হারিয়ে পাওয়া
পাহাড়ী রাস্তা । স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন সোমদত্তা সান্যাল।দার্জিলিং এর যনাথন স্কুল এর গানের শিক্ষিকা । পনেরো বছর ধরে এই স্কুলে রয়েছেন । বেশ অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেল । পিছনে একটা গাড়ি অনেকক্ষণ থেকে হর্ণ বাজাচ্ছে । কিন্তু তিনি খেয়াল করেননি । অবশেষে ধাক্কা খেয়ে আহত হন । ওই ট্যুরিষ্ট গারিটিতে ছিল এক নব বিবাহিত দম্পতি । তারা তৎক্ষণাৎ সোমদত্তাকে গাড়িতে তুলে কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় । হসপিটালে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ওনাকে ছেড়ে দেওয়া হয় ।ছেলেটি ওনাকে ওদের হোটেলে নিয়ে এসে পরম যত্নে ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দেয় ।
ছেলেটির নাম সোহম আর তার স্ত্রী অপরাজিতা । দুজনের দেখাশুনা করেই বিয়ে । তার মতে Long term relation গুলো বিয়ের পর ভালোবাসা হারিয়ে মৃত শব হয়ে ঘুরে বেড়ায় ।এর পিছনে একটা কাহিণী আছে । সোহোম বার বার বিষয়টা এড়িয়ে গেছে ।আজ অপার জবরদস্তিতে সোহোম বলতে শুরু করে ।
বছর কুড়ি আগের কথা । তখন আমি খুব ছোটো ।শুনেছি 11 বছর প্রেম ছিল ওদের । মা অরফ্যান । মামার বাড়ি মানুষ । পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে দুজন । তাই মামারা কোনো সম্পর্ক রাখেনি । ঠাকুমা সহ্য করতে পারত না মাকে । তাই মায়ের সাথে ঠাকুমার খুঁটিনাটি লেগেই থাকত । হঠাৎ একদিন বাবার চাকরিটা চলে যায় । বাধ্য হয়ে মা চাকরির চেষ্টা শুরু করে । কিছুদিন পর একটা চাকরি পায় বেসরকারি ফার্মে । মায়ের ফিরতে সন্ধ্যে এক এক দিন রাতও হয়ে যেত । বাবাকে ঠাকুমা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলত । সব কথার মানে ঐ বয়সে ঠিক বুঝতে পারতাম না । মা বাড়ি ফিরলেই বাবা মায়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া করত । মায়ের গায়ে হাত তুলত । আমিও তখন সারাদিন মাকে কাছে পেতাম না । তাই অভিমানে মায়ের থেকে দূরে দূরে থাকতাম ।
মা আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদত । কাছের বলতে তো কেউ ছিল না ! এরপর বাবা একটা কাজ পায় । মাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে । মা রাজী হয়না । অশান্তি চরমে ওঠে । ঠাকুমার প্ররোচনায় বাবা ডিভোর্স ফাইল করে । আমাকে বোঝানো হয় কোর্টে যদি আমায় জিজ্ঞেস করা হয় আমি কার কাছে থাকতে চাই আমি যেন বলি বাবার কাছে । তার জন্য আমাকে অনেক ক্যাডবেরি ও আইসক্রিম দেওয়া হবে । কতো বোকা ছিলাম আমি !! সেদিন মা অনেক কেঁদেছিল আমাকে হারিয়ে । তারপর থেকে আর মায়ের খোঁজ কেউ নেয়নি । “তোর মা আজও কাঁদে ঋক ।” বহুদিনের ফেলে আসা ডাকনাম শুনে চমকে তাকায় দরজার পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে । আপনি ?? আমিই তোর সেই অভাগী মা ! সোহম দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মাকে । আমায় ক্ষমা করো মা । মায়ের থেকে আপন আর কেউ হয়না রে ঋক । তোর বাবা কেমন আছেন ? তোমায় তাড়ানোর পর ঠাকুমা তার পছন্দের মেয়ের সাথে বাবার বিয়ে দিয়েছিল । আমায় খুব মারত কষ্ট দিত । ঠাকুমাকে slow poison করে মেরে ফেলে । তারপরই বাবার হার্ট অ্যাটাক টা হয় । তখন থেকেই বাবা প্যারালাইসড । তারপর ঐ মহিলা কোথায় যেন চলে যায় ।খুব অনুতপ্ত বাবা । অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন । ফিরে চলো মা — বলে মাকে জড়িয়ে ধরে সে ।দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ।এই দেখো তোমার বৌমা ।তোমাকে না নিয়ে আমরা এখান থেকে যাবো না ব্যাস । শোনো পাগল ছেলের কথা । ওরে সন্তান ছাড়া মা যে বড্ড অসহায় । আমার শেষ বয়সের লাঠি হতে পারবি তো ? পারবো মা । তোমার সব চোখের জল আমি সুখের চাদরে ঢেকে দেবো । পনেরো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই মায়াবী হাসিটা আজ আবার উঁকি দিচ্ছে মায়ের মুখে ।