Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

অন্যদিন – 8

এত বড় বাড়ি খাঁ খাঁ করছে।

কেউ কোথাও নেই। গেটের পাশে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত আজ সেও নেই। দরজার সামনে ভাৱী পর্দা দুলছে। পর্দা টেনে ভেতরে ঢুকতে সংকোচ লাগলো। কে জানে হয়তো শেলীর মা ভেতরে বসে আছেন। তিনি কখনো আসেন না। আমার সামনে। হয়ত বিরক্ত হবেন। হয়ত লজ্জা পাবেন।

বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম। এগারোটা বাজাব ঘণ্টা দিচ্ছে। এদের বসবার ঘরে অদ্ভুত একটা দেয়াল ঘড়ি আছে। বাজনার মত শব্দে ঘণ্টা বাজে।

কাকে চান?

আমি চমকে দেখি চশমা পড়া একজন মহিলা পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। আমি ইতস্তত করতে লাগলাম; কে জানে ইনিই হয়তো শেলীর মা। থেমে থেমে বললাম, আমি শেলীর মাস্টার।

হ্যাঁ আমি চিনতে পারছি। কী ব্যাপার?

আমাকে আসতে বলেছিলেন।

কে আসতে বলেছিলেন?

শেলীর মা আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন।

ভদ্রমহিলার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। অবাক হয়ে তাকালেন।

আমি, আমি খবর দিয়েছিলাম? কেন, আমি খবর দেব কেন? ঘাম বেরিয়ে গেল আমার। পিপাসা বোধ হল। শেলীর মা শান্ত স্বরে বললেন, ঘরে এসে বসুন। কেউ নেই আজকে। শেলী তার ফুপার বাসায় গেছে। ফিরতে রাত হবে। আচ্ছা খবর দিয়েছে কে?

আমি ঘামতে ঘামতে বললাম, তাহলে হয়ত ভুল হয়েছে আমার। আচ্ছা আমি তাহলে যাই।

না না চা খেয়ে যাবেন। চা দিতে বলছি। খবর কে দিয়েছে আপনাকে?

আমি শুকনো গলায় বললাম, শেলী চিঠি দিয়েছিল।

ও তাই। আছে চিঠিটা? দেখি একটু।

শেলীর মা ভ্রূ কুঁচকে সে চিঠি পড়লেন। বন্ধ করে খামে ভরলেন আবার খুলে পড়লেন। আমার মনে হল তাঁর ঠোঁটের কোণায় একটু যেন হাসির আভাস।

চা আসতে দেরি হল না। চায়ের সঙ্গে দুটি সন্দেশ। ঝাক ঝাঁকে রুপোর গ্লাসে বরফ মেশানো ঠাণ্ডা পানি। ভদ্রমহিলা খুব কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন। এক সময় যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এই ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ একবার অবিশ্য বলেছিলাম শেলীকে তোমাকে এখানে আসবার কথা লিখতে! তেমন কোনো কারণে নয়।

আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। ভদ্রমহিলা বললেন, বয়সে অনেক ছোট তুমি। তুমি করে বলছি বলে আবার রাগ করছ না তো?

জি না।

তুমি আজ রাতে ন’টার দিকে একবার আসবে? শেলীর বাবা বাসায় থাকবেন তখন। আসতে পারবে?

যদি বলেন আসতে আসব।

হ্যাঁ। আসবে তুমি। আমি বরংচ গাড়ি পাঠাব।

গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমি আসব।

আর শোন, শেলীর চিঠিটা থাকুক আমার কাছে।

সমস্ত দিন কাটল এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে। একি কাণ্ড করল শেলী? কেন করল? বোধহয় কিছু না ভেবেই করেছে। সারা দুপুর শুয়ে রইলাম। কিছুই ভাল লাগছে না। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। এর মধ্যে করিম সাহেব এসে খ্যান খ্যান শুরু করেছেন। তার বক্তব্য –সফিক কোন সাহসে তাকে চায়ের দোকানে যোগ দিতে বলল। চাকুরি নাই বলেই রিকশাওয়ালাদের জন্যে চা বানাতে হবে? সফিক ভেবেছেটা কী? মান-সম্মান বলে একটা জিনিস আছে ইত্যাদি। আমার বিরক্তির সীমা রইল না। করিম সাহেব বক বক করতেই লাগলেন, আমার দাদার বাবা ছিলেন জমিদার বুঝলেন? তিনটা হাতী ছিল আমাদের। জুতা হাতে নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ হাঁটতে পারত না। জুতা বগলে নিতে হত। আমাদের বসত বাড়ির ইট বিক্রি করলেও লাখ দুই লাখ টাকা হয় বুঝলেন?

সফিক আসলো সন্ধ্যাবেলা। অতিব্যস্ত সে। এসেই এক ধমক লাগাল, সন্ধ্যাবেলা শুয়ে আছিস। কাপড় পর। নীলগঞ্জ হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে আনি।

আরেক দিন দেখব। আজ কাজ আছে এক জায়গায়। নটার সময় যেতে হবে।

নটা বাজতে দেরি আছে। উঠ দেখি। করিম সাহেব। আপনিও চলেন দেখি। সবাই মিলে রেস্টুরেন্টটা দাঁড় করিয়ে দেই।

করিম সাহেব মুখ লম্বা করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

সফিক হাসি মুখে বলল, ঘর ভাড়া নিয়ে নিয়েছি। সাইন বোর্ড। আজ সকালে টাঙ্গিয়ে দিয়ে আসলাম। জিনিসপত্তর কেনাকাটা বাকি আছে। লালুকে সাথে নিয়ে সেই সব কিনব, এক্সপার্ট আদমি সে।

সফিকের উৎসাহের সীমা নেই। আমি শুনছি কী শুনছি না। সেই দিকেও খেয়াল নেই। নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছে, ঘরের মধ্যে পার্টিসন দিয়ে থাকার জায়গা করেছি। দিব্যি পড়াশুনা করতে পারবি তুই। ইলেকট্রিসিটি আছে, অসুবিধা কিছু নাই। তুই আর করিম সাহেব তোরা দুইজন কাল পরশুর মধ্যে চলে আয়।

করিম সাহেব?

হ্যাঁ ও আর যাবে কোথায়? পঞ্চাশ বৎসর বয়সে কী আর নতুন করে চাকরি করা যায়? দুই একদিন গাই গুই করবে তারপর দেখবি ঠিকই লেগে পড়েছে হা হা হা।

ঘরের সামনে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নড়বড়ে একটা ঘর কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে।

এই তোর ঘর?

তুই কী ভেবেছিলি? একটা সাত মহল রাজপ্রাসাদ?

কে আসবে তোর এখানে চা খেতে?

আসবে না কেন সেইটা শুনি আগে?

একটা ছেলে এসে ঘরের তালা খুলে দিল। সফিক হৃষ্ট চিত্তে বলল, এর নাম কালু। দারুণ কাজের ছেলে।

কি রে ব্যাটা আছিস কেমন?

বালা আছি স্যার।

আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম সব। সারি সারি বেঞ্চ পাতা। ফাঁকে ফাঁকে আবার টুল কাঠের চেয়ার। মেঝেতে ইদুর কিংবা সাপের গর্ত। দরমার বেড়ায় এক চিলতে জায়গা আবার আলাদা করা। তার মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা দুটি জরাজীর্ণ চৌকি।

সফিক বলল, কি রে পছন্দ হয়েছে?

আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, ভালই তো।

বুঝতে পারছি তোর পছন্দ হয়নি। দেখবি সব হবে। আমি না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। রাস্তায় রাস্তায় সুচ পর্যন্ত বিক্রি করেছি। আমি, কী ভেবেছিস ছেড়ে দিব? আয় চা খাই।

কোথায় চা খাবি?

পাশেই চায়ের দোকান আছে একটা।

চায়ের দোকানের মালিক সফিককে দেখে। গম্ভীর হয়ে গেল।

সফিক হাসিমুখে বলল,

ভাল আছেন নাকি রহমান সাব?

ভাল আর কেমনে থাকুম কন। আমার দোকানের পিছে দোকান দিছেন, ভাল থাকন যায়?

এই তো ভালরে ভাই কম্পিটিশন হবে। যেটা ভাল সেটা টিকবে।

সফিক ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বলল, রহমান সাব সব বি. এ. এম. এ পাস ছেলেরা কাজ করবে আমার দোকানে। এই দেখেন একজন বি. এ.পাস।

রহমান সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। সফিক গম্ভীর হয়ে বলল, আর আমাদের ম্যানেজার কে জানেন নাকি? নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব। জ্যোতিষ সাগর। বুঝেন কাণ্ড ইয়া দাড়িইয়া গোফ।

রহমান সাহেব নিস্পৃহ সুরে বললেন, ভদ্রলোক আপনেরা সাবধানে থাকবেন। পাড়াটা গুপ্ত বদমাইশের পাড়া। আমি থাকতে পারি না। আর আপনেরা নতুন মানুষ।

গুণ্ডা বদমাইশ কী করবে আমাদের? আমাদের ম্যানেজার সাক্ষাত দুর্বাষা মুণি। কাঁচা গিলে ফেলবে।

কাঁচা গিললে তো ভালই। আপনেরা চা খাইবেন? এই চা দে দেখি।

রহমান সাহেব গম্ভীর হয়ে বিড়ি ধরালেন। সফিক ফিসফিস করে বলল, ব্যাটা তখন থেকেই ভয় দেখাচ্ছে শুধু। একবার মিনো গুণ্ডাকে নিয়ে আসব। মিনো গুণ্ডাকে দেখলে রহমান সাহেবের দিল ঠাণ্ডা হয়ে যাবে দেখিস।

মিনোটা কে?

আছে আছে। আমার কাছেও জিনিসপত্র আছে। হা হা হা। মিনো গুণ্ডা আমার ছাত্র ছিল।

পান্থনিবাসে ফিরলাম রাত আটটার দিকে। বাড়ির সামনের জায়গাটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে কে যেন বসে আছে। সফিক কড়া গলায় বলল, কে ওখানে কে?

কোনো সাড়া শব্দ নেই। আরেকটু এগিয়ে যেতেই বুকের মধ্যে কী ধরনের যেন অনুভূতি হল। দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে চেঁচালাম, কে কে?

আমি নিশানাথ।

আমরা অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। সফিক প্রথম বলল, ভাবলেশহীন গলা, এইখানে কী মনে করে নিশানাথ বাবু? কিছু ফেলে গিয়েছিলেন নাকি?

নিশানাথ বাবু শান্ত গলায় বললেন, তুমি ভাল সফিক?

আমি কেমন আছি তা দিয়ে আপনার কোন দরকার নিশানাথ বাবু? আমি দৌড়ে গিয়ে নিশানাথ বাবুর হাত ধরে ফেললাম। গাঢ় স্বরে বললাম, আসেন। ঘরে আসেন।

প্রায় দুমাস পর দেখছি জ্যোতির্ষিণবকে। গেরুয়া পাঞ্জাবি ছাড়া সব কিছু আগের মতই আছে। পাঞ্জাবির বদলে সাদা রঙের একটি শার্ট। বেশ খানিকটা রোগ লাগছে। চোখ দুটি যেন অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। নাকি আমার দেখার ভুল।

সফিক এমন একটা ভাব করতে লাগল যেন জ্যোতির্ষাণবের ফিরে আসাটা তেমন কোন ব্যাপার নয়। সাধুজী যেন চা খেতে গিয়েছিল। চা খেয়ে ফিরে এসেছে। সে গুন গুন করে কী একটা গানের কলি ভাজিল। তারপর গভীর মনোযোগের সঙ্গে হিসাবপত্রের খাতা বের করে কী যেন দেখতে লাগল। এমন সব ছেলেমানুষী কাণ্ড সফিকের। শেষ পর্যন্ত আমার অসহ্য বোধ হল। চেঁচিয়ে বললাম, বন্ধ করা তো খাতাটা।

সফিক খাতা বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে বলল, নিশানাথ জ্যোতির্ষিণব, আপনাকে আমাদের ম্যানেজার করা হয়েছে।

কিসের ম্যানেজার?

চায়ের দোকান দিয়েছি আমরা।

জ্যোতির্ষিণবের ঠোঁটের কোণায় হাসি খেলে গেল। হালকা গলায় বললেন, সত্যি সত্যি শেষ পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট দিয়েছ?

হ্যাঁ ঘর ভাড়া হয়ে গেছে।

ঘর ভাড়া হয়ে গেছে।

হুঁ।

জ্যোতির্ষিণব হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ আর কেউ কোন কথা বলল না। সফিক মৃদু স্বরে বলল, নৈশব্দের পরী উড়ে গেছে তাই না নিশানাথ বাবু? হঠাৎ সবাই চুপ করলে পরী উড়ে যায়। তাই না?

জ্যোতির্ষিণব মৃদু স্বরে বললেন, তোমার অসুখটা সেড়েছে সফিক?

হ্যাঁ সেরেছে।

জ্বর আসেনা আর?

আর কোনোদিন আসবে না।

আমি বললাম, আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন?

জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ালাম।

খেতেন কী?

আশ্চর্যের কথা কী জান? খাওয়া জুটে গেছে। না খেয়ে থাকিনি কখনো। পান্থ নিবাসে বরং আমার কষ্ট হয়েছে বেশি।

সফিক দৃঢ় স্বরে বলল, আর কষ্ট হবে না। আর কখনো না খেয়ে থাকতে হবে না। দেখবেন দিনকাল পাল্টে ফেলব।

নিশানাথ বাবু একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। যেন সফিকের কথাটি ঠিক নয়। সফিক ভুল বলছে। আমি বললাম, আমাদের কিছু না বলে চলে গেলেন কেন?

খুব মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। মায়া কাটানোর জন্যেই এটা করেছি।

সফিক কড়া গলায় বলল, মায়া কেটেছে?

নিশানাথ বাবু থেমে বললেন, মায়া কাটছে সফিক।

তাহলে ফিরে আসলেন কেন?

জ্যোতির্ষিণব তার জবাব না দিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। যেন খুব একটি ছেলেমানুষী প্রশ্ন তাকে করা হয়েছে। কিন্তু নটা বেজে যাচ্ছে। আমি আর থাকতে পারি না। আমি উঠে দাঁড়ালাম, এক ঘণ্টার মধ্যে আমি আসব। একটা খুব জরুরি কাজ আছে না গেলেই নয়।

জ্যোতির্ষিণব আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন।

আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা।

শেলীর বাবা বললেন, তোমার দেরি দেখে ভাবলাম হয়তো আসবে না। গাড়ি পাঠাব। কিনা তাই ভূড়ামু, শেলীর মা কোণার দিকে একটি সোফায় বসেছিলেন, তিনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, শেলী শেলী।

শেলী এসে দাঁড়াল পর্দার ও পাশে। হয়ত সে এখানে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। সে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, কী জন্যে ডাকছ মা।

ভেতরে আস। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?

বল না। কী জন্য ডাকছ?

তোমার স্যারকে চা দাও।

শেলীর বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, দুপুর রাতে চা কেন? টেবিলে খাবার দিতে বল। তুমি নিশ্চয়ই খেয়ে আসনি? আর খেয়ে এসে থাকলেও বস।

খাবার টেবিলে অনেক কথা বললেন ভদ্রলোক। কত কষ্ট করে পড়াশুনা করেছেন। মানুষের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থাকতেন। সেই সব কথা বলছেন গর্ব এবং অহংকারের সঙ্গে। একজন সফল মানুষের মুখে তার দুর্ভাগ্যের দিনের কথা শুনতে ভালই লাগে। শেলীর মা একবার শুধু বললেন, এই সব কথা ছাড়া তোমার অন্য গল্প নাই?

ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেন। যেন মজার একটি কথা বলা হয়েছে। শেলী একটি কথাও বলল না একবার ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। একটি গাঢ় নীল রঙ্গের শাড়িতে তাকে জলপরীর মত লাগছিল। শাড়িতে কখনো দেখিনি তাকে! এ যেন অন্য একটি মেয়ে। শেলীর মা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করছিলেন, ক ভাই বোন আমরা। কী তাদের নাম। কী করছে। পান্থ নিবাসে থেকে পড়াশুনা করতে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়। পড়াশুনা শেষ করে কী করব?

খাওয়া শেষ হতেই আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি কী এখন যাব?

ভদ্রলোক আবার হা হা করে হেসে উঠলেন। যেন এই কথাটিও অত্যন্ত মজার। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই যাবে। তবে তুমি একটা কাজ কর আমার এখানে অনেক খালি ঘর পড়ে আছে। তুমি আমার এখানে এসে থাক।

শেলীর মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমিও তাই ভাবছিলাম। তুমি চলে আস এখানে পড়াশুনার তোমার খুব সুবিধা হবে। তা ছাড়া শেলী বেচারী খুব একলা হয়ে পড়েছে। তুমি থাকলে ওর একজন সঙ্গী হয়। বলতে বলতে মুখ টিপে হাসলেন। শেলীর দিকে ফিরে বললেন, ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল তো মা। তোমার স্যারকে পৌঁছে দিয়ে আসুক। রাত হয়ে গেছে।

শেলী আমাকে গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসল। কিছু একটা বলা উচিত তাকে। কিন্তু কোন কথাই বলতে পারলাম না। গাড়িতে ওঠার সময় শেলী শান্ত স্বরে বললো, আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে।

ঘরে ফিরে দেখি সফিক শুয়ে আছে। তার চোখ ঈষৎ রক্তাভ। বোধহয় আবার জর আসছে। সফিক ক্লান্ত স্বরে বলল, নিশানাথ চলে গেছে। বিদায় নিতে এসেছিল আমাদের কাছে।

কোথায় গেছে?

প্রথমে বারহাট্টা। সেখান থেকে যাবেন মেঘালয়ে। তাঁর কোন জ্ঞাতি খুঁড়ো থাকেন তার কাছে যাচ্ছে। ঐখানেই থাকবে।

আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারলাম না। সফিক বললো, কী জন্যে থাকবে সে? তিন পুরুষের কুলধৰ্ম ছাড়তে পারে কেউ?

আর আসবে না ফিরে?

না।

সফিক হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে উত্তেজিত স্বরে বলল, নিশানাথ না থাকুক তুই তো আছিস। দুজনে মিলে দেখা না কী কাণ্ড করি। আমি চুপ করে রইলাম। সফিক শুয়ে পড়ল। গায়ে হাত দিয়ে দেখি বেশ জ্বর। সফিক আচ্ছন্নের মত বলল, জ্যোতির্ষিণব কিন্তু সত্যি ভাল হাত দেখে। আজ আমি অবাক হয়েছি –খুব অবাক হয়েছি তার ক্ষমতা দেখে।

আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, কী বলেছে জ্যোতির্ষিণব?

সফিক সে কথার জবাব দিল না। আমি অবাক হয়ে দেখি তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। অশ্রু গোপন করবার জন্যে সে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল, শুধু জ্যোতির্ষিণব কেন তুই নিজেও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাস আমার তাতে কিছুই যাবে আসবে না। আমি ঠিক উঠে দাঁড়াব।

সেই রাত্রে একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। যেন আদিগন্ত বিস্তৃত একটি সবুজ মাঠ। মাঠের ঠিক মাঝখানে সফিক দাঁড়িয়ে আছে একা একা। তার গায়ে মুকুট নাটকের মধ্যম রাজকুমারের পোশাক। আকাশ ভরা জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না ভেজা সেই রাতে সবুজ মাঠের মাঝখান থেকে সফিক যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করল।

ঘুম ভেঙে গেল আমার। বাইরে এসে দেখি ফকফকা জ্যোৎস্না হয়েছে। বারান্দার মেঝেতে অপূর্ব সব নকশা। পায়ে পায়ে এগিয়ে উঁকি দিলাম। সফিকের ঘরে।

সফিক অন্ধকারে বসে চা খাচ্ছে একা একা। আমাকে দেখে সে হাসি মুখে ডাকল, চা খাবি রঞ্জু? আয় না, জ্বরটা সেরে গেছে। আমার বেশ লাগছে এখন।

অকারণেই আমার চোখে জল আসল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 8 of 8 ): « পূর্ববর্তী1 ... 67 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress