অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
“রাত্রির রূপ পরিবর্তন। তাই আবার হয় নাকি। সেতো সেই কালো, ভয়ঙ্কর, বীভৎস্য। তার আবার কিসের পরিবর্তন ঘটবে শুনি”—- কিছুতেই মানতে চায় না অহনা।
নিশীথেরও জেদ কিছু কম নয়। সেও ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে অহনাকে এটা বিশ্বাস করিয়েই ছাড়বে।
শুধু তাই নয় নিশীথ রীতিমত ভেবে রেখেছে রাত্রির পূর্বের রূপ এবং পরিবর্তিত রূপ অহনাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েই ছাড়বে।
অহনা, সে আসলে নিজের রূপের অহঙ্কারে অহঙ্কারী। সে মনে করে সে স্রষ্টার আশীর্বাদ আর রাত্রি হলো অভিশাপ। তাই তো যা কিছু শুভ তা অহনার আর সমস্ত অশুভ রাত্রির।
নিশীথ আর অহনার এই বিতর্ক সর্বজনবিদিত।
অহনার পক্ষে যারা —- তারা তাদের স্বপক্ষে সাফাই দেন “একমাত্র অহনা আছে বলেই প্রকৃতি এত সুন্দর।”
প্রকৃতির সৌন্দর্যের একটা অংশ অহনা হতে পারে, তা বলে সুন্দর প্রকৃতির সবটাই ওর —এটা মানা যায় বলুন তো?—-
অহনা যদি কৃতিত্ব নেয় তবে প্রভাতই বা নেবে না কেন?
কিন্তু প্রভাত কখনই এভাবে জাহির করে না নিজেকে। তপন, সে তো মুচকি হাসি হাসে এসব কথা শুনে। আসলে সে তো উচ্চমার্গের। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সে এসমস্ত ছেঁদো কথায় কান দেয় না। সে বিশ্বাস করে কর্মে। তাই অহনা, নিশীথের বিবাদের মধ্যে নিজেকে জড়াতে নারাজ তপন।
অহনা নিশীথের এই বিবাদের উৎস তপনের জানা।
বসুন্ধরার গতিবিধির জুড়িবুটিতেই যে এই দ্বন্দ্বের সুত্রপাত সে কথা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেন না এই দুজনকে।
অহনা ভাবে তপন শুধুই তার। তপনের ওপর তার অধিকার সবচেয়ে বেশি।
নিশীথের সাথে তপনের অদৃশ্য বন্ধুত্বকে আমল দেয় না অহনা।
নিশীথের একনিষ্ঠ বন্ধু চন্দ্র। নিশীথের সাথে অহনার বিবাদ থাকলেও রূপবান চন্দ্রকে ভারী পছন্দ অহনার। চন্দ্রের সাময়িকভাবে আগমন এবং প্রস্থান অহনার না-পসন্দ। কতবার নিশীথকে বলেছে চন্দ্রকে পাকাপাকি ভাবে আটকে রাখতে।
নিশীথ অহনার এই শিশুসুলভ আব্দারকে সুন্দর করে বোঝাবার চেষ্টা করেছে— যে চন্দ্র সর্বক্ষণ তারসাথেই থাকে।
চন্দ্রকে দেখতে গেলে শুধুমাত্র চোখ চাই।
অহনা তো তখন অন্ধ। চোখ বন্ধ করে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই কি করে সন্ধ্যা, রাত্রিদের অপদস্থ করবে।
সন্ধ্যাকে সামান্য ক্ষমা ঘেন্না করলেও রাত্রি যেন তার চিরশত্রু। তার মতে রাত্রি কালো। তাই তো সকলে রাত্রিকে ভয় পায়। যত চোর, ডাকাত, গুণ্ডা —এককথায় সমস্ত দুষ্কৃতকারীরাই রাত্রির অনুগত।
রাত্রি নিজের নিকষ কালো রূপে ওদের ঠাঁই দিয়ে নিজের বীভৎসতা বাড়িয়ে তুলেছে। ভূত, প্রেত, ডাকিনী, যোগিনীরা তাই তো বেছে নিয়েছে রাত্রির ঘন অন্ধকারকে।
এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নিশীথের জবাব যদি রাত্রির এই নিকষ কালো রূপ না থাকতো তবে কি তারারা তাদের মিষ্টি অস্তিত্ব নিয়ে থাকতে পারত। রাত্রির জন্যই তো মোম, প্রদীপরা একসময়ে দাপটের সঙ্গে কাজ করে গেছে।
রাত্রির প্রতি ভীতি দূর করবার জন্যই তো “জাগতে রহো “ধ্বনির উৎপত্তি –এ যুক্তি টেনে আনে অহনা।
নিশীথের পাল্টা যুক্তি যদি রাত্রি এত ভয়ঙ্কর হবে তবে ঝুমঝুম ঘন্টা বাজিয়ে পিঠে বোঝা নিয়েরা কিভাবে ছুটে চলতো।
আপ্রাণ চেষ্টা করে নিশীথ বলে রাত্রি এখন আর পুরোনো নিকষ কালো নেই। কালোর সাথে আলোর মেলবন্ধন ঘটেছে। তাই তো এই পরিবর্তণ সম্ভব হয়েছে।
রাত্রির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে আলো তার রূপে রাত্রিকে মোহিনীময়ী করে তুলেছে। উৎসব তো এখন রাত্রিকেই চায়। জাঁকজমক পূর্ণ আয়োজন নাকি রাত্রিতেই জমে ভাল। আলোর সহযোগিতায় রাত্রি এখন দিনের সাথে টক্কর দিতে শিখেছে।
মহানগরী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই নিজের মাপকাঠি মতো লক্ষ্য করা যায় এই পরিবর্তণ।
মহানগরীতে এখন রাত্রি মানে সারাদিনের কর্মব্যস্ত মানুষের একটু অক্সিজেন নেবার সময়। আধুনিক মানুষ স্বল্প দৈর্ঘ্যের মনুষ্যজীবনের অর্ধেকটা সময় ঘুমিয়ে কাটাতে চায় না শুধুমাত্র অন্ধকারের দোহাই দিয়ে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে।
তাই তো আজ মানুষ চব্বিশ ঘন্টা কাজে ব্যস্ত। নিশীথ অহনাকে তার জোরালো যুক্তিতে অহনাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে রাত্রিও তারই মত প্রকৃতির একরূপ।
রাত্রির অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অহনার জন্মরহস্য। বলা যায় “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো “ই হলো অহনা।।