অপেক্ষা : ০৬
জামিলুর রহমান সাহেবের বাড়িতে আজ ভয়াবহ উত্তেজনা। তিনি অফিসে যাননি। বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে আছেন। হাতে মোটা একটা দড়ি। তার সামনের টেবিলে চা দেয়া হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন না। চা ঠান্ডা হচ্ছে। আজ টোকন-শোভন দুই ভাইকে শান্তি দেয়া হবে। এই শাস্তি মাঝে মধ্যেই দেয়া হয়। শাস্তি প্রক্রিয়া ভয়াবহ।
ফাতেমা চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছেন। শোভন টোকনকে ঘরে ঢুকিয়ে তালা মেরে দেয়া হয়েছে। যথা সময়ে তালা খুলে জমিলুর রহমান সেই ঘরে দড়ি হাতে ঢুকবেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেবেন। পরের এক ঘণ্টা ভেতর থেকে পশুর গোংগানীর মত শব্দ আসবে।
ফাতেমা স্বামীর সামনে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় বললেন, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক কাপ বানিয়ে দেব?
জামিলুর রহমান বললেন, না।
ওরা কি করেছে।
কি করেছে তোমার জানার দরকার নেই।
ফাতেমা প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, ছেলেমানুষ।
জামিলুর রহমান বললেন, দুদিন পর এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। ছেলেমানুষ মোটেই না। দাড়ি গোফ উঠে গেছে–ছেলেমানুষ কি?
কর। তুমি বাবা, তুমিতো শাসন করতেই পার। আমার এই অনুরোধটা রাখ।
জামিলুর রহমান বললেন, যাও, চা আন। ফাতেমাকে যত বোকা মনে হয় তত বোকা তিনি বোধ হয় না। চা বানানোর কথা বলে তিনি সময় নিচ্ছেন। যত সময় যাবে রাগ তত পড়বে। চা বানিয়ে সুপ্রভার হাতে দিয়ে পাঠাতে হবে। মানুষটা এক মাত্র সুপ্রভার সঙ্গে সহজভাবে কথা বলে। সুপ্ৰভা হাত নেড়ে নেড়ে কি সব গল্প করে–মানুষটা আগ্রহ নিয়ে শুনে। সুপ্রভাকে বলতে হবে মজার কোন দীর্ঘ গল্প সে যেন শুরু করে।
ফাতেমা নিজেই চা বানাতে গেলেন। অনেক দিন চুলার পাশে যান না। শরীর ক্রমেই ভারী হয়ে যাচ্ছে। আগুনের আঁচ আজিকাল আর সহ্য হয় না। মাথা দপ দপ করে।
তালাবন্ধ ঘরের খাটে শোভন টোকন বসে আছে। শোভনকে মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। তবে টোকন ভয় পেয়েছে। তার মধ্যে ছটফটানির ভাব স্পষ্ট। সে বারবারই বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছে।
তাদের অপরাধ মোটামুটি গুরুতর। এই অপরাধ আগে কয়েকবার করেছে, ধরা পড়ে নি। আজ সকালে ধরা পড়ে গেছে। ধরা পড়ার কোন কারণ ছিল না। দুই ভাইয়ের হিসেবে সামান্য গন্ডগোল হয়ে গেছে।
জামিলুর রহমান সকালবেলা বাথরুমে অনেকখানি সময় কাটান। তিনি খবরের কাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেন এবং কাগজ শেষ করে বের হন। খুব কম করে হলেও পনেরো মিনিট সময় লাগে। বাবার কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কিছু টাকা সরানোর জন্যে এই সময়টা যথেষ্ট। তারা তাই করল। কিন্তু সামান্য গন্ডগোল হয়ে গেল। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করার সময় জামিলুর রহমান শোবার ঘরে ঢুকলেন। জমিলুর রহমান বললেন, তোরা আয় আমার সঙ্গে। তারা বাবার সঙ্গে গেল। এইখানে আরো একটা ভুল করা হল। তারা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারত। পালিয়ে যাওয়া হল না। জামিলুর রহমান দুই ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিলেন।
শোভনের পানির পিপাসা পেয়েছে। শাস্তি কখন শুরু হবে বলা যাচ্ছে না, পানি খেয়ে নিতে পারলে ভাল হত। পেছনের দিকের জানালাটা খোলা। সেই জানোলা দিয়ে এক জগ পানি যদি কেউ দিত। শোভন খাট ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। জানালায় লম্বা করে শিক বসানো। একটা শিক বাকানো কোন কঠিন কাজ না। শাবল দিয়ে চাড় দিলেই শিক বাঁকবে। দারোয়ান ভাইয়ের ঘরে শাবল আছে।
জানালার পাশে ইমনের মুখ দেখা গেল। ভয়ে তার মুখ শাদা হয়ে গেছে। টোকন-শোভন দুই ভাইই তার খুব প্রিয় মানুষ। রাতে সে এই ঘরে তাদের সঙ্গে ঘুমায়। এদের ভয়াবহ শাস্তি কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে। ভাবতেই তার বুক শুকিয়ে আসছে। এর আগের বার শোভন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ডাক্তার আনতে হয়েছে, স্যালাইন দিতে হয়েছে। আজও নিশ্চয়ই সে রকম হবে।
ইমন!
হুঁ।
যা–চট করে এক জগ পানি নিয়ে আয়।
ইমন ছুটে গেল পানি আনতে। পানির জগ শিকের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে না। সে জগ বদলে দুটা পানির বোতল নিয়ে এল। শোভন বলল, বাবা কি করছে রে?
চা খাচ্ছেন।
হাতে দড়ি আছে?
হুঁ।
তুই একটা কাজ কর। দারোয়ান ভাইয়ের ঘর থেকে শাবলটা নিয়ে আয়। শাবল দিয়ে শিকে চাড় দিয়ে শিক বাকিয়ে ফেলবি। আমরা পগার পার হয়ে যাব। পারবি না?
পারব।
তাহলে দেরি করিস না।
ইমন শাবল আনতে ছুটে গেল। জানালার শিক বাঁকানোর কাজটা খুব সহজেই হয়ে গেল। দুই ভাই মুহুর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল।
জামিলুর রহমান তালা খুলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শীতল গলায় ডাকলেন, ইমন।
ইমন ফ্যাকাশে মুখে ঘরে ঢুকল। জমিলুর রহমান বললেন, তুই কাপছিস কেন? তুই কি করেছিস? ওদের সাহায্য করেছিস?
ইমন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
কি ভাবে সাহায্য করেছিস?
শাবল এনে দিয়েছি।
সার্ট খোল।
ইমন সার্ট খুলল।
বিছানায় উপুড় হয়ে থোক। আজ তোকে এমন একটা শিক্ষা দেব যে, জীবনে কখনো অপরাধীকে সাহায্য করবি না।
জামিলুর রহমান ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দড়ি হাতে নিলেন। ইমন দাঁত কামড়ে পড়ে আছে। তার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যাবে। দরজা বন্ধ। ইচ্ছা থাকলেও কেউ তাকে বাচানোর জন্যে আসবে না। প্রচন্ড শারীরিক যন্ত্রণার সময় কোন প্রিয়জনকে ডাকতে ইচ্ছা করে। ইমান ফিস ফিস করে ডাকছে –ছোট চাচা। ও ছোট চাচা। বাতাস কেটে দড়ি শী শী শব্দে নিচে নেমে আসছে। এই শব্দে ইমনের ডাকাডাকি চাপা পড়ে যাচ্ছে। ইমন অজ্ঞান হয়ে যাবার আগমুহুর্তে দেখল— জানালার শিক ধরে মিতু এসে দাঁড়িয়েছে। মিতুর গোলাকার মুখ লালচে হয়ে আছে। মিতু তীব্র স্বরে— সারা বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল— বাবা বাবা।
এরপরে কি ঘটেছে ইমনের মনে নেই।
সন্ধ্যাবেলা ফিরোজ এসে হতভম্ব! ইমন অর্ধচেতনের মত পড়ে আছে। তার সারা গায়ে ব্যাণ্ডেজ। শরীরে জ্বর। ঠোঁট কেটে ফুলে উঠেছে।
ফিরোজ বলল, তোর কি হয়েছে?
ইমন বলল, কিছু হয় নি।
কিছু হয়নি মানে? কে তোকে মেরেছে?
বড় মামা।
তোর বড় মামা কি পাগল? এইভাবে কেউ কাউকে মারে? সে পেয়েছে কি? বাড়িতে জায়গা দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে? তোর এখানে থাকতে হবে না। তুই চলতো।
কোথায় যাব?
আমার সঙ্গে যাবি। আমার মেসে থাকবি। মেসে থেকে পড়াশোনা করবি। তোকে আমি এই বাড়িতে রাখব না।
মা যেতে দেবে না ছোট চাচা।
যেতে দেবে না মানে? অবশ্যই যেতে দিতে হবে। আমি ভাবীর সঙ্গে কথা বলছি।
ফিরোজ দোতলায় উঠে গেল। সুরাইয়া দোতলার বারান্দায় টুলের উপর বসে ছিলেন। তার হাতে একটা বই। বইটার নাম স্বপ্ন তথ্য। স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়া। স্বপ্নের ব্যাখ্যা পড়তে তাঁর ভাল লাগে। ফিরোজকে দেখে তিনি বই বন্ধ করলেন। তার চোখে ঈষৎ বিরক্তি দেখা গেল।
ভাবী কেমন আছেন?
ভাল।
ইমনের কি অবস্থা। আপনি দেখেছেন?
দেখিনি— শুনেছি। অপরাধ করেছে–শাস্তি পেয়েছে।
এইভাবে কেউ কাউকে মারে?
ভাইজানের রাগ বেশী। তিনি যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। শাসনের দরকার আছে। শুধু আদরে কিছু হয় না।
ভাবী, আমিতো ইমনকে এখানে রাখব না।
তুমি তাকে রাখা না রাখার কে? তুমি তাকে কোথায় নিয়ে রাখতে চাও? তোমার মেসে? খামাখা রাগ দেখিও না। খামাখা আদরও দেখিও না।
ভাবী, আমি কোন রাগ দেখাচ্ছি না। আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে।
এইসব মন খারাপের কোন দাম নেই। মাসে দুই মাসে একবার আসবে। সাথে থাকবে সস্তার কিছু খেলনা। খানিকক্ষণ কচলা-কচলি করে চলে যাবে। এইসব আদরের মানে কি?
ভাবী আপনি আমার উপর কেন রাগ করছেন বুঝতে পারছি না।
আমি রাগ করছি নাতো। তোমার উপর রাগ করব কেন?
ফিরোজ হতাশ গলায় বলল, ভাবী, আজ রাতটা আমি এই বাড়িতে থেকে যাব। ওর খুব জ্বর। ইমনের সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকি। ওর পাশে কারোর থাকা দরকার।
সুরাইয়া স্বপ্ন তথ্যের বই খুলতে খুলতে শুকনো গলায় বললেন, বাড়তি আদর দেখানোর কোন দরকার নেই। ওদের কপালে অনাদর লেখা–আমি চাই ওরা যেন অনাদরেই মানুষ হয়।
আপনি কি ইমনকে দেখেছেন?
না।
আপনার কি উচিত না, ওর পাশে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বসা।
শোন ফিরোজ, আমার কি উচিত বা অনুচিত এই উপদেশ তুমি আমাকে দিতে এসো না। আমি কাউকে উপদেশ দেই না। আমিও চাই না কেউ আমাকে উপদেশ দিক। এক কাজ কর আজ তুমি চলে যাও। অন্য একদিন এসো। আজ তুমি উত্তেজিত। আমি নিজে সারাক্ষণ উত্তেজনার মধ্যে থাকি— অন্যের উত্তেজনা আমার ভাল লাগে না।
চলে যেতে বলছেন?
হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি।
জামিল ভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বলে যাই।
অবশ্যই তুমি তার সঙ্গে কথা বলবে না।
সুরাইয়া স্বপ্নের বই খুলে বসলেন। সাপ দেখলে, শত্রু বৃদ্ধি পায়, সাপ কামড়াতে দেখলে, অসুখ হয়। সাপ মারতে দেখা শুভ–শত্রু বিনাস হয়। সাপ ও সাপিনিকে শঙ্খ লাগা অবস্থায় দেখলে— ধন প্রাপ্তি কিংবা পুত্ৰ সন্তান প্রাপ্তি।
ইমনের জ্বর কমেছে। দুপুরে একশ দুই ছিল, এখন একশ। ঘুমের ওষুধ দেয়ার কারণে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। সারাদিনে কিছু খায়নি। কিছুক্ষণ আগে এক বাটি সুপ খেয়েছে। তার মাথার কাছে সুপ্ৰভা বসে আছে। সুপ্ৰভা তাকে গল্পের বই পড়ে শুনাচ্ছে। ইমনের গল্প শুনতে মোটেও ভাল লাগছে না। বেচারী এত আগ্রহ নিয়ে পড়ছে বলে ইমন কিছু বলছে না। সুপ্ৰভা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে। ইমনের মনে হল— তার বোনটা ঐতো কিছুদিন আগেই হামাগুড়ি দিত— আজি এত বড় হয়ে গেছে। ভাইকে বই পড়ে শুনাচ্ছে— কি আশ্চর্য। সুপ্ৰভা রিনারিনে গলায় পড়ছে— লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু চোখের সামনে থেকে বইটা সরিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, রামমোহন রায়ের নাতি ছিল সেটা জানতেন? ফেলুদার মুখের উপর রুমাল চাপা, তাই সে শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে দিল।