Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হত্যাকারী কে || Panchkari Dey

হত্যাকারী কে || Panchkari Dey

প্রথমার্ধ

উপক্রমণিকা

আমার কথা

দুইজনেই নীরবে বসিয়া আছি , কাহারও মুখে কথা নাই। তখন রাত অনেক , সুতরাং ধরণীদেবীও আমাদের মত একান্ত নীরব। সেই একান্ত নীরবতার মধ্যে কেবল আমাদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ প্রতিক্ষণে স্পষ্টীকৃত হইতেছিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আমি পকেট হইতে ঘড়ীটা বাহির করিয়া দেখিলাম , “ইঃ ! রাত একটা !”

আমার মুখে রাত একটা শুনিয়া যোগেশবাবু আমার মুখের দিকে একবার তীব্র দৃষ্টিপাত করিলেন। অনন্তর উঠিয়া একান্ত চিন্তিতের ন্যায় অবনতমস্তকে গৃহমধ্যে পদচারণা করিতে লাগিলেন। এইরূপ আরও কিছুক্ষণ কাটিল , হঠাৎ পার্শ্ববর্তী শয্যার উপরে বসিয়া , আমার হাত ধরিয়া যোগেশচন্দ্র ব্যগ্রভাবে বলিতে লাগিলেন , –
“আপনার সদয় ব্যবহারে আমি চির ঋণী রহিলাম। আপনার ন্যায় উদার হৃদয় আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। আপনি ইতিপূর্ব্বে অনেক কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন ; কিন্তু আমি তাহার যথাযথ উত্তর দিতে পারি নাই ; আমার এখনকার অবস্থার কথা একবার ভাবিয়া দেখিলে আপনি অবশ্যই বুঝিতে পারিবেন , সেজন্য আমি দোষী নহি। আপনি আমার সম্বন্ধে যে সকল বিষয় জানিবার জন্য একান্ত উৎসূক হইয়াছেন , আমি তাহা আজ অকপটে আপনার নিকট প্রকাশ করিব ; নতুবা আমার হৃদয়ের এই দুর্ব্বহ ভার কিছুতেই কমিবে না। ঘটনাটা যেরূপ জটিল রহস্যপূর্ণ , শেষ পর্য্যন্ত শুনিতে আপনার অত্যন্ত আগ্রহ হইবেই। আপনি যদি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে পারেন , তাহা হইলে আমি এখনই আরম্ভ করিতে পারি। ঘটনাটার মধ্যে আর কোন নীতি বা হিতোপদেশ না থাক , অক্ষয়বাবু যে একজন নিপুণ ডিটেক্‌টিভ সে পরিচয় যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। কেহ যদি কখনও কোন বিপদে পড়েন , তিনি যেন অক্ষয়বাবুরই সাহায্য প্রার্থনা করেন। আমার বিশ্বাস , ন্যায়পথে থাকিয়া নিরপেক্ষভাবে যথাসময়ে ঠিক কার্য্যোদ্ধার করিবার ক্ষমতা তাঁহার বেশ আছে।”

আমি মুখে যোগেশবাবুকে কিছুই বলিলাম না। মুখ চোখের ভাবে মস্তকান্দোলনে বুজ্খাইয়া দিলাম , তাঁহার কাহিনী আমি তখনই শুনিতে প্রস্তুত , এবং সেজন্য আমার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আরও একটু ভাল হইয়া বসিলাম।
যোগেশচন্দ্র তখন বলিতে আরম্ভ করিলেন।

প্রথম পরিচ্ছেদ

যোগেশচন্দ্রের কথা

কি মনে করিয়া যে আমি তখন অক্ষয়বাবুকে আমার কাজে নিয়োজিত করিয়াছিলাম , সেকথা এখন ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। কতক বা ভয়ে , কতক বা রাগে এবং কতক বা অনুতাপে , তখন আমি কতকটা পাগলের মতই হইয়া গিয়াছিলাম। যদি আপনি কখনও কাহাকে ভালবাসিয়া থাকেন – প্রকৃত ভালবাসা যাহাকে বলে , যদি আপনি সেইরূপ ভালবাসায় কাহাকে ভালবাসিয়া থাকেন , তাহা হইলে আপনি বুঝিতে পারিবেন , কি মর্ম্মান্তিক ক্লেশ আমি ভোগ করিতেছি। কি আশ্চর্য্য , আমি এখনও সেই নিদারূণ যন্ত্রণা সহ্য করিয়া বাঁচিয়া আছি।

আমি বাল্যকাল হইতেই লীলাকে ভালবাসিয়া আসিতেছি। লীলা আমাকে সর্ব্বন্তঃকরণে ভালবাসিত ; সে ভালবাসার তুলনা হয় না। মরিয়াও কি লীলাকে ভুলিতে পারিব? শৈশবকাল হইতেই শুনিতাম লীলার সহিত আমার বিবাহ হইবে। তখন হৃদয়ের কোন প্রবৃত্তি সজাগ হয় নাই , তথাপি সেকথায় কেমন একটি অজানিত আনন্দ-প্রবাহে সমগ্র হৃদয় উল্লসিত হইয়া উঠিত। তাহার পর বড় হইয়াও সেই ধারা অটুট ছিল। আমাদিগের আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল ছিল না বলিয়া আমার সহিত লীলর বিবাহে লীলার পিতার কিছু অনিচ্ছা থাকিলেও লীলার মাতার আর তাহার ভ্রাতা নরেন্দ্রনাথের একান্ত আগ্রহ ছিল। নরেন্দ্রনাথ আমার সহাধ্যায়ী বন্ধু। এমনকি , তাঁহাদিগের আগ্রহে লীলার পিতাকেও সম্মত হইতে হইয়াছিল। সুতরাং লীলা যে একদিন আমারই হইবে , এ দৃঢ় বিশ্বাস আমার সমভাবে অক্ষুণ্ণ ছিল।

এমন সময়ে ডাক্তারের পরামর্শে আমার পীড়িতা মাতাকে লইয়া আমাকে বৈদ্যনাথে যাইতে হয়। পীড়ার উপশম হওয়া দূরে থাক্‌ , বরং উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। মা বাঁচিলেন না। মা ভিন্ন সংসারে আমার আর কেহ ছিল না। মাতার সহিত সংসারের সমুদয় বন্ধন আমার শিথিল হইয়া গেল – সমগ্র জগৎ শূন্যময় বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। একমাত্র লীলা – সে শূন্যতার মধ্যে – দীনতার মধ্যে – আমার সমগ্র হৃদয়ে অভিনব আশার সঞ্চার করিতে লাগিল।
বৎসরেক পরে দেশে ফিরিয়া শুনিলাম লীলা নাই – লীলা আমার নাই – তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে – সে তখন অপরের। তাহার চিন্তাও তখন আমার পক্ষে পাপ। এই মর্ম্মভেদী কথা শুনিবার পূর্ব্বে আমার মৃত্যু শ্রেয়ঃ ছিল।
লীলার পিতা এ বিবাহ জোর করিয়া দিয়াছেন , পত্নী পুত্রের মতামত তাঁহার কাছে আদৌ গ্রাহ্য হয় নাই।
যাহার সহিত লীলার বিবাহ হইয়াছে , তাহার নাম শশিভূষণ। সে আমার অপরিচিত নহে। তাহার সহিত আমার আগে খুব বন্ধুত্ব ছিল।
মাথার উপরে শাসন না থাকায় , নির্দ্দয়প্রকৃতি পিতৃহীন শশিভূষণের চরিত্র যৌবন-সমাগমে যখন একান্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল , আমি তখন হইতে আর তাহার সহিত মিশিতাম না ; হঠাৎ কখনও যদি কোনদিন পথে তাহার সহিত দেখা-সাক্ষাৎ ঘটিত , পরস্পর কুশল প্রশ্নাদি ছাড়া বন্ধুত্বসূচক কোন বাক্যালাপ ছিল না।
শশিভূষণের বাৎসরিক হাজার-বারশত টাকার একটা আয় ছিল ; তাহাতেই এবং প্রতিমাসে কিছু কিছু দেনা করিয়া তাহার সংসার , বাবুয়ানা , বেশ্যা এবং মদ বেশ চলিত। সেই ঘোরতর মদ্যপ বেশ্যানুরক্ত শশিভূষণ এখন লীলার স্বামী।

ক্রমে লোকমুখে বিশেষতঃ লীলার ভাই নরেন্দ্রের মুখে শুনিলাম , লীলার স্বামী লীলার প্রতি পশুবৎ ব্যবহার করিয়া থাকে ; এমন কি , যেদিন বেশী নেশা করে , সেদিন প্রহার পর্য্যন্ত। নরেন্দ্রনাথের সহিত দেখা হইলে সে প্রতিবারেই বন্ধুভাবে এই সকল কথা আমার কাছে উত্থাপন করিয়া যথেষ্ট অনুতাপ করিত , এবং পিতৃনিন্দানামক মহাপাপে লিপ্ত হইত।
অনুতাপদগ্ধ লীলার পিতা এখন ইহলোক হইতে অপহৃত হইয়াছেন , সুতরাং তাঁহার অমোঘ একজ্ঞায়িতার পরিণাম তাঁহাকে দেখিতে হয় নাই।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

এইরূপে আর একটা বৎসর অতিবাহিত হইল। লীলার স্বামী শশিভূষণের বাটী লীলার পিতৃগৃহ হইতে অধিক দূরে নহে , এক ঘণ্টায় যাওয়া-আসা যায় ; তথাপি শশিভূষণ লীলাকে এপর্য্যন্ত একবারও পিতৃগৃহে আসিতে দেয় নাই। নরেন্দ্রের কাছে শুনিলাম লীলারও সেজন্য বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। পিতার মৃত্যুকালে লীলা একবার মাত্র পিতৃগৃহে আসিবার জন্য তাহার স্বামীর নিকট অত্যন্ত জেদ্‌ করিয়াছিল ; কিন্তু দানবচেতার নিকটে তাহা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছিল। সেই অবধি লীলা আর পিতৃগৃহে আসিবার নাম মুখে আনিত না।

এ বৎসর পূজার সময়ে লীলা একবার পিতৃগৃহে আসিয়াছিল। শারদীয়োৎসবোপলক্ষে নহে , লীলার মার বড় ব্যারাম , তাই সে আসিয়াছিল। মাতার আদেশে একবার নরেন্দ্রনাথ শশিভূষণকে অনেক বুঝাইয়া হাতে-পায়ে ধরিয়া , কাঁদিয়া-কাটিয়া ভগিনীকে নিজের বাড়ীতে আনিয়াছিল।
আমি নরেন্দ্রের রুগ্না মাতাকে দেখিবার জন্য যেমন প্রত্যহ তাহাদের বাড়ীতে যাইতাম , সেদিনও তেমনি গিয়াছিলাম। সেখানে আমার আবাল্য অবারিত দ্বার। যখন ইচ্ছা হইত , তখনই যাইতাম ; কোন নির্দ্দিষ্ট সময়সাপেক্ষ ছিল না। সেদিন যখন যাই , তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল।

সন্ধ্যার পর শুক্লাষ্টমীর কি সুন্দর চন্দ্রোদয় হইয়াছে। জ্যোৎস্না-প্লাবনে নক্ষত্রোজ্জ্বল নির্ম্মেঘ আকাশ কর্প্পূরকুন্দধবল। অদূরবর্ত্তী প্রবাহমানা তটিনীর সুন্দর কলগীতি অস্পষ্ট শ্রুত হইতেছিল। সম্মুখস্থ পথ দিয়া কোন যাত্রাদলের বালক “দাসী বলে গুণমণি মনে কি পড়েছে তোমার” , গায়িয়া গায়িয়া আপন মনে ফিরিতেছিল। গায়ক বালকের হৃদয়ে কত হর্ষ ! কি উদ্দাম আনন্দ-উচ্ছ্বাস ! তুষানলদগ্ধ জীবন্মৃত আমি – আমি কি বুঝিব? হৃদয়ে যে নরকাগ্নির স্থাপনা করিয়াছি , তাহা আজীবন ভোগ করিতে হইবে। যেদিকে দৃষ্টিপাত করি , সকলই যেন হাস্যপ্রফুল্ল – উৎফুল্ল চন্দ্র ; উৎফুল্ল নক্ষত্রমালা ; উৎফুল্ল সমীরণ ; উৎফুল্ল আম্রশাখাসীন পাপিয়ার ঝঙ্কৃত মধুর কণ্ঠ ; উৎফুল্ল আলোকাম্বরা শোভনা প্রকৃতির চারুমুখ। কেবল আমি – শান্তিশূন্য – আশা শূন্য – কর্ত্তব্যচ্যুত – উদ্দেশ্যহীন কোন্‌ দূরদৃষ্ট পথের একমাত্র নিঃসঙ্গ যাত্রী।
বাটীর সম্মুখ-দ্বারেই নরেন্দ্রের সহিত আমার দেখা হইল। তখন সে ডাক্তারের বাড়ী যাইতেছে ; সুতরাং তাহার সহিত বিশেষ কোন কথা হইল না।
আমি বাটীর মধ্যে যাইয়া যে ঘরে নরেন্দ্রের মাতা ছিলেন , সেই ঘরের প্রবেশ-দ্বারে দাঁড়াইলাম। দেখিলাম , রোগশয্যায় নরেন্দ্রের মাতা পড়িয়া আছেন। পার্শ্বে বসিয়া একজন কঙ্কালসর্ব্বস্ব স্ত্রীলোক তাঁহার মস্তকে ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া দিতেছে। প্রদীপের আলো আসিয়া সেই উপবিষ্টা স্ত্রীলোকের অধিলুলিতচিবুক , প্রকটগণ্ডাস্থি অরক্তাধর ম্রিয়মাণ মুখের একপার্শ্বে পড়িয়াছে। প্রথমে চিনিতে পারিলাম না। তাহার পর বুঝিলাম – এ সেই লীলা। আজ দুই বৎসরের পরে লীলাকে এই দেখিলাম। যাহা দেখিলাম , তাহা না দেখিলেই ভাল ছিল।
লীলার সেই শরন্মেঘমুক্তচন্দোপম স্মিত মুখমণ্ডল রৌদ্রক্লিষ্ট স্থলপদ্মের ন্যায় একান্ত বিবর্ণ এবং একান্ত বিষণ্ণ। সেই লাবণ্যোজ্জ্বল দেহলতা নিদাঘসন্তপ্তকুসুমবৎ শ্রীহীন। সেই ফুল্লেন্দীবরতুল্য স্নেহ-প্রফুল্ল আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু কালিমাঙ্কিত ! বিষাদ-বিদীর্ণ হৃদয়ে লীলাকে দেখিতে লাগিলাম – ক্ষণেকে আমার আপাদমস্তক স্বেদাক্ত হইল। কি আশ্চর্য্য , দুই বৎসরে মানুষের এমন ভয়ানক পরিবর্ত্তনও হয় !
মনে মনে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিলাম , হে করুণাময় ! হে অনাথের নাথ ! দীনের অবলম্বন , নিরাশ্রয়ের আশ্রয় ! যাহার আশা আমি ত্যাগ করিয়াছি – যাহার চিন্তাতেও আমার আর অধিকার নাই ; কেন প্রভু ! আবার তাহাকে এ মূর্ত্তিতে আমার সামনে ধরিলে? প্রভো ! আমার হৃদয় অসহ্য বেদনাভারে ভাঙিয়া-চুরিয়া যাক্‌ , অবিশ্রান্ত তুষানলে পুড়িয়া খাক্‌ হইয়া যাক্‌ , ক্ষতি নাই ; লীলাকে সুখী কর – তাহার অন্ধকার মুখ হাসিমাখা করিয়া দাও। আমি আর কিছুই চাহি না।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

আমাকে দেখিতে পাইয়া লীলা মাথায় কাপড় দিল। এবং তাড়াতাড়ি উঠিয়া , জড়সড় হইয়া লজ্জানম্রমুখে যেমন ঘরের বাহির হইতে যাইবে , তাহার ললাটের একপার্শ্বে কবাটের আঘাত লাগিল। লীলা সরিয়া দাঁড়াইল।
আমি কতকটা অপ্রকৃতিস্থভাবে তাহাকে বলিলাম , ” লীলা , বসো। তুমি কি আমাকে চিনিতে পার নাই?”
আমার বিশ্বাস – লীলাকে চিনিতে প্রথমে আমার মনে যেমন একটা গোলমাল উপস্থিত হইয়াছিল , সেইরূপ তাহারও কিছু একটা ঘটিয়া থাকিবে। এ-লীলা , সে-লীলার মত নয় বলিয়া আমার মনে এইরূপ ধারণা হইয়াছিল। যাক , এমন সময়ে পার্শ্ববর্তী গৃহমধ্যস্থ কোন দুগ্ধপোষ্য শিশুর করুণ ক্রন্দন শ্রুত হইল। লীলা মৃদুনিক্ষিপ্ত শ্বাসে “আসছি”, বলিয়া ঘরের বাহির হইয়া গেল।
আমি চিন্তিত মনে রুগ্নার শয্যার পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইলাম। রুগ্না নিদ্রিতা। অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়াছিলেন , সুতরাং আমি পূর্ব্বে তাহা বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , “এখন কেমন আছেন?”
তাহাতেই তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। আমাকে দেখিয়াই বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার শয্যার একপার্শ্বে বসিলাম। তাহার পর তিনি বলিতে লাগিলেন “বড় ভাল নয় বাবা , এ যাত্রা যে রক্ষা পাইব , এমন মনে হয় না। নরেন রহিল – লীলা রহিল , উহাদের তুমি দেখিয়ো। আমি জানি , তুমি উহাদের ছোট ভাই ভাই-বোনের মত দেখ ; এখন উহাদের আর কেহ রহিল না ; তুমি দেখিয়ো। তুমিই উহাদের বড় ভাই।”
আমি বলিলাম , ” সেজন্য আমাকে বিশেষ কিছু বলিতে হইবে না। নরেন্দ্র ও লীলা যে আমাকে বড় দাদার ন্যায় ভক্তি করে , তাহা কি আমি জানি না? আমি আজীবন তাহাদের মঙ্গল-চেষ্টা করিব। ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনি এখন শীঘ্র আরোগ্য লাভ করিলে সকল দিক রক্ষা হয়।”

নরেন্দ্রের মাতা বলিলেন, ” না বাবা , আর বাঁচিতে ইচ্ছা নাই। নরেনের জন্য ভাবি না , সে বেটাছেলে , লেখাপড়া শিখিয়াছে , বড় ঘরে তাহার বিবাহও দিয়াছি – সে যেমন করিয়া হউক , আজ না হয় , দুদিন পরেও মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে। কেবল লীলার জন্য – লীলার স্বামী মাতাল – বদ্‌রাগী লোক – আমার সোনার লীলার যে দশা করিয়াছে দেখিলে চোখে জল আসে। লীলার জন্য আমার মরণেও সুখ হইবে না। লীলা এখন এখানে আছে , অনেক করিয়া তবে তাহাকে এবার আনিয়াছি।”আমি বলিলাম , ” হ্যাঁ , এইমাত্র আমি তাহাকে দেখিয়াছি – আমি প্রথমে লীলাকে চিনিতে পারি নাই। ”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জননী বলিলেন , “লীলা এখন সেই রকমই হইয়াছে।” তাঁহার চক্ষে দুই বিন্দু অশ্রু সঞ্চিত হইল।তাহার পর বলিলেন , “লীলার একটি ছেলে হইয়াছে , দেখ নাই?”
আমি শুষ্ক হাস্যের সহিত বলিলাম , ” না।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পাশের ঘরে লীলা ছিল , লীলার মা তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন , ” লীলা , প্রবোধচাঁদকে একবার এ ঘরে নিয়ে আয় – তোর যোগেশ দাদা এসেছে – দেখ্‌বে।”
বলা বাহুল্য শিশুর ক্রন্দনে এবং লীলার ব্যস্ততায় তাহা আমি পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম। অনতিবিলম্বে শিশুপুত্র ক্রোড়ে লীলা আমাদিগের ঘরে প্রবেশ করিল – দেখিলাম , সেই সেদিনের খেলাঘরের বালুকাকে অন্ন , কচুপাতাকে ঘণ্টে , ইঁটের ক্ষুদ্র টুকরাগুলিকে মৎস্যে এবং পরমান্নে পরিণত করিবার অসীমক্ষমতাধারিণী পাচিকা , হাস্যচপলা ছোট লীলা আজ মাতৃপদাধিষ্ঠাত্রী।

লীলা গৃহতলে বসিল। শৈশবে দুইজনে একসঙ্গে খেলা করিয়াছি , ছুটাছুটি করিয়াছি , ঝগড়া করিয়াছি ; ভাবের পর একসঙ্গে বসিয়া কত গল্প করিয়াছি। বুঝিতে পারিলাম না , কেমন করিয়া কোন্‌ দিন সহসা সে শৈশবস্বর্গচ্যুত হইলাম। শুধু স্মৃতিমাত্র রহিয়া গেল।

যাহা হউক , যদিও এখন সে-লীলা নাই , তথাপি লীলা আমাদের পাড়ার মেয়ে , তাহাকে আমি এতটুকু হইতে দেখিয়া আসিয়াছি , আমাকে দেখিয়া তাহার লজ্জা করিবার কোন আবশ্যকতা ছিল না। সে মাথায় একটু কাপড় দিয়া বসিল। আমি সস্নেহে তাহার শিশুপুত্রকে বুকে করিলাম।
সুন্দর টুকটুকে ছেলেটি – মুখ, চোখ, ও কপালের গড়ন ঠিক লীলার মত। বুঝিলাম , লীলাকে প্রবোধ দিতেই এই প্রবোধচাঁদের জন্ম , এবং লীলা হইতেই তাহার এইরূপ নামকরণ।
তাহার পর লীলার মাতা লীলার অদৃষ্টকে শতবার ধিক্কার দিয়া এবং লীলার স্বামীর প্রতি অনেক দুর্ব্বচন প্রয়োগ করিয়া নিন্দাবাদ করিতে লাগিলেন। তাহাতে লীলার মলিন মুখ আরও অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। স্বামীনিন্দা হিন্দুরমণীমাত্রেরই নিকট অপ্রীতিকর। তা লীলা শিক্ষিতা এবং সদ্‌কুলোদ্ভবা। লীলার স্বামীভক্তি অচলা হউক , লীলার চরিত্রহীন স্বামী দেবতুল্য হউক , লীলা সুখী হউক , আমি তাহাতেই সুখী।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

লীলার মা সে যাত্রা রক্ষা পাইলেন না। তাঁহার পবিত্র আত্মা পরলোকগত স্বামীর উদ্দেশ্যে চলিয়া গেল। দুইমাস পরে পিতৃমাতৃহীনা লীলা স্বামীগৃহে উপস্থিত হইল , এবং পূর্ব্বের ন্যায় এবারেও দুর্ভাগিনী , কাণ্ডজ্ঞানহীন মদ্যপ স্বামীর নিকটে উৎপীড়িত হইতে লাগিল।
ক্রমে আমি ধৈর্য্য হারাইলাম , যেমন করিয়া পারি , লীলার কষ্ট দূর করিতে হইবে। কি উপায় করি? অনেক চিন্তার পর স্থির করিলাম , পূর্ব্বে শশিভুষণের সহিত আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল – আবার তাহার সহিত সেই বন্ধুত্ব গাঢ় করিয়া তুলিতে হইবে। যদি তাহার সহিত মিলিয়া মিশিয়া ক্রমে তাহার সেই হেয়তম ঘৃণ্য চরিত্রের কিছুমাত্র সংশোধন করিতে পারি।
কার্য্যে তাহাই ঘটিল। আমি মধ্যে মধ্যে – তাহার পর প্রত্যহ শশিভূষণের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আরম্ভ করিলাম। উভয়ের মধ্যে আবার ঘনিষ্ঠতা নামক পদার্থটি অত্যন্ত নিবিড় হইয়া আসিতে লাগিল। এখন তাহাদের বাড়ীতে গেলে শশিভূষণ আমাকে যথেষ্ট খাতির যত্ন করিত।
দুই-চারিদিনের মধ্যে মধ্যে কথায় কথায় বুঝিতে পারিলাম , শশিভূষণ লীলাকে অত্যন্ত ভালবাসে। শুনিয়া সুখী হইলাম বটে , কিন্তু এ অত্যন্ত ভালবাসার উপরে , এ অত্যন্ত অত্যাচারের কারণ কিছুতেই নির্দ্ধারণ করিতে পারিলাম না।
যাহাই হউক , তাহার সেই মনোভাবে আমার মনে অনেকটা আশার সঞ্চার হইল। মনে করিলাম , আমার প্রচুর উপদেশ-বৃষ্টিবর্ষণে তাহার প্রেমতৃষ্ণার্ত্ত মরুহৃদয়ে এক সময়ে-না এক সময়ে সৎ প্রবৃত্তির বীজ উপ্ত হইবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমি বহু শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করিয়া এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ফুটনোট করিয়া বুঝাইতাম যে , ধর্ম্মপত্নীর উপর দুর্ব্ব্যবহার করা শাস্ত্রবিগর্হিত কাজ ; এবং তজ্জন্য অধঃপতন অনিবার্য্য। নরেন্দ্রের সহিত একান্ত হৃদ্যতায় আমার যে এই অযাচিতভাবে উপদেশ প্রয়োগে কিছু অধিকার আছে , তাহা শশিভূষণ বুঝিত ; এবং ভবিষ্যতে যাহাতে আমার উপদেশ রক্ষা করিয়া কাজ করিতে পারে , সেজন্য যথেষ্ট আন্তরিকতা প্রকাশ করিত।
এইরূপে তাহাকে অনেকটা প্রকৃতিস্থ করিলাম। কিছুদিন সে আমার কথা রক্ষা করিয়াছিল ; পরে আবার যে-কে-সেই। যেদিন বেশি মদ খাইত , সেদিন লীলার প্রতি দুর্বৃত্তের অত্যাচার একেবারে সীমাতিক্রম করিয়া উঠিত। তখন আমি উপদেশের পরিবর্ত্তে রুষ্ট হৃদয়ে তাহাকে যথোচিত তিরস্কার করিতাম। কখন সে মৌন থাকিত এবং কখনও বা অসন্তোষ প্রকাশ করিত।
একদিন শশিভূষণ মদের মুখে – অসদ্ভাবে নয় , সরল প্রাণে কলুষিত বদনে এইরূপ আত্ম-পরিচয আমাকে দিতে লাগিল , ” ভাই যোগেশ , আমার মতিগতি যাহাতে ভিন্ন পথে চালিত হয় , সেজন্য তুমি যে যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছ , তাহা যে আমি বুঝিতে পারি নাই , তাহা নহে। যদিও আমি মাতাল , কাণ্ডজ্ঞানহীন ; তথাপি আমি তোমার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারি। তুমি আমাকে অনেক বুঝাইয়াছ , বুঝি নাই , ভার্ৎসনা করিয়াছ – আমারই ভালর জন্য। সব বুঝিতে পারি , বুঝিলে হইবে কি , বেশী মদ খাইলে আর আমার কিছুই মনে থাকে না। বাঁচিয়া থাকিতে যে মদ ছাড়িতে পারিব – কখনই না। যদিও পারিতাম , এখন আর তাহা পারিব না। আমার মনের ভিতর কি বিষের হল্কা বহিতেছে , কে জানিবে? মদ খাইয়া অনেকটা ভাল থাকি। ইহার ভিতরে অনেক কথা আছে। কথাটা শুনিয়া যাও , এ পৃথিবীতে আমার মত তোমার ঘোরতর শত্রু আর কেহ নাই। আমি জানি , তুমি লীলাকে ভালবাসিতে , এবং লীলার সহিত তোমার বিবাহ হইবে ; কিন্তু -”
শুনিয়া আমি আপাদমস্তক শিহরিয়া উঠিলাম। শশিভূষণ সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া বলিতে লাগিল , – “লীলা যে তোমাকে ভালবাসে , আমি সে কথা অনুভব করিতে একবারও চেষ্টা করি নাই। যেদিন আমি সৌন্দর্য্য-মণ্ডিতা লীলাকে দেখিলাম , সেইদিন হইতে তাহার একটা অদম্য আকাঙ্খায় আমার সমগ্র হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
স্নেহ , মমতা, প্রেম প্রভৃতির অস্তিত্ব যে আমার হৃদয়ে আছে , সে সম্বন্ধে আমার নিজেরই কিছুমাত্র বিশ্বাস ছিল না ; কিন্তু যেদিন দেবী-প্রতিমার ন্যায় অশেষমহিমাময়ী লীলাকে দেখিলাম , শত সৎপ্রবৃত্তিও যেন হৃদয়দ্বার উদঘাটন করিয়া , সেই দেবী-প্রতিমার অর্চ্চনার জন্য সহস্র ব্যগ্র-বাহু প্রসারণ করিয়া একেবারে আকুল করিয়া উঠিল। সন্ধান লইয়া জানিলাম , তোমার সহিত লীলার বিবাহ হইবে। সেজন্য লীলার মা আর নরেন্দ্রনাথের যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আর তোমার আর্থিক অবস্থা যেমনই হউক , তোমার সচ্চরিত্রতার উপর তাঁহাদের এক বিশ্বাস। স্থির করিলাম নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য তাঁহাদের সেই অনন্ত বিশ্বাস দ্রুত ভাঙিতে হইবে।”
আমি স্তম্ভিত হৃদয়ে , সংযতশ্বাসে তাহার হৃদয়হীনতার ও পাষণ্ডপনার ঘৃণ্যকাহিনী শুনিতে লাগিলাম।
” তাহার পর তোমার রুগ্না মাতাকে লইয়া তুমি বৈদ্যনাথে চলিয়া গেলে। আমি সুযোগ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। তুমি যেদিন যাও , তাহার দুইদিন পূর্ব্বে বোধ হয় শুনিয়া গিয়াছিলে , হরিহর মুখোপাধ্যায়ের বিধবা কন্যাটি সহসা অন্তর্হিত হইয়াছে ; সে কাজ আমারই। আমিই সেই ব্রাহ্মণকন্যা মোক্ষদাকে গ্রামের বাহিরে – কেহ না সন্ধান করিতে পারে – এমন একটি গুপ্তস্থানে রাখিয়াছিলাম। সমাজের চক্ষে মোক্ষদা যতই দোষী হউক না কেন , সে তাহার দোষ নহে , তাহাদিগের কৌলীন্য-প্রথার দোষ। তোমার বৈদ্যনাথ যাইবার ছয় মাস পূর্ব্বে মোক্ষদার সহিত আমার পরিচয় হয়। মোক্ষদা আমাকে খুব ভালবাসিত – এখনও তাহার সেই ভাব। হায় , যদি তাহারই সেই নিঃস্বার্থ ভালবাসায় চিরমুগ্ধ থাকিতাম – যদি রূপৈশ্বর্য্যময়ী লীলা আমার চোখে না পড়িত ; এবং সেই একবার দর্শনে আমার হৃদয় মোহময় করিয়া না তুলিত , তাহা হইলে বোধহয় , পাপেই হউক , আর পুণ্যেই হউক , মোক্ষদাকে লইয়াই এ জীবনে এক রকম সুখী হইতে পারিতাম। সেকথা যাক্‌ , তাহার পর আমি গ্রামের মধ্যে রটনা করিয়া দিলাম , মোক্ষদার অপহণটি তোমার দ্বারাই হইয়াছে -”
কি নৃশংস !
“- তুমি মোক্ষদাকে আগে বৈদ্যনাথে পাঠাইয়া দিয়াছ , সেখানে তাহাকে কোন স্বতন্ত্র বাটীতে রাখিয়া , অপর একখানি বাটী ভাড়া করিয়া মাতাপুত্রে থাকিবে , এইরূপ অভিপ্রায়ে তুমি মাতার পীড়া উপলক্ষ করিয়া বৈদ্যনাথে গিয়াছ। তাহার পর কতকগুলা মিথ্যা প্রমাণ ঠিক করিয়া এখানকার সকলেরই নিকটে কথাটি খুব বিশ্বাস্য করিয়া তুলিলাম। নরেন্দ্র আর লীলার মা তোমাকে ভাল রকমে জানিতেন – তাঁহারা কথাটা প্রথমে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে শুনিয়াছিলেন বটে ; কিন্তু বিশ্বাস করেন নাই। তাহাতে আমার অভীষ্ট সিদ্ধির কোন ব্যাঘাত ঘটিল না। কেননা , লীলার পিতা ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই দেখিলেন না , এবং সহজেই বিশ্বাস করিলেন। তাহার পর দহ্যমান্‌ হস্তে একটি ক্ষুদ্র যূথিকাকে বৃন্তচ্যুত করিলাম। সেইদিন স্বহস্তে একটা অক্ষয় চিতা রচনা করিয়া নিজের – শুধু নিজের নহে – লীলার আর তোমার – এক সঙ্গে তিন জনের হৃদ্‌পিণ্ড ছিন্ন করিয়া সেই চিতানলে নিক্ষেপ করিলাম।”
শুনিয়া অনিবার্য্য ক্রোধে আমার শ্বাসরুদ্ধ হইল। মনে করিলাম , তখনই পদতলে দলিত করিয়া তাহার পাপ প্রাণটা এ পৃথিবী হইতে বাহির করিয়া দিই ; কিন্তু তখনই লীলাকে মনে পড়িল – সেই লীলা। এই দানব সেই দেবীরই স্বামী। আর সেই প্রবোধচাঁদ – তাহাকে কোন অপরাধে পিতৃহীন করিব?
ঈশ্বর যেন কখনও আমার এমন মতি না দেন। শশিভূষণকে হত্যা করিয়া কোন লাভ নাই ; কিন্তু সেইদিন হইতে প্রতিজ্ঞা করিলাম , সদুপায়ে হউক আর অসদুপায়ে হউক , যেমন করিয়া হউক , এই পাষণ্ডের পীড়ন হইতে লীলাকে মুক্ত রাখিবার জন্য প্রানপণ করিব ; এবং সেজন্য হিতাহিত বিবেচনাশূন্য হইব।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সপ্তাহ শেষে একদিন সন্ধ্যার কিছু পরে আমি শশিভূষণের সঙ্গে দেখা করিলাম। তখন সে একাকী তাহার একতল বৈঠকখানার উন্মুক্ত ছাদে বসিয়া মদ খাইতেছিল। এবং এক একবার এক একটা বিরাট রাগিণী ভাঁজিয়া সেই নির্জ্জন ছাদ এবং নীরব আকাশ প্রতিধ্বনিত করিতেছিল। কি জানি , কেন সেদিন শশিভূষণ আমার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিল না। তাহার সেই অপ্রসন্ন ভাব দেখিয়া বুঝিলাম , তাহার মনের অবস্থা আজ বড় ভাল নহে।

ক্রমে রাত দশটা বাজিয়া গেল। তখন আমি উঠিলাম। আমাকে উঠিতে দেখিয়া শশিভূষণ গলিল , ” চল , আমিও নীচে যাইব।” বলিয়া উঠিল।
বাড়ীর সম্মুখে একখানি ছোট সুন্দর বাগান। চারিদিকে ফলের গাছ , সম্মুখে নানাবিধ ফুলের গাছ , এবং রঞ্জিতপল্লব ক্রোটনশ্রেণীতে বাগানবাড়ী বেশ একরকম সুন্দর সাজান। ছাদের সোপান হইতে নামিয়াই আমরা সেই বাগানে আসিযা পড়িলাম।
তখন শশিভূষণ আমাকে বলিল , ” যোগেশ , তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।”
আমি বিস্মিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলাম।
শশিভূষণ বলিল , ” কাল হইতে তুমি আর এখানে আসিয়ো না , তুমি যে মৎলবে যাওয়া-আসা করিতেছ , আমি মাতাল বলে তাহা কি বুঝিতে পারি না? আমি তেমন মাতাল নই। সহজ লোক নও তুমি – চোরের উপর বাটপাড়ী করিতে চাও?”
কথাগুলি বজ্রাঘাতের ন্যায় আমার বুকে আঘাত করিল। সেদিন তাহারই মুখে তাহার নীচাশয়তার কথা শুনিয়া আমি ক্রোধে আত্মহারা হইয়াছিলাম। কেবল লীলার জন্য আমি দ্বিরুক্তি করি নাই – করিতে পারি নাই। আজ সহসা শশিভূষণের এই কটূক্তি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় সবেগে আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল। আজ ক্রোধ সম্বরণ আমার পক্ষে একান্ত অসাধ্য হইয়া উঠিল। আমি বলিলাম , ” শশিভূষণ , তুমি পশু অপেক্ষা অধম , তোমার মন যেমন কলুষিত , তাহাতে তুমি এইরূপ না বুঝিয়া ইহার অধিক আর কি বুঝিবে? আমার মনের ভাব বুঝিতে তোমার মত নারকীর অনেক বিলম্ব আছে ; কেবল লীলার মুখ চাহিয়াই আমি তোমার অমার্জ্জনীয় অপরাধ সকল উপেক্ষা করিয়াছি।”
শশিভূষণ বিকৃত কণ্ঠে কহিল , ” লীলা , লীলা তোমার কে? তুমিই বা লীলার কে – তাহার কথা লইয়া তোমারই বা এত আন্তরিকতা প্রকাশ কেন? আমি আমার স্ত্রীকে যাহা খুসী তাহাই করিব , তাহাতে তোমার এত মাথাব্যাথা কেন হে? আমি কি কিছু বুঝি না বটে? যাও যাও , তোমার মত ভণ্ড তপস্বী আমি অনেক দেখিয়াছি। মারের চোটে গন্ধর্ব্ব ছুটিয়া যায় , তাহাতে আর আমি তোমার চিন্তাটি লীলার মাথার ভিতর হইতে বাহির করিয়া ফেলিতে পারিব না?”
আমি অনিবার্য্য ক্রোধে আত্মসম্ভ্রমবোধশূণ্য হইলাম। কহিলাম , ” শোন শশিভূষণ , আমি জীবিত থাকিতে তুমি লীলার একটি মাত্র কেশের অপচয় করিতে পারিবে না। ইহার পর লীলার প্রতি যদি কখনও তোমার কোন অত্যাচারের কথা শুনি , সেই দণ্ডে আমি তোমাকে খুন করিব। তাহাতে যদি আমাকে ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলিতে হয় , তাহাও শ্রেয়ঃ – আমি আর কখনই তোমাকে ক্ষমা করিব না।”
শশিভূষণ অত্যন্ত রোষাবিষ্ট হইয়া , মস্তকান্দোলন করিয়া কহিল , ” বেশ বেশ , কে কাহাকে খুন করে দেখা যাবে। আগে আমি লীলাকে খুন কর্‌ব – তারপর তোকে খুন কর্‌ব – ‘কি স্পর্ধা , লীলার একটা কেশের অপচয় কর্‌লে আমাকে খুন কর্‌বে ! আমি যদি আজ লীলার রক্ত-দর্শন না করি , তাহলে আমার নাম শশিভূষণ নয় ; দেখি , তুই আমার কি করিস্‌।”
দুর্বৃত্ত তখন অত্যন্ত মাতাল হইয়াছিল ; তাহার সহিত আর কোন কথা কহা যুক্তি-সঙ্গত নহে মনে করিয়া , আমি তাহার বাগান হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। সে চলিয়া গেল , কি দাঁড়াইয়া রহিল , একবার ফিরিয়া দেখিলাম না।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

রাস্তায় আসিয়া মনটা বড়ই খারাপ হইয়া গেল। নিজেকে বারংবার ধিক্কার দিতে লাগিলাম। কেন আমি শশিভূষণকে এমন রাগাইয়া দিলাম? এই রাগের মুখে হয় ত আজ মদোন্মত্ত পিশাচ অভাগিনী লীলাকে কতই না যন্ত্রণা দিবে? এতদিন এত সহিয়াছি – আজ কেন আমি এমন করিলাম? কি কুক্ষণে কোন্‌ দুর্ম্মুখের মুখ দেখিয়া আজ আমি শশিভূষণের সহিত দেখা করিতে , বাটীর বাহির হইয়াছিলাম। কেন আমি এমন সর্ব্বনাশ করিলাম ! হায় হায় ! আমি লীলার ভাল করিতে গিয়া অগ্রেই তাহার মন্দ করিয়া ফেলিলাম ! মনুষ্য যা মনে করে – নির্দ্দয় বিধাতা এমনই তাহার বিপরীত ঘটাইয়া দেয়।

আমার মানসিক প্রবৃত্তি সমূহে তখন কেমন একটা গোলমাল পড়িয়া গেল। কি ভাবিতেছি – কি ভাবিতে হইবে – কি হইল , এইসব তোলাপাড়া করিতে করিতে যেন আমি কতকটা আত্মহারা হইয়া গেলাম। অশেষ সদ্‌গুণাভরণা , সৌম্যশ্রী লীলার সুখ দুঃখ যে এখন এমন একটা দয়াশূণ্য , ক্ষমাশূণ্য , নিষ্ঠুরতম বর্ব্বরের হাতে নির্ভর করিতেছে , এ চিন্তা প্রতিক্ষণে আমার হৃদয়ে সহস্র বৃশ্চিক দংশনের জ্বালা অনুভব করাইতে লাগিল। কি করিব ? কোন উপায় নাই। নিজের বুকে বিষাক্ত দীর্ঘ ছুরিকা শতবার আমুল বিদ্ধ করিতে পারি ; কিন্তু মুঢ় শশিভূষণের গায়ে একবার একটা আঁচড় দিই , এমন ক্ষমতা আমার নাই।
নির্জ্জন পথিমধ্যে প্রতিমুহূর্ত্তে আমার বেশ স্পষ্ট অনুভব হইতে লাগিল যে , নির্ব্বিঘ্নে চিন্তারাক্ষসী আমার হৃদ্‌পিণ্ড শোষণ করিয়া রক্তশোষণ করিতেছে। আমি মুমূর্ষের ন্যায় গৃহে ফিরিলাম। তাহার পর – হে সর্ব্বজ্ঞ ! সর্ব্বশক্তিমান ! তুমি জান প্রভো ! তাহার পর যাহা ঘটিয়াছিল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

হায় , পরদিন প্রভাতের সেই লোমহর্ষণ ঘটনার সেই ভয়ঙ্করী স্মৃতির হাত হইতে আমি কি মরিয়াও অব্যাহতি পাইব ? তখন বেলা ঠিক দশটা। এমন সময়ে নরেন্দ্রনাথ ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া আসিয়া আমার ঘরে প্রবেশ করিল। দেখিলাম , তাহার মুখ বিবর্ণ , এবং দৃষ্টি উন্মাদের। মুখ চোখের ভাবে যেন একটা কোন ভীষণতার ছায়া লাগিয়া রহিয়াছে। দেখিয়া শিহরিয়া উঠিলাম। নরেন্দ্রনাথ দৃঢ়মুষ্টিতে আমার জামাটা ধরিয়া এমন একটা টান দিল , আর একটু হইলে বা জামাটা অধিক দিনের পুরাতন হইলে তাহাতেই সেটা একেবারে ছিঁড়িয়া যাইত। নরেন্দ্রনাথে ব্যাকুল কণ্ঠে কেবল বলিতে লাগিল , ” যোগেশ দা সর্ব্বনাশ হয়েছে। যা ভেবেছিলাম , তাই হয়েছে – একেবারে খুন , আর উপায় নাই , যোগেশ দা কি হবে – তুমি চল – শীঘ্র ওঠো – এমন খুনে সে -”
আমি বিস্ময়বিহ্বলচিত্তে দাঁড়াইয়া উঠিলাম। সেই মুহূর্ত্তে একটা অনিবার্য্য বিমূঢ়তা আসিয়া আমার মস্তিষ্ক এমন পূর্ণরূপে অধিকার করিয়া বসিল যে , আমি নরেন্দ্রের কথা কিছুতেই হৃদয়সঙ্গম করিতে পারিলাম না। আমি তাহাকে একান্ত উৎকণ্ঠিত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম , ” কি হয়েছে নরেন , আমি তোমার কথা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
দেখিলাম , নরেন্দ্রনাথের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ। সে কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল , ” সর্ব্বনাশ হয়েছে যোগেশ দা! লীলা নাই – শশিভূষণ কাল রাত্রে লীলাকে খুন করিয়াছে। পুলিশের লোক শশিভূষণকে গ্রেপ্তার করেছে।”
আর শুনিতে পাইলাম না , বজ্রাহতের ন্যায় সেইখানে নিঃসংজ্ঞ অবস্থায পড়িয়া গেলাম।
যখন কিছু প্রকৃতিস্থ হইলাম , দেখি , নরেন্দ্রনাথ পাশে বসিয়া আমার চোখে মুখে জলের ছিটা দিতেছে।
আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া তাহাকে বলিলাম , ” আর কিছু করিতে হইবে না। সহসা এ ভয়ানক কথাটা শুনিয়াই – যাক , তুমি বলিতেছিলে না শশিভূষণকে পুলিসের লোক গ্রেপ্তার করেছে ?”
নরেন্দ্রনাথ কহিল , ” তাহাকে অনেকক্ষণ চালান দিয়াছে , চালান দিতে শশিভূষণের উপরে বড় একটা জোর-জবরদস্তি করিতে হয় নাই , সে একটা আপত্তিও করে নাই – নিজেই ধরা দিয়াছে। হয়ত শশিভূষণের তখনও নেশার ঝোঁক ছিল। যাই হোক , তুমি একবার চল যোগেশ দা , এ সময়ে তোমার একবার যাওয়া খুবই দরকার – যদি কোন একটা উপায় হয়।”
আমি কম্পিতকণ্ঠে , কম্পিত-হৃদয়ে , এবং অক্ম্পিত-কলেবরে ভীতি-বিহ্বলের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিলাম , ” কোথায় ? লীলাকে দেখিতে ? দাঁড়াও – দাঁড়াও – নরেন্দ্র , আমায় একটু প্রকৃতিস্থ হতে দাও – আমি বুঝিতে পারিতেছি না , আমার বুকের ভিতর যেন কি হইতেছে।”
আমার ভাবভঙ্গি দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ আমার মনের অবস্থা সম্যক্‌ বুঝিতে পারিয়াছিল। আমার কথায় সম্মত হইল ; কিন্তু সে একান্ত অধীরভাবে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে দেখিয়া আমি আর বড় বিলম্ব করিলাম না – তখনই বাহির হইলাম।

নবম পরিচ্ছেদ

যথাসময়ে আমরা শশিভূষনের বাটীতে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। সেখানে উপস্থিত হইয়া যাহা দেখিলাম , এ কাহিনীর মধ্যে একান্ত উল্লেখযোগ্য হইলেও , তাহা আমি বলিতে ইচ্ছা করি না। সেজন্য আমাকে ক্ষমা করিবেন।
এই হত্যা-সম্বন্ধে শশিভূষণের বিরুদ্ধে যেসকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে , তাহাতে সেই যে দোষী , সে সম্বন্ধে আর কাহারও কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। গতরাত্রে উদ্যানমধ্যে আমার সহিত শশিভূষণের যে সকল কথা হইয়াছিল , একজন দাসী তাহা শুনিয়াছে , সে নিজের জোবানবন্দীতে আমাদের মুখনিঃসৃত প্রত্যেক কথাটিরই পুনরাবৃত্তি করইয়াছে। প্রাতঃকালে লীলার মৃতদেহ বিছানার পাশে পড়িয়াছিল এবং তাহার বক্ষে একখানি ছুরিকা আমূল প্রোথিত ছিল ; সে ছুরিখানি শশিভূষণের নিজেরই ছুরি। অনেকেই সেই ছুরিখানি তাহার বৈঠকখানা ঘরে অনেকবার দেখিয়াছে। সেরকম ধরণের প্রকাণ্ড ছুরি সে গ্রামের মধ্যে আর কাহারও ছিল না। শশিভূষণের বিরুদ্ধে আরও একটা বিশেষ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে যে , গতরাত্রে শয়নকালে তাহাদিগের স্ত্রীপুরুষের মধ্যে একটা অত্যধিক বাগ্বিতণ্ডা হইয়াছিল। এবং শশিভূষণ তাহাকে অত্যধিক প্রহার করিয়াছিল। লীলার কপালে একটা মুষ্ট্যাঘাতের চিহ্ণও ছিল। তাহা ডাক্তারী পরীক্ষায় এইরূপ স্থিরীকৃত হয় যে , মৃত্যুর দুই-একঘণ্টা পূর্ব্বে তাহাকে সে আঘাত করা হইয়াছিল।
এসকল প্রতিপাদ্য প্রমাণ সত্ত্বেও সে যে স্ত্রীহন্তা , তাহা শশিভূষণ অখনও স্বীকার করিতে সম্মত নহে। সে অবিচলিতভাবে এখনও বলিতেছে , সে সম্পূর্ণ নিরপরাধ। তাহাকে ফাঁসীই দাও – মায় – কাট – খুন কর – যা ইচ্ছা তাই কর – সেজন্য সে কিছুমাত্র দুঃখিত নহে। শশিভূষণ সর্ব্বসমক্ষে এখনও স্বীকার করিতেছে যে , সে তাহার পত্নীর প্রতি অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করিত , মদের খেয়ালিই তাহার একমাত্র কারণ ; নতুবা সে তাহার স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালবাসিত ; এক্ষণে লীলাকে হারাইয়া তাহার জীবন একান্ত দুর্ব্বহ হইয়া উঠিয়াছে। জীবন ধারণে তাহারে তিলমাত্র ইচ্ছা নাই। শশিভূষণের এসকল কথা কতদূর সত্য , তাহা বিবেচনা করিবার শক্তি আমার তখন ছিল না। আরও শুনিলাম , আমার সহিত দেখা করিবার তাহার বড়ই আগ্রহ। যে কেহ তাহার সহিত দেখা করিতে যাইত , তাহাকেই সে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিত , আমি যেন একবার যাইয়া তাহার সহিত দেখা করি।
শশিভূষণের সহিত দেখা করিবার আমার ততটা ইচ্ছা ছিল না ; কিন্তু তাহার এইরূপ বারংবার আগ্রহ প্রকাশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একদিন আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম।

দশম পরিচ্ছেদ

নিজের হাজত ঘরে আমাকে উপস্থিত দেখিয়া শশিভূষণ অত্যন্ত আল্হাদিত হইল ; এবং আমার উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়াছে বলিয়া – আরও আমার সহিত যে সমুদয় অন্যায় ব্যবহার করিয়াছে , তাহার উল্লেখ করিয়া বারংবার আমার নিকটে অশ্রু-সংরুদ্ধকণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিল। তাহার পর বলিল , ” ভাই যোগেশ , তুমি আমাকে ক্সমা করিলে ; কিন্তু অভাগিনী লীলা কি এমন নরকের কীটকে কখন ক্ষমা করিবে ? আমি আজ আমার পাপের ফল পাইলাম। ধর্ম্মের বিচার অব্যাহত – আজ না হউক , দুদিন পরে নিশ্চয়ই সকলকে স্বকৃত পাপ-পুণ্যের ফলভোগ করিতে হইবে , কেহই তাহার হাত এড়াইতে পারে না। আমি লীলার প্রতি যে সকল নিষ্ঠুরাচরণ করিয়াছি , বোধ করি , কোন কঠোর রাক্ষসেও তাহা পারে না। আমি মনুষ্য নামের একান্ত অযোগ্য – আমার ন্যায় মহাপাপীর নাম এ জগৎ হইতে চিরকালের জন্য মুছিয়া যাওয়াই ভাল। ভাই যোগেশ , আজ সকলেই বিশ্বাস করিয়াছে , আমি লীলার হত্যাকারী। তুমিও যে এরূপ বিশ্বাস কর নাই , তাহাও নহে। জগতের সকলেরই মনে আমার মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এই ধারণা – এই বিশ্বাস চিরন্তন অটুট এবং অটল থাকিয়া যাক্‌ – বরং তাহাতে আমি সুখী ; কিন্তু যোগেশ , তুমি যেন আর সকলের মত তাহা মনে করিয়ো না , এই কথা বলিবার জন্যই আমি তোমার সহিত দেখা করিতে এত উৎসুক হইয়াছিলাম। আমার সত্য নাই – ধর্ম্ম নাই – এমন কিছুই নাই , যাহা সাক্ষ্য করিয়া স্বীকার করিলে তুমি কিছুমাত্র বিশ্বাস করিতে পার – আমি ধর্ম্মবিচ্যুত , মনুষ্যত্ত্ব-বিসর্জ্জিত , সয়তানের মোহমন্ত্রপ্রণোদিত , জগতের অকল্যাণের পূর্ণ প্রতিমূর্ত্তি – আমার কথায় কে বিশ্বাস করিবে ? ভাই যোগেশ , তুমি তাই অবিশ্বাস করিয়ো না , তাহা হইলে মরিয়াও আমার সুখ হইবে না – এ জগতে এমন একজন থাক্‌ , সে যেন জানে , আমি একটা মহাপাপী ছিলাম বটে , কিন্তু স্ত্রীহন্তা নই।”
বলিতে বলিতে শশিভূষণের কণ্ঠ কম্পিত এবং বাষ্পরুদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। সে দুই হাতে মুখ চাপিয়া বালকের ন্যায় কাঁদিতে লাগিল।
বলিতে কি তাহার সেই সকরুণ অবস্থা তখন আমার মর্ম্মভেদ ও সহানিভূতি আকর্ষণ করিয়াছিল। অনেক করিয়া তাহার পর আমি তাহাকে শান্ত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , ” শশিভূষন , এ পর্য্যন্ত যাহা ঘটিয়াছে , তুমি অকপটে সব আমাকে বল ; কোন কথা গোপন করিতে চেষ্টামাত্রও করিয়ো না। যদি এ দুঃসময়ে আমি তোমার কোন উপকারে আসিতে পারি।”
শশিভূষণ বলিল , ” আমি প্রভাতে উঠিয়া প্রথমেই দেখিলাম , লীলা রক্তাক্ত হইয়া আমার বিছানার পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। ধরিয়া তুলিতে গেলাম – দেখিলাম , দেহে প্রাণ নাই। দেখিয়াই আমার বুকের রক্ত স্তম্ভিত হইয়া গেল। বুঝিলাম , লীলা এ পিশাচকে জন্মের মত পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে – বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে খুঁজিলে আর তাহাকে ফিরিয়া পাইব না – পাইবার নহে। বলিতে কি , যোগেশ প্রথমে আমার বোধ হইল , মদের ঝোঁকে আমিই তাকে রাত্রে হত্যা করিয়াছি। তাহার পর যখন দেখিলাম , আমারই ছুরিখানা , লীলার বুকে তখনও আমূলবিদ্ধ রহিয়াছে , তখন আমার সে ভ্রম দূর হইল। আমার এখন বেশ মনে পড়িতেছে , ছুরিখানি আমার বৈঠকখানায় যেখানে থাকিত , সেখানে ছুরিখানা কাল রাত্রে দেখিতে পাই নাই , পরে খুঁজিয়াও কোথাও পাওয়া গেল না। আমি সে কথা তখনই লীলাকে বলিয়াছিলাম। সেজন্যই মনে একটু সন্দেহ হইতেছে ; নতুবা এখনও আমার মনে বিশ্বাস , কাণ্ডজ্ঞানহীন আমিই লীলার হত্যাকারী ; কিন্তু সেই ছুরিখানা যোগেশ , আরও ইহার ভিতরে আর একটা কথা আছে , আমার বোধ হয় – ঠিক বলিতে পারি না – যদি – যদি -”
শশিভূষণকে ইতস্ততঃ করিতে দেখিয়া নিজেও যেন একটু ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিলাম। সে ভাব তখনই সামলাইয়া আমি তাহাকে বলিলাম , ” কথা কহিতে এমন সঙ্কুচিত হইতেছ কেন ? তুমি যা জান বা বোধ কর , আমাকে স্পষ্ট বল।”
শশিভূষণ বলিল , “লীলার বুকে ছুরি বসাইতে পারে , একজন ছাড়া তাহার এমন ভয়ানক শত্রু আর কেহ না। তাহারই উপর আমার কিছু সন্দেহ হয় -”
আমি অত্যধিক ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম , ” কে সে ? – প্রকাশ কর নাই কেন ?”
শশিভূষণ অনুচ্চস্বরে বলিল , ” তুমি তাহাকে জান , আমি মোক্ষদার কথা বলিতেছি। যেদিন আমার বিবাহ হইয়াছে , সেইদিন হইতে মোক্ষদাও ভিন্নমূর্ত্তি ধরিয়াছে। কি একটা হতাশায় সে যেন একেবারে মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। অনেকবার সে আমাকে শাসিত করিয়া বলিয়াছে , ‘ইহার ফল তোমাকে ভোগ করিতে হইবে – আমি যে-সে নই – তবে আমার নাম মোক্ষদা। একবাণে কেমন করিয়া দুটা পাখী মারিতে হয় – আমা হতেই তা একদিন তুমি দেখিতে পাইবে।”
শশিভূষণ আবার দুইহাতে দুই চক্ষু আবৃত করিয়া কাঁদিতে লাগিল।
আমি অতিশয় চকিত হইয়া উচ্চকণ্ঠে বলিলাম , ” অসম্ভব ; তাহা কি কখনও হয় ?”
অনুতাপদগ্ধ রোরুদ্যমান্‌ শশিভূষণ বলিল , ” তাহা না হইলেও আমি তোমাকে বিশেষ অনুনয় করিয়া বলিতেছি , লীলার প্রকৃত হত্যাকারীকে , যাহাতে তুমি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পার , সেজন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিবে।” যাহার পর মুখ হইতে হাত নামাইয়া তাহার অশ্রুসিক্ত করুণ দৃষ্টি আমার মুখের উপর স্থাপন করিয়া বলিতে লাগিল , ” ভাই যোগেশ , তুমি মনে করিতেছ , আমার নিজের জন্য তোমাকে আমি এমন অনুরোধ করিতেছি – তাহা ঠিক নয় , আমার ফাঁসী হউক আর না হউক , সেজন্য আমি কিছুমাত্র চিন্তিত নহি , একদিন ত সকলকেই মরিতে হইবে – তা দুইদিন আগে আর পরে ; কিন্তু – কিন্তু যোগেশ , যখনই মনে হয় যে , লীলার হত্যাকারী তাহার এ নৃশংসতার কোন প্রতিফল পাইবে না -”
বলিতে বলিতে শশিভূষণের অশ্রুময় দৃষ্টি সহসা মেঘকৃষ্ণ রাত্রের তীব্র বিদ্যুদগ্নির ন্যায় ঝলসিয়া উঠিল। এবং এমন দৃঢ়রূপে সে নিজের হাত নিজের মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ধরিল যে , হাতের কব্জিতে নখরগুলা বিদ্ধ হইয়া রক্তপাত হইতে লাগিল।
যদিও আমি শশিভূষণকে অতিশয় ঘৃণার চোখে দেখিতাম , কিন্তু এখন তাহাকে নিদারুণ অনুতপ্ত এবং মর্ম্মাহত দেখিয়া আমার সে ভাব মন হইতে একেবারে তিরোহিত হইয়া গেল। শোকার্ত্ত শশিভূষণের সেই কাতরতায় আর আমি স্থির থাকিতে পারিলাম না। বলিলাম , ” শশিভূষণ , যেমন করিয়া পারি , তোমার নির্দ্দোষিতা সপ্রমাণ করিব। এখন হইতেই আমি ইহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিব।”
এইরূপ প্রতিশ্রুতির পর আমি তাহার নিকটে সেদিন বিদায় লইলাম।

Pages: 1 2
Pages ( 1 of 2 ): 1 2পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress