অন্যদিন – 6
জ্যোতির্ষিণব ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
রাত আটটায় ফিরে এসে দেখি নিশানাথ বাবুর ঘর খালি। চৌকিটা বাইরে টেনে এনে রাখা হয়েছে। রশীদ মিয়া চৌকির উপর গম্ভীর হয়ে বসে সিগারেট টানছে। কাদের বালতি বালতি পানি এনে ঘরের মেঝেতে ঢালছে এবং ঝাটা দিয়ে সশব্দে বাট দিচ্ছে। ছুটির দিন বলেই মেসে লোকজন কেউ নেই। নবী সাহেবও মেয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছেন। নয়। নম্বর ঘরে যে ছেলেটি থাকে। শুধু তার ঘরে বাতি জ্বলছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী ব্যাপার রশীদ সাহেব?
কিসের কী ব্যাপার?
সাধুজী কোথায়?
চলে গেছে।
কোথায় চলে গেছে?
আমি কি জানি কোথায় গেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন?
কখন গেছেন?
দুপুরে।
হঠাৎ চলে গেলেন যে?
কী মুশিবত আমি তার কী জানি। যেতে চাইলে আমি ধরে রাখব নাকি? শ্বশুর বাড়ি এইটা?
আমি বেশ অবাক হলাম। নিশানাথ বাবু কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করে চলে যাবেন এটা ভাবা যায় না। তা ছাড়া তার যাওয়ার কোনো জায়গাও সম্ভবত নেই। কে জানে হয়ত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিংবা হয়ত চায়ের দোকানে বসে আছে একা একা। আমি কাপড় না ছেড়েই চায়ের দোকানে চলে গেলাম। না সেখানে সাধুজী যাননি। রাস্তার মোড়ে যে ছেলেটি পান সিগারেট বিক্রি করে সে বলল–সাধুজী সুটকেস হাতে নিয়ে উত্তর দিকে গেছেন। তার দোকান থেকে দুপ্যাকেট স্টার সিগারেট কিনেছেন।
মেসে ফিরে যেতেই নয়। নম্বরের ছেলেটির সঙ্গে দেখা হল। এই ছেলেটি এক পত্রিকার অফিসে কাজ করে। তার সব সময় নাইট ডিউটি। সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘুমায়, কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। মেসে সে খায় না। ছুটি-ছাঁটার দিন তার কেরোসিন চুলায় নিজেই দেখি রান্না করে। আমাকে দেখেই ছেলেটি বলল, সফিক সাহেব কখন ফিরবেন?
জানি না কখন।
সফিক সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
কী ব্যাপার?
ছেলেটি আড় চোখে রশীদ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আসেন আমার ঘরে বসি। আপনি তো আসেন নাই কখনো। আমি নিজেই অবশ্যি কাউকে বলি না। আমার একা একা থাকতে ভাল লাগে। সিঙ্গেল রুম নিয়েছি। এই জন্যে।
তার ঘর নবী সাহেবের ঘরের মতো গোছানো। দেখেই মনে হয় নারীর স্পর্শ আছে। দেয়ালে আবার নীলরঙ্গা একটি তৈলচিত্র। জ্যোৎস্না রাত্রির ছবি। অসম্ভব সুন্দর এই ছবিটি ঘরের চেহারা পাল্টে ফেলেছে। তাকালেই মন বিষগ্ন হয়।
আমার ছোট ভাইয়ের আঁকা। আর্ট কলেজে পড়ে ফোর্থ ইয়ার। আপনি কী চা খাবেন? চায়ের ব্যবস্থা আছে।
না চা খাব না। আমি, ভাত খাই নাই এখনো। আপনি কী জন্যে ডাকছিলেন।
ছেলেটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
সাধুজী আজ দুপুরে আমার কাছে একটি ঘড়ি রেখে গেছেন। সফিক সাহেবকে দেয়ার জন্যে। খুব দামী ঘড়ি।
আমি চুপ করে রইলাম। ছেলেটি বলল,
তিনি যাওয়ার সময় কাদছিলেন। আমার এমন খারাপ লাগল বুঝলেন। বিকালে এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল, যাই নাই দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম।
আমি বললাম, আপনার নাম আমি জানি না। কী নাম ভাই?
সুলতান। সুলতান উদ্দিন। সাধুজী ছাড়া কেউ আমার নাম জানে না। কারো কাছে যাইনা তো। সাধুজীর কাছে একবার গিয়েছিলাম। মনটা খুব খারাপ সেই সময়। হঠাৎ গেলাম। তিনি অনেক কথা বললেন এখনো মনে আছে।
কী বললেন?
এই সান্ত্রনার কথা আর কি! অন্য রকম করে বললেন। সান্ধনার কথা বলা তো খুব কঠিন। সবাই বলতে পারে না। খুব হৃদয়বান মানুষ লাগে।
আমি অনেকক্ষণ বসে রইলাম তার ঘরে। কথাবার্তা না–চুপচাপ বসে থাকা। ছেলেটি একেবারেই কথাবার্তা বলে না যতবার বললাম, উঠি? ততবারই বলে, বসেন না। আরেকটু বসেন। সফিক সাহেব আসলে যাবেন। রাত এগারোটা পর্যন্ত সফিকের জন্যে অপেক্ষা করে খেতে গোলাম; এত রাত পর্যন্ত কাদের থাকে না। টেবিলে ভাত তরকারী ঢেকে রেখে ঘুমাতে যায়। কিন্তু আজ দেখি জেগে আছে। ভাত তরকারী বাড়তে বাড়ষ্ণুপ্রিশ্ন করে বলল, হুঁনছেন সারা করিম সার মাল খাইছে আইজ।
কী বললি?
মাথা ফট্টি নাইন। বমি কইরা ঘর ভাসাইয়া দিছে। আমারে সাফ করতে কয়। আমি কইছি মাল খাওয়া বমি আমি সাফ করি না। ভদ্রলোকের ছেলে আমি কী কন্ন স্যাব? অন্যায়। কইলাম।
উপরে উঠেই করিম সাহেবের সঙ্গে দেখা। বারান্দায় রাখা চৌকিবা উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। আমাকে দেখেই মাথা তুলে বললেন, সাধুজী চলে গেছে শুনেছেন? শালা রশীদ মিয়ার পেটে আমি একটা তিন নম্ববী চাকু যদি না ঢুকাই তাহলে আমি বেজন্ম কুত্তা। শালার মাকে আমি…
করিম সাহেব অনর্গল কুৎসিত কথা বলতে লাগলেন। তারপর এক সময হাড় হড় কবে বমি করে ফেললেন।
আপনার কী শরীর খারাপ করিম সাহেব?
না শরীর ঠিকই আছে। শালার সস্তার তিন অবস্থা। সস্তা জিনিস খেয়ে এখন মরণ দশা। ছয় টাকা করে বোতল বুঝলেন? বলতে বলতে আবার বমি।
সফিক আসল বারোটার দিকে। নিশানাথ বাবু চলে গেছেন এই খবরে তার কোনো ভাবান্তব হল না। ভেলভেটের বাক্সে মোড়া ঘড়ি ফেলে রাখল টেবিলের এক কোণায়। তার ভাবভঙ্গি এ রকম যেন নিশানাথ বাবুর ঘর ছেড়ে যাওয়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। বোজই এবকম হয়। রাতে ঘুমতে যাবার সময় বলল, চায়ের দোকান স্টার্ট দিয়ে দিব এইবার। খোঁজখবব শুরু করেছি। দুহাজার টাকা সেলামী দিলে শ্যামলীতে একটা ঘর পাওয়া যায়। ভাল ঘর; আভাকে বলব টাকাটা ধার দিতে।
দিবে সে?
দিবে নিশ্চয়ই। আর না দিলে কী আছে, ছোট করে শুরু করব। নবী সাহেবকে বলব কিছু দিতে।
নবী সাহেব অবশ্যি দিবেন।
সবাই দিবে। দেখিস না কী করি।
আমি বললাম, শুধু আমাদের ম্যানেজারই নেই। সফিক কোন উত্তর দিল না। বাতি নিবিয়ে মশারি ফেলে শুয়ে পড়ল। বাইবে করিম সাহেব মস মাস করে হাটতে লাগলেন। বমি টমি করলে শুনেছি মাতালদেব নেশা কেটে যায়। কিন্তু বাত যত গভীর হচ্ছে করিম সাহেবের নেশাও মনে হয় ততই গাঢ় হচ্ছে।
তিনি উঁচু গলায় বলছেন, ভয় পাওয়ার লোক না। আমি। কাউকে ভয় পাই না। লাথ দিলে সব ঠিক ঠাক। এমন লাথ ঝাড়ব পাছায় বাপের নাম ভুলিয়ে দিব।
এক সময় সফিক বিরক্ত হয়ে বলল,
ঘুমাতে যান করিম সাহেব।
কেন? তোমার হুঁকুম নাকি? আমি কী তোমার হুঁকুমের গোলাম?
চুপ করেন করিম সাহেব।
তুই চুপ কর শালা।
সফিক আর কথা বাড়াল না। আমার অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসল না। এপাশ ও পাশ করতে লাগলাম। বুঝতে পারছি সফিকও জেগে আছে। সফিক একবার ডাকল, জেগে আছিস নাকি রঞ্জু?
আমি জবাব দিলাম না। বাইরে করিম সাহেবেরও আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সফিক এক সময় মশারির ভেতরেই একটা সিগারেট ধরিয়ে খিক খ্যক করে কাশতে লাগল। অন্ধকার ঘরে একটা লাল ফুলকি উঠানামা করছে। দেখতে দেখতে ঘুম এসে গেল।
ঘুম ভাঙলো শেষ রাত্রে। ঘরের দরজা হাট করে খোলা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বৃষ্টির ছাটে বিছানা ভিজে একাকার। আমি ডাকলাম, সফিক এই সফিক।
কোন উত্তর নাই। বাইরে বেরিয়ে দেখি সে সিগারেট হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমাকে আসতে দেখে ক্লান্ত স্বরে বলল, ঘুম আসেছে নারে।
বৃষ্টিতে ভিজছিস তো।
সফিক একটু সরে বলল, জ্যোতির্ষাণবের জন্যে খারাপ লাগছে। বেশ খাবাপ লাগছে। সকাল হলেই খুঁজতে বের হব। ঢাকাতেই আছে নিশ্চয়ই।
সফিক খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, অনু মারা গেছে। গত পরশু চিঠি পেয়েছি। একটা টেলিগ্রাম করার দরকার মনে করে নাই।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
তুই তো আমাকে কিছু বলিস নাই সফিক।
এই সব বলতে ভাল লাগে না।
কি ভাবে মারা গেল?
সাপে কেটেছিল। তাই লেখা। ওঝা টঝা নাকি এসেছিল। আমি সফিকের হাত ধরালাম। আশ্চর্য জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ সহজ স্বাভাবিক মানুষের মত বসে আছে।
তোর তো ভয়ানক জ্বর সফিক।
হ্যাঁ শরীরটা খাবাপ।
আয় শুযে থাকবি? মাথায় জল পট্টি দেব?
নাহ এইসব কিছু লাগবে না। আমার ভালুক জ্বর; সকালবেলা থাকবে না দেখবি।
জ্যোতির্ষিণবকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় খোজা হয়। ছিন্ন মুল মানুষেবা যে সব জায়গায় রাতে ঘুমায়, সফিক গভীর বাতে সেই সব জায়গায় খুঁজতে যায়। কমলাপুব বেল স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল লাভ হয় না। কিছু। ফুটপাতে যে সব পামিস্টরা হাতেব ছবি আঁকা সাইন বোর্ড টানিয়ে বসে থাকে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, লম্বা চুল দাড়ির এক সাধু— হাত দেখেন, তাকে কেউ দেখেছেন? নিশানাথ নাম।
কেউ কিছু বলতে পারে না। নবী সাহেবের কথামত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় :
লম্বা চুল দাড়ি পরনে গেরুয়া রঙ্গের পাঞ্জাবি প্রখ্যাত জ্যোতিষ নিশানাথ জ্যোতির্ষিণবের সন্ধান প্রার্থী।
বিজ্ঞাপন ছাপার তিন দিনের দিন হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় আভা। আপনাদের জ্যোতিষী কোথায় গেছে?
সফিক বিরক্ত হয়ে বলে, কোথায় গেছে জানলে বিজ্ঞাপন দেই নাকি?
আমি ভাবলাম আপনাদের কোন পা্বলিসিটির ব্যাপার বুঝি।
তার পাবলিসিটি লাগে না। সে অনেক বড় দরের জ্যোতিষ।
আভা শান্ত স্বরে বলে, তিনি বড় জ্যোতিষী ছিলেন। আমার হাত দেখে জন্মবার বলে দিয়েছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।
শুধু নিশানাথ নয়। নবী সাহেবও পান্থ নিবাস ছেড়ে চলে গেলেন। স্কুল থেকে মহাসমারোহে তাকে বিদায় দেয়া হয়েছে। আমরাও তার বিদায় উপলক্ষে একটু বিশেষ খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছিলাম। খেতে পারলেন না। মুখে নাকি কিছুই রুচছে না। খাওয়া বন্ধ করে একবার ফিসফিস করে বললেন, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। পান্থ নিবাসে শিকড় গজিয়ে গেছে। বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগল।
সিরাজ সাহেবের প্রমোশন হয়েছে। অফির্সাস গ্রেড পেয়েছেন। অফিস থেকে তাকে কোয়ার্টার দেয়া হয়েছে। সুন্দর কোয়ার্টার। তাঁর সঙ্গে একদিন গিয়ে দেখে আসলাম। দক্ষিণ দিকে চমৎকার বারান্দা। হুঁ হুঁ করে হাওয়া বয়। সিরাজ সাহেবও পান্থনিবাস ছেড়ে চলে গেলেন। যাবার আগের দিন রাতে বিদায় নিতে এলেন আমাদের কাছ থেকে। কথা সরে না। তাঁর মুখে। অনেকক্ষণ বসে রইলেন চুপ চাপ। এক সময় বললেন, সুখেই ছিলাম ভাই আপনাদের সাথে। আনন্দেই ছিলাম। নিশানাথ বাবুর খালি ঘরটা দেখলে চোখে পানি আসে। আমার স্ত্রীকে তিনি বড় স্নেহ করতেন।
সত্যি সত্যি চোখে পানি ছলছলিয়ে উঠল। সফিক শুয়ে ছিল। সফিকের মাথায় হাত রেখে বললেন, জ্বর কী আবার এসেছে?
আছে অল্প।
অবহেলা করবেন না ভাই। ভাল ডাক্তার দেখাবেন।
ক্ষণিকক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে বললেন, আমি অতি দরিদ্র মানুষ তবু যদি কখনো কোন প্রয়োজন হয়…
সফিক কথার মাঝখানে আমাচকা জিজ্ঞেস করল, আপনার ছোট বোন রেবা, তার কী বিয়ে হয়েছে?
হ্যাঁ গত বৈশাখ মাসে বিয়ে দিয়েছি। ঢাকাতেই থাকে। ভাল বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা অতি ভাল। আমি ভাবি নাই এত ভাল বিয়ে দিতে পারব।
সফিক আর কিছু বলল না। সিরাজ সাহেব বললেন, আপনারা দু’জন একদিন গিয়ে যদি দেখে আসেন সে খুব খুশি হবে। আপনাদেবকে চিনে খুব। সেই দিনও জিজ্ঞেস করল। আপনার অসুখের কথা।
নতুন কোন বোর্ডার এল না পান্থনিবাসে। শুনেছি। রশীদ মিয়া মেস ভেঙে বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দেবেন। মেসে নাকি তেমন আয় হয় না। এর মধ্যে মার চিঠি পেলাম :
তোমার পাঠানো একশত টাকা পাইয়াছি। আমি শুনিয়া মর্মাহত হইলাম যে তুমি পড়াশুনা ছাড়িয়া কাপড় ফেরি করিয়া বেড়াও। তোমার দুই মামা অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াছেন। তোমাব মনে রাখা উচিত তোমার নানা অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তুমি ছোটলোকের মত ফেরিওয়ালা হইয়াছ এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। পারুলের মত তুমিও যে বংশের মান ডুবাইবে তাহা ভাবি নাই। দোয়া জানিও। অতি অবশ্য একবার আসিবে। তোমার বাবার একটি পা অচল। হাঁটা চলা করিতে পারে না…
চিঠি পড়ে আমি দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকি। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।