অন্ধকারের গান (১৯৯৭) – Ondhokarer Gaan – 11
বারটার সময় বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবার কথা। বুলু যেতে পারে নি। সকাল থেকেই তার গা আগুনে গরম। পায়ে অসহ্য ব্যথা। পায়ের নিচটা কেমন নীল হয়ে গেছে।
বীণা চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকে একটা ধাক্কা খেল। গোঙানীর শব্দ হচ্ছে। বুলুর মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। চোখ ঘোর রক্তবর্ণ। বীণা বলল, কি ব্যাপার দাদা? বুলু বলল,
একটা কুড়াল নিয়ে আয়। কুড়াল দিয়ে কোপ দিয়ে পা-টা কেটে ফেলে দে।
বীণা ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
বাবা অফিসে চলে যাবার পর বুলু শব্দ করে কাঁদতে লাগল। পাড়ার ডাক্তার এসে বলল, এখন হাসপাতালে ভর্তি করেন নি? কী আশ্চর্য! আপনারা এত ক্যালাস কেন? এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যান।
বুলু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, নিয়ে গেলেই হাসপাতালে ভর্তি করবে?
চেষ্টা চরিত্র করবেন। আপনাদের চেনা জানা কেউ নেই? দেরি করা উচিত হবে। না। আমার মনে হয় গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে।
বীণা একবার ভাবল বাবাকে অফিসে খবর দেবে। শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলাল না। নিজেই বুলুকে নিয়ে রওনা হল। ফরিদা ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন। বীণার দাদী চেঁচাতে লাগলেন—কে কান্দে রে? বড় বউ না? বড় বউ ক্যালে ক্যান? ও বড় বউ?
লীনা অসম্ভব ভয় পেয়েছে। বাবলুও ভয় পেয়েছে, তবে সে খানিকটা আনন্দিত। কারণ আজ স্কুলে যেতে হবে না। স্কুল তার একেবারেই ভালো লাগে না।
বীণা হাসপাতালে কিছুই করতে পারল না। এখানকার মানুষজন মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে দেখে পাথরের মতো হয়ে গেছে। একটা বয়স্ক ছেলে যে শিশুর মতো চেঁচাচ্ছে তার জন্যে কারো মনে মমতার ছায়া পড়ছে না। শুধু এক জন অল্প বয়স্ক ডাক্তার বীণাকে নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি করল। একসময় বলল, আপনি কাঁদবেন না। একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।
সেই ছেলেও কিছু করতে পারল না। এক সময় লজ্জিত গলায় বলল, আপনার পরিচিত বড় কেউ নেই?
বীণা চোখ মুছতে মুছতে বলল, না। বলেই তার অলিকের কথা মনে পড়ল। ধরা গলায় বলল, আমি কি একটা টেলিফোন করতে পারব?
অবশ্যই পারবেন। আপনি কাঁদবেন না প্লিজ, কাঁদবেন না।
অলিককে পাওয়া গেল। অলিক বলল, ফাচফাচ করে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে ঠাণ্ডা গলায় বল।
বোরহান সাহেব মিটিং-এ ছিলেন।
ছোটখাটো মিটিং না, বড় মিটিং। স্বয়ং মন্ত্রী মিটিং চালাচ্ছেন। এর মধ্যেই বোরহান সাহেবকে বলা হল-বাসা থেকে তাঁর মেয়ে টেলিফোন করেছে। অসম্ভব জরুরি। এক সেকেন্ডও দেরি করা যাবে না। বোরহান সাহেব শুকনো মুখে উঠে দাঁড়ালেন, মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার আমাকে তিন মিনিটের জন্যে একটু ছাড়তে হবে। বাসায় বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়েছে। আমি তিন মিনিটের মধ্যে আসছি। আমি খুবই লজ্জিত।
মন্ত্ৰী অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন। বললেন, আপনাকে ১৫ মিনিট সময় দেয়া হল। এর মধ্যে আমরা একটা টি-ব্রেক নেব। আপনি চা মিস করলেন।
বোরহান সাহেব টেলিফোন ধরা মাত্র অলিক বলল, কেমন আছ বাবা?
বোরহান সাহেব বললেন, এইটাই কি তোমার জরুরি খবর?
হ্যাঁ। তুমি কি ভালে আছ বাবা?
রাগ করতে গিয়েও তিনি রাগ করলেন না। নরম গলায় বললেন, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
ভালো না। আমার মনটা খুব খারাপ। খুবই খারাপ।
কেন মা?
আমার বন্ধুর ভাই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। হাসপাতালের বারান্দায় বসে কাঁদছে।
দেশের অবস্থাই তো এরকম মা। হাসপাতালে সিট নেই, ঘরে খাবার নেই, অফিসে চাকরি নেই।
বাবা।
বল মা।
তুমি এক ঘন্টার মধ্যে এই ছেলেটার হাসপাতালে ভর্তি করার একটা ব্যবস্থা করবে।
সে কী?
হ্যাঁ করবে।
কি করে করব বল তো? তুই কী ভাবিস আমাকে?
এক মিনিট কিন্তু চলে গেছে বাবা। আর মাত্ৰ ৫৯ মিনিট আছে।
তুই বড় পাগলামি করিস মা।
বেশি দিন তো করব না বাবা। আর খুব অল্পদিন করব। তারপর আর করব না। ইচ্ছা থাকলেও করতে পারব না।
বোরহান সাহেব বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি।
বাহান্ন মিনিটের মাথায় বুলু ভর্তি হয়ে গেল। দেড় ঘণ্টার মধ্যে দুজন বড় বড় ডাক্তার বুলুকে দেখতে এলেন।
বুলুর পাশের বেডে সবুজ শার্ট গায়ে দাড়িওয়ালা এক জন মানুষ। সে আগ্রহ নিয়ে বলল, ভাইজান আফনের পরিচয়?