অপেক্ষা : ১২
সুপ্ৰভাকে হেডমিসট্রেস ডেকে পাঠিয়েছেন। কেন ডেকেছেন সুপ্ৰভা জানে। সে খুব চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে। পারছে না। অদৃশ্য হবার মন্ত্র জানা থাকলে সে অদৃশ্য হয়ে যেত। কেউ কোনদিন তাকে দেখত না। সে সবাইকে দেখতে পারছে, অথচ তাকে কেউ দেখছে না। এরচে আনন্দের জীবন আর কি হতে পারে? পৃথিবীতে অদৃশ্য হবার মন্ত্র নেই বলে সে এখন দৃশ্যমান হয়ে হেডমিসট্রেস আপার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার পা কাঁপছে। বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগছে। ইসলামিয়াতের স্যার একটা দোয়া শিখিয়ে দিয়েছিলেন। যে দোয়া পড়লে ভয় কাটে। সুপ্ৰভা কিছুতেই সেই দোয়া মনে করতে পারছে না।
হেডমিসট্রেস আপা গোলগাল ধরনের মহিলা। গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। ছাত্রীরা আড়ালে তাকে ডাকে মিস বিলেক পটেটো। ব্ল্যাক ভেঙ্গে বিলেক বানানোর কারণ কেউ জানে না এবং তিনি মিসও নন, বিবাহিতা—মিসেস। স্কুলে একটা কথা প্রচলিত আছে—মিস বিলেক পটেটো দূর থেকে রক্ত চোষা গিরগিটির মত রক্ত চুষে খেয়ে নিতে পারেন। রক্ত খাবার কারণেই তার এমন ভর-ভরন্ত শরীর।
সুপ্রভার এখন মনে হচ্ছে রক্ত খাবার ব্যাপারে স্কুলে যে কথাটা প্রচলিত সেটা সত্যি। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, হাত পা কেমন যেন করছে। তাঁর শরীর কেমন যেন করছে।
সুপ্ৰভা!
জ্বি, আপা।
তুমি তিনটা সাবজেক্ট ফেল করেছি। অংক, ইংরেজি সেকেন্ড পেপার এবং ভূগোলে। কারণটা কি?
সুপ্ৰভা মাথা নীচু করে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কি করণীয় সে বুঝতে পারছে না। কাঁদতে পারলে ভাল হত। কাঁদতে পারছে না।
তোমাকে এই বছর প্রমোশন দেয়া হবে না। বুঝতে পারছি?
পারছি।
কিছু বলার আছে?
জ্বি না।
তোমাদের ক্লাসে তুমিই একমাত্র মেয়ে যাকে প্রমোশন দেয়া হল না। শুধু সাজসজ্জা করে পরী সাজলে হবে না। পড়াশোনাও করতে হবে। আমি ঠিক করেছি। সাজুনি মেয়েগুলিকে স্কুলে রাখব না, টিসি দিয়ে বিদায় করে দেব। তুমি তোমার গার্জিয়ানকে বলবে— আমার সঙ্গে দেখা করতে।
জি আচ্ছা।
যাও, এখন যাও। ঠোঁটে আরো বেশি করে লিপস্টিক দাও।
সুপ্ৰভা হেডমিসট্রেস আপার ঘর থেকে বের হল। সে এখন কি করবে? বাসায় ফিরে মাকে সে ফেল করার কথা বলতে পারবে না। মা তাকে খুন করে ফেলবেন। অবশ্যই খুন করে ফেলবেন। কিংবা দোতলার বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবেন। মা পুরোপুরি সুস্থ মানুষ না। বাবা থাকলে হয়ত তিনি মাকে সামলাতেন। বাবারা না-কি মেয়েদের অনেক বেশি আদর করেন। ব্যাপারটা সে তাদের স্কুলেও দেখেছে। মারা যখন মেয়েদের নিতে আসেন তখন মেয়েরা মার সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি যায়। বাবারা যখন আসে তখন মেয়েরা যায় বাবার হাত ধরে। সুপ্রভার কাছে ব্যাপারটা এত ভাল লাগে। সুপ্ৰভা অনেকবার ভেবেছে তার যদি বাবা থাকতো তাহলে তিনি তাকে নিতে এলে সুপ্ৰভা বাবার হাত তার কাধে রেখে দুহাতে সেই হাত ধরে রাখত এবং স্কুল থেকে বের হয়েই বলতো বাবা আমাকে আইসক্রিম কিনে দাও। আইসক্রিম আর দুই ক্যান কোক। কোক দুটা আমি ফ্রিজে রেখে দেব, পরে খাব। সুপ্ৰভা মার কাছে শুনেছে তার বাবা গম্ভীর ধরণের মানুষ ছিলেন। যত গম্ভীর হোক–তার কাছে এইসব চলবে না। মেয়ের কাছে বাবা গম্ভীর থাকবে। কেন? গম্ভীর থাকবে অফিসে, মার সঙ্গে— মেয়ের সঙ্গে কখনো না।
স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুপ্ৰভা তার অদেখা অচেনা বাবার জন্যে চোখের পানি ফেলতে লাগল। স্কুলের সব মেয়ে আজ কত আনন্দ করছে। নতুন ক্লাসে উঠেছে— তাদের হৈ চৈ চিৎকারে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। আর সে কি-না। চোখের পানি ফেলছে। শুধু সে না, তার মত আরো কিছু মেয়ে নিশ্চয়ই কাঁদছে। ফেল করা মেয়েরা সবাই একটা খালি ক্লাসরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদলে ভাল হত। সেই ঘরটার নাম হত। কান্নাঘর।
সুপ্ৰভা!
সুপ্ৰভা দেখল তার পেছনে অংক মিস দাঁড়িয়ে আছেন। অংক মিস ভয়ংকর রাগী। তাঁর সামনে কোন ছাত্রী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে আপনা। আপনি তার দমবন্ধ হয়ে যায়। আজ অংক আপার মুখটা এত কঠিন লাগছে না। হয়ত চোখ ভর্তি পানির কারণে অংক আপার মুখটা কোমল দেখাচ্ছে।
অংক আপা কিছু বলার আগেই সুপ্ৰভা বলল, আপা আমি ফেল করেছি।
অংক আপা সুপ্রভার কাধে হাত রাখলেন। কোমল গলায় বললেন, কেঁদো না, যাও, বাসায় যাও। সামনের বছর খুব ভালমত পড়াশোনা করবে। প্রতিদিন স্কুলের শেষে আমার কাছে অংক করবে। ঠিক আছে?
জি আচ্ছ। আপা।
আমি হেডমিসট্রেস আপাকে অনুরোধ করেছিলাম তোমাকে প্রমোশন দিয়ে দেয়ার জন্যে। বলেছিলাম, অংকটা আমি টেক কেয়ার করব। আপাকে রাজি করাতে পারিনি। এসো, আমার কাছে এসো, তোমাকে আদর করে দি।
সুপ্রভা বিস্ময়ে অভিভূত হল। এই আপাকে তার মনে হত–পৃথিবীর কঠিনতম মহিলা। অথচ তিনি ফেল করা একটা মেয়েকে এই ভাবে জড়িয়ে ধরতে পারেন? চোখের পানি মুছে মাথায় চুমু দিতে পারেন? মানুষ এত ভাল হয়? সুপ্ৰভা ঠিক করে ফেলল। সে আর কখনো মানুষের বাইরের রূপ দেখে মানুষকে বিচার করবে না। মানুষের বাইরের রূপ এবং ভেতরের রূপ। কখনোই এক রকম না।
জামিলুর রহমান সাহেব আজ অফিসে দেরী করে এসেছেন। অফিসে ঢুকতেই তাঁর ম্যানেজার বলল, স্যার আপনার ভাগ্নি এসেছে। আপনার ঘরে বসে আছে। খুব কান্নাকাটি করছে।
কেন?
জানি না। স্যার। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিছু বলে না। শুধু কাঁদে।
ফ্রিজে কোক আছে?
জি স্যার।
তাকে কোক দাও। গ্লাসে বরফ দিয়ে দিও। মেয়েটা আবার খুব ঠাণ্ডা না হলে খেতে পারে না।
জামিলুর রহমান ঘরে ঢুকলেন। সুপ্ৰভা চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মার সঙ্গে ঝগড়া টগড়া নিশ্চয়ই হয়েছে। জামিলুর রহমানের অত্যন্ত মন খারাপ হল। আহা বেচারি, গালে চোখের পানি শুকিয়ে বসে গেছে। কি অসহায় লাগছে মেয়েটাকে। অন্য দিন অফিসে ঢুকে সে নিজেই কোকের ক্যান বের করে। আজ তাও করে নি।
ঘরের ভেতরটা গরম গরম লাগছে। শীতকাল হলেও দুপুরে ঘর তেতে উঠে। মেয়েটা নিশ্চয়ই গরমেও কষ্ট পাচ্ছে। জামিলুর রহমান অতি সাবধানে ফ্যানটা ছাড়লেন। শব্দ শুনে মেয়েটা জেগে না যায়। ঘুমুচ্ছে ঘুমাক। সুপ্ৰভা ফ্যানের সামান্য আওয়াজেই জেগে উঠল।
জামিলুর রহমান বললেন, তোকে কতবার বলেছি অফিসে না আসতে। আবার এসেছিস?
সুপ্ৰভা জবাব দিল না। তিনি কোকের ক্যান এগিয়ে দিতে দিতে বললেন—কোক খেতে খেতে বল, কান্নাকাটি কিসের। কি এমন হয়েছে যে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিতে হবে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
সুপ্ৰভা নিচু গলায় বলল, মামা আজ আমাদের রেজাল্ট হয়েছে।
ফেল করেছিস?
হুঁ।
ফেলতো করবিই। পড়াশোনার সঙ্গে কোন যোগ নাই। সারাদিন হাসোহাসি। ঝাপাঝাপি। দৌড়াদৌড়ি। অফিসে ঘোরাঘুরি। এখন আর কেঁদে কি হবে?
বাসায় মাকে কি বলব?
এই দুঃশ্চিন্তাটা আগে করলেতো আর পরীক্ষায় ফেল করতি না। ভাল সমস্যা হল।
মাকে আমি কি বলব। মামা?
তুই কিছু বলিস না। যা বলার আমি বলব।
মামা, তুমি আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও। সেখানে কোন একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। শুধু তুমি আর আমি থাকব।
ভাগ্নির কথা শুনে জামিলুর রহমান দীর্ঘ দিন পর প্রাণ খুলে অনেকক্ষণ হাসলেন। হাসতে হাসতেই দুঃশ্চিন্তগ্রস্ত হলেন—বোকা মেয়ে। বড় হয়ে দারুণ সমস্যায় পড়বে। যেখানে সব মানুষের পেট ভর্তি শুধু চালাকি সেখানে এই সরল সোজা মেয়েটা করবে কি?
সুপ্ৰভা, তুই বাসায় চলে যা। তোর মাকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি ব্যবস্থা করব।
মা যদি জিজ্ঞেস করে কি রেজাল্ট?
জিজ্ঞেস করবে না। সেতো দিন রাত ঝিম ধরেই থাকে। আর যদি জিজ্ঞেস করেও বলবি সন্ধ্যার পর আমি এসে বলব।
আমার রেজাল্ট—তুমি কেন বলবে?
আমি বলব। কারণ তোদের হেড মিসট্রেস, তোর সম্পর্কে আলাপ করবার জন্যে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তোর রেজাল্ট কার্ড আমার কাছে দিয়েছেন।
তুমি মিথ্যা কথা বলবে?
জামিলুর রহমানের মন আরো খারাপ হল। কি বোকা মেয়ে। তিনি মিথ্যা কথা বলবেন শুনে সে আৎকে উঠেছে। বোকা মেয়ে জানে না যে জগৎটাই চলছে মিথ্যার উপরে। সত্যি কথা এখন শুধু বলে পাগলরা।
কোক খা।
কোক খেতে ইচ্ছা করছে না মামা।
খেতে ইচ্ছা করবে না কেন? খা। দে গ্রাসে খানিকটা আমাকেও ঢেলে দে। খেয়ে দেখি কি এমন জিনিস যে রোজ খেতে হয়।
কোক খেতে খেতে জমিলুর রহমান ঠিক করে ফেললেন তিনি সুপ্রভার স্কুলে যাবেন। হেড মিসট্রেসকে বলবেন, আমি আপনার স্কুলে কিছু ডােনেশন করতে চাই। আমি দরিদ্র মানুষ আমার সাধ্য সীমিত। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক সাথে করে এনেছি। যদি গ্রহণ করেন। খুশী হব। পরে আরো বেশি। কিছু করার ইচ্ছা আছে। আপাতত এইটা নিন।
এতেই কাজ হবার কথা। এরচে কমেও কাজ হবে। তবে তিনি কোন রিস্ক নেবেন না। সুপ্রভার প্রমোশনটা দরকার। মেয়ে ফেল করেছে শুনলে তার মা অত্যাচার করবে। যত দিন যাচ্ছে সুরাইয়া ততই যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আজকাল কথা বললেও মন দিয়ে শুনে না-কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাথা পুরোপুরি নষ্টই হয়ে গেছে। তার জন্যে কিছু করা দরকার। কি করবেন। তাও তিনি জানেন না। নিজের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সংসারের দিকে তাকানো হয় না।
রাত আটটার দিকে আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামল। একতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে সুপ্ৰভা বৃষ্টি দেখছিল। আসলে বৃষ্টি দেখছিল না, অপেক্ষা করছিল তার মামার জন্যে। তিনি এত দেরি করছেন কেন? সুরাইয়া এখনো তার মেয়েকে ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। সুপ্ৰভা জানে এই কাজটা তার মা করবেন। এক্ষুণি হয়ত ডাকবেন। তার আগে আগেই মামার বাড়িতে আসা খুব দরকার। মামা কিছু করতে পারবেন বলে তার মনে হয় না। মিনিস্টার টিনিষ্টার হলে হয়ত পারতেন। গত বৎসর মিনিস্টারের এক মেয়ে ফেল করেছিল। মিনিস্টার সাহেব স্কুলে এসেছিলেন। তাঁকে ফুলের মালা দেয়া হল। চা খাওয়ানো হল। এবং মেয়ে পাশ হয়ে উপরের ক্লাসে উঠে গেল।
সুপ্ৰভা!
সুপ্ৰভা তাকিয়ে দেখে মিতু। হাসি হাসি মুখ।
তুই এখানে মুর্তির মত বসে আছিস। দারুণ ব্যাপার হচ্ছে—শিল পড়ছে। আয় শিল কুড়াই।
ইচ্ছা করছে না, আপা।
ইচ্ছা না করলেও আয়—তোর হয়েছে কি? সারাদিন মুখ ভোতা করে আছিস।
আমার খুব মাথা ধরেছে।
আমি শিল কুড়াবার জন্যে ছাদে যাচ্ছি—ঢং করিস না, তুইও আয়। মাথা ব্যথা কমানোর জন্যে তোকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছাদে না এলে কঠিন শাস্তি দেব।
মিতু চলে যাবার পর পরই বুয়া এসে সুপ্রভাকে বলল, আপনারে আপনের
আম্মা ডাকে।
সুপ্ৰভা মার ঘরের দিকে রওনা হল। তার পা কাপছে। কিন্তু আশ্চর্য কারণে মনটা শান্ত।
সুরাইয়া খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। গত রাতে তার এক ফোঁটা ঘুম হয় নি বলে চোখের নিচে কালি পড়েছে। তাকে খুবই ক্লান্ত এবং অসুস্থ লাগছে। তার সামনে খবরের কাগজ। সেখানে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপনগুলি তিনি পড়ছেন এবং দাগ দিচ্ছেন। একটা বিজ্ঞাপন তার পছন্দ হয়েছে। শরীরটা ভাল লাগলে দেখে আসতেন। সারাদিন শরীর ভাল লাগেনি–এখন একটু ভাল লাগছে। এত রাতেতো আর বাড়ি দেখতে যাওয়া যায় না। সুরাইয়া মেয়েকে ঢুকতে দেখে বললেন—আজি না তোদের রেজাল্ট হবার কথা, রেজাল্ট হয়েছে?
সুপ্ৰভা বলল, হ্যাঁ।
হ্যাঁ-টা খুব সহজভাবে বললেও সুপ্রভার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। এখনই প্রশ্নটা করা হবে—রেজাল্ট কি? সুপ্ৰভা মনে মনে উত্তর ঝালিয়ে নিল। উত্তরটা হচ্ছে রেজাল্ট কি আমি জানি না মা। বড় মামা জানেন। হেডমিসট্রেস বড় মামাকে স্কুলে ডাকিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর কাছে রেজাল্ট দেবেন। তবে আমার ধারণা পাশ করেছি।
সুরাইয়া রেজাল্ট কি জানতে চাইলেন না। খবরের কাগজটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বাসা ভাড়ার এই বিজ্ঞাপনটা পড়ে দেখ। সস্তার মধ্যে খুব ভাল।
সুপ্ৰভা বিজ্ঞাপন পড়ল। দুই রুম, ড্রয়িং ডাইনিং, প্রশস্ত বারান্দা। সাউথ ফেসিং প্রচুর আলো বাতাস। ভাড়া—লাইট, গ্যাসসহ তিন হাজার টাকা।
কিরে ভাল না?
হুঁ।
আমি আর তুই আমরা একটা ঘরে থাকলাম। ইমনের জন্যে একটা ঘর ছেড়ে দিলাম।
বাসাটা কোন তলায়?
সেটাতো লেখেনি। টেলিফোন নাম্বার আছে। টেলিফোন করে দেখতো বাড়িওয়ালাকে পাওয়া যায় কি-না।
আচ্ছা।
সব ডিটেল জেনে নিবি। ফ্ল্যাট বাড়ি কি-না, কয়জন ভাড়াটে থাকেন—এইসব। কথাবার্তা ভাল মনে হলে, কাল তোকে নিয়ে যাব।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুপ্ৰভা চলে যাচ্ছিল, সুরাইয়া হঠাৎ ডাকলেন—
সুপ্ৰভা শোন।
সুপ্ৰভা থমকে দাঁড়াল। সুরাইয়া বললেন, তোর রেজাল্ট কি?
সুপ্ৰভা নীচু গলায় বলল, মা আমি ফেল করেছি।
ফেল করেছিস!
হ্যাঁ। তিন সাবজেক্টে ফেল করেছি। প্রমোশন দেয় নি।
ফেল করেছি। কথাটা এত সহজভাবে বলতে পারলি? মুখে একবারও আটকাল না?
সুপ্ৰভা দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না। তার পা এখন আর কাঁপছে না। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। বুকের উপর পাষাণ চেপে ছিল। সেই পাষাণ নেই। সুরাইয়া সহজ গলায় বললেন, তোর মত মেয়ের আমার দরকার নেই। তুই একটা কাজ কর—ছাদে উঠে যা। তারপর ছাদ থেকে নিচে লাফ দিয়ে পড়ে যা।
সুপ্ৰভা আগের মতই দাঁড়িয়ে রইল। একবার শুধু মার দিকে তাকাল। মায়ের মুখ কি শান্ত। কত সহজ ভাবেই না। তিনি কথাগুলি বলছেন। সুপ্ৰভা মনে মনে বলল, মা সামনের বছর থেকে আমি খুব মন দিয়ে পড়ব। ফাস্ট সেকেন্ড হয়ত হব না, কিন্তু প্রতিটি সাবজেক্ট পাশ করব। তাছাড়া আমাদের অংক মিস রোজ আমাকে অংক শেখাবেন।
সুরাইয়া তীব্র এবং তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? এক কথা আমি বার বার বলতে পারব না। যা ছাদে যা! ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করা।
সত্যি ছাদ থেকে লাফ দিতে বলছে!
হ্যাঁ বলছি। যদি সাহস থাকে, যা করতে বলছি করা। সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকিবি না। সং দেখতে আর ভাল লাগে না।
মিতু ছাদে শিল কুড়াচ্ছিল। হঠাৎ দেখল। সুপ্রভা ছাদে ঢুকল। মিতু হাসিমুখে বলল, শেষ পর্যন্ত তাহলে এলি। শিলগুলি রাখার জন্যে একটা পাত্র নিয়ে আয়তো।
সুপ্ৰভা দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না। হঠাৎ মিতুর মনে হল সুপ্রভার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। সুপ্ৰভাকে খুবই অস্বাভাবিক লাগছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যেই ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
মিতু চট করে উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে সুপ্ৰভাকে ধরতে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রেলিং বিহীন ছাদের শেষ মাথা পর্যন্ত সুপ্রভা ছুটে গেল। মিতু দেখল। সে ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্ৰভা নেই।
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোরে জমিলুর রহমান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পকেটে সুপ্রভার স্কুলের হেড মিসট্রেসের দেয়া কাগজ। সেখানে লেখা বিশেষ বিবেচনায় সুপ্ৰভাকে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হল। হেড মিসট্রেসের চিঠি তিনি পেয়েছেন দুপুরেই। একবার ভাবলেন তখনই বাসায় ফেরেন-তারপর মনে হল খালি হাতে বাসায় ফেরা ঠিক হবে না। পাশের মিষ্টি কিনে ফেরা দরকার। রসমালাই সুপ্রভার পছন্দ। এক কেজি রসমালাই কেনা দরকার। বিকেলে নিজেই রসমালাই কিনতে গিয়ে বৃষ্টিতে আটকা পড়লেন। সেই রসমালাই খাবার ঘরের টেবিলে সাজানো আছে। জামিলুর রহমান সাহেব বা রান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছেন। বৃষ্টি দেখতে তাঁর ভাল লাগছে, অথচ কিছুক্ষণ আগে একজন ডাক্তার এসে বলে গেছেন, মেয়ের অবস্থা ভাল না। ব্রেইন হেমারেজ হচ্ছে। আমাদের কিছু করার নেই।
জামিলুর রহমান যন্ত্রের মত বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনি যান। ভেতরে গিয়ে মেয়ের বিছানার পাশে বসুন।
জামিলুর রহমান সহজ গলায় বললেন, কোন দরকার নেই।
তিনি হাসপাতাল থেকে বের হলেন। তাঁর কেন জানি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে। ছোটবেলায় সুযোগ পেলেই বৃষ্টিতে ভিজতেন। সুযোগ পাওয়া যেত না। এখন প্রচুর সুযোগ কিন্তু বৃষ্টিতে নামতে ইচ্ছা করে না। আজ নামতে ইচ্ছা করছে। তিনি পথে নামতেই বৃষ্টি থেমে গেল। মেঘ কেটে আকাশে তারা দেখা গেল। জমিলুর রহমান সাহেব হাঁটছেন। চারপাশের পরিচিত ঢাকা নগরী তার কাছে আজ বড়ই অপরিচিত লাগছে। যেন তিনি এই নগরীকে চেনেন না। নগরীও তাঁকে চেনে না।
মৃত্যুর ঠিক আগে আগে সুপ্রভার পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এল। সে তার মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা আমি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বিরাট একটা ভুল করেছি। তুমি কিছু মনে করো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।
সুরাইয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে কি ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না।
সুপ্ৰভা বলল, মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দাও।
সুরাইয়া মেয়ের গায়ে হাত রাখলেন। সুপ্ৰভা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড় মামা যদি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় তাহলে আমার ব্যথাটা কমবে। বলার পর পরই সে মারা গেল।
মিতু ছুটে গেল করিডোরের দিকে, করিডোর শূন্য। সেখানে কেউ নেই। করিডোরের এক প্রান্তে রাখা টুলে ইমন বসেছিল। মিতু ইমনের কাছে গেল। শান্ত স্বরে বলল, এইভাবে চুপচাপ বসে থাকবি না। চিৎকার করে কাদ। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদ। কে কি মনে করবে। এইসব ভাবার কোন দরকার নেই।
ইমন উঠে মিতুকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল।
অভিমানী ছোট্ট মেয়েটি জানলও না—এই পৃথিবীতে তার জন্যে কত ভালবাসাই না জমা ছিল।
ছোট্ট সুপ্রভা। তোমার প্রসঙ্গ অপেক্ষা উপন্যাসে আর আসবে না। কারণ তোমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না। মৃত মানুষদের জন্যে আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্যে। এই চরম সত্যটি না জেনেই তুমি হারিয়ে গেলে।