Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অপরাহ্ন – 4

মামি সবসময় বলত–মাইয়ামাইনষের উপরে গোস্বা করবি না। এরা উলটাপালটা কাম করে। বুদ্ধি-কম জাত, কি করবি?

মনিরউদ্দিন মামি যা বলত তাতেই মাথা নাড়ত। কারণ তার তখন চরম দুঃসময়। মনে ভয় ঢুকে গেছে। মনে হচ্ছে মামিও তাকে দূর করে দেবে। একদিন কাছে ডেকে এনে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলবে, আকালের দিন পড়ছে রে বাপ! একটা বাড়তি পেটের জায়গা নাই। তুই অন্য জায়গা দেখ।

এই বলে সে খানিকক্ষণ কাঁদবে খুনখুন করে, তারপর একটা চকচকে সিকি হাতে ধরিয়ে দেবে। সাত বছর বয়সের মনির মিয়াকে তার ইহজাগতিক সম্বল একটি লুঙ্গি এবং একটি গামছা কাঁধে নিয়ে নতুন আশ্ৰয় খুজতে হবে। কোথায় খুঁজবে সে? খোঁজা হয়ে গেছে। কোথাও আর কেউ নেই।

কিন্তু মামি চরম আকালের দিনেও তাকে বের করে দেয় নি। উঠতে-বসতে এক শ কথা শোনায় নি। বরং আড়ালে-আবডালে ডেকে নিয়ে বলেছে, মাটি কামড় দিয়া পইড়া থাক। তোর মামা মাইরধর করব, খেদাইয়া দিতে চাইব। পুলাপান মানুষ তুই, যাইবি কই? খাইবি কী? আমি যত দিন আছি, তুইও থাকবি।

কী ভয়াবহ দুৰ্দিন। বৈশাখের ফসল মারা গিয়েছে। নাবাল অঞ্চলের ফসল এই একটিই। মানুষ খাবে কী?মনিরউদ্দিনের মামা চোখ লাল করে সারা দিন উঠোনে বসে থাকে। তার দিকে তাকালেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় মনিরউদ্দিনের। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, মামা তাকে কিছু বলে না। সংসারের তিনটিমাত্র পেট পালতে গিয়ে লোকটি দিশাহারা হয়ে যায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড গরমে খা-খ করে গ্রাম। মনিরউদ্দিন দুপুরে একা-একা ঘুরে বেড়ায়। বাড়ি ফিরলেই আমি ফিসফিস করে বলে, অত হাঁটাহাঁটি করিস না। হাঁটাহাঁটি করলেই খিদা লাগব। খিদা লাগলে খাবি কী? পাতিল ঠনঠন।

সেই এক বৎসরেই মামা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেল। অসুখবিসুখে শরীরও নষ্ট। মুনিষের কাজ, ঘরামির কাজ কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কাঁঠালগাছের নিচে একটা চাটাই পেতে সারা দিন শুয়ে থাকে। বিড়বিড় করে সারা দিন কথা বলে কাঁঠালগাছের সঙ্গে। মজার-মজার কথা। হাত নাড়িয়ে-নাড়িয়ে বলে আর হাসে। মাঝেমাঝে চুপ করে থাকে, তখন তার ভঙ্গি দেখে মনে হয় সে কথা শুনছে। লোকজন অবাক হয়ে দেখতে আসে। সে নির্বিকার। মনিরউদ্দিনও দেখে চোখ বড়-বড় করে, কাছে যেতে সাহস পায় না।

মামি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, মানুষটার মাথা-খারাপ হইছে বুঝছস মনির মিয়া? গাছের সাথে দোস্তি। রাইজ্যের আলাপ করে গাছের সাথে। কী সব্বনাশের কথা ক দেখি।

এই বলেই সে হাসে খিলখিল করে। মনিরউদ্দিন বুঝতে পারে না, তার হাসা। উচিত কি না।

ও মনির মিয়া, লোকটা পাগল হইলেও কিন্তু খারাপ না কি কস? এই যে অত দিন থাকলি—একটা কথা হইছে? অন্য কেউ হইলে লাথ দিয়া বাইর কইরা দিত। দিত কি না?

দিত।

পেটের খিার মতো খারাপ জিনিস নাই। বাঘেরা পেটে যখন খিদা ওঠে, তখন কী করে জানস?

না।

নিজের বাচ্ছা খায়। বিলাইও নিজের বাচ্ছা খায়। নিজের চউক্ষে দেখা। আল্লাহর কিরা।

মামার চিকিৎসা কিছু হল। গ্রাম্য চিকিৎসা। মাথা কামিয়ে খালিশপুরের পীর সাহেবের তেল-পড়া। তাতে লাভ হল না। শুধু মামার মুখটা শিশুদের মুখের মত হয়ে গেল। লোকটা মারা গেল ভাদ্র মাসে। যথারীতি গাছের নিচে শুয়ে ছিল। সন্ধ্যাবেলা রুটি আর ডাল নিয়ে খাওয়াতে গিয়ে দেখা গেল শক্ত হয়ে পড়ে আছে। মুখ হাঁ-করা। অসংখ্য লাল পিপড়া সারিবদ্ধভাবে মুখের ভেতর ঢুকছে এবং বের হয়ে আসছে।

মনিরউদ্দিনের মামি মৃত্যুকে গ্রহণ করল খুব স্বাভাবিকভাবে। তাকে দেখে মনে হল না, সে খুব-একটা মন-খারাপ করেছে। কান্নাকাটি হৈচৈ কিছুই নেই। দুঃসময়ে এক জন মানুষ কমে গেল, এই নিয়ে সম্ভবত কিছুটা খুশি। মনিরউদ্দিনকে দিয়ে গ্রামের মাতবরদের বলে পাঠাল, লেকটার কবর যেন কাঁঠালগাছটার নিচে দেওয়া হয়।

মাতবরদের একজন বজলু সরকার। লোকটি যে-কোনো কথাতেই রেগে ওঠেন। তিনি যথারীতি রেগে গিয়ে বললেন, কেন, কাঁঠালগাছের নিচে কেন?

গাছটার সাথে শেষ সময় মানুষটার দোস্তি হইছিল। নানান কথা কইত।

বজলু সরকার আকাশ থেকে পড়ল। বলে কী এইসব। সে বিস্ময় গোপন করে বলল, কী বলো তুমি? কার সাথে দোস্তি?

গাছের সাথে।

পাগল-ছাগলের মতো কথা কইবা না। আর শোন, স্বামী মারা গেল, চউক্ষে এক ফোঁটা পানি নাই—কেমন মেয়েমানুষ তুমি?

চউক্ষে পানি না-আইলে কি করমু কন?

আরে, এইটা তো মহা বেয়াদপ, মুখে-মুখে কথা কয়! এইসব কিয়ামতের নিশানা।

সত্যি-সত্যি কিয়ামতের নিশানা। পরের বৈশাখেও ফসল মারা পড়ল। পাকা ধানের খেত তিন ঘন্টার বৃষ্টিতে পানির নিচে গেল। বানিয়াবাড়ি গ্রামের মানুষগুলি পাথর হয়ে গেল। এটা কেমন কথা! আল্লাহ্‌র কেমন বিচার?

মৌলানা খবির হোসেন নানান জায়গায় বলে বেড়াতে লাগলেন, তিনি জানতেন এমন হবে। ধর্মের পথে কেউ নাই। জুম্মার দিনে নামাজঘরে দশটা লোক হয় না। তিনি অনেক দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন। এরকম নাকি কখনো দেখেন নি।

খবির হোসেনের এ-ধরনের কথা বলার অধিকার আছে। তিনি বিদেশি লোক। বহু দেশ-গ্রাম ঘুরে এখানে এসে স্থায়ী হয়েছেন। প্রথম যখন এলেন, তখন বানিয়াবাড়ির খুব রমরমা। মাঠভর্তি পাকা ধান। বৃষ্টি-বাদলায় একটি ধানের শিষও নষ্ট হয় নি। ধান কাটা হচ্ছে। রাত জেগে মেয়েরা সেই ধান সেদ্ধ করছে। হৈচৈ, চিৎকার। খবির হোসেনের বিস্ময়ের সীমা রইল না। এত ফসল ফলে ভাটি অঞ্চলে। এ দেখি আল্লাহতালার নিয়ামতের জায়গা!

তাঁর বিস্ময় দেখে বানিয়াবাড়ির লোকজন মহাখুশি। তারা দাঁত বের করে হাসে। একটা ফসল তুলি, বুঝলেন মৌলানা সাব, তারপরে পায়ের উপরে পা তুইল্যা সারা বচ্ছর খাই। ভাতের অভাব নাই।

তাই তো দেখতেছি।

এইটা হইল মৌলানা সাব ফুর্তির জায়গা। আমরা নিজেরার গানের দল আছে। বাইদ্যবাজনা হয়।

এইসব তো ঠিক না। গান-বাজনা হাদিস-কোরানে নিষেধ আছে।

চেংড়া-ফেডোরা করে আর কি। কাজকর্ম তো কিছু নাই—কি করবেন কন?

গ্রামের মুরুঝিরা বললেন, থাইকা যান মৌলানা সাব। গেরামে মসজিদ আছে। আজান দিয়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বেন। হাদিস-কোরানের কথা কইবেন। খাওয়াখাইদ্যের কোনো চিন্তা নাই। খোরাকি বাদ দিয়াও বছরে চল্লিশ-পঞ্চাশ মণ ধান পাইবেন। বিয়া-শাদি, পালা-পার্বণে মসজিদের ইমাম সাবের জন্যে আলাদা বন্দোবস্ত আছে। বানিয়াবাড়ি জায়গা খারাপ না।

খবির হোসেন থেকে গেলেন। এরা ভুল বলে নি। জায়গা ভালোই। রাতদিন মাঠের উপর দিয়ে হু-হু করে হাওয়া বয়। মন আনচান করে। বর্ষাকালে পানিতে ঢেকে যায় চারদিক। তখন ভাটি অঞ্চলের অন্য রূপ। বিয়ে-শাদি শুরু হয়। গানের দল দিনরাত ঢোল বাজিয়ে গান করে। মহা উৎসাহে বুডোর দল ঘন্টার পর ঘন্টা খেলে বাঘবন্দি। কাজকর্মের কোনোবালাই নেই। বর্ষার সময়ে কাজ একটাই-খাওয়া এবং ঘুম। বড় বিচিত্ৰ জায়গা। খবির হোসেনের বড় পছন্দ হল ব্যাপারটা। একটা বিয়ে-শাদি করে সংসারধর্ম শুরু করার ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। জমি সস্তা। কিছু জমিজমা করা খুব কঠিন হবে না। ভাটি অঞ্চলের সস্তার ধান কিনে উজান দেশে বিক্রি করলেও ভালো পয়সা। সেটাও করা যায়, এতে দোষের কিছু নেই। স্বয়ং রসুলুল্লাহ ব্যবসাবাণিজ্য করতেন। রুজির বার আনা হল গিয়ে ব্যবসায়। হাদিসের কথা। রসূলুল্লাহ্ নিজে তাঁর সাহাবিদের বলে গেছেন।

টাকাপয়সা হওয়া দোষের না। টাকাপয়সা থাকলে মনে শান্তি থাকে। আল্লাহখোদর নাম নেওয়া যায়। পেটে ক্ষুধা থাকলে মনে ঢোকে শুধু ভাতের চিন্তা। বড় চিন্তা আসে না।

এই যেমন এখনকার অবস্থা—বড় ভালো আছেন। মনে বড় শান্তি। আল্লাহকে ডাকতে পারছেন। ইবাদত-বন্দেগি করেও আরাম পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু শেষের দু বছরের অবস্থা দেখে খবির হোসেনের মাথা-খারাপ হবার জোগাড়। এ কী সর্বনাশের জায়গা। ইয়া মাবুদে এলাহি, ইয়া গাফুরুর রহিম। সমস্ত ফসল একসঙ্গে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এই ধারণাই তাঁর মাথায় আসে নি। পরবর্তী ফসলের জন্যে এই লোকগুলির আরো একটা বৎসর অপেক্ষা করতে হবে। এরা এখানেই থাকবে। অন্য কোন কাজকর্মের ধান্ধায় ঘর ছেড়ে বেরুবে না। কারণ, অন্য কাজকর্ম তাদের জানা নেই। উজানের দেশ থেকে ধুরন্ধর সব লগ্নিকারী টাকা নিয়ে আসবে। লগ্নি করবে পরের বছরের জন্যে। এক মণ ধানের টাকায় চার মণ ধান দিতে হবে। খবির হোসেন গত বৎসর এই জিনিস হতে দেখেছেন। এই বৎসরও দেখবেন। তারপর যদি সামনের বৎসরও ফসল না হয়, তখন?

মৌলানা সাহেব রোজ চিন্তিত মুখে বজলু সরকারের কাছারিঘরে বসে থাকেন। কারণ এই অভাবের দিনে তাঁর খাবার যায় এই বাড়ি থেকে। বজলু মিয়াকে তুষ্ট রাখা দরকার। বজলু মিয়া তুষ্ট হন না। বিরক্ত স্বলে বলেন, রোজ আইসা বইস্যা থাকেন, ক্যান?

কই যামু, কন?

মৌলানা মানুষ, মসজিদে গিয়ে বইস্যা থাকেন। আল্লাহ-খোদারে ডাকেন।

বড় অসুবিধার জায়গা ভাই এইটা। একটা মোটে ফসল। ফসল গেল তো সব। গেল। কী নাশের কথা।

দুনিয়ার সব জায়গা তো এক রকম না।

তা ঠিক, তা ঠিক। আল্লাহপাক বালির দেশও বানাইছে। যেমন ধরেন মরুভূমি।

বজলু সরকার উত্তর দেন না। রাগী চোখে তাকিয়ে থাকেন। মৌলানা সাহেব নিজের মনেই কথা বলেন, আল্লাপাকের খাস রহমতের জায়গা হইল গিয়া মরুভূমি। নূরনবীর জন্মস্থান।

এখন বাড়িত যান মৌলানা সাব।

জ্বি আচ্ছা। আমি একটা কথা কইতে আসছিলাম।

কি কথা?

ভাবছি দেশে চইলা গেলে কেমন হয়?

যাইতে চাইলে যান। আপনেরে কেউ বাইন্ধা রাখছে?

মসজিদে নামাজ হবে না এইটা নিয়ে মনে একটু কষ্ট, নামাজঘরে পাঁচ ওয়াক্ত আজান হওয়া লাগে, না হইলে আল্লাহ্পাক খুবই নাখোশ হন। আল্লাহ্‌র গজব নামে।

গজবের আর বাকি আছে?

তাও ঠিক। খুবই ন্যায্য কথা।

বাড়িত যান-বাড়িত গিয়া ঘুমান।

খবির হোসেন চিন্তিত মুখে বাড়ি ফেরেন। রাতে তাঁর ঘুম হয় না। কী সর্বনাশের দেশ। এমন দেশে মানুষ থাকে? নাকি এটা তাঁর ভাগ্য? যেখানে যান সেখানকার অবস্থাই বদলে যায়। তিনি কি মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা সাথে করে নিয়ে আসেন। এরকম অপয়া লোক কিছু-কিছু আছে। দুর্ভাগ্য তাদের ঘিরে থাকে। শুধু তাদেরই না, যারাই এইসব লোকজনের সংস্পর্শে আসে তাদেরও এই অবস্থা। তিনি নিজের জীবনেই এটা লক্ষ করেছেন। কত জায়গায় গেলেন, সুখে-শান্তিতে জীবন শুরু করলেন। যেই ভাবলেন এইবার স্থায়ী হবেন, যাযাবর জীবনের ইতি করবেন, নিজের ঘরসংসার, সামান্য কিছু জমিজমা, ধবধবে সাদা রঙের একটা গাই, উঠোনে পুঁইয়ের মাচা, বাড়ির পেছনে লকলকে ডাঁটা খেত, কয়েকটা হাঁস-মুরগি, সন্ধ্যাবেলায় যাদের ঘরে আবার জন্যে তাঁর স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে বেরুবে, নিচু গলায় বলবে, তই তই তই ঠিক তখন একটা ঝামেলায় সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে হয়েছে। আল্লাহপাক এত নারাজ কেন তাঁর উপর? তিনি কি আল্লাহপাকের আদেশ মাথা পেতে পালন করেন নি? রসুলে করিমের শিক্ষা অন্যদের বলেন নি? ভুলত্রুটি তিনি যদি কিছু করেই থাকেন, না-বুঝে করেছেন। আল্লাপাক তার জন্যে এমন কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা কেন করবেন? তিনি হচ্ছেন রহমতের সাগর। সেই রহমতের ছিটেফোঁটাও কি তাঁর জীবনে আসবে না? তিনি কি এতই নাদান। রাত জেগে খবির হোসেন তাহাজ্জতের নামাজ পড়েন। বিড়বিড় করে বলেন দয়া কর, দয়া কর। পানা দাও। আমার জন্যে গ্রামের মানুষগুলিকে তুমি কষ্ট দিচ্ছ কেন? এদের মুক্তি দাও।

খবির হোসেনের বারবার মনে হয়, তিনি গ্রাম ছেড়ে গেলেই সবসমস্যার সমাধান হবে। এই বানিয়াবাড়িতে সুখের প্লাবন বইবে। এমন ফসল ফলবে যে কেটে আনতে ইচ্ছা করবে না। চাঁদের ফকফকা আলোয় ছেলেপুলেরা ছোটাছুটি করবে। বৃদ্ধবৃদ্ধারা ভরপেটে ঘুমুতে যাবে।

অভাব চরমে ওঠে ভাদ্র মাসে। হাড়-জিরজিরে শিশুরা অলস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়। বেশির ভাগ সময়ই তারা ঘাটে বসে থাকে। কিছুদিন আগে বড় নৌকায় করে সাহায্য এসেছিল। আটা, চিড়া এবং অষুধপত্র। তারা বলে গিয়েছিল আবার আসবে। যদি আসে। সাহায্যের লোকজন আসে না, কিন্তু নানান ধরনের মানুষজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। এই ধরনের লোকদের অভাবের সময় দেখতে পাওয়া যায়। এদের কথাবার্তা খুব মোলায়েম। গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে। মিনিটে-মিনিটে সিগারেট সাধে। বানিয়াবাড়ির সবাই জানে, এরা হচ্ছে মতলবাজ লোক। বদ মতলব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তবু চুপ করে থাকতে হয়। দুঃসময়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।

গ্রামের মাত্ররা যদিও বলে বেড়ায়—কেউ যেন হালের গরু বিক্রি না-করে। গরু চলে গেলে হাল বন্ধ হয়ে যাবে। সব বেচে দিক, কিন্তু গরু যেন থাকে। অনেকেই তাদের কথা শোনে না। নানান কিসিমের নৌকায় ভাটি অঞ্চলের গরু-ছাগল পার হতে থাকে। পশুরা গভীর মমতায় চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে থাকে গ্রামের দিকে। ভাদ্র মাসের ভরা নদী ছল-ছলাৎ করে।

এই রকম চরম দুঃসময়ে মনিরউদ্দিনের মামি চাঁনসোনার ঘরে গ্রামের মাত্ররা একত্র হন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ হচ্ছেন নিয়ামত খাঁ। তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, এইসব কি করতাম তুমি চাঁনসোনা? ছিঃ ছিঃ।

চাঁনসোনা উত্তর দেয় না। দরজার ওপাশ থেকে তার কাঁচের চুড়ির শব্দ পাওয়া যায়।

অভাব তো আছেই। বেজায় অভাব। শুধু এই গ্রাম তো না, ভাটি অঞ্চলে কোনো খাওন নাই। তাই বইলা রাইতে-বিরাইতে বিদেশি লোকজন তোমার ঘরে আনাগোনা করব?

চাঁনসোনা ফিসফিস করে কী উত্তর দেয়, পরিষ্কার শোনা যায় না। নিয়ামত খা গলা খাকারি দিয়ে বলেন, তুমি এই গেরাম ছাইড়া যাও গিয়া।

কই যামু,কন?

বাপের বাড়ির দেশে যাও। ভাই-বেরাদরের সাথে গিয়া থাক।

বাপের বাড়িত আমার কেউ নাই।

তুমি মানুষের চউখের উপরে আকাম-কুকাম করতাছ। এর আগেও দুইবার খবর দিছি। দেই নাই? তোমার গেরাম ছাড়ন লাগব চাঁনসোনা।

মনির মিয়ারে কী করমু? হে কী খাইব?

তার ব্যবস্থা হইব। রুজিরোজগারের মালিক আল্লাহুপাক। তুমি-আমি কেউ না।

দরজার ওপাশ থেকে ক্ষীণ স্বরে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। নিয়ামত খাঁ ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি থাক, কিন্তু খবরদার, আর যেন কিছু না শুনি।

নিয়ামত খাঁর গলায় মমতা টের পাওয়া যায়। মমতার কারণ স্পষ্ট নয়। আলোচনা শুরুর আগে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন এইজাতীয় মেয়েছেলে গ্রামে রাখা যাবেনা। জোয়ান ছেলেপুলের চরিত্র নষ্ট করবে। এরা থাকুক যেখানে তাদের মানায়, সেখানে। গঞ্জের খুপরিতে। সন্ধ্যায় পান খেয়ে ঠোঁট লাল করবে। ঘরের দাওয়ায় অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে। ইশারা-ইঙ্গিত করবে, রঙ্গ-তামশা করবে। ঝুনঝুন করে বাজাবে লাল কাঁচের চুড়ি। কুপির লাল আলো পড়বে তাদের গিন্টি-করা গয়নায়। গয়না ঝিকমিক করবে। চাঁনসোনার মতো মেয়েদের এই একমাত্র গতি।

বড়-বড় অভাবের সময় এরকম দু-একটা মেয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এটা নতুন কিছু না, আগেও গিয়েছে। এদের যাওয়াই উচিত। তবু শেষ সময়ে নিয়ামত খাঁ আপোসের স্বর বের করছেন শুনে সবাই অবাক হয়। মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এর মানে কী? নিয়ামত খাঁ তাদের অস্বস্তি টের পান। মুখ থেকে দয়া ভাব মুছে ফেলে কঠিন স্বরে বলেন, তবে একটা কথা চাঁনসোনা, এম্নে থাকন সম্ভব না, তোমারে নিকা করন লাগব। আমার কথা বুঝছ?

মাতব্বররা এবার নড়েচড়ে বসেন। আলোচনার এই অংশটা তাদের ভালো লাগে। চাঁনসোনার শরীরে অভাব-অনটনের ছাপ নেই। গোলাকার মুখে স্নিগ্ধ ছায়া। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল-গৌর। চুলের গোছা নদীর ঢেউয়ের মতো ঢেউ তুলে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।

বিয়া-শাদি কইরা থাকবা ভদ্রলোকেরা মাইয়ার মতো। কাজ-কাম করব।

কে আমারে বিয়া করব?

নিয়ামত খাঁর গা জ্বলে গেল। কত বড় সাহস, নিজের মুখে বিয়ের কথা বলছে, একটুও আটকাচ্ছে না। গলার স্বরেও কোনো রকম অস্পষ্টতা নেই। তিনি নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললেন, শখ কইরা কেউ তোমারে বিয়া করত না। দয়া কইরা করব।

কে করব এই দয়া? আফনে?

চুপ হারামজাদি, যত বড় মুখ না তত বড় কথা! শইল্যে তেল বেশি হইছে? তর একটা উবগার করতে চাই, তুই বুঝস না?

তুই-তোকারি কইরেন না।

নিয়ামত খাঁ স্তম্ভিত হন। অন্য মুরুব্বিরা উদাস চোখে তাকান। ঘন-ঘন মাথা নাড়েন। কী অবস্থা! মেয়েমানুষ, কিন্তু কী তেজ। এমন তেজ ভালো না। এমন তেজের কপালে লাথি।

চাঁদসোনা খুনখুন করে কাঁদে। সেই সঙ্গে ঘন-ঘন চোখ মোছে। কাঁচের চুড়ি বেজে ওঠে তখন। বিধবা মেয়েমানুষ, কিন্তু হাতে চুড়ি। পরনে ছাপের শাড়ি। স্বামীর মৃত্যুর পর সাত বিধবা গিয়েছিল চাঁনসোনার কাছে। গোসল দেবে। গোসলের পর রঙিন শাড়ি বদলে সাদা শাড়ি পরিয়ে দেবে। চাঁনসোনা রাজি হয় নি। সে সাদা শাড়ি পরবে না। এই মেয়ে যে শেষমেষ এক কাণ্ড করবে, সেটা তো জানা কথা। এখন আবার কাঁদতে শুরু করেছে। মাররা বড় বিরক্ত হন। মোত্তালেব মিয়া উদার গলায় বলে, কাইলো না। খামাখা কান্দ ক্যান? তোমারে মারছি না ধরছি?

চাঁনসোনা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলে, আমি এই গেরামে থাকুম না।

যাইবা কই?

হেইটা দিয়া আপনে কী করবেন? যাইতে কইছেন, যাইতেছি।

আরে, এইটা তো বদ মেয়েমানুষ।

চাঁনসোনা গ্রাম থেকে জন্মের মতো যাবে, এটাই সাব্যস্ত হল। তার আগে চাঁনসোনার মাথা মুড়িয়ে দেবার প্রস্তাব উঠেছিল। নিয়ামত রাজি হন নি। মুখে বিরক্তির ভঙ্গি করে বলেছেন, শইল দেখাইয়া খাইব। চুল কাটলে হে দেখাইব কী? বাদ দেও।

পুরোপুরি বাদ অবশ্যি দেওয়া হয় না। দশ ঘা জুতার বাড়ি দেওয়া হয়। সেই দৃশ্য দেখার জন্যে সমস্ত গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে। অভাব-অনটনের মধ্যে দীর্ঘদিন পর প্রবল উত্তেজনার একটা ব্যাপার ঘটে। দশ ঘা জুতার বাড়ি খেয়েও মেয়েটার চোখে পানি আসে না কেন, এই নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়।

মনিরউদ্দিন তার মামির বিদায়ের ব্যাপারটি সহজভাবেই নিল। কান্নাকাটি করল না, সঙ্গে যাবার বায়না ধরল না—একবার শুধু বলল, আর আসবা না?

আসমু, আবার আসমু। এই গেরামে আমার কবর হইব। বুঝছস?

মনিরউদ্দিন কিছুই বুঝল না। কিন্তু মাথা নাড়ল, যেন সে বুঝেছে।

একটা কথা মন দিয়া হু মনির মিয়া-মাইয়ামাইনষের উপরে কোনোদিন বেজার হইস না। এরা না পাইরা অনেক কিছু করে, না বুইজ্যা করে।

তুমি আবার আসবা?

একবার তো কইলাম। কয়বার কওন লাগব রে বোকা বান্দর?

মনিরউদ্দিন দেখল, মামি যাবার আগে সাজগোজ করছে। একটা ভালো শাড়ি পরেছে। চোখে কাজল দিয়েছে। সুন্দর লাগছে মামিকে।

তুই কোনো চিন্তা করি না। তুই এই গেরামের পুলা। তরে এরা দেখাশুনা করব। মানুষ পাষাণ হয় নাই। মায়া-মুহত মানুষের মধ্যে আছে।

তুমি কই যাইছ?

জানি না। যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার বাপ মরল, মা বিয়া করল মই ধ্যম নগরের এক বেপারিরে। তারপর আর মার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ নাই। এখন পরথম যাইবাম মইধ্যম নগর। তারপরে দেখি। অনেক দূরের পথ। উজানের দেশ।

চাঁনসোনা মনিরউদ্দিনকে নিয়ামত খাঁর বাংলাঘরে বসিয়ে বেশ সহজ ভঙ্গিতে কেরাইয়া নৌকায় উঠল। ভাদ্র মাসের কানায়-কানায় ভরা নদী—একূল থেকে ওকূল দেখা যায় না। চাঁনসোনা টিনের ট্রাংকের উপর বসে আছে মূর্তির মতো। নৌকার মাঝি বলল, ওগো ভালোমাইনষের মাইয়া, ছইয়ের ভিতরে গিয়া বসেন।

চানসোনা জবাব দিল না। যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে রইল। কতকাল আগে এক শ্রাবণ মাসে তের বছরের চাঁনসোনা এই গ্রামে এসেছিল। লম্বা ঘোমটার ফাঁকে অবাক হয়ে দেখেছিল ভাটি অঞ্চল। অচেনা এই জায়গাটির জন্যে কেমন এক ধরনের মমতা জন্মেছিল। আজ সেই মমতা বহুগুণে বেড়ে তাকে ভাসিয়ে নিতে চাইছে। এতটুকু মাত্র শরীর মানুষের, এত মমতা সে কোথায় ধারণ করে?

নৌকার মাঝি বলল, কাইন্দেন না মা। মনটারে পাষাণ করেন। ছইয়ের ভিতরে গিয়া বসেন। পানি দেখলেই চউক্ষে বেশি পানি আসে। পানি খুব নরম জিনিস গো ভালোমাইনষের ঝি, খুব নরম জিনিস।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress