Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 2

অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার || Shirshendu Mukhopadhyay

জ্যোতিষী হিসেবে জটেশ্বর ঘোষাল

জ্যোতিষী হিসেবে জটেশ্বর ঘোষালের খুবই নামডাক। গণনা করে যা বলেনটলেন একেবারে অব্যর্থ। ফলবেই কি ফলবে। তবে তার মধ্যেও একটু কথা আছে। ফলে বটে, তবে উলটো রকমে। এই যেমন পরীক্ষায় ফল বেরোবার আগে কাঁচুমাচু মুখে পালবাড়ির ছোট ছেলে ফটিক এসে বলল, “জ্যাঠামশাই, হাতটা একটু দেখে দেবেন? রেজাল্টের জন্য বড় ভয় হচ্ছে।”

জটেশ্বর গম্ভীর মুখে খুব ভাল করে ফটিকের হাত দেখলেন, অনেক হিসেবনিকেশ করলেন, তারপর ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “না রে, এবারটায় হবে না।”

শুনে ফটিক লাফিয়ে উঠে দু’ পাক তুর্কি নাচ নেচে, “মেরে দিয়েছি! মেরে দিয়েছি!” বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে বেরিয়ে গেল। এবং রেজাল্ট বেরোবার পর বাস্তবিকই দেখা গেল, ফটিক বেশ ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে।

নবারুণ ক্লাবের ফুটবল ক্যাপ্টেন গত দু’বছর ধরে আন্তঃজেলা ফুটবলের শিল্ড জিততে না পারায় একদিন জটেশ্বরের কাছে এল। বলল, “কাকামশাই, এবারও কি শিন্ডটা আমাদের ভাগ্যে নেই?”

জটেশ্বর ফের গণনায় বসলেন। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে ক্লাবের জন্মমুহূর্ত থেকে একটা ঠিকুজিও করে ফেললেন। এবং বললেন, “উঁহু, শিল্ড এবারও তোদের কপালে নেই!”

সেই খবর শুনে ক্লাবে সে কী উল্লাস! হিপহিপ হুররে, জিন্দাবাদ

ইত্যাদি ধ্বনির সঙ্গে রসগোল্লা বিতরণও হয়ে গেল। শেষ অবধি নবারুণ ক্লাব শিল্ডও জিতেছিল।

গণেশবাবুর সেবার যায়-যায় অবস্থা। ডাক্তার ভরসা দিচ্ছে না। উইলটুইল করে ফেলেছেন। একদিন জটেশ্বরকে ডাকিয়ে এনে বললেন, “বাপু জটেশ্বর, কোষ্ঠীটা একটু ভাল করে দ্যাখো তো! মৃত্যুযোগটা কি এগিয়ে এল?”

জটেশ্বর কোষ্ঠী নিয়ে বসে গেলেন। বিস্তর ক্যালকুলেশনের পর মাথা নেড়ে বললেন, “না গণেশখুড়ো, মৃত্যুযোগ তো দেখছি না!”

শুনে গণেশবাবুর মুখ শুকনো। বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। গণেশবাবু ক্ষীণ গলায় বললেন, “একটু ভাল করে দ্যাখো হে! অনেক সময় রিস্টিগুলো ঘাপটি মেরে থাকে। খুঁজে দ্যাখো, লুকোছাপা করে কোনও কোনায় ঘুপচিতে গা-ঢাকা দিয়ে আছে কি না। ডাক্তার যে জবাব দিয়ে গিয়েছে!”

জটেশ্বর ফের হিসেব নিয়ে বসলেন এবং ঘণ্টাখানেক গলদঘর্ম হয়ে অবশেষে বললেন, “হ্যাঁ খুড়ো, একটা মঙ্গল আর রাহুর অবস্থানের যোগ পাচ্ছি বটে! তা হলে তো সামনের পূর্ণিমাতেই…”

গণেশবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বাড়িতেও ভারী আনন্দের লহর বয়ে গেল। এবং গণেশবাবু আজ সকালেও অভ্যাসমত চার মাইল প্রাতভ্রমণ করেছেন।

আর এই জন্যই জটেশ্বরের নামডাক। অন্য জ্যোতিষীরা দশটা ভবিষ্যদ্বাণী করলে দু’-চারটে মিলে যায়। কিন্তু জটেশ্বরের দশটার মধ্যে দশটাই ভুল হয়। এই জন্যই শুভ কাজের আগে জটেশ্বরের কাছে গিয়ে লোকে হাত বা কোষ্ঠী দেখিয়ে নেয়।

যদিও জটেশ্বরকে দেখলেই করালীডাক্তার তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, তবু প্রতিদিনই বিকেলের দিকটায় জটেশ্বরের একবার করালীডাক্তারের বাড়ি এক কাপ চা খাওয়া চাই-ই। কারণ, করালীর ২০

বাড়ির চা অতি বিখ্যাত। যেমন সুগন্ধ, তেমনই স্বাদটা অনেকক্ষণ জিভে লেগে থাকে।

আজ করালীডাক্তারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেই করালী হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “তুমি তো একটা খুনি! তোমার ফাঁসি হওয়া উচিত।”

জটেশ্বর বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “আহা, সে হবে’খন। অত তাড়াহুড়ো কীসের? আমার গলাও আছে, ফঁসির দড়িও পালিয়ে যাচ্ছে না। বলি, হয়েছেটা কী?”

“কী হয়নি? আমার রুগি গোপীবল্লভবাবুকে যে তুমি খুন করেছ, সেটা কি জানোনা?”

“খুন হয়েছেন বুঝি! যাক, কানাঘুষো শুনছিলাম বটে! এই তোমার কাছে পাক্কা খবর পেলাম।”

“কানাঘুষো শুনছিলে! কীসের কানাঘুষো?”

“ওই যা সব সময় শোনা যায় আরকী! লোকে ফিসফাস করছে, করালীডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় গোপীবাবুর প্রাণটা বেঘোরে গেল!”

করালী মারমুখো হয়ে আস্তিন গুটিয়ে তেড়েফুড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আস্তিন গুটোতে গিয়ে দ্যাখেন, তাঁর গায়ে জামা নেই, শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। আর স্যান্ডো গেঞ্জির আস্তিন গুটনো যে ভারী শক্ত কাজ এ কে না জানে। তিনি দাঁত কড়মড় করে বললেন, “যারা ওকথা বলে তাদের জিভ টেনে ছিঁড়ে নিতে হয়। তাদের নাম বলল, আমি তাদের ব্যবস্থা করছি।”

জটেশ্বর আদুরে গলায় বললেন, “তুমি যে গুন্ডা প্রকৃতির লোক একথা সবাই জানে। এখন আসল কথাটা ভেঙে বলো তো!”

“তুমি পরশুদিন গিয়ে গোপীবাবুকে বলে আসোনি যে, নরহরি

চাকলাদারের সঙ্গে তাঁর যে পাঁচ লাখ টাকার সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছে তাতে তিনি নির্ঘাত জিতবেন। বলোনি?”

জটেশ্বর অবাক হয়ে বললেন, “বলেছি বইকী? গুনে দেখলুম, একেবারে জলবতরলং ব্যাপার। মামলায় জিত কেউ আটকাতে পারবে না।”

“তুমি কি জানো যে, তোমার ভবিষ্যদ্বাণী শুনেই উনি রাতে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান?”

“কেন, মামলায় কি গোপীবাবুর জেতার ইচ্ছে ছিল না?”

“খুব ছিল। কিন্তু তোমার ফোরকাস্ট শুনেই উনি বুঝলেন যে, জেতার কোনও আশাই নেই। আর তাই টেনশনে হার্ট অ্যাটাক!”

অতি উচ্চাঙ্গের একটি হাসি হেসে জটেশ্বর বললেন, “তা হলে কি বলতে চাও লোকে আমাকে উলটো বোঝে?”

“না, লোকে তোমাকে ঠিকই বোঝে। আর তাই উলটো করে ধরে নেয়। তুমি কি জানো যে, তুমি একজন ধাপ্পাবাজ? তুমি না জানলেও ক্ষতি নেই। লোকে জানে।”

জটেশ্বরের বিচলিত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। মুখে ভারী মিষ্টি একটু হাসি। মিষ্টি করে বললেন, “মুখে যাই বলল করালী, মনে-মনে যে তুমি আমাকে শ্রদ্ধা করো তা আমি জানি।”

করালীবাবু হা হয়ে গেলেন। তারপর স্তম্ভিত গলায় বললেন, “শ্রদ্ধা! তোমাকে!”

জটেশ্বর মৃদু-মৃদু হেসে বললেন, “তুমি দুর্মুখ বটে, ডাক্তার হিসেবেও অচল, তবে লোকটা তো আর খারাপ নও। সেই কুড়ি বছর আগে যখন তুমি এখানে এসে থানাগেড়ে বসলে, তখনই তোমাকে বলেছিলুম কিনা, ‘ওহে করালী, প্রথমটায় তোমার খুব পসার হবে ঠিকই। তবে রাখতে পারবে না!’ কথাটা ফল কিনা দেখলে তো!”

“ধাপ্পাবাজির আর জায়গা পেলে না? তোমাকে আমি কস্মিনকালেও হাত দেখাইনি, কোষ্ঠীবিচারও তোমাকে দিয়ে করাইনি। তোমার আগড়মবাগড়ম কথাকে পাত্তাও দিইনি। আর পসার কমেছে তোমাকে কে বলল? এখনও মরণাপন্ন রুগির জন্য সবাই আমার কাছে এসেই ধরনা দেয়।”

“আহা, চটো কেন ভায়া! আমিও তো সর্দিকাশি বা জ্বরজাড়ি হলে অনিচ্ছে সত্ত্বেও ক্ষমাঘেন্না করে তোমার ওষুধ বার কয়েক খেয়েছি। তাতে কাজ না হলেও বন্ধুকৃত্য বলেও তো একটা কথা আছে নাকি! কিন্তু সেই যে বনবিহারী ঘোষের সান্নিপাতিকের সময় তুমি তাকে ঘাড় ধরে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে চোবালে, তারপর পুকুর থেকে তুলে গায়ে ফুটন্ত গরম জল ঢাললে, ফের পুকুরে ডোবালে, ফের তুলে গরম জল ঢাললে- ও কাজটা তোমার মোটেই ঠিক হয়নি।”

“তার তুমি কী বুঝবে? বনবিহারীর টাইফয়েড এমন জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বাঁচার কথাই নয়। ওই অল্টারনেটিভ বাথ দেওয়ায় প্রাণে বেঁচে যায়। বনবিহারী রাজি হচ্ছিল না বলে তাকে প্রাণে বাঁচাতে একটু জুলুম করতে হয়েছিল, এই যা!”

“তা বটে। তবে প্রাণে বাঁচলেও বনবিহারী সেই থেকে তোমার মুখদর্শন করা বন্ধ করেছে তা জানো? তারপর ধরো, খগেন হাওলাদার। সে ঘড়ি ধরে ওষুধ খায়নি বলে তুমি তার গলা টিপে ধরেছিলে। খগেনের জিভ বেরিয়ে যায়। আর-একটু হলেই তুমি খুনের দায়ে পড়তে!”

“খগেন অতি বজ্জাত। হাই শুগার হওয়া সত্ত্বেও সে লুকিয়ে রসগোল্লা খেত। গলা টিপে ধরায় সে ভয় খেয়ে মিষ্টি ছেড়েছে। তাতে তার মঙ্গলই হয়েছে।”

“তা হয়তো হয়েছে। কিন্তু খগেন যে তোমার নামে পুলিশে রিপোর্ট করেছিল তাও তো আর মিথ্যে নয়। তারপর ধরো উপেন দাস। তাঁর কোষ্টকাঠিন্যের জন্য তুমি তাঁকে গ্লিসারিন সাপোজিটারি দিয়েছিলে। দোষের মধ্যে সে জিজ্ঞেস করেছিল দিনে ক’টা করে খেতে হবে। তাতে খাপ্পা হয়ে তুমি তাকে এমন তাড়া করেছিলেন যে, সে ছুটে গিয়ে বিদ্যাধরীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায়। কাজটা কি উচিত হয়েছিল হে করালী? লোকে কি আর সাধে বলে করালডাক্তার’!”

“ডাক্তারের কাজ হল ছলে-বলে-কৌশলে রোগীর প্রাণরক্ষা করা। শুধু নিদান লিখে দিয়ে পকেটে পয়সাটি পুরলেই ডাক্তারি হয়।! রোগী ওষুধ ঠিকমতো খেল কি না, পথ্যিতে গণ্ডগোল করল কি

সেটা দেখাও ডাক্তারের কর্তব্য। লোকে আমাকে অপছন্দ করতে পারে, কিন্তু কেউ কখনও বলতে পারবে না যে, করালীডাক্তার পয়সা নিয়ে মিথ্যে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়েছে বা স্যাম্পেল ওষুধ বাজারে বিক্রি করেছে।”

‘তুমি ভাল লোক হলেও হতে পার, কিন্তু ভ ভদ্রলোক মোটেই নও। ভ ভদ্রলোক কি কখনও গুন্ডামি করে বেড়ায়, নাকি লোকের উপর হামলা করে? আচ্ছা, নবকিশোরের দোষটা কী ছিল বলো? তোমার চেম্বারে বসে সে বিনোদডাক্তারকে প্রশংসা করছিল, তাতে দোষটা কী? সে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, “দেশটা তো জালি ডাক্তারে ভরে গিয়েছে, তার মধ্যে বিনোদডাক্তার যেন বাতিঘর। কিন্তু মিছে কথাও বলেনি। বিনোদ অতি সজ্জন, অমায়িক, ডাক্তারও ভাল। আর তুমি কী করলে? এই কথা শুনে খেপে গিয়ে নবর গলার চাঁদর ধরে মুচড়ে কী ঝাঁকুনিটাই দিচ্ছিলে! ঘাড় মটকে মরেই যেত। অন্য লোকেরা এসে তোমার হাতে-পায়ে ধরে তাকে বাঁচায়।”

“ও তুমি বুঝবে না। নব ইচ্ছে করেই ওসব বলছিল। অতি উচ্চাঙ্গের বদমাশ।”

এই সময়ে করালীডাক্তারের স্ত্রী সুরবালা দু’ কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, “আচ্ছা, দুটো লোক এক নাগাড়ে বিশ বছর ধরে কী করে ঝগড়া করতে পারে তা আমাকে বুঝিয়ে বলবেন? ঝগড়ার বহর দেখে তো আমি রোজ ভাবি, এবার বোধ হয় দু’জনে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল! ওমা, কোথায় কী, পরদিনই দেখি দু’জনে আবার কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে বসে গিয়েছে! এত ঝগড়া, তবু দেখি দুজনে দুজনকে একদিনও না দেখে থাকতে পারেন না?”

করালীডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন, “হুঁ, ওরকম একটা ধাপ্পাবাজ দু’নম্বরি লোকের মুখ দেখলেও পাপ হয়। হায়া লজ্জা নেই কিনা, তাই বিনা পয়সায় চা খেতে আসে।”

সুরবালা রাগ করে বললেন, “ছিঃ, ওকথা বলতে আছে? ঠাকুরপো জ্যোতিষী করেন বটে, কিন্তু কারও কাছ থেকে পয়সা নেন না। আর চায়ের খোঁটা দিচ্ছ? ঠাকুরপোর বাড়িতে ভাল পদ রান্না হলে, পিঠে-পায়েস হলে যে বাটি ভর্তি করে নিজে বয়ে এসে দিয়ে যান, সেটা বুঝি কিছু নয়?”

করালী অত্যন্ত গম্ভীর মুখে একটু তাচ্ছিল্যের হুঁ, দিয়ে চুপ করে গেলেন।

সুরবালা বললেন, “আপনি কিছু মনে করবেন না ঠাকুরপো!”

মৃদু হেসে অতি মোলায়েম গলায় জটেশ্বর বললেন, “অন্য রকম হলেই মনে করতুম বউঠান। বাঘের গায়ে যদি বোঁটকা গন্ধ না থাকে, বঁড় যদি লাল রং দেখে তেড়ে না আসে, গরিলা যদি নিজের বুকে থাবড়া না মারে, তা হলেই চিন্তার কথা। তেমনই করালী যদি হঠাৎ ভ ভদ্রলোক হয়ে ওঠে, তা হলে তাকে করালী বলে চেনা যাবে কি?”

সুরবালা হেসে চলে গেলেন। করালীডাক্তার দাঁত কড়মড় করে বললেন, “আমার বাড়ির লোকের আশকারা পেয়েই তোমার আম্পদ্দা দিনে-দিনে বাড়ছে।”

জটেশ্বর চায়ে চুমুক দিয়ে একটা আরামের শব্দ করলেন, “আঃ!” ঠিক এই সময় ফটকের ওপাশে রাস্তায় একটা গোরুরগাড়ি এসে থামল। দু’জন মুনিশগোছের লোক একজন প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরা লোককে ধরে ধরে গাড়ি থেকে নামাল।

চায়ের কাপ শেষ করে জটেশ্বর চুকচুক শব্দ করে বললেন, “আহা রে, কার এমন ভীমরতি হল যে, তোমার কাছে চিকিচ্ছে করাতে আনছে! উঁহু, এ গাঁয়ের লোক নয়। এ গাঁয়ের লোক হলে এমন দুর্মতি হত না!”

যার উদ্দেশে বলা সেই করালীডাক্তার কিন্তু কথাটা শুনতে পেলেন না। তিনি দূর থেকে তীক্ষ্ণ চোখে মাঝখানের লোকটাকে নিরীক্ষণ করতে করতে আপন মনে স্বগতোক্তির মতো বললেন, “জলেডোবা কেস। মেমোরি লস, হেমারেজ।”

চায়ের কাপটা রেখে জটেশ্বর বললেন, “বাঃ, দূর থেকেই যখন ডায়াগনোসিস করে ফেললে তখন নিদানটাও হেঁকে বলে দাও। রোগীকে আর নেড়েঘেঁটে দেখার দরকার কী? ফটক থেকেই বিদেয় হয়ে যাক।”

করালীডাক্তার কথাটায় কান দিলেন না। উঠে পড়তে-পড়তে বললেন, “না হে, দেখতে হচ্ছে।”

শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জন লোকটাকে বারান্দায় এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে করালীকে বলল, “বিদ্যেধরী থেকে তুলেছি আজ্ঞে, আপনার কাছেই নিয়ে এনে ফেললাম!”

“বেশ করেছ। কেন, আমার বাড়িটা কি ধর্মশালা, না লঙ্গরখানা?” দু’জনেই মিইয়ে গেল খুব। শঙ্কাহরণ মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, “বড়ঘরের মানুষ বলে মনে হচ্ছে, তাই ভাবলুম আমাদের কুঁড়েঘরে তো তোলা যায় না, আর খাওয়াবই বা কী? আমাদেরই জোটে না, তাই!”

চেয়ারে বসেই লোকটার ঘাড় লটকে গেছে, চোখ বোজা।

করালীডাক্তার গম্ভীর গলায় বললেন, “ও পাশে রুগির ঘরে নিয়ে বেডে শুইয়ে দে। আধমরা করে তো এনেছিস!”

জটেশ্বরও বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসে লোকটাকে দেখলেন। তারপর বললেন, “এ তত বড়ঘরের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে হে। হাতে দামি ঘড়ি, আঙুলে হিরের আংটি!”

ভাগ্যিস এগুলো বলতে তোমার জ্যোতিষ বিদ্যে লাগে না। কিন্তু ঘড়ি আর আংটি ছাড়াও লক্ষ করার আরও বিষয় আছে, বুঝলে। সিল্কের জামাটার একটা ফুটো দেখতে পাচ্ছ? ওটা বোধ হয় বুলেট ইজুরি।”

তারপর করালী শঙ্কাহরণ আর বিপদভঞ্জনকে বললেন, “জামা, গেঞ্জি খুলে শোওয়াবি।”

দুজনে তাড়াতাড়ি লোকটাকে চ্যাংদোলা করে বারান্দার লাগোয়া সিক রুমে নিয়ে গেল।

করালীডাক্তার গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ ধরে লোকটাকে পরীক্ষা করলেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে করালীডাক্তারের পরীক্ষানিরীক্ষা দেখার পর পাশ থেকে জটেশ্বর প্রশ্ন করলেন, “কেমন বুঝছ?”

“বেঁচে যাবে। তবে সময় লাগবে।”

“মেমরি লস বুঝলে কীভাবে?”

“চোখ দেখে। লুকটা খুব ভ্যাকান্ট।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *