অপেক্ষা : ১৩
রাত তিনটার দিকে জামিলুর রহমানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তলপেটে অসহ্য ব্যথা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে ফাতেমা ঘুমুচ্ছে। এইত পােশ ফিরল। ইচ্ছা করছে ফাতেমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিতে। ব্যথার এমন যন্ত্রণা তিনি তার জীবনে আর পেয়েছেন বলে মনে করতে পারলেন না। কি ভয়ংকর ব্যাপার, মনে হচ্ছে কামারশালার কামার গরম গানগনে লাল কাস্তে পেটে ঢুকিয়ে পেটের নাড়িভুড়ি টেনে বের করার চেষ্টা করছে। বের করে ফেললেও শান্তি ছিল, বের করতে পারছে না। পেটের ভেতর সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, ফাতেমা এই ফাতেমা।
ফাতেমা গভীর ঘুমে। হালকা ভাবে তার নাক ডাকছে। জামিলুর রহমান বিছানা থেকে নামলেন। পানি খেতে ইচ্ছা করছে। শোবার ঘরে পানির বোতল দেখলেন না। পানি খেতে হলে খাবার ঘর পর্যন্ত যেতে হবে। ফ্রীজের দরজা খুলে পানির বোতল বের করতে হবে। এত শক্তি কি তার আছে?
জামিলুর রহমান দরজা খুলে বারান্দায় চলে এলেন। বারান্দার বেতের চেয়ারে আপাতত কিছুক্ষণ বসে থাকবেন। ছোটবেলায় পেট ব্যথা হলে পেটের নিচে বালিশ দিয়ে মা উপুড় করে শুইয়ে রাখতেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা চলে যেত। শৈশবের সেই চিকিৎসা কি এখন চলবে? না চলবে না। জমিলুর রহমানের মনে হল কিছুক্ষণের মধ্যে এই বেতের চেয়ারেই তাঁর মৃত্যু হবে। মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না। তিনি পানির তৃষ্ণায় ছটফট করবেন। কেউ তাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি এগিয়ে দেবে না।
বারান্দায় আলো জুলছে। চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাম্ব বারান্দার দক্ষিণ মাথায় অথচ এতেই সারা বারান্দা আলো হয়ে আছে। শুধু বারান্দা না আলো চলে গেছে উঠানেও। জমিলুর রহমানের মনে হল মৃত্যুর আগে মানুষের চেতনা তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। নয়ত বারান্দায় জুলা একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাম্বে তিনি গোট পর্যন্ত দেখতে পারতেন না। বাড়ির কোথায় কি শব্দ হচ্ছে তাও শুনতে পাচ্ছেন। ফাতেমার নাক এখন ডাকছে না। সে থেমে থেমে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে। শোবার ঘরের লাগোয়া বাথরুমে পানির ট্যাপ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষীণ ধারায় ট্যাপ থেকে পানি পরার শব্দ কানে আসছে। শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরে যাবার জন্যে যে করিডোর আছে সেখানে কি কেউ হাঁটছে? খালি পায়ে হাঁটার শব্দ আসছে। কেউ একজন মনে হয় এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। তিনি বললেন কে? শব্দটা তার কাছাকাছি এসে থেমে গেল। জমিলুর রহমানের অস্পষ্টভাবে মনে হল সুপ্ৰভা নয়তো? খুবই হাস্যকর চিন্তা। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর থাকা অবস্থায় মানুষ অনেক হাস্যকর চিন্তা করে।
এ বাড়িতে অবশ্যি বেশ কিছুদিন ধরেই সুপ্ৰভাকে নিয়ে নীচু গলায় আলোচনা হচ্ছে, ফিসফাস হচ্ছে। দুজন বুয়াই দাবী করছে তারা সুপ্ৰভাকে দেখেছে। একজনের ভাষ্য হচ্ছে সে ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়েছিল। আনতে ভুলে গেছে। সন্ধ্যার পর কাপড়ের কথা মনে হতেই সে আনতে গেল। দড়িতে ঝুলানো কাপড় তুলছে হঠাৎ দেখে ছাদের এক কোণায় পা ঝুলিয়ে কে যেন বসে আছে। তার বুকে ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগল। সে একটু এগিয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখে— সুপ্ৰভা। আপন মনে পেয়ারা খাচ্ছে। কাজের বুয়া বলল, ছোট আফা! সুপ্ৰভা তার দিকে তাকাল। তারপরই পেয়ারা ছাদে ছুঁড়ে ফেলে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
বানানো গল্প। বেশি বয়সের বুয়ারা প্ৰায় বাড়িতেই এ জাতীয় গল্প বানায়। কেন বানায় কে জানে। জমিলুর রহমান ভেবেছিলেন, বুয়াকে ডেকে কঠিন ধমক দেবেন। তার আগেই আরেকজন ঘোষণা করল, সেও ছোট আপাকে দেখেছে। সিঁড়িতে চুপচাপ বসে ছিল। তাকে দেখেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। ফাতেমাও এক রাতে শোবার সময় গলা নীচু করে বলল, কোন বড় মওলানা এনে দোয়া পড়ালে হয় না? জামিলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কেন?
ঐ যে সুপ্ৰভাকে সবাই দেখছে। আমিও একবার দেখেছি।
তুমি কখন দেখলে?
রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি মশারির পাশ দিয়ে হাঁটছে। মাথা নীচু। দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে হাঁটছে।
জামিলুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, কেন মিথ্যা কথা বলছ?
ফাতেমা বিড়বিড় করলেন, মিথ্যা বলছি না। শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন? আমার মিথ্যা বলার দরকারটা কি?
সামান্য আরশোলা দেখলে তুমি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোল— এত বড় একটা ঘটনার পর তুমি কিছুই করলে না, চিৎকার না, কিছু না। আমি পাশে ঘুমিয়ে আছি আমাকে ডেকেও তো তুললে না।
তুমি সারাদিন পরিশ্রম করে এসে ঘুমাও এই জন্যে তোমাকে ডাকি নি।
জামিলুর রহমান রাগী গলায় বললেন, আজে বাজে মিথ্যা আমার সঙ্গে বলবে না। মৃত একটা মেয়েকে নিয়ে এইসব কি আজে বাজে কথা চালু করলে। ভাগ্যিস সুরাইয়া এখানে নেই। সে থাকলে কি রকম মনে কষ্ট পেত।
প্রায় চারমাস হল সুরাইয়া চলে গেছেন। জুলাই মাসের ৭ তারিখে গিয়েছেন এখন নভেম্বর মাস। শীত পড়তে শুরু করেছে।
সুরাইয়া ছেলেকে নিয়ে ঝিকাতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। এক দিকে ভালই হয়েছে। সুরাইয়া ভাল আছে। নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। প্রবল শোক ভুলে থাকতে পারছে এটা মন্দ কি। এইভাবে চলতে চলতে সুরাইয়া যদি স্বাভাবিক হয় তাহলে এরচে ভাল ব্যাপার। আর কি হতে পারে? এ বাড়িতে থাকলে সুপ্ৰভা সম্পর্কে আজগুবি সব গল্প সুরাইয়ার কানো যেত। মাথা আরো খারাপ হয়ে যেত।
করিডোরে আবারো পায়ের শব্দ। এখন মনে হচ্ছে স্যান্ডেল পরে কে যেন হাঁটছে। ছোট ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলছে। সেই নিঃশ্বাসের শব্দও আসছে। ব্যাপারটা কি?
জামিলুর রহমান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পেটের ব্যথাটা এখন একটু কম লাগছে। না-কি মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে বলে ব্যথা টের পাচ্ছেন না? তিনি খাবার ঘরে ঢুকলেন। করিডোরের বাতি জ্বলিয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত গেলেন। কেউ নেই। রান্নাঘরে দুজন বুয়া কথা বিছিয়ে ঘুমুচ্ছে। তাদের নিঃশ্বাসের শব্দই হয়ত শুনেছেন। এই বাড়িতে বুয়াদের জন্য আলাদা ঘর আছে, তারপরেও তারা কেন জানি রান্নাঘরে ঘুমায়। তিনি ফ্ৰীজ খুলে ঠাণ্ডা পানির বোতল খুলে পানি খেলেন। ঠাণ্ডা পানি খেলেই তার সুপ্রভার কথা মনে হয়। শুধুমাত্র এই মেয়েটার জন্যেই তিনি অফিসে ফ্রীজ কিনেছিলেন। মেয়েটা যখন তখন অফিসে চলে এসে ফ্ৰীজ খুলে কোক খেত। তার জন্যে কেনা পাঁচটা কোকের ক্যান এখনো ফ্রীজে আছে। মাঝে মাঝে সুপ্রভার জন্যে তার বুক হু হু করে। তিনি অফিসের ফ্ৰীজ খুলে কোকের ক্যানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বয়স যত বাড়ছে, মন তত দুর্বল হচ্ছে। চোখ-বগাপসা রোগ হয়েছে। যখন তখন চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
ঠান্ডা পানি খেতে খেতেও তার চোখ ঝাপসা হল। তিনি কি মনে করে। ছাদের দিকে রওনা হলেন। এই পৃথিবীতে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে। তাঁর জীবনে কখনো কোন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে নি। তাই বলে যে কোনদিন ঘটবে না, তাতো না। হয়ত তাঁর জীবনেও অবিশ্বাস্য কোন ঘটনা ঘটবে। হয়তো আজ রাতেই ঘটবে। তিনি ছাদে উঠে দেখবেন ছাদে পা ঝুলিয়ে সুপ্ৰভা বসে আছে। তিনি কোমল গলায় ডাকবেন, সুপ্ৰভা!
সুপ্ৰভা তার দিকে তাকিয়ে হাসবে। তিনি বলবেন, কেমন আছিসরে মা? সুপ্ৰভা বলবে, তুমি কেমন আছ বড় মামা। তিনি বলবেন, আমি ভাল আছি। সুপ্ৰভা রাগি রাগি গলায় বলবে, তুমি মোটেও ভাল নেই। তোমার পেটে ব্যথা হচ্ছে। এ রকম ব্যথা নিয়ে তুমি ছাদে এলে কেন? মামা তোমার কি কান্ডজ্ঞান নেই?
তোকে দেখতে এসেছিরে মা।
আমাকে কিভাবে দেখবে? আমিতো মরে গেছি।
মা কেন এই কান্ডটা করলি?
ভুল করে ফেলেছি মামা। মানুষ ভুল করে না? ভুল করে বলেইতো সে মানুষ। শুধু শুদ্ধ করলে কি সে মানুষ হয়? সে হত রোবট।
জামিলুর রহমান ছাদে উঠার ঠিক আগে থমকে গেলেন–ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কে যেন গান গাইছে। নিশুতি রাতে ছাদে গান করবে কে? সুপ্রভার গলা না? হ্যাঁ সুপ্রভার গলাতো বটেই। মিষ্টি রিনারিনে বিষাদময় গলা। ব্যাপারটা কি? জামিলুর রহমানের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। তার মনে হল তিনি মাথা ঘুরে এক্ষুনি পড়ে যাবেন। আসলেই সুপ্ৰভা গান গাইছে। গানের কথাগুলো স্পষ্ট না। টানা সুরের গান বলে কথা স্পষ্ট হচ্ছে না। ফুলে ফুলে এই দুটা শব্দ শুধু পরিষ্কার।
জামিলুর রহমান ছাদে পা রাখলেন। সুপ্ৰভা বলে ডাকতে গিয়ে থমকে গেলেন, কাপড় শুকানোর দড়ি দু হাতে ধরে যে মেয়েটি গান গাইছে সে সুপ্ৰভা নয়— মিতু। ছাদে গান গাইছে মিতু।
মিতু শব্দ শুনে বাবাকে দেখে সহজ গলায় বলল, বাবা তুমি? তুমি ছাদে কি করছ।
জামিলুর রহমান বিস্মিত হয়ে বললেন–রাত তিনটার সময় তুইই বা কি করছিস?
বাবা আমিতো ছাদেই থাকি।
ছাদে থাকিস মানে? ছাদে কোথায় থাকিস?
চিলেকোঠার ঘরটায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তাই হাঁটাহাঁটি করছি।
হাঁটাহাঁটি কোথায় তুইতো গান করছিলি।
হুঁ করছিলাম।
চিলেকোঠার ঘরে কবে থেকে থাকিস?
অনেক দিন থেকেই থাকি। সবাই জানে। তুমি বাড়ির কোন খোঁজ খবর রাখ না বলে তুমি জান না।
একা একা ছাদে থাকিস আশ্চর্য কান্ড। ভয় লাগে না?
ভয় লাগবে কেন? ভয় লাগার কি আছে। এই যে তুমি হঠাৎ এসে উপস্থিত হলে— আমি কি তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছি?
জামিলুর রহমানের পেটের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। খোলা ছাদেই শুয়ে পড়তে হবে। মিতু বলল, কি হয়েছে। বাবা? তুমি এ রকম করছি কেন?
তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
মিতু ছুটে এসে বাবার হাত ধরল। চিন্তিত গলায় বলল, তোমার শরীরতো। কাঁপছে বাবা। এসো আমার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে থাক।
পানি খাব।
তোমাকে পানি দিচ্ছি–তুমি এসোতো।
জামিলুর রহমান মিতুর ঘরে শুয়ে আছেন। এক চিলতে ছোট্ট অদ্ভুত একটা ঘর। মুখের কাছে গ্রামের রেলস্টেশনের টিকিট ঘরের মত জানালা। সেই জানালার হাওয়া এসে শুধু মুখের উপর পড়ছে। ভাল লাগছে। মিতুর চিলেকোঠার এই ঘরটা এমন মজার তিনি জানতেন না। বাড়ির অনেক কিছুই তিনি জানেন না। তেমনি তার নিজের জগতের অনেক কিছুই বাড়ির কেউ জানে না। তিনি যেমন তার ব্যাপারগুলো জানানোর প্রয়োজন মনে করেন না। তারাও তেমনি তাদের ব্যাপারগুলো জানাবার প্রয়োজন মনে করে না।
শোভন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে এই খবর তিনি বাড়িতে কাউকে দেন। নি। দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি। পুলিশ শোভনের উপর শারিরীক নির্যাতন করছে। এই খবরও তিনি পেয়েছেন। শারিরীক নির্যাতন খবরাখবর বের করার জন্যে করছে না। নির্যাতনটা করছে যেন খবর পেয়ে ছেলের বাবা জামিলুর রহমান পুলিশকে বড় অংকের টাকা দেবার ব্যবস্থা করেন। এই ব্যবস্থা জামিলুর রহমান করেছেন। বড় অংকের টাকাই পুলিশকে দিয়েছেন। মার বন্ধ হয়েছে। ওসি সাহেব এই সুসংবাদ নিজে এসে দিয়ে গেছেন। সিগারেট টানতে টানতে বলেছেন, আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আপাতত জামিন হচ্ছে না। কিন্তু মূল কেইস এমন ভাবে সাজানো হবে যেন তাসের ঘর। সব ঠিক ঠাক-কোর্টে গিয়েই-ধপাস। ঘর ভেঙ্গে পড়ে গেল। কেউ কিছু বুঝল না। আসামী বেকসুর খালাস। হা হা হা।
এমন বিশ্ৰী করে জামিলুর রহমান কাউকে হাসতে দেখেননি। তিনি শুকনা গলায় বললেন, ওসি সাহেব আজ চলে যান। আরেকদিন আসুন। আমি বের হব, জরুরী কাজ আছে।
এক কাপ চ খেয়ে তারপর যাই। আপনার এখানে চা-টা ভাল করে।
জামিলুর রহমান চা দিতে বললেন। একজন মানুষের সামনে মুখ সেলাই করে মূর্তির মত বসে থাকা যায় না। টুকটাক কথা বলতে হয়। তিনি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
ওসি সাহেব বললেন, দেশের ইয়াং ছেলে।পুলেরা যে কোন দিকে যাচ্ছেভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমার তিন মেয়ে, ছেলে নেই। আমার স্ত্রীর এই নিয়ে আফসোস আছে। আমি তাকে বললাম, শাহানা তুমি আল্লাহর কাছে শুকুর গুজার কর যে তোমার ছেলে নেই।
হলেতো আপনাদের ভাল। নষ্ট ছেলেমেয়ের বাবা-মার কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পান। অনেক বাবা-মাদের সঙ্গেই নিশ্চয় আপনাদের মাসকাবারি বন্দোবস্ত আছে। আছে না?
খুব কঠিন কথা। এই কঠিন কথা শুনেও ওসি সাহেব হাসছেন। যেন মজাদার রসিকতা শুনে বিমলানন্দ পেলেন। তিনি আরাম করে চা খেলেন।
চায়ের খুব প্রশংসাও করলেন। চায়ের পাতা কোন দোকান থেকে কেনা হয়। জানতে চাইলেন। ক্লোন চা, না ডাস্ট চা তাও জিজ্ঞেস করলেন।
মিতু পানি নিয়ে এসেছে। বাবার মাথায় হাত দিয়ে সে বাবাকে তুলে
বসালো।
ব্যথা কি একটু কম লাগছে। বাবা?
উহু।
বাবা চল তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
সকাল হোক তারপর দেখা যাবে।
না এখুনি চল। তোমার চোখ মুখ কালো হয়ে গেছে। আমার ভাল লাগছে না। বাবা।
ব্যথাটা এখন একটু কম।
এখন কম?
হুঁ। এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবি মা?
অবশ্যই পারব। চল নিচে চলে যাই।
আমি এখানেই থাকি— তুই চা বানিয়ে নিয়ে আয়।
মিতুর ঘর ছেড়ে তাঁর নড়তে ইচ্ছা করছে না। মিতুকে বলে তাঁর ঘরটা কি তিনি নিজের জন্যে নিয়ে নেবেন। অফিস থেকে এসে এই ঘরে থাকবেন। ঘরেতো বাথরুম নেই। বাথরুমের জন্যে নিচে যেতে হবে। মিতুর ঘরটা নেয়া ঠিক হবে না। বেচারীর শখের ঘর। মিতুকে একটা বাথরুম বানিয়ে দিতে হবে। রাজমিস্ত্রীকে সকালবেলাই বলে দেবেন। মিতুর ঘরের সঙ্গে সুন্দর একটা বাথরুম হবে। আর ছাদের চারদিকে রেলিং হবে।
চা খেতে গিয়ে জমিলুর রহমান লক্ষ্য করলেন— তার ব্যথা একটুও নেই। শরীর ঝড়ঝড়ে লাগছে। শরীর ভাল থাকলে যা হয়— সব কিছুই ভাল লাগে। এখনো তাই লাগছে। এই যে তার পাশে মিতু বসে আছে। বিস্মিত চোখে তাকে দেখছে এই দৃশ্যটাও দেখতে ভাল লাগছে।
তুই কি পড়াশোনাও এখানে করিস?
না। এটা হচ্ছে আমার ঘুম-ঘর শুধু ঘুমুবার সময় এখানে আসি। ঘরট সুন্দর না বাবা?
হুঁ সুন্দর।
তোমার ব্যথা কি এখনো আছে?
না-ব্যথা সেরে গেছে।
সেরে গেলেও, তুমি সকালে কোন একজন ভাল ডাক্তারকে তোমার শরীরটা দেখাও।
ডাক্তার দেখাতে হবে না। আমি খুব পরিশ্রম করিতো। পরিশ্রমী মানুষের অসুখ বিসুখ হয় না। এই যে সুরাইয়া এখন স্বাভাবিক আচরণ করছে। কেন করছে? পরিশ্রম করছে বলেই এই উন্নতিটা হয়েছে।
ফুপু কি এখন ভাল হয়ে গেছেন?
আমারতো মনে হয় সে আগের চেয়ে অনেক ভাল। কথাবার্তা ও স্বাভাবিক। তোর কাছে মনে হয় না?
আমিতো বাবা জানি না। ফুপুদের বাড়িতে কখনো যাইনি।
কেন?
যেতে ইচ্ছা করে নি।
ইমন? ইমন আসে না?
না।
কেন?
জানি না বাবা।
সে আসে না বলেই কি তুই যাস না?
মিতু হেসে ফেলে বলল, এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তুমি মাথা ঘামিওনাতো। মা-পুত্র নতুন সংসার পেতেছে, ওদের বিরক্ত করতে ইচ্ছা করে না বলেই যাই না।
ওরা কেন আসে না?
আমি কি করে বলব ওরা কেন আসে না?
আচ্ছা আমি বলে দেব।
তোমাকে কিছু বলতে হবে না। বাবা।
মনের ভেতরের আকাশ মেঘে মেঘে ঢেকে গেলে— গলা এমন ভারী হয়। কেন তার মেয়ের মনে এত মেঘা জমবে? তিনি যেমন একা একা জীবন যাপন করেন তার মেয়েটাও কি তাই করে? এটা ঠিক না। এই বয়সেই একা জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বাকি জীবন কাটানো খুব কষ্টকর হবে।
বাবা!
হুঁ।
সকাল হয়ে যাচ্ছে। ছাদ থেকে সরকাল হওয়া দেখা খুব ইন্টারেস্টিং, দেখবো?
আয় দেখি।
জামিলুর রহমান মেয়ের সঙ্গে সকাল হওয়া দেখতে গেলেন। ব্যাপারটা তাঁর এত ভাল লাগবে তিনি নিজেও ভাবেন নি। গ্রামের সকাল সুন্দর, কিন্তু শহরের সকালও এত সুন্দর হয়? এত পাখি ডাকে? দিনের প্রথম আলোয় এত রহস্য?
জামিলুর রহমানের খুব ইচ্ছা করল মেয়েকে বলেন, মা তুমি আমাকে সুন্দর একটা জিনিস দেখালে। এখন তুমি বল আমার কাছে কি চাও। যা চাইবে তাই আমি দেব। তাঁর নিজেকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের মত মনে হল। মনে হল তার ক্ষমতা অসীম। মিতু নামের মেয়েটি এই মহেন্দ্রক্ষণে যা চাইবে তাই তিনি তাকে দিতে পারবেন।
মিতু কিছু চাচ্ছে না। সুন্দর করে হাসছে। আশ্চর্য! তাঁর নিজের মেয়ে এত সুন্দর করে হাসে আর তিনি জানেন না। শোভনের ব্যাপারটা কি মিতুর সঙ্গে আলাপ করবেন? এমন সুন্দর সকালে কুৎসিত কিছু নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছা করে না।
মিতু!
জ্বি বাবা।
শোভন পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। থানা হাজতে আছে।
বাবা আমি জানি।
তুই জানিস?
হুঁ।
তোর মা। তোর মা-কি জানে?
হ্যাঁ মাও জানেন। টোকন ভাইয়া এসে বলে গেছে।
জামিলুর রহমান চুপ করে গেলেন। সবাই সব কিছু জানে। অথচ সবাই এমন ভাব করছে যেন কেউ কিছু জানে না। বদলে যাচ্ছে, সবাই বদলে যাচ্ছে।
মিতু!
জ্বি বাবা।
তুই যে একটা গান করছিলি। ঐ গানটা করতো শুনি।
মিতু বিস্মিত গলায় বলল, আমি গান করছিলাম মানে? আমি কি গান জানি না-কি যে গান করব?
আমিতো স্পষ্ট শুনলাম তুই গান করছিস।
বাবা আমি কখনো গান করি না। অনেকে বাথরুমে গুনগুন করে গান করে। আমি তাও করি না। আমার গলায় কোন সুর নেই। গান করতো। সুপ্ৰভা। যখন তখন গান।
জামিলুর রহমান চুপ করে গেলেন। তিনি তাহলে সুপ্রভার গানই শুনেছেন।