Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অনিল বাগচির একদিন || Humayun Ahmed » Page 6

অনিল বাগচির একদিন || Humayun Ahmed

আয়ুব আলি

আয়ুব আলি অনিলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছেন। তাঁর ছোট মেয়েটি অনিলের কোলে, সেও ঘুমুচ্ছে। আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী বোরকার পর্দা তুলে ফেলে কৌতূহলী হয়ে চারপাশে দেখছেন। তাঁর মুখভর্তি পান। এরা বেশ সুখে আছে বলেই অনিলের মনে হল।

এই দেশ ছেড়ে সময়মতো চলে যেতে পারলে অনিলরাও কি সুখে থাকত? ১৯৬৫ সনে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেল। তখন অনেকেই চলে গেল। অনিলের ছোট কাকা বরুণ বাগচী তাদের একজন। রূপেশ্বরে তিনি পাকা বাড়ি তুলেছিলেন, দোতলা বাড়ি। বাড়ির পেছনে পুকুর। চুপি চুপি সব বিক্রি করলেন। কেউ কিছুই জানল না। যে কিনল সেও কোন শব্দ করল না।

ছোট কাকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। টুকটাক ব্যবসা করেই কি করে যেন ধাই করে একদিন তিনি বড়লোক হয়ে গেলেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক কমে গেল। তবু যাওয়া-আসা ছিল। কিন্তু তারা যে সব বিক্রি করে কোলকাতায় চলে যাচ্ছে এই সম্পর্কে কিছুই বলে নি। যে-রাতে যাবে সে-রাতে বরুণ বাগচী একা তাদের বাড়িতে বেড়াতে এল। তেমন শীত না, তবু সারা শরীর চাদরে ঢাকা।

সুরেশ বাবু বাংলা ঘরে বসে ছাত্র পড়াচ্ছিলেন, সেখান থেকেই বললেনকি খবর বরুণ?

তোমার সাথে একটু কথা আছে দাদা। ভেতরে আস।

ছাত্র পড়াচ্ছি তো।

একদিন ছাত্র না পড়ালে তেমন ক্ষতি হবে না। জরুরি কথা।

সুরেশ বাগচী অপ্ৰসন্ন মুখে উঠে এলেন। বরুণ গম্ভীর গলায় বলল, তোমার পুত্ৰ-কন্যাদেরও ডাক। কথাবার্তা সবার সামনেই হোক। এরা ছোট হলেও এদেরও শোনা দরকার। নয়ত বড় হয়ে আমাকে দোষ দিবে।

তোর ব্যাপার তো কিছুই বুঝতেছি না।

বরুণ বসল খাটে পা তুলে। তার গলার স্বর এমনিতেই ভারী। সে রাতে আরো বেশি ভারী শোনাল।

তোমরা ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথা কিছু ভাবছ? সুরেশ বাবু অবাক হয়ে বললেন, শুধু শুধু ইন্ডিয়া চলে যাবার কথা ভাবব কেন?

অনেকেই তো যাচ্ছে।

অনেকেই কেন যাচ্ছে তাও তো বুঝি না।

কেন বুঝছ না? বেশিদিন মাস্টারি করলে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায় জানি, এতটা পায় তা জানতাম না।

মাস্টারির দোষ দেয়ার প্রয়োজন নাই। তুই কি বলতে চাস বল।

বরুণ চাপা গলায় বলল, এই দেশ আমাদের থাকার জন্য না।

কেন না? তুই তো ভালোই আছিস। ব্যবসা-বাণিজ্য করছিস। দোতলা দালান দিয়েছিস।

তা দিয়েছি মনের শান্তির বিনিময়ের দিয়েছি। মনে শান্তি নাই।

শান্তি না থাকার মতো কি হল?

দাদা, তুমি বুঝতে পারছ না, এই দেশে আমরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন।

সুরেশ বাগচী হাসতে হাসতে বললেন, নিজেকে সেকেন্ড ক্লাস ভাবলেই সেকেন্ড ক্লাস। তুই এ রকম ভাবছিস কেন? আমাকে দেখ। আমি তো ভাবি না।

দাদা, সত্যি করে বল তো— তুমি কোন রকম অনিশ্চয়তা বোধ করা না?

না করি না। কেন করব?

কি আশ্চর্য কথা! একটা প্রশ্ন করলেই তুমি উল্টা প্রশ্ন করছ। আমি তো তোমার ছাত্র না।

তোর হয়েছে কি সেটা বল।

দাদা, তোমাকে সত্যি কথা বলি, এই দেশে মনটা ছোট করে থাকতে হয়।

যার মন ছোট, সে যে দেশেই যাক তার মন ছোটই থাকবে।

খবরের কাগজে দেখেছি। আরতীবালা নামের এক মেয়েকে কিছু প্রভাবশালী লোক ধরে নিয়ে গেছে, সাতদিন পর ছেড়েছে?

শুধু হিন্দু মেয়েদের এ রকম হচ্ছে তা তো না, মুসলমান মেয়েদের বেলায়ও হচ্ছে। হচ্ছে না? এমন যদি হত শুধু হিন্দু মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটছে তাহলে ভিন্ন কথা হত। তা ঘটছে না। আরতীবালাকে নিয়ে খবরের কাগজে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। ব্যাপারটা সবার খারাপ লেগেছে বলেই হয়েছে।

এটা একটা জঘন্য দেশ দাদা।

তুই যেখানে যাচ্ছিস সেটা কি খুব উন্নত কিছু? সেখানে এমন হচ্ছে না? সমস্যা তো দেশের না, সমস্যা মানুষের। দেশ মন্দ হয় না। মাটি কি কখনো মন্দ হয়?

বরুণ রাগী গলায় বলল, আমাকে এসব বড় বড় কথা বলবে না। দাদা। আমার এসব বড় বড় কথা শুনতে বিরক্তি লাগে।

আচ্ছা ঠিক আছে, আর বড় বড় কথা বলব না। তুই একটু সহজ হয়ে বসতো। তোর মাথা গরম হয়েছে। গা থেকে গরম চাদরটা খোল। লেবুর সরবত খাবি? অতসী তোর কাকাকে লেবুর সরবত করে দে।

আমি কিছু খাব না।

তুই কি অকারণে রাগোরাগি করার জন্যে এসেছিস?

বরুণ কঠিন গলায় বলল, দাদা, আমি ঠিক করেছি- কোলকাতা চলে যাব।

কি বললি?

শুনলেতো কি বললাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোলকাতা চলে যাব।

সুরেশ বাবু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। আমি কিছু বললে তো সিদ্ধান্ত পাল্টাবি না। আমাকে বলা অর্থহীন।

তোমাকে বলছি, কারণ তোমাকে খবরটা জানানো দরকার।

আচ্ছা যা, আমি জানলাম।

তোমাকে সবাই স্যার স্যার করে, খাতির করে, কাজেই তুমি আছ একটা ঘোরের মধ্যে। আসল সত্য তোমার অজানা। এই দেশের সেনাবাহিনীতে কোন হিন্দু নেয়া হয় না, এটা তুমি জান?

না, জানতাম না।

এখন তো জানলে। এখন বল কি বলবে?

এরা যে নিচ্ছে না। এটা এ-দেশের মানুষদের বোকামি। দেশের সব সন্তানের সমান অধিকার। অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এক ধরনের ভুল। সেই ভুলের জন্য দেশকে কেন দায়ী করব?

কাকে দায়ী করবে?

যেসব মানুষ এই ভুল করছে তাদের দায়ী করব।

শুধু দায়ী করবে, আর কিছু না?

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব যেন তারা ভুল বুঝতে পারে।

ঈশ্বর সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রার্থনা শুনবেন?

শোন বরুণ, আমি বুঝতেই পারছি না কেন তুই এত রেগে আচ্ছিস কেউ কি তোকে কিছু বলেছে?

না। দাদা, আমি চলে যাচ্ছি।

সেটা তো শুনলাম। কবে যাচ্ছিস?

আজই যাচ্ছি। আজ রাত এগারোটায়।

সুরেশ বাগচী দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বললেন, আজ রাত এগারোটায় তুই চলে যাচ্ছিস আর আমাকে সে-খবর দিতে এখন এসেছিস? বাড়িঘর কি করবি?

বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়েছি।

কখন বিক্রি করলি?

মাস খানিক হল। সব চুপি চুপি করতে হল। জানাজানি হলে সমস্যা হবে।

আমাকেও জানালি না!

একজন জানলে সবাই জানবে।

সুরেশ বাগচী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এই দেশের কাউকেই তুই বিশ্বাস করিস না। শ্রীরামকৃষ্ণের একটা কথা আছে না? কচ্ছপের মতো মানুষ। তুই হচ্ছিস সে রকম। কচ্ছপ থাকে জলে কিন্তু ডিম পাড়ে ডাঙ্গায়। তুই থাকিস এক দেশে আর মন পড়ে থাকে অন্য দেশে। কাজেই তোর চলে যাওয়াই ভালো। তবে তুই যে শেষ সময়ে আমাকে খবরটা দিতে এলি তাতে মনে দুঃখ পেয়েছি।

তোমাকে আগে বললে লাভটা কি হত?

সুরেশ বাগচী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোন লাভ হত না। যাচ্ছিস যা। ঐখানে মন টিকবে না। মানুষ গাছের মতো। মানুষের শিকড় থাকে। শিকড় ছিড়ে যাওয়া ভয়ংকর ব্যাপার। গাছ ছিড়লে যেমন মারা যায়, মানুষও মারা যায়। গাছের মৃত্যু দেখা যায়। মানুষেরটা দেখা যায় না। তুই দুঃখ পাবি।

দুঃখ তুমিও পাবে দাদা। দুদিন পর বুঝবে কি বোকামি করেছ। হিন্দুমুসলমান দাঙ্গা লাগবে, ঘরে আগুন দিবে।

এইটা কখনো হবে না। বরুণ। আমি কোনদিন এদের অবিশ্বাস করি নি। এরাও করবে না। তুই এখন যা, তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না।

বরুণ তারপরেও চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইল। তাকাল অতসীর দিকে। নিচু গলায় বলল, অতসী, আমি কি অতসীকে নিয়ে যাব?

ওকে নিতে চাস কেন?

ওরা ভালো বিয়ে দেব। এই দেশে ওর জন্যে ছেলে পাবে না।

তুই চলে যা বরুণ। এগারোটার সময় যাবি দশটা প্ৰায় বাজে।

তুমি আজ বুঝতে পারছ না। দাদা। একদিন বুঝবে। মর্মে মর্মে বুঝবে।

বরুণ চলে গেল। সুরেশ বাবু বারান্দায় সারা রাত বসে রইলেন। সেই রাতে তিনি উপবাস দিলেন। বিগড়ে গেলে শরীরকে কষ্ট দিয়ে মন ঠিক করতে হয়। সুরেশ বাগচী ঠিক করলেন আগামী দিনও তিনি নিরন্তু উপবাস দেবেন।

বাসের ঝাঁকুনিতে অনিলেরও ঘুম পেয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই মনে হল, সে দিন ছোট কাকার সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে গেলে তার এই বিপদ হত না। বাবা বেঁচে থাকতেন। তবে অনিল এও জানে, কোন উপায়ে সে যদি বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারত- বাবা, তোমার কি মনে হচ্ছে দেশ ছেড়ে গেলে তোমার জন্যে ভালো হত? থেকে যাওয়াটা বোকামি হয়েছে। তাহলে তিনি জবাব দিতেন— অনিল, এই বিপদ কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর আসে কি, সারা দেশের উপর এসেছে। আমার মৃত্যু এমন কোন বড় ব্যাপার না বাবা। তাছাড়া তোমার হেড স্যার কি তোমাকে লেখেন নি আমার মৃত্যু সংবাদে রূপেশ্বরের হাজার হাজার মানুষ চোখের জল ফেলেছে। মানুষের ভালবাসায় আমার মৃত্যু। এই দুর্লভ সৌভাগ্য কজনের হয়?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *