অন্ধকারের গান (১৯৯৭) – Ondhokarer Gaan – 6
এটা কে?
বুলু না?
মাথা নিচু করে চা খাচ্ছে। গায়ে চেক হাওয়াই শার্ট। হাতে একটা সিগারেটও আছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। পেছনটা দেখা যাচ্ছে। মিজান সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। কল্যাণপুর বাস ডিপোর সঙ্গের রেস্টুরেন্ট। বখা ছেলেদের আড্ডা। এদের মধ্যে এক জন আছে—অতি বদ। স্কুল ড্রেস পরা কোনো মেয়ে দেখলেই কিছু না কিছু বলবে। কদর্য কিছু কথা যার সঙ্গে রসিকতা মেশানো। কথা শেষ হওয়া মাত্র রেস্টুরেন্টের সবাই একসঙ্গে হেসে উঠবে।
বুলু এই দলের মধ্যে বসে আছে? ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। বুল তেমন ছেলে না। তবে কোনো বাবা-মা নিজের ছেলেমেয়েদের খুব বেশি চেনেন না। মিজান সাহেবও হয়ত চেনেন না। একটা বিশেষ বয়স পর্যন্ত তাদের চেনা যায়, তারপর আর যায় না।
মিজান সাহেব অপেক্ষা করতে লাগলেন। বুলুর হাতের সিগারেটটা শেষ হোক। বুলু সিগারেট ধরেছে এটা অবশ্যি খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু মিজান সাহেব কেন জানি তেমন দুঃখিত বোধ করলেন না। এর কারণ কি কে জানে। হয়ত তাঁর মনে ভয় ছিল বুলুকে পাওয়া যাবে না। অবশ্যি এমন কিছু সচেতন ভাবে তিনি ভাবেন নি, তবে অবচেতন মন বলে একটা ব্যাপার আছে। যেই মন গোপনে অনেক কিছুই ভাবে।
বুলুকে তিনি কি বলবেন? আদরের ভঙ্গিতে বলবেন, চল বাসায় চল। নাকি ঠাণ্ডা গলায় বলবেন, বাসায় যা। তিনি নিজেও কি বুলুর সঙ্গে বাড়ি ফিরবেন, না বুলুকে ফেরার কথা বলে সহজ ভঙ্গিতে অফিসের দিকে রওনা হবেন। যেন এক মাস পর ছেলের দেখা পাওয়া তেমন কোনো ঘটনা না। কিংবা তেমন কোনো ঘটনা হলেও একে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।
বুলু সিগারেট ফেলে উঠে দাঁড়াতেই মিজান সাহেব চমকে উঠলেন—এ বুলু নয়। চোয়াডে ধরনের একটা ছেলে। চেহারায় বুলর সঙ্গে কোনো মিল নেই অথচ তিনি এতক্ষণ ধরে তাকে বুলু ভাবছেন—এর কারণ কি? গায়ের শার্টটাই কি কারণ? বুলুরও এই রকম একটা শার্ট আছে। খয়েরি রঙের শার্ট।
মিজান সাহেব বাসে উঠে পড়লেন। তাঁর মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। খয়েরি রঙের চেক শার্ট পরা ছেলে এই শহরে নিশ্চয়ই অনেক আছে। তাদের সবাইকে কি তিনি এখন থেকে বুলু বলে ভুল করবেন? তিনি জানালার পাশে একটা সিট পেয়েছেন। বাসে জানালার পাশে বসলে আপনাতেই মনটা ভালো হয়। আজ হচ্ছে না।
অফিসে ঢুকবার মুখে বেয়ারা অজিত বলল, স্যার আফনের ছেলে ফিরছে?
মিজান সাহেব জবাব দিলেন না। এই এক যন্ত্রণা হয়েছে। অফিসে আসামাত্র সবাই একবার জিজ্ঞেস করবেছেলে ফিরেছে কিনা। বুলু ফিরেছে কি ফেরে নি এই নিয়ে কারো কোন আগ্রহ নেই। অথচ সবাই জিজ্ঞেস করে। এটা যেন একটা রুটিন কাজ। আপনি ভালো আছেন? এর মত একটা বাক্য। প্রশ্নকর্তা অভ্যাসের মতো জিজ্ঞেস করেন। ভালো থাকলেও প্ৰশ্নকর্তার কিছু যায় আসে না, ভালো না থাকলেও না।
নিজের ঘরে ঢোকার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পাশের কামরার করিম সাহেব চায়ের কাপ হাতে চলে এলেন চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, কোনো খবর পাওয়া গেল?
বেয়ারা শ্রেণীর কারোর প্রশ্নের জবাব না দিলে চলে কিন্তু সহকর্মীদের প্রশ্নের জবাব। দিতে হয়। মিজান সাহেব বললেন, না।
বলেন কি? এক মাসের মতো হয়ে গেল না?
জ্বি।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এদের কাছে খোঁজ করেছেন?
না।
করা দরকার, তারপর থানায় একটা জিডি করিয়ে রাখুন। সময় খারাপ, কিছুই বলা যায় না।
মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন। ছেলের প্রসঙ্গে কথা বলতে তাঁর ভালো লাগছে না কিন্তু উপায় নেই। অপ্রিয় বিষয় নিয়েই মানুষকে বেশি কথা বলতে হয়।
মিজান সাহেব।
জ্বি।
চিন্তা করবেন না। চিন্তার কিছু নেই। এই বয়েসে ছেলেদের ঘর পালানো রোগ হয়। আমার নিজের ভাগ্নে এই কাজ করল। ফুফাত বোনের ছেলে। রাগ করে বাড়ি থেকে উধাও। দুমাস ওর কোনো খোঁজ ছিল না পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, রেডিওতে বিজ্ঞাপন বিরাট হুলুস্থুল। আর কত রকম গুজব। একবার তো খবর পাওয়া গেল লঞ্চড়ুবিতে মারা গেছে। বুঝেন অবস্থা, আমার বোন ঘন-ঘন ফিট হচ্ছে…..
মিজান সাহেব ফাইলে মন দিতে চেষ্টা করলেন। মন বসছে না। ভালো লাগছে না। কিছুই ভালো লাগছে না। মাথায় একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে।
মিজান সাহেব।
জ্বি।
থানায় একটা জিডি করিয়ে রাখা দরকার। তাছাড়া এটা একটা নাগরিক কর্তব্য। আমার দূর সম্পর্কের এক ভাগে আছে মোহাম্মদপুর থানার ওসি। বলেন তো আমি নিয়ে যাব।
মিজান সাহেব কিছু বললেন না। করিম সাহেব বললেন, আজ বিকেলে অফিস ছুটির পর যাওয়া যেতে পারে, যাবেন?
না।
কথাবার্তা হয়ত আরো কিছুক্ষণ চলত। গনি সাহেব ডেকে পাঠালেন।
গনি সাহেবকে আজ অন্যদিনের চেয়েও গম্ভীর মনে হচ্ছে। গম্ভীর এবং চিন্তিত। তিনি সিগারেট খান না কিন্তু আজ হাতে সিগারেট। অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে টান দিয়ে খুক খুক করে কাশছেন। মিজান সাহেব বললেন, স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। ভালো আছেন?
জ্বি ভালো।
বসুন, মিজান সাহেব বসুন।
মিজান সাহেব বসলেন। গনি সাহেব বললেন, কিছু ভেবেছন?
মিজান সাহেব তাকিয়ে রইলেন। গনি সাহেব বললেন, আপনাকে বললাম না, জনহিতকর কিছু করতে চাই। টাকা কোনো সমস্যা হবে না। ঐটা মাথায় রেখে ভাববেন। বুঝতে পারছেন?
পারছি।
চা খান।
গনি সাহেব বেল টিপে চায়ের কথা বললেন। তাঁর সিগারেট নিভে গিয়েছিল, সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, সিগারেট আমি খাই না। কে যেন একটা প্যাকেট ফেলে গিয়েছিল। একটা ধরালাম। এখন মাথা ঘুরছে। আচ্ছা ভালো কথা— গণ্ডগোলটা ধরেছেন? মানে আপনার ঐ হিসাবে?
মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন। গনি সাহেব বললেন, আমাদের হিসাব পত্রের ব্যাপারগুলি আরো আধুনিক করা দরকার। আমি ভাবছি হিসাব নিকাশের সুবিধার জন্যে একটা কম্পুটার রাখলে কেমন হয়? আপনি কি বলেন?
আমি তো স্যার ঐসব ঠিক জানি না।
আমি নিজেও জানি না। দিনকাল বদলাচ্ছে। আমাদেরও তো সেইভাবে বদলাতে হবে। কি বলেন, ঠিক বলছি না?
ঠিকই বলছেন।
আমি দুতিন জন কম্পুটারওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা কি বলে জানেন? ওরা বলে হিসাবটা কম্পুটারে থাকলে আজ যে সমস্যা আপনার হয়েছে সেই সমস্যা হত না।
জ্বি স্যার।
আমাদের অফিসের রহমান সাহেবের ছেলের কিডনির কী অসুখ যেন ছিল, কি হয়েছে জানেন?
এখন ভালো আছে।
আলহামদুলিল্লাহ। কিডনি ট্রান্সপ্লেন্ট হয়েছিল তাই না?
জ্বি। তাঁর স্ত্রী কিডনি দিলেন।
ভালো। ভালো। খুবই ভালো। ভাবছিলাম একবার দেখতে যাব। খোঁজ নেবেন তো বাসাটা কোথায়?
শান্তিনগরে বাসা।
ঠিক আছে। একবার যাব। অপারেশনটা হল কোথায়?
মাদ্রাজে।
বিরাট খরচান্ত ব্যাপার তো।
লাখ তিনেক টাকা খরচ হয়েছে স্যার।
তা তো হবেই। বিদেশে চিকিৎসা। লাখ তিনেক হলে তো কমই হয়েছে। নিন চা খান। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।
মিজান সাহেব চা শেষ করলেন। চা খাবার ফাঁকে ফাঁকে গনি সাহেব দেশ, দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বললেন। মিজান সাহেব উঠে যাবার আগের মুহুর্তে বললেন, আমি আপনার কাগজপত্রগুলি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ভালো করে দেখতে পারি নি। তবু মনে হল দুলাখ পঁচাশি হাজার টাকার একটা সমস্যা আছে। তাই না?
জ্বি স্যার। চিন্তা করে বের করুন তো কী ব্যাপার। টাকাটা বড় না—যেটা বড় সেটা হচ্ছে–।
গনি সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর টেলিফোন এসেছে। তিনি টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এক ফাঁকে মিজান সাহেবকে বললেন, আচ্ছা এখন যান মিজান সাহেব।
মিজান সাহেব সাধারণত নিজের চেয়ারে বসেই লাঞ্চ খান। আজ লাঞ্চের জন্যে ক্যান্টিনে চলে গেলেন। এই অফিসে ক্যান্টিন চালানোর মতো কর্মচারী নেই। ছোট একটা কামরা আলাদা করা আছে। সেখানে চা এবং বিস্কিটের ব্যবস্থা আছে। মিজান সাহেব ক্যান্টিনের এক কোণায় টিফিন বক্স নিয়ে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। গনি সাহেব। খুবই বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছেন এটা যে কোনো বোকা লোকও বুঝতে পারবে। মিজান সাহেব ভেবে পেলেন না এই ব্যাপারটা তার বুঝতে এত দেরি হল কেন?
রহমান সাহেব ক্যাশ সেকশনে আছেন আজ ছবছর। নিতান্তই নির্বিরোধী মানুষ। কারো সঙ্গেই কোনো কথাবার্তা বলেন না। নীরবে কাজ করেন। মাঝেমাঝে দুহাতে মাথার রগ টিপে ধরে ঝিম মেরে বসে থাকেন। এই সময় তাঁর মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়। তীব্র ও অসহ্য ব্যথা। তাঁর ফর্সা মুখ লাল টকটকে হয়ে যায়। ভুরুর চারপাশে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে। কেউ যদি বলে—কি ব্যাপার রহমান সাহেব। তিনি বলেন–কিছু না। তাঁর ব্যথা কতক্ষণ থাকে কেউ জানে না, কিন্তু তাঁকে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কাজ শুরু করতে দেখা যায়। এই সময় তিনি খুব ঘন-ঘন পানি খান কিছুতেই যেন তার তৃষ্ণা মেটে না। তাঁকে বড় অসহায় লাগে।
গনি সাহেব তার সেক্রেটারি মজনু মিয়াকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মজনু মিয়া বিনা কারণে প্ৰচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছে। গনি সাহেব যখনই তাকে ডেকে পাঠান তখনই তার মনে হয় এইবার বোধ হয় তিনি বলবেন, কাজকর্ম তো তোমার কিছুই নেই, কাজেই তোমাকে শুধু শুধু বেতন দিয়ে পোষার মানে নেই। তুমি বিদেয় হও। অথচ মজনু মিয়া কাজ করতে চায়। বিনা কাজে দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত আফসে বসে থাকার যন্ত্রণা আর কেউ না জানুক সে জানে।
মজনু মিয়া।
জ্বি স্যার।
ভালে আছ?
জ্বি স্যার ভালো।
গতকাল কেউ এক জন আমার এখানে এক প্যাকেট সিগারেট ফেলে গেছে। খুঁজে বের করতো। প্যাকেটটা ফেরত দিতে হবে।
মজনু মিয়া হতভম্ব হয়ে গেল। কে সিগারেট ফেলে গেছে, সে কী ভাবে খুঁজে বের করবে? এটা কি সম্ভব নাকি? তা ছাড়া এক প্যাকেট সিগারেট এমন কী জরুরি জিনিস?
কি পারবে না?
মজনু মিয়া মাথা চুলকাতে লাগল। গনি সাহেব বললেন, বের করা খুব সোজা বলেই তো আমার ধারণা। এই অফিসের কেউ আমার সামনে বসে সিগারেট খায় না—তাই না? বাইরের কেউ হবে। গতকাল আমার কাছে কে-কে এসেছে তোমার জানা আছে না? ওদের মধ্যেই কেউ হবে। খুঁজে বের কর, তারপর গাড়ি নিয়ে প্যাকেটটা দিয়ে আসবে এবং বলবে এখানে একটা সিগারেট কম আছে। আমি খেয়ে ফেলেছি। এই জন্যে আমি খুব শরমিন্দা। বলতে পারবে না?
পারব স্যার।
গাড়ি নিয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
গনি সাহেব পানের কৌটা বের করে একটা পান মুখে দিলেন। বাসায় টেলিফোন করলেন। টেলিফোন ধরল ঘোট জামাই। তিনি টেলিফোন কানের কাছে ধরে। রাখলেন—এ পাশ থেকে বার-বার শোনা যাচ্ছে, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো।
তিনি টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। নামাজের সময় হয়ে গেছে। নামাজ পড়বেন। তিনি ওজুর পানি দিতে বললেন। বাথরুমেই পানির ব্যবস্থা আছে কিন্তু তিনি সে পানি ব্যবহার করেন না। ওজুর জন্যে তিনি পুকুরের পানি ব্যবহার করেন। ড্রামে করে সেই পানি জমা রাখা হয়।