নবুমামা চলে যাবার পর
নবুমামা চলে যাবার পর আমার কিছু করবার রইল না। আম-কঁঠালের ছুটি হয়ে গেছে স্কুল। সারাদিন বাড়িতে ঘুরে বেড়াই। বিকেল বেলাটা আর কিছুতেই কাটে না। রোদের তাপ একটু কমতেই হাঁটতে হাটতে চলে যাই সোনাখালী। হেঁটে যেতে যেতে কত আজগুবি চিন্তা মনে আসে। যেন কোন অপরাধ ছাড়াই দেশের রাজা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। হুকুম হয়েছে, আমার ফাঁসি হবে। রাজ্যের সমস্ত লোক ফাঁসির মঞ্চের চারদিকে জড় হয়েছে। আমি তাকিয়ে দেখি, এদের মধ্যে লাল রঙের পোশাক পরা একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, না, এ ছেলে কোনো দোষ করেনি, এর ফাঁসি হবে না। বলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলেছে। আমি বলছি, না, হোক, আমার ফাঁসি হোক। মেয়েটি অপলকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার মুখের গড়ন অনেকটা লালমামির মত।
সোনাখালী পাকাপুলে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতাম। সেই সময় আমার মন থেকে ভূতের ভয় কেটে গিয়েছিল। একেক দিন নিশীথ রাতে একা এক ফিরেছি। অন্ধকারে একা ফিরতে ফিরতে কতবার চমকে উঠেছি নাম-না-জানা পাখির ডাকে। কিন্তু ভয় পাইনি কখনো। রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালেই মোহরের মা ভাত বেড়ে দেয়, নাও, খেয়ে গুণ্ঠী উদ্ধার কর। এইসব কথা কখনো গায়ে মাখি না।
আমি সে সময় অনেক বড়ো দুঃখে৷ ডুবে ছিলাম। ছোটখাটো কষ্টের ব্যাপার, যা প্রতিদিন ঘটত, এই নিয়ে সেই কারণেই কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
দিন আর কাটতে চায় না কিছুতেই। স্নেহ, ভালবাসা ছাড়া কোনো মানুষই বাঁচতে পারে না। আমি সেই কারণেই হয়ত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে সময় কাটাই। কেন জানি না, অসুখটাই ভাল লাগে। সকাল থেকে সন্ধা শুয়ে শুয়ে ঘুমানো ছাড়া অন্য কাজ নেই। মাঝে-মধ্যে বাদশামামা এসে বসেন। নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তা হয়। মামা হয়ত বললেন,
বেশি করে দুধ খা, শরীরে জোর হবে।
আচ্ছা মামা, খাব।
পীরপুরে জন্মাষ্টমির মেলা, যাবি নাকি দেখতে?
অসুখ সারলে যাব।
মামা থাকেন অল্পক্ষণ। কথা বলেন ছাড়া-ছাড়া ভঙ্গিতে। দেখে-শুনে বড় অবাক লাগে। তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। গাল বসে গিয়ে কেমন প্রৌঢ় মানুষের মত দেখায়।
লালমামি বড়-একটা আসেন না। হয়ত দরজার বাইরে থেকে বললেন,
রঞ্জর জ্বর আবার এসেছে নাকি?
না মামি, জ্বর নেই।
না থাকলেই ভাল। এই বলে তিনি ব্যস্তভাবে চলে যান। তাঁর যাওয়ার পথে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকি। সে সময়ে লালমামিকে আমি একইসঙ্গে ভালবাসি আর ঘৃণাও করি। কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি এ ধরনের দ্বৈত অনুভূতি–সে-ই আমার প্রথম। পরবর্তী সময়ে অবশ্যি আরো অনেকের জন্যেই এমন হয়েছে।
ঠিক এ সময়ে আমার সফুরা খালার সঙ্গে অল্পমাত্রায় ঘনিষ্ঠতা হল। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হবে এ আমার খুব ছোটবেলাকার বাসনা। তিনি আমার চেয়ে বছরখানেকের বড়ো হবেন। খুব চুপচাপ ধরনের মানুষ। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, তিনি একা-একা হেঁটে বেড়াচ্ছেন বারান্দায়। হাতে একটা লাঠি। মাঝে মাঝে ঠক ঠক করে শব্দ করছে আর মুখে বলছেন, উড়ে গেল পাখি। প্রথমদিন এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি! তিনি আমাকে দেখতে পাননি, কাজেই তিনি লাঠি হাতে ঠক ঠক করতে লাগলেন আর পাখি ওড়াতে লাগলেন। আমি যখন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
খালা, কী করেন?
লজ্জায় খালার চোখে পানি এসে গেল। কোনো রকমে বললেন,
কিছু না, আমি খেলি। তারপরও খালাকে এমন অদ্ভুত খেলা খেলতে দেখেছি। লজ্জা পাবেন এই জন্যে আমি তার সামনে পড়িনি। তাঁর সঙ্গে ভাব করবার আমার খুব ইচ্ছে হত। কিন্তু তিনি আমাকে দেখলেই ভারি লজ্জা পেতেন।
অসুখের সময় প্রায়ই সফুরা খালা এসে দাঁড়াতেন আমার দরজায়। আমি ডাকতাম,
খালা, ভেতরে আসেন।
না, আমি এখানেই থাকি।
এই বলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন দরজায়। অনেক রকম কথা হত তার সাথে। কী ধরনের কথা তা আজ আর মনে নেই, মনে আছে, খালা সারাক্ষণই মুখ টিপে টিপে হাসতেন।
খালা মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব গল্প করতেন।
একদিন এসে বললেন, কাল রাতে ভারি আশ্চর্য একটি ব্যাপার হয়েছে রঞ্জু। ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই দেখি একটি ফুটফুটে পরী আমার খাটে বসে আছে। আমি তো অবাক! তারপর পরীটি অনেক গল্প করল আমার সঙ্গে। ভোর হয়ে আসছে। যখন তখন সে বলল, আমি যাই। আমি বললাম, ও ভাই পরী, তোমার পাখায় একটু হাত দেব? সে বলল, দাও না। আমি পরীর পাখায় হাত বুলিয়ে দেখলাম, কী তুলতুলে পাখা। আর সেই থেকে আমার হাতে মিষ্টি গন্ধ। দেখি না শুঁকে।
আমি সফুরা খালার হাত শুকতেই বকুল ফুলের গন্ধ পেলাম। খালা হয়ত অনেকক্ষণ বকুল ফুলের মালা হাতে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তারই গন্ধ। সফুরা খালা সত্যি ভারি অদ্ভুত মেয়ে ছিল। এক রাতে ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। আমি লিলিকে স্বপ্নে দেখলাম। সে ঠিক আগেকার মত অভিভাবকসুলভ ভঙ্গি করে বলছে, রঞ্জু, তোর একটুও যত্ন হচ্ছে না। এখানে। তুই আমার কাছে চলে আয়।
আমি লিলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কত দিন হয়েছে সে চলে গেছে। এ দীর্ঘদিনেও তার কথা কেন যে মনে পড়ল না! স্বপ্ন ভেঙে আমার খুব অবাক লাগল। লিলি যে দেখতে কেমন ছিল তাও পৰ্যন্ত আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, তার চিবুকটা লম্বাটে ধরনের ছিল। সেখানে একটা লাল রঙ্গের তিল ছিল। লিলি ছোটবেলায় আমাকে এই তিল দেখিয়ে বলত, রঞ্জু, এই তিলটিা যদি কপালে থাকত, তাহলে আমি রাজরানী হতাম।
দীর্ঘদিন পর লিলিকে স্বপ্নে নিখুঁতভাবে দেখলাম। এবং সে রাতেই ঠিক করলাম, ঘুম ভাঙতেই নানাজানের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে লিলিকে চিঠি দেব। এই মনে করে আমার খুব ভাল লাগতে লাগল। মনে হল শরীর সেরে গেছে, একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাই।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই জোছনা দেখে চোখ ছলছলিয়ে উঠল। এমন উথাল-পাথাল আলো দেখলে মানুষের মনে এত দুঃখ আসে। কেন কে জানে?
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। পা যখন ধরে এলো তখন দেয়াল ঘেঁষে বসে রইলাম। হঠাৎ শুনি পাশের ঘরে লালমামি কাঁদছেন।
কোনো ভুল নেই, স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মামাও যেন নিচু গলায় কি একটা বললেন। মামি কান্না থামিয়ে ধমকে উঠলেন, কোনো কথা শুনব না। আমি।
বাইরের এই অপূর্ব জোছনার সঙ্গে এই ঘটনা কেমন যেন মিশ খায় না। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।’