পাখাটা ছেড়ে দিয়ে বিলকিস বলল
পাখাটা ছেড়ে দিয়ে বিলকিস বলল, বসুন। আমি এখুনি আসছি।
রোদ্দুরে রোদ্দুরে বেশ তো হেঁটে বেড়ানো চলছিল আবুর, বিলকিস তাকে গাড়ি থামিয়ে তুলে নিয়ে এসেছে বাসায়। সেদিন সে তাকাতে পারেনি বলে আজ কি মোলআনায় শোধ দেবার ইচ্ছে?
ভেতর থেকে একটু পরে পারিজাতের হাতে এলো নেবুর এক গেলাশ ঠাণ্ডা শরবৎ। পারিজাত তাকে দেখে হাসল এবং গেলাশ নামিয়ে রেখেই দৌড়ে পালাল।
বড় রোদ, একেবারে আসমান শুদ্ধ তেতে উঠেছে, শরবতের গেলাশ হাতে নিয়ে ভাবলো আবু। সেটা ঠোঁটে ঠেকিয়েছে কী ঠেকায় নি, বিলকিস পর্দা ঠেলে এসে বসলো। মাথায় তার আধ ঘোমটা কাপড় তুলে দেয়া।
অপরূপ লাগল।
রোদ্দুরটা এড়াতে গিয়ে ও ঘর থেকে আসবার সময় হয়ত মাথায় কাপড় তুলে দিয়েছিল, এখনো নামিয়ে নেয়া হয়নি।
বাসায় এসে বিলকিস তার পরনের শাড়িটা বদলে নিয়েছে। এখন যেটা পরে তার সমুখে বসে আছে ঠিক তেমনটি যেন কতকাল আগে মা পরতেন, ভাবল আবু। পাড়ের মধ্যে নীল সুতোয় আঁকা ময়ুর, বাড়ি, গাছ, তারপর আবার ময়ুর বাড়ি, গাছ—- পর পর আবার ময়ুর, বাড়ি, গাছ। তার পায়ের পাতা ঘিরে কোলের ওপর দিয়ে, বুক জড়িয়ে মাথার পরে গিয়ে পৌঁছেছে ময়ুর, বাড়ি, গাছ।
তন্ময় হয়ে দেখছিল আবু। মায়ের ট্রাঙ্ক খোলন্যাপথলিনের ঘুম পাড়ানো ঘ্রাণটা যেন ফিরে আসছে।
বিলকিস কোনরকম ভূমিকা না করে সোজা বলল, সেদিন কি আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল?
তার ছোট্ট চিঠিটার কথা বিলকিস আজো ভুলতে পারেনি। বিলকিস বলল, এমন করে চিঠি লিখে গেলেন, যে কেউ দেখলে একটা কিছু ভেবে বসত। কেন লিখতে গেলেন ও সব? আমি তো কারো সঙ্গে রেখে ঢেকে মিশিনি।
শেষ কথাটার সঙ্গতি খুঁজে পেল না আবু। একটুপর উত্তর করল, কী জানি কেন লিখলাম। দেখুন না, আপনার থাকবার কথা ছিল, থাকলেন না, আগে থেকে নোটিশও দিলেন না। অনেক দূর বয়ে এসেছিলেন, না পেয়ে রাগ হবারই কথা।
খুব বোদ্ধা মানুষের মতো ভান করে আবু; নিজেকেই নির্মমভাবে বিশ্লেষণ করতে থাকে সে। বলে চলে ক্ষমাহীন কণ্ঠে, মনটা বুঝতে চাইল না। কেন চাইল না? কী জানি। ছেলে মানুষের মতো রাগ করে বসল। নইলে সত্যি তো কী করে সম্ভব হল? অন্যায় হয়েছে। থাক, খুব হয়েছে।
বিলকিস তাকে বাঁ হাতের করতল তুলে বাধা দেয়। বিলকিস যেন আবছা আবছা বুঝতে পারে আবু তার মনের একটা গোলমাল ঢাকতে গিয়ে অযথা নিজের প্রতি রুঢ় হচ্ছে। বিলকিসের যেন মন হয় তার চোখের ভেতরে দুর্বোধ্য কী একটা লিপি পড়তে পারছে। উল্টা দিকে আবু ভেতরে আচমকা পরম একটা আলস্য অনুভব করতে থাকে। সব কিছু নিরর্থক মনে হয়। খামোকা বলে, আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করতে চেয়েছিলাম একদিন।
আমি তো ভালো গল্প বলতে জানি না।
বেশ তো, আমি না হয় বলবো, আপনি শুনবেন।
শোনার অভিনয় করতে পারবো হয়ত। তাতে খুশি হবেন?
নিষ্ঠুর শোনায় কথাটা। আবু একটা কথাও বলতে পারে না। যেন এক ফুঁ এ কেউ বাতি নিবিয়ে দিয়েছে। চোখের সমুখে মিছিল করে চলতে শুরু করেছে ময়ুর বাড়ি গাছ, আবার ময়ুর বাড়ি গাছ, আবুর চোখ এসে তার রক্তিম পা ঘিরে পাড়ের ওপর স্থির হয়।
বিলকিসও বুঝতে পারে এমন করে কথাটা বলা ঠিক হয় নি। কিন্তু না বলেও তো উপায় ছিল না। মিছেমিছি লোকটা ভুগবে। সহজ করে দেয়ার জন্য বিলকিস জিগ্যেস করল, সেদিন কে এসেছিলেন?
কোথায়?
আপনাদের বাসায়।
আমার বড় ভাই।
বাইরে ছিলেন বুঝি?
আবুর মাথায় ভেতরে হঠাৎ বাঘের মতো একটা উজ্জ্বল দীপ্তি লাফ দিয়ে পড়ে। ঝুঁকে পড়ে সে বলে, হাশেম ভাই বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলেন।
পালিয়ে?
বিবাগী হয়ে।
সে আবার কী?
আবু যেন খুব তুষ্ট হতে পারছিল না বিলকিসের মুখে পালিয়ে শব্দটা শুনে। নিজের ওপরেও রাগ হলো, কেন সে শব্দটা ব্যবহার করতে গিয়েছিল! হাশেমকে যেন সে ভীষণ ছোট করে ফেলেছে। অনুতাপ হতে লাগল তার। বলল, একজনকে ভালবাসতেন হাশেম ভাই।
কী হলো তার?
সে ভালবাসত না।
বিলকিসের কাছে কথাটা বলতে গিয়ে কেমন হাস্যকর শোনাচ্ছে আবুর নিজের কানেই। এ কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে সে বিব্রত বোধ করতে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে কখন বিলকিস সত্যি সত্যি হেসে ফেলবে, সে মনে মনে চটে যাবে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু আশ্চর্য, বিলকিস হাসল না। বরং তার গভীরতম দেশে গিয়ে বাসা করে নিল আবুর কথাকটি। ছায়া হয়ে এল তার সারাটা মুখ। বলল, জানেন, মানুষের ভেতরটাকে এত আমি চিনেছি যে, আপনার ভাইয়ের ব্যথাটা যেন বুঝতে পারলাম।
আবুর তখন তীব্র ইচ্ছে করে নিজের আত্মার ওপর থেকে একটানে সমস্ত আবরণ ফেলে দিতে। মাথার ভেতরে এক অশান্ত নাচ হতে থাকে। মানুষের ক্ষমতা এত বাধা কেন? তার মনের পৃথিবীকে কেন শুধু কথার ভেতর দিয়ে, কাজের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতে হবে? জানান না দিলে কেন কেউ বুঝতে পারবে না তার ভেতরে কী হচ্ছে? এ শক্তি কেন মানুষ পেল না যে, সরাসরি আত্মা থেকে আত্মায় ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত তরংগ?
একী? আপনি বড্ড ঘামছেন।
আবুর চমক ভাঙ্গে।
পাখাটা বাড়িয়ে দেব?
দিন।
পাখা হঠাৎ দুরন্ত গতি পেল। তার বাতাসে যেন ঝড় উঠল বিলকিসের শাড়িতে, চুলে। পাখার কেন্দ্র থেকে সরে আসতেই আবার শান্ত হয়ে গেল সব। বিলকিসকে হঠাৎ রক্তের মধ্যে আপন করে অনুভব করে আবু। মনে হয়, তার মাথার ভেতর থেকে একটা শক্তি ফেটে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাসিয়ে দেবে সব কিছু। মুখে বলে, আমাকে উঠতে হবে।
যাবেন?
আবুর সত্যি সত্যি যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বসে থাকাও অসম্ভব। জোর করে সে বলে, হা। দরকার আছে।
এলেন, বসলেন না। বলছিলেন গল্প করবেন।
আবু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুখ অন্য দিকে রেখে উচ্চারণ করে, কাল, না হয় পরশু আবার আসব।
তার কথা বলার ধরনটা অদ্ভুত লাগে বিলকিসের কাছে। হঠাৎ মনে পড়ে বকুলের ঠিকানার কথা। বলে, বকুলের ঠিকানাটা নিয়ে যান।
পেয়েছেন? কী করে?
জবাব না দিয়ে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে ঠিকানাটা লিখে দেয় বিলকিস। লিখতে লিখতে বলে, বকুলকে ভালোবাসত আপনার হাশেম ভাই, না?
শুনে অবাক হয় সে। বিলকিস কী করে টের পেল? বকুল তাকে বলেছে? অসম্ভব, সে বলতেই পারে না। কিছুতেই যেন আবু ভাবতে পারে না, বকুল উচ্চারণ করবে এই অতীত। বিস্মিত আবু ঠিকানাটা হাত বাড়িয়ে নেয়। বিলকিস দরোজার পর্দা ঠেলে ধরে বলে, আসবেন কিন্তু।
আবু কোনো উত্তর না দিয়ে পথে নেবে আসে। সমস্ত শক্তি যেন তার অন্তর্হিত হয়ে গেছে। তার চেতনা আচ্ছন্ন করে সঙ্গীতের মতো ফিরে ফিরে বাজতে থাকে আসবেন কিন্তু আসবেন কিন্তু।
বিলকিস যেটা তাকে বলতে গিয়ে বলতে পারে নি বকুল তার বড় বোন।
.
আগুন পথের দুধারে ফুলে ফুলে জ্বলছে একেকটা গাছের চূড়ায়। চোখ ধাধিয়ে দেয়। চোখ রাখা যায় না। প্রকৃতি যেন আজ ষড়যন্ত্র করে আবুর সঙ্গে চতুরালি করছে। কোনদিন যা চোখে পড়ল না, বিলকিসের বাসা থেকে বেরিয়েই দুচোখের দুয়ার ঠেলে তা ভেঙে পড়ছে। চলতে চলতে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে গাছের অজস্র শিখরের দিকে। কোথায় যেন মিলের আভাস।
তার মনটাও এখন এমনি অস্থির অথচ উদাস; এমনি মাতাল করা, লাফিয়ে পড়া, অথচ দূর। পথ দিয়ে চলছে, তবু মনে হচ্ছে এখনো বিলকিসের সমুখে বসে আছে। এখনো যেন স্পষ্ট তাকে দেখতে পাচ্ছে ঐ প্রখর উজ্জ্বল বর্ণের ভেতরে।
বিলকিসকে আজো কিছু বলা হলো না। মনের ভেতরে চাপা একটা আক্রোশ ফুসতে থাকে। কী হতো বললে? হয়ত যা হতো, তা স্বর্গের চেয়েও সুন্দর। হয়ত, বিলকিস অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। পরে আবছা গলায় উচ্চারণ করত, আমি জানতাম।
আবুর দুচোখ পুড়ে যেতে থাকে রক্তিম ফুলে।
অস্থির হয়ে বাম করতলে ডান হাত মুঠো করে সে আঘাত করতে থাকে। খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে। রোদে তেতে জ্বর জ্বর হতে ইচ্ছে করছে। তীক্ষ্ণ, দুর্বোধ্য, মানে হয় না উচ্চারণে মুখটা ব্যথা করে ফেলতে ইচ্ছে করছে, ঠিক যেমন ছোটবেলায় একেকদিন করত। অকারণে তখন হঠাৎ খেপে গিয়ে ধুলো পানি ঝড়ে একাকার হয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু সেই অনেক আগের দিনগুলোয় ছিল না বেদনার স্মৃতি। আর আজ কোথায় যেন বেদনার বীজ অংকুরিত হয়ে উঠবার জন্যে থরথর করে কাঁপছে।
এ আমার কী হলো? এ আমার কী হলো?
আবু মনে মনে বুক–ভাঙ্গা–মন্ত্রের মতো আওড়াতে থাকে। আবার চোখ মেলে ওপরের দিকে, সামনে ডানে বামে তাকায়। গাছ আর গাছ।
রঙের উৎসব লেগেছে ডালে ডালে।
.
যেন সে জানত বীথি বসে বসে বই পড়ছে এই ঝিমঝিম দুপুর বেলায়। তক্ষুনি বাসায় ফিরে সোজা বীথির ঘরে এলো।
বীথি সত্যি সত্যি বই পড়ছিল। সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়াল আবুর রোদে পোড়া লাল চেহারা দেখে। কোথায় ছিল? কী করছিল? বীথি বুঝতে পারল না, আসবে না বলে মাত্র কালরাতেই প্রতিজ্ঞা করবার পর আজ এমন কী অসাধারণ কারণ ঘটলো যে আসতে হলো?
যে কোনো কারণই থাক, জোর করে পাথর হতে চেষ্টা করল বীথি। সে সব শুনেছে, সব টের পেয়েছে। তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এ বাসা থেকে বড় চাচার বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে। যাবে না সে, কিছুতেই যাবে না।
আবু বলল, বীথি আছিস?
যেন খুব নিশ্চিন্ত হলো তাকে ঘরে পেয়ে। হাত বাড়িয়ে বলল, আয়, আমার সঙ্গে।
আশ্চর্য হলো বীথি। প্রতিজ্ঞার কথা মানুষ মাত্র ষোল ঘণ্টার ব্যবধানে ভুলে যায় কী করে? আবু আবার বলল, আয় না।
আস্তে আস্তে চেযারে গিয়ে আগের মতো বসলো বীথি। বইটাকে আঁকড়ে ধরল শক্ত হাতে। বুঝতে পারল আবুর সেই আবেগ উদ্দাম মুহূর্তগুলো আবার ফিরে এসেছে। সেই উদ্দামতার তাড়নায় কোন কিছুই আর টিকতে পারছে না।
আবু একটা চিত্রের মতো হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার আকুল হয়ে উঠেছে। ঠোঁটের পরে অনুপম সি আঁকা। হাসিটা যেন বলতে চায়, ভয় কী? হাসিটা যেন পৃথিবীর সমস্ত অশুভের বিরুদ্ধে জয়ের প্রতীক চিহ্ন। বীথি বই ওলটাতে ওলটাতে জোর করে উচ্চারণ। করল, না, না।
মাথা নাড়তে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে। আরেকটু হলেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। চোখ একেবারে ভরে উঠেছে। মুছতে পারছে না, পাছে আবু দেখে ফেলে। নিজেকে সে জোর করে মগ্ন রাখতে চেষ্টা করে বইয়ের পাতায়। আবু তখন পেছনে এসে দুহাত দিয়ে বীথির দুকাধ শক্ত করে ধরে। মুখ নাবিয়ে বলে, রাগ করেছিস? সেদিন আমার চিঠিটা পেয়ে সত্যি সত্যি রাগ করলি?
বীথি বিস্মিত হয়ে যায়। চিঠিটার কথা বুঝতে পারে না। আবু তাকে তো কোনো চিঠি লেখে নি। বীথি বলে, কোন চিঠি?
আবু যেন শুনতেই পায়নি। যেন বলাটাই তার একমাত্র কাজ। আবু কণ্ঠে মমতা তুলে বলে চলে, আমার চিঠিতে তুই ঝাজটুকুই দেখলি, আমাকে দেখলি না? বেশ তো, যদি চাস আমি আসব না। তাহলে আসব না।
আবু তো বীথির মধ্যে বীথিকে দেখছে না। বীথি তখন আবুর চোখের দিকে তাকায়। ভয় করতে থাকে।
তোমার কী হয়েছে, আবু ভাই?
আমার? কিছু না তো।
আবু মনে মনে বুঝতে পারে, যার উদ্দেশে এই বলা সে বীথি নয়, কিন্তু তবু বীথিকেই তার বলতে হচ্ছে। এতে উপশম হচ্ছে, মনের ভেতরে মুক্তির স্রোতোধারা বয়ে যাচ্ছে। আবু তাকে দুপায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। বলে, চল, বীথি।
বীথির তখন কী হয়, তাকে অনুসরণ করতে থাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
.
বীথি আর আবুকে দেখা যায় হাইকোর্টের পাশ দিয়ে মগবাজারের দিকে হাঁটতে। রোদে তেতে উঠেছে ফুটপাথ। লম্বা রাস্তাটা সুম সুম করছে উত্তাপে। একটা গাছের ছায়ায় পানির কল। পানি জমেছে এক চিলতে। সেখান থেকে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে চকিত একটা কাক। আবু বলতে থাকে, আমাকে তোর কী মনে হয়, বীথি?
বীথি কী জবাব দেবে বুঝতে পারে না। মনে মনে তোলপাড় করতে থাকে, এ প্রশ্নটাও কি তাকেই করা? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। উত্তর করে, আমার কী মনে হয়, জেনে কী করবে?
কী জানি কী করবো। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে যে। জানিস বীথি, আমার মাথার মধ্যে কিস্সু ঢুকছে না। খালি মনে হচ্ছে, আমার বুঝবার শোনবার সব শক্তি চলে যাচ্ছে। যে জিনিসটা একেবারে সামনে, তাকেও যেন কেউ দেখিয়ে না দিলে দেখতে পারব না—- এমনি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার এ কী হলো, বীথি?
তাড়াতাড়ি বীথি বলে, রোদে হাঁটতে বলেছে কে তোমাকে?
কে আবার? কি করবো তাহলে?
অসুখ করবে যে।
তার কি বাকি আছে রে?
বীথি ছায়া ঘেঁষে ঘেঁষে চলে। তার সঙ্গ নেয়ার জন্যে আবুকেও ছায়ার ভেতর দিয়ে চলতে হয়। আবু বলে, তোর ওপরে ভারী অবিচার করলাম।
বীথির বুকটা স্তব্ধ হয়ে যায়।
কদিন থেকে শরীর খারাপ তোর, তোকে এই রোদে বার করে আনলাম। মরে যাস যদি?
বীথির তখন মমতা হয়। উত্তর করে, আমার কিছু হয়নি তো। তোমার কথা বলছিলাম। তুমি একটা অসুখ বাঁধিয়ে বসবে এই আমার ভয়। যাচ্ছ কোথায়?
আবু তার দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসে। বলে, হঠাৎ আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কী অসম্ভব রক্ত রঙ ফুল ধরেছে। তখন বুঝলি বীথি, আমার মাথার ভেতরে সেই আগুন জ্বলে উঠল। থমকে দাঁড়ালাম। তোর হাসি পাচ্ছে? তোকে ডাকতে হলো। তুই না এলে কী করতাম?
আবু আস্তে আস্তে নিজের অস্তিত্ব আর সঙ্গতি ফিরে পাচ্ছে দেখে বীথি একটু আশ্বস্ত হলো।
যে উন্মত্ততা একটু আগে বাসায় দেখেছিল এখন তা পড়ে এসেছে। বীথি বুঝতে পারে, আবুর একটা ধাক্কা লেগেছে কোথাও। যেন হাশেম ভাইয়ের কথা বলার আভাস ফুটে বেরুচ্ছে তার কণ্ঠ থেকে। কেবল সেই ধাক্কাটা ভালো না মন্দের দিকে এইটে বীথি বুঝতে পারছে না। দাঁড়াও, আবু ভাই।
কেন রে?
বীথি যেন সব বুঝতে পারছে। বীথি চোখ মেলে দেখতে থাকে ফুলে ফুনে আকাশের নীলের ভেতরে লাল একটা রাজপথ। যেন আস্তে আস্তে ওদের দুজনকে চারদিক থেকে এইসব আগুন ফুলগুলো জড়িয়ে ধরছে। ডুবিয়ে দিচ্ছে আশেপাশের সব কিছু।
আর আবু ভাবতে থাকে, বিলকিস এখন কী করছে? সে অনুভব করতে পারে বিলকিসের আত্মা তার খুব কাছে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে নিরিখ করছে। আবু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বীথি মুখ ফিরিয়ে বলে, যাই।
যাবি? কেন? না যেতে পারবি না।
কোন জবাব না দিয়ে বীথি একা একা হাঁটতে থাকে। আবু যখন বারবার তাকে ফেরাবার চেষ্টা করে তখন কঠিন হয়ে বলে, কাল রাতে কথা দিয়েছিলে না?
দিয়েছিলাম। তাহলে এলি কেন?
আবু কিছুতেই ছেড়ে দেবে না তাকে।
শোন, বীথি।
রাস্তায় একটা সিন না করলেই না, আবু ভাই?
তিরস্কারটা শুনে ফেটে পড়ে আবু।
আমি না হয় তোকে জ্বালাই, তাই বলে সিন করতে পারব ভাবতে পারলি? যা, যেখানে খুশি যা। তুই মরে যেতে পারলি না?
যাবোই তো, মরেই যাবো।
বীথি একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে বসলো। বলল, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?
আবু কোনো জবাব না দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
.
রাস্তার মোড়ে কামালের সঙ্গে দেখা। আবুকে দেখে সে রিকশা থামায়, জিগ্যেস করে, ক্লাশ শেষ হলো বুঝি?
উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। কোন রকমে বলল, হ্যাঁ।
তাহলে আয় আমার সঙ্গে। মেলা খবর আছে।
বীথি চলে যাবার পর আবার আবুর মাথার মধ্যে প্রপাতের মতো ফিরে এসেছিল বিলকিস। বিলকিসের ওখানে যে কথাগুলো হয়েছিল সব একাকার হয়ে একটা সিম্ফনির মতো বাজছিল। বিলকিসের সমুখে এসে নিজের অক্ষমতা, নিজের বোবা হয়ে যাওয়ার প্রবৃত্তিকে শাপ শাপান্ত করছিল সে। বিলকিসের কাছে আবার যেতে ইচ্ছে করছে। এখন গেলে কেমন হয়? না। দুপুরে দুবার দেখা হলে কী ভাববে বিলকিস? এ–কী টানাপোড়েন! যার কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা, সংকোচ তার কাছেই? নিজেকে খুন করে ফেলতে পারলে যেন শান্তি পাওয়া যেত। আবু হঠাৎ নিজেকে চোখ বুজে ছুঁড়ে মারে কামালের দিকে। বলে, চল, কোথাও বসি। সেদিন খাওয়াতে চেয়েছিলি, আজ হোক।
রিকশায় উঠে বসে আবু শুধালো, কী খবর বল? মেলা খবর শুনে মনে হচ্ছে ভাগ্যটা হঠাৎ ফিরিয়ে ফেলেছিস তুই?
কামাল সুখী আত্মবিলাসী হাসি হাসল। তার হাসিটা অন্যসময়ে আবুর কাছে ভালগার মনে হতে পারত। কিন্তু এখন চোখেই পড়ল না। হাসির তোড় থামিয়ে কামাল বলল, হঠাৎ দুটো লাইসেন্স পেয়েছি। সেদিন বলছিলাম না খুব লস হচ্ছে?
আবু কামালের কথার ভেতরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখবার চেষ্টা করে। যেন কামালের ব্যবসার ওঠা পড়ার সঙ্গে তার এবং সারা পৃথিবীর উত্থান পতন নির্ভর করছে।
.
মাগরেবের নামাজ পড়তে গিয়ে আজ কেমন খালি খালি লাগে মরিয়মের। মনে হয়, কী যেন নেই তার সংসারে। কী যেন ছিল, হঠাৎ করে পালিয়ে গেছে। নামাজ পড়ে মুনাজাত করতে গিয়ে নিজের হাতের ভেতরে, সন্ধ্যার করুণ অন্ধকারের ভেতরে বীথির মুখ দেখতে পান মরিয়ম।
বীথিকে আজ বিকেলে খোরশেদ চৌধুরী এসে নিয়ে গেলেন। মেয়েটা কাঁদে নি, কোন কথা বলে নি। মরিয়ম যেন অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারছিলেন, বীথির হৃদয়টা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
কদিন থেকে ওকে নিয়ে যাবার কথা হচ্ছিল। মরিয়ম নিজে পারেন নি মেয়েটাকে বলতে। মুরশেদ চৌধুরী বলেছিলেন।
কথাটা শোনার পর থেকে বীথিকে লক্ষ্য করেছেন তিনি। আশ্চর্য হয়েছেন ওর সহ্য করবার ক্ষমতা দেখে। অতটুকু শরীরে এত বড় ব্যথাকে কবর দেয়ার শক্তি ও পেলো কোথায়? বীথি যে চলে যাচ্ছে, তাকে চলে যেতে হচ্ছে, এটাই যে তার শেষ যাওয়া এ বাড়ি থেকে এইটে তিনি ভুলতে পারছিলেন না। তবু যদি মেয়েটা ভালোয় ভালোয় যেত তাহলে মরিয়ম কাঁদতে পারতেন—- চলে যাওয়ার শোকটাকে মুক্তি দিতে পারতেন। কিন্তু যে অপবাদ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল তা মনে করে কাঁদতে সাহস পান না তিনি। বদলে কান্নাকে অনুমতি দিয়েছেন তাঁর অন্তরকে খাক করে দেওয়ার জন্য।
বিরাট নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে অশান্ত পাতাগুলোর মতো মরিয়মের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। বীথিকে নিয়ে যে তিনি কতখানি ভরে ছিলেন, আজ চলে যাবার পর তা ভীষণ রকমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নামাজ পড়ে ওপাশের বারান্দায় গেলেন মরিয়ম। সেখানে হাশেম একটা ইজিচেয়ারে চোখ বুজে পড়ে আছে। সন্ধ্যের একটু আগে ওকে শোয়া থেকে উঠিয়ে এনে বাইরে বসিয়ে দিয়েছেন। নইলে আল্লাহর লানৎ পড়বে।
এসে তার কপালে হাত রাখলেন মরিয়ম। জ্বরটা কমেছে একটু। এত ডাক্তার দেখালেন, ওষুধ আনালেন, কিন্তু তবু ছেলেটা ভালো হচ্ছে না দেখে মন তাঁর এমনিতেই খারাপ হয়ে। আছে। আজ পাঁচ বছর পর হারানো ছেলে কি ফিরে এসেছে মায়ের কোলে মরবার জন্যে?
সময়টা ভর সন্ধ্যে। মরিয়ম বুকে থুতু দিলেন, দরুদ পড়লেন। সন্ধ্যে বেলায় এমন অলুক্ষণে কথা মনে আনতে নেই। আল্লাহ তুমি মাফ কর।
হাশেমের পাশে মেঝেয় বসে ছেলের হাত ঘসে দিতে লাগলেন মরিয়ম। যেন তার করতল থেকে মৃত্যুর বিরুদ্ধে শক্তির ফৌজ পাঠিয়ে দিচ্ছেন ওর আত্মায়। হাশেম চোখ মেলে। তাকাতেই মরিয়মের বুকটা ভেঙ্গে পড়ল। এই ছেলেটা কত ছোট ছিল একদিন। তাঁর কোল ভরে চাঁদের মত শুয়ে থাকত। ইচ্ছে করলে, হাশেমকে যেন এখনো তিনি কোলে করতে পারবেন।
বললেন, ঘরে যাবি, বাবা?
হাশেম হাসল। কথা বলল না। কিন্তু ওতেই বোঝা গেল, ঘরে যাবে না। মরিয়ম চুপ করে। তাকিয়ে থাকেন। হাশেম তবু এ কদিন বকাবকি করত, যা খুশি তাই বলত। আজ সকাল থেকে একেবারেই চুপচাপ। আশঙ্কা হয় তার। হাশেম যে কথা বলছে না, এটা অশুভ চিহ্ন বলে মনে হয়। মনে হয়, হাশেম এখুনি উঠে পায়চারি করে বেড়াক, এলোপাথারি কথায় কান ঝালাপালা করে দিক—- তিনি স্বস্তি পাবেন। তিনি তবু অনুভব করতে পারবেন হাশেম বেঁচে আছে, হাশেম ভালো আছে।
মরিয়মের আকুতিটা যেন গিয়ে পৌঁছুলো হাশেমের অন্তরে। হাশেম বলে উঠল, তোমার ভয় করছে, মা?
কেনরে?
আমি মরে যাবো বলে।
বালাই ষাট, সোনা আমার।
মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিয়ে তুমিও কম কষ্ট পাচ্ছ না।
মরিয়ম অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকান। যেন ছেলের কাছে করুণ একটা অপরাধ করে ধরা পড়ে গেছেন তিনি। বললে, কষ্ট কী? পরের মেয়ে, চিরদিন থাকবে বলে তো আসেনি। চিরদিন থাকবে বলে তো কেউ আসে না। তবু কষ্ট হয়। কষ্ট না হলে তুমি আজ অমন করছ কেন?
মরিয়ম কিছু বলেন না। হাশেমের কাছে ধরা পড়েও যেন ভাল লাগছে।
হাশেম বলল, নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, মা। পাখিগুলো ঘরে ফিরে এসেছে। সারাদিন কোথায় ছিল ওরা? আকাশে বাতাসে মাঠে ঘাঠে সারাটা পৃথিবী ভরে উড়ে বেরিয়েছে। তারপর রাতের আশ্রয় যেখানে, যেখান থেকে ভোরবেলায় বেরিয়েছিল, সেখানে ফিরে এসেছে সবাই। আমার কী মনে হয় জানো মা? এই ছবিটাকে যদি সহজ করে মানুষ বুঝত, তাহলে কোনো দুঃখই থাকত না। সহজ বলেই তো বুঝতে পারাটা এত কঠিন। প্রাণের টান যেখানে, সে যেখানেই যাক না ফিরে আসবে। আমি তো বলি, মানুষ মিথ্যেই কষ্ট পায়। আমরা বাইরের পাওয়া, বাইরের চেহারাটাকে এত দাম দিয়েছি যে অন্তরকে একেবারে পায়ে ঠেলে বসে আছি। কেউ বুঝলো না বলেই তো খ্যাপা লাগে আমার।
মরিয়ম শুনতে শুনতে ওর কপালে হাত রাখেন। মনে একটু আশার সঞ্চার হয়। হাশেম আবার বকতে শুরু করেছে, যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তিনি আদর করে বলেন, সবাই বুঝবে কী? সবাই তোর মতো পণ্ডিত হলে বুঝত।
পাণ্ডিত্যের কী আছে, মা? ঐখানেই তো আরেকটা মস্তফাঁকি। পাণ্ডিত্য দিয়ে তর্ক করা যায়, ভয় দেখানো যায়; বোঝানো যায় না, ভালোবাসা যায় না। অন্তরকে বুঝতে হলে অন্তর দিয়ে। বুঝতে হয়।
কথা শেষ করে মায়ের করতলের নিচে পড়ে থাকে হাশেম।