অপরাহ্ন – 10
এতগুলি মানুষ মাঠে কাজ করছে, এটা বোঝর কোনো উপায় নেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ধান কাটার ব্যাপারটায় অনেকখানি আনন্দ আছে। ধানের গোছা স্পর্শ করায় আনন্দ, তার ঘ্রাণে আনন্দ। এই সময়টায় শিশুরা সারা মাঠে ছোটাছুটি করে। বাবারা কপট রাগের ভঙ্গিতে ধমক দেয়-দামালি করি না। শিশুরাও টের পায় এটা কপট রাগ। তারা আরো হৈচৈ করে।
কিন্তু আজকের পরিবেশ ভিন্ন। এক দল ধান কাটছে, অন্য দল কাটা ধান অতি দ্রুত ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোদিকে তাকানোর অবসর নেই। তবু এরা মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। যত বার তাকাচ্ছে ততবারই তাদের মুখে শঙ্কার ছায়া গাঢ়তর হচ্ছে।
মাঠ রক্ষার জন্যে এক জন ফিরাইল আছেন। লম্বা কালো রঙের পাঞ্জাবি গায়ে ফিরাইলের চেহারা হয়েছে ছাইবৰ্ণ। তাঁর বিদ্যার পরীক্ষা হবে আজ। আসন্ন ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে মাঠকে তিনি কি রক্ষা করতে পারবেন? গত দু মাস ধরেই মাঠে তিনি বাস করছেন। ছোট্ট একটা টং বানিয়ে দেওয়া হয়েছে মাঠের মাঝখানে। খাওয়াদাওয়া, ঘুমুনো–সবই এইখানে। গত দু মাস এই মাঠের শস্য তিনি রক্ষা করেছেন। শেষ মুহূর্তে তিনি কি পারবেন?
ফিরাইল সাব, গতিক কেমন বুঝেন?
ফিরাইল জবাব দেন না। তাঁর হাতে পাকা বাঁশের দু হাত লম্বা লাঠিটি ক্রমাগত ঘরে। বিড়বিড় করে তিনি ক্রমাগত কী-সব পড়েন। লাঠির সঙ্গে-সঙ্গে তিনি নিজেও ঘোরেন।
ফিরাইল সাব, উত্তর দিক দিয়া বাতাস ছাড়ছে। উত্তর-পশ্চিম কোণা। টের পান?
ফিরাইল মাথা নাড়েন। তিনি জানেন, তিনি সব জানেন। তিনি লক্ষ রাখছেন। যা করবার তিনি করবেন। এক জায়গায় তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন না। কিছুক্ষণ পরপর জায়গা বদল করছেন। তাই নিয়ম। তবে একটা সময় আসবে, যখন তিনি আর জায়গা বদল করবেন না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন। সেরকম ক্ষমতাবান ফিরাইল হলে তিনি দুর্যোগ টেনে নেবেন নিজের শরীরে।
কত হয়েছে এরকম। খুব বেশি দিনের কথাও নয়। বছর দশেক আগে ঠিক এরকম অবস্থা হল। মাঝরাতে হঠাৎ আকাশ কালো করে বজের শব্দ হতে লাগল। বিকট শব্দ নয়। খুব ধীর শব্দ। শিলাবৃষ্টির আলামত। বৈশাখের মাত্র শুরু। ধান সবে পাকতে শুরু করেছে। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ দলে-দলে বের হয়ে এল। তারা দেখল, ফিরাইল সাহেব তাঁর লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে সমস্ত মাঠ জুড়ে উন্মাদের মতো ছোটাছুটি করছেন। মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন। সেই হুঙ্কার ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। তিনি হুঙ্কার দেন, সঙ্গে-সঙ্গে আকাশ হুঙ্কার দিয়ে তার জবাব দেয়। যেন আকাশ এবং মানুষের যুদ্ধ। এক সময় আকাশের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। ফিরাইল দুই হাত উঁচু করে ধরলেন। পৃথিবী কাঁপিয়ে বজ্ৰপাত হল। ফিরাইল লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করলেন শস্যের মাঠ।
আজকের ইনি কি তা পারবেন? এঁর চেহারা ছেলেমানুষের মতো। গলার স্বর মেয়েদের মতো চিকন। কথা বলেন মধুর স্বরে। ফিরাইলদের সেই কঠোরতা এর মধ্যে নেই। তবু এই লোকও খুব নামী লোক। অতীতে বহু মাঠ রক্ষা করেছেন। হয়তো এটাও করবেন।
বজলু সরকার সেই দুপুর থেকেই মাঠে আছেন। দাঁড়িয়ে আছেন এক জায়গাতেই। যেখানে আছেন, তার চারপাশের অনেকখানি জমিই তাঁর। কলক করছে পাকা ধান। কী পুরুষ্টু গোছা! বজলু সরকার আফসোসের একটি শব্দ করলেন।
তিরিশ জন লোক একসঙ্গে তাঁর জমিতে ধান কাটছে। দশ জন বাইরের উজান দেশের। উজান অঞ্চলের লোকেরা পুরুন্টু ধানের গোছা ঠিকমতো ধরার কায়দা পর্যন্ত জানে না। তা ছাড়া কাজেও মন নেই। একটু পরপর বলছে-কই, তামুক দেখি। এক জন আবার মহা বাবু, সে সিগ্রেটের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। আয়েশ করে সিগ্রেট টানছে। কিছু দূর টানা হলে বন্ধুকে দিচ্ছে। নিচু গলায় হাসি-মশকরা করছে। আশ্চর্য, এই সময়ে করো হাসি আসে? এটা হাসির সময়? কী সৰ্বনাশ হতে যাচ্ছে, তা কি এই বেকুবগুলি বুঝতে পারছে না?
বজলু সরকার উঁচু গলায় ডাকলেন, জলিল, জলিল।
জলিল কাস্তে হাতে উঠে এল। বজলু সরকার কোমল গলায় বললেন বও এট্র। এইখানে বও।
জলিল বিস্মিত স্বরে বলল, এইটা বওনের সময়? কি কইবেন তাড়াতাড়ি কন।
বইতে কইছি, বও।
জলিল বসল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বজলু সরকার প্রশংসার চোখে তাকিয়ে আছেন। এরকম দশটা মানুষ থাকলে ফসল কেটে ঘরে তোলা যায়। এরা মানুষ নয়, যন্ত্ৰ।
মনিরের খবর কি?
কোনো খবর নাই।
কেমন দেখলা?
বালা না। অবস্থা খারাপ।
এই সময়টার মইধ্যে মনির থাকলে……
বজলু সরকার কথা শেষ করলেন না। জলিল বলল, আর কিছু জিগাইবেন?
ওঝা কী কয়?
আরে, ঐ ব্যাটা বলদ, জানে না কিছু।
পুরানা কালের ওঝা কই পাইবা কও? পুরানা দিন নাই, বুঝলা। পুরানা মানুষও শেষ, দিনও শেষ।
জলিল উসখুস করতে লাগল। দাঁড়িয়ে বকবক করার সময় এটা না। এই মানুষ এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারছে না। চিন্তা-ভাবনায় হয়তো মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে।
জলিল মিয়া।
জ্বি।
এইখানের যে ফিরাইল দেখতাছ, হেও নিকামা। এক ফোঁটা বিষ্টি ফিরানির ক্ষ্যামতা নাই। মুখের মইধ্যে দুধের গন্ধ–চেংড়া পোলা।
জলিল বলল, যাই, কাম করি গিয়া। বেহুদা দিরং হইতাছে।
তুমি একটা কাম কর–যাও, মনিরের বাড়িত যাও গিয়া। একজন-কেউ থান দরকার।
জলিল বিস্মিত হয়ে তাকাল।
আমি যাইতাম, কিন্তু নড়তাম পারছি না। যাও, তুমি যাও।
যাইয়া লাভটা কি?
মনিররে ডাক্তারের কাছে নেও।
ডাক্তার-কবিরাজ এর কী করব?
না করুক, তবু নেও। মনের শান্তি।
জলিল জবাব না-দিয়ে কাস্তে হাতে নিঃশব্দে তার জায়গায় ফিরে গেল। এ অঞ্চলের একমাত্র পাশ-করা ডাক্তার থাকেন নান্দিপুরে। এখান থেকে কম করে হলেও কুড়ি মাইল। নদীতে পানি নেই। গরুর গাড়ির ব্যবস্থা দেখতে হবে। সেও এগ্রামে নেই। সবচেয়ে বড় কথা, দিনের এই অবস্থা।
জলিল মিয়া।
জ্বি।
কি কইলাম এতক্ষণ? যাও, মনিরের বাড়িত যাও।
লাভ নাই কিছু।
লাভ-লোকসান দেখনের কাম নাই। তোমারে যা কইলাম, কর।
বজলু সরকার মুখে বললেন, লাভ-লোকসান নিয়ে তিনি বিচলিত নন, কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়। তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে ছোট্ট একটা খেলা খেললেন। ঈশ্বরকে প্রবঞ্চনা করতে চাইলেন। তাঁর মনে হল, নিজের ক্ষতির ভয় থাকা সত্ত্বেও তিনি মনিরের জন্যে লোক পাঠাচ্ছেন। এতে আল্লাহ্ খুশি হবেন এবং কোন অলৌকিক উপায়ে তাঁর শস্যের খেত রক্ষা পাবে।
আকাশে গুড়ুগুড়ু মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। মেঘের পরে মেঘ জমছে, অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, বৃষ্টির ফোঁটাও এখনো পড়ে নি।
তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করে ফিরাইলের দিকে তাকালেন। হাত তুলে অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি করছে লোকটা। রাগে গা জ্বলে যায়। এই চেংড়াকে আনাই ভুল হয়েছে। এসব কি চেংড়া-ফেংড়ার কাজ।
উজানের কামলাদের একজন কিসে যেন খুব মজা পেয়েছে, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। অন্যরা ধান কটা বন্ধ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বজলু সরকার এগিয়ে গেলেন। কামলাটি হাসিমুখে বলল, সরকার সাব, কুদ্দুসের কথা হুনছেন। কুদ্দুস কয় কি……
বজলু সরকার তাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। প্রচণ্ড একটি লাথি বসিয়ে দিলেন। লোকটি ধানখেতে গড়িয়ে পড়ল। সরকার সাহেব নিজের জায়গায় ফিরে এলেন।
হতভম্ব কামলাটি উঠে বসেছে। সে সঙ্গীদের দিকে তাকাচ্ছে সমর্থনের আশায়। কিন্তু সঙ্গীরা আবার কাজ শুরু করেছে, যেন কিছুই হয় নি।
নিয়ামত খাঁ মাঠে আসেন নি। এ ছাড়া আর সবাই আছে। খাঁ সাহেব কেন আসেন নি বোঝা যাচ্ছে না। শরীর খারাপ বোধহয়। তাঁর দিন শেষ হয়ে আসছে। ছেলে নেই, দুটিমাত্র মেয়ে। মেয়ের জামাইরা এখনই কোন্দল শুরু করেছে। জমির ভাগাভাগি কী হবে, এ নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা। জামাই দুটিই হচ্ছে মহা হারামজাদা। বজলু সরকার এক জনকে লক্ষ করলেন। বেশ প্যান্ট-শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছে। চোখে কালো চশমা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ছিল, বজলু সরকারকে দেখে ফেলে দিয়ে সে এগিয়ে এল এবং শুদ্ধ বাংলায় বলল, চাচাজীর শরীরটা ভালো তো?
শরীর ভালই। তোমার শরীর কেন?
আছি কোনোমতে।
এইখানে আইছ কি জইন্যে? রঙ্গ-তামশা দেখতে?
জ্বি, কি বললেন?
এইটা রঙ্গ-তামশা দেখনের সময় না। তুমি গেরামের জামাই। যদি জামাই না হইতো, তা হইলে তোমারে ধান কাটতে লাগাইয়া দিতাম।
জামাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রাইল। নিয়ামত খাঁর জামাইকে এত বড় কথা বলাটা ঠিক হয় নি, কিন্তু বজলু সরকার বেশ ভেবেচিন্তেই বলেছেন। এই বিদেশি ছেলেটির সঙ্গে তিনি একটি বিরোধ তৈরি করতে চান। তিনি চান না, এখানেই সে স্থায়ী হোক। বাইরের লোকজন এখানে আস্তানা গাড়ুক, তা তিনি চান না। এ ছাড়া এই শার্ট-প্যান্ট-পরা যুবকটির সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করায় একটু আগে তিনি লাথি বসিয়ে যে-অন্যায়টি করেছিলেন, তা খানিকটা কমবে। যে খেয়েছে, সে বুঝবে, এই লোকটি কাউকে রেয়াত করে না। তাঁর স্বভাবই এমন। বজলু সরকার সব কাজই খুব ভেবেচিন্তে করেন। বড় হতে হলে ভেবেচিন্তে কাজ করতে হয়। তিনি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টা এবং নিজের বুদ্ধিতে বিশাল সম্পত্তি করেছেন। জলমহাল করেছেন। এইসব এমনি-এমনি হয় না। সম্পত্তি করা খুব কঠিন নয়। বজায় রাখাটাই কঠিন।
বজলু সরকার লক্ষ করলেন, নিয়ামত খাঁর জামাই মুখ কালো করে চলে যাচ্ছে। যাক, আপদ বিদায় হোক। তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে একটি গভীর ক্ষত আছে। বিপুল বিষয়-সম্পত্তি করেছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো পুত্ৰ-কন্যার মুখ দেখতে পারেন নি। তাঁর তিন স্ত্রীর প্রতিটিই অপদার্থ। আরেক বার চেষ্ট করা যায়। কিন্তু কেন জানি আর কোনো আগ্রহ বোধ করেন না। রক্তের তেজ মরে গেছে।
বজলু সরকার লক্ষ করলেন, ফিরাইল তাঁর দিকে দ্রুত আসছে। কি বলতে চায় কে জানে? তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। এদের মুখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি কথা বলতে ভালো লাগে না।
সরকার সাব।
বলেন।
একটা কথা বলতে চাই আপনেরে।
বলেন। কি কথা?
কথাটা এট্টু আড়ালে করতে চাই।
যা কওয়ার এইখানেই কম। কানাকানি আমি পছন্দ করি না। কানাকানি করে। মেয়েলোকে।
ফিরাইল ইতস্তত করছেন। কথাটা যেন বলতে পারছেন না, আবার না-বলেও পারছেন না।
কি, বলেন আপনের কথা।
আপনে বাড়িত গেলে ভালো হয়। বাড়িত যান গিয়া।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
দিনের অবস্থা খুব খারাপ। আপনে থাকলে অসুবিধা হইব।
কি অসুবিধা।
যারার পুত্রসন্তান নাই, তারা মাঠে থাকলে আমার অসুবিধা। আমি ফিরাইতে পারতেছি না। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে সরকার সাব। অপরাধ নিবেন না। আপনে বাড়িত যান।
আমি চইলা গেলে তুমি ফিরাইতে পারবা?
চেষ্টা করমু। অখন চেষ্টাও করতে পারতেছি না।
কামলারা ধান কটা বন্ধ করে অবাক হয়ে ফিরাইলের কথা শুনছে। বজলু সরকার প্রথম বারের মতো তীক্ষ চোখে লোকটিকে দেখলেন। একে শুরুতে দুধের বাচ্চা বলে মনে হয়েছিল, এখন হচ্ছেনা। এ বোধহয় পারবে। বজলু সরকার হাঁটতে শুরু করলেন। তাঁর পা মনে হচ্ছে পাথরের মত। টেনে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে।
আকাশে বজের শব্দ। হালকা বাতাস ছাড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বজলু সরকার এক বারও পেছনে ফিরে তাকালেন না।