Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আনু এখন বড় হয়ে গেছে

আনু এখন বড় হয়ে গেছে। এই খবরটা কেবল আনু ছাড়া সবাই জানে। কেবল আনু জানে না, সবাই জানে, আনু এখন বড় হয়ে গেছে।

আগে বেলা করে উঠতে ইচ্ছে করত না তার। সালু আপা একদিন যদি ডাকতে দেরি করত, তাহলে সেদিন সারাদিন তার বেণি আস্ত থাকত না। এখন সালু আপা বেণি করে না, মা–র মতো খোঁপা করে। আনু এখন ভোরে ওঠে।

ভোরে উঠে আর ফুল কুড়োতে ছুটে বেড়ায় না। সবার আগে উঠে, কেবল মা–র পরে উঠে, আনু বড় বড় পা ফেলে বাসা থেকে বেরোয়। মা তখন কুয়োতলায় ওজু করছেন, তার সংগে। একটা কথা পর্যন্ত হয় না!

পথটা ভারী নির্জন হয়ে পড়ে থাকে। যেন কালরাতে কার গা থেকে ছাই–রং একটা শাল পড়ে গেছে, আর ভোলা হয়নি—- আকাশটা তেমনি। যেন মোটা আম গাছটার আড়ালে থেকে বাবাকে এখুনি দেখা যাবে পায়চারি করতে করতে আনুর দিকে আসছেন। তার সমস্ত মুখ সূর্য ওঠার লাল রংয়ে ছবির মতো। তার হাসির ভেতর থেকে যেন সূর্য উঠেছে।

খুব গম্ভীর হয়ে একা একা হাঁটতে থাকে আনু। ডাক বাংলোর পুকুরে এসে পদ্ম দেখে, পাতায় পাতায় একটুও পানি দেখা যাচ্ছে না। একটা দুটো পাতা সরিয়ে অনেকক্ষণ ধরে মুখ ধোয় আনু। রাতভর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। ঠাণ্ডা পানিতে চোখের ভেতরটা যেন কাটতে থাকে।

কোনো কোনো দিন আনু সেখান থেকে আসে নদীর দিকে। ধরলার দিকে। ধরলার পাড়ে দাঁড়িয়ে কোনো কোনো দিন হিমালয় দেখা যায়। একেবারে সারা আকাশ জুড়ে নীল মেঘের মতো। তারপর, কখন যেন, একটা মেঘের চূড়া ঝকঝক করে ওঠে। আনুও তখন হাসতে থাকে। তার মনের মধ্যে আর কিছুই মনে থাকে না। না বড় আপার ছায়ার মতো মুখ, মেজ আপার কান্না, সেজ আপার এটা নেই ওটা নেই বলে মুখ ভার, মার রাত জেগে জেগে নামাজ, মিনু আপা বখাটে হয়ে যাচ্ছে, সালু আপার জামা ছিঁড়ে শাদা কাধ বেরিয়ে পড়েছে, বাবাকে জেলে নিয়ে গেছে, পানু ভাই রেলে কাটা পড়ে মারা গেছে, কিছুই মনে থাকে না। সব ভুলে গিয়ে সে দেখতে থাকে —-ঝকঝক করছে, হাসছে।

তারপর দপ্ করে নিভে যায়। বাবা বলতেন, সূর্য একটু উঠে গেলেই আর রোদ পড়ে না, তখন কাঞ্চনজংঘা আবার নীল হয়ে যায়। সেটাও মজা লাগতো। দপ্ করে নিভে যেতেই বাবার হাত ধরে আনন্দে লাফিয়ে উঠত আনু। দৌড়ে বাসায় এসে বাকুম বাকুম করে সেই গল্প শোনাতো। মিনু আপা যদি ঠোঁট উলটে বলত, যা, আমিও দেখেছি তাহলে মনটা ভারী ছোট হয়ে যেত আনুর। বাবা সেটা লক্ষ্য করে মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলতেন, মিনু আর কি দেখেছে? আজকের মতো কোনদিন হয়নি। কি বলিস আনু?

এখন আনু কাঞ্চনজংঘা নিভে যাওয়া পর্যন্ত আর দাঁড়ায় না। তার আগেই চলে আসে। এসে আর গল্পও করে না।

আসবার পথে দেখতে পায় ইস্টিশানের দোকানগুলোয় ডালপুরি বানাচ্ছে গরম গরম। ভারী ইচ্ছে করে একটা কেনে। পকেটে হাত দিয়ে দেখে হয়ত চারটি পয়সাও আছে। কিন্তু কেনে না। পকেটের মধ্যে হাত দিয়ে শক্ত করে পয়সাটাকে অনুভব করতে থাকে, ঘোরাতে থাকে, হাতের তেলো ঘামতে থাকে। কিন্তু কেনে না। বাসায় এসে শুধু এক পেয়ালা চা খেয়ে নাশতা করে। বারান্দায় বসে বসে দেখে, রান্নাঘরে গতরাতের বাসি ভাত নিয়ে বসেছে মেজ আপা, সেজু আপা; বড় আপা বড় এক গেলাসে পানি খাচ্ছেন। কেউ তাকে পড়তে বলে না। একটু পর আনু নিজেই পড়ার বই নিয়ে বসে। আবৃত্তি করে পড়ে না। মনে মনে, মাথা নিচু করে, বারান্দার থাকে ঠেস দিয়ে এক্সিমোদের কথা পড়ে আনু।

সেদিন হঠাৎ অফিস থেকে পিয়ন এসে বলল, আনু মিয়া মাস্টার সাহেব আপকো বোলায়া।

মাস্টার সাহেব? কে মাস্টার সাহেব? আনু জানে না পোস্টমাস্টারকেও মাস্টার সাহেব বলে। তাদের বাসায় জায়গির থেকে পড়ত মাস্টার সাহেব, বাবা যখন জেলে গেলেন, তিনি চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় তাকে সব সাদা খাতা, দুটো গল্পের বই, একটা টাকা, কাঁচের দোয়াত দান, পেতলের একটা ছোট্ট বক দিয়ে গিয়েছিলেন। আনু এখন বুঝতে পারে–বাবা যে নেই, তারা খেতে দিতে পারবে না, তাই চলে গিয়েছিল মাস্টার সাহেব। পানু ভাই বুঝি আগেই টের পেয়েছিল ঘুস নিতে গিয়ে ধরা পড়বেন বাবা, জেলে যাবেন, তাই রেলে কাটা পড়ে ফাঁকি দিয়ে গেল। পানু ভাইয়ের কী? বড় হয়েছে, বি,এ, পাশ করেছে, ঢাকা দেখেছে, ভালো ভালো জামা আর জুতো কিনেছে, বড় বড় জংশনে কাজ করেছে। তার মরে যেতে কী। মরতে একটুও দুঃখ নেই তার।

পিয়নের ডাক শুনে মা এসে দাঁড়িয়েছিলেন দরোজার ওদিকে। নিচু গলায় তিনি জিগ্যেস করলেন, আনু জিগ্যেস কর, ওরা ডাকছে কেন?

পিয়নটা উত্তর করে, মা–জি হামারা মালুম নেহি।

আনু ভেতরে আসে। একটা কথাও বলে না! আলনা থেকে বেছে একটা শার্ট বের করে গায়ে দেয়। সুন্দর করে শার্ট ধুয়ে রাখেন মা! নোখ দিয়ে দিয়ে কালারে, বোতামের জায়গায় কুচিগুলো সমান করে রাখেন।

মা বললেন, বুলুকে নিয়ে যা।

বুলু পাশের বাড়ির ছেলে। এবার নাইনে পড়ে। বুলুর মাকে খুব ভালো লাগে আনুর। বুলুর বাবাকেও, বুলুকেও। বুলুদের সবাইকে ভালো লাগে আনুর। বুলুরা কেউ কখনো বলে না, আনুর বাবা ঘুস খেয়ে জেলে গেছে। সারা শহরে শুধু বুলুরাই বলে না। আর সবাই বলে। বলে, আর দাঁত বার করে হাসে। কেবল বুলুরা বলে না। আর বলে না ইয়াসিন সিপাহী। বাবা যখন এখানে দারোগা ছিল, তখন ইয়াসিন বাজার করে দিত। ইয়াসিন এখনো মাঝে। মাঝে হাট করে দিয়ে যায়। ইয়াসিন আনুকেও বলত, দারোগা সাহেব। বলত, আনু যখন দারোগা হবে তখন তার ঘে৷ রাখবে ইয়াসিন। আনু দারোগা হবে না। আনু হবে গার্ড সাহেব। পানু ভাই তো ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার। সে হবে গার্ড। রাত দুপুরে ঝক ঝক ঝিক ঝিক করতে করতে তার গাড়ি বানার পাড়া ছাড়িয়ে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা চলে যাবে। বুলুব বাবা মাসে দুমাসে রোজ ঢাকা যান। দোকানের জিনিস কিনে আনেন। পিন, কলের গান, রেডিও, রেকর্ড, কাঁচে বাঁধানো বিলেতের রাস্তা ঘাট সমুদ্রের ছবি। একটা ছবি খুব ভালো, যেটাতে দুটো ছেলে বসে মাছ ধরছে। আনুও মাছ ধরে। আনুর জন্যে বুলুর বাবা গেল মাসে এক সেট বড়শি আর মুগা সুতো এনে দিয়েছেন। আনু কাল যখন মাছ ধরতে যাবে বুলুর বাবাকে অনেকগুলো মাছ দেবে।

বুলুকে সংগে করে আনু পোস্ট অফিসে এলে। মাথার ওপরে বড় বড় করে লেখা পোস্ট ও টেলিগ্রাম অফিস। পানু ভাই যখন মরে গেল তখন টেলিগ্রাম এসেছিল একটা।

পোস্টমাস্টার বললেন, রেলকোম্পানি তোমার বাবাকে টাকা পাঠিয়েছে পানুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে। কে নেবে টাকা? তোমার বাবা তো জেলে। তোমার মাকে নিতে হলে দরখাস্ত করতে হবে সাতদিনের মধ্যে। নইলে টাকা ফেরৎ যাবে।

বেরিয়ে এসে বুলু বলল, কী তুই। বুঝতে পারলি না? তোর ভাই ডিউটিতে মারা গেছে কিনা, তাই টাকা দিচ্ছে।

তবু আনু বুঝতে পারে না। ভাবে রেলের লোকজন খুব লজ্জা পেয়ে গেছে তার ভাই মরে যাওয়াতে, তাই টাকা দিয়ে ভাব করতে চাইছে। দরকার নেই তার টাকার। নেবে না সে টাকা। টাকা দিয়ে কী হবে?

বাবার খুব টাকার দরকার ছিল না। আনু যেন স্পষ্ট শুনতে পায়, একদিন মা রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সব ভাইবোনকে নিয়ে দুধের গল্প করছিলেন। বাবার খুব টাকার দরকার ছিল? চিন্তায় চিন্তায় মাথা ঠিক ছিল না বাবার। বড় আপা, সেজ আপা, ছোট আপা সবগুলোকে বিয়ে দিতে হবে। তাই বাবা ঘুস নিয়েছিল। শুনে মুখ কাচুমাচু করেছিল আপারা। তাদের দেখাদেখি সালু আপা, মিনু আপাও—-ওরা বড় নয় তবু বাবা বলতেন, আনুকে বোর্ডিংয়ে রেখে পড়াবেন। তার দারোগার চাকুরি খালি বদলি আর বদলি। বোধ হয় আনুর বোর্ডিংয়ের। জন্যেও মেলা টাকা দরকার ছিল বাবার। মুখ ছোট করে আনুও মাথা নামিয়ে নিয়েছিল।

বাসার কাছাকাছি এসে গিয়েছিল এরা। দেখা যাচ্ছে বকশীদের বাড়ির মাঠে আনুদের ছাগলের বাচ্চাগুলো খুব লাফাচ্ছে। কোরবানির সময় বিক্রি করবেন বলেছেন। ততদিনে ওরা বড় হয়ে যাবে।

আনু কম্পিত গলায় জিগ্যেস করে, বুলু ভাই?

কিরে?

কত টাকা দেবে পানু ভাইয়ের জন্যে।

কী জানি।

বুলু ভাবতে থাকে। আনুর কাঁধে হাত রেখে আচমকা বলে, টাকা পেলে, এবার তোর সালু আপাকে ভালো জামা কিনে দিস।

আনু মুখ তুলে দেখে, বুলুর মুখটা হঠাৎ খুবই ঝকঝকে দেখাচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিল বুলু। তাড়াতাড়ি বলল, তোর মা সেদিন আমার মাকে বলছিল ও নাকি কিছু চেয়ে নেয় না।

আনমনা হয়ে যায় আনু। কাল বিকেলে ওদের বাসার পেছনে সরু গলিটায় সালু আপাকে দেখেছিল কি যেন বলতে। বুলুকে বলতে। বুলুকে বোধ হয় জামার কথা বলেছে। আনু। বলল, ওর একটা ভালো শাড়ি ছিল। সাইত্রিশ টাকা দাম। বড় আপা সেদিন বেড়াতে যাবে, ওর ভালো শাড়ি নেই দেখে দিয়ে দিল সালু আপা। আর নেয়নি।

দরোজার পাট ধরে দাঁড়িয়েছিলেন বড় আপা। আনু কাছে আসতেই সে জিগ্যেস করল, কিরে?

আনু বলল, টাকা এসেছে।

কার?

পানু ভাইয়ের।

কী ভেবে আনু আবার বলল, আমাদের।

.

পাঁচ হাজার টাকা এসেছিল। বুলুর বাবাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন পোস্টমাস্টারের সংগে দেখা করে। মাস্টার সাহেব নিজে এসে নিজে হাতে টাকা দিয়ে গেলেন আনুর মাকে। সইটা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন, চশমা পরে দেখলেন, চশমা ছাড়া দেখলেন। তারপর বুলুদের বাড়িতে চা খেয়ে ছাতা খুলে মাথায় দিতে দিতে চলে গেলেন।

বুলুর বাবা গলা বড় করে ভেতর বাড়িতে আনুর মাকে বললেন, কাল পোস্টাফিসে একটা পাশ বই করেন। এত টাকা কাছে রাখা ঠিক না। আনু, সকালে দোকানে যাবার সময় আমাকে মনে করিয়ে দিও।

রাতে খেয়ে দেয়ে শুয়ে ছিল আনু। এই ঘরটাতে ও থাকে একা চৌকিতে। বাবার বড় পালংকে থাকে মা মিনু আপা আর সালু আপা। ওপাশের ঘরে বড় আপারা। আসলে ঘর একটাই, মাঝখানে হাত তিনেক পথ রেখে বেড়া দিয়ে পার্টিশন করা। ও ঘরে হারিকেন। এ ঘরটা অন্ধকার। শুয়ে পড়েছে সালু মিনু আপা। ও ঘরে মেজ আপার চুল আঁচড়ানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেজ আপা গুন গুন করছে, বোধ হয় মুখে সর মেখে শোবে। যেদিন রাতে ও মুখে সর মাখে সেদিন অমনি গুন গুন করে। আনু কতদিন মাছ ধরতে যায়নি। মা বকে, বলে, মাঝি পাড়ায় গিয়ে থাক, এ বাড়িতে আসিস কেন? হাত নিসপিস করতে থাকে আনুর। বুলুর বাবার দেওয়া সুতো বড়শি যে–কে–সেই পড়ে আছে। কাল যদি মাছ ধরতে যায় বুলুর বাবাকে অনেকগুলো মাছ দেবে। কাল যদি মাছ ধরতে যায়, আনু তাহলে কটা মাছ পাবে? তিনটে, না পাঁচটা জিয়োল, এক গণ্ডা বাচা, একটা বড় শোল, দুটো বেলে। বড় আপা বেলে মাছ ভালোবাসে। আর সবাই জিয়োল। মা, যেদিন শোল মাছ হয় খুব সুন্দর করে রাধেন। বাচা মাছ দেবে বুলুর বাবাকে। একটা রুই মাছের বাচ্চা যদি পাওয়া যেতো, হাত দেড়েক, ঝাল ঝাল মাখা মাখা করে রান্না হতো, মাছটা দিয়ে একটুখানি ডাল রান্না করত যদি মা। কিন্তু হাফিজ মিয়ার পুকুর ছাড়া রুই পাবে কোথায় আনু? দেখলে আর কথা নেই। জবাই করে ফেলবে আনুকে। আনুর ঘুম পায়। হাফিজ মিয়ার পুকুরে রুই মাছগুলো যেন দেখতে পায়; কাঁচের মতো পানির নিচে ছবির মতো সব মাথা গুঁজে পানির মধ্যে পড়ে আছে। মাথার পরে খুব রোদ উঠেছে কিনা!

লণ্ঠনের আলো সারমুখে টের পায় আনু। দ্যাখে, মা। মা লণ্ঠন তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ঘুমিয়েছিস?

না।

কিন্তু মা লণ্ঠন নামিয়ে নেন। যেন যাবার উদ্যোগ করেন। বলেন, থাক, তাহলে ঘুমো।

আনু কান পেতে শোনে, এখন আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। অনেক রাত হয়েছে নিশ্চয়ই। বড় আপাদের ঘরে বাতিটা নেভানো। আনু উঠে বসে। বলে, কি?

মা খুব দ্বিধা করে আদর নিয়ে বলেন, একটা চিঠি লিখৰি আনু? আয়, আমি পোস্টকার্ড কলম বার করে রেখেছি।

আনু তখন উঠে দাঁড়ায়। যেন পড়ার টেবিলে যাবে লিখতে। তারপরই মনে হয় টেবিল তো এ বাড়িতে আনা হয়নি। ঘুমিয়ে গিয়েছিল আনু, সব ভুলে গিয়েছিল আনু।

কলম টলম নিয়ে এসে মা বসলেন চৌকির এক কোণে। মাঝখানে লণ্ঠন রেখে মনোযোগ দিয়ে ছোটবড় করে আলো ঠিক করলেন মা। পোস্টকার্ডটা তেলতেলে হয়ে গেছে। কলম নিয়ে আনু ওপরে সুন্দর করে লিখল, গড ইজ গুড়। তারপর জিগ্যেস করল, কার কাছে লিখবো মা?

তোর মামার কাছে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল আনু পোস্টকার্ডের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু মা কিছুই বললেন না। যখন চোখ তুলে তাকাল দেখল মা খুব ভাবছেন। মা তাকে মাথা তুলতে দেখে একটু থতমত খেলেন যেন। তারপর পরামর্শ করার গলায় বললেন, টাকা যখন পাওয়াই গেল আনু এবার। তোর বড় আপাকে বিয়ে দিতে হয়। কত বড় হয়ে গেল। লোকে কত কী বলে, আরো বলবে এখন। তার মামাকে ডেকে আনি, কি বলিস? তুই বড় হলে আমার দুঃখ ছিল না।

মার চোখ যেন পানিতে চিকচিক করতে থাকে। আনু দেখতে চায় না। আনু চোখ নামায় আবার। মা বলেন, লেখ, পাকজোনাবেষু, আমার শত কোটি ভক্তিপূর্ণ সালাম জানিবেন ও ভাবীজানকে দিবেন।

.

সোমবারে রংপুরে গেল আনু বাবাকে দেখতে। বুলুর বাবার কাজ ছিল রংপুরে! তার সংগে গেল আনু। মা পিঠে বানিয়ে দিয়েছেন বাবার জন্যে। ছোট্ট টিফিনকারিতে ভরে সারাক্ষণ কোলে কোলে রেখে সকাল দশটার গাড়িতে চেপে বেলা দেড়টায় রংপুরে পৌঁছলো আনু। এর আগে আরো কয়েকবার এসেছিল। মাও এসছিলেন তিনবার। বড় আপা, সেজ আপা, মেজ আপাও তিনবার। সালু আপা দুবার। মিনু আপা প্রায় প্রত্যেকবার যতবার আনু এসেছে। মিনু আপা আজ আসেনি, ওর পরীক্ষা। আনু রোজ মাসে দুবার। আনু যখন জেলগেটে এলো তখন চারটেও বাজেনি। পথে খুব শস্তা বাঁধাকপি দেখে কিনেছিল একটা। মা দেখলে খুশি হবেন। মার মুখটা মনে করে ভালো লাগলো আনুর।

কত লোক এসেছে দেখা করতে। দুটো বউ এসেছে গরুর গাড়ি করে। তাদের সংগের লোকটা উবু হয়ে বসে আর তিনজনের সংগে পরামর্শ করছে। এককোণে চার পয়সার। কবিতা সুর করে করে পড়ছে আর বিক্রি করছে দুজন চোঙা লাগিয়ে। একজন পড়ছে, একজন থেমে যাচ্ছে, আবার সে পড়ছে, আগের জন দম নিচ্ছে। আর এক হাতে কপি, আরেক হাতে টিফিনকারি। মেলা লোক ভিড় করে পাঠ শুনছে। হাতখালি থাকলে আনুও গিয়ে শুনতো। চারটে বাজতে এখনো অনেক দেরি।

তারপর লাইনে গিয়ে দাঁড়াল আনু। এগুলো সব তার এখন মুখস্থ হয়ে গেছে। অফিসের এককোণে ছোটবাবুর টেবিলের কোণায় জিম্মা রাখলো কপিটা। টিফিনকারিটা দেখে দিল ওরা। ডাক পড়ল আনুর।

রোজকার মতো, বাবা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন আনুকে। আনুর এটা অভ্যেস হয়ে গেছে। আনু বলল, পানু ভাইয়ের পাঁচ হাজার টাকা এসেছে। শুনে চমক ভাঙলো বাবার। বললেন, টাকা কোথায় রেখেছে তোর মা?

পোস্টাফিসে। মা বললেন, বড় আপার বিয়ে দেবে।

কোথায়?

জানি না। আমাকে বলেনি।

বাবা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। চারিদিকে খুব হৈচৈ হচ্ছে। সবাই দেখা করছে। নিঃশ্বাসটা তাই শুনতে পেল না আনু।

পানুটা থাকলেও ভাবনা ছিল না। তুই নিজে পছন্দ করিস আনু। তোর পছন্দ না হলে না করে দিস।

আনুর কেমন লজ্জা করতে থাকে। আবার খুশিও লাগে। বলে, আমার কথা মা শুনবে?

শুনবে। আমি চিঠি লিখে দেব। আর শোন, তোর মামাকে ডাকিস না।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে আনু। বাবা বলে চলেন, তোর মামা তোক ভালো না। নিজের ভালো দেখবে, তোদের কিছু হোক না হোক তাকাবেও না। পানুর টাকার কথা ওকে জানিয়ে কাজ নেই। তোর মায়ের সৎ–ভাই হাজার হলেও।

কিন্তু সেদিনই রাতে আনু মামার কাছে টাকার কথা লিখেছে মার জবানিতে। বাবাকে বলতে সাহস হয় না। পায়ের নখ দিয়ে মেঝে খুঁড়তে থাকে। বাবা তখন তার মাথায় হাত রেখে চুলের জট ছাড়াতে থাকেন। জিগ্যেস করেন, রংপুর এসে কিছু খাসনি?

আনু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।

কী খেয়েছিস?

আনু জবাব দিতে পারে না। বাবা আরো হাত বুলোতে থাকেন। খামকা আনু বলে, মিনু আপার পরীক্ষা। একটুও পড়ে না।

আচ্ছা আমি লিখে দেব। পড়বে না কেন? না পড়লে কেউ বড় হতে পারে? অনেক পড়বে, পড়তে পড়তে স্কুল পাশ করবে, কলেজে যাবে, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি তারপর বিলেত। বিলেত থেকে ফিরে এসে রিসার্চ করবে, ডক্টরেট নেবে। লোকে কত ভালো বলবে। সালাম দেবে। বিদ্বানের কত সম্মান, কত প্রতিপত্তি। রাজা পর্যন্ত বিদ্বানের কাছে মাথা নত করে।

বলতে বলতে বাবার মুখচোখ দিয়ে আলো ঝরতে থাকে। যেন সুদূর দেখছেন তিনি। আনুর মাথায় হাতটাও কখন থেমে যায়। আনু টের পায়, বাবার গলা ধরে এসেছে। তার নিজেরও কেমন ছমছম করতে থাকে বুকের ভেতর। ঠিক তখন ঘণ্টা পড়ে। ঢং ঢং করে বুড়ো সেপাই ঘণ্টা বাজায়। বটগাছটা থেকে কাকগুলো হঠাৎ উড়ে গিয়ে আবার একে একে বসতে থাকে। আনু বেরিয়ে আসে। এসে বঁধাকপিটা নেয়। খালি টিফিনকারি পায়ের সঙ্গে লেগে লেগে ঢ ঢন করতে থাকে। নবাবগঞ্জে এসে গ্রামোফন–ডিলার দাশ–কোম্পানির বেঞ্চিতে জিরোয় আনু। সন্ধ্যের সময় বুলুর বাবা এখান থেকে এসে তাকে নিয়ে যাবেন। বসে বসে গান শুনতে থাকে আনু। সেজ আপা গান শিখলে গলাটা এমনি মিষ্টি হতো। লোকে কত রেকর্ড কিনে নিয়ে যেত সেজ আপার। দাশ কোম্পানির আলমিরার মাথায় বাঁধানো থাকত সেজ আপার ছবি সবার সঙ্গে।

.

আজ মাছ ধরতে যাবে আনু। দুপুরে সকাল সকাল খেয়ে চুপ করে বেরিয়ে পড়ল। হাফিজ মিয়ার পুকুরে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু যাওয়া যাবে না। হাফিজ মিয়া নিজেই কাল থেকে ছিপ ফেলছেন। পকেটে তবু মেথি দিয়ে তৈরি বড় মাছের টোপ বানানো আছে। কাল রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে মেজ আপা আর সে বানিয়েছে। মেজ আপার খুব সখ এদিকে। বাবার সাইকেলটা নিয়ে উঠোনেই সে পাক খায়। চড়তে শিখেছিল কমলগঞ্জে থাকতে। মা বলেন, গেছো মেয়ে। আনুর খুব ভালো লাগে; বুলুর বাবার দোকানে একটা ছবি ঝোলানো আছে, অনেক কটা মেমসাহেব সাইকেল চালিয়ে একসংগে সবাই ডানহাত তুলে হাসতে হাসতে যাচ্ছে।

পথে পিয়ন একটা চিঠি দিল আনুকে। পথে এরকম দেখা গেলে সে আর বাসায় যাবার কষ্ট করে না। বেঁচে যায় যেন, খুব খুশি হয়। আনু ছিপটা মাটিতে ঠেকিয়ে পোস্ট কার্ডটা তক্ষুণি পড়তে শুরু করে। পড়ে দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে মাথায়। কিন্তু সেটা টের পায় না আজ। ছিপ তুলে খুব তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসে।

এসে দেখে মা জলচৌকিতে শুয়ে আছেন। তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে তোলে আনু। বলে, মামা চিঠি লিখেছে মা।

ধড়মড় করে মা উঠে বসেন। বলেন, কই? কখন?

মা পড়তে বলার আগেই আনু পড়তে শুরু করে দেয় দোয়া বহুত বহুত পর সমাচার এই যে, আয়ুস্মান আনুর হস্তাক্ষরে একখানি পত্র পাইয়া তোমার যাবৎ বিষয় অবগত হইলাম। রেল কোম্পানি নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিয়াছে ইহা একরূপ ঠকাইয়াছে বলিয়া আমার ধারণা। পানুর এন্তেকালে এ সংসারের যাহা ক্ষতি হইল তাহা লক্ষ টাকাতেও শোধ হইবার নহে। যাহা হউক, আল্লাহর নিকট শোকর গোজারি করিলাম যে, অন্তত কিঞ্চিত কিনারা হইয়াছে। তোমার প্রথমা কন্যার বিবাহের জন্য ভাবনা করিও না। আমি নিজ দায়িত্ব তাহা সম্পন্ন করিব। অত্র মহাকুমা সদরে একজন বি,এ, ফেল শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত বংশীয় পাত্রের সন্ধান। আছে। আমি দুই চারি দিনের মধ্যেই তাহাকে ও তাঁহার দুই একজন খাস্ দোস্ত সমভিব্যহারে তোমার বাটিতে পহুছিব। পছন্দ হইলে শুভকার্য এই যাত্রাতেই সম্পন্ন করা যাইবে। আর বিশেষ কি লিখিব? এদিকে আরেক সুযোগ হাত ছাড়া হইতেছে। বিলাতের মাতা তাহার নিষ্কর জমির তিন বিঘা মাত্র দুইশত পঁচিশ টাকা প্রতি বিঘা দরে বিক্রয় করিতে ইচ্ছুক। আমার হাত বর্তমানে কপর্দক শুন্য। যদি সাত শত টাকা ঋণ দিতে পারো তো প্রথম বর্ষের শস্য হইতেই শোধ করিতে পারিতাম। আমি তাহাকে বহু বুঝাইয়া রাখিলাম। তুমি অর্থের জোগাড় রাখিও। শ্ৰেণীমত আমার দোয়া পৌঁছাইয়া দিও।

চিঠি পড়া শেষ হতেই মা বলেন, তাহলে তো বাড়িঘর দোর ঠিক করতে হয় আনু।

আনু সেদিকে কান না দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, টাকা দেবে নাকি তুমি মামাকে?

মা অবাক হয়ে তাকান। আনু আবার বলল, বলো, তুমি দেবে নাকি?

তুই চেঁচাচ্ছিস কেন আনু?

হাত ধরে তাকে চৌকিতে বসাতে চেষ্টা করেন মা। কিন্তু আনু শক্ত করে চিঠিটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, তুমি টাকা দিতে পারবে না।

তার গলার স্বর শুনে আপারা এসে ঘিরে দাঁড়ায়। বড় আপা জিগ্যেস করে, কার চিঠিরে আনু?

সবার দিকে তাকিয়ে মার চেহারাটা যেন হঠাৎ বদলে যায়। দেখতে পায় আনু, যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আনু যেন ছোট হয়ে যায়। মনে হয়, ভীষণ একটা অন্যায় করে ফেলেছে সে। মা বলেন, এত যে চেঁচাস একা মামা ছাড়া তোদের আছে কে? বাপ তো জেলে, তাকে এসব দেখতেও হয় না, শুনতেও হয় না। গুষ্টি মরলে দুনিয়ায় শান্তি হতো।

চোরের মতো বেরিয়ে আসে আনু, ছিপটা লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। ছিপটা বাইরের ছোট্ট ঘরে আড় হয়ে পড়ে ছিল। পথে এসে প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই টোপের কৌটা ঠেকল। সেটা খুলে সব ফেলে দিল কচুবনের মধ্যে। বুলুদের বাসায় কলের গান বাজছে। সবাই যদি এক সংগে আজ মরে যেতে পারত তো মা টের পেতেন মজা। বড় আপার ওপর খুব রাগ হলো তার মাকে কিছু বলল না দেখে। অন্য দিন বকলে খুব এসে পেছনে ডাকে, আড়ালে। নিয়ে যায়। আজ সে চলে এলো, কেউ চোখ তুলে দেখলও না। বুক পকেটে পোস্টকার্ডখানা উঁকি দিচ্ছে। ভাজ করে রাখল আনু। তারপর ইস্টিশনে গিয়ে বসলো। বেলা চারটের গাড়ি এসেছে, ইঞ্জিন ব্যাক করছে, পানি নেবে একটু পরে। উলিপুর চিলমারীর বাস এসে পৌঁছুলো। লোকগুলো দৌড়ে দৌড়ে সব টিকেট ঘরের কাছে যাচ্ছে। বুলবুল চানাচুর বিক্রি করছে, বস্তা একআনা, লালমণিরহাট থেকে ভেজে আনে। ভারী চমৎকার। আনু একটা কিনল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress