অপেক্ষা : ২১
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। ঢাকা শহরের রাজপথগুলিতে হলুদ বাতি জুলতে শুরু করেছে। যে কোন শহরকে সবচে কুৎসিত দেখায় সন্ধ্যাবেলা। তখন প্রকৃতি তার আলো নিভিয়ে দেয়, মানুষ তার আলো জ্বালাতে শুরু করে। প্রকৃতির শেষ আলোর স্মৃতি মাথায় থেকে যায় বলেই মানুষের আলো অসহ্য বোধ হয়।
শোভন বলল, সোডিয়াম ল্যাম্পের আলো কি জঘন্য দেখছিস?
ইমন বলল, হুঁ।
সব কটা সোডিয়াম ল্যাম্প ইট মেরে ভেঙ্গে ফেলতে পারলে হত।
ইমন হাসল। শোভন ভাইয়ার কথা শুনতে তার খুব মজা লাগে।
তারা বসে আছে কলাবাগানের বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া শিশু পার্কে। শিশুরা কেউ নেই। কখনোই থাকে না। বিচিত্র ধরণের মানুষরা আনাগোনা করে।
ঠোঁটে গাঢ় করে লিপিস্টিক দেয়া পনেরো ষোল বছরের একটা কিশোরো কয়েকবার তাদের সামনে দিয়ে ঘুরে গেল।
ইমন বলল, শোভন ভাইয়া। চল উঠি। এই পার্কে একটা পাগল থাকে খুবই ভয়ংকর। ছুরি নিয়ে মানুষ তাড়া করে। কয়েকজনকে জখম করেছে।
শোভন বলল, আমাকে করবে না। পাগলরা মানুষ খুব ভাল চেনে। ওদের সেন্স কুকুরের মত। গন্ধ শুকে বলে দিতে পারে কার কাছে গেলে মহা বিপদের সম্ভাবনা।
তোমার কাছে এলে মহা বিপদের সম্ভাবনা?
অবশ্যই। পকেটে পিস্তল আছে না? বাদাম নিয়ে আয়তো। পার্কে বসলেই বাদাম খেতে ইচ্ছে করে।
চা খাবে? চা ওয়ালা আছে।
চা খাওয়া যায়।
ইমন বাদাম এবং চা নিয়ে এল। কিশোরী মেয়েটা আবারো এসেছে। মেয়েটা দেখতে ভাল। তবে মাথায় জব্বজবে করে তেল দিয়েছে। তার খন্দেরের অভাব হবার কথা না। সে এ রকম পিছে লেগে আছে কেন কে জানে।
শোভন বলল, তুই যে আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিস তোর ভাল লাগছে?
হুঁ।
কেন ভাল লাগছে বল দেখি।
ইমন চুপ করে রইল। শোভন বলল, আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে তোর ভাল লাগছে। কারণ আমি খুবই খারাপ লোক। খারাপ লোক বলেই মানুষ হিসেবে দারুন ইন্টারেস্টিং। ফেরেশতার মত মানুষ কখনো ইন্টারেস্টিং হয় না। তারা সব সময় সত্যি কথা বলবে, সব সময় শুদ্ধ কাজ করবে। তাদের গা থেকে আসবে আতরের গন্ধ।
ইমন বলল, মাঝে মাঝে তুমি খুব সুন্দর করে কথা বল।
খারাপ লোক বলেই কথা সুন্দর।
শোভন হাত ইশারা করে মেয়েটাকে ডাকল। মেয়েটা খুব হেলা ফেলা ভঙ্গি করে আসছে। খদের ছিপে আটকা পড়েছে। এখন অনাগ্রহের ভাব
দেখানো যায়। দাম বাড়ানো যায়।
শোভন বলল, তোর নাম কি?
নাম দিয়া দরকার কি?
যা ভাগ-বড় বড় কথা, নাম দিয়া দরকার কি?
মেয়েটা চলে গেল না। আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, নাম ববিতা।
নকল নাম? সিনেমার নায়িকার নামে নাম-সত্যি নাম বল।
জরিনা।
ভাড়া কত?
ছিঃ কেমুন কথা কন? আমি কি রিকশা, যে ভাড়া কত?
ভাড়া কত বল।
দুইজনে একশ টেকা লাগব। এইটা ফাইন্যাল কথা। দরদাম নাই। আমার অত ঠেকা নাই।
ইমন ভীত গলায় বলল, ভাইয়া চল যাই।
শোভন সঙ্গে সঙ্গে বলল, চল। দুজনেই উঠে দাঁড়াল। জরিনা বলল, আচ্ছা! শুনেন এই ভদ্রলোক, দেন পঞ্চাশ টেকাই দেন। আমার কোন রোগ নাই। আল্লার কীড়া।
শোভন রাস্তায় এসেই বেবীটেক্সি দাড়া করাল। জরিনা সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। খুব করুন মুখে বেবীটেক্সির দরদাম করা শুনছে। শোভন বেবীটেক্সিতে উঠেই মানি ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে মেয়েটার দিকে ছুঁড়ে क्रिब्ल!
ইমনের বুক ধ্বক ধ্বক করছে। সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল শোভন ভাইয়া মেয়েটাকে বেবীটেক্সিতে তুলে নেবে। এবং চলে যাবে পুরানো ঢাকার বোর্ডিং হাউসে। এখনো ইমনের শরীর কাপছে। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে মেয়েটাকে তোলা হয়নি।
ইমন!
হুঁ।
যত দিন যাচ্ছে তোর মার মাথা তত খারাপ হচ্ছে তাই না?
হুঁ।
এখনো সে পুরোপুরি বিশ্বাস করে আছে যে তোর বিয়ের রাতে তোর বাবা ফিরে আসবে?
হুঁ।
তোর বিয়ের রাতে কেউ যদি না আসে তাহলে তো পুরো ব্ৰেইন নষ্ট হয়ে যাবে।
ইমন কিছু বলল না। শোভন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মস্ত ভুল করা হয়েছে। শুরুতেই বলা উচিত ছিল যে তোর বাবা মানে আমার ফুপা, মারা গেছেন। তাহলে এই সমস্যা হত না। ফুপু আর অপেক্ষা করে থাকত না। তোর মার লাইফ এমন বেড়াছেড়া হয়ে যেত না। এখনো সময় আছে।
কি সময় আছে?
ফুপুকে বল যে আসল খবর পাওয়া গেছে। ফুপা মারা গিয়েছিলেন। রোড এক্সিডেন্ট। থানায় রেকর্ডে নাম পাওয়া গেছে।
এই প্রসঙ্গটা ইমনের ভাল লাগছে না, সে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যে বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
গোরান যাচ্ছি।
সেখানে কি?
আব্দুল কুদ্দুস বেপারীর খোঁজ পেয়েছি। গোরানের এক বাড়িতে ঘাপটি মেরে আছে। আজ তাকে শিক্ষা দেব।
ইমন ভীত গলায় বলল, কি শিক্ষা দেবে?
শোভন হাসিমুখে বলল, তুই কি ভাবছিস? গুলি করে মেরে ফেলব? আরে দূর-জাস্ট ভয় দেখাব। কানে ধরে উঠ বোস করাব। পায়ের জুতা চাটতে বলব। দেখিস কেমন করে জুতা চেটে পরিষ্কার করে। লুঙ্গি খুলিয়ে পাছায় লাথি দেব। তুই খুব মজা পাবি। ভয়ে আধমরা হয়ে যাওয়া মানুষের কান্ড কারখানা দেখার মধ্যে আনন্দ আছে।
শোভন হাসছে। হাসি থামিয়ে হঠাৎ গুনগুন করে গাইল-বাচুপানকে দিন ভুলানা দেনা। ইমন মুগ্ধ হয়ে গেল। বেবীটেক্সিওয়ালা পর্যন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে। সব কথাই তাহলে সে শুনছে। ইমান অস্বস্তি বোধ করছে। শোভন বলল, সিগারেট খাবি? ইমন বলল, না।
আরে খা। একটা সিগারেট খা। সিগারেট খাওয়া যায়। শুধু গাঁজাটা খাবি না।
আব্দুল কুদ্দুস বেপারীর বাড়িটা টিনের। বাড়ির সামনে গ্রামের ঘর বাড়ির মত গাছপালা। কলাগাছও আছে। জঙ্গলার মত হয়ে আছে। বাড়ির সামনে গেট আছে। গোটে সাইনবোর্ডে লেখা ময়না মিয়া হোমিওপ্যাথি। গোল্ড মেডালিস্ট।
ইমন বলল, এই বাড়ি?
শোভন বলল, হ্যাঁ।
তারা গেট খুলে উঠোনে ঢুকল। শোভন ডাকল, কুদ্দুস ভাই, কুদ্দুস ভাই।
পঞ্চাশের মত বয়সের এক লোক বের হয়ে এল। গায়ে চান্দর। মাথার চুল কাঁচা পাকা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কুদ্দুস পান খাচ্ছিল-মুখ ভর্তি পান। ঠোঁট লাল হয়ে আছে। কুদ্দুস বিস্মিত গলায় বলল, কে?
শোভন হাসি মুখে বলল, ভাল করে দেখুনতো চিন্তে পারেন কি-না। আপনি আমার কাছে একবার একটা পিস্তল বিক্রি করেছিলেন। ঐ পিস্তলটি নিয়ে এসেছি।
কুদ্দুসের মুখ হা হয়ে গেল। সে তাকাল ঘরের খোলা দরজার দিকে। শোভন আরেকটু এগিয়ে গেল। কুদ্দুস কিছু বলছে না। তার মুখ দিয়ে পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। সে মুখ বন্ধ করতে ভুলে গেছে।
ইমন পর পর দুবার গুলির শব্দ শুনল। সে দেখছে কুদ্দুস নামের মানুষটা দরজার কাছে কুতুলি পাকিয়ে পরে গেছে। খোলা দরজায় লাল ফ্রক পরা বাচ্চা একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। টিনের বাড়িটার বারান্দা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়েটা চিৎকার করছে। কুদ্দুস হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে যাবার চেষ্টা করছে। কে যেন খুব শক্ত করে ইমনের হাত ধরেছে। ইমনকে টেনে গেট থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। কে? কে তাকে টেনে গেট থেকে বের করছে? ছোট চাচা? ছোট চাচা এখানে আসবেন কি ভাবে? শোভন ভাইয়া কোথায়? শোভন ভাইয়া?
ইমন হাঁটতে পারছে না। রাস্তা খুব উঁচু নিচু মনে হচ্ছে। বমি আসছে। ইমন বমি করতে শুরু করল। কে যেন তাকে টেনে বেবীটেক্সিতে তুলছে। কে ছোট চাচা? ছোট চাচা তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে থোক। আমি মরে যাচ্ছি। পুকুরে সাঁতার কাটার সময় তুমি আমাকে যেমন শক্ত করে ধরে রেখেছিলে ঠিক সেই ভাবে ধরে থোক। এত ঠান্ডা লাগছে কেন?
এই ইমন, ইমন!
ইমন তাকাল। তাকে ধরে শোভন বসে আছে। কিন্তু সে শোভনকে চিনতে পারল না। ইমন ভীত গলায় বলল, কে?
তোকে বাসায় রেখে আসি। এরকম করছিস কেন? পানি খাবি?
হ্যাঁ পানি খাব।
বেবীটেক্সিওয়ালা বলল, উনার কি হয়েছে?
শোভন বলল, জানি না।
মাথায় পানি ঢালেন।
শোভন বেবীটেক্সি থামিয়ে ইমনকে নিয়ে নামল। এক বেবীতে করে যাওয়া যাবে না। বেবী বদলাতে হবে। ইমনকে পানি খাওয়ানো দরকার। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে ইমন তাকে চিনতে পারছে না।
ইমন! ইমন!
জ্বি।
বেশি খারাপ লাগছে?
না।
চল বাসায় যাই।
বাসায় যাব না। আপনি দয়া করে আমাকে ছোট চাচার কাছে নিয়ে যান।
দরজা খুলে দিলেন সুরাইয়া। ইমন দরজা ধরে একা দাঁড়িয়ে আছে। সুরাইয়া আতংকিত গলায় বললেন, ইমন তোর কি হয়েছে? তুই এইভাবে তাকাচ্ছিস কেন?
ইমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মার দিকে। এবং মাকে চিনতে পারল না। ইমন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
সুরাইয়া ইমনকে ধরতে গেলেন। ধরার আগেই সে মেঝেতে পড়ে গেল। সে হামাগুড়ি দিয়ে এগুবার চেষ্টা করছে।
সুরাইয়া তীক্ষ্ণ ও তীব্র গলায় বললেন, কি হয়েছে? আমার ইমনের কি হয়েছে?