Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অবস্থান || Bani Basu

অবস্থান || Bani Basu

ওয়াজিদ? ওয়াজিদ আলি শা? খিদিরপুরে থাকেন বললেন না? কেমন উৎসাহিত উত্তেজিত গলায় বলল খুকিটা। ছুট্টে গিয়ে আজকালের সব টেপটাপ হয়েছে, সেই একখান চালিয়ে দিল, বাবুল মেরা নৈহার ছুট হি জায়, ঘুরে ঘুরে মিহিন। সানাইয়ের সুরে বাজতে লাগল টেপটা।

ভালো লাগছে? আপনার ভালো লাগছে এই গান? জ্বলজ্বলে চোখে খুকি বলে।

কী করবে? মাথাটা তালে তালে নেড়ে দেয় সে। ভালো আসলে লাগছে না ততটা। কিন্তু অত উৎসাহের আগুনে ফুস করে জল ঢালা যায় কি?

খুশি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে।

আপনার পূর্বপুরুষের লেখা গান। জানেন তো? নবাব ছিলেন ওয়াজিদ আলি শা। ঠিক আপনার নাম। একেবারে হুবহু।

এত উৎসাহ, উত্তেজনা, গান-ফানের কিছুই বোঝে না সে।

ওয়াজিদ নয় খুকি, আমার নাম ওয়াজির, ওয়াজির…। আলি নয়, শা নয়, মোল্লা—থেমে থেমে বলে সে। গলার আওয়াজটা বড়ে গোলামের মতো না হলেও বেশ জোয়ারিদার।

মোল্লা? ওরে বাবা খুকি যেন চমকে ওঠে।

কেন? ওরে বাবা কেন?

সে আমি বলছি না জেদি ঘাড় দোলায় খুকি।

আমি বুজতে পেরেছি ওয়াজির মোল্লা দাড়ির ফাঁকে হাসে।

বুঝতে পেরেছেন তো? খুকির গলায় সোয়াস্তি। বস্তুত দুজনেই হাসে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ষড়যন্ত্রীর হাসি।

কিন্তু আপনাকে ওয়াজিদ আলি শা সাহেব বলেই ডাকব। কেমন?

এটা কিন্তুক বুজলুম না খুকিসাহেব। … ওয়াজির মোল্লা মন দিয়ে পাকা পুডিং, রজন জ্বাল দেয়। নুটি ঠিক করে মার্কিনের টুকরোর মধ্যে ঝুরো তুলো ভরে।

খুকিসাহেব?—খুকিটি ভীষণ হাসি হাসতে থাকে। লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে একেবারে।

এত হাসি! ওয়াজির মোল্লা তার পালিশের নুটি নিয়ে প্রস্তুত। এত কিছু মজাদারি আছে নাকি কথাটায়! নাকি সিরেফ জওয়ানি। যৌবনই এমন বাঁধভাঙা হাসি হাসায়।

খুকির বাবা একটুকুন আগে অফিস চলে গেছেন। এবার মা যাচ্ছেন। নাম্বা নাম্বা ইস্ট্রাপের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুটখুট করে ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়ার মতো, না না ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া হতে যাবেন কেন? কত বড়োমানুষ! এতগুলিন সামানে ল্যাকর পালিশ দিবেন। ব্যাপরে। সেন্টের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে চাদ্দিক। চকচক কচ্ছে চামড়া। কত ল্যাকর কত জলুসের জান! ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া কেন হতে যান! ইনি হলেন গিয়ে ভালো জাতের রেসের ঘুড়ি। যেমনটি কুইনের পার্কের পাশে ঘোড়দৌড়ের বাজির মাঠে দেখা যায়! অতটা নাম্বাই-চওড়াই নেই। তা না-ই থাকল।

উনি বললেন, অত কী বকবক করছিস খুকি। কাজটা হবে কখন?

আমার হাত কামাই নেই দিদিসাহেব।–নুটি চালাতে চালাতে মোল্লা বলে।

তা হোক, খুকি, বড্ড বিরক্ত করছ!

না মা। ইনি একজন বিশেষ মানুষ। হিস্ট্রির লোক। এঁর নাম জানো? ওয়াজিদ, ওয়াজিদ আলি শাহ। খিদিরপুরে থাকেন।

তা-ই-ই? ভীষণ অবাক আবিষ্কারের দৃষ্টিতে কর্ত্রী তাকালেন। চেহারাটাও দেখেছিস!

খুকি আবার হাসতে থাকে! তুমি তো আমজাদের চেহারার কথা ভেবে বলছ। আসল মানুষটা তো নয়! তোমার যা হিস্ট্রির সেনস।

আহা, আমরা লেম্যান তো ওইভাবেই জেনেছি! এ মিলটাও কি কম আশ্চর্যের!

ওয়াজির মোল্লা জানে না, কেন এই আশ্চর্য, কেনই-বা আবিষ্কার। কীসের মিল। কেন মিল। ভুল নাম নিয়ে কেনই বা এত কচলাকচলি। তবে সে আর শুধরে দেয় না। কী দরকার! রুজি যাদের কাছে, একটু-আধটু ভুলভাল বলে তারা যদি খুশি থাকে, থাক।

আমার মাকে দিদিসাহেব ডাকলেন কেন?

কর্ত্রী চলে যেতে খুকিটি আবার জিজ্ঞেস করে। প্রশ্নের তার শেষ নেই।

কেন? ভুল হয়েছে কিছু?

না, ভুল নয়। সবাই তো মা, বউদি এসব বলে। ও, আপনাদের বউদি নেই, না?

ওয়াজির মোল্লা কাঁধের কিনার দিয়ে চিবুক চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে থাকে।

তাই তো? দিদিসাহেব কেন? এই ডাকগুলান মুখ দিয়ে আপসে বেরিয়ে যায়। এখন তার কার্যকরণ বাতলাও এই কৌতূহলী বালিকার কাছে। মাথায় সিন্দুর নাই। ঘোমটা নাই। খাটো চুল গুছি গুছি পিঠ ঝেপে আছে। ঝুলঝুলে দুল। গলায় ঝুটো পাথরের দেখনাই হার। হাতেই-বা কী? একটা হাতঘড়ি। একটা কাঠ না কিসের বালা। এমন ধারা শো হলে মা ডাকটা ঠিক হয় না। দিদিই ঠিক। কিন্তু এসব কথা খুকিকে বলা যাচ্ছে না। সে খানিকটা প্রশ্নের উত্তর বেমালুম উড়িয়ে এড়িয়ে বলে সাহেব মানে একটা মান, একটা সনভ্রম, বোঝেন তো?

খুকি আবারও প্রচুর হাসে। সনভ্রম? কী বললেন? সনভ্রম?

খুকি বলতে ঠিক যতটা বাচ্চা হওয়া দরকার, এই খুকি কি ততটা? উলিথুলি চুল। চক্ষু দুটি ডাগর। তাতে ভাসে কৌতুক, কুতূহল, কোশ্চেন, ছোট্টখাট্ট, সবই ঠিক। কিন্তু খুকি খুকি শো থাকলেও এঁর সোমত্ম বয়স হয়েছে। ঢলঢলে কামিজ তবু বোঝা যায়। তা ছাড়াও, চলনবলন ছোটন-দাঁড়ান, কাজকম্মের একটা গোছ ধরন সবই ওই কথাই বলে।

তুমি ইস্কুলে যাবে না?

আমি কলেজে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ার। ওরে বাবা! সেকেন কেলাস একেবারে? তবে তো খুব ভুল হয়ে গ্যাছে। খুকিসাহেব? তা আপনি কলেজে যাবেন না?

টেস্ট হয়ে গেছে, এখন আর যেতে হয় না।

বা বা–বাহবাটা কেন দিল মোল্লা তা জানে না।

শীতের বাতাসে বেশ আঁচ লেগেছে। শুখুটে শুখুটে দিনগুলো। পুরোনো সামান সব ঘষেমেজে, বাটালি দিয়ে চেঁছে ফেলে, নতুনের সঙ্গে তাকে মানিয়ে-গুনিয়ে কাজ। দরজার এড়ো, ক্যাবিনেটের পাওট সব নতুন করে বাদাম কাঠ মাপসই করে করা। এখন আর সব মিস্তিরি জববর, গোপাল, মুন্না—সব কটিকে বিদেয় করে দিয়েছে। একটু একটু কবে সাজিয়ে তুলতে হবে এখন সব। একা একা। অভিনিবেশ চাই তো না কি? শীতের শুখে থাকতে থাকতে সারতে হবে।

যবে থেকে একলা কাজ করছে আপন মনে, খুকিটি সেই ইস্তক সেঁটে আছে। অবিশ্যি সেঁটে বলতে ঠিক সেঁটে নেই। মাঝে মাঝে একেবারে অদর্শন হয়ে যায়। তারপর ঘুরছে ফিরছে, কাছে এসে বসছে, এটা ওটা নাড়ছে চাড়ছে। আর ফুলঝুরির মতো কোশ্চেন।

আরে সববনাশ, ও ঢাকা খুলেন না, খুলেন না।

কেন?

ইস্প্রিট সব ভোঁ হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে পানি। জল।

জল? স্পিরিটে জল?

একটু আধটু ভেজালি এই লাইনে সবাই দিচ্ছে খুকি, কাকে ফেলে কাকে ধরবেন?

কী করে বুঝলেন জল আছে?

এই দ্যাখেন, নিজের মোটা মোটা খসখসে আঙুলগুলি মেলে ধরে ওয়াজির!

চামড়া কেমন কুঁকড়ে উঠেছে দেখেছেন? এই হল গিয়ে পানির নিশানি। … মনোযোগ দিয়ে দেখে খুকি।

স্পিরিট শুদ্ধ থাকলে কী হত?

পেলেন থাকত চামড়া।–স্পিরিটের মধ্যে গালা ঢালে ওয়াজির।

কী দিলেন ওগুলো?

গালা, কুসমি গালা খুকিসাহেব।

কুসমি? কুসমি কেন?

ডিমের কুসুম দেখেন তো? তলতলে কাঁচা-সোনা বর্ণ? সেইমতো হল গিয়ে বাজারের সেরা গালা। ফার্নিচারে মারলে কাঠের ওরিজন্যাল রংটিই ধরবে। এমন ঝিলিকদার হবে যে, এদিক থেকে লাইট মারলে ওদিকে পিছলে পড়বে।

তা অ্যাত্তো সব হাঁড়ি-কুঁড়ি বাটি-ঘটি নিয়ে কী করছেন?

খেলা করছি। রান্নাবাড়ি—ছোটো ছেলেরা খেলে না?

খেলাই তো!

খেলা, কিন্তুক কেমন জানেন? পরানপনের খেলা।

কেন এর মধ্যে আবার প্রাণপণের কী হল?

ও আপনি বুঝবেন না খুকিসাহেব। এ হল গিয়ে রং ফেরাবার খেলা। একেকটি খোরায় জানের একেকটি ধরে রাখছি।

দেখি দেখি কেমন আপনার জানের রং।

তো দ্যাকেন, এই রং মেহগনি, ডার্ক ব্রাউনের সঙ্গে ভুষো কালি, একটু এই অ্যাতেটুকু সিন্দুর…

সিন্দূর?

বাঃ, আপনারা সাজেন আর আপনাদের ফার্নিচার সাজবেন না। সিন্দুরে, আলতায় কাজলে, সুর্মায় সাজবেন বইকি! তারপর কাপড় পড়বেন ঝাঁ চকচক!

কী কাপড়? সিনথেটিক তো? নাইলন। … এতক্ষণে খুকি খেলাটা ধরতে পেয়েছে।

না খুকিসাহেব, ওরে কি কাপড় কয়? পরবে বেনারসি, তসর, মুগা, বিষ্ণুপুরের বালুচরি।

ওরে বাবা! কই বেনারসি, তসর এসব কই?

বানাচ্ছি। খাপি মিহিন খোলে। এমন গ্লেজ দেবে যে সিল্কের সঙ্গে তফাত করতে পারবেন না। চোখে ঝিলিক মারবে।

সবই তো দেখছি একরকম!

আরে সাহেব, সবই একরকম হলে কি আর এত ছাবাছোবার দরকার হত? এই দ্যাখেন এরে কচ্ছে ওয়ালনাট। বড়ো বড়ো হৌসে এই রং লাগায়। আই. সি. আই, আই. টি. সি., টাটা স্টিল…। ওয়ালনাটেরই কি আর একরকম? তিন-চার রকম আছে খুকি। আপনারা হয়তো দেখে কইবেন মেহগনি। যে জন জানে সে জন বুঝবে।

খুকি একটা কাঠের টুকরো তুলে নিল, বলল, বাঃ, খুব সুন্দর তো ধরিয়েছেন রংটা।

ধরাব না? আপনার মা-বাবা এসে স্যাংশন দিবেন তবে না? কাঠের পিসে সবরকমের ধরতাই দিয়ে রাখছি।

এতে কী দিয়েছেন?

কিচ্ছু না, কুসমি গালার রসের সঙ্গে এই অ্যাটুকুনি বেগনি রং।

তাতেই এই টিন্টটা এসে গেল?

তাতেই। তারপর আছে ঘষামাজা। আপনার মাথা ঘষেন না? একবার দুবার। তারপর মুখে কিরিম দাও, মোছো, আবার মাখো, আবার মোছো…এই সুন্দরীদেরও তেমনি। মাখবেন, তুলবনে, মাখবেন, তুলবেন। তবে না গ্লেজ আসবে। মুণ্ডু ঘুরবে দেখনদারের। এই তো সাইডটায় হাত দিয়ে দ্যাখেন।

সত্যি তো! কী স্মথ করে ফেলেছেন।

আরও করব খুকিসাহেব। তারপর ফেরেঞ্চ চক মাখাব। পাউডার মাখবেন সোহাগি আমার।

তেমন তেমন লাগসই উপমাগুলো ওয়াজির মোল্লা খুকির সামনে বলা উচিত মনে করে না। যত্ত চিকনচাকন হবে দেহখানি বিবির পালিশ তো তত্ত খুলবে! না কী?

তা এইটুকু শুনেই খুকির মুখ সামান্য লাল হয়। সে বলে ওঠে, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনার চা-টা হল কি না দেখে আসি।

বড়ো গেলাসের চায়ে পাঁউরুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে তৃপ্তি করে খায় ওয়াজির মোল্লা।

এ মা, বর্ডারগুলোতে কালো দিলেন কেন?

উ হুঁ হুঁ। কালো নয়। কালো বলেন না। ও হল ডার্ক মেহগানি। যত শুকোবে তত খোলতাই হবে। হাসতে থাকবে। এই যে ভেতরে? সব ওয়ালনাট ফিনিশ দিইছি। দেখে ন্যান, ধারে ধারে একটু অন্যতম রং চাই, বুজলেন? অন্যতম কিছু। আবার ধরেন আপনাদের শয়নের ঘরে একরকম, তো বসার ঘরে বিকল্প চাই। সবখানেই ওয়ালনাট মেহগনি হলে হবে না। রোজউড দেব ক্যাবিনেটটাতে, দেখবেন চোখ যেন স্তম্ভিত হয়ে থাকতে চাইবে। একেবারে বিকল্প।

খুকি অনেকক্ষণ ধরেই হাসছিল,বলল, আপনি লেখাপড়া জানেন, না?

কই আর জানলুম খুকি।

খুকির বাবা এসে ডাকেন, মিস্ত্রি।

নতুন রং করা চেয়ারে বসলাম, গ্লেজ তো উঠে গেল।

তা তো যাবেই সাহেব।

সে কী! তাহলে এত কষ্ট করে খরচা করে পালিশ করার মানে কী!

আহা এখনও তো ফিনিশ হয়নি। শেষ অস্তে ল্যাকার পালিশ চড়াব। চক্ষে ধাঁধা লেগে যাবে।

গ্লেজ?

উঠবে না সাহেব। দশটি বচ্ছর চোখ বুজে থাকতে পারবেন।

পারলেই ভালো। সাহেব গটমট করে চলে যান।

হ্যাঁ কী যেন বলছিলেন! খুকি সুযোগ পেয়ে কাছিয়ে আসে।

কী আবার!

ওই যে অন্যতম, বিকল্প …ভালো ভালো কথা বাংলা রচনা বই থেকে?

ওই সেই কথা? এই যেমন ধরুন, খুকিসাহেব আপনারা আজকালের মেয়েরা সব ম্যাচিং দ্যান না? ফলসা রঙের শাড়ি, তো সেই রঙের সায়া, সেই রঙের জামা! মনে কিছু করবেন না, সরবো চেহারা লেপেপুঁছে খেদিকুঁচি লাগে।

খুকি আর হাসি সামলাতে পারে না।

আপনি হাসছেন? আমি যখন একেকটি ফার্নিচার সাজাই, তাকে জামা পরাই, সায়া পরাই, কাপড় পরাই, তকন আমার ওই লেপাপোঁছা মনে ধরে না। একটা কিছু অন্যতম খুঁজি। কেমন জানেন? লাহা বাড়িতে কাজ করতে গেছলুম। সে কি আজকার কথা! সে এক অন্যতম কাল! তা সে বাড়ির মেয়েরা সব হুরি রূপসি। আশি নম্বর একশো নম্বর কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে ঘষে তবে তেমনতরো তেলা চামড়া হয় খুকি, তারপর খালি সবেদা দিয়ে সাদা গালার পোঁচ, সর-হলুদ বাটা আর কমলালেবুর খোসা,গ্লেজ কী! চোখ পিছলে যায়।

পিছলে যায়? আটকে থাকে না? খুকি হাসি চেপে দুষ্টু প্রশ্ন করে।

উঁহু, রজন পাইল দিলে চিটে হবে, ওইখানেই তো পালিশের সরবো কারিগরি।

আহা পালিশ নয়, ওই লাহা বাড়ির সুন্দরীদের কথা কী যেন বলছিলেন?

ও হ্যাঁ, তা ওনারা পরতেন ধবধবে সাদা খোলের কাপড়। তাতে ভোমরাকালো, কিংবা খুনখারাবি লাল রঙের পাড়। জামা পরতেন ছিটের। লালের মধ্যে হলুদ কালো সবুজ চিকিমিকি। আর সায়াটি থাকত ধোয়া গোলাপি।

এ মা! কী বিচ্ছিরি!

হাঁ হাঁ করে ওঠে ওয়াজির মোল্লা। না না। একেবারে বিকল্প। ওই যে সবটি লেপাপোঁছা, হল না, অন্যতম রঙের খোয়ব রইল, তাতেই রূপগুলি বিকল্প হয়ে উঠত। এই যে বর্ডার দিচ্ছি, একটা জমিনকে আলে আলে বেঁধে দিচ্ছি, এতে করে আপনার আপন হয়ে যাবে দ্রব্যটি। উদোম মাঠ নয়, যেটা বারোয়ারি। একটা ধরুন শস্যক্ষেত্র। কেমন? নয় কি?

খুকি এখন আর হাসছে না। অভিনিবেশ সহকারে শুনছে। একটু পরে সে উঠে গেল।

বাড়িটি চমৎকার সেজে উঠেছে। ওয়াজির মোল্লাসাহেব দেখছেন। ঘরের মধ্যে যেন চাঁদনি। এমনধারা চাঁদনিতে মানুষের প্রকৃত মুখটি এই ধরা পড়ে, তো এই পড়ে না। একঘর আলো, তা বুঝি তার কতকগুলান উঁচার দিকে মুখ। মানুষগুলিকে মনে হয় খোয়াবে দেখা হুরি পরি জিন জাদুকর। হ্যাঁ জাদুকরও আছে। মোল্লাসাহেব বড়ো আয়নায় দেখছেন, তিনি নিজেই যেন জাদুর মানুষ। ভুষো কালি আর শ্বেত গালাতে মিলেমিশে ছোটো দাড়ি। হাতের কালচে চাম ইস্পিটের অ্যাকশনে উঠে উঠে যাচ্ছে, কাজের লুঙ্গি আর গেঞ্জিটি আলাদা করে রাখলেও ছাপছোপ পুরোপুরি এড়াতে পারেননি। পেলে একটু আধটু নানা রঙের পোঁচ লেগেছে। হলঘরটি যেন সিনেমা হল। তার মধ্যে ফার্নিচারে আলো ঠিকরোয়, ভালো গোমেদ পাথরের কাটিং যেন।

দুটো হাঁড়ি ওপর ওপর বসানো। ফরসা পুরোনো কাপড়ে বেঁধে দিচ্ছেন কর্ত্রী।

মিস্ত্রিসাহেব, ছেলেমেয়ে বিবিদের দেবেন গিয়ে।

কী আছে মা এতে? … দাত্রী রমণীকে আজ মা ডাকতে ইচ্ছে যায়।

লেডিকেনি আছে। আর রসগোল্লা…ভালোবাসেন তো?

হ্যাঁ মা…চমৎকার ভালোবাসি সব।

সন্ধে হয়ে গেল আজ শেষ দিনে আপনার…আর এই শাড়িখানা…পছন্দ হয়?

আপনার পছন্দ হয়েছে মাওয়াজির চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন, দেখান।

খুব। আবার দরকার পড়লে ডাকব আপনাকে। খোদা করুন, ডাকবার দরকার না হয় মালিক। বিশ বচ্ছরের কাম ফতে করে গেছি। রাখতে যদি পারেন। পানি আর রোদ্দুর এই দুই হল পালিশের দুশমন। পাতলা কাপড় দিয়ে মোলায়েম করে মুছে দেবেন, বাস। আর পাড়া-পড়োশন, ভাই-বহেন এঁদের কাছে যদি সুপারিশ করেন তো…আজকাল তো পালিশ লোকে করায় না, সব তেল রং আর পেলাস্টিক রং, হাউহাউ চিৎকার করছে। পালিশের কদর ওই বনেদি বাবুরাই করেন। বিকল্প কিছু…।

শাড়িটা প্যাকেট থেকে খুলে বার করেন মোল্লাসাহেব। ছাপের কাপড়। নানান রঙের হোরিখেলা। বিবি পরবেন ভালো। মোল্লাসাহেবের তত মনোমতো হয় না। কিন্তু তিনি বলেন, সুন্দর, চমৎকার। হেসে উঠছে কাপড়, আপনার এই বাড়ির মতো। সালাম, সালাম। কাঁধে ঝোলাঝুলি নিয়ে নীচে নেমে যান মোল্লাসাহেব।

ও ওয়াজিদ আলি শা সাহেব…একটু দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান। হাঁফাতে হাঁফাতে ছোট্ট জমি দিয়ে ছুটে আসে খুকিসাহেব।

ঘাসের জমিতে সবুজ টিলটিল করছে। বেগুনি আভা সাঁঝের গায়ে। মিহি কাঞ্চন রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে খুকি। চওড়া জাম রঙের পাড়। ভেতরে জরির সুতো, কালো সুতো চমকাচ্ছে। আর জামাতে বেশ খলখলে হাসকুটে কালো, কালো না মেহগনি, বুঝি খুকিও ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে। কোনো উৎসবে যাবে বোধহয়।

অন্যতম হয়েছে? …

হাসি দাড়ি বেয়ে টাপুর টুপুর ঝরে।

হয়েছে, হয়েছে।

আর বিকল্প?

চতুর্দিকে হাতড়ান মোল্লাসাহেব। বিকল্পটি কি ঠিক হল? বিকল্প বলে কি তিনি সবসময় এক কথাই বোঝাতে চান? বিকল্প মানে এখন, এখানে অবিকল্প। সেরকমটি? হয়েছে কি?

খুকি রিনরিন করে হাসে। বোঝার চোখে তাকায়।

বিকল্পটা ঠিক হল না, না শা সাহেব?

হল না কি?—হাঁ হাঁ করে ওঠেন ওয়াজির মোল্লা—এখন এক্কেবারে বেগমসাহেবা। হানডেড পার্সেন। দুজনেই ষড়যন্ত্রীর মতো হাসতে থাকেন। একটা যে রঙ্গ হয়ে গেল সেটা উভয়েই বুঝেছে। শিল্পীর চোখে বিকল্প অর্থাৎ অবিকল্প?

তাও কি সম্ভব?

আচ্ছা চলি বেগমসাহেবা…

আবার আসবেন ওয়াজিদ আলি শা সাহেব…

ওয়াজির মোল্লা কিছু দূর চলে গিয়েছিলেন। ঘুরে দাঁড়ান।

ওয়াজিদ নয় কিন্তুক। ওয়াজির…ওয়াজির মোল্লা। খিদিরপুরে বাস নয়, কাজকাম করি ওখানে, নাহারবাবুদের ফ্যাকটরিতে। সাকিন নপাড়া বাগনান, সাউথ ইস্টার্ন রেলোয়ে।

নিজস্ব শিল্পভাবনার অবিকল্প নিশানখানা কাঁধের ওপর প্রশান্ত গর্বে তুলে ধরে নতুন পাড়ার দিকে রওয়ানা দেন ওয়াজির মোল্লা। কোনো ইতিহাস, পুরাণ কিংবদন্তির সঙ্গে অন্বিত হতে চান না। কিছুতেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress