অপরাহ্ন – 2
পরবর্তী কয়েক মিনিটের মধ্যে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় মনিরউদ্দিন কিছু কাজকর্ম করল। ঘরে ঢুকে কুপি ধরাল। পাটের কোটা দিয়ে এক হাতে দড়ি পাকিয়ে দুটি বাঁধ দিল। একটি হাঁটুর নিচে, অন্যটি উরুতে। তার ভাবভঙ্গিতে কোনো রকম চাঞ্চল্য প্রকাশ পেল না। বরঞ্চ মনে হল, সাপের কামড় খেয়ে তার অভ্যাস আছে।
সে কুপিটিকে ডান পাশে রেখে পা দুটি ছড়িয়ে বসে আছে। তার কপালে ও নাকে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। মনিরউদ্দিন একটা বিড়ি ধরাল। ঘুমের ঘরে শরিফা বিড়বিড় করে কী বলতেই সাদা মুরগিটি গর্বিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল। এর অসম্ভব সাহস! সে কুপির পাশে রাখা দেয়াশলাইটিতে একটি ঠোকর দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল। পরক্ষণেই পুতির মতো লাল চোখে গভীর আগ্রহে মনিরউদ্দিনকে দেখতে লাগল। মনিরউদ্দিন ভারি গলায় বলল, কি দেখস?
সাদা মুরগি সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। মনিরউদ্দিন হালকা গলায় বলল, দেখনের আর কিছু নাই। খেইল খতম।
পায়ের বাঁধন অতিরিক্ত আঁট হয়েছে। রক্ত চলাচল বন্ধ বলেই তীব্র ব্যথা তাকে কাবু করে ফেলতে লাগল। গোড়ালির কাছে একটি দাঁতের দাগ স্পষ্ট। মুরগির লাল চোখের মতোই সেখানে এক ফোঁটা রক্ত। এতক্ষণে তা কালো হয়ে যাবার কথা, তা হয় নি। কুপির আলোয় উজ্জ্বল লাল রক্তবিন্দু চকচক করছে। মনিরউদ্দিন উঁচু গলায় ডাকল, শরিফা, ওই শরিফা।
শরিফা সঙ্গে-সঙ্গে উঠে পড়ল।
একটা ধার কিছু দে। রক্ত বাইর করন দরকার।
কি হইছে?
পাওডার মইধ্যে বন্ধন দেখস না? দুই বান দিছি।
আপনের কী হইছে?
আরে, বেকুব মাইয়ামানুষ লইয়া মুসিবত। সাপে কাটছে বুঝস না?
শরিফা চৌকি থেকে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে মেড়ি খেয়ে পড়ল। মনিরউদ্দিন বিরক্ত স্বরে বলল, ইস-জ্ঞান নাই? ব্লাউজের বোতাম ঠিক করু। হায়াশরম নাই?
ব্লাউজের বোতাম নেই। সেফটিপিন ছিল, কোথায় খুলে পড়ে গেছে। শরিফা ব্যাকুল চোখে সেফটিপিন খোঁজে, সেই সঙ্গে আকাশ-ফাটানো চিৎকার দিতে যায়, কিন্তু চিৎকার দেয় না। মনিরউদ্দিন রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। চিৎকার দিলেই ক্ষেপে যাবে। শরিফা ফিসফিস করে বলল, কোনখানে কাটছে?
হেইটা দিয়া তুই কবি কি? যেইখানেই কাটুক-এক কথা। তুই যাস কই?
মানুষজনরে খবর দেই।
চুপ কইরা বইসা থাক্। সকাল হউক, ব্যবস্থা হইব।
দেরি হইব।
হইলে হইব। তুই চুপ থাক্। মাইয়ামানুষ কথা বেশি কইলে সংসারে আল্লাহ্র গজব পড়ে। পানি গরম দে। চুলা জ্বালা।
গরম পানি দিয়া কী হইব?
আহ্, খালি কথা বাড়ায়। আরে, তুই যাস কই?
শরিফা কখনই এই মানুষটির কথার অবাধ্য হয় নি। কিন্তু আজ প্রথম সে তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফেলা দরজা দিয়ে উঠোনে নেমে ছোট-ঘোট পা ফেলে ছুটতে শুরু করল। এদের বাড়িটি গ্রামের এক প্রান্তে। মেয়েটিকে অনেকখানি পথ যেতে হবে।
ভোররাতের নির্জন গ্রাম। মরা চাঁদের অস্পষ্ট আলো। এর ভেতর দিয়ে এলোচুলে একটি রূপবতী তরুণী দৌড়াচ্ছে। মাঝে-মাঝে তার অস্পষ্ট কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দৃশ্যটি ছবির মধ্যে সুন্দর।
মৌলানা খবির হোসেন ফজরের নামাজের জন্যে অজু করতে বের হয়েছিলেন। তিনি অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখলেন। কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই মেয়েটি অনেক দূর চলে গেল। তাকে এখনো ডাকা যায়। কিন্তু তা ঠিক হবে না। তিনি একা মানুষ। রাতের বেলা মেয়েছেলে ডাকাডাকি করার অনেক রকম অর্থ করবে লোকে। মানুষের মনভর্তি পাপ। তিনি একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, অজুর দোয়ায় গণ্ডগোল করে ফেললেন। তের বছর বয়স থেকে এই দোয়া তিনি দিনে পাঁচ বার করে পড়েন, আজ তাঁর বয়স সাতচল্লিশ। এত দিন ধরে পড়া একটি ছোট্ট দোয়ায় ভুল হবে কেন?
খবির হোসেন চিন্তিত মুখে মসজিদের দিকে রওনা হলেন। মসজিদের আশেপাশে একটাও মানুষ নেই। ধর্মকর্মে মন নেই মানুষের ধর্ম ছাড়া মানুষ আর হয়ওয়ানএই দুয়ের মধ্যে তফাত কিছু নেই। কিন্তু এই জিনিস বুঝবে কে? একটা ভালো কথা বললে কেউ বুঝতে পারে নাই তোলে। বেকুবের দল! গত জুম্মার দিনে খাবার পর তিনি ইবলিশ শয়তানের কথা শুরু করেছেন, তখন এক জন বলে বল, তাড়াতাড়ি করেন ইমাম সাব। কী সর্বনাশের কথা! হাদিস-কোরানের কথা শুনতে চায় না। এইসব কেয়ামতের নিশানা। কেয়ামত যখন নজদিক, তখন খোদার কথা কেউ শুনতে চায় না। দুনিয়াদারি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ইমাম সাহেব মসজিদের তালা খুললেন। এই তালা গত হাটবারে কেনা হয়েছে। খোদার ঘরে তালা দিয়ে রাখতে হয়, এর চেয়ে লজ্জার কথা কিছু আছে? কত বড় সাহস মানুষের খোদার ঘর থেকে চাটাই এবং অজুর বদনা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। আফসোসের কথা! রোজ হাশরের দিনে আল্লাহপাক যখন জিজ্ঞেস করবেন—পেয়ারা বান্দা, তুমি যে আমার ঘর থেকে বদনা নিয়ে গেলে, বিষয়টা কী বল দেখি? তখন কী জবাব দেবে? ভাবতে গিয়েও খবির হসেনের গা ঘেমে যায়। সূর্য থাকবে এক হাত মাথার উপরে। মাবুদে এলাহি। কী ভয়ংকর দিন আছে আমাদের সামনে! কী ভয়ংকর দিন।
তিনি আজান দেবার জোগাড় করলেন। ফজর ওয়াক্ত হয়েছে কি না ঠিক বোঝ যাচ্ছে না। আকাশে চাঁদ থাকলে এই মুশকিল। সময় আন্দাজ করা যায় না। অথচ একটা ঘড়ির কত আর দাম? এতগুলি মানুষ চাঁদা তুলেও তো একটা ঘড়ি কিনতে পারে। যদি কিত, কত বড় এক জন সাক্ষী হত তাদের। হাশরের ময়দানে এই ঘড়ি কথা বলত। ঘড়ি বলত, হে বুদ, তোমার বান্দাদের হয়ে আমি সাক্ষ্য দিতেছি। হে মাবুদ, তোমার এইসব পেয়ারা বান্দারা আমাকে খরিদ করেছিল……
স্লামালিকুম ইমাম সাব।
ওয়ালাইকুম সালাম।
বদর মুনশি এসে পড়েছে। তার মানে ফজর ওয়াক্তের আর দেরি নেই।
আজান হইছে ইমাম সাব?
না, এখনো হয় নাই। সময় এখনো কিছু আছে।
বদর মুনশি অজু করতে গেল। টিনের একটা ড্রামে অজুর পানি তোলা আছে। তোলা পানিতে অজু করা ঠিক নয়। অল্পতেই তোলা পানি নাপাক হয়। সবচেয়ে ভালো পুকুরের পানি। পানি নষ্ট হবার ভয় নেই। একটা পুকুর কাটা এমন কোন সমস্যা না। কিন্তু কাটবেটা কে?
বদর মুনশি।
জ্বি।
একটা মেয়েছেলেরে দৌড়াইয়া যাইতে দেখলাম। বেপর্দা অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি…..
আমি দেখছি, মনিরের বৌ।
বিষয় কি?
জানি না। জিজ্ঞেস করি নাই। উত্তরের দিকে যাইতাছে।
অসুখবিসুখ নাকি?
কে কইব?
খবির হোসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। পাড়াপড়শীর ব্যাপারে আগ্রহ নেই। মেন খারাপ কথা! হয়তো বিপদ-আপদ কিছু হয়েছে। বিপদ-আপদ ছাড়া মেয়েমানুষ দৌড়াবে কেন?
খবর নেওয়া দরকার, হাদিস শরিফে পরিষ্কার লেখা আছে, পড়শীকে নিজের ভাইয়ের মতো দেখিবে। পড়শীর বিপদ নিজের বিপদ বলিয়া জানিবেসহি হাদিস।
এই শেষ না। বোখারী শরিফে আছে, যে-ব্যক্তি প্রতিবেশীর বিপদ দেখে না, আগুন তাহার ভাই।
বলেই খবির হোসেনের মনটা একটু খারাপ হল। তিনি মাঝেমাঝে বানিয়ে বানিয়ে হাদিসের কথা বলে ফেলেন। জিনিসটা উচিত না। আল্লাহপাক নিশ্চয়ই নারাজ হন। কিন্তু তিনি কাজটা মানুষের ভালোর জন্যেই করেন। আল্লাহপাক হচ্ছেন আলেমুল গায়েব, এই জিনিসটিও তিনি নিশ্চয়ই জানবেন।
খবির হসেন আজান দিয়ে মসজিদের ভেতর এসে বসলেন, যদি আর কেউ আসে। তিনি অনেকক্ষণ বসে রইলেন। কেউ এল না।
বদর মুনশি বিরক্ত হয়ে বলল, নামাজ পড়েন। দেরি করতেছেন কেন?
আজান দিয়া সাথে-সাথে নামাজে দাঁড়া হাওয়া ঠিক না। হাদিসে নিষেধ আছে। দেখি একটু, যদি কেউ আসে।
আকাশ ফর্সা হয়ে এল। কাউকে আসতে দেখা গেল না। খবির হোসেন ভারি মন নিয়ে নামাজের জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। তখন হঠাৎ মনে হল, ঘরে বিপদ-আপদ হলে মেয়েটা কাছের মানুষের কাছে না-এসে এত দূরে যাচ্ছিল কেন? তাঁর কাছে আসতে পারত। এল না কেন? ছিঃ ছিঃ, নামাজের মধ্যে এইসব কি ভাবছেন তিনি। নামাজ কবুল হবে না। আর তাঁরটা কবুল না হলে পাশে যে আছে, তারটাও হবে না। ইমামতি করার মত দায়িত্বের কাজ আর কিছু আছে? বিরাট একটা দায়িত্বের কাজ। এই কাজটা ঠিকমতো করতে পারছেন না। বড় লজ্জার কথা।
কিন্তু মেয়েটা তাঁর কাছে এল না কেন? মনিরের বৌ তো তাঁকে চেনে। আর না চিনলেই কী? বিপদের দিনে পর্দা থাকে না, রোজ হাশরের দিনে ছেলেমেয়ে একসাথে দাঁড়াবে। বেপর্দা অবস্থায় দাঁড়াবে। কারো গায়ে কোনো কাপড় থাকবে না। এর মানে কী? মানে অতি পরিষ্কার। বিপদের দিনে কোন পর্দা নাই। পর্দা মাফ।
পেছনের সারি থেকে খুক করে দবির কেশে উঠল। নকল কাশি। তার মানে ইমাম সাহেব দীর্ঘ সময় ধরে রুকুতে আছেন। খবির হোসেনের অনুতাপের সীমা রইল না। আল্লাহ্র সামনে দাঁড়া হয়ে এসব কী। আল্লাহ্ কি তাঁকে হাশরের ময়দানে জিজ্ঞেস করবেন না—হে বান্দা, তুমি নামাজে দাঁড়া হয়ে দুনিয়াদারির কথা ভাব। তখন মানকের, নেকের বলবেইহা সত্য। ইহা সত্য। হায় হায়, কী লজ্জার কথা!