Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অপরাহ্ন – 5

নিবারণ ওঝার বয়স সত্তরের উপরে।

দড়ি-পাকানো চেহারা। মুখটি অসম্ভব ক্ষুদ্র। বছর দশেক আগে বা চোখে মানকাঁটার খোঁচা লেগেছিল। সেই চোখটি নষ্ট। অন্য চোখটি অস্বাভাবিক লাল। লাল চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ। রাতে সব কিছুই ছায়া-ছায়া মনে হয়। দিনে রোদের আলোয় চোখ মেলতে পারে না। করকর করে। সারাক্ষণই চোখ থেকে আঠাল কষের মত পানি ঝরে। বড় কষ্ট হয়। সার্বক্ষণিক কষ্টও এক সময় সহ্য হয়ে যায়। নিবারণ চোখের যন্ত্রণা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে পারে। গত বছর গঞ্জের হাসপাতালে গিয়েছিল। ডাক্তার চোখে টর্চের আলো ফেলে বিরক্ত মুখে বললেন, আপনি কী করেন? চাষবাষ না অন্য কিছু?

নিবারণ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি ওঝা। সাপের বিষ ঝাড়ি।

কড়ি চালনা জানেন?

তা জানি। জানুম না ক্যান? বিদ্যা শিখছি।

কোনোদিন কড়ি চালনা করে সাপ এনেছেন?

জ্বে আজ্ঞে, আনছি।

মিথ্যা কথা বলতে মুখে আটকায় না? সত্যি কথা বলেন, নয়তো অষুধ দেব না।

ডাক্তার কেমন নিষ্ঠুরের মতো তাকিয়ে থাকেন। বিড়বিড় করে বলেন, এইসব ঝাড়ফুকের ওস্তাদরা গরিব মানুষগুলিকে লুটেপুটে খাচ্ছে।

কী অদ্ভুত কথা! লুটেপুটে খেলে নিবারণের আজ এই অবস্থা? নিবারণের জ্যাঠার ছেলে কৃষ্ণ যদি খাবার নিয়ে আসে, তাহলেই তার খাওয়া হয়। কৃষ্ণ একবারই খাবার আনে-দুপুরে। সকাল থেকে নিবারণ ভাবে, আজ কী খাবার আনবে কৃষ্ণ? প্রায়ই মিলে যায়। তখন বড় আনন্দ হয়।

আজ কেন জানি মনে হচ্ছে কৃষ্ণ ভালো কিছু আনবে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই মনে হচ্ছে। খিদেও এই কারণে খুব জানান দিচ্ছে।

ঘরে কিছু মুড়ি আছে। মুড়ি খেয়ে কয়েক ঢোক পানি খেলে হয়। কিন্তু নিবারণের উঠতে ইচ্ছা করছে না। খিদে নষ্ট করে লাভ নেই। কৃষ্ণ যদি সত্যি-সত্যি ভালো কিছু আনে!

তার খড়ের ছাউনির একচালাটির তার মতোই অন্তিম দশা। গোলঞ্চ আর বয়রা গাছের জঙ্গল চালটিকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। এই অঞ্চলের এত নামী একজন ওঝার বাসস্থানটি দেখে চমকে যেতে হয়।

জলিল মিয়াও চমকে গেল। বাড়ির উঠোনে নিবারণ ওঝা বসে আছে। লাল চোখে তাকিয়ে আছে একসারি পিপড়ার দিকে। কিছুক্ষণ পরপরই প্রবল বেগে মাথা চুলকাচ্ছে। মাথায় চুল নেই বললেই হয়। অল্প যা আছে, তাতে জটা ধরেছে। জলিল বলল, নিবারণ ভাই ভালো আছেন?

নিবারণ মাথা চুলকানো বন্ধ করে ঠাণ্ডা গলায় বলল, কোন গ্রাম?

বানিয়াবাড়ি।

নৌকা আনছেন?

আনছি।

রুগী পুরুষ না মাইয়া?

পুরুষ।

আইছা। বসেন, জামাটা গায়ে দিয়া আসি।

বসার কোন জায়গা নেই। জলিল দাঁড়িয়ে রইল। নিবারণ ওঝার সঙ্গে আর কেউ বোধহয় থাকে না। বাড়ির ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না। জলিল মিয়াকে দীর্ঘ সময় একা-একা দাঁড়িয়ে থাকতে হল। জামা গায়ে দিতে নিবারণ ওঝার এত সময় লাগার কথা নয়।

একটু দেরি হইল। মুড়ি ছিল চাইরডা, খাইলাম। খিদা লাগছিল।

জলিল মিয়া লক্ষ করল, নিবারণ বেশ ফর্সা একটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে এসেছে। পায়ে রবারের জুতা।

আপনেরে পান-তামুক কিছু দিতে পারলাম না। ঘরে কিছু নাই।

কিছু দরকার নাই নিবারণ ভাই। আপনেরে পাওয়া গেছে, এইটাই বড় কথা।

আপনের নাম কি?

জলিল।

রুগী আপনের কে হয়?

আমার কিছু হয় না। দোস্ত মানুষ।

কাটছে কোন সময়?

ভোররাইতে।

আপনেরে একটা কথা কই। রুগী বাঁচানি মুশকিল হইব। মঙ্গলবারে কাটছে। শনি আর মঙ্গল এই দুই দিনে সাপের বিষের তেজ থাকে বেশি। বুঝলেন বিষয়ডা?

জলিল জবাব দিল না। সে লম্বা-লম্বা পা ফেলছে। নিবারণকে যত তাড়াতাড়ি গ্রামে নিয়ে উপস্থিত করা যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু নিবারণ হাঁটতে পারছে না। একটা পা টেনে-টেনে সে যাচ্ছে। এই লোকটিরও সময় বোধহয় শেষ হয়ে আসছে। থামতেও হচ্ছে নানান জায়গায়। গ্রামের মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। হাজারো প্রশ্ন করছে।

কোন গ্রামে?

কারে কাটল?

ক্যামনে কাটল?

বয়স কত?

কী সাপ?

জলিল এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো আগ্রহ বোধ করছে না, কিন্তু নিবারণ করছে। সে শুধু যে দীর্ঘ সময় নিয়ে উত্তর দিচ্ছে তাই নয়, উত্তরের শেষে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে শনি-মঙ্গলবারে কৃষ্ণপক্ষের সময় সাপে-কাটা রুগী বাঁচান অসম্ভব ব্যাপার। অন্য কোন ওঝা হলে ঘর থেকেই বেরুত না, সে বলেই বেরুচ্ছে।

নৌকায় উঠেও নিবারণের কথা বন্ধ হল না। নিজের মনেই বকবক করতে লাগল। তার মূল বক্তব্য হচ্ছে, ওঝাগিরি করে তার লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে স্বাস্থ্য নষ্ট, মনের শান্তি নষ্ট। বাড়িতে দালান-কোঠা ওঠে নি। সিন্দুক টাকাপয়সায় ভর্তি হয় নি। কারণ রুগীর কাছ থেকে টাকাপয়সা নেওয়া ওস্তাদের নিষেধ। অবশ্যি রুগী ভালো হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে যদি পালাপার্বণে খুশি হয়ে কেউ কিছু দেয় তাতে দোষ হয় না। কিন্তু কেউ দেয় না।

সব ঠনঠন। বুঝলা, ঠনঠন। দুই বেলা পেটে ভাত হয় না।

শিখলেন ক্যান এই কাম?

জানি না ক্যান শিখলাম, অখন পস্তাই। রাইতে ঘুম হয় না। বিছানার কাছে সাপ আনাগোনা করে। এরা সুযোগে আছে। বুঝলা, সুযোগ খুঁজছে। আমার দিনও শেষ।

বয়স কত আপনের?

কে জানে কত! হিসাবপত্তর নাই।

বিয়া-শাদি করেন নাই?

করছিলাম। বৌটা মরছে সাপের কামড়ে। ঘরে ছিলাম না। এই সুযোগে কাম শেষ করছে।

নিবারণ একটি নিঃশ্বাস ফেলল।

সারা রাইত বাত্তি জ্বালাইয়া রাখতে হয়। সাপের আনাগোনা জ্বালাইতে কেরোসিন লাগে, কে দিব কেরোসিনের পয়সা।

জলিল দ্রুত বৈঠা ফেলছে। বাতাস দিচ্ছে। বাতাস কেটে যেতে হচ্ছে বলেই বড় পরিশ্রম হচ্ছে। বুদ্ধি করে আরেকজন কাউকে সঙ্গে করে আনলে হত। নিবারণ চোখ বন্ধ করে আছে। সম্ভবত ঘুমিয়েই পড়েছে।

জলিল লক্ষ করল রোদের তেজ একটু যেন কম। তার বুকে ছাৎ করে উঠল। ঢল নামবে না তো? সর্বনাশ হয়ে যাবে। ধান কটা মাত্র শুরু হয়েছে। অবশ্যি আকাশ চকচকে নীল। এক খণ্ড মেঘও নেই। তবু জলিলের মনে হল, রোদের তেজে ভাটা পড়েছে। নিশ্চয়ই মনের ভুল।

বানিয়াবাড়ির মাটিতে নেমেই নিবারণ গম্ভীর মুখে ঘোষণা করলনয়া মাটির পাতিলে এক পাতিল কালা গাইয়ের দুধ লাগব। একটা পাঁচহাতি গামছা, স্বর্ণসিন্দুর আর তালমিছরি লাগব।

গ্রামে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। ওঝা বিষ ছাড়াতে এসেছে, এমন উত্তেজনার ব্যাপার দীর্ঘদিন এই গ্রামে ঘটে নি। গ্রামের সব মানুষ ভেঙে পড়ল মনিরউদ্দিনের বাড়িতে।

নিবারণ ওঝা হাঁটছে রাজকীয় চালে। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। কথাবার্তা তেমন বলছে না। মাঝে হঠাৎ দাঁড়িয়ে সন্দেহজনকভাবে চারদিকে তাকাচ্ছে। সবাই থমকে দাঁড়াচ্ছে। তাদের কৌতূহল যখন তুঙ্গে, তখনই আবার সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করছে।

জীবন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। নিবারণ ওঝা হয়তো এ-মানুষটিকে বাঁচিয়ে তুলবে, হয়তো তুলবে না। এই সময়টির মতো রহস্যময় সময় আর কী কতে পারে?

মনিরউদ্দিনকে উঠোনের মাঝখানে একটি জলচৌকিতে বসানো হয়েছে। হয়তো সূর্যের আঁচেই তার মুখ লাল হয়ে আছে। চোখের কোণ ফোলা-ফোলা।

নিবারণ নতুন গামছা পানিতে ভিজিয়ে মনিরউদ্দিনের মুখ মুছিয়ে গামছাটা তার কাঁধে জড়িয়ে দিল। শান্ত গলায় বলল, হাত-মুখ ধোয়ার জল দেন আমারে। কালা গাইয়ের দুধ জোগাড় হইছে?

জানা গেল দুধের জোগাড় এখনো হয় নি।

কাঁইক্যা মাছের দাঁত দরকার। চাইর-পাঁচটা নতুন কলাপাতা আনেন। পিতলের কলসিতে এক কলসি জল দেন। আর শুনেন মা সকল, আপনারার মধ্যে যারা বিধবা, তারা মন্ত্র পড়ার সময় দূরে থাকবেন। অপরাধ নিয়েন নাগগা মা সকল। এইটাই হইতাছে নিয়ম।…

পুলাপানরে দূরে থাকতে কন। এইটা রঙ্গ-তামাশার জায়গা না। বড় কঠিন। সমস্য।

কালো গাইয়ের দুধ এসে পড়েছে। নিবারণ মনিরউদ্দিনের সাপে-কাটা পায়ের গোড়ালি দুধে ড়ুবিয়ে মুখ অন্ধকার করে ফেলল।

বিষ খুব তেজী। উঠছে অনেক দুর। কালনাগের বিষ। বড় কঠিন সমস্যা।

মন্ত্রপাঠ শুরু হল। ছোটখাটো নিবারণ ওঝা, এখন একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব। তার কণ্ঠ গমগম করছে–

ও বালা লখিন্দররে…
কোন কাল ভুজঙ্গ তরে খাইলরে!……

এতগুলি মানুষ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিবারণ ওঝার মন্ত্র ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এক সময় নিবারণ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। বড়-বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। ঠিক তখন শরিফার কান্নার শব্দ শোনা গেল। সে কাঁদছে ক্ষীণ স্বরে। কিন্তু মাঝে। মাঝে ক্ষীণ স্বরও তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

মনিরউদ্দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, তিয়াষ লাগছে, পানি দে। ও শরিফা, শরিফা।

তার চারপাশে এতগুলি মানুষ, কিন্তু সে নির্লজ্জর মতো স্ত্রীকে ডাকছে।

নিবারণ বলল, পানি অখন খাইয়েন নাগগা বাপধন। তালমিছরির টুকরা চোষেন। পানি খাইলে শরীর টিলা হইয়া যাইব।

হউক টিলা ও শরিফা, পানি দে।

নিয়ম-কানুন তো আছেগগা বাপধন।

থাউক নিয়ম-কানুন ও শরিফা, শরিফা।

নিবারণ হতাশ ভঙ্গিতে তাকাল সবার দিকে, তারপর এমনভাবে মাথা নাড়ল, যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, সে কোনো আশা দেখছে না।

জলিল কড়া ধমক দিল, মনির, ওঝা যা কইতেছে হোন।

পানির তিয়াষ লাগছে।

তিয়াষ লাগছে পানি খাইবা। এট্টু সবুর কর।

অনেকেই কথা বলে উঠল। সবারই একই বক্তব্য, সবুর কর। নিবারণ বাঁ হাতে এক চিমটি স্বর্ণসিন্দুর নিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুতোর সঙ্গে মন্ত্রপাঠ শুরু করল–

ভৈরবী ছিন্নমস্তা, চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।

বগলা সিন্ধাবিদ্যা চ মাতাঙ্গি কমলাত্রিকা।

এতো দশমহাবিদ্যাঃ সিন্ধাবিদ্যাঃ প্রকীৰ্ত্তিকা।……

নিবারণের মুখে ফেনা জমে উঠছে। রক্তবর্ণের চোখে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা। তাকে এই জগতের মানুষ বলে এখন আর মনে হচ্ছে না। অনেকখানি দূর থেকে ডান হাত ঘোরাতে ঘোরাতে সে ছুটে আসছে। থমকে দাঁড়াচ্ছে মনিরউদ্দিনের সামনে। ঝড়ের বেগে নেমে আসছে ঘুরন্ত হাত। সেই হাত গিয়ে পড়ছে মনিরউদ্দিনের উরুতে। মনিরউদ্দিন প্রতিবারই ধমকে উঠছে—আহু, কী করেন?

নিবারণ অতি দ্রুত কী-সব বলছে তা এখন আর বোঝার উপায় নেই। শব্দ হচ্ছে। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো। কতক্ষণ এরকম চলবে কে জানে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress