অপরাহ্ন – 1
ভোররাতে মনিরউদ্দিন স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল।
স্বপুটা তার মনে ছিল না, কিন্তু তার মায়া মনিরউদ্দিনকে আচ্ছন্ন করে রাখল। স্বপ্নের মধ্যে খুব আনন্দের কিছু ছিল। তেমন আনন্দময় জীবন তার নয়। আর নয় বলেই হয়তো ভোররাতের স্বপ্ন তাকে অভিভূত করে রাখল। সে উঠে বসল। খুব সাবধানে পাশে শুয়ে-থাকা শরিফার গায়ে হাত রাখল। শরিফা ঘুমের ঘোরে চমকে একটু সরে গিয়ে কিশোরীদের রিনরিনে গলায় বলল–না, না।
মনিরউদ্দিন হাত সরিয়ে নিল। অন্য সময় এরকম হয় না। গায়ে হাত রাখলেই কাছে টানতে ইচ্ছে করে। আজ করছে না। কেন করছে না?
বৈশাখ মাসের অসহ্য গরম। এক ফোঁটা বাতাস নেই। ঝিম ধরে আছে চারদিক। ঘরের ভেতর ঘামের গন্ধের মতো কটু গন্ধ। ভোররাতের স্বপ্নের সঙ্গে এর কোনটিরই মিল নেই। মনিরউদ্দিন চৌকি থেকে নামতে গেল। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ে না। কোথায় যেন একটি চিমটি রাখা, পা লেগে সেটি গড়িয়ে চলতে লাগল। চৌকির নিচের হাঁস-মুরগিগুলি এই অস্বাভাবিক দৃশ্যে ভয় পেয়ে কককক করতে লাগল। মনিরউদ্দিন বিরক্ত মুখে বলল-আহু, চুপ। কিন্তু তারা চুপ করল না। একটি সাদা মোরগ চৌকির নিচ থেকে বেরিয়ে এসে প্রবল বেগে ডানা ঝাপ্টাতে লাগল। শরিফা জেগে উঠে ভয়-পাওয়া গলায় বলল, কি হইছে?
মনিরউদ্দিন ভারি গলায় বলল, কিছু হয় নাই।
কই যান?
যাই না।
মনিরউদ্দিন দরজা খুলে উঠোনে এসে দাঁড়াল। মুরগিগুলি এখনো কককক করছে। দরজা খোলা দেখে হয়তো জানতে চাচ্ছে ভোর হয়েছে কি না। শরিফা জিভ দিয়ে তালুতে অদ্ভূত একটা শব্দ করতেই ওরা থেমে গেল। যেন এতক্ষণ এই পরিচিত শব্দটি শোনবার জন্যেই অপেক্ষা করছিল।
শরিফা আবার শুয়ে পড়ল। এই অসহ্য গরমেও তার গায়ে একটি পাতলা কাঁথা। খোলা দরজায় খানিকটা চাঁদের আলো এসেছে। সেই আশোয় শরিফার মুখ অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। সতের বছরের একটি তরুণীর রোগশীর্ণ কোমল মুখ। এই নিগ্ধ কোমল মুখের সঙ্গে মনিরউদ্দিনের স্বপ্নের মিল ছিল, কিন্তু সেই মিল তার চোখে পড়ে নি। সে ঘর ছেড়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মুরগিগুলি আবার কককক করছে। শরিফা ঘুমের ঘোরেই সেই অদ্ভুত শব্দ করল। ওরা আবার শান্ত হয়ে গেল। বহু দূর থেকে ঝিকঝিক শব্দ আসছে। ট্রেনের শব্দ। দিনমানে কখনো শোনা যায় না। ট্রেনের শব্দে মনিরউদ্দিনের ভেতর এক ধরনের চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল। সে উঠোন ছেড়ে বাঁ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন সে ট্রেনের শব্দ আরো ভালো করে শুনতে চায়। বাঁ দিকে দুটি অফলা লেবুর প্রকাণ্ড ঝাড়। আকাশে চাঁদ থাকা সত্ত্বেও এ-জায়গাটায় অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। মনিরউদ্দিন স্বপ্নের কথা ভেবেই হয়তো শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। আর ঠিক তখন সে পায়ে তীব্র ও তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করল। পৃথিবী দুলে ওঠার মতো ব্যথা। মনিরউদ্দিন অসম্ভব অবাক হয়ে লক্ষ করল, লম্বা কালে সাপটি এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়েই সে আর নড়ল না। মাথা ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখতে লাগল, যেন সে তার কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত।
মনিরউদ্দিন ভাঙা গলায় বলল, হারামজাদী, তুই করছস কী।
সাপটিকে স্ত্ৰীজাতীয় মনে করার তার কোন কারণ ছিল না। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় পুরুষ এবং স্ত্রী-সাপের ভেতর কোনো রকম পার্থক্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু মরিউদ্দিনের ধারণা, হৃদয়হীন ব্যাপারগুলি স্ত্ৰীজাতীয় প্রাণীদের দ্বারাই হয়ে থাকে। এরা এসব করে না-বুঝে। কাজেই তাদের ওপর রাগ করা যায় না। সে সাপটির ওপর রাগ করল না। ক্লান্ত গলায় বলল, হারামজাদী, ভাগ! যা করনের করছ, দেখস কী? দেখনের কিছু নাই। সাপটি মনে হয় তার কথা শুনল। ঢুকে গেল লেবুঝোপের ভেতর। সবুজ লুঙ্গি-পরা খালিগায়ের একটি বেঁটেখাটো লোকের পায়ে সে তার তীব্র বিষের অনেকখানি ঢেলে দিয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে? জানার কোনো উপায় নেই। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের চিন্তাচেতনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
চাঁদের আলো একটু যেন স্পষ্ট হল। হয়তো মেঘে ঢাকা পড়েছিল, মেঘ কেটে গেছে। বাতাসে লেবুফুলের গন্ধ। লেবুগাছগুলি ফল ধরাতে পারে না বলেই প্রচুর ফুল ফোটায়।