Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হারানো প্রাপ্তি || Kajal Mukherjee

হারানো প্রাপ্তি || Kajal Mukherjee

সেদিন রফিক বাজারে যাচ্ছিল সকালে, বাজারে যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে গাছের নিচে ফুটপাতে দেখল এক বৃদ্ধা বসে আছে , মলিন ছেঁড়া জামা কাপড় পরনে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ কয়েকদিন খাওয়া দাওয়া হয়নি তার।

রফিককে দেখে ওই বৃদ্ধা খাবার চাইলে ,রফিক ১০ টা টাকা ওই বৃদ্ধার হাতে দিয়ে চলে গেল বাজারে, একটু তাড়া ছিল তার, বাজার করে বাড়ি এসে স্নান খাওয়া দাওয়া করে অফিস যাবে ।

বাজার করে ফেরার পথে ফুটপাতের ওই জায়গাটায় বেশকিছু মানুষের জটলা দেখে তাড়া সত্বেও রফিক সেখানে উঁকি মেরে দেখল ,ওই বৃদ্ধাকে ঘিরেই বেশ ভিড় জমে গেছে ।

ওই ভিড়ের মধ্যে একজনকে লাঠি হাতে ওই বৃদ্ধাকে শাসাতে দেখা যাচ্ছিল, আর একজন মহিলা ওই বৃদ্ধাকে চড় থাপ্পড় মারছিল।
‘এমন কি হয়েছে আর ওই বৃদ্ধা কি এমন খারাপ কাজ করেছেন, যে ওই বৃদ্ধাকে মারধর করা হচ্ছে আর শাসানো হচ্ছে,’ ওখানে উপস্থিত একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে রফিককে তিনি বললেন , আশপাশে বাড়ির কোনো একটা বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই ছেলে ধরা সন্দেহে ওই বৃদ্ধাকেই মারধর করা হচ্ছে। যারা মারছে তাদের ধারণা ছেলে ধরা দলের সঙ্গে ওই বৃদ্ধার যোগ আছে, তাই ওই বৃদ্ধার মুখ থেকে কথা বার করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে এইভাবে।

রফিক ওই দৃশ্য দেখে আর থাকতে পারলো না, বাজারের ব্যাগ হাতে ভিড় ঠেলে ওই বৃদ্ধার কাছে গিয়ে, তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলল,’ আপনারা কি মানুষ ? দেখছেন না এনার এই অবস্থা?
কতদিন ঠিকমতো খেতেও পায়নি, ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, অসুস্থ মানুষ একজন।এই ফুটপাতে আধমরা অবস্থায় এইভাবে পড়ে আছে ,ভিক্ষে করছে, আর এইরকম একজন বৃদ্ধাকে আপনারা ছেলেধরা সন্দেহে মারধর করছেন? ওনাকে কি ছেলে ধরা বলে মনে হয়? আপনারা কেউ কি দেখেছেন বা জানেন যে ওই হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটাকে ইনি চুরি করেছেন বা ওই বাচ্চাটির চুরির সাথে ইনি যুক্ত, শুধুমাত্র ভুল সন্দেহের বশে এইরকম একজন অসহায়, অসুস্থ মহিলাকে আপনারা হেনস্থা করছেন, মারধর করছেন?’

রফিকের কথা শুনে , যারা ওই বৃদ্ধাকে হেনস্থা করছিল তারা থমকে গেল একটু, তারপর বলল ,’আপনি কি করে জানলেন যে ও ছেলেধরা দলের সঙ্গে জড়িত নয়, আসলে এরাই বাচ্চা চুরি দলের সাথে জড়িত, ওদের খবর সরবরাহ করে,এরা এইরকম অসুস্থ, অসহায় অবস্থার ভান করে থাকে,একে চাপ দিলেই এদের দলের সব খবর পাওয়া যাবে,আর বাচ্চাটার খবরও পাওয়া যাবে।’

রফিক আবার জোর গলায় বলল ,’না উনি ওসব নন ,আমি ওনাকে চিনি,আর আপনাদের যদি ওনাকে ছেলে ধরা বলে সন্দেহ হয় তাহলে পুলিশে খবর দিন পুলিশ এসে যা করবার করবে, নিখোঁজ বাচ্চাটিকে খুঁজে বার করবার দায়িত্ব পুলিশের, আপনাদের নয়, আর মিথ্যে ,অকারণ সন্দেহের বশে মানুষকে হেনস্থা করা, মারধর করা আইনের চোখে আর সমাজের চোখে অপরাধ। নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না, পুলিশে খবর দিন, পুলিশ যা করার করবে। ওনার এখন খুব খারাপ অবস্থা ,সেবা সুশ্রূষা করার দরকার, আর দরকার পেট ভরে খাবার। তাই মানবিকতার খাতিরে আমি ওনাকে এখন আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আমাকে তো এই অঞ্চলের মানুষজন চেনেন আর আমার ফোন নাম্বারও দিয়ে যাচ্ছি। দরকার হলে বা পুলিশ চাইলে আমার কথা বলবেন, আমাকে ফোন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

রফিকের কথা শুনে আস্তে আস্তে জমে থাকা ভিড়টা হালকা হয়ে গেল ,যে যার কাজে চলে গেল ।
রফিক ওই বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তাকে দুহাতে তুলে তারপর একটা রিক্সা ডেকে সেখান থেকে নিয়ে নিজের বাড়িতে গেল।
বাড়িতে রফিকের বাবা মা ওই বৃদ্ধাকে দেখে চমকে গেল তার অবস্থা দেখে, তারপর রফিককে বলল,’ এ কাকে নিয়ে এসেছিস বাড়িতে’?

রফিক তার বাবা মাকে সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা বলল , রফিকের বাবা-মা রফিকের এই মানবিক কাজে বাধা হয়ে তো দাঁড়ালেনই না উপরন্তু তার এই কাজে তাকে পূর্ণ সমর্থন করলেন।
এরপর ওই বৃদ্ধাকে রফিকের মা স্নান ঘরে নিয়ে গিয়ে ভালো করে স্নান করিয় একটা পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে দিলেন। এরপর ক্ষতস্থানগুলোকে ওষুধ দিয়ে দিলেন নিজের হাতে এখন ওই বৃদ্ধাকে অনেকটাই সুস্থ লাগছিল । এরপরই ওই বৃদ্ধা আকারে ইঙ্গিতে তাঁর খিদে পাওয়ার কথা বোঝালেন ।
রফিকের মা ওই বৃদ্ধাকে পাত পেড়ে বসিয়ে খেতে দিলেন। ওই বৃদ্ধার খাওয়া দেখেই বোঝা গেল যে সে অনেকদিন পেট ভরে কিছু খেতে পায়নি।
খাওয়া দাওয়ার পর ওই বৃদ্ধাকে একটা ঘরে বিছানা পেতে দিল রফিকের মা, বৃদ্ধা সেখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এতক্ষণে বৃদ্ধার মুখ থেকে কেউ একটা কথাও শোনে নি, যা কিছু সবই আকার ইঙ্গিতে ওই বৃদ্ধ বোঝার ছিলেন। ওই বৃদ্ধা যে আদৌ কথা বলতে পারেন কিনা সেটাই ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না।
তবে বৃদ্ধাকে দেখে মনে হয় হয়তো উনি ভালো ঘরের বাসিন্দা ,হয়তো বা বৃদ্ধ বয়সের জন্য স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন , কঠিন কোনো অসুখের জন্য বাকশক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন।
হয়তো বা ওনার ছেলে মেয়ে বা পরিবারের মানুষজন ওনার খোঁজে হয়রান হচ্ছেন, এমনও হতে পারে ওই বৃদ্ধা নিজেই পথ ভুলে হারিয়ে স্মৃতিভ্রংশ হয়ে রাস্তায় বসে ছিলেন, স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যাওয়ার জন্য বাড়ির কথা, পরিবারের কথা কিছুই মনে করতে পারছেন না ,আর বাকশক্তি হারানোর জন্য কথাও বলতে পারছেন না।
তবে ওই অজানা অচেনা বৃদ্ধাকে এই অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য রফিকের বাবা মা রফিকের মানবিক বোধের, বিপদের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই প্রচেষ্টায় খুবই খুশি হলেন ।
ওই বৃদ্ধাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য রফিককে সাধুবাদ জানালেন। রফিকও তার বাবা মাকে ভালো করেই চেনে, তাদের উদার মনোভাব আর মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মনোভাবের কথা জানে,সেই জন্যই সে ওরকম একজন সহায় সম্বলহীন বিপদগ্রস্ত বৃদ্ধাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসতে পেরেছিল।
এরপর ওই বৃদ্ধাকে রফিক ও তার বাবা-মা এইভাবে নিজেদের পরিবারেরই একজন সদস্য করে নিয়েছিল ।
তাদের একটাই অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কারণ ওই বৃদ্ধার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল, আগেকার কোন কথা মনে করতে পারছিলেন না আর কথাবার্তাও বিশেষ কিছু বলতে পারছিলেন না। আকারে ইঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করছিল, কিন্তু উনি যে বোবা নন ,এটা বোঝা যাচ্ছিল ওনার হাবভাব দেখে।
যাই হোক রফিকেরা নানাভাবে চেষ্টা করছিল ওই বৃদ্ধার প্রকৃত পরিচয় জানার জন্য।
রফিকদের বাড়িতে যখন রফিকের মা ঘরে বসে নামাজ পড়তো তা দেখে ওই বৃদ্ধা বেশ উৎসাহী আর খুশি হতেন, কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেন ।
রফিকের মা বোঝার চেষ্টা করছিল উনি কি বলছেন, তাতে উনি আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে কোনো একটা ঠাকুরের ছবি ,যেটা নিয়ে উনি হাত জোড় করে নমস্কার করে পুজো করবেন।
সেটা বুঝে রফিক একটট কালী ঠাকুরের ছবি বাড়িতে নিয়ে এল, যদিও মুসলিম বাড়িতে ছবি আর মূর্তি ব্যবহার হয় না ।
কালী ঠাকুরের ছবি পেয়ে ওই বৃদ্ধা খুব খুশি হলেন আর এই ছবির সামনে হাতজোড় করে পূজা করতেন নিয়মিত।
রফিকেরা বুঝতে পারলো ওই বৃদ্ধা হিন্দু আর উনি নিয়মিত ঠাকুর পূজো করেন, ঠাকুর ভক্ত।
তবে ঠাকুর পূজার সময় ধীরে ধীরে ওনার মুখ থেকে নানা রকম মন্ত্র বিশেষ করে আদ্যা স্তোত্র যেন অস্ফুটে মুখ থেকে বেরোতে লাগলো ,রফিকেরা সেসব না বুঝলেও , এটা বুঝতে পারল যে ওই ভদ্র মহিলা ধীরে ধীরে কথা বলতে পারছেন বা চাইছেন কথা বলতে।
রফিক তার বন্ধুদের মধ্যে কথা বলে অবশেষে হ্যাম রেডিয়োর সাথে যুক্ত মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল,অবশেষে হ্যম রেডিওর একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হলো।
উনি একদিন রফিকদের বাড়িতে এলেন ,তারপর ওই বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে ও আকারে ইঙ্গিতে নানাভাবে ওনার মুখ থেকে কিছু কথা বার করতে পারলেন, তাতে বোঝা গেল যে উনি উত্তরবঙ্গের কুচবিহারের বাসিন্দা।
তারপর সেই ভদ্রলোক হ্যাম রেডিওতে কুচবিহারের হ্যম রেডিও টিমের সাথে যোগাযোগ করলেন, এইভাবে জানা গেল ওই বৃদ্ধা কুচবিহারের বাসিন্দা এবং ওখানকার একটি হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা নন্দিতা চট্টোপাধ্যায় ।
উনি ্যনিখোঁজ হয়েছেন বেশ কিছুদিন হল।
নন্দিতা চট্টোপাধ্যায়ের স্বামী প্রায় বছর দশেক হল মারা গেছেন।
বছর চারেক আগে স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করার পর একমাত্র ছেলে আর ছেলে বউয়ের কাছে থাকতেন নন্দিতা দেবী।
প্রায় বছর দুয়েক হলো নন্দিতা দেবী দূরারোগ্য সিভিয়ার অ্যালজাইমার্স রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
তিনি তাঁর অতীতের প্রায় সবকিছুই ভুলে গিয়েছিলেন ,এমনকি তার বাক শক্তিও হারিয়ে গিয়েছিল।
নন্দিতা দেবীর ছেলে এবং ছেলের বউ মায়ের যথাসাধ্য চিকিৎসা করাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি,উল্টে পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
এমতাবস্থায় কলকাতায় ভালো চিকিৎসার জন্য তার ছেলে তাকে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু হাসপাতালের আউটডোর থেকে কখন যেন নন্দিতা দেবী বেপাত্তা হয়ে যান।
সেই সময় তার ছেলে হাসপাতালের ফার্মেসিতে ওষুধ আনতে গিয়েছিল, নন্দিতা দেবীকে হাসপাতালের আউটডোরের ওয়েটিং হলে বসিয়ে রেখে, ওখান থেকে এসে দেখে তাঁর মা ওখানে নেই, অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে নন্দিতা দেবীর ছেলে স্বাগত, থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছে, কিন্তু কিছুই হয়নি।
কলকাতায় বেশ কয়েকদিন থাকার পর অবশেষে কোচবিহারে ফিরে যায় স্বাগত।
ওখানেও নিখোঁজ ডায়েরী করা হয়েছে,কিন্তু খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এখন এই হ্যাম রেডিওর মানুষজনের সাহায্যে খোঁজ পেয়ে ওনার ছেলে স্বাগত পরের দিনই কলকাতায় এসে, রফিকদের বাড়িতে এল।
মাকে দেখতে পেয়ে স্বাগত দৌড়ে এসে সজল চোখে মাকে জড়িয়ে ধরল আর বলল,’ মা তুমি এখানে কি করে এলে ? জানো ,তোমাকে কত খুঁজেছি , কিন্তু কোথাও পাইনি। এনারা সত্যিই খুব ভালো মানুষ, তোমাকে ভালোভাবে ,সুন্দরভাবে রেখেছেন, আর এনাদের জন্যই আজ আমি তোমাকে খুঁজে পেলাম।’
নন্দিতা দেবীও ছেলেকে কাছে পেয়ে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে ।
নন্দিতা দেবীর তখন দুচোখে জল আর তাঁর মুখ থেকে কথা বেরিয়ে এল,’ তুই এসেছিস বাবু? এবার আমাকে বাড়ি নিয়ে চল, আর আমি হারিয়ে যাব না তোদের থেকে।’

মা আর ছেলের এই পরস্পরকে খুঁজে পাওয়া দেখে,তখন ওই ঘরে উপস্থিত রফিক, তার বাবা-মা আর হ্যাম রেডিওর প্রতিনিধি, প্রত্যেকের চোখে আনন্দের অশ্রু!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress