থাক।”—এই বলিয়া তাহাকে জীবন্ত অবস্থায় পুঁতিয়া ফেলিতে হইবে।”

আমি ঈষৎ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এত বিধি-ব্যবস্থা জানিলে কোথা হইতে?”

দিঙ্‌নাগ হাসিয়া বলিল, “এ কার্য আমি পূর্বে করিয়াছি। ধনশ্ৰী শ্রেষ্ঠী যখন গুপ্ত রত্নাগার মাটির নীচে তৈয়ার করে, তখন আমিই কুলিক ছিলাম। সেই সময় অরণ্য হইতে এক শবর ধরিয়া আনিয়া শ্রেষ্ঠী এই নরযাগ সম্পন্ন করে। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম।”

আমি বলিলাম, “তবে এ কার্যও তুমিই কর।”

দিঙ্‌নাগ বলিল, “করিব। কিন্তু নায়ক, কার্যকালে আপনাকেও উপস্থিত থাকিতে হইবে। ইহাই বিধি।”

“বেশ থাকিব।”

দিঙ্‌নাগ চলিয়া যাইবার পর নানা চিন্তায় মগ্ন হইয়া আছি, এমন সময় সে ছুটিতে ছুটিতে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “নায়ক, সর্বনাশ! সন্ন্যাসী আমাদের ফাঁকি দিয়াছে!”

“ফাঁকি দিয়াছে!”

“বিষপান করিয়াছে। তাহার কবচের মধ্যে বিষ লুকানো ছিল, জীবন্ত সমাধির ভয়ে তাহাই খাইয়া মরিয়াছে। এখন উপায়?”

“মানস করিয়াছি, বলি না দিলে যে সর্বনাশ হইবে! রুদ্র কুপিত হইবেন।” দিঙ্‌নাগ মাটিতে বসিয়া পড়িল।

চিন্তার কথা বটে। নির্বোধ সন্ন্যাসীটা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে পারিল না! পাছে আমাদের একটু উপকার হয়, তাই তাড়াতাড়ি বিষপান করিয়া বসিল। এদিকে আমন্ত্রিত দেবতা প্রতীক্ষা করিয়া আছেন। অন্য বলি কোথায় পাওয়া যায়?

বিশেষ ভাবিত হইয়া পড়িয়াছি, এরূপ সময় শিবিরের প্রহরী আসিয়া সংবাদ দিল, “কতকগুলা মুণ্ডিত-মস্তক ভিখারী ছাউনিতে আশ্রয় খুঁজিতেছিল, ধরিয়া বাঁধিয়া রাখিয়াছি। আজ্ঞা হয় তো লইয়া আসি।”

দিঙ্‌নাগ লাফাইয়া উঠিয়া মহানন্দে চিৎকার করিয়া উঠিল, “জয় রুদ্রেশ্বর, জয় ভৈরব!…নায়ক, দেবতা স্বয়ং বলি পঠাইয়াছেন।”

এত সহজে যে বলি-সমস্যর মীমাংসা হইয়া যাইবে তাহা ভাবি নাই। ভিখারী অপেক্ষা উত্তম বলি আর কোথায় পাওয়া যাইবে? দিঙ্‌নাগ ঠিকই বলিয়াছে, দেবতা স্বয়ং বলি পাঠাইয়াছেন।

সর্বসুদ্ধ চারি-পাঁচটি ভিখারী,—পরিধানে কৌপীন, সংঘাটি ও উত্তরীয়, হস্তে ভিক্ষাপাত্র,—আমার সম্মুখে আনীত হইল। ভিক্ষুকগণ সকলেই বয়স্থ;— কেবল একটি বৃদ্ধ,–বয়স বোধ করি সত্তর অতিক্রম করিয়াছে।

এই বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিয়া সহসা আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যেন তড়িৎস্পষ্ট হইয়া জাগিয়া উঠিল। আমি কে, কোথায় আছি, এক মুহুর্তে সমস্ত ভুলিয়া গেলাম। কেবল বুকের মধ্যে এক অদম্য বাষ্পোচ্ছাস আলোড়িত হইয়া উঠিল। কে ইনি? এত সুন্দর, এত মধুর, এত করুণাসিক্ত মুখকান্তি তো মানুষের কখনও দেখি নাই। দেবতার মুখে যে জ্যোতির্মণ্ডল কল্পনা করিয়াছি, আজ এই বৃদ্ধের মুখে তাহা প্রথম প্রত্যক্ষ করিলাম। এই জ্যোতির স্ফুরণ বাহিরে অতি অল্প, কিন্তু চক্ষুর মধ্যে দৃষ্টিপাত করিলেই মনে হয়, ভিতরে অমিতদৃতি স্থির সৌদামিনী জুলিতেছে। কিন্তু সে সৌদামিনীতে জ্বালা নাই, তাহা অতি স্নিগ্ধ, অতি শীতল, যেন হিম-নিঝরিণীর শীকর-নিষিক্ত।

সে মূর্তির দিকে তাকাইয়া তাকাইয়া আমার প্রাণের মধ্যে একটি শব্দ কেবল রণিত হইতে লাগিল—“অমিতাভ! অমিতাভ!”

আমি বাক্‌রহিত হইয়া বসিয়া আছি দেখিয়া তিনি আবার হাসিলেন। অপূর্ব প্রভায় সে মুখ আবার সমুদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। বলিলেন, “বৎস, আমরা যাযাবর ভিক্ষু, কুশীনগর যাইবার অভিপ্ৰায় করিয়াছি। আদ্য রাত্রির জন্য তোমার আশ্রয় ভিক্ষা করি।”

অবরুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কে?”

তাহার একজন সহচর উত্তর করিলেন, “শাক্যসিংহ গৌতমের নাম কখনও শুনা নাই?”

শাক্যসিংহ? ইনিই তবে সেই শাক্যবংশের রাজ্যভ্ৰষ্ট যুবরাজ! মহামন্ত্রী বর্ষকারের কথা মনে পড়িল। ইহারই উদ্দেশে তিনি বলিয়াছিলেন,–ধূর্ত, কপটী, পরস্বলুব্ধ! মরি মরি, কে ধূৰ্ত কপটী? মনে হইল, মানুষ তো অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু আজ এই প্ৰথম মানুষ দেখিলাম। হায়, মহামন্ত্রী বর্ষকার, তুমি এই পুরুষসিংহকে দেখা নাই, কিংবা দেখিয়াও আত্মাভিমানে অন্ধ ছিলে। নহিলে এমন কথা মুখে উচ্চারণ করিতে পারিতে না।

বুকের মধ্যে প্রবল রোদনের উচ্ছাস সমস্ত দেহকে কম্পিত করিতে লাগিল। আমার অতিবাহিত জীবনের অপরিমেয় শূন্যতা, অশেষ দৈন্য, যেন এককালে মূর্তি ধরিয়া আমার সম্মুখে দেখা দিল, কি পাইয়া এত দিন ভুলিয়া ছিলাম!

আমি উঠিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে পতিত হইয়া বলিলাম, “অমিতাভ, আমি অন্ধ, আমাকে চক্ষু দাও, আমাকে আলোকের পথ দেখাইয়া দাও।”

অমিতাভ আমাকে ধরিয়া তুলিলেন। মস্তকে করার্পণ করিয়া বলিলেন, “পুত্র, আশীর্বাদ করিতেছি, তোমার অন্তরের দিব্যচক্ষু উন্মীলিত হইবে, আপনিই আলোকের পথ দেখিতে পাইবে।’

আমি আবার তাঁহার চরণ ধারণ করিয়া বলিলাম, “না, শ্ৰীমন্‌, আমার হৃদয় অন্ধকার। আজ প্রথম তোমার মুখে দিব্য জ্যোতি দেখিয়াছি। ঐ জ্যোতির কণামাত্র আমাকে দান কর।”

একজন ভিক্ষু বলিলেন, “শাস্তা, আপনি ইহাকে ত্রিশরণ দান করুন।”

শাক্যসিংহ কহিলেন, “আনন্দ, তাহাই হউক। আমার মস্তকে হস্ত রাখিয়া বলিলেন, “পুত্ৰ, তুমি ত্রিশরণ গ্রহণ করিয়া গৃহস্থের অষ্টশীল পালন কর। আশীবাদ করি, যেন বাসনামুক্ত হইতে পার।”

তখন বুদ্ধের চরণতলে বসিয়া তদগতকণ্ঠে তিনবার ত্রিশরণ মন্ত্র উচ্চারণ করিলাম।

অদূরে দাঁড়াইয়া দিঙ্‌নাগ–দুর্ধর্ষ, নিষ্করুণ, অসুরপ্রকৃতি দিপ্তনাগ-গলদশ্রু হইয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহার বিকৃত কণ্ঠ হইতে কি কথা বাহির হইতে লাগিল বুঝা গেল না।

এ যেন কয়েক পলের মধ্যে এক মহা ভূমিকম্পে আমাদের অতীত জীবন ধূলিসাৎ হইয়া গেল। কীট ছিলাম, এক মুহুর্তে মানুষ হইয়া গেলাম।

পরদিন ঊষাকালে তথাগত কুশীনগর অভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। হিরণ্যবাহুর সুবর্ণ-সৈকতে দাঁড়াইয়া আমার হস্তধারণ করিয়া তিনি কহিলেন, “পুত্র, আমি চলিলাম। হিংসায় হিংসার ক্ষয় হয় না, বৃদ্ধি হয়—এ কথা স্মরণ রাখিও।”

বাষ্পাকুল-স্বরে কহিলাম, “শাস্তা, আবার কত দিনে সাক্ষাৎ পাইব?”

সেই হিমবিদ্যুতের নায় হাসি তাঁহার ওষ্ঠাধরে খেলিয়া গেল, বলিলেন, “আমি কুশীনগর যাইতেছি, আর ফিরিব না।”

তারপর বহুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে গঙ্গা-শোণ-সংগমে দুর্গভূমির প্রতি তাকাইয়া রহিলেন। শেষে স্বপ্নবিষ্ট কণ্ঠে কহিলেন, “আমি দেখিতেছি, তোমার এই কীর্তি বহু-সহস্ৰবর্ষ স্থায়ী হইবে। এই ক্ষুদ্র পাটলিগ্রাম ও তোমার নির্মিত এই দুর্গ এক মহীয়সী নগরীতে পরিণত হইবে। বাণিজ্যে, ঐশ্বর্যে শিল্পে, কারুকলায়, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে পৃথিবীতে অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করিবে। সদ্ধৰ্ম এইস্থানে দৃঢ়প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে। তোমার কীর্তি অবিনশ্বর হউক।”

এই বলিয়া, পুনর্বার আমাকে আশীবাদ করিয়া, দিব্যদশী পরিনির্বাণের পথে যাত্ৰা করিলেন।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *