হলধর নাগ (‘পদ্মশ্রী’ সম্মানপ্রাপ্ত কোশলি ভাষায় কবি)
“প্রেমের পরশে সবাই কবি হয়ে ওঠে।”
– (প্লেটো)
৩১শে মার্চ ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দে উড়িষ্যার বরগড় জেলার ঘেস গ্রামে একটি হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই মানুষটি। দশ বছর বয়সে যখন বাবা মারা যান, কৃতকার্য হয়েই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয় তাকে।
অভাবের তাড়নায় পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে সেই ঘেস গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে রাঁধুনি হিসেবে তার জীবনসংগ্রাম শুরু করেন।
এই কাজের সময় তার সাথে পরিচয় হয় মালতী নামের একটি মেয়ের । যিনি সেই হোস্টেলেই রান্নার কাজে সাহায্য করতেন । ধীরে ধীরে মালতীকে ভালবাসতে শুরু করেন তিনি । মালতি বেশ সুন্দরী হওয়ায় মুখে ভালবাসার কথা বলতে না পারলেও রান্নাঘরের দেওয়ালে কয়লা দিয়ে কবিতা লিখে মালতীকে ভালবাসার কথা বোঝাতে চাইতেন তিনি । রান্না ঘরের দেওয়াল ভরে উঠত এমন শত শত কবিতায় । শেষে এই লাজুক প্রেমিকটির মনের গভীরতা ভাল লেগে যায় মালতীর ; বিয়েও করেন । সংসার বড় হয় । আসে তাদের ভালবাসার প্রাপ্তি- মেয়ে নন্দিনী ।
পরবর্তীতে মিষ্টির দোকানে বাসন ধোয়া থেকে রাস্তায় ঘুগনি বিক্রি করা, এমন সব অনেক কাজই জীবনে করতে হয়েছে তাকে। গোটা জীবনটাই কেটেছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের পরামর্শেই বিদ্যালয়ের প্রবেশ দ্বারের পাশে একটি ছোট্ট বই-খাতার দোকান খোলেন তিনি । ছেড়ে দেন রান্নার কাজ ।
এই প্রথম কলম হাতে ওঠে তার । আর সাদা পৃষ্ঠার অভাব ছিল না দোকানে । শুরু হয় পুরোদমে কবিতা লেখা। ছোটবেলা থেকেই কোসলি ভাষায় ছোটগল্প লেখা শুরু করেন তিনি। কবিতা চর্চা শুরু করেন একটু বড় হয়ে। ১৯৯০ সালে প্রথম লেখা কবিতা ‘ধোদো বরগাছ’ অর্থাৎ বুড়ো বটগাছ স্থানীয় এক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ তারপর তিনি আরও চারটি কবিতা পাঠান ঐ পত্রিকায়। সেগুলোও প্রকাশিত হয় একে একে।
কোশলি ভাষায় কবিতা লিখতেন তিনি । ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে যার কোন লিখিত রূপই ছিল না। তাকে তিনি মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছিলেন। শুরুতেই তার প্রথম কবিতা “ধোদো বড়গাছ” (বুড়ো বটগাছ) প্রকাশ পায় ১৯৯০ সালে। পত্রিকার পক্ষ থেকে কিছু সম্মান-দক্ষিণা দিয়ে তাকে উৎসাহিত করা হয়।এরপর “ভাব”, “সুরুত” একে একে শত শত কবিতা প্রকাশ পায় তাঁর । লিখে ফেলেন কোশলি ভাষায় ‘আচিয়া’, ‘বাছার’, ‘মহাসতী উর্মিলা’, ‘তারা মন্দোদরী’, ‘শিরি সামালাই’, ‘প্রেম পইচান’, ‘বীর সুরেন্দ্র সাই’, ‘শান্ত কবি বিমাভাই’, ‘রুশি কবি গঙ্গাধর’ ইত্যাদি ২০ টি মহাকাব্য।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক লেখা প্রশংসা কুড়োয় সাধারণ মানুষ থেকে সাহিত্য সমালোচকদের। তাঁর সমস্ত কবিতা একত্রিত করে ‘হলধর গ্রন্থাবলী’ প্রকাশ করেছে সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়। চলছে এই বই এর দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তুতিও।
ভারতের ইতিহাসের ১৬ জনপদের একটি কোশল রাজ্যের ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন উৎকৃষ্ট মহাকাব্য আর কেউ লেখেননি কোনও দিন। এই মানুষটির লেখা হাজার হাজার কবিতা কোশলি কাব্যসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ । কোশল প্রদেশের মানুষ তথা উড়িষ্যার মানুষ “কোশল কুইলি”, “যাদব কুলগৌরব”, “যাদবজ্যোতি” “কোশলরত্ন” ইত্যাদি নামে ভূষিত করেছে তাকে ।
পরনে সাদা ধুতি ও কুর্তা। পিঠ পর্যন্ত লম্বা তেল জবজবে চুল। পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই। এমন চেহারার ঘুগনি বিক্রেতা স্বাভাবিকভাবেই কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে না৷ আর তাই অনেকেই জানেন না পর্যন্ত যে, এই অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন কাটানো মানুষটি পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত জনপ্রিয় একজন কবি।
তাঁর প্রতিভা কখনও জীবনের অভাবের কাছে হার মানেনি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া হলধরের উপর ছিল মা সরস্বতীর আশীর্বাদ, তাই যতবারই তিনি কলম ধরেছেন তাঁর হাত থেকে ঝরে পড়েছে সাহিত্যের মণিমুক্তা।
২০১৪ সালে তিনি “উড়িষ্যা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার” পেয়েছেন । তার সেই বইখাতার দোকানটি এখন তার গুণমুগ্ধ স্কলারদের কাছে মন্দির স্বরূপ । উড়িষ্যা সরকার সংরক্ষণ করেছে সেটিকে ।
এই অতি সাধারণ মানুষটি হলেন, হলধর নাগ ।
সম্বলপুরী-কোশলি ভাষায় সাধারণ গ্রাম্য জীবনে মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা, ভালবাসার কথা, প্রতিবাদের কথা, অতীত গৌরবের কথা, ধর্মের কথা এত সুন্দর আঙ্গিকে এর আগে কেউই তুলে ধরতে পারেননি । তার লেখার কৌশল একটি নতুন কাব্য ধারা তৈরি করে, যেটি তার নাম অনুযায়ী “হলধর ধারা” হিসেবে পরিচিত ।
তার কাব্যগুলি সঙ্কলিত করে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে “হলধর গ্রন্থাবলী” এবং “হলধর গ্রন্থাবলি- ০২” । এই বইগুলি সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স সিলেবাসের পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে ।
লোক কবিরত্ন- হলধর নাগ ; আপনাকে এমন সম্মান দিয়ে ভারতবর্ষ গর্বিত ।
এই মুহুর্তে তার লেখা নিয়ে গবেষণা করছেন পাঁচ জন গবেষক।
২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন তিনি।
২০১৯ সালে তিনি সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয় দেয় সাম্মানিক ডক্টরেট। প্রতিভা হল ছাই চাপা আগুন। তার প্রমাণ ‘লোক কবি রত্ন’ হলধর নাগ।
এখনও তিনি আগের মতই অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন।
* [ হলধর নাগের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন : সুশান্ত কুমার মিশ্র ও বর্ণদীপ নন্দী ]
“ছোটবেলা থেকেই কি আপনার কবিতার প্রতি আকর্ষণ ছিল?
উ: হ্যাঁ কবিতা, লোকগীতি আমায় ছোটবেলা থেকেই টানত।
প্রশ্ন: কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কারা আপনার কাছে অনুপ্রেরণা?
উ: কবি গঙ্গাধর মেহেরা, ভীম ভোয়ী এঁদের কবিতার ভাষা, বিশেষত কবি গঙ্গাধর মেহেরার প্রাকৃতিক বর্ণনা আমায় ভীষণ মুগ্ধ করে।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম লেখা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন-
উ: সেই অর্থে প্রথম লেখার কথা যদি বলতে হয় তবে বলতে হবে প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘ধোড়ো বড়গাছ’ (বুড়ো বটগাছ) কবিতাটির কথা। যার বিষযবস্তু একটি বটগাছ। গ্রামের কত জন্ম-মৃত্যু, মান-অভিমান একমনকী একটা ছোট্ট চুরির ঘটনারও সাক্ষী সেই গাছটি। দীর্ঘদিন এক জাযগাতে দাঁড়িয়ে থেকে সে দেখে যাচ্ছে পরিবর্তনের ইতিহাস।
প্রশ্ন: আপনি যে ‘পদ্মশ্রী’ সন্মান পেইয়েছেন এটা একজন কবির কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। কবিদের জনপ্রিয়তা বা প্রচারের আলোকে আসার ক্ষেত্রে সন্মানপ্রাপ্তি কতটা জরুরি বলে আপনার মনে হয়?
উ: কবি সন্মানের কথা ভাবেন না বা সন্মানপ্রাপ্তির জন্য লেখেন না। যিনি সন্মানপ্রাপ্তির জন্য লেখেন তিনি কবি নন, তিনি লেখক নন, তিনি সাধক নন।
প্রশ্ন: সন্মানপ্রাপ্তির পর কবি বা লেখকের লেখায় কি কোনও পরিবর্তন আসে বলে আপনার মনে হয়?
উ: কবি সন্মান পেতে পারেন তবে তার সাথে লেখায় প্রভাব পড়ার কোনও যোগসূত্র নেই। কবি নিজের মতো জীবনধারণ করেন এবং কলমের মাধ্যমে জীবনপ্রকৃতি বহিঃপ্রকাশ করেন। তার মধ্যে থেকেই বেরিযে আসে কালজয়ী কবিতা। এক্ষেত্রে কবি আর পাখি সমান। পাখি বিভিন্ন গাছের ফল-মূল খেয়ে উগরে দেয়। কখনও কখনও তার মধ্যে থেকেই একটা আস্ত বটগাছ জন্মায়।
প্রশ্ন: ‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়া ও ওখানে কাটানো কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত যদি আমাদের সাথে ভাগ করে নেন…
উ: রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্মশ্রী গ্রহণের মুহূর্ত তো অবশ্যই একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। আরেকটি স্মরণীয মুহূর্তের কথা আপনাকে বলি, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কার নেওযার পর জলখাবারের জন্য এক জাযগায় যেতে বলা হল। গেলাম। তারপর সেখানে যখন চা খাচ্ছি তখন পেট্রোলিযাম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান বললেন, হলধরবাবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমি কোনওক্রমে উত্তেজনায় চায়ের কাপটা সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। উনি(নরেন্দ্র মোদি) আসলেন এবং হাত মেলালেন। তারপর বললেন,‘আপ ওড়িশাকা স্বভিমান বাড়হা দিহা।’
প্রশ্ন: এবার একটু কবিতার কথায় আসি। আপনি কবিতায় মূলত কী ধরনের বিষযবস্তুকে প্রাধান্য দেন?
উ: আমি মাটির কবিতা লিখি। আমাদের সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। কবির কলমের উচিত সেই সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। সে হোক পৌরাণিক, হোক ঐতিহাসিক বা মনগড়া যাই লিখিনা কেন তা সমাজকে শুধরাবার জন্য।
প্রশ্ন: বর্তমানে পৌরাণিক ঐতিহাসিকের কথা আসলে বেশিরভাগ মানুষ নাক শিটকায়। বর্তমান যুগে শীততাপ নিযন্ত্রিত ঘর, ফাইভ স্টার হোটেল তার ভেতরে চলে কবিতাপাঠ, সেখানে পৌরাণিক কবিতাকে নেহাত গ্রাম্য বা গেঁযো বলে ব্যাঙ্গ করা হবে। আপনি কখনও এমন পরিস্থিতির সন্মুখীন হয়েছেন?
উ: দেখুন কবিতার জীবন আছে। কবির কোনও ভেদাভেদ নেই। কবিদের অন্তরাত্মা একই। সে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হন বা রাম, শ্যাম, যদু, মধু।
প্রশ্ন: বর্তমানের কবিতাচর্চা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
উ: এখানকার অনেক কবিতার মানেই আমি বুঝতে পারি না। কবি তো অন্যের জন্য কবিতা লিখবে। যদি অন্যরা বা সমাজ তার কবিতা না বোঝে তাহলে কী জন্য সে কবিতা লেখে? এই দেখুন না জগন্নাথ দাস উড়িষ্যা তথা সারা ভারতে পরিচিত হয়ে গেলেন ধর্মগ্রন্থ ভগবত লিখে। তিনি কী করেছিলেন, অতি সরল ভাষায সর্বসাধারণের জন্য লিখেছিলেন।
প্রশ্ন: আচ্ছা কখনও রাজনীতির প্রসঙ্গ বা বিষয় আপনার কবিতায় উঠে এসেছে?
উ: হ্যাঁ এসেছে তো। যেমন একটা কবিতার উদাহরণ দিই, কবিতাটির নাম ‘কাহি এ বাহিরচি ঘরু’। গ্রামে মন্ত্রী এসেছেন সবাই মন্ত্রীকে নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে যাচ্ছে। এক অন্ধ, সেও আর ঘরে বসে থাকতে পারল না। ভাবল তারও তো সমস্যা কম না। যদি মন্ত্রী মহোদয়কে জানালে কিছু সুরাহা হয়। রাস্তায় বেরিয়ে সে মন্ত্রীর গাড়ির নীচে চাপা পড়ল। যখন মন্ত্রীর গাড়ির নীচে অন্ধ চাপা পড়ে গেছে তখন গ্রামের সবাই বলল- কাহি এ বাহিরচি ঘরু? (কেন এ ঘর থেকে বেরিইয়েছে?)। এক্ষেত্রে মন্ত্রীর কোনও দোষ দেখল না কেউ।
প্রশ্ন: আপনার ছেলেবেলা ও জীবনসংগ্রাম সম্পর্কে কিছু বলুন।
উ: তিন ক্লাস পড়তে পড়তে আর পড়াশোনা হয়নি। মা-বাবা দুজনেই মারা গেলেন। আমার তখন বয়স দশ। পেটের জ্বালায তখন আর পড়া! প্রথম দু-বছর হোটেলের কাপ-প্লেট ধুযে পেট চালালাম। তারপর সরপঞ্জ(গ্রামপ্রধান) স্কুলের(ঘেস হাই স্কুল) হোস্টেলে রাঁধুনির কাজ যোগাড় করে দিলেন। সেখানে ষোল বছর রান্নার কাজ করি। স্কুলটা আমার বাড়ির মতো হযে গিয়েছিল। এরপর মালতীকে বিয়ে করলাম, তারপর মেয়ে হল। মেয়ে বড় হল তার বিয়ে দিলাম। তারপর এই এখনও চলছি জীবনের উঁচু-নীচু পথ ধরে।
প্রশ্ন: আপনি যখন পদ্মশ্রী আনতে দিল্লি গেলেন তখনও এই সাদামাটা পোশাকেই পায়ে জুতো ছাড়াই পেঁছে গেলেন দিল্লি। জুতো পরেন না কেন?
উ: আমার ছোটবেলা থেকে কখনও জুতো পরার অভ্যেস নেই। জুতো পরলে আমি হাঁটতে পারি না। তাছাড়া আমাদের বদ্যিমশাই বলতেন খালি পাযে থাকলে মাধ্যাকর্ষণের সাথে ডাইরেক্ট কানেকশন থাকে, সেই থেকেই এই অভ্যাস। আর এই বেশভুষা আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের সংস্কৃতি। তাই এই বেশভূষাতেই দিল্লি চলে গেলাম। টাই-স্যুট ওগুলো এমনি আমার সাথে খাপ খায না। আমি সাদামাটা মানুষ।
প্রশ্ন: আপনি নিজের একটি ধারা তৈরি করে ফেলেছেন সম্বলপুরী-কোসলী ভাষায (হলধর ধারা) যে ধারায় শতাধিক কবি কাব্যচর্চা করছেন। এ এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। আপনি যখন কোথাও কবিতা বলতে যান সেখানে নাকি হাজার হাজার মানুষের ভীড় জমে, যারা কবিতা বা বই-ই কখনও পড়েনি বা পড়ে না এমন মানুষও আপনার কবিতা শুনতে আসে। আপনার কবিতাতে কী এমন যাদু আছে যা এত মানুষকে টেনে আনে?
উ: যাদু-টাদু কিছ নেই। আমি মানুষের কথা লিখি। সহজ সরল ভাষায় লিখি।
(সৌজন্যে : নবাঙ্কুর পত্রিকা)
তাঁর পাঁচটি কবিতা : –
১).
বীক্ষণ
হলধর নাগ
অবিরাম ধান কেটেছি গত ঘুমে— কাস্তে ছিল ঘামের জোয়ার
অবিরাম মাছ ধরেছি গত ঘুমে— জাল ছিল নিশ্ছিদ্র তুষার
অবিরাম পুড়েছে জীবন গত ঘুমে— অসহ রাতের শরম
অবিরাম বীজ বুনেছি গত ঘুমে— মাটি ছিল নারীর নরম
অবিরাম হেঁটেছি শ্রমণ গত ঘুমে— মন ছিল মত্ত শ্রবণে
অবিরাম গেয়েছি গান গত ঘুমে— বেহুলার অশ্রু শ্রাবণে
আরো অবিরাম,অবিরাম কেটেছে প্রহর কত অনুভবে জেনে যাই আমি
তবু গানে ও গমনে বুঝি না জীবনে— চাষ করি কার জমি…
(দ্র.ব্য : কোশলি ভাষা থেকে অনূদিত বীক্ষণ কবিতাটি পরিবর্তন নিউজ (১৪ এপ্রিল ২০১৬ সাল) প্রকাশিত ; কিন্তু অনুবাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।)
কবিতা এই পাললিক অরন্যে (Poetry in this alluvial forest)
২).
অন্তরীণ মধুপের শিস
হলধর নাগ
প্রভু, তাহলে মৃত্যু দাও— আত্মঘাতি উৎসবের মতো
কোকিলার স্নেহে পান করি উষ্ণতার শীত
প্রভু, নইলে সংরক্ষিত বাগানের ফুলে সেঁটে দাও
গোটা কয়েক শুদ্ধস্তন
আর বিজিত অধম ভেবে আমাকে প্রবেশাধিকার দাও
শপথ—সঙ্গলিপ্সায় কোনো দিন বনে বাজারে ঘুরবো না
প্রভু, অন্তত পাহাড়-প্রসূত প্রস্রবনে একটা বিয়ে দিও
যদি অতিরিক্ত আদরে মরে যাই
লোকদের ভাসিয়ে দিতে বলো—
আরক্ত গোলাপের স্রোতে
(দ্র.ব্য : কোশলি ভাষা থেকে অনূদিত বীক্ষণ কবিতাটি পরিবর্তন নিউজ (১৪ এপ্রিল ২০১৬ সাল) প্রকাশিত ; কিন্তু অনুবাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।)
কবিতা এই পাললিক অরন্যে (Poetry in this alluvial forest)
নীচের কবিতাগুলি
[ কোশলি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন : কৌশিক ভাদুড়ি ]
৩).
কোকিল
হলধর নাগ
লুকিয়ে লুকিয়ে গান গাস রে কোকিল
আম বাগানের ঝোপে
(যেন) টুপটাপ পড়ে চাক ভেঙে রস
তাই শুনে পেট ভরে।।
পাখির ভেতর তুই রানি হোস
কন্ঠ বেড়ালের ঘণ্টা*
তোর বুলিটা নিখাদ মধুর
গলে মিশে যায় মনটায়।।
কাকের বাসাতে ডিম পেড়ে রেখে
নছড়ামি তোর ঘোর
ঝারা হাতপায়ে ট্যাংট্যাং ঘোরা
নেই সন্তান স্নেহ তোর।।
শুনেছি মালিকা যখন কৃষ্ণ
গেল কংসবধ দেখি
তার মা যশোদা শরণে কেশব
কেঁদেছিল তুই সাক্ষী।।
বছরে একবার আজ যে দশমী
পথে উল্টো রথের ঢল
শ্বশুর ভিটেতে খেটে মরা বধুর
সে খবরটাই সম্বল।।
গিরগিটি বয় কাপড়ের গাঁট
ফুল সাজি বয় ফিঙে
দুটো টুনটুনি যেন বউ দুটি
উলু দেয় তিতিরে।।
পাখির মিছিলে কাঠঠোকরা ঢাকী; মুহুরি অন্য পাখি
বিবাহের এই শোভাযাত্রায় ভাট পানকৌড়ি
ডালা সাজিয়ে বাজা বাজিয়ে গায়ে হলুদের তত্ত সাজিয়ে
ফলমূল আর খাজাগজা নিয়ে ময়না তাদের নেত্রী।।
দেখা দিস না রাগিণী শোনাস
লাজ করে গুণবতী
দেখা দেন না বিচক্ষণ সুজন
(দিলে) গুণ হয়ে যায় মাটি।।
* উল্টো রথের সময়ে শ্রাবণের শুরুতে কোকিলের ডাক ঘণ্টির মতো শোনায়।
হয়তো তারা ছানা কোকিল, কিংবা বড় কোকিলের শেষ মেটিংকল।
৪).
পাঁচ অমৃত
হলধর নাগ
যেখান থেকে অমৃত ঝরে
সাত সমুদ্র থেকে
স্বর্গ থেকে
মায়ের স্তন থেকে
মহৎ নীতির ধারা থেকে
কবির কলম চালাই।।
৫).
উজ্জ্বল সলিতা
হলধর নাগ
প্রদীপ জ্বাললে জীবন উজ্জ্বল
ঘুপচি ছাদের ঘরে
চাঁদকে জীবন্ত উজ্জ্বল দেখে
আঁধার পালায় ডরে।।
অজ্ঞানতার আঁধার ভিতরে
পাঁড় ছ্যাঁচোর রত্নাকর
জ্ঞানের উজ্জ্বলতা দেখে হয়ে গেল
বাল্মীকি মুনিবর।।
আঁধারের ঝারে যোগ্য ছেলেটি
দিয়েছে প্রদীপ জ্বালি
জ্বলা সলিতার মতো উজ্জ্বল
পশ্চিম উড়িষ্যার বুলি।।
—————————————————————-
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র – অন্তর্জাল ]