অপরূপ অন্ধকার
বিশ্বনাথকে গোপন খবরটা দিয়েছিলেন ওঁরই বন্ধু সন্দীপন।
তবে সেটা মোটেই সহজে দেননি। ওঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনেক চাপাচাপি করতে হয়েছিল, সঙ্গে ঘুষ দিতে হয়েছিল এক প্যাকেট বিদেশি সিগারেট। তারপর একটু-একটু করে ব্যাপারটা ফাঁস করেছিলেন সন্দীপন।
ফাঁস করেছিলেন আরও একটা কারণে। বিশ্বনাথের রোজকার হেনস্থার কথা শুনে সন্দীপনের মনটা নরম হয়েছিল। বন্ধুর দুঃখ-কষ্ট দাগ কেটেছিল মনে। তাই গোপন কথাটা আর গোপন রাখতে পারেননি।
শুনে থ’ হয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। এরকমটাও হয়।
‘হয় মানে!’ চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, সন্দীপন, ‘হচ্ছে! এই তো আমি জলজ্যান্ত তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তারপরেও তুমি অবিশ্বাস করবে?’
না, শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস করতে পারেননি বিশ্বনাথ। কিন্তু অভিনব ধাক্কাটা সামলাতে সময় লেগেছিল। আর সেই বেসামাল অবস্থাতেই একটা গোপন ইচ্ছে মনের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছিল।
সন্দীপনকে আর কিছু বলেননি বিশ্বনাথ। শুধু একটা ঝিম ধরা ভাব নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।
সেদিন রাতে ছেলের বউ পারমিতা যখন ওঁর সামনে খাবারের থালা রেখে দিয়ে চলে গেল তখন বিশ্বনাথ বিরক্ত হতেও ভুলে গেলেন। সন্দীপনের কথাগুলো ওঁকে এমনই মশগুল করে রেখেছিল।
খানিকক্ষণ পর খেয়াল হতেই থালায় সাজানো পদগুলো দেখতে পেলেন। তিনটে রুটি, বেগুনপোড়া, একটা সবজি, আর একটা ছোট্ট বাটিতে দই।
ওঁর মতো ষাট পেরোনো বৃদ্ধের স্বাস্থ্যরক্ষা করতে এই ধরনের মেনুই নাকি ডাক্তারের পরামর্শ।
বিশ্বনাথের মনে হল, পাশেই ডাইনিং স্পেসে গিয়ে পারমিতা আর আলোকের পাতটা দেখে আসেন। ডাক্তাররা কোন ধরনের মেনু সাজেস্ট করেছেন বত্রিশ আর সাতাশের স্বামী-স্ত্রীর জন্য। আর ডাইনিং স্পেসের পাশের বারান্দায় গিয়ে দেখে আসেন, আলোকের পোশা অ্যালসেশিয়ান ভিক্টরের জন্য কোন মেনু বরাদ্দ হয়েছে।
স্ত্রী রেণুকণা বেঁচে থাকলে বলতেন, ‘ছেড়ে দাও! এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কিছু বোলো না। সবাই তোমাকে ছোট ভাববে। তার চেয়ে বরং একটু না হয় স্যাক্রিফাইস করলে…।’
স্যাক্রিফাইস! আলোক আর পারমিতা জানে এই শব্দটার মানে?
রেণুকথার কথা মনে পড়তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের জমাট অন্ধকার ঠেলে বেরিয়ে এল বাইরে।
দীর্ঘশ্বাসের আর দোষ কী! রেণুকথা চলে যাওয়ার পর গত পাঁচ বছর ধরে এটা বিশ্বনাথের গা সওয়া হয়ে গেছে।
বেশ মনে পড়ে, আলোকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ও কলেজ থেকে বি. এসসি. পাশ করে বেরোনোর পর-পর।
এমনিতে ছোটবেলা থেকেই ও বেশ আদরে-আদরে মানুষ হয়েছে—একমাত্র সন্তান হলে সাধারণত যেমনটা হয়। তবে ও যতই বড় হয়েছে ওর মধ্যে জেদ আর স্বার্থপর ভাব ততই মাথাচাড়া দিয়েছে।
বিশ্বনাথ ব্যাপারটা ভীষণ অপছন্দ করতে শুরু করেছিলেন।
রেণুকথা আলোককে যেমন স্নেহ করতেন, তেমন শাসনও করতেন। তবে দুটোর মাত্রা বোধহয় সঠিক অনুপাতে ছিল না। অথবা বোধহয় ভাবতেন, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু হয়নি।
আলোকের সঙ্গে যেদিন বিশ্বনাথের প্রথম সরাসরি সংঘর্ষ বাধে সেদিনটা বিশ্বনাথ ভোলেননি। কারণ, দিনটা ছিল আলোকের জন্মদিন। তখন ও থার্ড ইয়ারে পড়ে।
বাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করেছিল আলোক। আর ভ্যাপসা গরমের মধ্যে সারাটা দিন ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাত পুড়িয়ে ছ’-সাত পদ রান্না করেছিল রেণুকথা। ফ্রায়েড রাইস, চাইনিজ আলুর দম, চিনি চিকেন, আরও কত কী!
জন্মদিন আসার দিনসাতেক আগে থেকেই মায়ের কাছে বায়না করেছিল আলোক। বলেছিল, ‘মা, কলেজে এবারই আমাদের লাস্ট ইয়ার—এরপর বন্ধুরা কে কোথায় ছিটকে যাবে। এবারের বার্থডেটা একটু জোরদার করতে হবে। আমার খুব ক্লোজ পাঁচ-ছ’জন বন্ধুকে সেদিন নেমন্তন্ন করব—রাতে এখানে খেতে বলব।’
রেণুকথা হেসে রাজি হয়েছিলেন। কারণ, আলোকের সেই কোন সাত বছর বয়েসে বেশ ঘটা করে ওর জন্মদিন উদযাপন করা হয়েছিল। তারপর থেকে প্রায় সব বছরেই শুধু ওরা তিনজন। আর রেণুকণার হাতে তৈরি পায়েস, সঙ্গে মাংস, কিংবা চিংড়ি মাছের মালাইকারি।
তাই সেবার খাওয়াদাওয়ার আয়োজনটা ভালোই হয়েছিল। বিশ্বনাথ নিজের হাতে চুটিয়ে বাজার করেছিলেন।
সন্ধেবেলা আলোকের পাঁচজন বন্ধু এসে হাজির হল। তিনজন ছেলে, দুজন মেয়ে। ওদের পোশাক বেশ আধুনিক ফিটফাট। চেহারাও টগবগে, তরতাজা। মুখে হাসি লেগেই আছে। আর হাতে গিফটের প্যাকেট।
বিশ্বনাথ আর রেণুকণার সঙ্গে বন্ধুদের আলাপ করিয়ে দিল আলোক। ওরা সবাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করল।
বিশ্বনাথের ব্যাপারটা ভালো লেগেছিল। যদিও যুগ এখন অনেক এগিয়ে গেছে, চারপাশটা অনেক আধুনিক, তা সত্ত্বেও এই সেকেলে অভ্যাসটা বিশ্বনাথকে তৃপ্তি দিয়েছিল।
সারা সন্ধে ধরে আলোকের ঘরে ওরা হুইহুল্লোড় করল। সাউন্ড সিস্টেমে চড়া আওয়াজে গান বাজিয়ে নাচল। গোটা ফ্ল্যাটে আনন্দ আর খুশির পাগলা হাওয়া উদ্দামভাবে ছুটে বেড়াতে লাগল।
পাশের ঘরে বসে বিশ্বনাথ আর রেণুকণা উৎসবের এই মেজাজটা বেশ ভালোই উপভোগ করছিলেন। কয়েকটা গানের সঙ্গে রেণুকথা গুনগুন করে গলাও মেলাচ্ছিলেন।
বিশ্বনাথের বয়েসটাও পিছিয়ে যাচ্ছিল দ্রুতবেগে। তিনি রেণুর হাত চেপে ধরে একটা গোপন ইশারা করলেন, তারপর হো-হো করে হাসিতে ফেটে পড়লেন।
কিন্তু রাতের খাওয়াদাওয়ার পরেও ওদের হুইহুল্লোড় চলতে লাগল।
বিশ্বনাথের ভুরু কুঁচকে গেলেও ব্যাপারটা অতটা গায়ে মাখেননি। শুধু ঘড়ির কাঁটা দশটা পার হতেই রেণুকণাকে বললেন, ‘দশটা বেজে গেছে…এখনও এরকম শোরগোল হচ্ছে…আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন এবার মাইন্ড করতে পারে…।’
রেণু বললেন, ‘তুমি গিয়ে একবার আলোকে বলো না…।’
বিশ্বনাথ বেঁকে বসলেন। রেণুকণাকেই বললেন দায়িত্বটা নিতে। কিন্তু রেণুও গাঁইগুঁই করে বিশ্বনাথের কোর্টে বল পাঠাতে চাইলেন।
এইভাবে বেশ কয়েকবার বল চালাচালির পর বিশ্বনাথ হেরে গেলেন। ব্যাজার মুখে উঠে দাঁড়ালেন। রওনা হলেন আলোকের ঘরের দিকে।
ওর ঘরে যেতে-যেতে মনে-মনে রিহার্সাল দিচ্ছিলেন বিশ্বনাথ। ঠিক কীভাবে কথাটা বলবেন আলোকে? ঘরের বাইরে ইশারায় ডেকে নেবেন? তারপর চাপা গলায় বলবেন, ‘আলো, রাত হয়েছে—এবার বন্ধুদের বাড়ি যেতে বলো।’
নাঃ, এটা একটু শাসনের মতো শোনাচ্ছে। ছেলে বড় হয়েছে। ওর ইগো এতে হার্ট হতে পারে।
তার চেয়ে এরকম করে বললে হয়: ‘আলো, সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজটা একটু আস্তে করে দাও। অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন হয়তো ডিসটার্বড হচ্ছে…।’
হ্যাঁ, এটা অনেক বেটার। এ-কথা বলে আলোক মোটেই বিশ্বনাথের ওপরে রাগ করবে না।
সুতরাং রিহার্সাল দেওয়া সংলাপটা একরকম মুখস্থ করে বিশ্বনাথ আলোকের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
ঘরের বাইরের বারান্দার আলোটা নেভানো ছিল। খোলা দরজা দিয়ে ঘরের আলো আর শব্দ চলকে পড়ছে বাইরে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছেলেকে ইশারা করে ডাকার জন্য আলোর এলাকায় মাথাটা বাড়িয়ে দিলেন বিশ্বনাথ। সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর ভেতরকার ছন্দ-তাল সব গরমিল হয়ে গেল।
কারণ, যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
মিউজিক সিস্টেমের ঝংকারের তালে-তালে ছ’টা ছেলেমেয়ে উদ্দামভাবে নাচছে। মেঝেতে ওদের এলোমেলো পা ফেলার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছিল, পায়ের সঙ্গে মাথার তেমন সুষম যোগযোগ নেই।
আলোককে দুপাশ থেকে ধরে রেখেছে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলেটি রোগা, লম্বা, থুতনিতে এক চিলতে দাড়ি। আর মেয়েটি মাথায় খাটো, ফরসা মুখের দুপাশে কোঁকড়া চুলের ঢল, চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা, গায়ে লাল রঙের থ্রি-কোয়ার্টার হাতা টপ, পায়ে স্কিন-টাইট জিনস।
আলোককে ওরা ধরে রেখেছে কারণ আলোক ঠিকঠাক অবস্থায় নেই। ও চোখ বুজে জিভটা লম্বা করে বাইরে বের করে রেখেছে। আর ওর জিভের সামনে লকলক করছে ছোট্ট একটা সবুজ সাপ। সাপটাকে আলোকের জিভের কাছাকাছি ধরে রেখেছে কালো মতন কদমছাঁট চুল একটি ছেলে। ছেলেটির চুলের ডানপাশটা সাপটার মতোই সবুজ। আর হাতে চামড়ার দস্তানা।
বেসামাল নাচের তালে-তালে আলোকের জিভ এপাশ-ওপাশ সরে যাচ্ছিল। আর সাপটাও জিভের নিশানা ঠিক রাখতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছিল।
বিদ্যুৎ-ঝিলিকের মতো সবুজ হিলহিলে সাপটা আলোকের জিভে ছোবল মারল।
ছোবল এসে পড়ল বিশ্বনাথের বুকেও। যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। ভেজা কাপড় নিংড়ানোর মতো ওঁর হৃৎপিণ্ডটা অমানুষিক শক্তিতে মোচড় দিচ্ছিল কেউ, আর টপটপ করে রক্ত ঝরছিল।
পৃথিবীর যত বয়েস বাড়ছে ততই সে আধুনিক হয়ে উঠছে। পৃথিবীর বয়েস আসলে যেন কমছে। কিন্তু বিশ্বনাথের বুকের ভেতরটা হুহু করছিল।
একটু-আধটু নেশা করা হয়তো দোষের নয়। কিন্তু তাই বলে সাপের ছোবল!
ছোবলটা জিভে পড়ার পরই পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল আলোক। ওর শরীরটা বেপরোয়াভাবে ছটফট করতে লাগল। ব্যাপারটা যন্ত্রণার না আনন্দের সেটা আলোকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বুঝতে চাইলেন বিশ্বনাথ। কিন্তু পারলেন না।
শুধু দেখলেন, আলোকের দুপাশের ছেলেটা আর মেয়েটা শক্ত করে আলোককে চেপে ধরে আছে। আর আলোকের ঠোঁটের কোণ থেকে লালা ঝরছে। একটা তৃপ্তির গোঙানিও যেন শোনা যাচ্ছে ওর মুখ থেকে।
ভাঙা বুক নিয়ে সরে এসেছিলেন বিশ্বনাথ। অন্ধকার বারান্দায় শুরু হয়ে গিয়েছিল ওঁর নতুন রিহার্সাল। রেণুকণাকে গিয়ে এখন কী বলবেন? বলবেন সাপের ছোবলের কথা? রেণুকণার সমস্ত আনন্দ আর সুখ শেষ করে দেবেন এক ছোবলে?
না, বিশ্বনাথ সেটা পারেননি। ফিরে এসে মিথ্যে কথা বলেছিলেন স্ত্রীকে: ‘আলো বলল, একটু পরেই ওরা চলে যাবে…।’
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সেই শুরু।
রেণুকণা বিশ্বনাথের কাছ থেকে আলোককে আড়াল করেছেন। আর বিশ্বনাথ পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আলোর কালো দিকগুলো লুকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।
এইভাবে দুজনে গোপনে সাপের ছোবল খেয়ে চলেছেন বরাবর।
সময় বদলে যাচ্ছিল, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে আলোকও। কিন্তু বিশ্বনাথ আর রেণুকণা নিজেদের বদলে ফেলতে পারছিলেন না মোটেই। যখনই ওরা শক্ত হয়ে কোনও একটা রুক্ষ সিদ্ধান্তের কথা ভাবছিলেন, তখনই ম্যাজিকের মতো ছোট্টবেলার আলোক হাসিমুখে আধো-আধো কথা নিয়ে ওঁদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছিল। আর সেই স্নেহের তাপে বরফের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গলে জল হয়ে যাচ্ছিল ধীরে-ধীরে।
শেষ পর্যন্ত ওঁরা আড়ালে শুধু চোখের জল ফেলেছেন।
আলোক বড় হয়ে উঠছিল আর চারপাশের উচ্ছৃঙ্খলতার সঙ্গে দিব্যি নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল।
ওকে ব্যবসা করার জন্য টাকা দিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। সে-টাকা নষ্ট হলেও কোনও প্রশ্ন করেননি ছেলেকে—কোনও জবাবদিহি চাননি। শুধু রেণুকণার কাছে আড়ালে আক্ষেপ করেছেন।
আলোক ওর ইচ্ছেমতো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আউটিং-এ গেছে। সারা রাত ধরে নাইটক্লাবে গিয়ে হুল্লোড় করেছে। কিংবা বাড়িতে ইয়ার দোস্তদের ডেকে রঙ্গিলা পার্টির আয়োজন করেছে।
একইসঙ্গে আলোকের পোশাক-আশাক, চুলের ছাঁট ইত্যাদি পালটে গিয়েছিল।
কখনও লম্বা-লম্বা চুল, এক কানে দুল, বুড়ো আঙুলে সোনার আংটি নিয়ে ও হাজির হয়েছে বিশ্বনাথের সামনে। আবার কখনও-বা জুলপি-হীন কদমছাঁট, হাতে রিস্ট ব্যান্ড, গলায় সরু চেন—তার লকেটে কঙ্কালের মাথা। আবার কোনওদিন নাভি পর্যন্ত খোলা থ্রি-কোয়ার্টার হাতা ফিনফিনে কাপড়ের জামা, বুকে নানান রঙের উল্কি, ডানবুকের নিপলে আটকানো সোনার রিং।
এইভাবে ছেলেটা ধীরে-ধীরে অচেনা হয়ে যাচ্ছিল বিশ্বনাথের কাছে। আলোক থেকে স্রেফ লোক হয়ে যাচ্ছিল।
জীবনের শেষ ক’টা বছর রেণুকণার বেশ কষ্টে কেটেছিল। চাপা গলায় আপনমনে প্রায়ই বলতেন, ‘আমাদের সেই আগের সময়টাই ছিল ভালো— যখন আর কেউ ছিল না…শুধু তুমি আর আমি…।’
কথাটা বলতে গিয়ে রেণুকণার গলা ধরে যেত। তিনি সবসময় বিশ্বনাথকে যেমন ছেলের কাছ থেকে আড়াল করতেন, একইসঙ্গে নিজেও ছেলের জীবন থেকে সরে থাকতে চাইতেন। গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শকের মতো ওঁরা আলোকের জীবনযাপন দূর থেকে দেখতেন।
আলোক একটা ওষুধকোম্পানিতে প্রথম চাকরি নিয়েছিল। তারপর অত্যন্ত কম সময়ে উঠে গেল ওপরদিকে। হঠাৎ একদিন ও একটা এসি প্রিমিয়াম গাড়ি কিনে ফেলল—গাড়িটার রং তেল চকচকে কালো—ছ’টা দরজা। আর তার সপ্তাহদুয়েক পরেই একটা সুন্দরী মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। রেণুকণাকে ডেকে বলল, ‘মাম, এ হল পারমিতা। আজ থেকে আমার সঙ্গে থাকবে—।’
ঘটনাটা রেণুকণাকে নতুন করে তেমন ধাক্কা দেয়নি। আধুনিক টিভি প্রোগ্রামের দৌলতে সবাই জানে যে, শাঁখা-সিঁদুর-বিয়ে বহুবছর ধরে মাথায় উঠেছে। এখন শুধু থাকাথাকির যুগ। যতদিন পোষায় একসঙ্গে থাকো। তারপর ইচ্ছে হলে একা চলে যাও।
কিন্তু বিশ্বনাথ বা রেণুকণা ব্যাপারটাকে ‘বিয়ে’ বলেই ভেবেছেন। পারমিতা আজও বিশ্বনাথের চোখে আলোর ‘স্ত্রী’।
আলোকের বিয়ের—অথবা, ওইরকম কিছুর—বছরখানেক পর রেণুকণা চলে গেলেন। চলে যাওয়ার সময় নিজে যেমন কষ্ট পাননি, তেমনিই কাউকে কষ্ট দেননি। রাতে ঘুমিয়েছিলেন। সকালে সেই ঘুম আর ভাঙল না। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, সিভিয়ার সেরিব্রাল অ্যাটাক। হাই ব্লাড প্রেশারের সমস্যা ছিলই—সম্ভবত সেটাই ঘুমের মধ্যে লাগামছাড়া হয়ে গেছে।
রেণুকণা চলে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিলেন না—তাই কিছুই গুছিয়ে যেতে পারেননি। বিশ্বনাথকে আচমকা ফাঁকা মাঠে একা দাঁড় করিয়ে চলে গেলেন। ঢেউয়ের দাপটে লাট খাওয়া মানুষের মতো বিশ্বনাথের সব ওলটপালট হয়ে গেল। তিনি হতবুদ্ধি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন।
তার পর থেকে পাঁচটি বছরে সবকিছুই কেমন বদলে গেল।
ফ্ল্যাটের সবচেয়ে ছোট ঘরটায় বিশ্বনাথের ঠাঁই হল। সরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ড্রাগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ থেকে সিনিয়ার সুপারিটেন্ডেন্ট হিসেবে রিটায়ার করলেন এবং ছোটবেলার মতো বেকার হয়ে গেলেন।
টিভি দেখে, রেণুকণার কথা ভেবে, আর বই পড়ে সময় কাটাতে লাগলেন বিশ্বনাথ। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা কমিয়ে দিলেন। চারপাশের জীবন থেকে ধীরে-ধীরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে তিনি যেন কোনও চরম মুহূর্তের অপেক্ষায় রইলেন। একটা অপ্রয়োজনীয় জীবনকে বয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি আর গ্লানি বিশ্বনাথকে কুরে-কুরে খেতে লাগল।
সামনে রাখা থালার দিকে হাত বাড়ালেন। একটুকরো রুটি ছিঁড়ে নিয়ে সেটা দিয়ে খানিকটা বেগুনপোড়া মুড়ে নিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘দ্যাখো রেণু, কপালপোড়া দিয়ে রুটি খাচ্ছি—।’
গ্রাসটা মুখে পুরে দিলেন। একইসঙ্গে চোখ ফেটে জল এল। খাবারটা চিবিয়ে ঢোঁক গিলতে কষ্ট হল।
রেণুকণা ওঁর বুকের ভেতর থেকে বকুনি লাগালেন: ‘কী ছেলেমানুষের মতো করছ! কী খেলে সেটা বড় কথা নয়—শরীর রাখাটাই বড় কথা। ভুলে যাও কেন, তোমার বয়েস হয়েছে? নাও, খেয়ে নাও…কেঁদো না, লক্ষ্মীটি…।’
গলা ব্যথা করলেও খাওয়া শেষ করলেন বিশ্বনাথ। অনেকটা জল খেয়ে গলা সাফ করে তবেই ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারলেন আবার। পারমিতার ছকে দেওয়া নিয়ম মতো এঁটো থালা আর গ্লাসটা টয়লেটের কাছে ওয়াশবেসিনের নীচে রেখে দিলেন। তারপর বেসিনে হাত-মুখ ধুচ্ছেন, হঠাৎই একটা চাপা গরগর শব্দ শুনে বেসিনের সামনে আয়নার দিকে তাকালেন।
আলোকদের বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিক্টর।
লোমে ঢাকা ভারী শরীর। গলার কাছটায় লোমগুলো এত ঘন যে, গলার বেলটটা লোমে ডুবে গেছে। দুটো হলদে চোখ কী তীব্র! কপাল থেকে ছাই রং নেমে এলেও পরে সেটা গাঢ় হয়ে ছুঁচলো মুখের কাছে কালো হয়ে গেছে। চোয়াল দুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। নাকের ডগাটা কুঁচকে ওপরের পাটির কয়েকটা দাঁত বের করে রেখেছে বলে হিংস্র আর ভয়ংকর লাগছে।
তার সঙ্গে ওই গরগর শব্দ।
রোজকার রুটিন থেকে বিশ্বনাথ জানেন, ভিক্টর এখন টয়লেটে যাবে। পারমিতা ট্রেনিং দিয়ে ওকে এটা অভ্যেস করিয়েছে। টয়লেট ব্যবহার করার সময় ভিক্টর একা থাকতে চায়—আশপাশে লোকজন চায় না। অর্থাৎ বিশ্বনাথকে এখন টয়লেটের কাছ থেকে সরে যেতে হবে।
বিশ্বনাথ সরে এলেন।
ভিক্টরের কাছাকাছি হতে ওঁর ভয় করে। কারণ, মাসকয়েক আগে ভিক্টর ওঁর হাতেকামড়ে দিয়েছিল। আলোক আর পারমিতার কাছে সে ঘটনা জানানোর পর ওদের যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল!
আলোকের কথাগুলো মনে পড়তেই বিশ্বনাথের কান গরম হয়ে উঠল। অপমান আর ধিক্কারের জ্বালা নতুন করে ছুঁচ ফোটাল বুকে।
ঘরে এসে অলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন বিশ্বনাথ। আজ আর বই পড়তে কিংবা টিভি দেখতে ইচ্ছে করল না।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে একটা হাত মাথার ওপরে রেখে অন্ধকার সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আলোক আর পারমিতার কাছে বিশ্বনাথের পরিচয় প্রয়োজনহীন নিষ্কর্মা একজন বাড়তি মানুষ। বিশ্বনাথ থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী! বিশ্বনাথ যে বেঁচে আছেন সেটা কেউ টের পায় না। আবার চলে গেলেও কেউ যে ওঁর অভাব টের পাবে তাও মনে হয় না।
সব মিলিয়ে এক হতচ্ছাড়া জীবন।
সেইজন্যই সন্দীপনের কথাটা মনে পড়ছিল বারবার।
সত্যিই তো! যে-জীবনটা অবহেলা আর অপমানে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে সেটাকে একটু বদলে নিলে ক্ষতি কী!
বিশ্বনাথের ইচ্ছে হল, এক মুহূর্তে সন্দীপনকে একটা ফোন করেন। কিন্তু উপায় নেই। বেস ফোন আলোকদের ঘরে। আর বিশ্বনাথের মোবাইল ফোন নেই।
কিন্তু সন্দীপনের আছে।
এই নতুন ‘চাকরি’টা নেওয়ার পরই বোধহয় তিনি মোবাইল ফোন কিনেছে।
কমিউনিটি পার্কে রিটায়ার্ড বৃদ্ধদের আড্ডায় সন্দীপন বিশ্বনাথের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কারণ, দুজনের জীবনে অনেকটা মিল আছে।
সন্দীপন বিপত্নীক। ওর এক ছেলে। ছেলে যেমন একরাশ মেয়েবন্ধু জুটিয়ে ফূর্তিফার্তা করে, ছেলের বউও একই টাইপের। দুজনে একেবারে যেন রাজযোটক। সন্দীপন ওদের সঙ্গে কোনওরকমে টিকে আছেন।
সেইজন্যই বিশ্বনাথের সঙ্গে সন্দীপনের সুখ-দুঃখের কথা হয় বেশি।
আজ সন্ধেবেলা পার্কে বসে সন্দীপনের কাছে ব্যাপারটা শোনার পর বিশ্বনাথ হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একটা ভয়ংকর ধাক্কা খেয়েছিলেন।
কিন্তু যতই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছেন ততই মনে হচ্ছে, সন্দীপন ঠিকই করেছেন।
প্রথমত, এই ‘চাকরি’টা নিলে একটা কাজের মধ্যে থাকা যাবে। আর দ্বিতীয়ত, আর্থিক টানাপোড়নের জায়গাটা অনেক নরম আর সহজ হয়ে যাবে। তা ছাড়া, এখন যে-জীবনে বিশ্বনাথ হাঁটছেন—হাঁটছেন কি না কে জানে!—তার ডাকনাম হয়তো ‘জীবন’, কিন্তু পোশাকী নাম যে ‘মরণ’ সেটা ক’জন বুঝবে!
বিশ্বনাথ ভেবে দেখলেন, মরে থাকা মানুষ আর মরতে পারে না। তাই ঠিক করলেন, কাল রাস্তায় বেরিয়ে সন্দীপনকে ফোন করবেন।
বাড়িটার বাইরের চেহারাটা যে ছদ্মবেশ সেটা বোঝা গেল ভেতরে ঢোকার পর। বাইরেটা যেমন জরাজীর্ণ, আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো, ভেতরটা ততটাই উলটো—ঝকঝকে, স্মার্ট। এটাই ‘শটস অ্যান্ড বিকস’-এর অফিস।
রাস্তার ফোনবুথ থেকে সন্দীপনকে ফোন করে একটা কোম্পানির নাম আর একটা সেল ফোনের নম্বর নিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। তারপর দুরুদুরু বুকে সেই নম্বরে ফোন করেছেন।
‘হ্যালো…”শটস অ্যান্ড কিকস”?’
‘ইয়েস।’ একটা মেয়েলি গলা উত্তর দিল, ‘আপনি কে বলছেন?’
বিশ্বনাথ নাম বললেন।
‘এই ফোন নাম্বারটা আপনাকে কে দিয়েছেন—রেফারেন্সটা কাইন্ডলি বলবেন?’
বিশ্বনাথ সন্দীপনের নাম-ঠিকানা বললেন।
সঠিক রেফারেন্স না দিতে পারলে কথাবার্তা যে সেখানেই শেষ সেটা সন্দীপন বারবার করে বিশ্বনাথকে বলে দিয়েছেন। বলেছেন যে, ওরা স্রেফ ‘রং নাম্বার’ বলে লাইন কেটে দেবে।
ও-প্রান্তে মেয়েটি একটু সময় নিচ্ছিল। বোধহয় কম্পিউটারের ডেটাবেস-এ সন্দীপনের নাম-ঠিকানাটা ক্রসচেক করে নিচ্ছিল।
একটু পরেই: ‘ও. কে., মিস্টার বোস, বলুন কীভাবে আপনাকে আমরা হেলপ করতে পারি—।’
বিশ্বনাথ বেশ চেষ্টা করে বললেন, ‘আমি সি. ভি. অপারেশান করাতে চাই।’
এ-কথা শুনে মেয়েটির যান্ত্রিক গলা একটুও কাঁপল না। ও বলল, ‘আপনার ফুল পোস্টাল অ্যাড্রেস দিন আর আপনার মায়ের বিয়ের আগের পদবী বলুন।’
বিশ্বনাথ নিজের পুরো ঠিকানা বললেন। তারপর আমতা-আমতা করে জানতে চাইলেন, ‘আমার মায়ের মেইডেন সারনেম? মা তো বহু বছর আগে মারা গেছেন…তাঁর বিয়ের আগের…।
মেয়েটি বিশ্বনাথকে বাধা দিয়ে বলল, ‘একটা-দুটো অফবিট পারসোনাল ইনফরমেশান আমরা ডেটাবেস-এ স্টোর করে রাখি, মিস্টার বোস। আমাদের কোনও পেশেন্ট ওভার দ্য ফোন কোনও ইনফরমেশান চাইলে আমরা তাঁর টেলিফোনিক পারসোনাল আইডেন্টিফিকেশান নাম্বার ছাড়াও দু-একটা পারসোনাল ইনফো ক্রসচেক করে নিই—সেইজন্যেই আপনার মায়ের মেইডেন সারনেমটা দরকার। যদি বাই চান্স কেউ আপনার টি-পিন নাম্বারটা জেনেও যায়, সে আপনার নাম করে ফোন করেও আমাদের কাছ থেকে আপনার কোনও প্রাইভেট ইনফো বের করতে পারবে না।’ একটু দম নিল মেয়েটি। তারপর বলল, ‘দিস ইজ অ্যাবসোলিউটলি ফর প্রোটেকশান অফ ইয়োর প্রাইভেসি, মিস্টার বোস। আই হোপ ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড…।’
বিশ্বনাথ বুঝলেন, কিন্তু একইসঙ্গে অবাকও হলেন। এত সতর্কতা কীসের জন্য?’
একটু পরেই ওঁর মনে হল, অপারেশানটা হয়তো ইল্লিগাল—তাই এত সাবধান হতে চায় ওরা।
বিশ্বনাথ ওঁর মায়ের বিয়ের আগের পদবি বললেন।
তখন মেয়েটি ওঁকে একটা নম্বর দিয়ে বলল, ‘এটা আপনার রেফারেন্স নাম্বার। আমাদের অফিসের রিসেপশানে এসে এই রেফারেন্স নাম্বারটা বলবেন, আর আপনার ফোটো আই-ডি কার্ড দেখাবেন। তা হলেই আপনাকে একজন এক্সিকিউটিভ অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে। আপনার দেখা করার সময় হল সন্ধে সাতটা থেকে ন’টা। যদি আজ থেকে ঠিক সাতদিনের মধ্যে আপনি যোগাযোগ না করেন তা হলে আপনার সমস্ত রেকর্ডস আমাদের ডেটাবেস থেকে অটোমেটিক্যালি ইরেজড হয়ে যাবে। তখন আপনাকে পুরো কেসটা রিওপেন করতে হবে। ‘ইজ ইট ক্লিয়ার, মিস্টার বোস?’
এত কথা বলার সময় মেয়েটির গলায় এতটুকু ওঠা-পড়া হয়নি। মনে হচ্ছিল, টেলিফোনে মেয়েটি পড়া মুখস্থ বলছে।
এরপর মেয়েটি বিশ্বনাথকে ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর ঠিকানা দিল। তারপর বলল, ‘উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট ইন ইয়োর পসিবল নিউ লাইফ, মিস্টার বোস। থ্যাংক ইউ ফর কলিং। হ্যাভ আ নাইস ডে।’
টেলিফোনে কথা বলার পর বেশ কয়েকদিন তীব্র দোটানায় ভুগেছেন বিশ্বনাথ। অপারেশান করাবেন—না কি করাবেন না? রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে রেণুকণার সঙ্গে অনেক কাল্পনিক তর্ক-বিতর্ক করেছেন, নিজের সঙ্গেও অনেক লড়াই করেছেন। কারণ, এই সি. ভি. অপারেশানটা পারমানেন্ট—রিভার্সিবল নয়। একবার অপারেশান হয়ে গেলে আর ফেরা যায় না।
বিশ্বনাথ অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে এলেন, তিনি আর ফিরতে চান না।
সুতরাং বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ফিরে যাওয়ার কোনও ঝটকা টের পেলেন না বিশ্বনাথ। বরং মনে হল, সামনেই নতুন জীবন।
বাড়িটার রং চটে গেছে, নানান জায়গায় ফাটল। তার কোনও-কোনও জায়গা থেকে উঁকি মারছে বট-অশ্বত্থের চারা। রাস্তার ভেপার ল্যাম্পের কটকটে আলোয় বাড়িটাকে শতচ্ছিন্ন পোশাক পরা ভিখারি মনে হচ্ছে।
বাড়ির সদর দরজার মাথায় ছোট্ট ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ড। তাতে ইংরেজি হরফে লেখা: ‘শটস অ্যান্ড কিকস’। তার নীচে ছোট-ছোট হরফে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ‘ড্রাগ অ্যাবিউজ ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ।’
চারপাশে ড্রাগের নেশা কীরকম জাঁকিয়ে বসেছে সেটা বিশ্বনাথ ভালোই জানেন। সরকার ড্রাগ অ্যাবিউজের সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত। খবরের কাগজ কিংবা টিভি চ্যানেল খুললে ড্রাগের বিষয়ে খবর অন্তত শতকরা দশ ভাগ। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স থেকেই ঝাঁকে-ঝাঁকে ছেলেমেয়েরা ড্রাগের খপ্পরে পড়ছে। সেটা সামাল দিতে সরকার যে-স্পেশাল নারকোটিকস ডিপার্টমেন্ট খুলেছে তারা দিন-রাত হিমশিম খাচ্ছে। সেইসঙ্গে নাজেহাল হচ্ছে পুলিশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির সমস্যা থেকেই এই সমস্যাটা মাথাচাড়া দিয়েছে। আর অর্থনীতির সমস্যার শিকড়ে রয়েছে তীব্র বেকার সমস্যা।
না, এতসব জটিলতা বিশ্বনাথ বোঝেন না। তিনি শুধু দেখছেন, চারপাশের ছেলেমেয়েরা দিন-দিন কেমন উচ্ছৃঙ্খল বেপরোয়া হয়ে উঠছে, নিত্যনতুন নেশার পিছনে পাগলের মতো ছুটছে। ওদের সামনে নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য নেই।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে ঝকঝকে তকতকে একটা অফিসের মুখোমুখি হলেন বিশ্বনাথ। চারপাশে শুধু কাচের দেওয়াল, সৌখিন রাবার উডের ফার্নিচার, ল্যাপটপ কম্পিউটার আর টেলিফোন। কোথাও-কোথাও মিহি সুরে ফোনের রিং বাজছে—এ ছাড়া এয়ার কন্ডিশান্ড অফিসটায় আর কোনও শব্দ নেই।
সব পার্টিশান কাচের হাওয়ায় অফিসের ভেতর অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।
বিভিন্ন কাচের দেওয়ালে যেসব স্লোগান আর পোস্টার লাগানো রয়েছে তাতে মনে হবে ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর আসল কাজ হল ড্রাগের মারাত্মক নেশা ছাড়ানো। প্রতিটি পোস্টারে ওদের লোগো—’এস’, ‘এ’, ‘কে’ অক্ষর তিনটে সুন্দর জড়ানো কায়দায় লেখা।
বিশ্বনাথের অবাক লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এটাও আর-একটা ছদ্মবেশ।
রিসেপশানে অনেক লোকের ভিড়। বেশিরভাগই কমবয়েসি ছেলেমেয়ে—সঙ্গে ওদের বাবা-মা কিংবা গার্জেন। ওঁরা সত্যি-সত্যি হয়তো ছেলেমেয়ের ড্রাগের নেশা ছাড়াতে এসেছেন।
ওই ভিড়ের মধ্যে দুজন বয়স্ক মানুষকে দেখে বিশ্বনাথের সন্দেহ হল। ওঁরা দুজন সি. ভি. অপারেশানের জন্য আসেননি তো!
কে জানে, ‘শটস অ্যান্ড কিকস’ হয়তো ড্রাগের দু-দিকেই কাজ করে: ড্রাগের নেশা ধরানো এবং ছাড়ানো।
রিসেপশানিস্ট মেয়েটি ফুটফুটে দেখতে। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। লম্বা-লম্বা নখে একই রঙের নেইলপালিশ। কানের লতিতে বিশাল মাপের দুটো রুপোলি রিং। ওর পিছনের দেওয়ালে জ্বলন্ত সিগারেটের ওপরে লাল কাটা চিহ্ন দেওয়া একটা পোস্টার।
রিসেপশানে বিশ্বনাথ নিজের নাম লেখা স্লিপ জমা দিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পালা আসতেই রিসেপশানিস্ট মেয়েটি ওঁর নাম ধরে ডাকল।
বিশ্বনাথ চেয়ার ছেড়ে উঠে মেয়েটির কাছে গেলেন। নিজের রেফারেন্স নম্বর বললেন, ফটো আই-ডি কার্ড দেখালেন।
মেয়েটি ভাবলেশহীন মুখে ল্যাপটপের বোতাম টিপতে লাগল। কালো কিবোর্ডের ওপরে ওর নড়েচড়ে বেড়ানো লাল নখগুলোকে ফুলের পাপড়ি বলে মনে হচ্ছিল।
ল্যাপটপের পরদায় মেয়েটি কী দেখল কে জানে! শুধু চোখ তুলে বিশ্বনাথের দিকে কয়েকপলক তাকাল। তারপর বলল, ‘আপনি বসুন, মিস্টার বোস। আপনাকে নিতে লোক আসবে।’
তারপরই মেয়েটি কিবোর্ডের বোতাম টেপায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বেশিক্ষণ বসতে হল না। সাদা অ্যাপ্রন পরা একটি ছেলে অফিসের ভেতর থেকে হেঁটে আসছিল রিসেপশানের দিকে। কাচের দরজা ঠেলে সে রিসেপশান জোনে এল। রিসেপশানিস্টের কাছে গিয়ে চাপা গলায় কী যেন জিগ্যেস করল। উত্তরে রিসেপশানিস্ট চোখের ইশারায় বিশ্বনাথকে দেখিয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটি স্মার্টভাবে চলে এল বিশ্বনাথের কাছে। নীচু গলায় বলল, ‘মিস্টার বোস?’
বিশ্বনাথ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে উঠে দাঁড়ালেন।
‘কাইন্ডলি আমার সঙ্গে আসুন—।’
ছেলেটির সঙ্গে এগোলেন বিশ্বনাথ। ওকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। চোখের আধুনিক পলিমার লেন্সের চশমা। ফরসা, রোগা চেহারা। এতই রোগা যে, চোয়াল এবং কণ্ঠা বিশ্রীভাবে নিজেদের জাহির করছে। তবে ছেলেটির মাথার চুল অস্বাভাবিক ফোলানে-ফাঁপানো। ওর রোগা চেহারার সঙ্গে ভীষণ বেমানান লাগছে। ওর পা ফেলার সঙ্গে-সঙ্গে ঝাঁকড়া চুলগুলো নড়ছে।
ছেলেটির সঙ্গে অনেকগুলো কাচের দরজা পেরোলেন বিশ্বনাথ। তারপর একটা পরদা ঘেরা কাচের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
ছেলেটি বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল: ‘ভেতরে যান, মিস্টার বোস। ডক্টর মালাকার আপনার জন্যে ওয়েট করছেন।’
হাত বাড়িয়ে কাচের দরজা ঠেলে খুলল ছেলেটি। চোখের ইশারায় বিশ্বনাথকে ভেতরে যেতে ইশারা করল।
বিশ্বনাথ যখন ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকছেন তখন ছেলেটি চাপা গলায় বলল, ‘অল দ্য বেস্ট, স্যার—।’
ছেলেটি ‘স্যার’ বলায় বিশ্বনাথ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন। ছেলেটি মুচকি হেসে চলে গেল।
এতক্ষণ বিশ্বনাথের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ছিল। যদিও জেদটা মনের ভেতরে ভালোমতোই জাঁকিয়ে বসেছিল। ছেলেটির বলা ‘স্যার’ শব্দটা বিশ্বনাথকে যেন নতুন এক ভরসা দিল। নতুন এক মর্যাদাও যেন অনুভব করলেন।
ভাবার সময় আর বেশি ছিল না। শক্ত পায়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন বিশ্বনাথ। সঙ্গে-সঙ্গে ডক্টর মালাকার ওঁকে খুব চেনা আত্মীয়ের মতো অভ্যর্থনা জানালেন।
‘আরে, ‘আসুন…আসুন, বিশ্বনাথবাবু…’ একগাল হেসে দু-হাত বাড়িয়ে বিশ্বনাথের হাত চেপে ধরলেন মালাকার: ‘বলুন, কেমন আছেন? সব কুশল মঙ্গল তো!’
বিশ্বনাথ একটু অপ্রস্তুত হয়ে কাঠ-কাঠ হাসলেন। নীচু গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি—।’
ডক্টর মালাকার কি অন্য কোনও সূত্রে ওঁকে চেনেন? এমনভাবে ভদ্রলোক কথা বলছেন যেন কতদিনের চেনা!
‘বসুন, বসুন—’একটা শৌখিন রিভলভিং চেয়ারের দিকে ইশারা করলেন ডক্টর মালাকার। তারপর একই ঢঙে উচ্চারণ করলেন, ‘হুম। তো আপনি ভ্যাম্পায়ার হতে চান? মানে, সি. ভি. অপারেশান করাতে চান—মানে, যেটাকে আমরা কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার বলি…।’
বিশ্বনাথ চেয়ারে বসলেন বটে, কিন্তু ওঁর গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
মালাকার তাঁর চেয়ারে বসে হাসি-হাসি মুখে বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোধহয় উত্তরের অপেক্ষা করছিলেন।
আশ্চর্য! কী সহজে কথাগুলো বললেন মালাকার! যেন ব্যাপারটা রোজকার দাড়ি কামানোর মতোই মামুলি।
ঠান্ডা ঘরের মধ্যেও ঘেমে গেলেন বিশ্বনাথ। অবাক চোখে মালাকার এবং তাঁর অফিসটাকে দেখতে লাগলেন। যেন পুরোটাই অন্য কোনও গ্রহের ব্যাপার।
ডক্টর মালাকার বেশ মোটাসোটা। কোমরের বেলটের ওপর থেকে মাঝারি মাপের ভুঁড়ি উপচে পড়ছে। মাথায় মসৃণ টাক—শুধু কানের ওপরটায় কয়েক খাবলা কাঁচাপাকা চুল। আর কানের পাশ দিয়ে অনেকটা গালপাট্টার মতন পাকা জুলপির জঙ্গল নেমে এসেছে।
মালাকারের রং ফরসা—তবে কিছুটা রোদে পোড়া। কপালে কয়েকটা ভাঁজ। ছোট মাপের ভুরু। তার নীচেই মেটাল ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। দু-দিকে ফোলা গানের মাঝে নাকটা বক্সারদের মতো থ্যাবড়ানো। গোঁফ-দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। থুতনির নীচে দু-থাক চর্বি। সবমিলিয়ে মুখে একটা কমিক ভাব আছে। ফলে এই লোক যে সি. ভি. অপারেশন করেন সেটা ভাবাটা বেশ কঠিন।
মালাকারের চেম্বারটা মাপে বেশ বড়। দেখে ডক্টরস চেম্বার বলেই মনে হয়। দু-দেওয়াল জুড়ে ‘এল’ কাউন্টার। তাতে বেশ কয়েকটা মোটা-মোটা বই আর কাগজপত্র রাখা। তার পাশেই একটা এলসিডি মনিটারওয়ালা কম্পিউটার। মনিটারে কারসর দপদপ করছে।
কাউন্টারের বাঁদিকে প্রচুর ডাক্তারি যন্ত্রপাতি। অপারেশানের জন্য সেগুলো ব্যবহার হয় কি না বিশ্বনাথ ঠিক বুঝতে পারলেন না। তার ঠিক ওপরেই কাচের দেওয়ালে একটা ইলেকট্রনিক ক্যালেন্ডার—তাতে আজকের তারিখটা লাল রঙে জ্বলছে।
ডক্টর মালাকারের সামনে রাবার উডের বড়সড় টেবিল। টেবিলের একপাশে ল্যাপটপ কম্পিউটার। হয়তো বিশ্বনাথ ঘরে ঢোকার আগে মালাবার এই কম্পিউটারেই কাজ করছিলেন।
কম্পিউটারের পাশে একটা বেঁটেখাটো প্ল্যাস্টিকের স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডের একইঞ্চি ওপরে একটা ডাম্বেল আকৃতির রোটর শূন্যে ঘুরছে। আর স্ট্যান্ডের একপাশে লেখা ‘এস. এ. কে’।
এ ছাড়া টেবিলে পড়ে আছে রঙিন কয়েকটা পেন, দুটো মোবাইল ফোন, আর চার-পাঁচটা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন।
মালাকার আবার জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি সি. ভি. অপারেশানটা করাতে চান তো, বিশ্বনাথবাবু?’
বিশ্বনাথ মাইক টেস্ট করার মতো গলাখাঁকারি দিয়ে গলা টেস্ট করলেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, চাই…যত তাড়াতাড়ি সম্ভব…।’
উত্তর শুনে মালাকার হাসলেন, বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল! আপনার মতো কনফিডেন্ট পেশেন্ট আমরা খুব বেশি পাই না। বেশিরভাগই দোটানায় ভোগে।’
বিশ্বনাথ অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরপর কী করতে হবে সেটা ডক্টর মালাকার তাড়াতাড়ি বলে ফেললেই ভালো। সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েই গেছে তখন আর দেরি করে লাভ কী!
সন্দীপন এখানকার কনট্যাক্ট নম্বর বিশ্বনাথকে দিয়েছেন, আর দু-চার লাইনে অপরেশানটার কথা বলেছেন। এও বলেছেন, ‘আর বেশি জানতে চেয়ো না। ওরা পুরো ব্যাপারটাই কনফিডেনশিয়াল রাখতে বলেছেন। তুমি আগে ডিসাইড করো কী করবে—তারপর ওখানে গেলে ওরাই সবকিছু তোমাকে ডিটেইলসে বলে দেবে…।’
এখন সেই ডিটেইলস শোনার পালা।
ডক্টর মালাকার টেবিলে রাখা ল্যাপটপের কিবোর্ডে আঙুল চালালেন। এলসিডি পরদার দিকে কয়েক সেকেন্ড আড়চোখে তাকালেন। তারপর বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন।
‘বিশ্বনাথবাবু, আমরা আপনার একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনটা বদলে দেব—নতুন থ্রিলিং জীবনের দরজা খুলে দেব আপনার সামনে।’ টেবিলের ওপরে ঝুঁকে এলেন মালাকার: ‘না, না—এগুলো মোটেই সেলস টক নয়। এগুলো হার্ড রিয়েলিটি। তা ছাড়া অপারেশানের জন্যে আমরা তো পয়সা নেব—সো ইউ শুড নট বি গ্রেটফুল টু আস। ইটস আ প্রফেশনাল ডিল। আপনি যা চান—আমরা দেব।
‘আপনি তো জানেন, এই টুয়েন্টি সেকেন্ড সেঞ্চুরিতে টেকনোলজি বুম যেমন হয়েছে তেমনই হয়েছে অ্যাডিকশান বুম—স্ম্যাক বুম। এখনকার ইয়াং জেনারেশানের টুয়েন্টি এইট পার্সেন্ট অ্যাডিকটেড। মদ, গাঁজা, চরস, হ্যাশিশ, এলএসডি, মারিজুয়ানা, কোকেন, মরফিন, মিথাডেন, মেস্কালাইন—এরকম কত নাম আর বলব! এর কোনওটা স্টিমুল্যান্ট, কোনওটা নারকোটিক, আবার কোনওটা বা হ্যালুসিনোজেন। এরকম আরও অনেক টাইপ আছে। কিন্তু লাস্ট পনেরো কি বিশ বছরে আরও অনেক নতুন-নতুন নেশা ইনট্রোডিউসড হয়ে গেছে…।’
ডক্টর মালাকারকে বাধা দিয়ে বিশ্বনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ—যেমন সাপের ছোবল।’
হাসলেন মালাকার: ‘ঠিকই বলেছেন। তবে সাপের ছোবলেই ব্যাপারটা থেমে থাকেনি। সাপের পাশাপাশি চালু হয়েছে পাহাড়ি কাঁকড়াবিছে, গিরগিটি আর বেজির কামড়—এ ছাড়া যদিও খুব রেয়ার এবং কস্টলি, কেউ-কেউ নেশার জন্যে অ্যামেরিকার অ্যারো-পয়জন ফ্রগের বিষ ডাইলুট করে ব্যবহার করে। আপনি জানেন কি না জানি না—বহুবছর আগে কাফ সিরাপ আর ঘুমের ট্যাবলেটও এসব কাজে ব্যবহার হত—’
বিশ্বনাথ মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, তিনি শুনেছেন।
ডক্টর মালাকার ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু এখন সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে কোন নেশা জানেন?’
বিশ্বনাথ জানেন। সন্দীপনের কাছে শুনেছেন। কিন্তু তিনি চুপ করে রইলেন। ডক্টর মালাকারের কাছ থেকেই উত্তরটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
‘ভ্যাম্পায়ারের ছোবল।’ চোখ বড়-বড় করে বললেন মালাকার, ‘এটাই এখন ট্রেন্ডি। বড়লোকের নেশা করা ছেলেমেয়েরা এই ছোবলের জন্যে পাগল। বুঝতেই পারছেন, এই নেশাটা কস্টলি—তাই একটু অ্যাফ্লুয়েন্ট ফ্যামিলির ছেলেমেয়েরাই এই নতুন নেশায় হ্যাবিচুয়েটেড…। চলতি কথায় এটাকে আমরা বলি ”ভি-স্টিং”। আফটার সি. ভি. অপারেশান স্টিং প্রোভাইড করাটাই হবে আপনার প্রফেশান। তাতে খুব একটা খারাপ ইনকাম হবে না আপনার। তা ছাড়া বোনাস হিসেবে কতকগুলো বাড়তি সুবিধে পাবেন…থাক—সেগুলো পরে জানবেন।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে হাত বোলালেন মালাকার: ‘মোট কথা, আমি আপনাকে বলছি, আফটার অপারেশান, দিস নিউ লাইফ ইজ গোয়িং টু বি ভেরি-ভেরি ইন্টারেস্টিং। রিয়েলি ইট ইজ—কারণ, এ পর্যন্ত আমরা কোনও কমপ্লেইন পাইনি।’
টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সেইসঙ্গে কেঁপে উঠে নড়তে লাগল টেবিলের ওপরে।
ডক্টর মালাকার ফোনটা তুলে কথা বললেন, ‘হ্যাঁ’, ‘হ্যাঁ’, করে কিছুক্ষণ কথা বলে শেষে বললেন, ‘হ্যাঁ, পেশেন্টের সঙ্গে ফাইনাল কথা বলে অপারেশানের ডেট ফিক্স করে নিচ্ছি। ও. কে.।’
মোবাইল ফোনের বোতাম টিপে ওটা টেবিলে আবার রেখে দিলেন মালাকার। তারপর স্থির চোখে তাকালেন বিশ্বনাথের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘মিস্টার বোস, লেট আস নাউ কাম ডাউন টু বিজনেস। লেট মি টেল ইউ দ্য ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস অ্যাবাউট দ্য সি. ভি. অপারেশান…।’
ডক্টর মালাকার বলে গেলেন, বিশ্বনাথ শুনে গেলেন।
অপারেশানটার জন্য খরচ দু-ঘণ্টা সময়, আর চল্লিশ হাজার টাকা। তবে হিসেব করলে অপারেশানটা মোটেই কস্টলি নয়। কারণ, অপারেশনের পরে বিশ্বনাথ যখন ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর মাধ্যমে নেশার ক্লায়েন্ট পাবেন, তখন ক্লায়েন্টপিছু এক-একটা রাতের জন্য তিনি পাবেন একহাজার টাকা। তার মধ্যে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ‘শটস অ্যান্ড কিকস’ কেটে নেবে থার্টি পার্সেন্ট। সুতরাং অঙ্ক কষলে দেখা যাবে, মাত্র আটান্ন রাতের কাজ পেলেই বিশ্বনাথের অপারেশানের খরচ উঠে আসবে। তা ছাড়া অপারেশানের পর বিশ্বনাথ কিছু নতুন-নতুন ক্ষমতার মালিক হবেন। সেগুলো বোনাস বলেই ভাবেন।
‘আমাদের এই অপারেশান বা রিলেটেড ব্যাপারগুলো কিন্তু অ্যাবসোলিউটলি কনফিডেনশিয়াল। আমাদের যে-এগ্রিমেন্ট তৈরি হবে তার একটা মেজর কন্ডিশানই হচ্ছে সিক্রেসি। কারণ, জেনে রাখুন, এই সি. ভি. অপারেশানটা পানিশেবল আন্ডার ইন্ডিয়ান পিনাল কোড। যদি অপারেশানের পরে আমাদের সিক্রেট পুলিশ কিংবা সিকিওরিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট আপনার খোঁজ পায়…যদি জানতে পারে যে, আপনি কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার, তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে আপনাকে অ্যারেস্ট করবে। তা ছাড়া ভ্যাম্পায়ারের ছোবল দিয়ে নেশা করা বা করানো—দুটোই ইল্লিগাল।’ মালাকার আবার চওড়া হাসলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত দুটো ভুঁড়ির ওপরে রাখলেন। একটু কেশে নিয়ে বললেন, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন, ইল্লিগাল হলে এই কাজটা আমরা করছি কেন। করছি কারণ, এই অপারেশানটা বায়োটেকনোলজির একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট। তা ছাড়া আমরা ভালো কাজও তো করছি! এই যে, কত ছেলেমেয়েকে ড্রাগের সর্বনাশা নেশা থেকে বাঁচাচ্ছি! আসলে একগাদা পুণ্যের সঙ্গে ছিটেফোঁটা পাপ মিশে থাকলে ওটা হিসেবের মধ্যে আসে না।
‘মোট কথা, মিস্টার বোস, আপনি এখন ”এস এ সি”-র টপ সিক্রেট জোনে ঢুকে পড়েছেন। এবার আপনাকে এগ্রিমেন্ট ফর্ম আর বন্ড সই করতে হবে। তারপর আপনার রুটিন মেডিকেল চেক-আপ করা হবে। এই ইসিজি, ইইজি, ব্লাডপ্রেশার, ইউএসজি এইসব আর কী!
‘এবারে বলুন, আপনি কবে অপারেশানটা করাতে চান?…
বিশ্বনাথ যে সি. ভি. অপারেশানটা করিয়েছেন সেটা আলোক বা পারমিতা টের পেল না। কারণ, অপারেশানটা এমন যে, অপারেশানের পর ঘণ্টাতিনেক রেস্ট নিলেই রুগি চাঙ্গা হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। ফলে বিশ্বনাথও অপারেশানের পর ‘শটস অ্যান্ড কিকস’ থেকে দিব্যি পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এসি ট্রলি বাস ধরে বাড়ি চলে এসেছেন। ওরা কেউ কিছু টের পায়নি।
তবে ভিক্টর বিশ্বনাথকে দেখে একটু যেন বাড়তি গরগর করেছিল। তাতে ভয় পেয়ে সাততাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।
বিশ্বনাথের কেমন যেন গা গুলোচ্ছিল। তাই রাতে আর কিছু খাননি। ডক্টর মালাকার বলেছেন, ক’টা দিন ঠান্ডা নরম জিনিস খেতে—তার সঙ্গে দুধ বা ফলের রস।
তেতো হাসি আঁকা হয়ে গেল বিশ্বনাথের ঠোঁটে। দুধ বা ফলের রস! মালাকার তো আর জানেন না ও-দুটো জিনিসের বন্দোবস্ত করতে গেলে অকর্মণ্য বেকার বুড়ো বাপের জন্য আলোর যা বাজেট সেটা ছাড়িয়ে যাবে!
ডক্টর মালাকার বন্ধুর মতো সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশ্বনাথকে। সাতদিন বিশ্রাম। তারপর ‘এস এ কে’-তে গিয়ে ডক্টর মালাকারের কাছে পোস্ট অপারেশনাল চেক-আপ। এই রুটিন চলবে টানা বত্রিশ দিন। তারপর বিশ্বনাথ নতুন জীবনের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবেন।
যেহেতু অপারেশানটা রিভারসিবল নয় সেহেতু মালাকার বারবার করে বলেছেন, নতুন জীবন নিয়ে কখনও কোনওরকম আক্ষেপ না করতে। এও বলেছেন, ‘…আপনার যা বয়েস তাতে দুঃখ বা আক্ষেপ হলেও খুব বেশিদিন সেটা আপনাকে সইতে হবে না। সবসময় অপটিমিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলবেন, বিশ্বনাথবাবু। ইট উইল বি গুড ফর ইয়োর নিউ লাইফ।’
আলোক আর পারমিতার জীবন ওদের ছন্দে চলছিল। আর বিশ্বনাথ থেকেও-না-থাকার ঢঙে দিন কাটাতে লাগলেন। শুধু অপারেশানের উপসর্গগুলো ওঁকে কষ্ট করে সইতে হচ্ছিল। দাঁতে আর মাড়িতে অসহ্য ব্যথা, কান ভোঁ-ভোঁ করা, মাথা ঘোরা, গলা শুকিয়ে আসা। মালাকার ওঁকে মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। বলেছেন, ‘দরকার মনে করলেই আমাকে ফোন করবেন। আমার ফোন চব্বিশ ঘণ্টা অন থাকে—।’
অপারেশানের সময় স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বনাথের কোনও জ্ঞান ছিল না। তবে অপারেশানের আগে ডক্টর মালাকার সংক্ষেপে সহজে ব্যাপারটা ওঁকে মোটামুটি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।
বিশ্বনাথের ক্যানাইন টুথ বা শ্বদন্ত দুটো আধুনিক কৌশলে রিস্ট্রাকচারড করা হয়েছে। ফলে দাঁত দুটো এখন আরও চোখা হয়েছে। আর ও-দুটোর ভেতরে সূক্ষ্ম চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। ওর লালা গ্রন্থির মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট করা হয়েছে একটা স্পেশাল ভ্যাম্পায়ার সিরাম গ্ল্যান্ড। এ ছাড়া নার্ভাস সিস্টেমটাকেও রিমডেল করে ভাইটালাইজ করা হয়েছে। আর মাসল স্ট্রেংথ অনেক বাড়ানো হয়েছে—সেই সঙ্গে কমানো হয়েছে যন্ত্রণা অনুভবের ক্ষমতা।
ডক্টর মালাকারের ভাষায়, ‘…পুরো ব্যাপারটাই এটা হাই-টেক ইনট্রিকেট কোঅর্ডিনেটেড অপারেশান। গত পাঁচ দশকে বায়োটেকনোলজির ফেনোমেনাল বুম না হলে এই অপারেশানটা শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানের বইয়ে পাওয়া যেত—বিজ্ঞানের বইয়ে নয়।’
বিশ্বনাথ বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অপারেশানের পর আমি তা হলে কী হব? মানুষ, না ভ্যাম্পায়ার?’
‘দুটোই—।’ হেসে বলেছেন মালাকার, ‘ইউ উইল হ্যাভ দ্য বেস্ট অফ বোথ ওয়ার্ল্ডস।’
তারপর তাঁর সে কী মজার হাসি!
হতভম্ব বিশ্বনাথের চোখের সামনে সন্দীপনের মুখটা ভেসে উঠেছিল। সন্দীপন বলেছিলেন, তিনি বেশ মজায় আছেন। কোনও সমস্যা নেই। যেহেতু এই সিক্রেট অপারেশানটা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করাটা স্ট্রিকটলি বারণ, তাই সন্দীপন সব খুলে বলতে পারছেন না। শুধু বিশ্বনাথের দুরবস্থা দেখে বন্ধু হিসেবে মনে কষ্ট পেয়েছেন বলেই পথের নিশানাটুকু জানিয়েছেন।
অপারেশানের সাতদিন পর থেকেই বিশ্বনাথ পরিবর্তনগুলো টের পেতে লাগলেন।
আগে অন্ধকারের সময় কাটাতে খুব একটা পছন্দ করতেন না। কারণ, একরাশ বিষণ্ণতা মনটাকে ঘিরে ফেলত। রেণুকণার সঙ্গে মনে-মনে কথা বলা শুরু করে দিতেন—সেই কথার বেশিরভাগটাই ছিল আক্ষেপের।
কিন্তু এখন ধীরে-ধীরে সব কেমন পালটে যাচ্ছে। অন্ধকারের আকর্ষণ ক্রমশ টের পাচ্ছেন বিশ্বনাথ। সন্ধের পর নিজেদের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে উঠে সময় কাটাতে বেশ লাগে। খুব প্রয়োজন না হলে ঘরের আলো জ্বালেন না। আর সেই অন্ধকারে চোখ মেলে কত না নতুন-নতুন রূপ দেখতে পান বিশ্বনাথ। ওঁর চোখের সামনে জমাট অন্ধকার কেমন সুন্দর-সুন্দর ছবি তৈরি করে। তখন রেণুকণার সঙ্গে কথা বলেন বিশ্বনাথ। আক্ষেপের নয়—আনন্দের কথা। যেমন, আর কিছুদিন পর থেকেই বিশ্বনাথের টাকাপয়সার টানাপোড়েন আর থাকবে না। তখন অনেকটা নিজের মতো করে বাঁচতে পারবেন। রাস্তার হোটেল-রেস্তরাঁয় ইচ্ছেমতো ভালো-মন্দ কিছু খেতে পারবেন। কোনও দুঃস্থ মানুষকে পাঁচটা টাকা ভিক্ষে দিতে পারবেন। কমিউনিটি পার্কে খেলতে আসা ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের লজেন্স বা চকোলেট বিলি করতে পারবেন।
বিশ্বনাথের খুশি-খুশি ভাব দেখে রেণুকথা খুশি হন। নিশ্চিত হন।
ঘ্রাণশক্তিও কি খানিকটা বেড়ে গেছে বিশ্বনাথের? পারমিতার ঠিকে কাজের লোক যখন রান্নাঘরে রান্না করে তখন ঘরে বসেও সে-রান্নার গন্ধ তিনি পান কেমন করে? ভিক্টরের গন্ধও বা মাঝে-মাঝে নাকে আসে কেন?
আগে তো এমন আসত না!
নতুন এই ক্ষমতাগুলোকে বিশ্বনাথ উপভোগ করছিলেন আর বত্রিশ দিন শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ডক্টর মালাকারের রুটিন চেক-আপ চলছিল। প্রতিটি চেক-আপের পর তিনি দিলখোলা ঢঙে হেসে বলেন, ‘ইউ আর হিলিং আপ একসিলেন্টলি। আই অ্যাম রিয়েলি সারপ্রাইজড।’
ডক্টর মালাকার একদিন বললেন, ‘আপনার হিলিং আপ প্রসেস শেষ হয়ে গেলে আমাকে মোবাইলে মাঝে-মাঝে ফোন করবেন। আমি আপনাকে প্রথম ক্লায়েন্ট দেব। আর ভি-স্টিং এর প্রসেসটাও ভালো করে বুঝিয়ে দেব। ও. কে.?
বিশ্বনাথ বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নেড়ে, ‘এস এ কে’ থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
কিন্তু বিশ্বনাথের দাঁত নিয়ে কৌতূহল ছিল। রোজ সকালে ওয়াশ বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজার সময় শ্বদন্ত দুটোকে পরখ করেন। দেখেন তার ওপরের মাড়ির অবস্থাটা। চোয়াল নাড়িয়ে দাঁতে-দাঁতে আলতো করে ঠোকাঠুকি করেন। না, তেমন ব্যথা আর নেই।
শুধু এতেই থামেননি বিশ্বনাথ। লুকিয়ে-লুকিয়ে কামড় দিয়েছেন বিছানার তোশকে। সেটা সে শুধু দাঁতের জোর পরীক্ষার জন্য তা নয়। দাঁত কেমন যেন সুড়সুড় করছিল কামড় দেওয়ার জন্য—কুকুরছানাদের যেমন করে।
অস্বীকার করে লাভ নেই, তোশকে কামড় দিয়ে একটু যেন তৃপ্তিও পেয়েছেন। যদিও জিভে তোশকের স্বাদটা মোটেই ভালো ঠেকেনি।
সেরে ওঠার বেশ কিছুদিন পর প্রথম ক্লায়েন্টের ডাক পেলেন বিশ্বনাথ। ডক্টর মালাকার বিশ্বনাথকে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন ‘এস এ কে’-র স্পেশাল সেল’-এ। ওরাই ক্লায়েন্টদের ফাইল মেনটেইন করে।
স্পেশাল সেল-এর কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে ক্লায়েন্টের ঠিকানায় পৌঁছে গেলেন।
শশিভূষণ দে স্ট্রিটের একটা অন্ধকার বাঁকে দাঁড়িয়ে একটা পুরোনো তিনতলা বাড়ি। বাড়ির একতলায় একটি মলিন মিষ্টির দোকান। তার রং-চটা সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে একমাত্র ভগবানই জানেন। দোকানের ময়লা শো-কেসের বেশিরভাগটাই খালি। যে-ক’টা মিষ্টি চোখে পড়ছে সেগুলো মনে হয় বেশ পুরোনো। দোকানের দেওয়ালে ঝুল-কালির ছোপ। একটি নাদুসনুদুস লোক খালি গায়ে শো-কেসের পিছনে বসে আছে।
এই মিষ্টির দোকানটাই বিশ্বনাথের ল্যান্ডমার্ক। এই দোকানেই ক্লায়েন্ট ব্রতীন সরকারের খোঁজ করতে হবে।
খোঁজ করলেন বিশ্বনাথ। তারপর দোকানের পাশের ছোট্ট একটা দরজা দিয়ে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লেন।
সিঁড়িতে ওঠার আগে বাঁ-দিকে একটা তালিমারা কাঠের দরজা। তাতে নতুন রং করা হয়েছে। দরজার পাল্লায় একচিলতে কম্পিউটার প্রিন্টআউট আঠা দিয়ে সাঁটা। তাতে ব্রতীন সরকার নামটা ছাপা রয়েছে।
দরজায় টোকা মারলেন বিশ্বনাথ। একইসঙ্গে স্পেশাল সেল-এর নির্দেশ মনে পড়ল: ‘ভি-স্ট্রিং-এর কাজটা সারতে আড়াই মিনিট মতো লাগে। কোনও অবস্থাতেই ক্লায়েন্টের সঙ্গে পাঁচমিনিটের বেশি কাটাবেন না। মনে রাখবেন, যে-সার্ভিসটা আমরা ক্লায়েন্টদের প্রোভাইড করছি সেটা অ্যাবসোলিউটলি ইল্লিগাল। সিক্রেট পুলিশ কিংবা সিকিওরিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের হাত থেকে আপনাকে বাঁচতে হবে। আপনি যে-কাজে যাচ্ছেন সেটা একটা কাজ। এখানে পারসোনাল রিলেশানের কোনও জায়গা নেই।’
দরজা খুলে গেল।
দরজায় দাঁড়িয়ে পঁচিশ-ছাব্বিশের ছিপছিপে এক ফরসা যুবক। মাথার চুল কদমছাঁট। দু-গালে কুণ্ডলী পাকানো সাপের উল্কি। বাঁ ভুরুর শেষে একটা ছোট আংটি।
ব্রতীনের চোখ ঢুলুঢুলু। তবে সেটা নেশার জন্য নাও হতে পারে। কারণ, বিশ্বনাথ কোনওরকম গন্ধ পেলেন না।
ওর গায়ে লাল স্যান্ডো গেঞ্জি, আর পরনে সাদা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট—যাকে সবাই থ্রি-কিউ বলে।
‘কী চাই?’ ভারী গলায় প্রশ্ন করল ব্রতীন।
স্পেশাল সেল-এর বলে দেওয়া কোড নম্বরটা বললেন বিশ্বনাথ।
ঠোঁটে হাসল ব্রতীন। ওর চোখের মণি প্রত্যাশায় উজ্জ্বল হল। ঘষা নার্ভাস গলায় বলল, ‘আসুন, ভেতরে আসুন—।’
পাশের কোনও ঘর থেকে কড়াইয়ে ফোড়ন দেওয়ার ‘ছ্যাঁক’ শব্দ পেলেন বিশ্বনাথ। ওঁর বুকের ভেতরটাও কেমন যেন ‘ছ্যাঁক’ করে উঠল। সামনেই প্রথম পরীক্ষা। বিশ্বনাথ ঠিকঠাক পারবেন তো?
রান্নার গন্ধ নাকে গিয়ে ব্রতীনের ঘরে ঢুকলেন।
ছোট্ট অগোছালো ঘর। চারপাশে কড়া সিগারেটের গন্ধ। রঙিন জামা-প্যান্ট এখানে-সেখানে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। একটা ছোট্ট টেবিল বইপত্রে পাহাড় হয়ে রয়েছে। খাট বিছানা প্রায় লন্ডভন্ড। তার ওপরে সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, তিনটে রঙিন সলিউবল প্লাস্টিকের প্যাকেট আর বেশ কয়েকটা একশো টাকার নোট এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে। একদিকের দেওয়ালে দড়িতে একরাশ জামাকাপড় ঝুলছে। তার পাশেই মাঝারি মাপের একটা শৌখিন আয়না।
ব্রতীন ঘরের মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়েছিল। বোধহয় ওরও এটা প্রথমবার।
বিশ্বনাথ কাঁপা হাতে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে খিল এঁটে দিলেন। তারপর ব্রতীনের দিকে হাত বাড়ালেন: ‘টাকাটা?’
বাইটের ফি-টা আগে চেয়ে নেওয়াটাও নিয়মের মধ্যেই পড়ে। স্পেশাল সেল থেকে এটা বিশ্বনাথকে বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে।
ব্রতীন বিছানার ওপরে হুমড়ি খেয়ে খামচে-খামচে একশো টাকার নোটগুলো তুলে নিল। কাঁপা হাতে খসখস শব্দ করে গুনে নিল। তারপর বিশ্বনাথের দিকে এগিয়ে দিল: ‘ওয়ান থাউজ্যান্ড…।’
বিশ্বনাথ টাকাটা গুনে পকেটে রাখলেন। টাকাটা নেওয়ার সময় ওঁর কানদুটো কেমন গরম হয়ে উঠল। মনে হল যেন, পৃথিবীর আদিম ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। টাকার বিনিময়ে খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করা।
‘কনভার্টেড ভ্যাম্পায়াররা এরকম এজেড হয় নাকি?’ ব্রতীন নার্ভাসভাবে জিগ্যেস করল।
বিশ্বনাথ ওর দিকে তাকাতেই খেয়াল করলেন, ব্রতীন ওঁকে খুঁটিয়ে দেখছে।
বিশ্বনাথ ধীরে-ধীরে নার্ভাস ভাবটা কাটিয়ে উঠছিলেন। নিজেকে বুড়ো ভাবতে এখনও রাজি নন। তাই ব্রতীনের কথার ‘এজেড’ শব্দটা ওঁকে একটু খোঁচা দিয়েছিল।
‘তা আপনি কি পঁচিশ-ছাব্বিশের টগবগে ইয়াং লেডিকে আশা করেছিলেন নাকি?’
ব্রতীন এই পালটা প্রশ্নে মোটেই আহত হল না। বরং সরলভাবে বলল, ‘না, আমি তো ঠিক জানি না…মানে, আগে কখনও বাইট নিইনি…তাই। আপনি কিছু মাইন্ড করবেন না, প্লিজ…।’
ছেলেটার কথায় বিশ্বনাথের কেমন যেন মায়া হল। বুঝতে পারলেন, এটাই ওর ভার্জিন বাইট। বিশ্বনাথের আরও কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বললেন না। স্পেশাল সেল-এর নির্দেশ মনে পড়ল: ‘ক্লায়েন্টদের সঙ্গে প্রফেশন্যাল প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও নয়। ডোন্ট ওয়েস্ট আ সিঙ্গল মোমেন্ট। ইট ইজ অ্যান ইমপরট্যান্ট সেফটি রুল…।’
বিশ্বনাথ চোখ থেকে চশমাটা খুলে পকেটে ভরে নিলেন। তারপর ব্রতীনের কাছে এগিয়ে গেলেন।
টের পেলেন ঘামতে শুরু করেছেন। বুকের ভেতরে হাপর চলছে। রেণুকণার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। এরকমই হাপর চলেছিল ওকে প্রথম জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার সময়।
ব্রতীন ঠিক বুঝতে পারছিল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কী ওর করার আছে। ওর চোখের নজরে কেমন যেন একটা হতবুদ্ধি ভাব ছায়া ফেলছে। একজন কিশোরীর মতো অস্বস্তি নিয়ে ও ভার্জিন বাইটের জন্য অপেক্ষা করছিল।
ব্রতীন মাথাটা ডানদিকে সামান্য হেলিয়ে দিল। বিশ্বনাথ ওর কণ্ঠার হাড় দেখতে পেলেন। বাঁ কানের লতির ইঞ্চিতিনেক নীচে ফরসা কোমল জায়গাটায় মনোযোগ দিয়ে তাকালেন। এইরকম জায়গায় ঠোঁট রেখে রেণুকণাকে আদর করেছেন অসংখ্যবার। কখনও-কখনও মৃদু দংশনও করেছেন।
আজ রেণুকণার বদলে একজন পুরুষ। আর দংশনও বিষাক্ত।
আর দেরি করলেন না বিশ্বনাথ। ব্রতীনের দু-কাঁধে হাতের ভর রেখে মুখ নীচু করলেন। ঠোঁট ছোঁয়ালেন ঘাড় আর কাঁধের জোড়ের কাছটায়। তারপর ঠোঁট ফাঁক করে শ্বদন্ত উঁচিয়ে ধরলেন।
ঠিক তখনই আড়চোখে আয়নাটার দিকে কেন তাকিয়েছিলেন কে জানে! সেখানে দেখা গেল একজন সুঠাম প্রৌঢ়ের মুখ। হাঁ করার ফলে মুখের চারপাশে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। বাঁ-গালে একটা ছোট তিল।
সবই ঠিক ছিল—শুধু একটা জায়গায় বিশ্বনাথ ধাক্কা খেলেন। আয়নার প্রৌঢ়ের চোখে তৃষ্ণা মেটানোর আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।
বিশ্বনাথ আর ভাবতে চাইলেন না। ওঁর নাকে ব্রতীনের ঘামের গন্ধ আসছিল। সেই গন্ধটাই কোন অজানা কৌশলে ফেরোমোনের কাজ করছিল যেন। বিশ্বনাথকে টানছিল।
আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। দাঁত বসালেন।
ছোট্ট করে ‘আঃ’! শব্দ করল ব্রতীন। যন্ত্রণা আর আমেজে ওর চোখ বুজে গেল।
ভালো করে কামড় দিলেন বিশ্বনাথ। বুঝতে পারলেন, ভ্যাম্পয়ার সিরাম গ্ল্যান্ডে চাপ পড়ছে। একইসঙ্গে টের পেলেন, কামড়টা তোশকের তুলনায় অনেক—অনেক ভালো লাগছে। একটা উত্তেজনার ঢেউও যেন খেলা করছে বিশ্বনাথের শরীরে।
ব্রতীনকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরলেন। দুটো পুরুষ-শরীর ক্রমে জট পাকিয়ে যেতে লাগল। কেউ দেখলে ভাববে, সমকামী টানে শঙ্খ লাগা দুটো মানুষ।
আবার কামড় বসালেন বিশ্বনাথ। তারপর আবার।
স্পেশাল সেল-এর এটাই নিয়ম। মোট তিনবার। বোধহয় নেশাটাকে সুনিশ্চিত করার জন্য।
দ্বিতীয় কামড়ের পরেই রক্তের নোনা স্বাদ পেলেন। এই স্বাদটা যতটা জঘন্য লাগার কথা ততটা লাগল না। বরং ব্রতীনের ঘাড় থেকে মুখ তোলার পর দাঁতে এবং ঠোঁটে লেগে থাকা রক্ত জিভ দিয়ে দিব্যি চেটেপুটে মুছে নিলেন।
বিশ্বনাথের হাতের বাঁধনে ব্রতীন এলিয়ে পড়েছিল। বিশ্বনাথ অনায়াসে ওর শরীরটা তুলে নিয়ে বিছানায় ঢেলে দিলেন। পকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে দিলেন। তারপর সঙ্গে তার নিয়ে আসা স্টিকিং প্লাস্টার এঁটে দিলেন ব্রতীনের ক্ষতচিহ্নের ওপরে।
শরীরটা একটু দুর্বল লাগছিল। মাথাটাও যেন ঝিমঝিম করছিল খানিকটা। এগুলো বাইটের আফটার এফেক্ট। স্পেশাল সেল তাই বলেছিল।
নিজেকে সামলাতে দশ কি পনেরো সেকেন্ড সময় নিলেন। বিছানায় শিশুর মতো অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা ব্রতীনের দিকে একবার তাকালেন। ঘুমন্ত ছেলেটার মুখ দিয়ে তৃপ্তির একটা ‘উঁ-উঁ’ শব্দ বেরিয়ে আসছে।
বিশ্বনাথ হঠাৎই অবাক হলেন। গায়ের শক্তি কি বেড়ে গেছে? নইলে ব্রতীনকে এত সহজে পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলেন কীভাবে? ডক্টর মালাকার তো গায়ের জোর বেড়ে যাওয়া নিয়ে কোনও কথা বলেননি! তা হলে কি এটা হিসেবের বাইরের কোনও ঘটনা? সি. ভি. অপারেশানের পর যে-যে পরিবর্তনগুলো হওয়ার কথা তার বাইরেও কি কিছু-কিছু হয়ে যায়? ব্যাপারটা কি চান্স ফ্যাক্টর, না হিউম্যান ফ্যাক্টর?
বিশ্বনাথ আর সময় নষ্ট করলেন না। চুপিসারে ব্রতীনের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজাটা আলতো করে টেনে ভেজিয়ে দিলেন। তারপর চলে এলেন রাস্তায়।
ওঁর প্রথম বাইটের অ্যাডভেঞ্চার বেশ নিশ্চিন্তেই শেষ হল বলা যায়। তাই বাড়ি ফেরার পথে বিশ্বনাথ হালকা মনে রেণুকণার সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ারকিতে মেতে উঠলেন। শুধু ওঁর মুখের ভেতরে একটা আঁশটে গন্ধ লেগে ছিল। গন্ধটা বিশ্বনাথের খুব একটা খারাপ লাগছিল না।
তিতলির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা বিশ্বনাথের জীবনে একটা অলৌকিক ঘটনা। আর দেখা হলও এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। চৌরঙ্গি এলাকার বারগুলো তখন সবে সন্ধে শুরু করেছে। প্রতিটি বারের বাইরে লাল-নীল-সবুজ নিওন সাইন। তার পাশেই হলোগ্রাম ছবিতে প্রায়-নগ্ন ক্যাবারে নাচের বিজ্ঞাপন। হলোগ্রাম-নর্তকী সুরের ঝংকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীরের নানান প্রত্যঙ্গ নাচিয়ে চলেছে। আলো আর সুরের মেলা জাঁকিয়ে বসেছে রাস্তাটায়।
বিশ্বনাথ আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। চারপাশের প্রাপ্তবয়স্ক জগৎ দেখছিলেন।
বারগুলোর বাইরে মানুষজনের জটলা। কেউ হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে। কেউ চাপা গলায় বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে, কেউ-বা ঢলানি সঙ্গিনীর কোমর জড়িয়ে ধরে অসভ্যতায় মেতেছে।
আনমনা হাঁটতে-হাঁটতে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামটা সবে ছাড়িয়েছেন, হঠাৎই দেখলেন একটা গাড়ি ছুটে এসে একটা গাড়ির গায়ে রুক্ষভাবে ধাক্কা মারল। ধাতু আর প্লাস্টিক ভেঙে পড়ার শব্দ হল। তারপর চেঁচামেচি।
জায়গাটায় আলো বেশি ছিল না। কিন্তু বিশ্বনাথের দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতাটা ওঁর দিনকেদিন জোরালো হয়েছে। চশমা ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন সপ্তাহদুয়েক আগেই। আলোক আর পারমিতা এতে অবাক হলেও কোনও মন্তব্য করেনি।
বিশ্বনাথ দেখলেন, প্রথম গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে চট করে রাস্তায় বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। তারপর পাশের একটি সরু রাস্তা ধরে প্রাণপণে ছুট লাগাল।
পিছনের গাড়ির দরজা খোলা-বন্ধের শব্দ হল। তিনটি লোক নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। নেমেই ধাওয়া করেছে ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে পালানো মেয়েটিকে।
বিশ্বনাথের ভেতরে একটা ভ্যাম্পায়ার জেগে উঠল। তিনি ছুটলেন লোকগুলোর পিছনে।
শরীরের এই জোর কোথা থেকে পেলেন সে-প্রশ্নের উত্তর দিকে পারেননি মালাকার। শুধু বলেছেন, ‘দেখুন, এটাকে আমরা বলি এক্স-ফ্যাক্টর। হিউম্যান ফ্যাক্টর, চান্স ফ্যাক্টর, আননোন ফ্যাক্টর—এইসব মিলেমিশেই এক্স-ফ্যাক্টর তৈরি। তবে এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই—শুধু বলব, এনজয় ইয়োর নিউ লাইফ, বাট প্লে ইট সেফ। বুঝতেই তো পারছেন…।’
এখন সেই এক্স-ফ্যাক্টর নিয়েই ছুটছিলেন বিশ্বনাথ।
রাস্তার দুপাশে পুরোনো আমলের বড়-বড় বাড়ি। তার সীমানায় বিশাল-বিশাল অন্ধকার গাছ। গাছের অচেনা ফুলের গন্ধ বিশ্বনাথের নাকে আসছিল।
রাস্তা নির্জন বলে ছুটন্ত পায়ের শব্দ দিব্যি শুনতে পাচ্ছিলেন। এ ছাড়া আরও শব্দ কানে আসছিল। কুকুরের ঘেউঘেউ, গাছের পাতার খসখস, রাতপোকার ডাক। অপারেশানের পর থেকে এরকম কত সূক্ষ্ম শব্দই যে শুনতে পান!
সত্যি, এই জীবনটা একদম নতুন—মানে, নতুন ধরনের।
গত দু-মাসে বেশ কয়েকজন ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট করেছেন বিশ্বনাথ। তাই হাতে টাকাও এসেছে ভালোই। আর যতই টাকা এসেছে বিশ্বনাথের স্বাধীনচেতা মন ততই মাথাচাড়া দিয়েছে। আলোক আর পারমিতার শাসন থেকে অল্প-অল্প করে বেরিয়ে এসেছেন বাইরে।
এখন খুশিমতন বাইরে বেরোন, পছন্দসই খাবার মাঝে-মধ্যে কিনে খান, হলে গিয়ে সিনেমাও দেখে ফেলেন টুকটাক।
আলোক বা পারমিতার বেশিরভাগ অভিযোগেরই কোনও উত্তর দেন না। এক কান দিয়ে ঢোকান, অন্য কান দিয়ে বের করে দেন। আর ভিক্টরকে একটু সামলে চলেন। কারণ, এখন ওঁকে দেখলেই ভিক্টর কেমন যেন লোম খাড়া করে চাপা গরগর শব্দ করতে থাকে। ঠোঁট পিছনে টেনে ধারালো দাঁতের পাটি হিংস্রভাবে মেলে ধরে।
যত যা-ই হোক, নতুন জীবনটার মধ্যে যে একটা রোমাঞ্চ আছে সেটা বিশ্বনাথ স্বীকার করেন।
এখন, অন্ধকার রাস্তা ধরে ছুটে যেতে-যেতে, সেই রোমাঞ্চটাই টের পাচ্ছিলেন।
একটু পরেই রাস্তাটা একটা গলির মুখে এসে পড়ল। আর তখনই লোক তিনটে মেয়েটাকে ধরে ফেলল।
মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। রাস্তার আলোয় ওর ভয় পাওয়া ফরসা মুখ ঝলসে উঠল।
বিশ্বনাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বড়-বড় শ্বাস নিতে লাগলেন।
এতক্ষণ একটা ঝোঁকের মাথায় ছুটে এসেছেন। বয়েসটার কথা ভাবেননি। এখন যেন হঠাৎই খেয়াল হল, ওরা তিনজন, আর বিশ্বনাথ একা।
লোক তিনটে তখন মেয়েটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আর মেয়েটা প্রতিবাদ আর যন্ত্রণার চিৎকার করে উঠছিল বারবার।
রেণুকণা যে পাশেই ছিলেন বিশ্বনাথ টের পাননি। হঠাৎই শুনলেন ওঁর চাপা ফিসফিসে গলা: ‘কী হল, যাও—মেয়েটাকে বাঁচাও…।’
‘ওরা তিনজন—আর আমি একা…।’ কাতর গলায় মিনমিন করে বললেন বিশ্বনাথ।
খিলখিল করে হাসলেন রেণুকণা: ‘আরে পাগল! ওরা মানুষ—আর তুমি ভ্যাম্পায়ার! এই নতুন জীবনটাকে ভালো কাজে লাগানোর চেষ্টা করো। যাও!’
এই আদেশের পর আর কোনও কথা চলে না।
বিশ্বনাথ চোখের পলকে ছুটে চলে গেলেন জটলার কাছে। সামনে যে-লোকটাকে পেলেন তার হাত ধরে এক টান মারলেন।
লোকটা বিরক্ত হয়ে বিশ্বনাথের দিকে ঘুরে তাকাল। এবং বিশ্বনাথের চেহারা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
কোন আক্কেলে এই বুড়োটা এই সংঘর্ষে নাক গলাচ্ছে?
বিশ্বনাথের বুকে সজোরে ধাক্কা দিল লোকটা। কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলে উঠল, ‘আবে সুড্ডা লাল্লু, ফাট। সালা রাস্তা মাপ—নইলে দোকানের ঝাঁপ খুলে দেব।’
কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা একটা ছুরি বের করে ফেলেছে লোকটা।
রাস্তার আলোয় ওকে ভালো করে দেখলেন বিশ্বনাথ।
এমনিতে ভদ্রলোকের মতো চেহারা, তবে কুতকুতে চোখে শয়তানির ছাপ রয়েছে। চোয়াল চওড়া, কাঠের মতো শক্ত। মুখ থেকে অশ্রাব্য গালিগালাজ আর মদের গন্ধ বেরোচ্ছে।
বোঝাই যাচ্ছিল, এসব কাজে লোকটা পুরোনো পাপী।
মেয়েটা বাকি দুজনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছিল আর ‘ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!’ বলে চিৎকার করছিল। দুজনের একজন পিছন থেকে মেয়েটাকে কষে জাপটে ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে আসছিল।
অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু বিশ্বনাথের নজরে পড়েছিল। এও খেয়াল করেছিলেন, এত হইচই সত্ত্বেও কোনও লোক অকুস্থলে এসে হাজির হয়নি। বরং দু-একজন রাতচরা মানুষ যা চোখে পড়ছিল তারা চলার গতি বাড়িয়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছিল।
প্রথম লোকটা বিশ্বনাথকে লক্ষ্য করে ছুরিসমেত হাত চালাল। ছুরির ধারালো ডগাটা বিশ্বনাথের বুক ছুঁয়ে গেল।
গায়ের জামাটা চিরে গেল কিনা বিশ্বনাথ বুঝতে পারলেন না, তবে একটা জ্বালা টের পেলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। সামনে গলা বাড়িয়ে লোকটার ছুরি ধরা হাতে ভয়ংকর এক কামড় বসালেন। বাইটের নিয়ম মতো একটা কামড় বড়জোর পাঁচ সেকেন্ড। কিন্তু এখন বিশ্বনাথ নিয়ম-টিয়ম সব ভুলে গেলেন। কচ্ছপের কামড়ের মতো চোয়াল চেপে রইলেন—যেন মেঘ না ডাকলে ছাড়বেন না।
লোকটা কিছুক্ষণ ঝটপট করল। কামড় ছাড়ানোর জন্য হাতটা একবার ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
তারপরই লোকটা ফুটপাথের ওপরে খসে পড়ল। যন্ত্রণার চেঁচাচ্ছিল, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে-চিৎকার জড়িয়ে গিয়ে আলতো হয়ে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল।
বিশ্বনাথ অদ্ভুত ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওকে ছেড়ে দাও!’
বাকি দুজনের মধ্যে যার হাতে কাজ কম ছিল সে একটা ছোট টর্চ বের করে বিশ্বনাথকে তাক করে বোতাম টিপল।
আসলে লোকটা বোতাম টিপেছিল কৌতূহল আর বিস্ময়ে। কারণ, আধো-আঁধারিতে বিশ্বনাথকে দেখে ওর কমজোরি প্রৌঢ় বলেই মনে হয়েছিল। তার সঙ্গে মোকাবিলায় সঙ্গীর এই হাল লোকটা মানতে পারছিল না।
কিন্তু টর্চের আলো বিশ্বনাথের মুখের ওপরে পড়তেই পলকে সবকিছু মেনে নিল।
বিশ্বনাথের ঠোঁটের কোণ থেকে রক্তের রেখা গড়িয়ে নেমে এসেছে থুতনির দিকে। বুকের কাছে জামাটা রক্তে ভেজা। মানুষটার চোখে অমানুষিক দৃষ্টি। আর ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে থাকায় রক্ত মাখা দাঁত দেখা যাচ্ছে, সেইসঙ্গে জিভেরও খানিকটা।
ফুটপাথে পড়ে থাকা সঙ্গীর দিকে ঘুরে গেল টর্চের আলো। আর সেই মুহূর্তে বিশ্বনাথ ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রাণের মায়া ভুলে।
ওই যে মাথার ভেতরে রেণুকণা বলছিলেন, ‘…নতুন জীবনটাকে ভালো কাজে লাগানোর চেষ্টা করো…।’
ভয় পাওয়া লোকটা হাত বাড়িয়ে আক্রমণটা ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল। বিশ্বনাথ পাগলের মতো ওর ডানহাতের কড়ে আঙুলটা কামড়ে ধরলেন। দু-হাতে আঁকড়ে ধরলেন শত্রুর ডানহাত। এবং এক ঝটকায় হাতটাকে বেঁকিয়ে দিলেন অন্যদিকে।
‘মটাস’ শব্দ হল একটা। বিশ্বনাথ আঙুল ভাঙার শব্দ আগে কখনও শোনেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা।
এবার লোকটার চিৎকারের পালা।
ওর হাত থেকে টর্চ ছিটকে পড়ল। সাঁড়াশি দিয়ে গলা চেপে ধরা শুয়োরের মতো বীভৎস আর্তনাদ করে উঠল। ছুটও লাগাল একইসঙ্গে।
নিজের অজান্তেই বিশ্বনাথ দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে গেলেন সামনের দিকে। তিননম্বর লোকটা বুঝল গল্প শেষ। তাই একটুও দেরি না করে মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে পালাল।
বিশ্বনাথ বাঁ-হাতের পিঠ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে নিলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁপাতে লাগলেন। লজ্জায় গ্লানিতে একেবারে মরে যাচ্ছিলেন। পাগলের মতো এসব কী করলেন তিনি? ওই তো লোকটা পড়ে রয়েছে ফুটপাতে! বেঁচে আছে, না মরে গেছে? যদি সিক্রেট পুলিশ দেখে ফেলে এখন!
বিশ্বনাথ কী এক লজ্জায় মেয়েটার দিকে তাকাতে পারছিলেন না। বোকার মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠান্ডা বাতাস ওঁকে ঘিরে খেলা করতে লাগল। বাতাস বলছিল, ‘শীত আসছে। বিশ্বনাথের গা শিরশির করছিল। একইসঙ্গে হালকা মদের গন্ধ নাকে আসছিল। বুঝলেন, মেয়েটা নেশা করেছে।
‘শিগগির পালিয়ে চলুন! পুলিশ দেখতে পেলে কেলেঙ্কারি হবে।’
মেয়েটার কথায় বিশ্বনাথ যেন জেগে উঠলেন। মেয়েটা ওঁর হাত ধরে টান মারল: ‘শিগগির ছুট লাগান! এদিকে—।’
অন্ধকার রাস্তা ধরে দৌড়তে শুরু করল মেয়েটি। আর ওর পিছন-পিছন বিশ্বনাথ।
একটু পরেই ওরা বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল।
মেয়েটার গাড়িটা জায়গামতো দাঁড়িয়ে। তবে যে-গাড়িটা ওঁকে ধাক্কা মেরেছিল সেটাকে দেখা গেল না।
ঝটপট গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল মেয়েটি। উলটোদিকের দরজাটা খুলে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকল বিশ্বনাথকে: ‘কুইক!’
বিশ্বনাথ সিটে বসে দরজা বন্ধ করেছেন কি করেননি এক হ্যাঁচকায় গাড়িটা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। তারপর ফাঁকা রাস্তা ধরে বিপজ্জনক গতিতে ছুটে চলল।
রাস্তার দিকে চোখ রেখেই মেয়েটি বলল, ‘থ্যাংকস ফর সেভিং মাই লাইফ।’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তারপর: ‘আমার নাম তিতলি। আপনার?’
‘বিশ্বনাথ। আপনাকে ওরা অ্যাটাক করেছিল কেন?’
‘সে অনেক ব্যাপার—পরে কখনও বলব।’ হঠাৎ বিশ্বনাথের জামার দিকে নজর গেল তিতলির: ‘আরে! আপনার জামাটা তো রক্তে ভিজে গেছে! শিগগির নার্সিংহোমে চলুন—একটা ব্যান্ডেজ-ফ্যান্ডেজ বেঁধে না দিলে…।’
বিশ্বনাথ সামান্য কাত হয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। রুমালটা বাঁ-হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। চাপা শান্ত গলায় বললেন, ‘না, না, সেরকম কিছু হয়নি। জাস্ট একটু চিরে গেছে।’
কাটা জায়গাটা এখন বেশ চিড়বিড়-চিড়বিড় করছিল। ছুরিটা ধারালো হওয়ায় প্রথমটা কিছু টের পাননি। তবে জ্বালাটা সহ্য করতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিল না। পুরোনো জীবন হলে এই জ্বালাই হয়তো অসহ্য ঠেকত। তা ছাড়া বিশ্বনাথ জানেন, এই কাটা-ছেঁড়া নিয়ে নার্সিংহোমে যাওয়া মানেই সিক্রেট পুলিশকে নেমন্তন্ন করা।
‘শিয়োর আপনার কষ্ট হচ্ছে না?’ তিতলি উদ্বেগের গলায় জানতে চাইল আবার।
‘উঁহু। একদম না…।’
তিতলি সন্দেহের চোখে কয়েক পলক বিশ্বনাথের দিকে চেয়ে রইল।
তিতলির ফরসা মুখের ওপরে রাস্তার আলো পড়ছিল, সরে যাচ্ছিল। বিশ্বনাথ ওকে খুঁটিয়ে দেখলেন।
বয়সে কুড়ি কি বাইশ। গোল টলটলে মুখ। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত—মাথা নাড়লেই এপাশ-ওপাশ নড়ছে। চুলের একটা পাশ বোধহয় সোনালি রং করা।
তিতলির গলায় ফ্লুওরেসেন্ট পুঁতির মালা—আধো-আঁধারিতে লাল-নীল-সবুজ রং জ্বলছে। কানে একই ধরনের দুল। গায়ে কালো পোশাক। কবজিতে প্লাটিনামের ব্রেসলেট আর ঘড়ি। ডানহাতের আঙুলে পাশাপাশি একইরকম দুটো আংটি।
উইন্ডশিল্ডের সামনের তাকে রাখা ছিল একটা পারফিউমের শিশি। সেটা বাঁ-হাতে তুলে নিল তিতলি। ‘শ-শ-শ’ শব্দ করে নিজের গায়ে পারফিউম স্প্রে করল। তারপর সামনের রাস্তার দিকে আড়াচোখে নজর রেখে দেখল বিশ্বনাথের দিকে: ‘পারফিউম নেবেন?’
বিশ্বনাথ হকচকিয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না—না।’ পারফিউমের কড়া গন্ধে বিশ্বনাথের অস্বস্তি হচ্ছিল।
‘ওইরকম তিনটে ইয়াংম্যানের সঙ্গে এরকম ম্যাজিকের মতো লড়ে গেলেন কেমন করে?’
ওর কথাতেই জবাব দিলেন বিশ্বনাথ, ‘সে অনেক ব্যাপার—পরে কখনও বলব।’
পারফিউমের শিশিটা তাকে ফিরিয়ে দিল তিতলি: ‘চমৎকার। আমার কথায় আমাকেই দিলেন!’
‘আমার দেওয়ার মতো কিছু নেই—।’
‘তা হলে কি শুধু নেওয়া বাকি?’
‘সেটাই বা পারছি কই?’
হেসে ফেলল, তিতলি: ‘আপনার কথাবার্তা বেশ ইন্টারেস্টিং। আপনার সঙ্গে আমার জমবে।’
বিশ্বনাথ ওর কথা বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
‘আপনি কি ভি-স্টিং প্রোভাইডার?’ আচমকা প্রশ্ন করল তিতলি।
‘হ্যাঁ—, এক সেকেন্ড সময় নিয়ে স্পষ্ট জবাব দিলেন বিশ্বনাথ। মেয়েটা তা হলে লড়াইয়ের সময় বিশ্বনাথকে ভালোভাবেই লক্ষ করেছে।
‘আমি আগে কখনও কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার দেখিনি। আমার এক বন্ধু বাইট নেয়—আমি কখনও নিইনি। একবার চেখে দেখলে হয়!’
‘নেশা করা খারাপ…।’
‘এটা কি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ?’ ব্যঙ্গের সুরে কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল তিতলি।
একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘নেশা করা খারাপ তো সো হোয়াট? আমার এই লাইফটাও তো খারাপ। যদিও তার জন্যে কোনও স্ট্যাটিউটরি ওয়ার্নিং দেওয়া ছিল না…।’
মেয়েটার লাইফটা খারাপ?
বিশ্বনাথ নিজের জীবনের কথা ভাবলেন—রেণুকণা চলে যাওয়ার পরের জীবনের কথা। সেটাকে মোটেই ভালো বলা যায় না। বরং ডক্টর মালাকারের দেওয়া এই নতুন জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে খারাপ লাগছে না।
‘আপনাকে কোথায় নামাব?’
‘যেখানে খুশি। তবে থাকি শ্যামবাজারে—নিউ টাউন, ফেস ফোর-এ।’
ব্রেকে চাপ দিল তিতলি, গাড়ির মুখ ঘোরাল: ‘চলুন, শ্যামবাজারেই আপনাকে নামিয়ে দিই। আমার হাতে কোনও কাজ নেই…।’
‘থ্যাংকস।’
‘আশ্চর্য।’ ভুরু উঁচিয়ে তাকাল: আপনি আমার জীবনদাতা—আর বলছেন ”থ্যাংকস”!’
‘অভ্যেস সহজে মরতে চায় না।’ বুকের জ্বালাটা হঠাৎ খোঁচা দিল। বিশ্বনাথ যন্ত্রণায় চোখ বুজলেন একবার।
‘আমি কোথায় থাকি জিগ্যেস করলেন না তো?’
‘আমার বয়েস বাষট্টি। ছাব্বিশ হলে জিগ্যেস করতাম—।’
খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল তিতলি। সে-হাসি আর থামতেই চায় না।
বিশ্বনাথ চুপ করে ওকে দেখতে লাগলেন।
‘ওঃ, আপনি তো দারুণ কথা বলেন! বাষট্টি উলটো ছাব্বিশ…’ হাসির দমকে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল তিতলি, ‘এনিওয়ে, আমি থাকি লালা লাজপত রায় সরণিতে। আর আমার বয়েস বাইশ—ওলটালেও একই থাকে।’
‘এত রাতে চৌরঙ্গিতে কী করছিলেন?’ কৌতূহল বিশ্বনাথকে কাঁটা ফোটাচ্ছিল।
‘সেসব কথা পরে হবে—’ মাথা ঝাঁকিয়ে চুল ওড়াল তিতলি: ‘দিন, আপনার ফোন নাম্বার দিন।’
‘আমার পারসোনাল কোনও ফোন নেই।’
তিতলি এক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকাল বিশ্বনাথের দিকে। তারপর সহজভাবে বলল, ‘তা হলে আমার মোবাইল নম্বরটা লিখে নিন—।’
বিশ্বনাথের কাছে কাগজ-পেন ছিল না। তাই রাস্তার ধারে গাড়ি সাইড করল তিতলি। গাড়ির গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট থেকে পেন আর কাগজ বের করে রাস্তার আলোতেই ফোন নম্বর লিখে দিল।
কাগজের টুকরোটা বিশ্বনাথের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘ফোন করবেন কিন্তু।’
বিশ্বনাথ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন।
‘প্রমিস?’ বিশ্বনাথের ডানহাতের পাতাটা নিজের মুঠোয় নিয়ে আন্তরিকভাবে জানতে চাইল।
বিশ্বনাথ অদ্ভুত মেয়েটার চোখে তাকালেন। বললেন, ‘গড প্রমিস।’
আবার গাড়ি ছোটাল তিতলি।
গাড়ির গতি আর দুরন্ত বাঁক নেওয়ার মধ্যে একটা খুশির ছাপ খুঁজে পেলেন বিশ্বনাথ। বুকের জ্বালাটা তখন আর টের পাচ্ছিলেন না।
বেশ মনে আছে, ব্রতীনকে সার্ভিস দিয়ে আসার পর রাতে ভালো করে দাঁত মেজেছিলেন। সেদিন রাতে কিছু খেতে ইচ্ছে করেনি। আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। তারপর রেণুকণার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছিলেন।
‘আমি আজ যা করে এলাম সেটা কি পাপ?’
‘কে বলেছে পাপ! হঠাৎ এসব আজেবাজে কথা তোমার মনে হচ্ছে কেন?’
‘না…মানে…একটা অল্পবয়েসি ছেলেকে নতুন একটা নেশায় নামিয়ে দিলাম…।’
‘তুমি না গেলে, ”শটস অ্যান্ড কিকস” অন্য কোনও সি. ভি.-কে পাঠাত। তাছাড়া ব্রতীন তো আর মরে যায়নি। বরং কিছুটা আনন্দ পেয়েছে।’
শেষ পর্যন্ত বিশ্বনাথ রেণুকণার যুক্তির কাছে হেরে গেছেন।
কিন্তু আজ? আজ কী বলবেন রেণু?
আজ রাতে বাড়িতে এসে কলিংবেল বাজাতেই আলোক বিরক্তভাবে দরজা খুলে দিল।
‘কী যে তোমার একটা বাজে অভ্যেস হয়েছে! নিশাচর প্রাণীর মতো রাত করে বাড়ি ফেরা!’ তারপরই রক্তে ভেজা শার্টটা চোখে পড়ল ওরঃ ‘কী ব্যাপার? রক্ত কিসের?’
বিশ্বনাথ শুধু ছোট্ট করে বললেন, ‘গুণ্ডারা অ্যাটাক করেছিল—।’
‘চমৎকার!’ আলোক ঠোঁটের কোণ দিয়ে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে শূন্যে হাত নাড়ল: ‘এখন সিক্রেট পুলিশের ঝুটঝামেলা সামলাবে কে?’
‘কোনও ঝুটঝামেলা হবে না…।’ নীচু গলায় কথাটা বলে ছেলের কাছ থেকে সরে গেলেন বিশ্বনাথ। তিতলির মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল। অপলকে সেটাই দেখছিলেন।
আশ্চর্য! যার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক, বিশ্বনাথের আঘাত নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই তার—বরং পুলিশি ঝামেলার ভয়ে সে অনেক বেশি ব্যতিব্যস্ত।
আর যাকে তিনি চেনেন না জানেন না সে বলেছিল, ‘…শিগগির নার্সিহোমে চলুন…।’
একদলা থুতু এসে গেল মুখের ভেতরে। নিজের ঘরের দিকে যেতে-যেতে আড়চোখে দেখলেন পারমিতা ওদের শোওয়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে ঘেন্না এবং বিরক্তি।
নিজের ঘরে ঢোকার পর নতুন জীবনের অলৌকিক শ্রবণক্ষমতায় শুনতে পেলেন পারমিতার কথা, ‘বুড়োটা দেখছি লায়েক হয়ে গেছে!’
জামা-টামা খুলে কাটা জায়গাটা ভালো করে পরখ করলেন। না, বিশেষ কিছু হয়নি—ইঞ্চিচারেক সামান্য চিরে গেছে। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে গেছে। তবে চিড়চিড়ে জ্বালাটা এখনও আছে।
তুলো দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করলেন বিশ্বনাথ। তারপর অ্যান্টিসেপটিক হিলার স্প্রে করে দিলেন। জ্বালাটা বেশ কমে গেল।
রাতে অন্ধকার বিছানায় শুয়ে আবার রেণুকণার সঙ্গে কথা-যুদ্ধ।
ব্রতীনের বেলায়—যা ব্রতীনের মতো আরও অনেক ক্লায়েন্টের বেলায়—রেণুকণার যুক্তির কাছে কাবু হয়ে গেছেন বিশ্বনাথ।
কিন্তু আজ?
রেণুকণা বরাবর শান্ত, বুদ্ধিমতী। মৃত্যুর আগেও—পরেও। আজ বিশ্বনাথকে সুন্দর ঠান্ডা যুক্তি শোনালেন রেণুকণা।
একটা বাইশ বছরের মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে বিশ্বনাথ যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। তা ছাড়া ফুটপাথে পড়ে যাওয়ার লোকটা যে মরে গেছে সে-কথা কে বলেছে! লোক তিনটে যেরকম ক্রিমিনাল টাইপের তাতে মনে হয় তারা এর আগে প্রচুর খুন-জখম-ডাকাতি করেছে। অনেক আগেই ওদের মৃত্যুদণ্ড পাওয়া উচিত ছিল। আক্ষেপ এটাই যে, দুটো গুণ্ডা প্রাণে বেঁচে পালিয়েছে।
ব্যস। বিশ্বনাথ আবার ঠুঁটো জগন্নাথ।
সুতরাং পরদিন সকালে যখন রাস্তায় বেরোলেন তখন বিশ্বনাথ পালকের মতো হালকা। বড় রাস্তার মোড়ে সিক্রেট পুলিশের দুজন অফিসারকে দেখে মোটেই ঘাবড়ে গেলেন না। বরং ওদের একজনকে সময় জিগ্যেস করে ঘড়ি মেলালেন। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে একটা পাবলিক ফোন বুথে ঢুকে পড়লেন।
কাগজের চিরকুটটা দেখে তিতলির নম্বর ডায়াল করলেন বিশ্বনাথ। ও-প্রান্তে ‘হ্যালো’ শোনামাত্রই বললেন, ‘বাইশ, কেমন আছ?’
‘হু ইজ ইট?’ ঘুমজড়ানো স্বরে তিতলি জিগ্যেস করল।
‘বাষট্টি বলছি—।’
সঙ্গে-সঙ্গে চিনে ফেলার খিলখিল হাসি। তারপর: ‘ও, আপনি!’
‘কী করছ এখন, বাইশ?’
‘ঘুমোচ্ছি—।’
‘ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কথা বলা যায় না কি?’
‘যায় বলছি তো!’ আবার হাসি।
‘আমাকে ফোন করতে বলেছিলেন কেন?’
‘আজ দুপুরে আমার এখানে খাবেন। আমরা খেতে-খেতে গল্প করব।’
‘ওখানে আর কে-কে আছে?’
‘কেউ না। আমি একা থাকি—আমার আর কেউ নেই…।’
তিতলির গল্পটা জানতে ইচ্ছে করল বিশ্বনাথের। মনে পড়ল, কাল রাতে ও বলেছিল, ‘…সে অনেক ব্যাপার…।’
বিশ্বনাথ যেতে রাজি হলেন। তিতলি ওঁকে বলে দিল কীভাবে ওর ফ্ল্যাটটা চিনে নেওয়া যাবে। তারপর জিগ্যেস করল, ‘শিয়োর আসছেন তো? প্রমিস?’
বিশ্বনাথ হেসে বললেন, ‘গড প্রমিস—।’
বাড়ি ফিরে বিশ্বনাথ শেভ করলেন। অনেক বাছাবাছির পর একটা শার্ট প্যান্ট পছন্দ করে পরে নিলেন। বহুদিন পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলেন। মুখে পাউডার, ক্রিম লাগালেন। তারপর অযত্নে পড়ে থাকা একটি পারফিউমের শিশি খুঁজে বের করে জামায় বেশ কয়েকবার স্প্রে করলেন।
মনের ভেতরে একটা খুশি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। এমন খুশি যে-খুশি সবাইকে ক্ষমা করতে শেখায়। হয়তো সেইজন্যই বেরোনোর সময় পারমিতার ভ্রূকুটি আর ভিক্টরের গজরানিকে ক্ষমা করে দিলেন।
পারমিতার দিকে না তাকিয়েই আলতো করে বললেন, ‘একটু বেরোচ্ছি। দুপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন…।’
পারমিতার দিকে না দেখলেও বুঝতে পারলেন বউমা কী নজরে গলগ্রহ অকর্মণ্য শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তিতলির ফ্ল্যাটে পৌঁছতে খুব একটা অসুবিধে হল না বিশ্বনাথের। কলিংবেল বাজাতেই দরজার ওপাশে পায়ের শব্দ পেলেন। ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখার জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় গেল বোধহয়। তারপর দরজা খুলে গেল, সামনে তিতলি।
‘আমার দেরি হয়নি তো, বাইশ?’ বিশ্বনাথ হেসে জিগ্যেস করলেন।
‘একটুও না। আসুন, ভেতরে আসুন—।’
ফ্ল্যাটের ভেতরে পা দিলেন বিশ্বনাথ। চারপাশটা দেখে মনে হল স্বর্গ। কিন্তু স্বর্গটা নরকের মতো লন্ডভন্ড, অগোছালো।
আসার সময় বিশ্বনাথ বাইশটা লাল গোলাপ দিয়ে একটা সুন্দর তোড়া তৈরি করিয়েছিলেন। সেটা তিতলির হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা নাও। বাইশকে বাইশটা গোলাপ দিয়ে অভিনন্দন।’
তিতলি তোড়াটা দু-হাত বাড়িয়ে নিল। লম্বা শ্বাস টেনে গন্ধ শুঁকল। বলল, ‘আঃ দারুণ। বেশিক্ষণ শুঁকলে নেশা হয়ে যেতে পারে।’
তিতলির সঙ্গে বসবার ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন বিশ্বনাথ। চারপাশে ভালো করে নজর বোলাতে লাগলেন।
ঘরের সর্বত্র বিস্তর খরচের ছাপ। সোফা সেট, চায়ের টেবিল, ক্যাবিনেট সবই স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। তার সঙ্গে অতি আধুনিক ট্যাপেস্ট্রি।। ডিজিটাল প্লেট টিভি, সারাউন্ড থিয়েটার, ওয়ালস্ক্রিন টেলিফোন—কী নেই ঘরে! কিন্তু সব জিনিসই এলোমেলোভাবে রাখা। ওদের ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখার জন্য কেউ সময় দেয়নি। আর ধুলোও ছড়িয়ে আছে নানান জায়গায়।
বিশ্বনাথ লক্ষ করলেন, দেওয়ালে মাস্টারদের গোটাতিনেক ওরিজিন্যাল অয়েল পেইন্টিং। ঘরের এক কোণে ব্রোঞ্জের একটা মডেল। আর জানলায় রঙিন সুতোর বল দিয়ে তৈরি অদ্ভুত ধরনের ঝুলন্ত পরদা।
সারা ঘরে মোলায়েম একটা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। বিশ্বনাথ কয়েকবার নাক টেনে ঘ্রাণ নিলেন। তারপর একটা সোফায় বসে পড়লেন। তাকালেন তিতলির দিকে।
ঘরটার মতো তিতলিও অগোছালো, কিন্তু ওকে দারুণ লাগছিল বিশ্বনাথের।
বোধহয় একটু আগে স্নান করেছে। কানের দুপাশে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো যে ভিজে সেটা বোঝা যাচ্ছে। গায়ে একটা গোলাপি শার্ট, পায়ে সাদা পাজামা। গলায় সরু প্লাটিনামের চেন, কানের লতিতে সরষের মতো দুটো প্লাটিনামের ফুটকি।
তিতলি জিগ্যেস করল, ‘কাটা জায়গাটা কেমন আছে?’
‘ঠিক আছে।’ বিশ্বনাথ বুকে দুবার আলতো চাপড় মেরে প্রমাণ দিলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি ফুল ভালোবাসো?’
‘কেন বাসব না! সবাই ভালোবাসে।’ ফুলের তোড়াটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখল তিতলি: ‘তা ছাড়া আমার হাতে তো বেশি সময় নেই! তাই আমার সবকিছু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।’
‘কেন, সময় বেশি নেই কেন? তুমি তো সবে বাইশ!’
মলিন হাসল তিতলি। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বিশ্বনাথের মুখোমুখি বসে পড়ল। বিশ্বনাথ কাল রাতের পারফিউমের গন্ধটা পেলেন। সেইসঙ্গে সিগারেটের গন্ধও।
‘বলছি। আগে একটু কফি খান।’ চট করে উঠে পড়ল। হেসে বলল, ‘আমি রান্নাবান্না কিছু জানি না। শুধু চা আর কফি বানাতে পারি।’
‘তা হলে দুপুরে খাব কোথায়? বাইরে?’
‘না, এখানে। কাছেই একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ আছে। বেশ ভালো। ওখানে ফোন করে বলে দিয়েছি। একটা নাগাদ খাবার এসে যাবে। এক মিনিট বসুন, কফিটা করে নিয়ে আসি—।’
প্রায় পাঁচমিনিট পরে কফির কাপ আর বিস্কুট ট্রে-তে সাজিয়ে হাজির হল। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই বিশ্বনাথের চোখে পড়ল কফির কাপের পাশেই বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট আর শৌখিন লাইটার।
সোফায় বসে বিশ্বনাথের হাতে কফির কাপ এগিয়ে দিল তিতলি। নিজেও নিল। কফির কাপে কয়েক চুমুক দেওয়ার পরই সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার তুলে নিল। বিশ্বনাথের দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল: ‘লাইক আ স্মোক?’
মাথা নেড়ে ‘না’ জানালেন বিশ্বনাথ। আগে সিগারেটের নেশা ছিল। রেণুকণা তাই নিয়ে দিনরাত আপত্তি করতেন। রেণুকণা মারা যাওয়ার পর ওই নেশাটা ছেড়ে দিয়েছেন।
তিতলি মাথা নীচু করে সিগারেট ধরাল।
‘নিন, কফি খান। বোধহয় তেমন ভালো হয়নি।’
‘তা কেন? ভালোই তো হয়েছে!’ কাপে লম্বা চুমুক দিলেন বিশ্বনাথ।
‘কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ারের লাইফ আপনার কেমন লাগছে?’ ধোঁয়া ছেড়ে জিগ্যেস করল তিতলি।
‘আগের লাইফের চেয়ে অনেক ভালো…।’
‘আগের লাইফ মানে?’
কফি খেতে-খেতে বিশ্বনাথ তার আগের লাইফের গল্প বলতে লাগলেন।
বাষট্টির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বাইশ সেই গল্প শুনতে লাগল। শুনতে-শুনতে এতই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে, সিগারেটটা কখন ছোট হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতেই চমকে জেগে উঠল তিতলি।
কফি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বনাথ তখনও গল্প বলেছিলেন। হঠাৎ, কী মনে হল কে জানে! তিতলির কাছ থেকে চেয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। তিতলিও একটা ধরাল।
রেণুকণার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বনাথের চোখে জল এসে গেলে। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চোখ মুছলেন। ঘষা গলায় বললেন, ‘এখনও আমি মনে-মনে ওর সঙ্গে কথা বলি। ও-ই আমার কথা বলার লোক।’
সব শোনার পর তিতলি অনেকক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল। তারপর বলল, ‘বাষট্টি, আমার ওসব প্রবলেম নেই। কারও সঙ্গে রিলেশান থাকলে—তারপর সেটা কেটে গেলে, তবে না তাকে মিস করব…।’
বিশ্বনাথ ওর গলায় বাষট্টি শোনামাত্রই চোখ তুলে তাকালেন। ওর কথার পিঠে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কারও রিলেশান হয়নি…সেটা ভাবা যায় না। তুমি এত সুন্দর…।’
‘আপনি দেখছি ছাব্বিশের মতো কথা বলছেন!’
‘সরি।’ ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন বিশ্বনাথ। একটু থেমে বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। একটা বয়েসের পর সত্যি কথা বলতে নেই—বেমানান লাগে—।’
‘আমি কিন্তু হার্ট করতে চাইনি। জাস্ট একটু মজা করছিলাম—।’
‘আগের প্রশ্নটা আবার করতে পারি?’ অনুমতি চাওয়ার ঢঙে বললেন বিশ্বনাথ।
‘কোন প্রশ্ন?’
‘কারও সঙ্গে রিলেশান হয়নি কেন?’
একটু ইতস্তত করে তিতলি বলল, ‘আপনাকে সত্যি কথাটা বলছি। কাল আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তা না হলে আজ এত কথা কার সঙ্গে বলতাম।’ মাথার চুলে হাত বোলাল। ভঙ্গিটা বিশ্বনাথের ভালো লাগল। আরও মনে হল, একটা বয়েসের পর এই ভালো লাগাটা অন্যায়।
তিতলি সময় নিচ্ছিল। এপাশ-ওপাশ তাকাল অকারণেই। তারপর খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলার ঢঙে আলতো স্বরে বলল, ‘সেই ছোটবেলায় একজনের সঙ্গে রিলেশান হয়েছিল। তখন আমি পনেরো। ও-ই আমাকে আমার শরীরটাকে চিনিয়েছিল। ও ছাড়া আমাকে আর কেউ ভালোবাসত না—আমার বাবা-মাও না।’
বিশ্বনাথের দিকে চোখ ফেরাল। চোখের কোণে হিরের কণা।
‘কেন? বাবা-মা নয় কেন?’
‘বাবা মেয়ে চায়নি। আমার জন্মের পর যখন আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে তখন একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছিল…।’ আবার জানলার দিকে তাকাল তিতলি।
বিশ্বনাথ ওর মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
চট করে বিশ্বনাথের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল: ‘এসব কথা আপনাকে বলছি…এগুলো ভীষণ পার্সোনাল…মানে…।’
বিশ্বনাথ বুঝলেন তিতলির ভেতরে একটা লড়াই চলছে। ও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল। বিশ্বনাথ সুবোধ ছাত্রের মতো অপেক্ষা করে চললেন।
একসময় মেঝের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। বলল, ‘টু হেল উইথ সো কলড সিক্রেটস!’ মুখ তুলল, ঠোঁট কামড়াল। তারপর: ‘আমাদের রিলেটিভসরা সবাই আমাকে আর মা-কে দেখতে এসেছে। আমার এক মাসি হঠাৎ বাবাকে লক্ষ করে বলল, ‘কী সুন্দর দেখতে হয়েছে না! ঠিক মন্দিরার মুখটা যেন বসানো। কী দারুণ লাগছে, তাই না!”
‘মন্দিরা আমার মায়ের নাম। বাবা ”মণি” বলে ডাকত। তো মাসির কথা শুনে বাবা সেই কথাটা বলেছিল…।’
‘কী কথা?’ আড়ষ্ট গলায় জানতে চাইলেন বিশ্বনাথ।
‘বাবা মাসিকে বলেছিল, ”পরীক্ষায় ফেল করলে যেমন লাগে আমার ঠিক সেরকম লাগছে।” কথাটা শুনে মা নাকি সবার সামনে কেঁদে ফেলেছিল।’
‘তুমি জানলে কী করে?’
‘আমি বড় হওয়ার পর বাবার সঙ্গে মায়ের একদিন তুমুল ঝগড়া লেগেছিল। বাবা রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তখন মা হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে…কথাগুলো …বলেছিল আমাকে…।’
চোখে জল জমে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিতলি চোখ না বুজে জোর করে তাকিয়ে রইল। জলের ফোঁটা ওর গালে গড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। সিগারেটটা বিশ্বনাথের তেতো লাগছিল। ওটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। তিতলিও কখন যেন হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে দিয়েছে।
বিশ্বনাথ নরম গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘মা ভালোবাসত না?’
‘বাসত—’ ধরা গলায় তিতলি বলল।
‘তারপর?’
‘আমার জন্মের পর থেকে মায়ের সঙ্গে বাবার রিলেশানটা ধীরে-ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বেশ কয়েক বছর পর মায়ের মনে হল, আমার জন্যেই এমনটা হচ্ছে—আমি নাকি অপয়া।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মুখ ভার করে বসে রইল। তারপর: ‘কী আর বলব! বাবার বাইরের টান ছিল…মা সেটা জানত। আমি তো ছোট ছিলাম…অতসব বুঝতাম না। মা বলত, ”পরীক্ষায় ফেল করার পর থেকে তোর বাবার বাইরের নেশা বেড়েছে। এখনও বুঝিসনি তুই অপয়া!” আমি আস্তে-আস্তে বুঝতে শিখছিলাম…। তারপর কয়েক বছরের মধ্যে মনে-মনে অনেক দূরে চলে গেলাম…একা হয়ে গেলাম…।
‘তারপর…পনেরোয় পা দিলাম। ও এল…চলেও গেল। ব্যস, গল্প শেষ!’
বিশ্বনাথের দিকে মুখ তুলে হাসল তিতলি। চোখে তখনও জল। জল মুছল। তারপর দু-হাত শূন্যে ঘুরিয়ে আনন্দের ভঙ্গি করে বলল, ‘দুর! ওসব পুরোনো কথা ভেবে কোনও লাভ নেই। হাতে বেশি সময় নেই, বাষট্টি। তাই আমি লাইফের সবরকম দেখতে চাই…।’
বিশ্বনাথের মনে হল, তিতলি এখন আর মুখ খুলবে না। তাই স্বাভাবিক গলায় ফিরে আসার চেষ্টা করে বললেন, ‘কেন লাইফ কি সিনেমা নাকি? যেখানে সবরকম মশলা পাওয়া যায়?’
‘না তো কী!’ একলাফে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
বিশ্বনাথ দেখছিলেন, মেয়েটা কেমন পালটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ওর একটু আগের কষ্টমাখা মুখটাকে বদলে ফেলতে চাইছে একপলকে।
‘কাল রাতে লোকগুলো তোমাকে অ্যাটাক করেছিল কেন?’ সেই পুরোনো প্রশ্নে ফিরে গেলেন বিশ্বনাথ।
‘ওসব পরে হবে। চলুন, আপনাকে আগে ফ্ল্যাটটা ভালো করে দেখাই—’ তিতলি ওর শোওয়ার ঘরের দিকে রওনা হল। বিশ্বনাথকে আসার জন্য ইশারা করে বলল, ‘ফ্ল্যাটটা নেহাত খারাপ না—কী বলেন!’
‘দারুণ ভালো—’ ফ্ল্যাটের তারিফ করলেন বিশ্বনাথ, ‘শুধু একটু অগোছালো—।
‘হ্যাঁ। জাস্ট লাইক মাই লাইফ।’
এরপর ওরা দুজনে এ-ঘর সে-ঘর ঘুরে দেখতে লাগল।
বিশ্বনাথ ফ্ল্যাটের মার্বেল করা মেঝেতে বেশ সহজভাবেই ঘোরাফেরা করছিলেন। ওঁকে মোটেই অতিথি বলে মনে হচ্ছিল না।
ড্রইংরুম, ডাইনিং স্পেস, বেডরুম, গেস্টরুম—সবই ঝকঝকে, সর্বত্র বিলাসের আদর মাখানো।
বিশ্বনাথ তিতলির বিছানা দেখলেন, আধুনিক খাট দেখলেন, জামাকাপড় রাখার শৌখিন আলনা দেখলেন, এয়ারকুলার দেখলেন, দেখলেন পড়াশোনার টেবিল-চেয়ার। কিন্তু টেবিলে বইপত্রের বদলে পড়ে আছে সিগারেটেরপ্যাকেট, মদের বোতল, স্ম্যাকের পুরিয়া।
বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল বিশ্বনাথের। ওর দিকে তাকিয়ে অকারণেই জিগ্যেস করলেন, ‘এসব নেশার জিনিস কার?’
‘কার আবার? ইউ গেস।’ থুতনি উঁচিয়ে বিদ্রোহী সুরে বলল তিতলি।
বিশ্বনাথ চুপ করে গেলেন। সামনের খোলা জানলার দিকে তাকালেন। সামনের বাড়ির দেওয়ালে রোদ পড়েছে, কার্নিশে দুটো চড়ুই।
ওরা আবার ড্রইংরুমে এসে পড়ল। সোফায় অলসভাবে বসে নানান গল্প শুরু করল।
সন্ধের মুখে তিতলির ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে তিতলি ‘আবার আসবেন কিন্তু’ বলছিল। হঠাৎই ও ‘একমিনিট—’ বলে ছিটকে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে গেল।
একটু পরেই একটা গোলাপ নিয়ে ফিরে এল। বলল, ‘আপনার দেওয়া বাইশটা থেকে একটা নিয়ে এলাম—আমার জীবনদাতার জন্য। এটা রাখুন—।’
বিশ্বনাথ হেসে বলনে, ‘কোনও মানে হয়!’
অথচ বিশ্বনাথ কল্পনায় একটা সাদা কার্ড দেখতে পাচ্ছিলেন—ফুলটার বোঁটার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। আর কার্ডে গোটা-গোটা হরফে লেখা: ‘বাষট্টিকে বাইশ।’
ফুলটা পকেটে নিয়ে এক অনুপম ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরে এলেন।
দিনগুলো কীভাবে কাটছিল বিশ্বনাথের ঠিক ঠাহর হচ্ছিল না।
ক্লায়েন্টদের ভি-স্টিং দেওয়ার কাজ যেমন চলতে লাগল তারই সঙ্গে চলল তিতলিকে নিয়ে ব্যস্ততা।
প্রথম দিন ওর ফ্ল্যাট থেকে ফিরে প্রায় সারা রাত গোলাপটাকে নিয়ে কত কী না ভেবেছেন বিশ্বনাথ! রেণুকণার সঙ্গেও অনেক কথা বলেছেন।
রেণুকণা বলেছেন, ‘দ্যাখো, ভালো-মন্দ পাপ-পুণ্যের ব্যাপার নয়—তোমাকে খুশি দেখলেই আমি খুশি। এর বেশি আমি কিছু চাই না…।’
পরদিন রাস্তায় বেরিয়ে ফোনবুথ থেকে তিতলিকে ফোন করেছিলেন বিশ্বনাথ।
আজ সকালে বাইরে বেরিয়েও বিশ্বনাথের মনে হল, বাইশকে ফোন করলে কেমন হয়।
সঙ্গে-সঙ্গে ফোন বুথ। নম্বর ডায়াল। ক্রি-রি-রিং। এবং ‘হ্যালো’।
‘বাইশ, কেমন আছ?’
‘ভালো। সবে ঘুম থেকে উঠছি।’
‘এখন দশটা বাজে—।’
‘অনেক রাতে শুয়েছি যে।’
‘আমিও। তুমি এত রাত পর্যন্ত কী করছিলে?’
‘ভাবছিলাম। আর নেশা করে বুঁদ হয়ে ছিলাম। এখনও হ্যাং-ওভার কাটেনি…।’
‘নেশা করা খারাপ।’
‘আবার গোরু রচনা! আমার সবচেয়ে খারাপ নেশাটা করতে ইচ্ছে করছে—দারুণ জমবে।’
‘সেটা কী?’
‘আহা! জানেন না যেন!’ একটু হাসল। তারপর: ‘ভি-স্টিং…বাইট। এখনও পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে মারাত্মক নেশা। টিভিতে বলছিল…।’
‘নেশা করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।’
‘ওঃ! মাই গুডনেস!’
‘যাকগে—আজ কী আমাদের দেখা হচ্ছে?’
‘অফ কোর্স…সন্ধেবেলা চলে আসুন…।’
বিশ্বনাথ একলহমা চিন্তা করে নিলেন। ঠিক করলেন, বিকেলে কমিউনিটি পার্কে বেড়ানো আর আড্ডা দেওয়ার পর অনায়াসে তিতলির ফ্ল্যাটে যাওয়া যেতে পারে।
‘যাব। সাতটা নাগাদ। অসুবিধে হবে?’
খিলখিল হাসি। তারপর: ‘ভদ্রতা লিমিট ছাড়িয়ে গেলে তাকে ন্যাকামি বলে। অফ কোর্স সাতটায় আসবেন…।’
‘ছাড়ছি তা হলে…।’
‘না, না—একটা জরুরি কথা আছে।’ সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল।
‘কী?’
‘কাল রাতে একটা লোক ফোন করেছিল। ফোনে থ্রেট করছিল…।’
‘চেনা?’
‘না—।’
‘তো আগে জানালেই পারতে…।’
‘কী করে জানাব?’
বিশ্বনাথ যেন হঠাৎই বুঝতে পারলেন, ওঁর কোনও ফোন নেই।
তিতলি তক্ষুনি ওঁর মনের কথাটা উচ্চারণ করল, ‘আপনি একটা মোবাইল ফোন কিনে নিন—আজকেই।’
‘ঠিক বলেছ।’
‘সেদিন রাতে আপনাকে সামনে পেয়ে আজেবাজে সব ভাট বকে গেছি। হেভি বোর করেছি। কিছু মাইন্ড করবেন না।’
‘সে তো আমিও বেশ লম্বা অটোবায়োগ্রাফি রিডিং পড়ে শুনিয়েছি।’ একটু থামলেন। তারপরে: ‘এবার আজকের কথা বলো…।’
‘সাতটায় মনে করে আসবেন। আমরা আজ গাড়ি নিয়ে যেদিকে দু-চোখ-যায় ঘুরতে বেরোব। রাস্তায় কোথাও ডিনার করে নেব।’
‘তাই হবে। কিন্তু ওই ফোনটার কথা শুনে ভয় করছে…।’
হাসল তিতলি। বলল, ‘ভয় পাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি।…মনে থাকে যেন। সাতটায়।’
তিতলি ‘বাই’ বলে লাইন কেটে দিল।
বিশ্বনাথ চিন্তা করে দেখলেন, ওঁর এখন যা আর্থিক অবস্থা তাতে অনায়াসেই একটা মোবাইল ফোন কেনা যায়।
সন্ধেবেলা তিতলির ফ্ল্যাটে রওনা হওয়ার আগে সত্যি-সত্যিই একটা মোবাইল ফোন কিনলেন। বাড়তি টাকা দিয়ে নম্বরটা এমন বাছলেন যেন বাইশ আর বাষট্টি সংখ্যা দুটো নম্বরে পাশাপাশি থাকে। দোকানদারের কাছ থেকেই মোবাইলের প্রাথমিক কলাকৌশল শিখে নিলেন।
বাস স্টপেজ থেকে এসি চেয়ার কারে ওঠার আগে দুটো গোলাপ কিনলেন বিশ্বনাথ। দুটোই তিতলিকে দেবেন—তারপর একটা ফিরিয়ে নেবেন নিজের জন্য।
তিতলির ফ্ল্যাটে পৌঁছে মোবাইল ফোন আর গোলাপ দেখিয়ে ওকে চমকে দিলেন বিশ্বনাথ। গোলাপ দুটো ওর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যে একটা আমি যাওয়ার সময় নিয়ে যাব…আমার জন্যে…।’
বিশ্বনাথকে ভেতরে ডেকে নিল তিতলি। মোবাইল ফোনের নম্বর নিয়ে ওঁকে ঠাট্টা করল।
ওকে নয়ন মেলে দেখতে লাগলেন বিশ্বনাথ।
কালো আর ছাই রঙের ছক কাটা ছোট হাতার একটা টপ পরেছে। তার বুকের কাছটায় লাল হরফে লেখা: ‘আই অ্যাম মি।’ পায়ে হলদে প্যান্ট, তাতে কালি ছেটানোর মতো কালো-কালো স্পট। গলায় অন্যরকম একটা চেন, কানের লতিতে ঝুরির মতো দুল, হাতে ব্রেসলেট।
বাইরের সন্ধের সঙ্গে মেয়েটা বেশ মানিয়ে গেছে। ওকে ঘিরে একটা সুগন্ধী বাতাস খেলে বেড়াচ্ছিল।
তিতলি আর দেরি করল না—বিশ্বনাথকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ও যে গাড়ি চালানোয় বেশ পটু তা আগের দিনই টের পেয়েছিলেন বিশ্বনাথ। আজও ওকে লক্ষ করছিলেন। কী সহজ অনায়াস ভঙ্গিতে স্টিয়ারিং, ব্রেক, ক্লাচ, অ্যাকসিলারেটর নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে!
বিশ্বনাথকে প্রথমে একটা গেমস পারলারে নিয়ে গেল তিতলি।
বিশাল মাপের তিনতলা পারলার। তাতে নানান ধরনের চোখধাঁধানো খেলা চারপাশে রঙিন আলো। লোকজনের ভিড়। চারটে ট্রান্সপারেন্ট এলিভেটর ব্যস্তভাবে ওঠা-নামা করছে। মাঝে-মাঝে মেগাফোনে নানারকম অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। সারি-সারি ক্যাশ-কাউন্টার থেকে ইলেকট্রনিক স্মার্ট কার্ড কুপন বিক্রি হচ্ছে। কোনও নির্দিষ্ট গেমের স্লটে কার্ডটা টানলেই গেমের চার্জ বিয়োগ হয়ে যাবে।
এলিভেটরে দোতলায় উঠে ‘নাইন স্টিকস’ নামে একটা খেলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। ন’টা রং-বেরঙের লাঠি পাশাপাশি দাঁড় করানো আছে। প্রায় ছ’-সাত মিটার দূর থেকে একটা বড় মাপের বল গড়িয়ে দিতে হবে লাঠিগুলোর দিকে। লাঠিগুলোর মধ্যে একটা কাঠের, আর বাকিগুলো হলোগ্রাম ইমেজ। কিন্তু দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। পাঁচবার বলটা গড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে খেলোয়াড়। তার আসল কাজ হল, কাঠের লাঠিটায় বল লাগানো। সেটায় ধাক্কা লাগলেই ‘ঠক’ করে শব্দ হবে। প্রথম তিনটে থ্রো-র মধ্যে আসল লাঠিটা হিট করতে পারলে পাওয়া যাবে পুরস্কার।
হইহই করে খেলায় নেমে পড়ল তিতলি। বিশ্বনাথকেও নামিয়ে দিল। একবার এই খেলা, আর একবার সেই খেলায় নাম দিয়ে বিশ্বনাথকে পাগল করে দিল। ওর সঙ্গে দৌড়-ঝাঁপ করতে-করতে বিশ্বনাথও যেন বাইশ হয়ে গেলেন।
ঘণ্টাখানেক পর গেমস পারলার থেকে ওরা বেরিয়ে এল রাস্তায়। বেশ কিছু টাকা প্রাইজমানি হিসেবে পেয়েছে তিতলি। ও খুশিতে বিশ্বনাথকে একটা আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘বাষট্টি, আপনি ভীষণ পয়া। দেখলেন, কত টাকা প্রাইজ পেলাম!’
বিশ্বনাথ হাসলেন।
আবার গাড়িতে চড়ে ওরা ছুট লাগাল।
এবারে তিতলি গিয়ে থামল ‘রিল্যাক্স’ নামের একটা অ্যাডিকশান জয়েন্টে। এখানে নেশার সবরকম খোরাক পাওয়া যায়।
তিতলি বলল, ‘এখানে আমি প্রায়ই আসি—।’
‘রিল্যাক্স’-এর বাইরে লাল-নীল নিওন সাইন দিয়ে বিরাট হরফে লেখা রয়েছে: ‘ইউ মাস্ট বিএইটিন টু এনটার’ তার মধ্যে ‘এইটিন’ কথাটা লাল রঙে সংখ্যায় লেখা।
ভেতরে ঢুকে বেশ অবাক হলেন বিশ্বনাথ। যদিও জানতেন চারপাশে এসব চলছে, তবুও নিজে কখনও এরকম আস্তানায় আগে আসেননি।
চতুর্দিকে আলোর মেলা। তারই মধ্যে আলো দিয়ে ছবি আঁকা সব বিজ্ঞাপন। বেশিরভাগ বিজ্ঞাপনই নানান লিকার কোম্পানির। তা ছাড়া আছে নেশা করার কিছু ড্রাগের বিজ্ঞাপন। আর লুকোনো স্পিকার থেকে ভেসে আসছে রক মিউজিক।
সত্যি, নেশা-প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে গেছে!
একটা রঙিন ফুলের ছবি চোখে পড়ল। সেটা রোজ দু-মিনিট করে শুঁকলেই অদ্ভুত নেশা হবে। আর মাসে একবার ফুলটাকে রিচার্জ করে নিতে হবে। সেইরকম দাবি করেছে একটি কোম্পানি।
বিশ্বনাথ অবাক শিশুর চোখে জগৎটাকে দেখছিলেন।
বিশাল হলঘরের নানা জায়গায় দাঁড় করানো আছে মদের স্লট মেশিন। তাতে বোতাম টিপে স্মার্ট কার্ড টানলেই গ্লাসে পরিমাণ মতো তরল পাওয়া যাবে। একটা কোণে ওয়াইড স্ক্রিন প্লেট টিভি-তে সিনেমা চলছে। ডানপাশের একটা লম্বা কাউন্টারে ড্রাগের সুদৃশ্য পলিপ্যাক বিক্রি হচ্ছে। কাউন্টারের মাথায় নিওন সাইনে লেখা ‘স্ম্যাক জ্যাক’। আর কাউন্টারের সামনে উঁচু টুলে বসে আছে ঝিম মেরে যাওয়া খদ্দেররা।
হলে সাজানো চেয়ার-টেবিলের মেলা ছাড়িয়ে দূরের একটা অঞ্চলে লাল নিওন সাইনে লেখা ‘হট স্পট’। সেখানে সিলিং থেকে লাল-নীল-হলদে-সবুজ আলো ঠিকরে পড়েছে। সেই আলের নীচে চলেছে মাতালদের ছন্দহীন উদ্দাম নাচ।
বিচিত্র সব নেশার গন্ধে বিশ্বনাথ পাগল হয়ে গেলেন। তেজি ঘ্রাণশক্তি ওঁকে আরও বিব্রত করে দিচ্ছিল। ভাবছেন বেরিয়ে যাবেন কি না, ঠিক তখনই ওঁর হাত ধরে টান মারল তিতলি।
‘চলুন, ওইখানে গিয়ে বসি—।’ একটা খালি টেবিলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল মেয়েটা।
‘বসব? কেন’ বিশ্বনাথের গলায় আপত্তির ছোঁয়া।
‘ভী-ষণ তেষ্টা পাচ্ছে।’ অনুনয় করে বলল। একটা কাউন্টারে সাজানো রঙিন বোতলের সারির দিকে দেখাল।
‘না!’
‘না কেন? আমার যে অভ্যেস…। তা ছাড়া এখানে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা…।’
একটু চুপ করে রইলেন বিশ্বনাথ। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি তা হলে বোসো—আমি যাই!’
তিতলি এবার বিশ্বনাথের হাত ধরে ফেলল: ‘সেটা কখনও হয় নাকি! আপনি আমার গেস্ট…।’
‘তা হলে চলো…চলে যাই। এখানে আমার ভালো লাগছে না!’
ছোট বাচ্চার বায়না করার ভঙ্গিতে তিতলি বলল, ‘একবার—জাস্ট একবার!’
বিশ্বনাথ এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন।
তিতলি কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তারপর বিশ্বনাথের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কথা শুনব, যদি আপনি আমার কথা শোনেন—।’
‘কী কথা?’
‘আমি আপনার কাছে বাইট নেব—আজ রাতে।’
বিশ্বনাথ একটা জোরালো ধাক্কা খেলেন। বাইশ বলে কী!
কিন্তু বাইশ জেদ ধরে বসে রইল। বিশ্বনাথের কোনও জ্ঞানের কথা সে শুনতে রাজি নয়।
কথা কাটাকাটি করতে-করতেই ওরা ‘রিল্যাক্স’-এর বাইরে বেরিয়ে এল।
শেষ পর্যন্ত তিতলি এমন কথাও বলে বসল, ‘আপনি এত আপত্তি করছেন কেন বুঝতে পারছি না। যা চার্জ লাগে আমি দেব…।’
বিশ্বনাথ যে বেশ আহত হলেন সেটা ওঁর মুখ-চোখ দেখেই বোঝা গেল। আর কোনও তর্কাতর্কির মধ্যে গেলেন না। তিতলির সঙ্গে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই বিশ্বনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমার ফ্ল্যাটে—এখন বাইরে ডিনার করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তার চেয়ে ফ্রিজের লেফট ওভার গরম করে দুজনে খেয়ে নেব, কেমন।’ গাড়ি চালাতে-চালাতে বলল তিতলি। চোখ সামনের রাস্তার দিকে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। কখন যেন ধরিয়েছে।
বিশ্বনাথ কয়েক পলকে ওকে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘আমি নেমে যাব। বাইট কোথায় পাওয়া যায় সে-কনট্যাক্ট নম্বর তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে নামিয়ে দাও…।’
তিতলি তাকাল। হাসল। বলল, ‘রাগ হয়েছে? অন্য কারও কাছে বাইট নেব না—আপনার কাছেই নেব।’
‘কেন?’
‘আপনি স্পেশাল, তাই—।’
‘কেন, স্পেশাল হতে যাব কেন?’
খিলখিল করে হাসল তিতলি। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘রিল্যাক্স-এ তো প্রচুর লোক নেশা করছিল—আপনি শুধু আমাকে বারণ করলেন কেন?’
বিশ্বনাথের মুখে রক্তের ঝলক ছুটে এল। লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলেন।
তিতলি থুতনি উঁচু করে বলল, ‘আপনাকে আমি গাড়ি থেকে নামতে দেব না। দেখি আপনি কী করেন।’
বিশ্বনাথ একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি কিছুই করব না। হেরে ভূত হয়ে গেছি।’
‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়। আমি চাই আমাকে আজ রাতে ভূতে ধরুক।’
বিশ্বনাথ চমকে উঠে তিতলির দিকে তাকালেন। ও তখন একমনে সিগারেটের টান দিয়ে চলেছে।
ফ্ল্যাটে এসে ওদের আর-একদফা তর্কাতর্কি শুরু হল। চলল জেদ আর বায়নার দড়ি টানাটানি।
শেষে তিতলি চোখ কুঁচকে, ঠোঁট উলটে, একটা আঙুল দেখিয়ে আন্তরিকভাবে বলল, ‘বাষট্টি, প্লিজ…একবার। জাস্ট একবার…।’
বিশ্বনাথ তা সত্ত্বেও গাঁইগুঁই করছিলেন।
তখন তিতলি ব্যথা পাওয়া গলায় বলল, ‘আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার হাতে বেশি সময় নেই। হয়তো বাইট কেমন সেটা আর জানাই হবে না কখনও…। একটা দুঃখ থেকে যাবে, বাষট্টি।’
‘কেন, সময় নেই কেন?’ বিশ্বনাথের জেদ নমনীয় হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, এর আগেও একদিন তিতলি এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়েও দেয়নি।
সোফাতে হেলান দিয়ে হাতদুটো ওপরে তুলে সোফার পিছনে ঝুলিয়ে দিতে চাইল মেয়েটা। তারপর ঘষা কাচের মতো চোখ মেলে তাকিয়ে রইল বিশ্বনাথের দিকে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে যেন অনেক কষ্টে বিশ্বনাথকে ফোকাস করল। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আজ আপনাকে বলব…সব বলব।’
বিশ্বনাথ চুপ করে রইলেন। অপলকে বাইশকে দেখতে লাগলেন। ওঁর বুকের ভেতরটা কেমন করতে লাগল।
বাইশ বলতে শুরু করল।
‘আপনাকে কখনও বলা হয়নি। আমরা…আমরা জঘন্য বড়লোক। আমাদের দুটো কয়লা খনি, আর একটা অভ্র খনি আছে। এ ছাড়া আর যা-যা থাকে…বড়লোকের। মানে, কলকাতায় তিনটে বাড়ি, রাজারহাটে একটা বাগানবাড়ি। আর তিনটে গাড়ি…আমারটা নিয়ে।
‘যদিও ”আমাদের”, ”আমাদের” বলছি…আসলে এসবের মালিক এখন আমি একা। সব আমার। কারণ, দু-বছর আগে আমার মা-আর বাবা হাইওয়েতে…এনএইচ-থার্টিফোর-এ…একটা হরিবল অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। স্পট ডেড।
‘আগে মনে-মনে একা ছিলাম, অ্যাক্সিডেন্টটার পর সত্যি-সত্যি একা হয়ে গেলাম। এক কাকা ছাড়া আর কেউ রইল না। আর সেই কাকা…কাকা আমাকে পাগলের মতো তাড়া করে বেড়াতে লাগল।’
তিতলি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডানহাত নামিয়ে চোখ ঢাকল।
বিশ্বনাথ বিড়বিড় করে বললেন, ‘…তাড়া করে বেড়াতে লাগল কেন?’
চোখ ঢেকে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল তিতলি। ওর বুকের ওঠা-নামা দেখে সেটা বুঝতে পারছিলেন বিশ্বনাথ।
একটু পরেই ও চোখ থেকে হাত সরাল। তারপর বারদুয়েক নাক টেনে বলল, ‘কাকা আসানসোলে থাকতেন। মাইনগুলো দেখাশোনা করতেন। তার জন্যে বাবা টাকা দিত মাসে-মাসে। কিন্তু ওই রোড অ্যাক্সিডেন্টটার পর কাকা একেবারে খেপে গেলেন। একে ওই কোটি-কোটি টাকার প্রপার্টি…আর তার সঙ্গে লোভ। বছরদেড়েকের মধ্যেই আমার কাছে তিনি ধরা পড়ে গেলেন। আমাকে বোকা বানিয়ে তিনি সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার তাল করতে লাগলেন। আমি বুঝতে পেরে বাধা দিলাম। লোকজানাজানি হয়ে গেল। আর তখনই বাধল ঝামেলা।
‘আমাকে কিডন্যাপ করে কাকার একটা লুকোনো আস্তানায় তোলার জন্যে কাকা সুপারি দিয়ে প্রফেশন্যাল হুডলামদের লাগিয়ে দিলেন। কারণ, কাকা সম্পত্তি আইনমাফিক কবজা করতে গেলে কয়েকটা ডকুমেন্টে আমার সাইন দরকার। তো সেই লোকগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সুযোগ খুঁজছে। ওরা কখনও আমাকে ফোন করে ভয় দেখায়। কখনও ফলো করে। কখনও-বা ফ্ল্যাটের দরজায় এসে সময়ে-অসময়ে কলিংবেল বাজায়।
‘প্রথম-প্রথম আমি ভীষণ ভয় পেতাম। তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। বুঝলাম, ফালতু ভয় পেয়ে আর লাভ নেই—মরতে হবেই। কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। তা ছাড়া একে-একা কারই-বা সেরকম বাঁচতে ইচ্ছে করে!’
তিতলি একটু থামতেই বিশ্বনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘কেন? তুমি তো পুলিশে খবর দিতে পারো…।’
‘দিয়েছিলাম’। তেতো হাসল: ‘কোনও লাভ হয়নি। ওরা কাউকে ট্রেস করতে পারেনি। খুন-টুন হলে তারপর ক্লু পাওয়া যায়। খুনের আগে থেকেই এগুলো এক্সপেক্ট করাটা বড্ড বাড়াবাড়ি। এ-কথা একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বলেছেন।’
‘প্রথম-প্রথম আমি এ-শহর থেকে ও-শহর পালিয়ে বেড়াতাম। দু-মাস পর ক্লান্ত হয়ে আবার কলকাতায় ফিরে এসেছি। আর কোথাও আমি পালাতে চাই না। টু হেল উইথ দৌজ সুপারি কিলার্স। আই ওয়ান্ট টু ডাই ইন মাই ওন সিটি। যা হবে দেখা যাবে।’ বিরক্তি আর ঘেন্না নিয়ে কথা শেষ করল তিতলি।
‘তোমার কোনও বন্ধু নেই।’
‘এখন?’
ওর প্রশ্নে বিশ্বনাথ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘না, আগে হোক, এখন হোক…।’
‘তিনজন কপালে জুটেছিল। কিলারদের কথা শোনামাত্রই দুজন সটকে পড়েছে। আর-একজন তো একটা এনকাউন্টারের মাঝে পড়ে গিয়ে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।’
‘এনকাউন্টার?’
‘হ্যাঁ। সেদিন রাতে জওহরলাল নেহরু রোডে যেমন হয়েছিল। দুটো লোক একটা গাড়ি নিয়ে আমাকে চেজ করেছিল। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম, শুভ্র আমার পাশে বসে ছিল। হেকটিক কার চেজের পর কোনওরকমে ওদের কাটিয়ে দেখি শুভ্র ফেইন্ট হয়ে গেছে।’
হাসল তিতলি। বলল, ‘আর কিছু জানতে চান?’
বিশ্বনাথ মাথা নাড়লেন: ‘না!’
‘একমাত্র আপনাকেই দেখলাম, অকারণে ছুটে এসে বোকার মতো ডেঞ্জারাস সিচুয়েশানে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন…।’
‘হয়তো আমি বোকা, ডেঞ্জারাস, তাই।’
‘আপনি কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার। সেজন্যেও হতে পারে।’
‘কে জানে! হতেও পারে—।’
‘কী অদ্ভুত ব্যাপার! আমার কথায় বারবার সায় দিচ্ছেন কেন?’
‘সায় দিতে ভালো লাগছে।’
অবাক হয়ে বিশ্বনাথের দিকে তাকাল তিতলি। তারপর উঠে দাঁড়াল: ‘চলুন, এবার শুরু করুন…।’
‘কী?’
‘আহা! ন্যাকা! বাইট।’
হতাশভাবে মাথা নাড়লেন বিশ্বনাথ। সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। বললেন, ‘তোমার সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। চলো, বেডরুমে চলো…।’
বিশ্বনাথ যেরকম সহজভাবে ‘বেডরুম’ কথাটা বললেন, তিতলি তার চেয়েও সহজভাবে বলল, ‘এই ফ্ল্যাটের রুমগুলোর মধ্যে বেডরুমটা আমার সবচেয়ে ফেবারিট।’
ওরা শোওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল।
অন্ধকার ঘরে ঢুকেই তিতলি সুইচ টিপল। ঘরের সিলিং-এ ছড়িয়ে পড়ল নীল আলোর আভা। কিন্তু ল্যাম্পটা বিশ্বনাথের চোখে পড়ল না। শুধু দেখলেন, অদ্ভুত এক নীল মায়া ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে।
আর-একটা সুইচ টিপল তিতলি।
খুব নীচু লয়ে কোমল সুর জেগে উঠল কোথা থেকে। ঠিক যেন মায়ের আদর মাখা ঘুমপাড়ানি গান।
বিশ্বনাথ তিতলিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন। গাঢ় নীল অন্ধকার দিয়ে সেজে উঠেছে মেয়েটা।
ও হাতছানি দিয়ে ডাকল বিশ্বনাথকে।
বিশ্বনাথ পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন ওর কাছে। কাঁধ আর গলার খাঁজে ঝুঁকে পড়লেন। পারফিউমের চড়া গন্ধ নাকে এল।
এক অদ্ভুত বিষণ্ণ আনন্দ বিশ্বনাথের মনে ঢেউ তুলছিল। আঙুলের ডগা দিয়ে কাঁধের কাছ থেকে ওর পোশাকটা একটু সরিয়ে দিলেন। তারপর আরও ঝুঁকে ঠোঁট রাখলেন ওর কোমল ত্বকে।
তিতলি হঠাৎই বিশ্বনাথকে জাপটে ধরল। চাপা গলায় বলল, ‘ওঃ, সিক্সটি টু!’
বিশ্বনাথ নাভিমূল থেকে কেঁপে গেলেন। পলকে যেন ছাব্বিশ হয়ে গেলেন। ওর উষ্ণ ঘনিষ্ঠতা বিশ্বনাথকে উষ্ণ করে তুলল। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল, সব কেমন গুলিয়ে গেল।
ভ্যাম্পায়ারদেরও তা হলে নেশা হয়!
ঠোঁট ফাঁক করে কামড় বসালেন বিশ্বনাথ। এক অলৌকিক চরম তৃপ্তি ওঁর ভেতরে কাজ করে চলল। তিতলির রক্তের স্বাদ জিভে টের পাচ্ছিলেন। একইসঙ্গে সিরাম গ্ল্যান্ডে চাপ পড়ছিল। নেশা চুঁইয়ে-চুঁইয়ে ঢুকছিল তিতলির শরীরে।
আগে খেয়াল করেননি, বিশ্বনাথ কখন যেন আঁকড়ে ধরেছেন মেয়েটাকে। দুজনের বুক প্রবল চাপে মিশে যাচ্ছিল। তার পরেও মেয়েটা বিশ্বনাথকে কাছে টানতে চাইছিল, পাগলের মতো করছিল।
সেই সময় বিশ্বনাথের ধারালো দাঁতের চাপে একটা রক্তের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। ওঁর মনে হল, এইরকম একটা আশ্লেষের আকাঙ্ক্ষায় লক্ষ বছর বেঁচে থাকা যায়। ওঁর জীবনে পশ্চিমদিকটা আচমকা পুবদিক হয়ে গেল যেন। যে-সূর্যটা অস্ত যাচ্ছিল, সেটা যেন কোন এক ম্যাজিকে ভোরের সূর্য হয়ে গেল।
তিতলির ঠোঁট চিরে একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে আসছিল। ঘুমিয়ে পড়ার ঘোরে বাচ্চারা যেমন আলতো ‘উঁ-উঁ’ শব্দ করে সেইরকম।
শব্দের তেজ ক্রমশ কমতে-কমতে শেষে একেবারে মিলিয়ে গেল। তিতলি শরীরের ভার ছেড়ে দিল বিশ্বনাথের হাতে।
বিশ্বনাথ ওকে যত্ন করে ধরে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। পকেট থেকে স্টিকিং প্লাস্টার বের করে লাগিয়ে দিলেন ক্ষতের ওপরে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন ওর ঘুম-ঘুম মুখের দিকে।
বিশ্বনাথ বিছানায় বসে পড়লেন। তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুখের ভেতরের নোনা আঁশটে স্বাদটা বারবার জিভ বুলিয়ে থুতু গিলে কমাতে চাইলেন।
বিশ্বনাথ নিজের নতুন জীবনের কথা ভাবছিলেন। কোথায় ছিলেন, আর কোথায় এসে পড়লেন। যে-জীবনটাকে প্রতিদিন ঘেন্নায় দূরে ঠেলতে চাইতেন, সেটাকে এখন তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
এমন সময় দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল।
ঘোর ভেঙে গিয়ে চমকে উঠলেন বিশ্বনাথ। কে এল এ সময়? তিতলি তো বলেছিল, ওর সেরকম কোনও আত্মীয় কিংবা বন্ধু নেই!
ঝরনার শব্দ তুলে বেল বাজাল আবার।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। তাড়াতাড়ি পা চালালেন ফ্ল্যাটের দরজার দিকে।
ডাইনিং রুমে কোনও আলো জ্বলছিল না। তবে ড্রইংরুমে জ্বলছিল। বিশ্বনাথ দরজার ম্যাজিক আই-তে চোখ রাখলেন।
দুটো অচেনা লোক দরজায় দাঁড়িয়ে। একজন বেশ লম্বা, আর-একজন বেঁটে। বেঁটে লোকটার মুখ লেন্স দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বড্ড বেশি নির্লিপ্ত কাঠখোদাই মুখ। বিশ্বনাথের ওকে পছন্দ হল না।
লম্বা লোকটা একপাশে মুখ ঘুরিয়ে কান চুলকোচ্ছিল। তাই ওর মুখটা দেখতে পেলেন না। কিন্তু ওর কান চুলকোনোটা অভিনয় হতে পারে বলে মনে হল।
কী ভেবে ঘরে আলো নিভিয়ে দিলেন বিশ্বনাথ। তারপর ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন।
সঙ্গে-সঙ্গে বেঁটে লোকটা একটা লম্বাটে রঙিন কৌটো বিশ্বনাথের মুখের সামনে উঁচিয়ে ধরল। এবং বিশ্বনাথ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অ্যাটমাইজারের বোতাম টিপল।
‘স-স-স-স’ শব্দ করে মিহি রেণুর শঙ্কু ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশ্বনাথের মুখে।
মিষ্টি গন্ধ পেলেন। বুঝতে পারলেন, স্প্রে করা তরলটা ক্লোরোফর্ম কিংবা ওই জাতীয় কিছু হতে পারে।
তিতলি যেহেতু একা থাকে তাই বেঁটে লোকটা ভেবেছে তিতলিই দরজা খুলবে। ফলে দরজা খোলামাত্রই সময় নষ্ট না করে অ্যাটমাইজারের বোতাম টিপেছে। তিতলি অজ্ঞান হয়ে গেলেই ওরা দুজনে ওকে তুলে নিয়ে যাবে।
বিশ্বনাথ দরজা খোলায় গল্পটা ভেস্তে গেল।
যে-পরিমাণ তরল বেঁটে লোকটা স্প্রে করেছ তাতে কমপক্ষে দুজন মানুষের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু সি. ভি. বিশ্বনাথ অজ্ঞান হলেন না। চোখের নিমেষে ডানহাত বাড়িয়ে বেঁটে লোকটার টুঁটি খামচে ধরলেন।
লোকটার হাত থেকে রঙিন কৌটোটা খসে পড়ে গেল। ও চোখ বড় করে হাঁসহাঁস করতে লাগল। দু-হাতে বিশ্বনাথের কবজি চেপে ধরল। প্রাণপণ চেষ্টায় টুঁটির বাঁধন ছাড়াতে চাইল।
কিন্তু কোনও কাজ হল না।
বিশ্বনাথ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমি একটা কামড় দিলে তুমি খতম হয়ে যাবে।’
এ-কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ হল।
পিছনের লম্বা লোকটা সবে কী করবে ভাবতে শুরু করেছিল। ও সঙ্গীকে ফেলে রেখে সটান সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাল। বিশ্বনাথের হঠাৎই মনে হল, লম্বা লোকটা বোধহয় আগের দিন সংঘর্ষের সময় হাজির ছিল। বিশ্বনাথের কামড়ে কী হতে পারে ও হাড়ে-হাড়ে জানে।
বেঁটে লোকটার অবস্থা তখন মরা নেংটি ইঁদুরের মতো। বিশ্বনাথ ওকে পিছনে ঠেলে দিলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘তিতলির গায়ে হাত দিতে গেলে আমাকে ডিঙিয়ে যেতে হবে…।’
বিশ্বনাথের ধাক্কায় লোকটা পড়ে গিয়েছিল। গলায় হাতে বোলাতে-বোলাতে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল।
বিশ্বনাথ বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে যেন আমার আর দেখা না হয়।’
লোকটা কোনও জবাব না দিয়ে ছুটে পালাল। কিন্তু ওর ছুটটা এক-পা খোঁড়া কুকুরের মতো দেখাল।
বিশ্বনাথ হাঁপাচ্ছিলেন। একটু-আধটু ভয়ও করছিল। এরা যদি সেই সুপারি কিলার হয় তা হলে সহজে হাল ছাড়বে না—ওরা আবার আসবে, এবং তৈরি হয়ে আসবে।
ঘুমপাড়ানি ওষুধের কৌটোটা মেঝেতে পড়ে ছিল। বিশ্বনাথ সেটা কুড়িয়ে নিলেন। তারপর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ড্রইংরুমে সোফায় বসে কৌটোটা টেবিলে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। টেলিফোনের পাশ থেকে কাগজ আর পেন নিয়ে তিতলিকে দু-লাইন নোট লিখলেন:
বাইশ,
একটা বিপদ এসেছিল। রুখেছি। চলে যাচ্ছি। কাল কথা হবে।
বাষট্টি
কাগজটা নিয়ে বেডরুমে গেলেন। ঘুমন্ত তিতলিকে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। তারপর কাগজের টুকরোটা রেখে দিলেন ওর হাতের কাছে।
তিতলির ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর এক অদ্ভুত ক্লান্তি টের পেলেন। ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল হঠাৎই। তখনই রেণুকণার গলা পেলেন, ‘সারা সন্ধে যা ধকল গেল! তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো—।’
বিশ্বনাথ একটু অন্যমনস্ক ছিলেন বোধহয়। তাই রেণুকণার গলা পেয়ে চমকে চারপাশে তাকালেন। তারপরই বুঝতে পারলেন, রেণুকণার কথাগুলো এসেছে ওঁর বুকের ভেতর থেকে।
তিতলিকে গাঢ় আবেগে জড়িয়ে ধরেছেন। ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে আছেন গলা। পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছেন—সেইসঙ্গে তিতলির গন্ধও। বুঝতে পারছিলেন, এই বাইট অন্তত—কিছুতেই শেষ হবে না।
জীবনের টান ভোরবেলায় বিশ্বনাথকে এই স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। যখন জেগে উঠলেন তখনও স্বপ্নটা আদর মাখা চাদরের মতো বিশ্বনাথকে জড়িয়ে ছিল।
বেলা হতেই রোজকার মতো রাস্তায় বেরোলেন বিশ্বনাথ। এটিএম থেকে পেনশনের টাকা তুলতে হবে। তারপর ‘শটস অ্যান্ড কিকস’-এর স্পেশাল সেল-এ একবার ফোন করতে হবে। নিজের জন্য টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে আর ওষুধ কিনতে হবে। তারপর সন্দীপনের সঙ্গে একবার দেখা করবেন। সি. ভি. জীবনের সুঃখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলবেন।
রোদে হাসিখুশি রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে মনে হল তিতলিকে একটা এসএমএস করা যাক। এখন সওয়া দশটা বাজে—নিশ্চয়ই ঘুম ভেঙেছে ওর।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে এসএমএস করলেন বিশ্বনাথ:
বাইশ জেগে ওঠো। তবে না ‘গুড মর্নিং’ বলব।
তাকিয়ে দ্যাখো, একটা দিন আমাদের জীবন থেকে
কমে যাচ্ছে।
বিশ্বনাথ যখন ওষুধের দোকানে তখন এসএমএস-এর উত্তর এল:
বাষট্টি, জেগেছি। গুড মর্নিং বলবেন না?
বিশ্বনাথ ভাবলেন, ওষুধের দোকানে কাজ মিটিয়ে তারপর ওকে ফোন করবেন।
প্রায় দশমিনিট পর দোকান থেকে বেরোতে না বেরোতেই আবার তিতলির এসএমএস:
কী ব্যাপার? হারিয়ে গেলেন নাকি?
বিশ্বনাথ হেসে ফেললেন আপনমনে। কী অল্পেতে ঠোঁট ফোলায় মেয়েটা! আসলে ওর কোনও দোষ নেই। সারা জীবনে কারও কাছ থেকে ও কিছু পায়নি। যা ওর পাওনা ছিল তাও না। না পাওয়ার যন্ত্রণা ওকে অভিমানী করে তুলেছে।
বিশ্বনাথ মোবাইল বের করে ওকে ফোন করলেন।
‘হ্যালো, বাইশ। কেমন আছ?’
‘কী ব্যাপার? হারিয়ে গেলেন নাকি?’ তিতলি নয়, ওর অভিমান কথা বলল বলে মনে হল বিশ্বনাথের।
‘গুড মনিং, বাইশ—।’
‘গুড না ছাই! ফোন করতে আর-একটু দেরি হলেই মর্নিংটা ব্যাড হয়ে যেত।’
‘কেন? তুমি তো ফোন করতে পারতে আমাকে—।’
‘পারতাম। কিন্তু সকালের প্রথম ফোনটা আপনার কাছ থেকে পেতে ভালো লাগে।’ হাসল তিতলি: ‘থ্যাংকস ফর দ্য সুইট বাইট লাস্ট নাইট।’
মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা। বিশ্বনাথ একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। নীল আলোয় যা আকাঙ্ক্ষার মনে হয়েছিল এখন ঝকঝকে রোদে সে-কথা মনে পড়তেই বিব্রত হয়ে পড়লেন হঠাৎ।
তারপর উঠল বিশ্বনাথের লিখে আসা দু-লাইন চিঠিটার কথা। কথা চলল, এবং চলতেই থাকল।
সময় ভুলে গেলেন বিশ্বনাথ। আর তিতলিও।
বিশ্বনাথের মনে পড়ল, বাড়িতে যেদিন ওঁর মোবাইল ফোনের রিং-এর শব্দ আলোক প্রথম শুনতে পেয়েছিল সেদিন ওর মুখের অবস্থাটা কী বিচ্ছিরিই না হয়েছিল। বিশ্বনাথের ঘরে ছুটে এসে গায়ের ওপরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ছেলে। অবাক গলায় জিগ্যেস করেছিল, ‘এ কী, বাবা, তুমি মোবাইল ফোন কিনেছ?’
‘হ্যাঁ, কী হয়েছে?’ শান্ত গলায় পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন বিশ্বনাথ।
‘না, অনেক টাকার ব্যাপার…তাই…।’
‘ঘরে যাও। পারমিতা তোমাকে বোধহয় ডাকছে।’
ভিক্টরের মতো গরগর করতে-করতে চলে গিয়েছিল আলোক।
পারমিতার কাছে অনেক খবরই ও পাচ্ছে আজকাল।
বিশ্বনাথ বড্ড বেশি বাড়ির বাইরে-বাইরে কাটাচ্ছেন। নতুন-নতুন জামাকাপড় তৈরি করাচ্ছেন। পারফিউম স্প্রে করছেন। আগে তিন-চারদিন পরপর শেভ করতেন—এখন রোজ করছেন। দু-একদিন ওঁকে ফুল হাতে নিয়ে ঢুকতে দেখেছে পারমিতা।
ছেলে আর বউমার বিস্ময় অবশ্যই টের পান বিশ্বনাথ। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ করেননি। পুরোনো জীবনকে তোয়াক্কা না করাটা এখন ওঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
তিতলির সঙ্গে, বলতে গেলে রোজই দেখা করেন বিশ্বনাথ। ওর সঙ্গে পথে বেরিয়ে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান। তিতলির যেমন খেয়াল হয় সেভাবেই ওদের পা চলে।
একদিন তিতলি বলল, কলকাতার টুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরে-ঘুরে দেখবে। ব্যস, অমনই ওদের ট্যুর শুরু হয়ে গেল। পুরো চারদিন লেগেছিল সবগুলো দেখে শেষ করতে।
ওর ছেলেমানুষি দেখে বিশ্বনাথ মজা পান। সেইসঙ্গে ভালোও লাগে। ওর মনের সমস্ত ভাবনা, খামখেয়ালিপনা, এত স্পষ্ট, এত খাঁটি যে, তার তুলনা নেই। মনটা পড়ে নেওয়া যায় খোলা খাতার মতো।
একদিন সন্ধেবেলা ময়দানে হাঁটতে-হাঁটতে তিতলি বলল, ‘হাতে আমার যদি বেশি সময় থাকত তা হলে ভালো হত…।’
‘তার মানে?’ বিশ্বনাথ জিগ্যেস করলেন।
‘মানে বাইশ থেকে বাষট্টিতে পৌঁছতে ইচ্ছে করছে। সবকিছু ছেড়ে চট করে চলে যেতে মন চাইছে না…।’
‘কোথায় চলে যাবে?’
চলতে-চলতে হঠাৎই থমকে দাঁড়াল। আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখাল।
‘এসব পাগলামি ছাড়ো! কে তোমাকে চলে যেতে দিচ্ছে?’
‘কে আটকাবে? আপনি?’
‘যদি বলি হ্যাঁ—আমি।’ বেশ জোর করে বললেন বিশ্বনাথ।
মনমরা হাসল তিতলি: ‘আপনি পারবেন না। ওরা প্রফেশন্যাল। ডেঞ্জারাস।’
‘আর তুমি তো জানো, আমি বোকা এবং ডেঞ্জারাস—।’
তিতলি কোনও জবাব দিল না। ঠোঁটের কোণ দিয়ে হাসল শুধু।
বিশ্বনাথ তিতলির জন্য ভীষণ চিন্তা করছিলেন।
গত দশ-বারোদিন ধরে হুমকি-ফোনের ব্যাপারটা বেশ বেড়ে গেছে। তিতলিও ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে যেন। যখন ও মরতে ভয় পেত না তখন ওর কোনও ভয় ছিল না। যেদিন থেকে ওর বাষট্টি হতে ইচ্ছে করছে, একটু-আধটু বাঁচতে ইচ্ছে করছে, সেদিন থেকে ভয় চুঁইয়ে-চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে ওর ভেতরে।
সন্ধে হয়ে আসছে দেখে বিশ্বনাথ বললেন, ‘বাইশ, এবার বাড়ি ফেরা যাক—।’
পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে তিতলি বলল, ‘এখনও সূর্য অস্ত যায়নি।’
‘দেরি করার কী দরকার!’ বিশ্বনাথের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিলেন।
লাল সূর্যের দিকে চোখ রেখে তিতলি বলল, ‘বাষট্টি, কাল আমরা দূরে কোথাও বেড়াতে যাব।’
‘কোথায়?’
‘কাল ভোরে উঠে যেদিকে যাওয়ার ইচ্ছে হবে সেদিকে…।’
হঠাৎই বিশ্বনাথ দেখলেন, তিনটে লোক মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে। তার মধ্যে একজন একটু বেশি লম্বা।
ভয় চলকে উঠল। অদৃশ্য গিটারের মোটা তার ঝংকার তুলল বিশ্বনাথের বুকের ভেতরে।
মাঠে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরও লোকজন রয়েছে। বিপদে পড়ে চিৎকার করে উঠলে তারা নিশ্চয়ই ছুটে আসবে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।
বিশ্বনাথ এ-কথা ভাবছিলেন এবং আড়চোখে লোক তিনটের দিকে নজর রাখছিলেন।
তিতলি লাল-হয়ে-যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনাভাবে নানান কথা বলছিল। কিন্তু সব কথা বিশ্বনাথের মাথায় ঢুকছিল না। কারণ, লোক তিনটের দিকে লক্ষ করছিলেন।
হঠাৎই বিশ্বনাথ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন।
লোক তিনটে মোটেই ওদের দিকে আসছিল না। ওরা হাঁটতে-হাঁটতে একটা গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। সেই গাছ-বরাবর তাকালে দূরের রাস্তায় তিতলির শ্যাওলা রঙের গাড়িটা চোখে পড়ছে। অর্থাৎ, গাড়ির কাছে যেতে হলে লোকগুলোকে ডিঙিয়ে যেতে হবে।
বিশ্বনাথ আরও লক্ষ করলেন, গাছের নীচটায় ছায়া নেমে এসেছে। মাঠের লোকজনও কমে যাচ্ছে দ্রুত।
আর ঝুঁকি নেওয়ার কোনও মানে হয় না। তিতলিকে হাত ধরে টান মারলেন বিশ্বনাথ, ‘বাইশ, চলো, আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
তিতলি বায়নার সুরে হলল, ‘কেন? আর একটু থাকি…।’
‘না।’
তিতলির হাত টেনে নিয়ে এগোতে লাগলেন। লক্ষ করলেন, আকাশের লাল আভা মলিন হয়ে সেখানে ছায়া-ছায়া তুলির আঁচড় পড়েছে। ঘরে ফেরা কাক-চড়ুইয়ের দল ঝাঁকড়া গাছগুলোয় বসে তুমুল হল্লা করছে। রাস্তার ধারে পার্ক করা তিতলির গাড়িটাকে বেশ কষ্ট করে দেখতে পাচ্ছেন।
সেইসঙ্গে এও দেখতে পেলেন, লোক তিনটে বৃত্তচাপের ঢঙে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা কালো বাজপাখি যেন ডানা ছড়াচ্ছে।
বিশ্বনাথের আর সন্দেহ রইল না। চট করে চলার দিক পালটালেন। একইসঙ্গে গতিও বাড়ালেন।
তিতলি বারবার জিগ্যেস করছিল, ‘কী হয়েছে?’
বিশ্বনাথ চাপা গলায় বললেন, ‘সুপারি কিলার্স।’
তিতলির গলা দিয়ে একটুকরো ভয়ের শব্দ বেরিয়ে এল।
সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্বনাথ বললেন, ‘চুপ! আমি তো আছি!’
‘ওদের সঙ্গে বোধহয় আর্মস আছে…।’
ওকে সাহস দিতে বিশ্বনাথ হাসলেন: ‘আর্মস আমারও আছে—তুমি জানো।’ দাঁতের পাটি ফাঁক করলেন বন্ধ করলেন।
‘আজ রাতে একটা বাইট প্রেজেন্ট করা যাবে?’
কী অদ্ভুত কথা! মেয়েটার কি মতিগতির ঠিক নেই? এই সাংঘাতিক মুহূর্তে নেশার আবদার করছে!
‘ওসব পরে হবে। আগে…।’
বিশ্বনাথ লক্ষ করলেন, লোকগুলো আর দাঁড়িয়ে নেই। দুজন জায়গা বদলে গাড়ির দিকে এগোনোর পথটা আগলাচ্ছে। আর তিন নম্বর লোকটা জোর পায়ে ছুটে আসছে বিশ্বনাথ আর তিতলির দিকে।
‘রান!’ বিশ্বনাথ গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘ছুট লাগাও জলদি—।’
ওরা ছুটতে শুরু করল। কিন্তু কিছুটা দৌড়ে যাওয়ার পরই তিননম্বর লোকটা ওদের ধরে ফেলল। একটা খাটো রড উঁচিয়ে ধরল মাথার ওপরে।
বিশ্বনাথ হাতের এক ঝটকায় তিতলিকে ছিটকে দিলেন ঘাসের ওপরে। আর একইসঙ্গে লোকটার নেমে আসা হাতটা রুখে দিলেন। কিন্তু আঘাতটা পুরোপুরি এড়াতে পারলেন না।
রডটা মাথার পাশে এসে লেগেছিল। তখনই বুঝতে পেরেছেন ওটা লোহার। একটা ভোঁটা যন্ত্রণা মাথায় চারিয়ে গেল। পুরোনো বিশ্বনাথ হলে হয়তো অজ্ঞানই হয়ে যেতেন। নতুন বিশ্বনাথ ব্যথাটা সামলে নিলেন।
লোকটা মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করেনি। বিশ্বনাথও না।
লোকটাকে দেখলেন।
ছোট-ছোট চুল। পুরু গোঁফ। গাল ভাঙা। দাঁতে রঙিন ছোপ। গলায় সোনালি চেন। পোশাক বলতে চাপা প্যান্ট আর টি-শার্ট।
না, এই লোকটা সেদিন তিতলির ফ্ল্যাটে অ্যাটাক করতে আসেনি। এটা নতুন।
লোকটাকে দেখতে একপলক লাগল। আর ওর গলায় কামড় বসাতে আর এক পলক।
ভিক্টরের মতো অলৌকিক ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বনাথ। তারপর হিংস্রভাবে কামড় বসিয়েছেন। কনভার্টেড ভ্যাম্পায়ার যে আসল ভ্যাম্পায়ারের চেয়ে কিছু কম নয়, সেটাই যেন মরিয়া হয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন।
এতক্ষণ কথা না-বলা লোকটা এবার গুঙিয়ে উঠল যন্ত্রণায়। ঢলে পড়ে গেল ঘাসের ওপর। কিন্তু বিশ্বনাথ কামড় ছাড়েননি। লোকটার সঙ্গে-সঙ্গে সমান তালে ঝুঁকে পড়েছিলেন। শেষে হুমড়ি খেয়ে রইলেন ওর গলার ওপর।
নোনা। নোনা। নোনা।
গোটা সমুদ্রটা যেন ঢুকে পড়ছিল বিশ্বনাথের মুখের ভেতরে। সেইসঙ্গে যেন সমুদ্রের মাছগুলোও। কারণ, জোরালো আঁশটে গন্ধ টের পাচ্ছিলেন। শুনতে পেলেন, রেণুকণা বলছেন, না, এ কোনও অন্যায় নয়। একটা শয়তানকে মেরে তুমি একটি দুঃখী মেয়েকে বাঁচাচ্ছ। বাঁচাও! বাঁচাও!
তার মানে, শয়তানটাকে মারো, মারো!
বিশ্বনাথ তাই করছিলেন। লোকটা গলা কাটা ছাগলের মতো ছটফট করছিল। আর একইসঙ্গে ওর প্রাণটা ধীরে-ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ময়দানের ঘাষ ভিজে যাচ্ছিল।
মিনিটখানেক পর লোকটাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন, কাছেই তিতলি দাঁড়িয়ে। চোখ বড়-বড় করে বিশ্বনাথের কাণ্ডকারখানা দেখছে।
‘শিগগির ছোটো গাড়ির দিকে! গাড়ি নিয়ে পালাও। কুইক!’
কিন্তু তিতলি বিশ্বনাথের কথা যেন শুনতেই পেল না। বলল, ‘ওই দ্যাখো, ওই দুটো লোক আসছে…।’
‘আসুক। ওদের আমি রুখে দিচ্ছি। বাট ইউ রান লাইক হেল। আমার কথা শোনো, বাইশ, প্লিজ! গাড়ি নিয়ে স্ট্রেট বাড়ি চলে যাও। সিক্রেট পুলিশকে ইনফর্ম করো। তারপর ফ্ল্যাটের দরজা লক করে বসে থাকো। খবরদার, আমার কথা বলবে না কিছুতেই। যাও!’
‘আর তুমি?’ কাঁদতে-কাঁদতে জিগ্যেস করল তিতলি।
‘আমি তোমাকে ফোন করব। তারপর কাল হয়তো তোমার আস্তানায় গিয়ে হাজির হব।’ কথাটা শেষ করে বিশ্বনাথ হাসতে চাইলেন। কিন্তু হাসি এল না। ঠোঁট-মুখ চটচট করছে। থুতনি, গলা বেয়ে আঠালো তরল গড়িয়ে নামছে। হয়তো জামাতেও লেগে গেছে।
ছায়া-ছায়া আঁধারে ঠিক কী যে হচ্ছিল বাকি দুটো লোক সেটা ঠিকমতো ঠাহর করতে পারেনি। তা ছাড়া ওরা গাড়ি আগলাবে না সাহায্যের জন্য ছুটে যাবে, সেটা নিয়েও দোটানায় ছিল। তাই ওদের সিদ্ধান্ত নিতে সময় লেগেছে। এখন ওরা জোরকদমে এগিয়ে আসছে বিশ্বনাথের দিকে।
তিতলি কান্না-ভেজা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি একা যাব না—তুমিও চলো।’
বিশ্বনাথ তিতলিকে রুক্ষভাবে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি গাড়ি নিয়ে পালাও। আমি এদের ব্যবস্থা করে তারপর…।’
বিশ্বনাথ লম্বা-লম্বা শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছিলেন। আবার বললেন, ‘বাইশ, লক্ষ্মীটি—আমার এই কথাটা রাখো—প্লিজ। যাও—।’
‘বাষট্টি!’ বলে ডুকরে উঠল তিতলি। তারপর ঘুরপথে ছুট লাগাল গাড়ির দিকে।
লোক দুটো তখন বিশ্বনাথের হাতদশেকের মধ্যে এসে গেছে। সাবধানে সতর্ক পা ফেলে এক পা এক পা করে শিকার ধরতে এগিয়ে আসছে।
দুজনের মধ্যে লম্বা লোকটাকে একটু যেন চেনা মনে হল বিশ্বনাথের। তিতলির ফ্ল্যাটে কি লোকটা এসেছিল? তা হলে তো বিশ্বনাথকে ও চিনবে।
একটা লোকের গলা শোনা গেল, ‘ছামিয়াটা যে ওদিক দিয়ে ছুট লাগাচ্ছে, বস—।’
‘আগে এই ঢ্যামনাটাকে কোতল কর। হারামিটা রামাইয়াকে লুটিয়ে দিয়েছে। আমাদের অপারেশানে বারবার দখল দিচ্ছে। আর ওই ছামিয়া পালাবে কোথায়! ওর তো ওই একটাই ঠেক—।’
কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন বিশ্বনাথ। এক্স-ফ্যাক্টর ওঁকে চমৎকার সাহায্য করছিল। ওঁর বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যাক, তিতলিকে আজ ওরা রেহাই দিচ্ছে। এই একটা দিনই বিশ্বনাথের দরকার। সন্দীপনের এক শালা সিক্রেট পুলিশে আছে। কাল সকালেই ওর সঙ্গে দেখা করে তিতলির ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। আগেও বিশ্বনাথ সন্দীপনকে এ-ব্যাপারে রেখে-ঢেকে একটু ইশারা দিয়েছেন, কিন্তু ইমার্জেন্সি ভেবে সেরকম তাগাদা করেননি।
লোকদুটো কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল শত্রু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পায়ের কাছে রামাইয়ার দেহ—অথবা, মৃতদেহ—অসাড় হয়ে পড়ে আছে।
বিশ্বনাথ তিতলির দিকে লক্ষ করছিলেন। দেখলেন, ও গাড়িতে উঠে পড়ল। হেডলাইট জ্বলে উঠল। তারপর হেডলাইট দুটো দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করল।
আঃ—!
পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেললেন বিশ্বনাথ। এখন আর কাউকে তিনি ভয় পান না। সামনের এই জঘন্য লোকদুটোকেও না।
দুটো লোকের গায়েই ঢোলা শার্ট। প্যান্টের ওপর দিকে ঝোলানো। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলেও বিশ্বনাথ ওদের দেখতে পাচ্ছিলেন। একজনের বাচ্চা-বাচ্চা লালিপপ মুখ। বাঁ ভুরুর ওপরে কাটা দাগ। গা থেকে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে।
আর অন্যজন সেই লম্বা লোকটা। শিকারি বাঘের মতো সামান্য ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম সুযোগেই ক্ষিপ্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
দুটো লোকই কোমরের কাছে হাত গুঁজে রেখেছিল। বোধহয় লুকোনো অস্ত্র হাতে ছুঁয়ে ভরসা খুঁজছিল। আর বিশ্বনাথের দু-পাটি অস্ত্র মুখের ভেতরে খটাখট শব্দ তুলে আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছিল।
একটা হাত বেরিয়ে এল ঢোলা শার্টের আড়াল থেকে। হাতে ধরা ফুটখানেক লম্বা একটা চওড়া ব্লেডের ছুরি।
বিশ্বনাথ হিসেব কষছিলেন। এই হতচ্ছাড়া দুটোকে যেভাবে হোক আটকাতে হবে। খতম না হোক, অন্তত ঘায়েল করতে হবে। যাতে ওরা বাইশকে আর জ্বালাতে না পারে।
হিসেবের উত্তর অনুযায়ী বিশ্বনাথ ছুরিওয়ালার ছুরি লক্ষ করে ঝাঁপ দিলেন। ভঙ্গিটা এমন, যেন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন।
সঙ্গে-সঙ্গে ছুরি চলল বাতাসে। বিশ্বনাথের বাঁ-হাতে, কুনুইয়ের ঠিক ওপরে, কেটে বসল ছুরিটা। বিশ্বনাথ লোকটার কান ধরলেন মুঠো করে। এক হ্যাঁচকায় ওকে টেনে নিলেন নিজের কাছে। এবং ওর ডান কাঁধে মরণ কামড় বসালেন।
শুয়োরের বাচ্চাটা বুঝুক ভ্যাম্পায়ারের কামড় কাকে বলে!
বাঁ-হাতে বসানো ছুরির ফলা। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু বাষট্টির কোনও তোয়াক্কা নেই। বরং কামড়টা ঠিকঠাক দিতে পেরেছে বলে বেজায় খুশি।
ঠিক সেই মুহূর্তে যন্ত্রণায় ছটফট করা লোকটা এক প্রবল ধাক্কা দিল বিশ্বনাথকে। বিশ্বনাথ ছিটকে পড়লেন বটে, তবে লোকটার কাঁধের খানিকটা মাংস ছিঁড়ে চলে এল দাঁতে।
আঁশটে গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। থু-থু করে সব ফেলে দিলেন। তারপর নজর ফেরালেন লোকদুটোর দিকে। দেখলেন আহত লোকটা টলছে—যে-কোনও মুহূর্তে খসে পড়বে জমিতে।
কিন্তু দু-নম্বর লোকটা কোথায় গেল?
ওই তো! আহত সঙ্গীকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঘাসের ওপরে চিত হয়ে পড়ে দেখতে লাগলেন বিশ্বনাথ। ওঁর একটা পা লম্বা হয়ে আছে রামাইয়ার গায়ের ওপরে। আর-একটা পা হিম-ভেজা ঘাসে।
আকাশের দিকে চোখ গেল। অন্ধকার গাঢ় হয়ে চাঁদকে উজ্জ্বল করে দিয়েছে। চাঁদের খাঁজ এবং বাঁকগুলো মুগ্ধ করল বিশ্বনাথকে। যে-বাতাস হঠাৎ বইতে শুরু করেছে তাতে শীতের গন্ধ পাচ্ছিলেন। তবে তার মধ্যে যেন আলতো করে মৃত্যুর পারফিউম মিশিয়ে দিয়েছে কেউ।
ওই তো লম্বা লোকটা! ও একটা দাঁড়িয়ে আছে। ওর শাগরেদ—কাঁধে কামড় খাওয়া লোকটা—নির্ঘাত খসে পড়েছে মাটিতে।
শরীরের সব শক্তি জড়ো করে উঠে বসলেন বিশ্বনাথ। বাঁ-হাতটা অসম্ভব জ্বালা করছে। এবার শেষেরটাকে খতম করার পালা। তা হলেই নিশ্চিন্ত। অন্তত কিছুদিনের জন্য।
লম্বা লোকটা কোমরের কাছ থেকে কী একটা বের করে শূন্যে তুলল।
অস্ত্রটা চিনতে পারলেন বিশ্বনাথ। খাটো হাতলের একটা কুড়ুল। কিন্তু ততক্ষণে অস্ত্রটা বাতাস কেটে শূন্যে বৃত্তচাপ এঁকে ধূমকেতুর মতো ছুটে আসতে শুরু করেছে বিশ্বনাথের দিকে।
কুড়ুলটা বিশ্বনাথের বুকে এসে আছড়ে পড়ল। সংঘর্ষের ভোঁতা শব্দ হল। ফলার অর্ধেকটা গেঁথে গেল ওঁর পাঁজরে। আর উঠে-বসতে-চাওয়া বিশ্বনাথ কুড়ুলের ধাক্কায় সটান চিত হয়ে পড়ে গেলেন।
হেঁচকি তোলার একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল মুখ থেকে। চেষ্টা করেও বিশ্বনাথ মর্মান্তিক শব্দটা চাপা দিতে পারেননি। একইসঙ্গে বুকের ভেতরে দম বন্ধ হয়ে এল। একটা প্রকাণ্ড পাথর যেন শ্বাসনালীতে আটকে গেছে।
ঝাপসা চোখে লম্বা লোকটার দাঁড়ানো সিল্যুট দেখতে পেলেন। ওর মাথার পাশ দিয়ে উঁকি মারছিল শুক্লপক্ষের চাঁদ।
সামনে ঝুঁকে পড়ে কুড়ুলের হাতল ধরে প্রকাণ্ড এক হ্যাঁচকা মারল শত্রু। বোধহয় ইচ্ছে ছিল কুড়ুলের দ্বিতীয় আঘাত হানবে বিশ্বনাথকে বুকে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। কারণ, কুড়ুলের ফলাটা কিছুতেই ছাড়ানো গেল না বিশ্বনাথের পাঁজর থেকে।
বিশ্বনাথের সারাটা শরীর চটচট করছিল। আঁশটে গন্ধ তুফান ছুটিয়ে দিয়েছে চারপাশে। কুড়ুলের কাঠের হাতলটা কোনওরকমে চেপে ধরলেন। তারপর ওঁর আঙুলগুলো কাঁকড়ার দাঁড়া হয়ে হাতল বেয়ে উঠতে লাগল। লম্বা লোকটা তখনও হাতল ধরে টানাটানি করছে। বিশ্বনাথের আঙুল ওর আঙুলের নাগাল পেয়ে গেল।
ব্যস। সঙ্গে-সঙ্গে তিতলিকে নিরাপদ করার তীব্র অভিলাষ বিশ্বনাথকে পেয়ে বসল। লোকটার আঙুল আঁকড়ে ধরে এক হিংস্র টান মারলেন। লোকটা নিমেষের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিশ্বনাথের বুকের ওপর। বিশ্বনাথ এক মুহূর্তও দেরি না করে লোকটার গাল কামড়ে ধরলেন। সিরাম গ্ল্যান্ডে চাপ দিলেন প্রাণপণে।
হে ভগবান, একে খতম করার পুঁজি যেন থাকে আমার অলৌকিক জীবনে! বিড়বিড় করে বারবার এই প্রার্থনা জানাতে চাইলেন বিশ্বনাথ।
লোকটা এলোপাথাড়ি ছটফটাচ্ছিল। কিন্তু একটু পরেই দম-ফুরিয়ে যাওয়া পুতুলের মতো স্থির হয়ে গেল। টাল খেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল বিশ্বনাথের গায়ের ওপর থেকে।
বিশ্বনাথের মনটা পালকের মতো হালকা হয়ে গেল। চিত হয়ে শুয়ে কুড়ুলের কালো হাতল আর চাঁদ দেখতে লাগলেন। হাতলটা যেন ওঁর শরীরেরই একটা বিচিত্র প্রত্যঙ্গ—আকাশের দিকে প্রতিবাদে উঁচিয়ে আছে।
ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল হঠাৎই। বিশ্বনাথের জ্বালায় আলতো প্রলেপ লাগাল।
সঙ্গে-সঙ্গে পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠল আনন্দের সুরে।
অতি কষ্টে ডানহাত পকেটে ঢুকিয়ে বের করে নিলেন ফোনটা। সুইচ টিপে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন, ‘হ্যালো—।’
‘বাষট্টি, তুমি ঠিক আছ তো? আর ইউ ও. কে.?’ উদ্বেগে পাগল তিতলির গলা।
‘আমি ঠিক আছি।’ কোনওরকমে বললেন বিশ্বনাথ। প্রাণপণে কষ্ট চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন: ‘আর কোনও ভয় নেই, বাইশ…।’
‘তুমি শিগগির আমার এখানে পালিয়ে এসো। এখানে কেউ তোমাকে কিচ্ছু করতে পারবে না—।’
‘যাচ্ছি।’ বিশ্বনাথের গলা স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল।
‘শিগগির চলে এসো।’ উচ্ছ্বল গলায় বলল তিতলি, ‘আমি তো ওয়েট করছি! আজ রাতে আমার ফ্ল্যাটে তুমি থেকে যাবে—।’
‘যাচ্ছি—।’ আবার বললেন বিশ্বনাথ। বইপত্র পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে যেটুকু তিনি জেনেছেন, তাতে কুড়ুলের ঘায়ে ভ্যাম্পায়াররা খতম হয় না। কাঠের বল্লম দিয়ে ফুঁড়ে দিতে হয় তাদের হৃৎপিণ্ড। সুতরাং কোনও ভয় নেই। এক্ষুনি ওর বীভৎস ক্ষতের জায়গাটা অলৌকিক ম্যাজিকে মোলায়েম হয়ে জুড়ে যাবে। তারপর, বিশ্বনাথ উঠে বসবেন। তিতলির…।
কিন্তু গল্পের সঙ্গে, সিনেমার সঙ্গে, ব্যাপারটা মিলছিল না। শরীরটা কাহিল হয়ে আসছিল, হাঁ করে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন, আর চোখের নজর দ্রুত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।
বোকার হদ্দ মেয়েটা তখনও ফোনে পাগলের মতো চেঁচাচ্ছিল, ‘বাষট্টি, তুমি আসছ তো? বাষট্টি! বাষট্টি…।’
বিশ্বনাথের শিথিল হাত থেকে মোবাইল ফোনটা খসে পড়ে গেল ঘাসের ওপরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘যাচ্ছি…।’