Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অন্যদিন || Humayun Ahmed

অন্যদিন || Humayun Ahmed

অন্যদিন – 1

পান্থনিবাস বোর্ডিং হাউস
১১-বি কাঁঠাল বাগান লেন (দোতালা)
ঢাকা-৯

চিঠি লিখলে এই ঠিকানায় চিঠি আসে। খুঁজে বের করতে গেলেই মুশকিল। সফিক লিখেছিল অবশ্যি, তোর কষ্ট হবে খুঁজে পেতে। লোকজনদের জিজ্ঞেস কবতে পারিস কিন্তু লাভ হবে বলে মনে হয় না। একটা ম্যাপ একে দিলে ভাল হত। তা দিলাম না, দুর্লভ জিনিস পেতে কষ্ট করতেই হয়।

এই সেই দুর্লভ জিনিস? দু’জন মানুষ পাশাপাশি চলতে পারে না। এরকম একটা গলির পাশে ঘুপসি ধরনের দোতলা বাড়ি। কত দিনের পুরনো বাড়ি সেটি কে জানে। চিতি পরে সমস্ত বাড়ি কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। দোতলায় একটি ভাঙা জানালায় ছেড়া চট ঝুলছে। বাড়িটির ডান পাশের দেয়ালের একটি অংশ সম্পূর্ণ ধসে গিয়েছে। সামনের নর্দমায় একটি মরা বেড়াল; দূষিত গন্ধ আসছে সেখান থেকে। মন ভেঙে গেল আমার। সুটকেস হাতে এদকি-ওদিক তাকাচ্ছি— দোতলায় যাবার পথ খুঁজছি, সিঁড়ি-ফিড়ি কিছুই দেখছি না। নিচ তলা তালাবন্ধ। নোটিশ ঝুলছে—

‘এই দোকান ভাড়া দেওয়া হবে।’

দোতলার জানালার চটের পর্দার ফাক দিয়ে কে যেন দেখছিল আমাকে। তার দিকে চোখ পরতেই সে বলল, জ্যোতিষী খুঁজছেন? হাত দেখবেন? উপরে যান, বাড়ির পেছন দিকে সিঁড়ি।

পান্থনিবাস বোর্ডিং হাউসের লোকজন আমার চেনা। সফিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখেছে আমাকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার মুখে যার সঙ্গে দেখা হল তিনি যে নিশানাথ জ্যোতিষণিব তা সফিকের চিঠি ছাড়াও বলে দিতে পারতাম। প্রায় ছফুটের মত লম্বা ঝাকড়া ঘন চুলের একজন মানুষ কপালে প্রকাণ্ড এক সিঁদুরের ফোঁটা, মুখ ভর্তি দাড়ি। গায়ে গেরুয়া রঙের একটি চাদর; পরনে খাটো করে পর একটি ধবধবে সাদা সিঙ্কের লুঙ্গি! পায়ে রুপোর বোলের খরম। প্রথম দশনেই হকচাকিয়ে যেতে হয়। জ্যোতির্ষিণব সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন, হস্ত গণনা করাতে এসেছেন? পরীক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বললেন, উঁহু, সুটকেস হাতে কেউ জ্যোতিষীর কাছে আসে না। লক্ষণ বিচারে ভুল হয়েছে। তুমি সফিকের কাছে এসেছ?

জি।

সফিক সারা সকাল অপেক্ষা করেছিল। তোমার না ভোরবেলা আসার কথা?

ট্রেন ফেল করলাম। ঢাকা মেইলে আসা লাগল।

জ্যোতির্ষাণর মহা গম্ভীর হয়ে বললেন,

আমি জানতাম। সফিককে বললাম। আশাভঙ্গ হওয়ার কারণ ঘটবে। সে সারা সকাল রাস্তার মোড়ে তোমার জন্য দাঁড়িয়েছিল। আশাভঙ্গ তো হলই ঠিক কিনা তুমি বল?

হ্যাঁ তা ঠিক।

ঠিক তো হবেই। তিন পুরুষ ধরে গুহ্য বিদ্যার চাচা আমাদের হুঁ হুঁ।

জ্যোতির্ষিণব আমাকে নিয়ে গেলেন তার ঘরে। তার ঘরের বর্ণনা সফিকের চিঠিতে পড়েছি। বাড়িয়ে লিখেনি কিছুই–ঘরে ঢুকলে যে কোন সুস্থ লোকের মাথা গুলিয়ে যাবে। তিনি জানালা বন্ধ করে ঘরটা সব সময় অন্ধকার করে রাখেন। অন্ধকার ঘরে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলে। ধূপদানী আছে, কেউ হাত দেখাতে আসছে টের পেলেই ধূপদানীতে এক গাদা ধূপ ফেলে নিমিষের মধ্যে গা ছমছমানো আবহাওয়া তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু এতসব করেও তাঁর পসার নেই মোটেও।

জ্যোতির্ষিণব আমাকে চৌকিতে বসিয়ে ধূপদানীতে ধূপ ঢেলে দিলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। থমথমে গলায় বললেন, উদ্দেশ্য সফল হবে তোমার। বি.এ. পাস করবে। ঠিকমত। কপালে রাজানুগ্রহের যোগ আছে। গ্রহ শান্তির একটা কবচ নিও আমার কাছ থেকে। সফিকের বন্ধু তুমি। নামমাত্র মূল্যে পাবে। আমি বললাম, কোথায়ও একটু গোসল করা যাবে? আশপাশে চায়ের দোকান আছে? বড় চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে।

জ্যোতির্ষিণব আঁৎকে উঠলেন। যেন এমন অদ্ভুত কথা কখনো শুনেন নি। রাগী গলায় বললেন, স্বাস্থ্য বিধির কিছুই দেখি জান না। গায়ের ঘাম না। মরতেই গোসল চা। ঠাণ্ডা হয়ে বস দেখি।

তিনি একটি টেবিল ফ্যান চালু করলেন। ফ্যানটি নতুন। ভয়ানক গভীর স্বরে বললেন, আমার এক ভক্ত দিয়েছে। এই সব বিলাস সামগ্ৰী দুই চক্ষে দেখতে পারি না। তান্ত্রিক মানুষ আমরা –এসব কী আমাদের লাগে? শীত গ্রীষ্ম সব আমাদের কাছে সমান।

ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করবার পর জ্যোতির্ষিণব আমাকে গোসলখানা দেখিয়ে দিলেন।

খুব সাবধানে গোসল সারবে রঞ্জু। দারুণ পিছল মেঝে। মেসের অন্য বোর্ডাররা কেউ নেই। যতক্ষণ ইচ্ছা থাক গোসলখানায়। চা আমি বানিয়ে রাখব এসেই গরম পাবে। কয় চামচ চিনি খাও চায়ে?

গায়ে পানি ঢালতেই শরীর জুড়িয়ে গেল। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি। পথের ক্লান্তি, নতুন জায়গায় আসার উদ্বেগ সব মুছে গিয়ে ভাল লাগতে শুরু করল। হঠাৎ করেই মনে হল নীলগঞ্জের পুকুরে যেন ভরদুপুরে সাতার কাটছি। আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি। সুখী হওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষের। অতি সামান্য জিনিসও মানুষকে অভিভূত করে ফেলতে পারে।

আমার বাবার কথাই ধরা যাক। তাঁর মত সুখী লোক এ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই বলেই আমার ধারণা! অথচ গত ছয় বছর ধরে তার কোন চাকরি-বাকরি নেই। তিনি ভোর বেলা উঠেই স্টেশনে যান। সেখানকার চায়ের স্টলটি নাকি ফ্যাস ক্লাস চা বানায়। খালি পেটে ঐ চা পর পর দুকাপ খাবার পর তিনি স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে গল্প-গুজব করেন। কি গল্প করেন তিনিই জানেন। নটার দিকে স্বরূলের ভাত রান্না হয় বাড়িতে। সে সময় তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। আনজু এবং পারুলের সঙ্গে অতি দ্রুত ভাত খেয়ে নেন। সময় তার হাতে খুব অল্প কারণ সাড়ে দশটার দিকে পোস্টাপিসে খবরের কাগজ আসে। কাগজটি পড়া তার কাছে ভাত খাওয়ার মতই জরুরি। সন্ধ্যাবেলা তিনি হারু গায়েনের ঘরে বেহালা বাজানো শিখেন। বর্তমানে এই দিকেই তার সমস্ত মন প্ৰাণ নিবেদিত। মহাসুখী লোক তিনি। মা যদি বলেন, পারুলের তো নাম কাটা গেছে স্কুলে। তিন মাসের বেতন বাকি।

বাবা চোখে-মুখে দারুণ দুঃশ্চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে বলেন, বড়ই মুসিবত দেখছি। গভীর সমুদ্র। হঁ যত মুশকিল তত আহসান। হাদিস কোরানের কথা। চিন্তার কিছু দেখি না। সমস্যার সমাধানও বের করেন সঙ্গে সঙ্গে, দরকার নাই স্কুলে পড়ার। পারুল মা, প্রাইভেটে মেট্রিক দিবে তুমি। আমি পড়াব তোমাকে। বইগুলি সব নিয়ে আয় তো মা এবং তিন নম্বরি একটা খাতা আন, রুটিনটা লেখি আগে।

মা ছাড়া আমরা কেউ বিরক্ত হই না বাবার ওপর। আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি বাবা এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। এই জগতের দুঃখ কষ্টের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই।

আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে বাবা স্টেশনে এসেছিলেন। ট্রেন ছাড়বার আগে আগে আমাকে বললেন,

রঞ্জু, একটু এদিকে শুনে যা তো।

পারুল আর আনজ্বর কাছে থেকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেলেন আমাকে। গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু করে বললেন, একটা ভাল বেহালার দাম কত, খোঁজ নিবি তো। ভুলিস না যেন।

খোঁজ নিব। ভুলব না।

আমার নিজের জন্যে না। বুড় বয়সে কী আর গান বাজনা হয়? তোর মাও পছন্দ করে না। অন্য লোকের জন্য।

আমি খোঁজ নিব।

ট্রেন ছাড়ার সময়ও এক কাণ্ড করলেন। ট্রেনের সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করলেন। ট্রেনের গতি যত বাড়ে তার গতিও বাড়ে। ট্রেনের লোকজন গলা বাড়িয়ে মজা দেখতে লাগল।

গোসল সেরে দোতলায় উঠে এসে দেখি জ্যোতির্ষিণবের ঘর জমজমাট। দুতিন জন লোক বসে আছে পাংশু মুখে। জ্যোতির্ষিণব একজনের হাতের তালুর দিকে অখণ্ড মনযোগে তাকিয়ে আছেন। আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, পর্দা ঠেলে ভেতরে চলে যাও। চা পিরিচে ঢাকা।

আগে লক্ষ্য করিনি যে পায়রায় খুপড়ির মত ঘরও পর্দা দিয়ে দুভাগ করা। ভেতরে ঢুকে দেখি দড়ির খাটিয়ার উপর ধবধবে সাদা চাদরে চমৎকার বিছানা করা। বিছানার লাগোয়া একহাত বাই একহাত সাইজের টেবিল একটি। তার উপরও ধবধবে সাদা ঢাকনি। খাটিয়াটার মাথার পাশে বেতের শেলফ। শেলফের উপর চমৎকার একটি কাচের ফুলদানীতে ফুল। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। জ্যোতিষণিব দেখি দারুণ সৌখিন লোক।

শুধু চা নয়। পিরিচে খাবার ঢাকা আছে। একটি লাড়ু এবং একটি সিঙ্গারা। আমি চ খেতে খেতে শুনলাম জ্যোতির্ষিণব গম্ভীর গলায় বলছেন, গ্রহ শান্তি কবচ নিতে পারেন আমার কাছ থেকে। রত্নও ধারণ করতে পারেন। তবে রত্ন অনেক দামী। তাছাড়া আসল জিনিস মিলবে না, চারদিকে জুয়াচুরি।

গ্রহ শান্তিতে কত খরচ পড়বে?

বিশ টাকা নেই। আমি, তবে আপনার জন্যে দশ।

দশ যে বড় বেশি হয়ে যায় সাধুজী।

জ্যোতির্ষাণব হাসেন।

পঞ্চ ধাতুর কবজের দামই মশাই পাঁচ টাকা। তাম্র স্বর্ণ রৌপ্য পারা ও দস্তা। তঞ্চকতা পাবেন না। আমার কাছে। একবার ধারণ করে দেখুন টাকাটা জলে যায় কিনা। টাকাই তো জীবনের সব নয়। হুঁ হুঁ।

বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি ধরে যায় আমার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে, ঘর অন্ধকার। সুইচ আছে একটি। আলো জ্বালাতে ঠিক সাহস হয় না। সাধুজী পাশের ঘরে প্রদীপ জেলে বসে আছেন। কে জানে ইলেকট্রিসিটির আলোতে তার হয়ত অসুবিধা হবে। সফিক কত রাতে ফিরবে কে জানে? শুয়ে পড়লাম সাধুজীর বিছানাতেই।

শুয়ে শুয়ে কত কি মনে হয়। বাবা যেন ম্যাকমিলান কোম্পানির তার সেই পুরানো চাকরিটা আবার ফিরে পেয়েছেন। গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরেছেন প্রকাণ্ড একটা মাছ হাতে নিয়ে। পারুলের বিছানার পাশে ঝুকে ডাকছেন,

ওরে পারুল, ওরে টুনটুনি, ওরে কুট কুট, ওরে ভুটি ভুটি।

মা কপট রাগের ভঙ্গি করে বলছেন, কি যে পাগলামী তোমার। এই দুপুর রাতে মাছ কুটিতে বসব নাকি?

বাবার মুখ ভর্তি হাসি।

একশ বার বসবে। হাজার বার বসবে।

পারুল ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। বার বার বলছে,

বইটা এনেছ বাবা? দেশ বিদেশের রূপকথা নাম লিখে চিঠি দিয়েছিলাম যে তোমাকে?

উঁহু, বডড ভুল হয়ে গেছে রে। একটুও মনে নেই। সামনের শনিবার ঠিক দেখিস…

পারুলের নিচের ঠোট বেঁকে যেতে শুরু করতেই বাবা ম্যাজিসিয়ানের ভঙ্গিতে বলে উঠেছেন,

টেবিলের উপর রূপকথার বইটা আবার কে আনল?

ঝিমুনি ধরলেও ঘুম আসে না আমার। বিছানায় এপােশ ওপাশ করি। ধূপের গন্ধে দম আটকে আসে একেকবার। কী যে কাণ্ড সাধুজীর। সফিক চিঠিতে লিখেছিল, দুনিয়াতে মন্দ মানুষ এত বেশি বলেই ভাল মানুষদের জন্য আঁমাদের এত মন কাঁদে। আমাদের নিশানাথ এমন একজন ভাল মানুষ। মানুষকে দেওয়াই যার জীবিকা— সে এমন ভাল মানুষ হয় কি করে কে জানে?

রাত নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সফিকের দেখা পাওয়া গেল না। নিশানাথ বাবু আমাকে বসিয়ে রেখে নিচে খেতে গেলেন। খাওয়ার পর আমাকে হোটেল থেকে খাইয়ে আনবেন।

হোটেলটি বেশ খানিকটা দূরে। নানান প্রসঙ্গে গল্প করতে করতে সাধুজী হাঁটছেন। অনেকেই দেখি তাঁকে চেনে। একটি পানওয়ালা দাঁত বের করে বললো, সাধুজীর শইলটা বালা নাকি?

তিনি থেমে বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তা বললেন পানওয়ালার সঙ্গে। তার গল্প বলার ঢং চমৎকার। মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। সফিক প্রসঙ্গে বলেন, সফিক ছেলেটা ভাল তবে বড় ফাজিল। ফাজলামী করে আমার সঙ্গে। আমি নাকি লোক ঠকিয়ে খাই। ছিঃ ছিঃ কি কুৎসিত চিন্তা। আমরা হচ্ছি তিন পুরুষের জ্যোতিষী। আমার ঠাকুরদা। তারানাথ চক্রবর্তী ছিলেন সাক্ষাৎ বিভূতি। মানুষের হাত দেখে জন্মবার বলতে পারতেন। আজকালকার ছেলে।পুলেরা এসবের কী জানবে?

কথা বলতে বলতে সাধুজীর মুখের ভাব বদলায়। রশীদ মিয়ার কথা বলতে বলতে তিনি চোেখ-মুখ কুঁচকে এমন ভাবে তাকান যেন রশীদ মিয়া ছুরি হাতে মারতে আসছে। রশীদ মিয়া, বুঝলে নাকি রঞ্জু? নরকের কীট। দেখা হলেই বলবে–বিজনেস কেমন চলছে আপনার?

আমি চুপ করে থাকি। সাধুজী রাগী গলায় বললেন, হাত দেখা বিজনেস হলে আজ আমার গাড়ি বাড়ি থাকত। সুসং দুর্গাপুরের জমিদার ভূপতি সিংহ আমার ঠাকুরদাকে আশি বিঘা লাখেরাজ সম্পত্তি দিতে চাইলেন। ঠাকুরদা বললেন, ক্ষমা করবেন, দরিদ্র ব্ৰাহ্মণ। সম্পত্তির মোহে পড়তে চাই না। রশীদ মিয়া কী বুঝবে আমাদের ধারা?

সফিক ফিরতেই তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল জ্যোতির্ষিণবের সঙ্গে। সফিক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, আমার ঘরের চাবি দিয়ে গেলাম আপনার কাছে। বললাম, রঞ্জু আসামাত্র আমার ঘর খুলে দেবেন তা না নিজের অন্ধ কূপের ধোয়ার মধ্যে নিয়ে…

তাতে তোমার বন্ধুর কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয়েছে?

না হোক মেসে রঞ্জুর জন্যে রান্না করতে বলে গেছি। টাকা খরচ করে তাকে হোটেল থেকে খাইয়ে এনেছেন। টাকা সস্তা হয়েছে?

টাকার মূল্য আমার কাছে কোনো কালেই নেই সফিক।

বড় বড় কথা বলবেন না। লম্বা লম্বা বাত শুনতে ভাল লাগে না। সামান্য ব্যাপার নিয়ে সফিক এত হৈচৈ করছে কেন বুঝতে পারলাম না। আমার লজ্জার সীমা রইল না।

সফিকের ঘরে দুটি চৌকি পাতা। আবর্জনার স্তুপ চারদিকে। দীর্ঘ দিন সম্ভবত ঝাঁট দেয়া হয় না। একপাশে একটি থালায় অভুক্ত ভাত পড়ে আছে। সফিক আমাকে বলল, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়। সকালে কথা বলব।

তুই কোথায় যাস?

খেয়ে আসি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। খেয়ে এসেই বিছানায় কান্ত হব। কথাবার্তা যা হবার সকালে হবে। তুই ঘুমো।

সফিক নিচে নেমেও খুব হৈচৈ করতে লাগল, হারামজাদা ডাল শেষ হয়ে গেছে মানে? পয়সা দেই না। আমি? আমি মাগনা খাই? যেখান থেকে পারিস ডাল নিয়ে আয়।

সাধু বাবা ডাল খেয়ে ফেলেছে।

সাধু বাবার বাপের ডাল।

সফিক বড় বদলে গেছে। এ রকম ছিল না। কখনো শরীরও খুব খারাপ হয়েছে। কোনো অসুখবিসুখ বাঁধিয়েছে কিনা কে জানে। আমি তো প্রথম দেখে চিনতেই পারিনি। চমৎকার চেহারা ছিল সফিকের। স্কুলে ‘মুকুট’ নাটক করেছিলাম আমরা। সফিক হয়েছিল মধ্যম রাজকুমার। সত্যিকার রাজপুত্রের মত লাগিছিল। কমিশনার সাহেবের বৌ সফিককে ডেকে পাঠিয়ে কত কি বলেছিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 1 of 8 ): 1 23 ... 8পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress