ভাদ্রমাসের প্রথমদিকে
ভাদ্রমাসের প্রথমদিকে নবুমামা অসুখে পড়লেন, কালান্তক ম্যালেরিয়া। হাত-পা শুকিয়ে কাঠি, পেট ফুলে ঢোল। উঠোনে ছেলেমেয়ের হুল্লোড় করে বেড়ায়, নবুমামা চাদর গায়ে দিয়ে জলচৌকিতে বসে বসে দেখে। ম্যালেরিয়ার তখন খুব ভাল ওষুধ বেরিয়েছে। গাঢ় হলুদ রঙের কুইনাইন ট্যাবলেট। সেকালের এক পয়সার মত বড়ো, আস্ত গেলা যায় না। গলায় আটকে থাকে। সপ্তাহে একদিন খাবার নিয়ম, ম্যালেরিয়া হোক আর না-হোক। ওষুধ খেলেই কান ভো ভো করত, মাথা হাল্কা হয়ে যেত।
কুইনাইন খেয়ে খেয়ে এসময় নবুমামার জ্বর সারল। শরীর খুব দুর্বল। নিজে নিজে দাঁড়াতে পারে না। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করে, এটা খাবে, ওটা খাবে। খিটখিটে মেজাজ। যদি কোনো কারণে লালমামি আমার দিকে তাকিয়ে হোসেছেন, অমনি তার রাগ হয়ে গেছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে হাস। শুনে লালমামি নিষ্ঠুরের মত বলে বসেন, তোর দিকে তাকিয়ে হাসব কি রে, তুই তো চামচিকা হয়ে গেছিস।
নবুমামার আকাশ-ফাটানো কান্না থামাবার জন্যে লালমামিকে অনেকক্ষণ নবুমামার দিকে তাকিয়ে হাসতে হয়। স্বাস্থ্যের জন্যে নুবুমামার স্কুলে যাওয়াও বন্ধু। রোগা শরীর পেয়ে বিভিন্ন রোগ ইচ্ছে মত ছেঁকে ধরেছে, আজ সর্দি তো কাল জ্বর, পরশু পেট নেমেছে।
কানাবিবির দেওয়া তাবিজের ঝোলা গলায় দিয়ে নমুমামা বেচারার মতো ঘুরে বেড়ায়। রাতের বেলা বড়ো জ্বালাতন করে। কিছুক্ষণ পর পর পানি খেতে চায়। পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার তার পেচ্ছাবের বেগ হয়। পেচ্ছাব করানোও কী কম হাঙ্গামা? হ্যাঁরিকেন জ্বালাতে হয়, নবুমামা হাতে নেন একটা টর্চ। আমাকে গিয়ে ডেকে তুলতে হয় নানীজানকে। নানীজান আর আমি বসে থাকি বারান্দায়। নমু মামা টর্চ ফেলে ভয়ে ভয়ে যান। তাতেও রক্ষা নেই, ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠেছেন, ওটা কী, ঐ যে গেল?
কিছু না, শেয়াল।
শেয়াল? তবে ছায়া পড়ল না কেন?
অন্ধকারে ছায়া পড়বে কি রে হাঁদা? নানীজান বিরক্ত হয়ে বলেন।
এই হল নিত্যকার রুটিন।
খাওয়া নিয়েও কী কম হাঙ্গামা! আজি ইচ্ছে হয়েছে কইমাছ ভাজা খাবেন। কইমাছ জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ। সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
শেষ পর্যন্ত পীর-ফকির ধরা হল। ধর্মনগরের সুফি সাহেবের পানিপড়া আনবার জন্যে আমি আর বাদশা মামা নৌকা করে ধর্মনগর রওনা হলাম। দু’দিনের পথ। উজান ঠেলে যেতে হয়। সঙ্গে চাল ডাল নিয়ে নিয়েছি। নৌকাতেই খাওয়া-দাওয়া। বাদশা মামা এই দীর্ঘ সময় চুপচাপ কাটালেন। সন্ধ্যার পর নৌকার ছাদে উঠে বসেন। নেমে আসেন। অনেক রাতে। সারাদিন শুয়ে শুয়ে ঘুমান। দেখলেই বোঝা যায়। ভরসা হারানো মানুষ। কিন্তু কী জন্যে ভরসা হারিয়েছেন তা বুঝতে না পেরে আমার খারাপ লাগে।
সপ্তম দিনে ফিরলাম। সুফি সাহেব খুব খাতির-যত্ন করলেন আমাদের। তাঁর অনুরোধে বাড়িতে চারদিন থেকে যেতে হল। কথা নেই বার্তা নেই, বাদশা মামা সুফি সাহেবের মুরিদ হয়ে গেলেন। মাথায় সব সময় টুপি, নিয়ম করে নামাজ পড়ছেন। যতই দেখি ততই অবাক হই।
আমার অবাক হওয়ার আরো কিছু বাকি ছিল। বাড়িতে ফিরে জানলাম, নকুমামা খুলনা জেলার মনোহরদীপুরে চলে যাচ্ছেন। কিছুদিন সেখানে থাকবেন। খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা, শরীর ফিরলে চলে যাবেন রাজশাহী। নানাজানের খালাতো ভাই থাকেন সেখানে। সরকারি জরিপ বিভাগের কানুনগো। নবুমামা সেখানে থেকেই পড়াশুনা করবেন। নানাজান নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে তারই আয়োজন চলছে। নবুমামা আগের চেয়েও মিইয়ে গিয়েছেন। আমাকে ধরা গলায় বললেন, লাল ভাবীকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
আমি ভেবেই পেলাম না একা একা আমি কী কবে থাকব। নব্বুমামা আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া একা একা স্কুলে যাচ্ছি। এই দৃশ্য কল্পনা করলেও চোখে পানি এসে যায়। নবুমামার আমার জন্যে কোনো মাথাব্যথা নেই, তার মুখে শুধুই লাল ভাবীর কথা। আমি বললাম,
নবুমামা, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান।
আমি কী করে নিয়ে যাব? তুই বাবাকে বল।
নানাজানকে বলবার সাহস আমার নেই। আমি লালমামিকে ধরলাম। মামি তখন বারান্দায় বসে সুচ-সুতো নিয়ে কী যেন করছিলেন। আমি কাঁদো-কাঁদো হয়ে সমস্ত খুলে বললাম। চুপ করে তিনি সমস্ত শুনলেন। আমার কথা শেষ হতেই বললেন, যা তো, দৌড়ে তোর ছোট খালার কাছ থেকে একটা সোনামুখী সুচ নিয়ে আয়। বলবি আমি চাইছি।
সুচ এনে দিয়ে আমার কাতর অনুরোধ জানালাম।
বলবেন তো মামি? আজই বলতে হবে। আজি সন্ধ্যা বেলাতেই।
মামি বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ঘ্যান ঘ্যান করিস, পরের বাড়িতে আছিস যে কুঁশ নেই? ইচ্ছে হয় নিজে গিয়ে বল।
এর কিছুদিন পরই পানশী নৌকা করে নানাজান আর নবুমামা চলে গেলেন। যাবার সময় নবুমামার সে কী কান্না! কিছুতেই যাবে না। লালমামির শাড়ি চেপে ধরেছে। তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, আমি যাব না, যাব না।
লালমামি শুকনো গলায় বললেন, শাড়ি ছাড়, শাড়ি ধরে চেঁচাচ্ছিস কেন?