Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অপেক্ষা || Humayun Ahmed » Page 14

অপেক্ষা || Humayun Ahmed

ইমন খেতে বসেছে। সুরাইয়া খুব আগ্রহ করে ছেলের খাওয়া দেখছেন। টেবিলে তিন রকমের তরকারি—সজনে ডাটা এবং আলু দিয়ে একটা ভাজি, ইলিশ মাছের ডিম, ডাল। ইমন কেমন যেন অনাগ্রহের সঙ্গে খাচ্ছে। সজনে ডাটা নিল, তার সঙ্গে ইলিশ মাছের ঝোল মেশালো। এর মধ্যে এক চামচ ডাল দিয়ে দিল।

সুরাইয়া বললেন, খেতে কেমন হয়েছে রে?

ভাল হয়েছে।

ভাল হয়েছে।তো এমন ভাবে খাচ্ছিস কেন? সব মিশিয়ে ঘ্যাট বানাচ্ছিস। আরাম করে খা।

আরাম করেই খাচ্ছি।

ইমন আরাম করে খাচ্ছে না। খাবার মোটেই ভাল হয়নি। প্রতিটি তরকারিতে লবণ বেশি। সামান্য বেশি হলেও খেয়ে ফেলা যেত। অনেকখানি বেশি। ইমনের ধারণা তার মার লবণের আন্দাজ নষ্ট হয়ে গেছে। হয় লবণ খুব বেশি হচ্ছে নয় লবণ হচ্ছেই না।

ইলিশ মাছের ডিম কেমন হয়েছে?

ভাল।

তোর বাবার খুব প্রিয় ছিল। লোকজন বাজার থেকে ডিম ছাড়া ইলিশ আনে–তোর বাবা আনতো ডিমওয়ালা ইলিশ। মাছ কোটার সময় তোর বাবা পাশে থাকতো। যদি দেখতে ডিম নেই। ওমি তার মুখটা কালো হয়ে যেত।

ইমন গল্প শুনে যাচ্ছে। হ্যাঁ হুঁ। কিছুই করছে না। বাবার গল্প এখন আর তার কাছে ভাল লাগে না। অসহ্য বোধ হয়। ইলিশ মাছের ডিম তার বাবার পছন্দের খাবার ছিল এই গল্প সে এর আগে অনেক অনেক বার শুনেছে। ভবিষ্যতেও আরো অনেকবার শুনতে হবে। মার আলোচনা কোন খাতে যাবে। ইমন এখন বলে দিতে পারে। ইলিশ মাছের ডিমের প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন

মাছের ঝোলের গল্প।

ইমান।

জ্বি।

বাজারে দেখিসতো মাষকলাইয়ের ডাল পাস কি-না। খোসা ছড়ানো ডাল না, খোসাওয়ালা ডাল। তোর বাবার খুব পছন্দ ছিল। অনেকে মাষকলাইয়ের ডালে মাছ টাছ দিয়ে রান্না করে। তোর বাবার তা পছন্দ না। মাছ দিলেই তার কাছে আঁষটে গন্ধ লাগতো। তোকে একদিন মাছ দিয়ে ডাল রান্না করে দেব। তোর বাবার পছন্দ ছিল না বলে যে তোরও পছন্দ হবে না। এমনতো কথা না। হয়ত তোর ভাল লাগবে। মাষকলাইয়ের ডাল নিয়ে আসিসতো।

আচ্ছা।

নতুন সর্ষে শাক উঠেছে কি-না খেয়াল রাখিস।

আচ্ছা।

সর্ষে শাক দিয়ে কৈ মাছও তোর বাবার প্রিয়। কোন বন্ধুর বাসা থেকে খেয়ে এসে একদিন আমাকে রাধতে বলল। সর্ষে শাক দিয়ে কৈ মাছের ঝোল-আমি জন্মে শুনিনি। একদিন ভয়ে ভয়ে রাধলাম। সেই রান্নাই কাল হল। দুদিন পর পর সর্ষে শাক আর কৈ মাছ। আমি আবার কৈ মাছ খেতে পারি না। কাঁটার ভয়ে। কৈ মাছের কাটা বরাশির মত একটু বাকানো, একবার গলায় আটকালে আর যাবে না। তোর বাবার মত কৈ মাছ খাওয়া লোকও যা বিপদে পড়েছিল— শোন কি হয়েছে …

ইমনের খাওয়া হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, মা তোমাকে একটা অনুরোধ করি। তুমি দয়া করে অন্য গল্প কর। বাবার গল্প শুনতে আমার এখন আর ভাল লাগে না। তাছাড়া গল্পগুলিতো নতুনও না, পুরানো।

সুরাইয়া আহত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইমন এ ধরণের কথা বলবে তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি। ছেলেটা দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। নিজেদের ফ্ল্যাটে আসার পর পড়াশোনাও করছে না। সময়ে অসময়ে ছেলের ঘরে ঢুকে দেখেছেন সে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার নিচে বালিশ নেই। সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। মানুষ একটু আধটু বদলায়। সেই বদলানোটাও খুব ধীরে হয় বলে চোখে পড়ে না— ইমনেরটা দ্রুত হচ্ছে বলেই চোখে পড়ছে।

হারিয়ে যাওয়া বাবার গল্প সুরাইয়া ইচ্ছা করেই করেন, যাতে মানুষটা পুরোপুরি হারিয়ে না যায়। সেই গল্প ইমন শুনতে চাচ্ছে না। মার সঙ্গে সে কঠিন গলায় কথা বলতে শুরু করেছে, এই গলা ভবিষ্যতে আরো কঠিন হবে। তখন কি হবে? সুরাইয়া বুকে চাপ ব্যথা বোধ করতে শুরু করলেন। এটা তাঁর পুরানো ব্যথা। আজকাল ঘন ঘন হচ্ছে।

সুরাইয়া দেখলেন ইমন সার্ট গায়ে দিচ্ছে। চিরুনী নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। সে কি কোথাও বের হচ্ছে? আজ ছুটির দিন। আজ কোন ঘর থেকে বের হবে? ছুটির দিনগুলি ঘরে থাকার জন্যে। বাইরে ছোটাছুটি করার জন্যে না। ইমন বাথরুম থেকে বের হতেই সুরাইয়া বললেন, কোথাও যাচ্ছিস?

ইমন বলল, হ্যাঁ।

কোথায় যাচ্ছিস?

কাজ আছে মা।

কাজটা কি?

ইমন বিরক্ত গলায় বলল, তুমি সব কিছু জানতে চাও কেন? এত জেরা করারতো কিছু নেই।

জেরা করছি না। কোথায় যাচ্ছিস জানতে চাচ্ছি। আমি জানতেও পারব না!

না।

তোর সমস্যাটা কি?

আমার কোন সমস্যা নেই। মা। সমস্যা তোমার। তুমি খুব বিরক্ত কর। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।

কোথায় যাচ্ছিস জানতে চাওয়াটা কি বিরক্ত করা?

হ্যাঁ বিরক্ত করা।

আর কি ভাবে বিরক্ত করি?

রাতে তুমি পঞ্চাশবার আমাকে দেখতে আস এটাও বিরক্তিকর।

দরজা বন্ধ করে তুই শুয়ে পড়িস তোকে পঞ্চাশবার দেখতে আসব কি ভাবে?

দরজা বন্ধ করলেওতো তোমার হাত থেকে নিস্তার নেই। তুমি একটু পর পর দরজার ফুটো দিয়ে তাকাবে। আমি এতদিন কিছু বলিনি-আজ বললাম। আমার ভাল লাগে না।

তুই মশারি ঠিকমত ফেলেছিস কি-না এটা দেখার জন্যে ফুটো দিয়ে তাকাই।

দয়া করে আর তাকবে না।

সুরাইয়া থমথমে গলায় বললেন, আমাকে আর কি কি করতে হবে এক সঙ্গে বলে দে। চেষ্টা করব তুই যা চাস সে রকম করতে—যদি না পারি চলে যাব।

কোথায় চলে যাবে?

সেটা তোর জানার বিষয় না। তুই কোথায় যাস সেটা যেমন আমার জানার বিষয় না। আমি কোথায় যাই সেটাও তোর জানার বিষয় না।

ইমন এর জবাব দিল না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বের হয়ে গেল, যেন কিছুই হয়নি।

সুরাইয়ার বুকে ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস কষ্টও শুরু হল। শ্বাসকষ্টের এই উপসর্গ তাঁর নতুন! মাঝে মাঝে হয়। ডাক্তারের কাছে যেতে ইচ্ছা করে না। কপালে কষ্ট থাকলে কষ্ট ভোগ করতেই হবে। ডাক্তার কবিরাজ কিছু করতে পারবে না।

সুরাইয়া দুপুরে খেলেন না। চাদর গায়ে ঘুমুতে গেলেন। বুকের ব্যথা এবং শ্বাস কষ্টের জন্যে ঘুম আসছে না। সেটাই ভাল, শরীরের কষ্ট নিয়ে জেগে। থেকে নিজের জীবনের কথা ভাবা। ভাবতে ভাবতে চোখের পানি ফেলা।

বারান্দায় রাখা ফুলের টবে আজ পানি দেয়া হয়নি। ভালই হয়েছে, গাছগুলিও কষ্ট করুক। তিনি একা কেন কষ্ট করবেন? তার সঙ্গে যারা বাস। করবে। তাদেরও কষ্ট করতে হবে। তারপর কোন একদিন ইমনের বাবার মত তিনিও ঘর ছেড়ে চলে যাবেন। আর কেউ কোনদিন তার খোঁজ পাবে না। ইমন থাকুক একা একা। ইমনের এখন তাঁকে দরকার নেই।— তিনি কেন শুধু শুধু ছেলের জন্যে ভাববেন? তাঁর এত কি দায় পড়েছে? ইমনের একটা বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে ভাল হত। ইমনের দিকে লক্ষ্য রাখবে এমন একজন দরকার।

একটা মেয়েকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। বাড়িওয়ালার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। মুন্নী। এই বাড়িতে থেকে ইডেন কলেজে পড়ে। দুনিয়ার কাজ করে। মেয়েটাকে তিনি পাঁচ মিনিটের জন্যেও বসে থাকতে দেখেন না। মেয়েটা দেখতে তত ভাল না। গায়ের রঙ কালো। সৌন্দর্যের প্রথম শর্তই গায়ের রঙ। সেই রঙ কালো হলে সবই মাটি। এমিতে অবশ্যি মেয়েটার খুব মায়া মায়া চেহারা। মাথা ভর্তি চুল, লম্বা একহারা গড়ন। গলার স্বর খুব মিষ্টি এবং হাস্যমুখি। হাসি ছাড়া কথা বলতে পারে না। মেয়েটা তাকে খালা ডাকে এবং অবসর পেলেই তার সঙ্গে গল্প করতে আসে। ইমনের বাবার সব গল্পই তিনি ইতিমধ্যে মেয়েটার সঙ্গে করেছেন। গল্প বলার সময় কয়েকবার তার চোখে পানি এসেছে। তিনি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন মেয়েটার চোখেও পানি এসেছে।

মেয়েটার কথা বার্তা বলার ভঙ্গিও সুন্দর। খুব মজা করে কথা বলে! ঐতো সেদিন হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা খালা আপনার পুত্র কি সব সময় এমন গম্ভীর থাকে? সব সময় ভুরু কুঁচকে আছে। গম্ভীরানন্দ।

তিনি হাসতে হাসতে বললেন, মা এটা হল ওদের বংশগত রোগ। তার বাবাও ছিল গম্ভীর।

আমার উনাকে দেখলে কি মনে হয় জানেন? মনে হয় এই বুঝি উনি ভুরু টুরু কুঁচকে আমাকে বলবেন-এই মেয়ে নিউটনের সেকেন্ড ল টা কি বুঝিয়ে বল।

মুন্নী হাসে, তিনিও হাসেন।

খালা আমি একটা প্ল্যান করেছি। উনাকে আমি একদিন খুব ভড়কে দেব। কি করব জানেন? আপনার বাসায় ঘাপটি মেরে বসে থাকব। উনি যখন বাসায় ফিরবেন, দরজা খোলার জন্যে কলিং বেল টিপবেন তখন আমি দরজা খুলে বলব, আপনি কে কাকে চান? উনি খুব ভড়কে যাবেন না!

না। ও ভড়কবার ছেলে না।

মুন্নীদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এলে মুন্নীর ঘুমুবার জায়গার সমস্যা হয়। সে চলে আসে সুরাইয়ার কাছে। আদুরে গলায় বলে, খালা আজ রাতটা কি আমি আপনার সঙ্গে ঘুমুতে পারি?

সুরাইয়া বলেন, অবশ্যই পার মা।

আমি ঘুমুতে এলে আপনার জন্যে ভালই হবে। আমি খুব সুন্দর করে চুলে বিলি কাটতে পারি। চুলে বিলি কোিট আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।

তোমাকে চুলে বিলি কাটতে হবে না। তুমি এসে আমার সঙ্গে ঘুমাও। দুজনে গল্প করব। ছেলেটা এমন হয়েছে যে তাকে দশটা কথা বললে সে একটা কথার জবাব দেয়। তার সঙ্গে কথা বলা আর একটা গাবগাছের সঙ্গে কথা বলা এক। গাব গাছের তাও পাতা নড়ে। তার তাও নড়ে না।

মুন্নী যতবার এ বাড়িতে থাকতে এসেছে ততবারই তিনি প্রায় সারারাত গল্প করেছেন। মুন্নীর জন্যে রাতগুলি কেমন ছিল তিনি জানেন না, কিন্তু তাঁর জন্যে রাতগুলি ছিল আনন্দময়।

মাঝে মাঝে মেয়েটা তাকে অদ্ভুত ধরণের কথাও বলে। অদ্ভুত এবং ভয়ংকর। পুরোপুরি ভেঙ্গে বলে না বলে তিনি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন। না। যেমন একরাতে অনেকক্ষণ গল্প গুজবের পর তিনি বললেন, মা এখন ঘুমুতে যাও। ফজরের আজান হতে বেশি দেরি নেই। মুন্নী তখন বিছানায় উঠে বসে সম্পূর্ণ অন্যরকম গলায় বলল, খালা আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন?

উনি বললেন, অবশ্যই পছন্দ করি।

আপনার কি ধারণা আমি একটা ভাল মেয়ে?

অবশ্যই তুমি ভাল মেয়ে।

খালা আমি কিন্তু ভাল মেয়ে না। আমি ভয়ংকর খারাপ মেয়ে। ভয়ংকর খারাপ মেয়েরা যা করে আমিও তাই করি। মাঝে মাঝে তারচে বেশিই করি। নিজের ইচ্ছায় করি না। করতে বাধ্য হই।

বাধ্য হয়ে অনেকেই অনেক কিছু করে।

ভাল মেয়েরা করেনা খালা। ভালমেয়েরা ভেঙ্গে যায় কিন্তু মাচকায় না। আমি ভাঙ্গি না মাচকাই। আমার জন্ম হয়েছে মাচকাবার জন্যে।

ভয়ংকর যে কাজটা কর সেটা কি?

আপনি আন্দাজ করুনতো?

আন্দাজ করতে পারছি না।

একদিন পারবেন।

মুন্নী শুয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। তিনি জেগে থাকেন। এবং বারবারই তাঁর মনে হয়—বড় ভাল একটা মেয়ে। গায়ের রংটা আর যদি একটু ভাল হত। তিনি সরাসরি ইমনের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ের কথা বলতেন। কালো মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে নাতী নাতনীগুলি কালো হবে। সেই কালো নাতনীগুলির বিয়ের সমস্যা হবে। বিয়ে অনেক বড় ব্যাপার হুট করে দিয়ে দিলেই হয় না। অনেক ভেবে চিন্তে দিতে হয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress