অচিনপুরের গল্প
অচিনপুরের গল্প লিখতে গভীর বিষাদে মন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। অনুভব করছি, সুখ এবং দুঃখ আসলে একই জিনিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুখ বদলে গিয়ে দুঃখ হয়ে যায়। দুঃখ হয় সুখ। জীবনের প্রবল দুঃখ ও বেদনার ঘটনাগুলি মনে পড়লে আজ আমার ভাল লাগে। প্রাচীন সুখের স্মৃতিতে বুক বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়।
হাসনার কোলে তিন মাস বয়সের যে শিশুটি এ সংসারে প্রবেশ করেছিল তার ভূমিকা তো যুক্তিসঙ্গত কারণেই তৃতীয় পুরুষের ভূমিকা হবে। তার উপস্থিতি হবে ছায়ার মত। সরফরাজ খানের এই পরিবারটির সুখ-দুঃখ তাকে স্পর্শ করবে না। কিন্তু আমি তাদের জীবনের সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠভাবেই না জড়িয়ে পড়লাম। বাদশা মামার মলিন চেহারা দেখলে আমার মন কাঁদে। সফুরা খালা যখন হেসে হেসে বলেন,
রঞ্জু, আমার খুব ইচ্ছে একদিন অনেক রাত্রে পুকুরে একা একা সাতার কেটে গোসল করি। পুকুর-ঘাটে তুমি আমার জন্যে একটুখানি দাঁড়াবে রঞ্জু? কেউ যেন জানতে না পারে।
তখন সফুরা খালার জন্যে আমার গাঢ় মমতা বোধ হয়। অথচ আমি নিশ্চিত জানি একদিন লিলির চিঠি আসবে। আমি এদের সবাইকে পেছনে ফেলে চলে যাব।
হালিম শেখের সঙ্গে পর পর দুটি মামলাতে নানাজানের হার হল। এতদিন যে জমিতে নানাজানের দখলিস্বত্ব ছিল, হালিম শেখের লোকজন লাল নিশান উঠিয়ে ঢোল আর কাসার ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে সে জমির দখল নিল। গ্রামের লোকজনকে গরু জবাই করে খাওয়াল হালিম শেখ।
জমির পরিমাণ তেমন কিছু নয়। অর্থব্যয়ও হয়েছে সামান্য। নানাজানের মত লোকের কাছে সে টাকা কিছুই নয়। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়লেন। রোজকার মত উঠোনে বসে কোরান পাঠ করতে বসেন না। নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের ভেতর স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। খাওয়া কমে গেল। রাতে ঘুমুতে পারেন না। উঠোনে অনেক রাত পর্যন্ত চেয়ার পেতে বসে থাকেন। নানীজান মাথায় হাওয়া করেন। পায়ে তেল মালিশ করে দেন।
দিন সাতেক পর নানাজান ঘোষণা করলেন, তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না। সম্পত্তির বিলি বন্দোবস্ত করতে চান। নবুমামার কাছে চিঠি গেল তিনি যেন পত্রপাঠ চলে আসেন, পড়াশুনার আর প্রয়োজন নাই। লোক পাঠিয়ে দামি কাফনের কাপড় কেনালেন। কবরের জন্য জায়গা ঠিক করা হল। কবর পাকা করবার জন্য ইট আনানো হল। মৌলানা ডাকিয়ে তওবা করলেন। বাড়ির সবাই এই নিঃশব্দ মৃত্যুর প্রস্তুতি দেখতে লাগল। ঠিক এই সময় বুড়ো নানীজান মারা গেলেন।
মোহরের মা রোজ সকালে দুধ নিয়ে যায় নানিজানের ঘরে। সেদিন কি কারণে যে দেরি হয়েছে। দুপুরের দিকে বাটিভর্তি দুধ নিয়ে গিয়েছেন। ঘরে ঢুকেই বিকট চিৎকার। মৃত্যু এসেছে নিঃশব্দে। কেউ জানতেও পারেনি কখন কিভাবে মারা গেলেন।
আমরা সবাই তার ঘরের সামনে ভিড় করে দাঁড়ালাম। পরিপাটি বিছানা পাতা। বালিশের চাদর পর্যন্ত একটুও কুচকায়নি। বড়ো নানীজান সেই পরিপাটি বিছানায় শক্ত হয়ে পড়ে আছেন। ইদুর কিংবা অন্য কোন কিছু তার ঠোঁট আর একটি চোখ খেয়ে গিয়েছে। বিকট হা করা সেই মৃত্যু দেখে সুফুরা খালা ও মাগো, ও মাগো বলে কাঁদতে লাগলেন। লালমামি সফুরা খালার হাত ধরে তাকে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেলেন।
নানাজানের জন্য কেনা। কাফনের কাপড়ে তার কাফন হল। নানাজানের জন্যে ঠিক করে রাখা জায়গায় কবর হল তার। যে ইট নানাজান নিজের জন্যে আনিয়েছিলেন, সেই ইট দিয়ে কবব বাধিয়ে দেওয়া হল।
সপ্তাহ খানিকের মধ্যে আমরা সবাই বড় নানীজনের কথা ভুলে গেলাম। আগের মত ঝগড়া, রঙ-তামাশা চলতে লাগল। বড় নানীজনের ঘর থেকে তার সমস্ত জিনিস সরিয়ে ফেলে সংসারের প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ রসুন রাখা হল গাদা করে।
দিন কেটে যেতে লাগল। একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবন। সেই একা একা হাঁটতে হাঁটতে সোনাখালী চলে যাওয়া। পুকুরঘাটে রাতের বেলা চুপচাপ বসে থাকা। এর বাইরে যেন আমার জন্যে কোনো জগৎ নেই। সমস্ত বাসনা-কামনা এইটুকুতেই কেন্দ্রীভূত। এর মধ্যে একদিন নানাজান আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেছেন। বলেছেন,
তোমার বড় নানীজান তার নিজের সম্পত্তি তোমাকে আর লিলিকে দিয়ে গিয়েছেন দানপত্র করে।
বড় নানীজান তার বাবার কাছ থেকে প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছিলেন জানতাম, তার পরিমাণ যে কত তা কেউ জানত না। নানাজান বললেন, অনেক জায়গা-জমি, লিলির আসা দরকার। কিন্তু তার ঠিকানা তো জানা নেই।