অপরাহ্ন – 11
মতির মা খাবার নিয়ে এসেছে।
এক গামলা ভাত, রুই মাছের তিনটা বড়-বড় দাগ। এক বাটি মাষকলাইয়ের ডাল। মনিরউদ্দিন তার কিছুই মুখে দেয় নি। দু-এক নলা মুখে দিয়ে থালা সরিয়ে দিয়েছে। শরিফা বলল, কি হইছে? খান না?
মুখে দেওন যায় না। তরকারিত লবণ দিছে দুই হাতে।
একটা ডিম ভাইজ্যা দেই?
না, খিদা নাই।
দেই, একটা ডিম দেই।
মনিরউদ্দিন কাল শরিফার দিকে। তার মুখ এতটুকু হয়ে গেছে। এমনভাবে ডিম ভেজে আনার কথা বলছে যে, মনিরউদ্দিন না বললে সে কেঁদে ফেলবে।
শরিফা আবার বলল, লবণ ছাড়া ভাইজ্যা দেই?
আচ্ছা দে।
সেই ডিমও মনিরউদ্দিন খেতে পারল না। মতির মা ভাত-তরকারি দিয়ে এল নিবারণকে। নিবারণ এমনভাবে খাচ্ছে, যেন সে দীর্ঘদিনের উপবাসী। মতির মা লম্বা ঘোমটা টেনে পাশে বসে আছে। নিবারণ বলল, তরকারি ভালো হইছে। পুঙ্কুনির রুই মাছ-এর বোয়াদই আলাদা। নদীর রুই মাছ অত স্বােয়াদ হয় না। নাম কি তোমার?
মতির মা নাম বলল না
বসল। তার নিজের নামের কি কোন খোঁজ আছে? তাদের মতো মানুষদের নিজের নাম থাকে না। ভাগ্যিস মতি বলে একটা মেয়ে ছিল। লোকজন সেই মেয়ের নামে তাকে ডাকে। মরা মেয়েটার কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়।
কোন বাড়ি তোমার?
বাড়িঘর নাই।
পান আছে? চুন বেশি কইরা দিয়া একটা পান খাওয়াও গো ভালো মাইনষের ঝি।
মতির মা পান আনতে গেল। লোকটার সঙ্গে বসে গল্প করতে ভালো লাগছে। এই লোকটির সঙ্গে তার মৃত স্বামীর কোথায় যেন একটা মিল আছে। ঐ মানুষটাও বড়বড় নলা করে ভাত মাখত। এমনিতে কথাটথা বলত না, কিন্তু একটু ভালো খাওয়াখাদ্য হলেই শুরু হয়ে যেত বকবকানি। তার গল্প মানেই খাওয়ার গল্প। মাশুল মাছ খেয়েছিল নাকি কোথায়, তার স্বাদের কোন তুলনা নেই। চোখ বড়-বড় করে বলেছে—দুনিয়ার মইধ্যে মাছ বলতে একটা মাশুল মাছ। হাড়েগুড়ে মিডা।
মিডা? মিছা মাছের আবার স্বোয়াদ কি?
না খাইলে বুঝবি না।
আন একদিন, খাইয়া দেখি।
দেখি, যদি পাই।
খাওয়া-খাদ্যের গলে ঐ লোটার কোনো ক্লান্তি ছিল না। মতির মা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে পান নিয়ে বের হয় এল। বাঁশের দরজায় হেলান দিয়ে নিবারণ ঘুমুচ্ছে। গাঢ় ঘুম। নিবারণের মুখ হাঁ হয়ে আছে। লাল টুকটুক জিভ অল্প-অল্প নড়ছে। মতির মা তাকে ডাকল না। পানের বাটা সামনে রেখে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তাকে যেতে হবে নিয়ামত খাঁর বাড়ি। অনেক কাজ সেখানে। ধান সেদ্ধ হচ্ছে। সেদ্ধ ধান ঘরে নেওয়া হচ্ছে। কাজের মেয়ে অনেক আছে। আরো দরকার। নিয়ামত শার বড় তরফের বৌ তাকে হাত ধরে বলেছে-দির করিস না। ভাতের গামলা থুইয়াই দৌড় দিয়া আসবি। মতির মার যেতে ইচ্ছা করছে না। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো ব্যাপার তার জীবনে দীর্ঘদিন ধরেই নেই। তাকে যেতেই হবে। শরিফা মেয়েটা একা-একা থাকবে। এমন দুঃসময়ে কাউকে একা থাকতে দেওয়া ঠিক না। কিন্তু এই সংসারে ঠিক কাজটা কখনো হয় না। বেঠিক কাজই সব সময় হতে দেখা যায়। জগৎ-সংসারের এইটাই নিয়ম। মতির মার চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল। পানি আসার কোনোই কারণ নেই। কেন এরকম হল কে জানে।
সে আর ঘরে ঢুকল না—সেখান থেকেই ক্লান্ত গলায় বলল, ও শরিফা, আমি গেলাম। সইন্ধার পর আসমু।
মতির মা উঠোনে নেমেই টের পেল, বাতাস দিচ্ছে। বেশ ভালো বাতাস। এই বাতাস কি মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে? মতির মা আকাশের দিকে তাকাল।
শরিফা ঘরে একটা কুপি জ্বালিয়েছে। সন্ধ্যা মেলানোর আগে কুপি ধরানো অলক্ষণ। এখন যেমন অন্ধকার করেছে, কুপি জ্বালানোয় নিশ্চয়ই দোষ হবে না। মনিরউদ্দিন বালিশে ঠেস দিয়ে কুপির আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। শরিফা বসে আছে কুপির সামনে। মনিরউদ্দিন লক্ষ করল, শরিফার নাকে সবুজ রঙের পাথর-বসানো একটা নাকফুল। গাইনবেটিদের কাছ থেকে কিনেছে বোধহয়। গাইনবেটিরা ফসল তোলার আগেই ডালা সাজিয়ে একবার আসে। পান-খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলে কিনেন। গগা ভইন। বালা সদাই। দামের চিন্তা নাই। ধান উঠুক।
গ্রামের বোকাসোকা মেয়েগুলি স্বামীকে লুকিয়ে জিনিসপত্র কিনে ঘর বোঝই করে। তরল আলতা, ফিতা, রাং, কাঁচের চুড়ি, পাউডার, কাজল, লক্ষ্মীবিলাস তেল, স্বামী-সোহাগী সাবান। জিনিস কেনার ব্যাপারে শরিফার হাত খুব দরাজ। যাই দেখবে কিনে ফেলবে।
গত বার কিনেছে পেলেন চিলুমচি। সেখানে তার নিজের নাম লেখা। ফুল লতাপাতা আঁকা। এক কাঠা চাল দিতে হয়েছে চিলুমচির জন্যে। এসব জিনিস দেখেও না-দেখার ভান করতে হয়। মেয়েজাতের নিয়মই হচ্ছে অবিবেচকের মতো কাজ করা। তবু মাঝেমধ্যে নিয়মরক্ষার জন্যে দু-একটা কড়া কথা বলতে হয় বলেই মনির বলল, খামাখা চিলুমচি কিনলা ক্যান?
শরিফা এঁকেবেঁকে বলল, আমার নাম লেখা আছে। আমার সামনে লেখছে।
কই, দেখি!
শরিফা আগ্রহ করে দেখাল।
সত্যি-সত্যি কী-সব যেন লেখা। নামই হবে।
বাজে-খরচ মোটেই করবানা, বুঝলা। এই বাজে-খরচ আমার পছন্দনা। বাজে। খরচে সংসার নষ্ট।
বলেই মনিরউদ্দিনের মনে হল, কথাগুলো বেশি কড়া হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে উদাস গলায় বলল, চিলুমচির অবশ্যি দরকার। ময়-মেহমান আসলে খাতির-যত্ন করতে হয়। না, ভালোই করছ।
শরিফা ক্ষীণ স্বলে বলল, আমার নাম লেখা আছে। চুরি হইত না।
তাও ঠিক, চিহ্ন আছে। ভালো হইছে। সিন্দুকে তুইল্যা থও। মাঝেমধ্যে তেঁতুলের পানি দিয়া মাজবা।
শরিফার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে তৎক্ষণাৎ তেঁতুলের পানি নিয়ে মাজতে বসে, এবং ঝকঝকে জিনিসটি গভীর মমতায় তুলে রাখে সিন্দুকে। যদি কোনো দিন মেহমান আসে, তা হলে এই জিনিস বেরুবে সিন্দুক থেকে।
মেহমান কেউ মনিরউদ্দিনের বাড়িতে আসে না। শুধু কিছুদিন পরপর আসে শরিফার ছোট ভাই অন্তু মিয়া। অন্তু মিয়ার বয়স এগার। অসম্ভব রোগা। সমস্ত শরীরের ভেতর বড়-বড় দুটি চোখ ছাড়া কিছুই নজরে পড়ে না। মাথা পরিষ্কার করে কামানো। সবুজ রঙের একটা লুঙ্গি এবং বেশ পরিষ্কার একটা গেঞ্জি পরে সে প্রায়ই ধুলো পায়ে সাত মাইল হেঁটে বোনের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে উঠোনেই বসে পড়ে। আর দু পা হেঁটে ঘরে ঢোকারও যেন সামর্থ্য নেই। বড়-বড় নিঃশ্বাস নেয়। দেখে মনে হয়, এই বুঝি দম আটকে এল। শরিফা ছুটে গিয়ে এক বদনা পানি ভাইয়ের মাথায় ঢালে। অন্তুর খানিকটা আরাম হয়। শরিফা জিজ্ঞেস করে, শরীর ভালো?
অন্তু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।
মাজানের শরীর?
এবারও সে মাথা নাড়ে। মুখে তার কথা নেই।
যা দু-একটা বলে, তা এতই ক্ষীণ স্বরে, শরিফা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারে না। সে কখনই খালি হাতে আসে না। কিছু-না-কিছু থাকেই তার সঙ্গে। অতি সামান্য জিনিস-এক হালি ডিম, আধ সের দুধ, একটা ছোট কাঁঠাল। এতেই শরিফার চোখে আনন্দে পানি এসে যায়। বাপের বাড়ির জিনিস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কতভাবে দেখে—এইটা কোন গাছের কলা রে? বিছারা তলার?
হুঁ।
নে, তুই খা।
না, তুমি খাও।
তৎক্ষণাৎ কলা ছিলে খেতে বসে শরিফা। তার বড় ভালো লাগে।
গুড়ের লাহান মিছা।
আরেকটা খাও।
না, থাউক। তোর দুলাভাইরে দিমু
অন্তু মিয়ার নিজের কিছু সম্পত্তিও এ-বাড়িতে থাকে। যেমন বুড়ো.ছাগল এবং লাল মুরগি। বুড়ো ছাগলটিকে সে এনে রেখেছে। কারণ সে টের পেয়েছে, ছাগলটিকে তার মা বিক্রি করে দেবে। চৈত্র মাসের অভাবে দরিদ্র কৃষকদের ছাগল-মুরগি সবই চলে যায়।
বোনের বাড়িতে এই ছাগলটি থাকায় অন্তু মনে খুব শান্তি পায়। বিক্রি হওয়ার ভয় নেই। এই অঞ্চলে চৈত্র মাসের অভাব এত প্রকট নয়। অন্তু মিয়া সারা দিন বোনের পেছনে-পেছনে ঘুরে রোদ পড়তেই আবার রওনা হয়ে যায়। রাতে সেকিছুতেই থাকবে না।
মনিরউদ্দিন বলে, চৈত্র মাসের এমন কড়া দিনে এত ঘন-ঘন আওন ঠিক না। অসুখে পড়ব। অন্তু মিয়ারে নিষেধ করব।
শরিফা ক্ষীণ স্বরে বলে, নিষেধ করি। ভাতের লোভে আয়। মার বাড়িত ভাত নাই। রুটি খায়।
বড় মায়া লাগে মনিরউদ্দিনের। ভাতের লোভ দুদিন পরপর ছেলেটা আসে। সে যখন অন্তু মিয়ার মতো ছিল, তখন কী ভয়ংকর অভাব। ভাতের লোভে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেত।
শরিফা।
কি?
ভালো কইরা খাওয়াইবা অনুরে। থালা ভইরা গরম ভাত দিবা। গাওয়া ঘি আছে? থাকলে পাতের কিনারায় দিবা মনে কইরা। ভুল হয় না যেন।
ভাত খাওয়ার সময় মাঝে-মাঝে মনিরউদ্দিন বসে অন্তুর সামনে। ক্ষুধার্ত বালকটির খাওয়া দেখতে তার ভালো লাগে। অন্তু মনিরউদ্দিনকে বড় ভয় পায়। সহজভাবে তার সামনে খেতে পারে না। শরিফা বলে, আপনের সামনে অন্তুর খাইতে শরম লাগে।
শরম? শরমের কী আছে? খাওনের মইধ্যে শরম কিছু নাই। লও, আর চাইরডা ভাত লও। তেঁতুল দিয়া মাইখ্যা খাও।
অন্তু মিয়া হাঁসের মতো গলা টেনে-টেনে ভাত খায়। মনিরউদ্দিন দরাজ গলায় বলে বসে, এইবার ঈদে তোমারে টুপি আর পাঞ্জাবি দিম। কচুয়া পাঞ্জাবি আর সাদা টুপি। না তুমি সাদা পাঞ্জাবি চাও?
অন্তু মুখভর্তি ভাত নিয়ে কোনোমতে বলে, কচুয়া।
আইচ্ছা ঠিক আছে, কচুয়া।
অন্তু মিয়া তার কচুয়া পাঞ্জাবির কথা ভোলে না। যত বারই আসে, শরিফার কাছে খোঁজ নিয়ে যায় দুলাভাইয়ের পাঞ্জাবির কথাটা মনে আছে কি না। মনে না-থাকলে যেন মনে করিয়ে দেওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাবিটা কেনা হয় না। শরিফার জন্যে একটা মোটাপাড় শাড়ি, সংসারের দুই-একটা টুকিটাকি কিনে, টাকার টান পড়ে যায়। বড় ঈদে কিনে দেওয়া যাবে এই ভেবে বাড়ি ফেরেমনিরউদ্দিন। অন্তুর জন্যে বড় মায়া লাগে। সে দুপুরের কড়া রোদে হেঁটে এসেছে পাঞ্জাবির জন্যে। ছেলেমানুষ সে, সংসারের টানাটানি এখনো বোধহয় সেরকম বোঝ না।
বড় ঈদে কিন্যা দিমু, বুঝলা অন্তু।
জি আইচ্ছা।
মনিরউদ্দিন গম্ভীর গলায় বলল, বড় ঈদে না কিন্যা দিলে আমি বাপের পুত না। বড় ঈদ তুমি আমরার সাথে করবা।
জ্বি আইচ্ছ্যা।
এক দিন আগে চইলা আইবা। একত্রে জামাতে যামু।
জ্বি আইচ্ছা।
বড় ঈদে অন্তু এক দিন আগে ঠিকই আসে। পাঞ্জাবি পায় না। সেসময় মনিরউদ্দিনের বড় দুঃসময়। একটা পয়সা হাতে নেই।
খুব শরমিন্দা হইলাম তোমার কাছে অন্তু মিয়া। গরিব হওন বড় শরমের ব্যাপার।
জামাতের সময়টায় মনিরউদ্দিন মুখ অন্ধকার করে কাঁঠালগাছের নিচে বসে থাকে। নামাজে যেতে ইচ্ছা করে না। শরিফাকে এসে বলে, নামাজে যামু না ঠিক করলাম।
শরিফা চোখ কপালে তুলে বলে, কী সৰ্বনাশের কথা কন!
ঈদের নামাজ গরিবের জন্যে না।
আল্লাহ-নারাজ কথা কইয়েন না। অন্তরে লইয়া নামাজে যান। আর আপনে মনটা অত খারাপ করছেন ক্যান? ঈদ তো শেষ হয় নাই। আরো তো ঈদ সামনে আছে।
কুপি জ্বলছে। তার লাল শিখার সামনে শরিফা বসে আছে নতমুখে। তার নাকের সবুজ ফল অসম্ভব সুলস্থুল করছে। নাকফুলটার দিকে তাকিয়ে আছে মনিরউদ্দিন। দরজার কাছে অন্তু মিয়ার বুড়ো ছাগল। সে মাথাটা ঢুকিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিল যে সে, এসেছে, তবে এই মুহূর্তে ঘরে ঢোকার ইচ্ছা নেই। লাল মুরগিটিও ঘরের ভেতর এক পা দিয়ে আবার বাইরে চলে গেল। অন্য মুরগিটাও তাই করল। এরা শরিফার ডাকের অপেক্ষা করে। না-ডাকা পর্যন্ত ঘরে ঢুকবে না, বারবার উঁকি দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবে।
মনিরউদ্দিন মৃদু সুরে ডাকল, শরিফা।
কি?
সিন্দুকের মইধ্যে দুই শ টাকা আছে। তুই জানস?
জানি।
যদি আমার কিছু হয়, ঐ টেকাডি দিয়া পইলা একটা কাম করিস।
শরিফা ঠাণ্ডা গলায় বলল, কি কাম?
অন্তু মিয়ারে একটা পাঞ্জাবি, পায়জামা আর টুপি কিইন্যা দিবি।
শরিফা কিছুই বলল না। দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। মনিরউদ্দিন নরম গলায় ডাকল, শরিফা।
কি?
কান্দস ক্যান? কাইলা কিছু হয় না। কান্দিস না। আমার মনে হয় না আমার কিছুহইব। অতক্ষণ যখন টিইক্যা আছি। কিছু হওয়ার হইলে এর মইধ্যে হইত। অখন শইডা ভালোই লাগছে।
পাওডাত ব্যথা নাই?
আছে। ব্যথা আছে। সাপের বিষ সহজ জিনিস তোনা। কঠিন জিনিস। একটা বিড়ি দে। তোষকের নিচে আছে।
শরিফা বিড়ি এনে দিল। মনিরউদ্দিন লক্ষ করল শরিফার ব্লাউজের একটি বোতাম এখন খোলা, অথচ মোটেও লক্ষ নেই এদিকে। সকালে একবার বলেছিল, তারপরও হুঁশ হয় নি। একবার ভাবল এই নিয়ে কিছু বলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না। হঠাৎ করে পায়ে অসম্ভব ব্যথা হচ্ছে। এ-ব্যথা আগের মতো না। অন্য রকম ব্যথা। মনিরউদ্দিন বিড়ি ফেলে দিয়ে চেচিয়ে কেঁদে উঠল। সমস্ত দিনের মধ্যে এই প্রথম সে কাঁদল। অন্তু মিয়ার বুড়ো ছাগল ঘরে ঢুকে তাকিয়ে আছে মনিরউদ্দিনের দিকে।
শরিফা।
কি?
আমার মামি যদি কোনোদিন ফিইরা আসে, যত্ন করিস। জলচৌকির উপরে বসাইয়া পাও ধুইয়া দিস। নিজের হাতে পাও ধুয়াইবি। মামির জইন্যে মন কান্দে।
আপনের শইল কি বেশি খারাপ?
মনিরউদ্দিন জবাব দিল না। শরিফা যেখানে বসে ছিল, সেখানেই বসে রইল। তার গালে জলের সূক্ষ্ম দাগ। সে তাকিয়ে আছে কুপির দিকে। কেমন লালচে দেখাচ্ছে তার মুখ।
শরিফা।
কি?
অন্তু মিয়ার কথা যেটা কইলাম মনে রাখিস। ভুল হয় না যেন। টাকা বড় জিনিস না। মায়া-মহতটা বড় জিনিস। পাঞ্জাবিটা ভাল জমিনের কিনবি।
শরিফার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। মনিরউদ্দিন ধরা গলায় বলল, আর শোন্ শরিফা, আমার উপরে কোনো রাগ রাখিস না।
এইডা কী কন?
মনিরউদ্দিন বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাশল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত থেকে জ্বলন্ত বিড়ি পড়ে গেছে। কিন্তু না, সে ঘুমুচ্ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নড়েচড়ে উঠল। অস্পষ্ট গলায় ডাকল, শরিফা, ও শরিফা।
কি?
খবির হোসেন লোকটারে মান্য করবি। ভালো লোক।
আফনে চুপ কইরা থাকেন। এট্টু বাতাস করি?
মনিরউদ্দিন হ্যাঁ-না কিছুই বলল না।