অচ্ছূৎ কন্যা
সাজলি ডোম পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্ৰামের মেয়ে। গ্ৰামের অদূরে একটা মজে যাওয়া পুকুরে রোজ জল আনতে যায়। গ্ৰামে একটা পুকুর আছে বটে, তবে সে পুকুরের জল গ্ৰামের লোকেরা ছুঁতে দেয় না। জন্ম হতে মা হারা মেয়ে বাবার সাথে নির্জন শ্মশানের পাশে থাকে। আশেপাশে চার পাঁচ ঘর নিয়ে একটা পাড়া। হাড়ি ,ডোম শূদ্র শ্রেনীর মানুষের বাস। সাজলি শূদ্র তাই সে অচ্ছুৎ। গ্ৰামের পুকুর থেকে জল নিতে পারে না। জলকষ্টে এই ক’ ঘর লোক ঠিকমত স্নান- রান্না করতে পারে না । গাঁয়ের লোক দেখতে পেলে কঠিন শাস্তি দেয়। তাদের যেতে হয় বহু দূরে একটা নোংড়া পানা ভরা ডোবা থেকে জল আনতে।
একবার গ্ৰীষ্মকালে প্রচন্ড গরমে জলের হাহাকার। ঢোবার জল শুকিয়ে গেছে। পুকুরের জলও শুকিয়ে কম।
উপায়ান্তর না দেখে সাজলি গ্ৰামের পুকুরে জল আনতে যায়। কিন্তু পুকুরে পা ডুববে তাই পাশে একটা টিউবওয়েল থেকে জল নেয়। সাজলির ভালে দুঃখ। তাই গ্ৰামের মোড়লের চোখে পড়ে। ব্যাস, লোকজন ডেকে সাজলির বালতি ভর্তি জলে নর্দমার কাদা নোংড়া দিয়ে দেয় আর সেই নোংড়া জল সাজলির মাথায় ঢেলে জুতো ছুড়ে মারতে মারতে সারা গ্ৰামে ঘোরায়। গরমে রোদের তাপে সাজলি কিছুদূর গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
বাবা হারু ডোম খবর শুনে তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে গ্ৰামের লোকের , মোড়লের পায়ে পড়ে ক্ষমা চায়। মোড়লের কড়া হুকুম , ‘ তোরা ক’ ঘর জাতে নীচু, অচ্ছুৎ তোরা,এখান থেকে জল লিতে পারবি নাই ।’ হারু নত মাথায় করজোড়ে বলে, বাবু এই গরমে ডোবাটো শুকিয়ে কাঠ, জলটো কোথায় পাব? জীবনটা তো রাখতে লারবো, মারে যাব গো আমরা।
মোড়ল বলে, ওসব জানিনা। তোরা শ্মশানে থাকিস, মরা পোড়ানোর কাজ করিস, তোদের ছোঁয়া জল খাবো কি করে? তাছাড়া তোরা শূদ্র জাত অচ্ছুৎ। এখন এই জলের কল গোবর গঙ্গা জলে শুদ্ধ করতে লাগবে। যা যা। ঘর চলি যা, এদিকে যেন না দেখি বাপ বেটিকে’। গ্ৰামের লোকের এক কথা শূদ্ররা অচ্ছুৎ, এখান থেকে জল দেওয়া যাবেনা। কোনোভাবেই জল কষ্টের কথা গ্ৰামের লোকেরা শুনলো না। শেষে ‘আর কোনোদিন এ মুখো হবেনা’ মুচলেকা দিয়ে মেয়েকে কোনোরকমে কাঁধে করে ঘরে নিয়ে এলো হারু।
হারুর স্ত্রী নেই, তাই মেয়েই তার একমাত্র সম্বল। মেয়েকে সে খুব ভালাবাসে।
মেয়েকে ঘরে এনেছে কিন্তু গায়ের নোংড়া কি করে ধোয়াবে, জল কোথায় পাবে! পাশের কয় ঘরের তো একই অবস্থা। অনেক দূরে বনের ভিতরে ডুংড়ি খালের একটা সরু শাখা রয়ে গেছে। কিন্তু অত দূরে পরন্ত বিকেলে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। পাশের বুড়ো সর্দারের একটা সাইকেল আছে। সেটা চেয়ে নিয়ে হারু তাড়াতাড়ি মেয়েকে পিছনে বসিয়ে স্নান করিয়ে নিয়ে আসে, সঙ্গে জলও আনে।তাই দিয়েই সেদিনের কাজ সারে।
রাতে ঘুম হয়না সাজলির। মনে মনে ভাবে আমরা সবাই মিলে পাশের মাঠে যদি একটা পুকুর কাটি তাহলে জল উঠবে । বৃষ্টিতে জল ভরবে আর জলকষ্ট হবেনা। সকালে বাবাকে জানালো সেকথা। পাশের লোকদেরও বলল। কিন্তু কেউই বিশেষ সাড়া দিল না। বুড়ো সর্দারের বউ বেটা বলল, তোদের বাপ বেটির মাথা খারাপ হইছে। এ কাজ সহজ লাকি! সাজলির মন মানতে চায় না। সে বাবাকে বলে ‘ চল আমরা দুজনে মিলে মাঠটোতে গিয়ে কুয়ো কাটি , কিছু তো ব্যাবস্থা নিতে হবে জলের লেইগে। বাপ বেটিতে রাত ভোর খেটে ছোট্ট একটা কুয়ো কাটলো। কিন্তু জল উঠলো না। পড়শিরা হাসে। বলে, পাগল বটে তুরা। বুড়ো বাপটোকে খাটায় মারবি। পরদিন বাপ বেটিতে গাছ কেটে দড়ি দিয়ে বেঁধে মই তৈরী করে।তারপর কুয়োতে মই নামিয়ে মই বেয়ে কুয়োতে নেমে আরো গভীর মাটি কাটে।এবার জল দেখা দেয়। পড়শিদের ডেকে দেখায়। সকলে অবাক।এবার সবাই মিলে দূরের সেই খাল থেকে জল এনে কুয়োর ভিতর ঢালতে থাকে।কুয়ো জলে ভরে যায় ।গ্ৰীষ্মে তাদের জলের কষ্ট দূর হয়।
বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। একদিন সাজলি দেখে রাতের অন্ধকারে কে যেন তাদের বাড়ির পাশে বসে আছে। চীৎকার করে সে পড়শিদের ডাকে। সকলে জড়ো হয়। হ্যারিকেনের আলোয় দেখে গ্ৰামের মোড়ল চাদর ঢাকা দিয়ে বসে। সকলে জানতে চায় , এখানে কেন বসে? উত্তরে মোড়ল বলে, সে আজ অচ্ছুৎ। তার বাড়িতে তার জায়গা নেই, এমনকি গ্ৰামের লোকেরা তাকে সেখানে থাকতে দিতে চায়না। সে কুষ্ঠ আক্রান্ত।চাদরের ভিতর থেকে হাত বের করে দেখায়। সকলে গালিগালাজ করে , অপমান করে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতে উদ্যত হয়।
কিন্তু সাজলি বলে -‘ বাবু অচ্ছুৎ বুইললে মনটোতে কিমন ব্যাথা লাগে আপনি বুইচ্ছেন, ইটাই আমার কাছে ভালো লাইগছে। তবে আমি আপনাকে তাড়াই দিব না। আমাদের বাসাটোর কোইণের মাঠটোতে আপনি থাইকবেন।বাপ আর আমি বাঁশের ছোটো ঘরে বানাই দিব। রোগটো হইলে কি করা যাইবেক । আমি খাবার, জল সব দিব, তবে জল নিতে যেতে পারবেন নাই। বাপ আমার জল দিয়ে যাবে।’
সাজলির বাবা বাঁধা দেয়। বলে, উ রোগটো বাজে আছে , ছড়ায় যাবে। তু কেন ইসব বইলছিস?
সাজলি বলে বাবা, সে -ই তো আজ অচ্ছুৎ।আমরা তো উয়াকে দূর মাঠে রাইখছি।দূর থিকা খাবার দিব , জল দিব। উয়ার বাড়িতে জানাইব। উয়ারা খরচ দিলে দিবে , না তো আমরা যা খাই তাই দিব। উয়ার মত নিষ্ঠুর কাজ কোরবক নাই, ভগবান পাপ দিবে।