অনিশ্চয়তার পথে
মা-বাবা হারা ছেলে বিমল দিদির আশ্রয়ে থাকে। জামাইবাবু যদিও তাকে বিরূপ নজরে দেখে।
যখন তখন ফাইফরমাশ খাটায়;
কথায় কথায় বলে পড়াশোনার ফাঁকে রোজগারের পথ দেখো।
বিমল ভীষণ মেধাবী। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করবার পর ইঞ্জিনিয়ারিং- এ চান্স পেলেদিদি নিজের গয়না বিক্রি করে তাকে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে। বিমল বলেছিল, দিদি টাকায় কুলাতে পারবেনা তুমি ,আমি বরং সায়েন্স নিয়ে গ্ৰেজুয়েশন করে কোনো একটা চাকরি ঠিক জুটিয়ে নেবো।
দিদি মানতে চায়না। বলে, তুই মন দিয়ে পড়াশুনা কর, তোকে অন্য কিছু ভাবতে হবে না।বাবা- মা’র তোর প্রতি অনেক আশা ছিল। তাঁরা তো নেই, তুই প্রতিষ্ঠিত হলে আমি নিশ্চিত হবো। টাকা ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। তোকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না।
কলেজ শুরু হলে বিমল দেখে আনুষঙ্গিক কিছু জিনিস কেনার প্রয়োজন। দিদির থেকে টাকা চাইতে সাহস পায়না। অতি কষ্টে এর ওর থেকে চেয়ে নিয়ে অসুবিধার মধ্যে পড়াশোনা করে। মেধাবী বলে সকলের সুনজরে সে। শুকদেব ও নীতিশ নামে দুই ছাত্রর সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়। তারা তাকে কলেজের পাঠ্য বিষয়ক জিনিসগুলো শেয়ার করে। পাড়ার অদূরেই কলেজের এক প্রফেসর সুনির্মল বসু-র বাড়ি। তিনি কিছুটা জানেন বিমলের পারিবারিক পরিস্থিতি। তাই বিমলের যাতে কিছু রোজগার হয় নিজের মেয়ে কবিতাকে সায়েন্সটা দেখিয়ে দেবার জন্য তাকে টিউটর নিযুক্ত করেন। বিমল আনন্দে দিদিকে এসে জানায় তার পড়ার যত অসুবিধাই হোক সে টিউশন পড়াবে। দিদি আশির্বাদ করে বলে, ঈশ্বর তোর সহায় হন। এগিয়ে যা ভাই, আমি সবসময় তোর পাশে আছি। কবিতা মাধ্যমিক দেবে। প্রতিদিন কলেজ শেষে কবিতাকে পড়িয়ে বিমল বাড়ি ফেরে। তারপর খাওয়া সেরে রাত জেগে পড়াশোনা করে। কঠোর পরিশ্রমে তার দিন কাটে। কবিতা অনেকদিন থেকেই বিমলকে মনে মনে ভালোবাসতো। পাড়ার ছেলে মেধাবী,ভদ্র ; সকলেরই প্রিয়।
বিমলকে কাছে পেয়ে তাই কবিতা নানান অছিলায় প্রেম নিবেদনের ইঙ্গিত করে। বিমল কৌশলে এড়িয়ে যায়। তার টাকার প্রয়োজন ; তাই ছেড়ে আসার উপায় নেই। আর ছেড়ে দিলে স্যারকেই বা কী জবাব দেবে? ভীষণ অসুবিধার মধ্যে সে টিউশন করে।
কবিতার বায়নাকে আমল না দিয়ে মাসের পর মাস বিমল পড়াতে যায়।
একদিন বিমল অসুস্থ। জ্বরজ্বর ভাব, মাথা যন্ত্রণা করছে।
কবিতাকে জানিয়ে সে দুটো অঙ্ক দেখিয়ে চলে আসছে , এমন সময় কবিতা তাকে পিছন থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলে, এখানে শুয়ে থাকো, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোমার! দাঁড়াও আমি জলপট্টি দিয়ে ওষুধ দিচ্ছি। তারপর একটু সুস্থ হলে বাড়ি যাবে। বিমল মানতে চায়না, জোর করে চলে আসতে গেলে কবিতা জড়িয়ে ধরে বাধ্য করে বসতে। বিমল ছাড়াবার চেষ্টা করলে কিছুটা ধস্তাধস্তি মত হয়। বাড়ির কাজের লোক উঁকি মেরে দেখে গিন্নিমা’কে রসিয়ে প্রেমের রং লাগিয়ে নালিশ করে। গিন্নি এসে পরিস্থিতি দেখে বিমলকে কড়া স্বরে বাড়ি চলে যেতে বলেন। কবিতা কিছু বলতে গেলে ধমকে থামিয়ে দেন।
বিমল ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। দিদিকে ঘটনার কিছুই জানায় না। পরদিন ওষুধ খেয়ে জ্বর কমিয়ে বিমল কলেজে গেলে, সুনির্মল স্যার ক্লাস নেওয়ার পর বিমলকে ওনার সঙ্গে দেখা করতে বলেন স্টাফ রুমে। স্যারের সঙ্গে দেখা করলে উনি আগের দিনের কথা তুলে বলেন, তোমাকে ভালো ছেলে বলেই জানতাম। দিদির বাড়িতে অনেক অসুবিধা করে থাকো, তাই হাতখরচের যাতে একটু ব্যবস্থা হয় তোমাকে টিউটর রাখি। কিন্তু এটা কি রকম তোমার আচরন! পড়ানোর নামে এতটুকু মেয়ের সঙ্গে তুমি প্রেমের সম্পর্ক গড়েছো? তোমাকে তো আর রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। বিমল যত তার কোনো দোষ নেই বোঝাতে চায়, সুনির্মল বসু শুনতেই চাননা।বিমল অনেক কাকুতি মিনতি করেও যখন দেখলো লাভ হলোনা, স্যারের পা ধরে বললো , দিদিকে জানাবেন না প্লিজ স্যার; জামাইবাবু শুনলে ভীষণ অশান্তি করবে। বিমল লজ্জায়, অপবাদে দিশেহারা।
সামনেই দ্বিতীয় সেমিস্টার। টাকা লাগবে। মনে ভাবে, ‘অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়।’ তার কিছু হবেনা। শুধু দিদির অন্ন ধ্বংস করছে। তাই সে বাড়ি না ফিরে নিরুদ্দেশে অনিশ্চয়তার পথে পাড়ি দিলো। রাতে বাড়ি না ফেরায় দিদি উদগ্ৰীব হয়ে স্যারের বাড়িতে যায়। স্যার বলেন, আজ বিমল পড়াতে আসেনি। পরদিনও ভাই ফেরেনি দেখে স্যারের কাছে গিয়ে কেঁদে বলে, ভাই আমার বড়ো দুখী; অর্থের অভাব। সেইজন্য কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসলো নাতো স্যার! কবিতা শুনে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওর কোনো দোষ নেই, আমিই ওকে জড়িয়ে ধরে জবরদস্তি করেছিলাম, গায়ে জ্বর ছিল, ওষুধ দেবো বলে।কিন্তু বাবা-মা সেকথা মানছেনা। এসব ঘটেছে আমার কারণেই। দিদি সব জানতে পারলো। বললো, স্যার একবার আমাকে তো জানাতে পারতেন! সুনির্মল স্যার বুঝলেন ভুল হয়ে গেছে।
দিদিকে নিয়ে থানায় গিয়ে নিখোঁজ ডায়েরি করলেন, আর খবরের কাগজে নিখোঁজ বিজ্ঞাপন দিয়ে, লিখলেন,” বিমল তুমি যেখানেই থাকো ফিরে এসো। আমায় ক্ষমা করো বাবা! আমি যে তোমার বড়ো ক্ষতি করে দিলাম।” কলেজে গিয়ে স্যার ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ বিমলের খোঁজ জানে কিনা? শুকদেব আর নীতিশকে বললেন, তোমার তো ওর কাছের বন্ধু ; ও দুদিন ধরে ঘরে যায়নি, জানো সে কোথায়? শুকদেব কলেজের কাছেই ভাড়া বাড়িতে থাকে।
সে বললো, সেদিন যখন আপনি ওকে দেখা করতে বললেন, ও আপনার কাছে গেল, আর আমি একটা কাজে বাড়িতে আসি। সন্ধ্যার পর বাজারে যাচ্ছি দেখি বিমল উল্টো দিকের রাস্তা ধরে ফাঁকা অন্ধকার মাঠে ঝিলের দিকে যাচ্ছে। ও কিছু কথা আমায় বলেছিল,তাই দৌড়ে কাছে গিয়ে বললাম, কি রে! এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
ও কেঁদে ফেললো।
বললো, আর আমার পড়াশোনা হবেনা রে। আমি এমন অভাগা ,ছোটোবেলায় বাবা-মা’কে হারিয়ে দিদির বাড়িতে থাকি ; এখন দিদির বাড়িতে অশান্তি লাগবে আমার জন্য। চলে যাচ্ছি দূরে, বহুদূরে।
সব শুনে আমি বুঝিয়ে আমার ঘরে নিয়ে এসেছি। স্যার শুনে তাড়াতাড়ি শুকদেবের বাড়িতে চললো।