মনে হচ্ছে বেঁচেই আছি
আমি মনে হচ্ছে বেঁচেই আছি।
মনে হচ্ছে বলছি কারণ আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। বড়ো রকমের একটা জট কীভাবে যেন লেগে আছে, জট খুলতে পারছি না। হয়তো পাগল-টাগল হয়ে গেছি। কোনো ইন্দ্ৰিয় ঠিকমতো কাজ করছে না। কিংবা মৃত মানুষদেরও হয়তো চেতনা বলে কিছু আছে। অদ্ভুত সব দৃশ্য সে দেখে এবং অদ্ভুত সব শব্দ সে শোনে।
যেসব ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেছে, আমি সেসব সাজাতে পারছি না। মহাকাশযানে করে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ। একটা দুর্ঘটনা ঘটল। ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। দুর্ঘটনায় আমার জীবনের ইতি হয়ে যাবার কথা। তাও হল না। মনে হল খানিকটা চেতনা অবশিষ্ট আছে। মাঝেমধ্যে কে যেন আমায় সান্ত্বনা দেয়, বলে, ধৈর্য ধর, আমরা আছি। কে বলে? জানতে পারি না, কারণ চারদিকে গাঢ় অন্ধকার।
এখন অন্ধকার নেই, আমি সব কিছু পরিস্কার দেখতে পারছি। তবে যা দেখছি তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে, যে জট লেগেছে তা কেনো দিন খুলবে না। কারণ আমি চারপাশে দেখছি আমার পরিচিত জগৎ। আমার এ্যাপার্টমেন্টের সাত তলার ঘর। কোঁচকান বিছানার চাদরের এক কোণায় কফির দাগ লেগে গিয়েছিল, সেই দাগও আছে। বাথরুমের শাওয়ারটা নষ্ট। সব সময় ঝিঝির করে পানি পড়ে। এখনো পড়ছে, শব্দ শুনছি। খাটের পাশে শেলফে অনেকগুলি বই। মেঝেতে একটা পেপারব্যাক বই পড়ে আছে, নাম দি ওরিওনা ভৌতিক উপন্যাস। কিনে এনেছিলাম, কিন্তু এক পৃষ্ঠাও পড়ি নি। খুব নাকি চমৎকার বই। নিকি পড়েছে। তার ধারণা এটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বই। এ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে আসবার সময় বইটি যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। আমার জন্যে এর চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখি প্রতিটি পৃষ্ঠা সাদা।
শেলফের বইয়েরও একই অবস্থা। বেশির ভাগ বইয়েরই সব পৃষ্ঠা সাদা। অবশ্যি কিছু কিছু বই পাওয়া গেল যেগুলিতে লেখা আছে। একটি বইয়ের ত্রিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লেখা, বাকি পাতাগুলি সাদা। এর মানে কী?
আমি জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। কী অদ্ভুত কাণ্ড, জানালার ওপাশে ঘন অন্ধকার–কিছুই নেই। আমার এই ঘরটি ছাড়া ব্ৰহ্মাণ্ডে যেন আর কিছু নেই। এর কোনো মানে হয় না। এটা গভীর রাত হলেও বাইরে লোকজন চলাচল করবে। স্ট্রিট লাইট জ্বলবে। কিন্তু এটা রাত নয়, কারণ আমার ঘরে বাতি জ্বলছে না, অথচ ঘরের ভেতর দিনের মতো আলো। আমার খাটে তেরছা করে সূর্যের আলো পড়েছে, অথচ বাইরে কোনো সূর্য নেই।
আমি উঁচু গলায় বললাম, এসব কী হচ্ছে? কেউ আমার কথার জবাব দেবে ভাবি নি, কিন্তু জবাব পেলাম। কোনো শব্দ হল না, অথচ পরিষ্কার বুঝলাম কেউ এক জন বলছে, তোমার ঘরটি কি আমরা ঠিকমতো তৈরি করি নি?
আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে? তুমি কে?
আমি কে তা জানতে পারবে। তার আগে বল কেমন বোধ করছ?
আমি কি বেঁচে আছি?
নিশ্চয়ই বেঁচে আছ, তোমাকে বাঁচিয়ে তুলতে খুবই কষ্ট করতে হয়েছে। তোমার বেশির ভাগ অঙ্গপ্রত্যঙ্গই নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে। এটা তেমন কোনো জটিল ব্যাপার নয়, তবুও খুব ক্লান্তিকর দীর্ঘ ব্যাপার।
আমি আমার চারপাশে যে সব দেখছি, তা কি আমার কল্পনা না সত্যি সত্যি দেখছি?
যা দেখছ সত্যি দেখছ। এইসব জিনিসের স্মৃতি তোমার মস্তিষ্কের কোষে, যাকে তোমরা বল নিউরোন সেখানে ছিল। আমরা তা দেখে দেখেই তোমার চারপাশের পরিবেশ তৈরি করেছি। তুমি একটু আগেই লক্ষ করেছ কিছু কিছু বইয়ের পাতা সাদা। ঐ বইগুলি তুমি পড় নি, কাজেই তোমার মাথায় কোনো স্মৃতি নেই। আমরা যে কারণে লেখা তৈরি করতে পারি নি। যেসব বই পড়েছ, তাঁর স্মৃতি তোমার আছে। কাজেই সেসব তৈরি করা হয়েছে। আমি কী কলছি বুঝতে পারছ?
না, পারছি না।
ধীরে ধীরে বোঝই ভালো। তোমার মস্তিষ্ক এখনো পুরোপুরি সবল হয় নি। আরো কিছু সময় যাক।
তোমরা কে?
এখনো বুঝতে পারছ না?
না।
বুঝবে, সময় হলেই বুঝবে।
আমার সঙ্গীরা কোথায়?
সবাই ভালো আছে।
তিশ-২ নামের একটি রোবট ছিল–।
তাকেও ঠিকঠাক করা হয়েছে।
তোমরা কি বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী?
প্রাণী বলতে তোমরা যা বোঝ, আমরা সে রকম নই। আমাদের জন্ম ও মৃত্যু নেই।
তা কী করে হয়।
কেন হবে না? একটি আঙটির কথাই ধর। আঙটিটির কোনো শুরু নেই আবার শেষও নেই। তাই নয় কি?
তোমরা দেখতে কেমন?
এই প্রশ্নের জবাব আমরা জানি না। আমরা লক্ষ করেছি দেখার ব্যাপারটিতে তোমরা খুব জোর দিচ্ছ। এই ব্যাপারটা কী, সেই সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। এখন তুমি বিশ্রাম নাও।
আমার চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে পরিচিত ঘর অদৃশ্য। চারপাশে অন্ধকার, গাঢ় অন্ধকার। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, কিংবা আমার চেতনা বিলুপ্ত হল। কী হল ঠিক জানি না।