অপেক্ষা : ১৮
অনেকদিন পর সুরাইয়াকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। তিনি পান খেয়েছেন। পান খাবার কারণে ঠোঁট লাল হয়ে আছে। মুখ হাসি হাসি। চোখ জ্বল জুল করছে। চাপা আনন্দের কোন ঘটনা ঘটলেই মানুষের চোখ এরকম জুলে। সুরাইয়ার আনন্দের কারণ হচ্ছে পুরানো ভাড়া বাড়িটা পাওয়া গেছে। আগের বাড়িওয়ালা যথেষ্ট ভদ্রতা করেছেন। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছেন। ভাড়া বেশি, আগে যে ভাড়া ছিল তার দ্বিগুনেরও বেশি, তবু সুরাইয়ার কাছে মনে হচ্ছে তুলনামুলক ভাবে ভাড়া সস্তা। বড় টানা বারান্দার খোলামেলা বাড়ি আজকাল পাওয়াই যায় না। সবাই বড় বাড়িগুলিকেও খুপরি খুপরি বানিয়ে ফেলছে। শান্তিমত নিঃশ্বাস নিতে হলেও খানিকটা খোলা জায়গা দরকার—এই ব্যাপারটা শহরবন্দি মানুষ ভুলে যেতে বসেছে।
সুরাইয়া ঠিক করেছেন বাড়িটাকে তিনি ঠিক আগের মত করে সাজাবেন। বারান্দায় ফুলের টব থাকবে। একটা বেতের চেয়ার কিনতে হবে। চেয়ারের গাদিটা হবে সবুজ রঙের। চেয়ারের সামনে ছোট্ট কাঠের টেবিল থাকবে। ইমনের বাবা অফিস থেকে ফিরে যে রকম চেয়ারে বসত অবিকল সে রকম চেয়ার। যে কাঠের টেবিলে চা রাখা হত সে রকম একটা কাঠের টেবিল। শোবার ঘরের খাট এবং ড্রেসিং টেবিলটা এখনো আছে। খাটটা বেঁধে ছেদে ভাইজানের বাড়ির স্টোর রুমে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে উদ্ধার করতে হবে। দেয়ালে যে সব ছবি টানানো ছিল তার সব কটাই আছে। তিনি খবরের কাগজে মুড়ে ট্রাংকে রেখে দিয়েছিলেন। ছবিগুলি বের করে দেয়ালে লাগাতে হবে। নীল রঙের একটা প্লাস্টিকের বালতি কিনতে হবে। বালতিটা থাকবে। বারান্দা থেকে উঠোনে নামার সিড়ির গোড়ায়। বালতির কাছে একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল রাখতে হবে। ইমনের বাবা অফিস থেকে ফিরেই স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে পায়ে পানি ঢালত।
বাসন কোসনগুলিও আগের মত কিনতে পারলে হত। কি বাসন কোসন ছিল সুরাইয়ার মনে আছে। চীনামাটির থালাগুলি ছিল নীল বর্ডার দেয়া। আজকাল কি এরকম থালা পাওয়া যায়? খুঁজতে হবে। খুঁজলে পাওয়া যায় না। এমন জিনিস ঢাকা শহরে নেই। পর্দা কিনতে হবে। দরজা জানালায় হালকা গোলাপী এক রঙা পর্দা ছিল। ভাগ্যিস ডিজাইনওয়ালা পর্দা ছিল না। থাকলে ডিজাইন মিলিয়ে পর্দা পাওয়া কঠিন হত। সুরাইয়া ঠিক করলেন মুন্নীকে নিয়ে বের হবেন। সারাদিন ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র কিনবেন। ইমনকে নিয়ে বের হতে পারলে খুব ভাল হত, কিন্তু ইমন তার সঙ্গে যাবে না।
আজ সুরাইয়ার ভাগ্যটা অসম্ভব ভাল। মুন্নীকে নিয়ে বের হবার কথা ভাবতে ভাবতেই মুন্নী চলে এল। মুন্নী হাসি হাসি মুখে বলল, খালা কেমন আছেন?
সুরাইয়া আনন্দিত গলায় বললেন, ভাল আছি মা। তুমি কি আমার সঙ্গে একটু বের হতে পারবে?
অবশ্যই পারব।
নতুন বাসায় যাচ্ছি মা। আগে ইমনের বাবাকে নিয়ে যে বাড়িতে থাকতাম সেই বাড়িতে। কয়েকটা জিনিস কিনব। একটু হয়ত দেরি হবে।
হোক দেরি, আমি থাকব আপনার সঙ্গে। এবং আপনারা যখন নতুন বাড়িতে যাবেন আমিও আপনাদের সঙ্গে চলে যাব। আপনাদের নিশ্চয়ই ঝি লাগবে। লাগবে না?
ছিঃ মা, তোমার যে কি কথা।
খালা আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। আমি এ বাড়িতে থাকতে পারছি না। আপনি যদি আমাকে না নেন, আমাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।
তুমি থাকবে আমার সঙ্গে। কোন সমস্যা নেই।
আপনার ছেলে থাকতে দেবে তো? তাকে আমি খুবই ভয় পাই। তার তাকানোর মধ্যে হেডমাস্টার হেডমাষ্টার ভাব আছে।
মা এটা হল ওদের বংশের ধারা। ইমনের বাবাও এ রকম করে তাকাতো।
আপনার ভয় করতো না? প্রথম প্রথম করতো। মা তুমি যাও, কাপড়টা বদলে আস। চল আমরা বের হই।
আমি এই কাপড়েই বের হব। আপনার কি ধারণা আমার আলনা ভর্তি শাড়ি? আমার তিনটা মোটে শাড়ি। তার মধ্যে একটা শাড়ি যাকাতের। বহরে খাট বলে পরতে পারি না।
মা তোমাকে আজ আমি একটা শাড়ি কিনে দেব।
থ্যাংক য়ু খালা। আমাকে কেউ কিছু দিতে চাইলে আমি কখনো না বলি না। আমি প্রায় ফকিরনী হয়ে গেছি। কিছু দিন পর মনে হয় ভিক্ষা চাইতে শুরু করব। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলব—আমাকে একটা শাড়ি দেবেন। প্লীজ।
কি যে অদ্ভুত কথা তুমি বল। শুনে দুঃখও লাগে, আবার হাসিও লাগে।
সুরাইয়া হাসছেন। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে তাঁর সব সময় ভাল লাগে। আজ অন্যদিনের চেয়েও বেশি ভাল লাগছে। মেয়েটাকে কেন জানি খানিকটা ফর্সাও লাগছে। এর কারণ কি?
মুন্নী বলল, আচ্ছা খালা একটা কথা জিজ্ঞেস করি—আপনার ছেলে কি অনার্স পরীক্ষা ড্রপ করেছে?
কি যে তুমি বল মা, ও পরীক্ষা ড্রপ করার ছেলে? পৃথিবী একদিকে আর তার পরীক্ষা একদিকে।
খালা আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন। আমার মনে হয় তিনি অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছেন না।
ও বাসাতেই আছে। দাঁড়াও জিজ্ঞেস করি।
আজ থাক খালা, আরেকদিন জিজ্ঞেস করবেন।
সুরাইয়া ছেলের ঘরের দিকে রওনা হলেন। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আগে রাতের বেলাতেই সে শুধু দরজা বন্ধ করে রাখতো। এখন দিনেও দরজা বন্ধ করে রাখে। সুরাইয়া দরজায় ধাক্কা দিতেই ইমন দরজা খুলে দিল। বিরক্ত মুখে বলল, কি চাও?
সুরাইয়া হতভম্ব গলায় বললেন, কি চাও মানে? মার সঙ্গে কেউ এই ভাবে কথা বলে?
ইমন বলল, আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে মা। কথা বলতে পারব না। তুমি কি জন্যে এসেছ বল।
মুন্নী বলছিল তুই না-কি অনার্স পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছিস। সত্যি? হ্যাঁ সত্যি।
আমার সঙ্গে ঠাট্টা করিসন। সত্যি কথা বল।
মা আমি কারো সঙ্গেই ঠাট্টা করি না। সত্যি কথাই বলছি। পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছি।
কেন?
পরীক্ষা দিলে ফেল করতাম সেই জন্যে।
তুই ফেল করবি মানে? তুই কি ফেল করার ছেলে।
ইমন জবাব দিল না। সুরাইয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই এইসব কি বলছিস। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
ইমন বলল, আমি সুপ্রভার মত হয়ে গেছি মা! ফেলটুস ছাত্র হয়ে গেছি। তোমার কথাতো শেষ হয়েছে এখন দরজাটা বন্ধ করি? ইমান দরজা বন্ধ করে क्रिीब्ल।
সুরাইয়া আহত গলায় ডাকলেন, ইমন ও ইমন!
ইমন দরজা খুলল না। সুরাইয়ার পা কাঁপছে। চোখে পানি আসছে। অন্য রকম ভয়ে শরীর যেন ছোট হয়ে আসছে। ইমন কোন কান্ড করে বসবে নাতো? সুপ্ৰভা যেমন করেছিল? না তিনি ইমনের উপর রাগ করবেন না। তাকে ধমক দেবেন না, কোন কড়া কথা বলবেন না। তার সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক আচরণ করবেন। পরীক্ষার প্রসঙ্গ আর তুলবেনই না। তাকে যা বলার ইমনের বাবা এসে বলবেন। ছেলেরা মার চেয়ে বাবাকে বেশি মানে।
মানুষটার ফিরে আসার সময় যে হয়ে এসেছে তা সুরাইয়া বুঝতে পারছেন। কষ্টের পর সুখ আসে, অনেকগুলি কষ্ট তিনি পার করেছেন–এখন সুখ আসার সময়। আগের বাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে বসার পরই সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটবে। দরজার কড়া নড়বে। না, কড়া না-কলিং বেল বাজবে। একবার দুবার তিনবার। থেমে থেমে বেজেই যাবে। তিনি ভাববেন, ভিখিরী। ক্লান্তিহীন কলিং বেল একমাত্র ভিখিরীরাই বাজায়। তিনি নিতান্ত বিরক্ত হয়ে দরজা খুলবেন। ভিখিরী না, মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই মানুষটা কোমল গলায় বলবেন—ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
তিনি বলবেন, না।
মানুষটা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলবে, ইমন কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
না জেগে আছে। তুমি এসেছ ভাল হয়েছে, ইমনকে শাসন করতে হবে। ও কি রকম যেন হয়ে গেছে। পরীক্ষা দিচ্ছে না। দিন রাত দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। সিগারেটও ধরেছে। প্রায়ই তার ঘরে সিগারেটের গন্ধ পাই।
বল কি? আমি খুব চিন্তার ভেতর ছিলাম। তুমি এসেছি, এখন আর চিন্তা করছি না। সারাজীবন অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। এখন যা চিন্তা করার তুমি করবে। আমি রেস্ট নেব। খাব, দাব, ঘুমাব। সিনেমা দেখব। কতদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয় না। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।
তিনি চিন্তিত গলায় বলবেন, এখন সে কি আর আমার কথা শুনবে? একটা বয়সের পর ছেলেরা বাবা-মা কারো কথাই শুনতে চায় না। শুধু স্ত্রীর কথা শুনে। ওকে বিয়ে দিতে হবে।
সুরাইয়া আনন্দিত গলায় বলবেন, কি যে মজার কথা তুমি বল। ইমনের বিয়ে দিয়েছিতো।
সে কি! কবে বিয়ে হল?
আজই হয়েছে। আজ বাসর হচ্ছে, আমাদের শোবার ঘরটা ওদের ছেড়ে দিয়েছি।
মানুষটা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলবে, ভাল করেছ। বউমাকে ডাক একটু দেখি।
সর্বনাশ! এখন ওদের ডাকতে পারব না। সকালে দেখবে। তুমি বরং তোমার এই বেতের চেয়ারটায় বোস। চা খাবে?
বেতের চেয়ারটা এখনো আছে? আশ্চর্য! কত দিনের কথা। আচ্ছা! সুরাইয়া তুমিতো আমাকে দেখে এতটুকুও অবাক হও নি। তুমি কি জানতে আজ আমি আসব?
হুঁ জানতাম। বালতির পাশে স্পঞ্জের স্যান্ডেল আছে। পা ধুয়ে বসোতো, আমি চা নিয়ে আসছি।
দরজা খুলে ইমন বের হয়ে এল। সে বাইরে কোথাও যাচ্ছে-সার্ট প্যান্ট পরেছে। সুরাইয়া বললেন, কোথায় যাচ্ছিস? ইমন বলল, কোথাও না।
সুরাইয়া সহজ গলায় বললেন, ইমান শোন–পরীক্ষা দিচ্ছিস না, এই নিয়ে মন খারাপ করবি না। সামনের বছর দিলেই হবে।
আমি মন খারাপ করছি না।
তোর কি ফিরতে দেরি হবে? ফিরতে দেরি হলে চাবি নিয়ে যা। আমি মুন্নীকে নিয়ে বের হচ্ছি। কখন ফিরব ঠিক নেই।
আচ্ছা।
আমি কিছু কেনা কাটা করব। আগে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম ঐ বাড়িটা পাওয়া গেছে। বুঝলি ইমন, বাড়িটা আমি ঠিক আগের মত করে সাজাব। তোর বাবা এসে যেন দেখতে পান কিছু বদলায় নি। সব আগের মত আছে। তুই তোর বড় মামার বাসা থেকে খাটটা এনে দিবি।
এখনি এনে দিতে হবে?
এখন না আনলেও হবে। নতুন বাসায় যেদিন যাব সেদিন এনে দিলেও হবে।
যখন বলবে। এনে দেব।
তুই যাচ্ছিস কোথায়?
বললাম তো কোথাও না।
ইমন হন হন করে বের হয়ে গেল। চাবি না নিয়েই গেল। সুরাইয়া চাবি সঙ্গে নেবার ব্যাপারটা আবারো মনে করিয়ে দেবার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার, যতই দিন যাচ্ছে তিনি ছেলেকে ততই ভয় পেতে শুরু করেছেন।
বাসার গেটের কাছে মুন্নী দাঁড়িয়ে আছে। ইমনকে দেখে সে হঠাৎ বলল, ইমন ভাইয়া, ভাল আছেন?
ইমন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মুন্নীর মনে হল এক্ষুনি সে তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাবে এবং প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বের হয়ে যাবে। মুন্নীকে অবাক করে দিয়ে ইমন বলল, আমি ভাল আছি।
মুন্নী বলল, আপনাকে আমি প্রায়ই দেখি কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডের শিশু পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছেন। ওখানে যাবেন না।
কেন?
ঐ পার্কে একটা পাগল থাকে। ছুরি নিয়ে মানুষকে তাড়া করে। দুজনকে জখম করেছে। পত্রিকায়ও উঠেছে।
আমি জানি। পাগলটার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।
আপনার ভয় লাগে না?
না।
আপনাকে আটকে রাখলাম, কিছু মনে করবেন না।
আমি কিছু মনে করি নি।
ইমন শিশুপার্কের দিকে হাঁটা শুরু করল। পার্কের বেঞ্চবীতে কোন কারণ ছাড়া চুপচাপ বসে থাকতে তার ভালই লাগে। ঘণ্টাখানিক চুপচাপ বসে থাকার পর তার নিজেকে গাছের মত মনে হতে থাকে। যেন সে এক সময় মানুষ ছিল, এখন গাছ হয়ে যাচ্ছে। তার শিকর চলে যাচ্ছে মাটির গভীরে। শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে। যখন বৃষ্টি আসবে সে বৃষ্টির পানিতে স্নান করবে। যখন জোছনা নামবে সে তার সারা গায়ে জোছনা মাখবে। আহ। বৃক্ষের জীবনতো আসলেই আনন্দময়।