Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অনুশোচনা || Mallik Kumar Saha

অনুশোচনা || Mallik Kumar Saha

অনুশোচনা

রাত্রি এগারোটা। আশি বৎসরের প্রৌঢ় কমলনাথ প্রতি রাতের মত সেই রাত্রেও হাপাতে লাগলেন।এমন সময় ভিতর কক্ষ থেকে বৌমা প্রভাতীর আওয়াজ এলো — “বাবা,টেবিলে কাশীর বড়ি রয়েছে এবং কাঁচের গ্লাসটায় জল রয়েছে।আপনি সেটা সেবন করে নেবেন। ও হ্যাঁ, ঘুমোবার আগে ঘুমের বড়িখানা অবশ্যই খেয়ে নেবেন। ডাক্তার মশাই বলেছেন আপনার এখন ঘুমের বিশেষ প্রয়োজন । তাছাড়া বেশ কদিন থেকেই দেখছি আপনার শরীরটা একেবারেই খারাপ যাচ্ছে।”

বৌমার কথা মত তিনি কাজ সেরে নেবেন এই ভেবে টেবিলের দিকে হস্ত প্রসারণ করা মাত্রই বিদ্যুৎ চলে গেল। সেই সঙ্গে কক্ষটি ঘনকালো অন্ধকারে ভরে উঠল তাই তিনি লন্ঠনখানা জ্বালিয়ে অন্ধকার কক্ষটিকে আলোকিত করলেন ।কাশীর বড়িখানা সেবন করা হয়ে গেলে ঘুমের বড়িখানা হতে তুলে নিলেন।মনে মনে কি যেন ভেবে বড়িখানা আগের জায়গায় রেখে দিলেন । তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন । তিনি বলে উঠলেন — না, কক্ষে ভীষণ গরম। তদুপরি বিদ্যুৎও নেই যে পাখা চালিয়ে শরীরটাকে একটু ঠান্ডা করি। অথচ হাতপাখা চালাতে মোটেই ইচ্ছে করছে না।

এই অসহ্য অস্থিরতাকে দূর করার জন্য তিনি জানালা খুলে ফেলেন। সেটি ছিল আশ্বিনের পূর্ণিমার রাত্রি। জানালার সঙ্গে লাগানো ফুলের বাগান। বিভিন্ন ফুলের সৌরভ চারিদিক আমোদিত করে রেখেছে। এতক্ষণ জানালাটা বন্ধ থাকায় দক্ষিণের মৃদু বাতাস তাহার কক্ষে প্রবেশ করতে পারেনি। শেফালি ফুলের মধুর সুগন্ধে কমলনাথ সজীব হয়ে উঠলেন। বাহিরে বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠখানায় জ্যোৎস্না পড়ে রূপার মত ঝকমক করছে এবং চাঁদের উজ্জ্বল আলোকে বিদ্যালয়টিকে মনে হচ্ছে এ যেন শ্বেত মার্ব্বেল পাথরের নির্মিত শাহজাহানের সেই তাজমহল। চাঁদের সেই উজ্জ্বল আলোক জানালা দিয়ে কক্ষে এসে কক্ষটিকে দ্বিগুণ আলোকে আলোকিত করে ফেললে।

কমলনাথ তাঁর পড়নের ধুতির খুট দিয়ে পুরোনো চশমাটা ভালো করে মুছে নাকে চড়িয়ে সেই পূর্ণিমা রাতের মধুর দৃশ্যখানা ভালো করে দেখবার জন্য দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সেখানে এক ইজি চেয়ারে বসে অতীত কল্পনায় ডুবে গেলেন। অতীত জীবনের ভাবনাগুলো মানস নয়নে ফুটে উঠেছে —
দেখতে দেখতে কিভাবে আশিটি বৎসর অতীত হয়ে গেল তা আমি ভেবেই পায়নি।চতুর্দিক নির্জন, আর এই নির্জন ও নীরবতার মধ্যে আমি রাত্রি দ্বিপ্রহর অবধি জেগে অতীত স্বপ্নে মত্ত। শৈশবেও আমার কোনকিছুর অভাব ছিল না, ছিল না অশান্তি,শুধু থাকার মধ্যে ছিল সাংসারিক জীবন যাত্রার পথ উন্নয়নের অটুট ও অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের বদ্ধপরিকর প্রচেষ্টা। শৈশবের সারল্য, কৈশোরের সেই উদ্যাম- উচ্ছল গতি, নির্ভীক চিত্ত, যৌবনের সেই অফুরন্ত লালিত্য এবং বৃদ্ধ বয়সের এক অফুরন্ত ও অসাধারণ অভিজ্ঞতা আজ আমাকে এই বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এনে দাঁড় করেছে। বাধাহীন, ঝঞ্ঝাটমুক্ত মহাকল্লোলসম এমন অতীত জীবন ক’জনেই বা ভোগ করে থাকে ? মোটের উপর সমস্ত জীবনটাকে একটা সুখী – জীবন বললেও ভুল হবে না । তবু কেন যে দিগন্তের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে এক অস্ফুট অথচ তীব্র, ক্ষণিক অথচ অসহ্য ব্যথায় আজ আমার সমস্ত অন্তঃকরণ বিদীর্ণ হতে চলেছে। ফেলে আসা অতীতের কোন অজ্ঞাত গুহায় না জানি কোন ভ্রম পূর্ণিমার এই উজ্জ্বল আলোককে অন্ধকারে লুটিয়ে ফেলতে মত্ত। কালবৈশাখী কেন আজ এই সুন্দর সুমধুর স্থির শরৎকে তার ধংসলীলার সমসাথী করতে উদ্যত ? বিছানায় শুইয়ে থাকা শিশুটিকে দেখে তো মনে হয় না তার কোন ভাবনা রয়েছে।সে জননীর বুকে তার সুকোমল আদরে নিদ্রামগ্ন। ভবিষ্যত কি— এর যে কি স্বাদ— এসব শিশুর চিন্তার অগম্য । কিন্তু আজ আমি শিশু নই। এক নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়। কিন্তু আমি তো আমার কর্তব্য কর্মের কোন ত্রুটি রাখিনি। আমি তো অতীতের সব রকম দায়দায়িত্ব থেকে একেবারে মুক্ত। তবুও কেন আমি অতীত চিন্তা থেকে বাধনমুক্ত পাখীটির ন্যায় দূর গগনে ছুটে চলতে পারি না ? কেন তবে সেই শিশুটির ন্যায় জননী ক্রোড়ে শান্তি নিদ্রা যাই না ? আমার মনে হচ্ছে, জননী আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে — ” আয় চলে আয় ! আমার বুকে আয় ! সূর্য অস্তমিত প্রায় ! সঙ্গীরা তো সব সন্ধ্যার পূর্বেই এই সবুজ বিস্তীর্ণ কোলাহলরত মাঠ ছেড়ে তাদের মায়ের কোলে নিদ্রা গেছে। আয় তুইও চলে আয়!”

— হ্যাঁ, আমাকেও যেতে হবে। আর দেরী নয়। জননীর রাতুল চরণে ভক্তিশ্রদ্ধা নিবেদনের শেষ ঘণ্টাধ্বনি ঐ ঐ ঐ বায়ু পথে আমার কর্ণে এসে প্রবেশ করছে। দুর্বার জলস্রোত মহাবেগে পর্বতগাত্র চূর্ণ করে যে ভাবে সম্মুখে অগ্রসর হয় তাতে তো মনে হয় এ জলস্রোত কখনও মহাকার জলমধ্যে আবদ্ধ হয়ে তোলপার জলোৎসাসে, ফেলে আসা অতীতকে মুছে ফেলতে সফল হবে। কিন্ত,অতীতের দিনগুলো যে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছে। ভুলে যাবার কোন পথ নেই। এ কেবল মিথ্যা প্রচেষ্টা মাত্র । তবে এ কেমন অনুশোচনা ?

ঢং ঢং ঢং — দেয়াল ঘড়িতে তিনটে বাজায় হঠাৎ চৈতন্য হল রাত্রি অনেক হয়েছে। এখন ঘুমোতে যেতে হবে। ভিতরে এসে জানালা – দরজা বন্ধ করে বিছানায় যাবার পূর্বে হটাৎ লণ্ঠনের আলোকে ঘুমের বড়িখানার দিকে দৃষ্টি পড়ল । না, এ বড়ি খেয়ে আর লাভ হবে না। দীর্ঘ তিন মাস এ বড়ি সেবনে এর কার্যকারিতা প্রায় নষ্ঠ হয়ে গিয়েছে।

তাই লণ্ঠনের আলো কমিয়ে দিয়ে চশমাখানা টেবিলের উপর খুলে রেখে নিদ্রাদেবীকে স্মরণ করে প্রৌঢ় কমলনাথ চোখ বুজে শুয়ে পড়লেন । কিন্তু,ঘুম কি আসবে? না অতীত দিনের ভাবনাগুলো আবার মানস নয়নে দেখা দিবে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *