অপেক্ষা : ০৮
অনেক্ষণ ধরে টেলিফোন বাজছে।
মিতু টেলিফোনের পাশেই, ভুরু কুঁচকে আছে। ক্রিং ক্রিং শব্দটা থামলে তার ভুরু মসৃণ হবে। যে টেলিফোন করেছে সে একসময় বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে— মিতুর তাই ধারণা। ইদানীং খুব আজে বাজে কল আসছে। কথা বাতাঁর ধরণ থেকে মনে হয় নাইন টেনের ছাত্র। কুৎসিত বাক্য মুখে ঠিকমত আসছে না, আবার বলার ইচ্ছাও আছে। মিতুর ধারণা চার পাঁচজনের একটা দল আছে। কুৎসিত কথা। একজন বলে অন্যরা হাতে মুখ চাপা দিয়ে খিক খিক করে হাসে। যেমন একজন বলল, আচ্ছ। আপা আপনার বুকের সাইজ কত? ব্রার নাম্বার কত থাটি ফোর, না থাটি সিক্স? চারদিকে শুরু হল খিক খিক হাসি। এই জাতীয় একটা বাক্যেই সারাদিনের জন্যে মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে। মিতু প্ৰতিজ্ঞা করেছে সে টেলিফোন ধরবে না।
আজ যে টেলিফোন করেছে তার ধৈৰ্য অসীম। সে বিরক্ত হয়ে লাইন কেটে দিচ্ছে না। ধরেই আছে। কিছুক্ষণ বিরতি নেয়। আবার করে। মিতু শেষটায় চোখ মুখ কঠিন করে রিসিভার হাতে নিল। ওপাশ থেকে মিষ্টি এবং কোমল গলায় একটি মেয়ে বলল–এটা কি ইমন ভাইয়াদের বাড়ি?
মিতু বলল, হ্যাঁ।
আপনি কে?
আমি ইমনের বড়বোন।
আপা স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
ইমন ভাইয়া কি বাসায় আছে?
তুমি একটু ধরে থাক, আমি দেখছি ও আছে কি-না। তোমার নাম কি?
নবনী।
নবনী বললেই সে তোমাকে চিনবে?
জ্বি।
আচ্ছা তুমি ধরে থাক।
মিতু ইমনের ঘরে ঢুকল। ইমন পড়ছিল, মিতুকে দেখে শুধু তাকাল, কিছু বলল না।
মিতু বলল, দিনের বেলা দরজা জানালা বন্ধ করে তুই পড়িস কি ভাবে? অন্ধকারে চোখের বারোটা বাজবো।
ইমন কিছু বলল না। প্রশ্ন না করলে সে জবাব দেয় না। এখনো তাকে কোন প্রশ্ন করা হয় নি। মিতু বলল, চা খাবি? ইমনের চা খাবার কোন ইচ্ছা নেই। তবু সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ইমান লক্ষ্য করেছে সে চা খেতে চাইলেই মিতু ট্রেতে করে দুকাপ চা নিয়ে আসে। ইমনকে এক কাপ দিয়ে নিজে এক কাপ নেয়। চা খাবার সময়টা পা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করে। মিতুর সেই গল্পগুলি হয় খুব মজার। চা খেতে ইচ্ছে না হলেও শুধুমাত্র গল্প শোনার লোভে ইমন চা খেতে চায়।
মিতু আবার এসে টেলিফোন ধরল।
হ্যালো নবনী!
জ্বি, আপা।
ইমনতো বাসায় নেই— মনে হয় সেলুনে চুল কাটাতে গেছে।
ও আচ্ছা।
তাকে কি কিছু বলতে হবে?
জ্বি না, কিছু বলতে হবে না।
নবনী নামের একটা মেয়ে টেলিফোন করেছিল এটা বলব? না-কি কিছুই বলব না।
আচ্ছা, বলতে পারেন।
আমি কি বলব তোমাকে টেলিফোন করতে?
জি না, দরকার নেই।
তবু সে হয়তো তোমাকে টেলিফোন করতে চাইবে তখন কি নিষেধ করব?
জি না, নিষেধ করার দরকার নেই।
ও কি তোমার টেলিফোন নাম্বার জানে?
আমি একবার কাগজে লিখে দিয়েছিলাম।
এক কাজ করতে পার আমাকে টেলিফোন নাম্বার দিতে পার , ও যদি আগের নাম্বার ভুলে গিয়ে থাকে। আমি দিতে পারব। তুমি বল আমি লিখে নিচ্ছি। আর আমার নিজেরো টেলিফোনে কথা বলতে ভাল লাগে। মাঝে মাঝে আমিও কথা বলতে পারি।
আশ্চৰ্যতো, আপনার সঙ্গে আমার খুব মিল। সামনা সামনি কথা বলতে আমার ভাল লাগে না। টেলিফোনে কথা বলতে ভাল লাগে।
তাহলে তুমি নিশ্চয়ই খুব রূপবতী। একমাত্র রূপবতীদেরই সামনা সামনি কথা বলতে ভাল লাগে না।
আপা আমি খুব রূপবতী না, মোটামুটি।
কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস টেন। এবার এস.এস.সি দেব।
ইমনের সঙ্গে পরিচয় হল কি ভাবে?
উনিতো আমার স্যার। সপ্তাহে তিনদিন আমাকে অংক করান।
ও আচ্ছা। ইমন আমাদের কিছু বলেনি। স্যারকে ভাইয়া ডাক?
স্যার ডাকতে ভাল লাগে না, এই জন্যে ভাইয়া ডাকি। আপা টেলিফোন নাম্বারটা লিখে রাখুন। আমার এক্ষুণি টেলিফোন ছেড়ে দিতে হবে। মা আসবে। আমি সারাক্ষণ টেলিফোনে কথা বলিতো, এটা মার খুব অপছন্দ।
নবনী টেলিফোন নাম্বার বলল। মিতু লিখে রাখল না। টেলিফোন নাম্বার মনে রাখার ব্যাপারে তার ভাল দক্ষতা আছে। একবার কোন নাম্বারা শুনলে তার সারাজীবন মনে থাকে। পড়াশোনা তেমন মনে থাকে না। মিতুর ধারণা টেলিফোন অপারেটরের চাকরি সে খুব ভাল করবে।
মিতু দুকাপ চা নিয়ে ইমনের ঘরে ঢুকল। চায়ের কাপ ইমনের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, তারপর তোর খবর কি?
ইমন বলল, ভাল।
কেমন ভাল? মোটামুটি না খুব ভাল?
ইমন কিছু বলল না। মিতুর সঙ্গে সে খুব বেশী কথাবার্তায় যায় না। মেয়েটাকে তার একটু ভয় ভয় লাগে। তার সব সময় মনে হয় এই মেয়েটার সামনে যেই দাঁড়ায় তার সব রহস্য ফাস হয়ে পড়ে। মিতু কিছু বিশেষ ক্ষমতায় মনের সব কথা বুঝে ফেলে।
ইমন সাহেব?
হুঁ।
তুই কি প্রাইভেট টিউশানি করিস না-কি?
হুঁ।
কাউকেতো কিছু বলিস নি।
বলার কি আছে?
তাও ঠিক, বলার কি আছে। কত টাকা দেয়?
এক হাজার টাকা।
মাত্ৰ?
এক হাজার টাকা মাত্র হবে কেন?
আমার কাছেতো মাত্র বলেই মনে হচ্ছে। তোর মত ব্রিলিয়ান্ট একজন ছাত্র বাসায় গিয়ে পড়াচ্ছিস! ওরা কি নাশতা দেয়?
হ্যাঁ দেয়।
ভাল নাশতা?
ইমন বলল, এত কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
মিতু সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গলা নিচু করে বলল, তোর ছাত্রী দেখতে কেমন?
ইমন বলল, দেখতে ভাল।
পুতুল পুতুল চেহারা?
পুতুল পুতুল চেহারা কি-না। আমি জানি না। কোন চেহারাকে পুতুল পুতুল চেহারা বলে?
আমার দিকে দেখা। আমার চেহারা, পুতুল পুতুল না। আমার মধ্যে কোন মায়া নেই। আমি হচ্ছি। কঠিন একটা মেয়ে।
মিতুকে এখন সত্যি কঠিন দেখাচ্ছে। ইমন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মিতুর চেহারার এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ সে ধরতে পারছে না। মিতু নিজেও বুঝতে পারছে না। সে হঠাৎ এমন রেগে গেছে কেন। নবনী নামের একটা মেয়েকে ইমন পড়ায় এটাই কি রাগের কারণ? এর মধ্যে রাগের কি আছে? ইমন পড়ার খরচ চালানোর জন্যে এটা করতেই পারে। করাটাই স্বাভাবিক। খবরটা গোপন রাখার জন্যে কি মিতু রাগ করেছে? তাওতো না। গোপন করা ইমনের স্বভাব। কোন কিছুই সে বলে না। তার বেশীর ভাগ খবর জানা যায় অন্যের মাধ্যমে।
ইমন, আজ বিকেলে কি তোর টিউশানি আছে?
না।
আজ বিকেলে তুই আমার সঙ্গে বনানী মার্কেটে যাবি। আমার এক বান্ধবীর হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওর বিয়ের গিফট কিনব।
আজতো যেতে পারব না।
কেন যেতে পারবি না?
আজি বিকেলে আমি আমাদের ক্লাসের এক ছেলের কাছে যাব। ওর সঙ্গে
কথা হয়ে আছে।
আজ না গিয়ে কাল যাবি। তোর এপয়েন্টমেন্টতো আর প্রাইম মিনিস্টারের এপিয়েন্টমেন্ট না যে রদবদল করা যাবে না।
ওর একটা কম্পিউটার আছে। আমি ওর কম্পিউটারে ল্যাবের কাজগুলি দেখি।
আরেক দিন দেখবি। একদিন প্র্যাকটিক্যাল না দেখলে কিছু হয় না।
আচ্ছা।
মিতু উঠে দাঁড়াল এবং তীব্র গলায় বলল, তোর যেতে হবে না। ঘর থেকে বের হবার সময় সে এত দ্রুত বের হল যে দরজায় বাড়ি খেয়ে মাথা ফুলে গেল। অন্য যে কোন ছেলে হলে পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় হকচাকিয়ে যেত। ইমনের বেলায় তার ব্যতিক্রম হল। সে সঙ্গে সঙ্গে বই নিয়ে বসল। বই এ সে ঠিক মন বসাতে পারল না। এই বই এর ফাঁকেই একটা রেজিস্ট্রি চিঠি লুকানো আছে। চিঠিটা গত সপ্তাহে এসেছে। চিঠির হাতের লেখা অপরিচিত। চিঠির ভাষা অশালীন কিন্তু চিঠিটা যে পাঠিয়েছে সে পরিচিত। চিঠিটার লেখক মিতু এই ব্যাপারে সে একশ ভাগ নিশ্চিত। চিঠির একটা লাইন হচ্ছে— জনগো তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুজো হয়ে হাঁট কেন? এই লাইনটাই বলে দিচ্ছে চিঠি মিতুর লেখা। মিতু তাকে কয়েকবার বলেছে—এই তুই রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কুজো হয়ে হাঁটিস কেন? তোকে দেখলে মনে হয়। হানচব্যাক অব নটরডাম।
মিতুর উদ্দেশ্য যদি হয় মজা করা তাহলে সে এই লাইনটি লিখে নিজেকে স্পষ্ট করে তুলল কেন? না-কি মিতু চাচ্ছে চিঠি পড়ে সে যেন পত্র-লেখক কে তা ধরতে পারে? মাঝে মাঝে ইমনের মনে হয় এই ব্যাপার নিয়ে সে মিতুর সঙ্গে কথা বলে, তারপরই মনে হয়, কথা বলে কি হবে? ইমন বই এর ভাজ থেকে আবার চিঠিটা বের করল। রুল টানা কাগজে মজার একটা চিঠি। আচ্ছ এমন কি হতে পারে যে এটা তাকে খুব চিন্তা ভাবনা করে লেখা মিতুর প্রথম প্ৰেম পত্র। এর একটা জবাব পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? রেজিস্ট্রি করা জবাব। সম্বোধন হবে আমার প্রাণ পাখি বুলবুলি। চিঠিটা হবে অবিকল আগের চিঠির কপি। আগের চিঠিতে যেখানে জান লেখা সেখানে সে লিখবে জানের স্ত্রী লিংগ জানি। শুধু চিঠির শেষে নামের জায়গায় লিখবে–ইতি, হানচব্যাক অব নটরডাম।
ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে। ইমান বই এ মন দেবার চেষ্টা করল। মন বসছে না। মিতুর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। এই ইচ্ছাটা তার প্রায়ই হয়। মাঝে মাঝে এত প্রবল হয় যে সে আতংকগ্ৰস্থ হয়ে পড়ে। কয়েকবার সে স্বপ্নে মিতুকে দেখেছে। মানসিক ভাবে সে নিশ্চয়ই অসুস্থ নয়ত এমন স্বপ্ন দেখত না। একটা স্বপ্ন ছিল ভয়াবহ— সে খাটে বসে বই পড়ছে। অনেক রাত। মিতু ঘরে ঢুকে বলল, এই শোন চোখ বন্ধ করা। ইমন বলল, কেন? মিতু বলল, কেন মানে? আমি ঘুমাব না?
ঘুমুলে চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?
আমি কি শাড়ি পড়ে ঘুমুতে যাব না-কি? নাইটি পরে ঘুমুব।
ইমন চোখ বন্ধ করল। এর মধ্যেও পিট পিট করে তাকাল। সত্যি মিতু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শাড়ি খুলে নাইটি পরে বিছানায় উঠে এসে বলল, ঘুমুতে এসো। এত বেশী পড়াশোনা করার দরকার নেই। শেষে আইনস্টাইন হয়ে যাবে।
ইমন স্বপ্নের মধ্যেই বুঝতে পারছে— মিতু তাকে তুই তুই করে বলছে না। মিতু তার স্ত্রী। স্ত্রীরা স্বামীকে তুই করে বলে না।
স্বপ্নটা দেখার পর প্রায় এক সপ্তাহ ইমন মিতুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে নি। তার কাছে মনে হয়েছে— মিতুর চোখে চোখ পড়লেই মিতু সবকিছু বুঝে যাবে।
একদিন মিতু নিজেই বলল, এই শোন, তুই আমাকে দেখলেই এমন পাস কাটিয়ে চলে যাস কেন? তোর সমস্যাটা কি? আমাকে তুই ভয় পাস না-কি?
ভয় পাব কেন?
ভয় কেন পাবি সেটাতো আমি জানি না। তোর ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হয়— হয় তুই আমাকে ভয় পাস, আর নয়তো তুই আমার প্রেমে পড়েছিস। প্রেমের প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলেরা এমন করে।
তুই প্ৰেম বিশারদও হয়েছিস না-কি?
আমি সর্ববিদ্যা বিশারদ। আমার মাছির মত ত্ৰিশ হাজার চোখ।
ইমন বলল, চোখ বেশী থাকার সমস্যাও আছে। চোখ যত বেশী ভিশন তত পুওর। প্রকৃতি একটা দিলে আরেকটা দেয় না।
প্রকৃতি যাকে দেবার তাকে উজার করেই দেয়। যাকে দেবার না তাকে কিছুই দেয় না। এই জন্যেই একজন হয়। রবীন্দ্রনাথ একজন হয় ঠেলাগাড়ির ড্রাইভার মুকাদ্দেছ।
মিতুর মন সচরাচর খারাপ হয় না। আর খারাপ হলেও তা বোঝা যায় না। আজ মিতুর মন বেশ খারাপ। ইমনের ঘর থেকে বের হয়ে সে প্রথমে ছাদে গেল। বেশীক্ষণ থাকল না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নেমে এল। তার মন খারাপ কি-না তা বোঝার উপায় হচ্ছে—সে রান্নাঘরে কি-না। যদি দেখা যায়। সে রান্নাঘরে ঢুকে কোন একটা রান্না নিয়ে ব্যস্ত তাহলে বোঝা যাবে তার মন বিশেষ খারাপ।
মার ঘরের পাশ দিয়ে রান্নাঘরে যাবার সময় ফাতেমা খুশী খুশী গলায় ডাকলেন, মিতু শুনে যা। তার খুশীর প্রধান কারণ হচ্ছে সুনামগঞ্জ থেকে পাগলা পীর সাহেব এসেছেন। আজ রাতে তিনি থাকবেন। নানান বিষয়ে গণা গুনবেন। বর্তমানে তিনি ফাতেমার ঘরে আছেন। ফাতেমার সঙ্গে পীর সাহেব ধর্ম বোন পাতিয়েছেন।
মিতু মার ঘরে উঁকি দিতেই পীর সাহেব মুখ ভর্তি হাসি দিয়ে বললেন—আম্মাজীর মুখ মলিন কেনে? মিতু পীর সাহেবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা ডাকছ কেন?
ফাতেমা ঝলমলে গলায় বললেন, পীর সাহেবকে দিয়ে তোর বিয়ের গনাটা গনিয়ে নে। কোথায় বিয়ে হবে কবে হবে সব বলে দেবেন।
মিতু বলল, আমার কোথায় বিয়ে হবে, কবে হবে, আমি জানি। পীর সাহেবকে গুনে বের করতে হবে না।
পীর সাহেব মনে হল মিতুর কথা শুনে মজা পেয়েছেন। খিক খিক করে হাসছেন।
পীর সাহেবের বয়স চল্লিশের মত। দাড়ি গোফ নেই। সার্ট পেন্ট পরেন। মজার মজার কথা বলেন। তাঁর ভবিষ্যৎ গাণার পদ্ধতিটাও একটু ভিন্ন। এক টুকরা শাদা কাগজ নিয়ে নানান চিহ্ন আঁকেন। তারপর সুনামগঞ্জের ভাষায় হাসিমুখে বলেন— দরখাস্ত পেশ করেন।
অর্থাৎ কি জানতে চান বলুন।
যখন কিছু জানতে চাওয়া হয় তখন কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিজের মনে বিড়বিড় করেন। শাদা কাগজে আরো কিছু আঁকি বুকি কাটেন। তারপর বলেন, বিসমিল্লাহ, বইল্যা আংগুল ফেলেন।
তখন বিসমিল্লাহ বলে আঁকি বুকি কাটা কাগজে আংগুল ফেলতে হয়। ংগুল ফেলা মাত্র পীর সাহেব হড়বড় করে প্রশ্নের জবাব দিতে থাকেন।
মিতুর ধারণা এই মানুষ পীর ফকির কিছু না— অতি ধুরন্ধর। মানুষের প্রশ্ন থেকেই জবাবটা কি হলে ভাল হয় সেটা আঁচ করে নেয়। সেই দিকেই সে অগ্রসর হয়। মিতুর ধারণা সত্যি হবার সম্ভাবনা আছে। এই মুহুর্তে পীর সাহেব ফাতেমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। ফাতেমা বললেন, ভাই আমার ছেলে দুইটা সম্পর্কে বলেন। একজনের নাম শোভন একজনের নাম টোকন।
পীর সাহেব বললেন, ভইন দরখাস্ত পেশ করেন। হাই কোর্টে দরখাস্ত দেন।
ফাতেমা বললেন, ওরা আছে কেমন?
পীর সাহেব বললেন, ভাল আছে। খুব ভাল আছে।
ফাতেমা বললেন, কোন বিপদে পড়বেনাতো?
প্রশ্ন থেকে পীর সাহেব বিপদের আঁচ পেলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, বিপদের মধ্যেইতো আছে। নতুন কইরা পড়ব কি?
ফাতেমা পীর সাহেবের আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় অভিভূত হলেন।
বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ কি?
পীর সাহেব কাগজে আঁকি বুকি কাটতে লাগলেন। ফাতেমাকে দিয়ে তিনি কয়েকবার তর্জনী দিয়ে কাগজ ছোয়ালেন। প্রতিবারই তার মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হল। যেন জবাবটা পাচ্ছেন।
মাথার মধ্যে চাপ পড়তা ছেগো ভইন। চা খাব। চা খাওনের পর আরেকবার চেষ্টা কইরা দেখব।
এ বাড়িতে পাগলা পীর সাহেব এলে সবচে উত্তেজিত অবস্থায় যে থাকে তার নাম সুপ্ৰভা। সে সারাক্ষণ পীর সাহেবের সঙ্গেই থাকে। পীর সাহেবকে ডাকে পীর মামা। আজ সুপ্রভার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুল থেকে ফিরে সে আতংকে অস্থির হয়ে আছে। তার কিছুই ভাল লাগছে না। স্কুল থেকে ফিরে সে ভাত খায়–ভাত খেতে পারে নি। খাবার নাড়াচাড়া করে রেখে দিয়েছে। কারণ সে ভয়ংকর বিপদে পড়েছে। এই বিপদ থেকে সে কি ভাবে উদ্ধার পাবে তা জানে না। দোয়া ইউনুস ক্রমাগত পড়তে থাকলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। দোয়া ইউনুস সে ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছে। বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথ দেখছে না। স্কুলে সে তার গলার চেইনটা হারিয়ে ফেলেছে। এক ভরী সোনার চেইন সুরাইয়া তার মেয়ের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন । সোনার গয়না পরে স্কুলে যাওয়া এমনিতে নিষেধ। আজ ছিল প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন। সেই উপলক্ষে কিছু সাজগোজ করার অনুমতি ছিল। এই অনুমতি কাল হয়েছে। চেইন যে হারিয়েছে এটা সে টের পেয়েছে স্কুল থেকে আসার পর। স্কুলে থাকার সময় টের পাওয়া গেলে মাঠে যেখানে সবাই মেয়েরা মিলে দৌড়াদৌড়ি করেছিল সেখানে খোঁজা যেত।
সুপ্ৰভা দোয়া পড়েই যাচ্ছে। দোয়া যদি কবুল হয় তাহলে জিনিসটা কি ভাবে পাওয়া যাবে সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ দেখা যাবে হারানো চেইন তার গলায় দুলছে? নাকি হঠাৎ স্কুলের দারোয়ান চাচা বাসায় উপস্থিত হয়ে বলবে–আপামনি আপনার চেইন পাওয়া গেছে। সমস্যা হচ্ছে স্কুলের দারোয়ানতো তার বাসার ঠিকানা জানে না।
জামিলুর রহমান লক্ষ্য করলেন সুপ্ৰভা সিঁড়ি ঘরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। তিনি কাছে এগিয়ে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কাঁদছিস কেন?
সুপ্ৰভা জবাব না দিয়ে ছুটে এসে তার বড় মামাকে জড়িয়ে ধরল।
জামিলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কান্না বন্ধ করে বল সমস্যাটা কি। মা বকা দিয়েছে?
না।
তাহলে হয়েছে টা কি?
সুপ্ৰভা ফুঁপাতে ফুঁপাতে তার সমস্যার কথা বলল। জামিলুর রহমান বললেন, কাপড় বদলে চল আমার সঙ্গে?
কোথায় যাব?
চল দেখি সমস্যার সমাধান করা যায় কি না। কেঁদোতো তুই আমার পাঞ্জাবী ভিজিয়ে ফেলেছিস। কান্না বন্ধ কর।
জামিলুর রহমানের মত কৃপণ মানুষ সুপ্রভাকে নিয়ে অনেক দোকান ঘুরে ঠিক আগের চেইনের মত দেখতে একটা চেইন কিনে দিলেন। সুপ্ৰভা বলল, মামা এটাতো বেশী চকচক করছে। মা যদি বুঝে ফেলে।
বুঝবে না। তোর মা খুঁটিয়ে আজকাল কিছুই দেখে না।
মামা একটা কাজ করলে কেমন হয়— চেইনটা নিয়ে তেতুল দিয়ে ধোয়া শুরু করি। মার সামনে ধুই। মা বুঝবে যে ধোয়ার জন্যে পরিষ্কার হয়েছে।
বুদ্ধিটা খারাপ না।
মামা কোক খাব।
কোক-ফোক না। আজে বাজে জিনিস খেয়ে শরীর নষ্ট।
কোকের একটা ক্যান জামিলুর রহমান কিনে দিলেন। কোক খেতে খেতে সুপ্ৰভা ফিরছে। হড়বড় করে অনবরত কথা বলছে। বড় মায়া লাগছে জামিলুর রহমান সাহেবের।