স্মার্ট গাই
চোখ মেলে সত্যেন চ্যাটার্জি চারদিকে ঘন অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। দুর্ভেদ্য, নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।
প্রথমে মনে হয়েছিল মাঝরাতে ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু শহরের মাঝরাত, সুখী গৃহকোণের মাঝরাতেও তো এমন অন্ধকার হয় না! ঘরে মৃদু নীল, রাস্তা থেকে রক্ষী আলো। পাশে একটা ঘুমন্ত, নিশ্চিন্ত মানবশরীরের নরম উষ্ণতা, যা এক রকমের আলোই। এখানে ঠান্ডা, জলে-জলে ভিজে ভিজে ভাব চারদিকে এবং…এবং… অন্ধকার…ত্রিলোক অন্ধ করা। আরে! এ তো তবে মৃত্যুর পরবর্তী অন্ধকার! নরকের! কেননা সে তো একটা মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল! বাঁচার কথা নয়! সে মানবলীলা সংবরণ করেছে। দপ করে মনে পড়ল গর্জমান সাইক্লপস-চোখ। বিকট বিধবংসী আওয়াজ আর তারপর অন্ধ তমস। গা হিম করা ভয়ে চোখ বুজল সে। মরলে তবে মানুষ প্রথম এই অন্ধকারে আসে? তারপর? তারপর কী ভাবতে গিয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল তার। কীসের লোম? গায়ের? গা কোথায়? কেন? কী করে? তখন সে বুঝল, কপালজোরে যে গুটিকতক লোক মরিয়াও মরে না সে সেই বিরল প্রজাতির। সে মরে নাই।
আকাশে ছিন্ন কাঁথার মধ্যে দিয়ে মলিন আলল। চোখ-সওয়া হয়ে যাচ্ছে অন্ধকার। ওই তো মরণ আলিঙ্গনে পরস্পরকে আঁকড়ে ধসে রয়েছে দানব ট্রাক আর তার নীল ইন্ডিকা। ট্রাকটার পশ্চাদ্দেশ মোটামুটি অক্ষত, কিন্তু নীল ইন্ডিকাখানা ট্রাকের দুমড়ানো সম্মুখভাগের তলায় ঢুকে গেছে। একেবারে পিণ্ডাকৃতি। আসলে সে ড্রাইভারের সিট থেকে ছিটকে পড়েছিল। কী করে সে জানে না। ডানদিকের দরজাটা কিছুদিন থেকেই একটু গোলমাল করছিল। গ্যাসকেট-ফ্যাসকেটের ব্যাপার আর কী? গারাজে যায যাব করে যাওয়া হচ্ছিল না, এত্তো বিজি শিডিউল…যাব যাব করে…সেই আলগা দরজাই তাকে বাঁচিয়েছে। কে বাঁচাল? আলগা দরজা? না সাত রতির রক্তপ্রবাল প্লাস তিন রতির নীলা? না কি? সে হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকায়—হে জগদীশ্বর, আর কেউ নয়, তুমি…তুমিই বাঁচিয়েছ। আমার ওপর তোমার অনিঃশেষ করুণা হে বিধাতা! তার চোখ দিয়ে গরম জল বেরিয়ে এল।
দিল্লি রোড বম্বে রোড যেখানটায় বিভক্ত হয়ে গেছে সেই মোড়টার কাছাকাছি ঘটেছিল দুর্ঘটনাটা। তারা ফিরছিল। লিজি আর সে। ভোরবেলা পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েই আবার অফিস ছুটতে হবে। সারা সপ্তাহের নিচ্ছিদ্র খাটুনির পর এইসব বিনোদন। তার আলসে-মেজাজ আর তারপর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে উল্লসিত উত্তেজনাময় ড্রাইভিং। সত্তর…আশি…আশি ছাড়াচ্ছে…নব্বই…। লিজ বলছে আরও জোরে। যেন মিলনমুহূর্তের তুঙ্গ শীৎকারে, সমস্ত শরীরে চারিয়ে যায় উন্মাদনা। অদূরে সাইক্লপস চোখ হঠাৎ…গাঁ গাঁ, প্রাণপণে গাড়ি ডাইনে ঘোরাবার চেষ্টা। বিকট আওয়াজ। অন্ধকার।
আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে নিজের শারীরিক অবস্থাটাকে বুঝে নিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সে। সারা শরীরে ব্যথা। কিন্তু সেরকম যন্ত্রণা নেই। হাড় ভাঙেনি। গরম সুটের দৌলতে শরীরটা সুরক্ষিত। কপালের ওপর একটা জায়গা জ্বালা করছে, হাতের পাতায়ও। বোধ হয় ভালোই ছড়েছে, উঠে দাঁড়িয়ে কোট থেকে ধুলো ঝাড়তে লাগল সে, পড়েছে একটা ঘেসো মাঠে। হাইওয়ের পাশে এরকম থাকে আকছার। কে জানত সেসব আয়োজন সত্যেন চ্যাটার্জির প্রাণ বাঁচানোর জন্য? কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে ঘাসভূমিকে চুম্বন দেয় চ্যাটার্জি। ক্রিকেটার ফুটবলাররা ম্যাচ জিতে যে-রকম দেয়। হাঁটুতে বেশ আড়ষ্ট ব্যথা লাগল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সত্যেন, ঘটনার জন্য, দুর্ঘটনার জন্য, লাভ লোকসানের অনুপাত কষে নেওয়া এক সুখ-দুঃখে মিশ্রিত পবিত্র কান্না। এবং, আর একটু পরে মাঠ পার হয়ে সাবধানে রাস্তার দিকে এগোতে থাকল সে।
আশ্চর্য! এ রাস্তা দিয়ে এখন তো মিনিটে মিনিটে ট্রাক যায়! একটাও?…নাঃ আসছে একটা, চোখে আলো পড়তেই হাত তুলতে গিয়েছিল, পরক্ষণেই আতঙ্কে মুখ ঢাকল সত্যেন। কী সর্বনাশ! সাহায্য কী? এখন সাহায্যের মানে কী?
ট্রাকটা চলে গেল প্রচণ্ড বেগে। কী একটা খড়মড়ে জিনিস উলটেপালটে ভাঙছে। তার চাকায়। ভ্রূক্ষেপও করল না। মত্ত ড্রাইভার, ঘোরে আছে। চাঁদ পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে এবার। সেই আলোয় সত্যেন আশ্চর্য হয়ে দেখল তারই গাড়ির নাম্বারপ্লেট, তিন-চার টুকরোয় ভাঙা, কিন্তু…তার পায়ের কাছে তারই গাড়ির আইডেনটিটি পৌঁছে দিয়ে গেছে মত্ত ট্রাক, কিংবা ট্রাক নয়…আসলে সেই সর্বশক্তি যিনি মারেন, বাঁচান। জল-উপছোনো চোখে সে ত্বরিয়ে লে নিল টুকরোগুলোকে, একটার পর একটা তাসের মতো সাজাল। অদূরে একটা লম্বা জলাশয় চিকচিক করছে, গলা থেকে টাইটা খুলে নিয়ে টুকরোগুলোকে পরম যত্নে বাঁধল সে, সঙ্গে বাঁধল একটা বড়োসড়ো পাথরের টুকরো। সব তার জন্য এই মধ্যরাতের বধ্যভূমিতে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। আকাশের দিকে তাকাল একবার। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে জিনিসটা মাঝপুকুরে ছুঁড়ে দিল। যেমন করে চাকার বল ছোড়ে। ধুপপপ চমৎকারভাবে ডুবে গেল আইডেনটিটি।
এবার সে অনেক সাহস সঞ্চয় করে তালগোল পাকানো অকুস্থলের দিকে যায়। ট্রাকটা যেন দু-পা তুলে আহত ঘোড়ার মতো সামনে লাফিয়ে উঠেছে, ভাঙা দরজা দিয়ে ঝুলছে একটি মৃতদেহ। মুখের জায়গায় একটা মাংসের রক্তাক্ত চাঙড়। অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছে। ইন্ডিকাটা ঢুকে গেছে ভেতরে। তার সামনে পেছন বলে আর কিছু নেই। একটা অসমান বিকৃত বস্তুপিণ্ড এবং সেই পিণ্ডের সঙ্গে পিণ্ডাকৃতি হয়ে, শিউরে উঠল সত্যেন, জড়িয়ে গেছে লিজের দেহ। খুব সাবধানে লাইটার জ্বালিয়ে দেখল—ধড় মুণ্ড বলে আলাদা কিছু নেই। বীভৎস! তার ভেতর থেকে প্রবল একটা বমির ভাব উঠে আসছে। কিছু নেই। কিছু অবশিষ্ট নেই। ট্রাঙ্কে তাদের ব্যাগগুলো ছিল। তাদের অস্তিত্বই বুঝতে পারল না সত্যেন। অকুস্থল থেকে সরে এসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল সে। বমিটাকে আটকাতে পারল না। ঘাসের ওপর উগরে দিল ভয়, ঘৃণা, তারপর একটু সুস্থ হতেই কী মনে পড়ল—সে নিজের পাশ পকেটে, হিপ পকেটে, বুক পকেটে হাত রাখল। পার্স, পার্স, গোছা গোছা টাকা। ক্রেডিট কার্ড। লাইসেন্স, এমনকি রুমাল সহ সব। পরিষ্কার গুছিয়ে রাখা, যেন পোশাকের সঙ্গে সেলাই করে দিয়েছে কেউ। সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এল। ভগবান, ওহ ভগবান, অগতির গতি! অবলের বল হে! একবার লাইটারটা আবার বার করল। জ্বালিয়ে দেবে? নাহ। আগুন এখন বহু দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, বিস্ফোরণ হতে পারে, বলতে কী সে নিজেও ঝলসে যেতে পারে অল্পবিস্তর। তা ছাড়া খোদার ওপর খোদকারি করার দরকারটাই বা কী! তিনি যখন যেচে পড়ে তাকে এমন রক্ষা করেছেন। যা নিতান্তই দুর্ঘটনা অগ্নিযোগ করলে সেটা প্রমাণ লোপের চেষ্টা বা অপরাধে পরিবর্তিত হবে। সে তো অপরাধী নয়! এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ীও সে নয়। মেজাজে গাড়িটা চালাচ্ছিল সে। দোষ ওই ট্রাক ড্রাইভারের, ব্যাটা মাতাল ছিল। ঘোর মাতাল, পুলিশ ওর পেটে পিপে-ভরতি দেশি পাবে। সে কলকাতা নগরীর দিকে হাঁটা দিল। তার শহর, তার আশ্রয় ও প্রশ্রয়।
স্টেশনের রিটায়ারিং রুম ভাড়া নিয়ে সারাদিন নিজের পরিচর্যা করল সত্যেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সুটটার কোথাও ফাটা-ফোঁটা হয়েছে কি না। নেই, তা সত্ত্বেও একজন অ্যাটেনড্যান্ট জোগাড় করে সুটটা ইস্ত্রি করিয়ে আনল, জুতো জোড়া পালিশ করাল, কপালের ওপরটা ভালো ছড়েছে। একবার ভাবল পট্টি লাগাবে। তারপর ভাবল সেক্ষেত্রে কৈফিয়ত দিতে হবে, তারপর ভাবল পট্টি না লাগালেও কৈফিয়ত অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং সে হাতে ও কপালে পট্টি লাগাল। চানটান করে ভালো করে ব্রেকফাস্ট করল, প্রেস করা সুটটা পরল, একটা ট্যাক্সি নিয়ে থানায় গেল, বালিগঞ্জ থানা, নিজের গাড়িটা মিসিং ডায়েরি করাল, তারপর দোকানে গিয়ে অবিকল আগেরটার মতো একটা টাই কিনে পরল, অবিকল আগেরটার মতো ওভারনাইট ব্যাগ। যে রকম দুটো স্টোনওয়াশ জিনস, নাইট-সুট ও টি-শার্ট নিয়ে গিয়েছিল সেগুলো কিনে ব্যাগটা ভরতি করে ফেলল। কটেজ ইন্ডাস্ট্রির দোকানে গিয়ে একটা শ্রীনিকেতনী লেডিজ ব্যাগ কিনে ফেলল। যেখানেই যায় মণির জন্য সে কিছু-না-কিছু উপহার আনে। তারপর বাড়ি ফিরে এল, পূর্ণদাস রোডে তার চমৎকার ফ্ল্যাট, যাকে বাড়ি বলাই যায়।
এখন মণি থাকবে না, সে স্কুলে গেছে। নার্সারি অ্যান্ড কিন্ডারগার্টেন। সাতটায় বেরোয়, দেড়টা-দুটোয় ফেরে। আর ঋত, ঋতম? সে-ও এখন স্কুলে। ঢোকবার আগে একটা কোচিং নিয়ে ঢোকে। কোন ভোরে তার মা উঠে তাকে ব্রেকফাস্ট করে দেয়। বেশ ভারী। তারপর টিফিনবাক্স ভরে দেয়। ফলটল বা কোনো মুখরোচক জাঙ্ক ফুড খেতে হলে টাকাপয়সা থাকে পকেটে। মণিমালার জেদ ঋতমকে তার বাবার মতো হতে হবে, যদি না তার চেয়েও বড়ো হয়।
চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল সত্যেন। সত্যেন ও মণিমালা দুটো নামই পুরনো ধরনের বলে তাদের দরজায় লেখা আছে এস চ্যাটার্জি, এম, চ্যাটার্জি, ঋতম চ্যাটার্জি। এই এস এম ঋতমের মধ্যে দিয়ে সত্যেন চ্যাটার্জি তার আইডেনটিটি কার্ডের মধ্যে ঢুকে গেল। ছবি হ্যান্ডসাম, বয়স–চ্ছ, ঠিকানা প্রারম্ভিকা ২৫ পূর্ণদাস রোড, কলকাতা…। পেশা-সার্ভিস, অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার এফ আর ইন্ডাস্ট্রিজ, ফোন…। মাঠের মতো লিভিংরুমের নিবিড় কার্পেটের ওপর শব্দহীন মার্জার চরণে সে শোবার ঘরের আয়ত আলস্যের মধ্যে এসে পৌঁছোল। প্রশস্ত ডবল বেডের পুষ্পিত আবরণী তাকে স্বাগত জানাচ্ছে, স্বাগত জানাচ্ছে দেয়াল থেকে হাস্যমুখ ফ্যামিলি অ্যালবাম। সত্যেন-মণি, মণি-সত্যেন, সত্যেন-মণি-ঋতম, মণি-ঋতম, সত্যেন-ঋতম হাস্যমুখ। বাপের হাসিতে সংযত আহ্বাদ, মা গরবিনি, পুত্র স্বাভাবিক শিশু-বালক হাসিতে স্নেহ-সুখ-জাগানিয়া। এ ছাড়াও আছে, বাঙ্গালোরে ম্যানেজমেন্ট স্নাতক যুবক সত্যেন সবান্ধব। তীক্ষ্ণ চোখ-মুখ, মুখটি দুধ দিয়ে ধোয়া। সদ্য-বিবাহিত দম্পতি, স্টুডিয়োয় ভোলা বিজ্ঞাপন ফটো, নতুন ফ্ল্যাট প্রবেশ, সাদা গরদের ধুতি চাদর, লালপাড় গরদের শাড়ি, কোলে ক্রন্দনরত ঋতম। সে নতুন ফ্ল্যাটে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। সিল্ক দেওয়াল, দাবাবোর্ড মেঝে, ঢাকনা দেওয়া ঘোমটা আলো, আসবাবের তনিমা, ইলেকট্রনিক্সের গ্ল্যামার কিছুই তার ভয় কাটাতে পারছে না। স্বাভাবিক শিশু-বিস্ময় জাগাতে পারছে না। সে বোধহয় ফিরে যেতে চায় সেই বউবাজারি দোতলার তুতো ভিড়ে, যেখান থেকে কনিষ্ঠতম শরিক সত্যেন চ্যাটার্জি নিজের অংশের তোয়াক্কা না করে সমাতৃক, সপত্নীক, সপুত্ৰক বেরিয়ে এসেছিল। এরকম হয়। বাচ্চাদের নতুন পরিবেশ অ নিরাপদ মনে হয়। মানিয়ে নিতে সময় লাগে। সেই মানিয়ে নেওয়ার ছবিও ঝুলছে দেয়ালে। ঠাকুমার কোলে নিদন্ত-হাসি ঋতম। পরম নিশ্চিন্ত, ঠিক যেমন এই ফ্ল্যাটটার কোলে এখন সত্যেন চ্যাটার্জি। অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার এফ আর ইন্ডাস্ট্রিজ। স্মার্ট গাই। সহকর্মীরা ঈষৎ বক্রোক্তির সঙ্গে ঈষৎ বাহবা মিশিয়ে বলে থাকে, চ্যাটার্জি ইজ আ স্মার্ট গাই।
আয়নায় ছায়া পড়েছে তার। বন্ধ ঘরে আলো কম, প্রতিবিম্বও তাই ছায়াময়। তাকে ঠিক কী রকম দেখাচ্ছে খাট থেকে বুঝতে পারল না সত্যেন। কাছে গিয়ে আয়নার ওপরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল। এই আলো জ্বেলে মণিমালা প্রসাধন করে। খুব নরম চেহারার, নরম ধাতের মণিমালা। মাখনে গড়া হাত-পা, চুলগুলো কাক-কালো, কপালে ছোটো টিপ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, গলায় সরু হার, কানে মাকড়ি, হাতে বালা, ঘড়ি-মণিমালা স্কুলে, কি বাজারে কি অন্য কোনো দরকারে বেরোচ্ছে। কিংবা মাথায় বিচিত্র খোঁপা, চোখে কাজল, দামি গাদোয়াল, গহনা মণিমালা বিয়েবাড়ি যাচ্ছে, পার্টি-বাড়ি যাচ্ছে। পাশে সত্যেন, স্মার্ট গাই। নতুন ওভারনাইট ব্যাগ ভরতি জামাকাপড় ঠিক যেমনটি নিয়ে গিয়েছিল, টাইয়ে বাঁধা গাড়ির নাম্বারপ্লেট গহিন জলে, প্যান্টের পকেটে, শার্টের ভেতর পকেটে গোছা গোছা ক্যাশ, পার্সে ক্রেডিট কার্ড, আইডেনটিটি কার্ড, লাইসেন্স, বাড়ির চাবি, ঈশ্বরের করুণা।
দ্রুত জামাকাপড় বদলে ফেলল সে, এক গ্লাস জল খেল, একটা হালকা শুয়ে পড়ল সর্বতাপহর বিছানার কোলে। ভাবতে লাগল কিছু কি ভুল হয়ে গেল। কোনো চিহ্ন পড়ে নেই তো? ব্যাগ-ফ্যাগ সব গাড়ির থ্যাঁতলানো শবের সঙ্গে এমনভাবে দলা পাকিয়ে গেছে যে সে হদিস করতে পারেনি। গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে গাড়ির কাগজপত্রগুলোরও নিশ্চয়ই একই দশা। তবু তার সামান্য আফশোশ হতে লাগল অকুস্থলে আগুন জ্বালিয়ে না আসার জন্যে। সে তো খুনখারাপি করছে না। অ্যাকসিডেন্টটাও সে ঘটায়নি। লিজ, ট্রাক ড্রাইভার ও তার খালাসি নিশ্চিত ডেড অ্যান্ড গন। তাদের বেঁচে থাকবার কোনো আশাই নেই। তা হলে আগুন ধরিয়ে শবদাহ করলে অপরাধ হত? সে তো কোনো অপরাধ করেনি! করেনি কী? অপরাধ? ঠিকঠাক! সত্যেন! ট্রাংকুলাইজারে আস্তে আস্তে তলাতে শুরু করল সে।
মি, স্যান্ডারসনের জন্যে লিজকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অফিসের আলিপুর গেস্ট হাউসে। উনি চেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান, বেঙ্গলি, লোক্যাল। লিজকে শাড়ি পরিয়ে নিতেই আর কোনো অসুবিধে হয়নি। আসল কথা, ওসব লোককে হ্যান্ডল করতে সফিস্টিকেশন চাই। লিজি তো হেজিপেঁজি নয়, সে-ও এক নামকরা কোম্পানির কলকাতা অফিসের রিসেপশনিস্ট। লম্বা লম্বা পা, মডেলের মতো লীলাময় চলাফেরা, একেবারে যেখানে যতটা মাপ দরকার তেমনই। গেস্ট হাউসে যখন স্যান্ডারসনের সঙ্গে কনট্রাক্ট বিষয়ে ফাইনাল কথাবার্তাগুলো হল, দেখা গেল পিএ-র কাজটুকু লিজি অনায়াসে করে দিতে পারে। মি. স্যান্ডারসন চমকৃত। ইদানীং লিজ তারও অনেক সেক্রেটারিয়াল কাজ করে দিচ্ছে। আনঅফিশিয়ালি। একটাই চাহিদা তার। সত্যেন, সত্যেনকে তার চাই।
প্রথম যেবার সত্যেন নিজেকে দিয়েছিল, এত কিন্তু কিন্তু, এত লাজুক ছিল সে যে নিজেকে স্মার্ট গাই বলে প্রমাণ করতেই পারেনি লিজের কাছে।
ভার্জিন না কি?–এখনও সেই হাসি শুনতে পায় সে।
কবে আর ভোগ করতে শিখবে?
বিবেক? আশ্চর্য সত্যেন, তুমি তো ফ্যামিলিকে বঞ্চিত করছ না। ইউ স্টিল লভ ইয়োর ওয়াইফ অ্যান্ড মেক লভ টু হার, ডোন্ট ইউ?
আস্তে আস্তে একেবারে অচেনা, উত্তেজক নেশার বস্তু চিনতে পেরে গেল। সত্যিই সারা সমাজটা পালটে গেছে এখন, পালটাবেই। এসব এখন কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না। আরে বাবা, রোজ তোমার বাড়িতে খেতে ভালো লাগে? থাই, মোগলাই, কন্টিনেন্টাল—জিভের বদল, স্বাদের বদল, পরিবেশ বদল—ভালো লাগে না? কী দোষ এতে? তেতাল্লিশ হয়ে গেল, কবে আর ভোগ করবে জীবনের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা ঐশ্বর্য? তা ছাড়া, মণিকে তো সে একটুও কম দেয় না। মণির চেহারা দেখলেই বোঝা যায়—শান্ত, প্রসন্নশ্রী…সকলেই বলে থাকে। আর ঋতম? তার তো কথাই নেই। তার মধ্যে নিজেকেই দেখতে পায় সত্যেন। এবং নিজের ছায়ার মতোই ভালোবাসে…অ্যান্ড হি লভস হিজ ওয়াইফ অ্যান্ড.মেকস লভ টু হার।…ডাজনট হি?
এ কী! তুমি এসে গেছ? অফিস যাওনি? এমন করে ঘুমোচ্ছ যে? শরীর ঠিক আছে তো?
সাধারণত সে ঢুর সেরে সোজা অফিস চলে যায়।
কীরকমভাবে ঘুমোচ্ছিল সে? পুঁটলি হয়ে। হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো, মাথাটা নুয়ে এসেছে বুকের ওপর। মাতৃগর্ভে জ্বণের মতো!
একটু একটু করে ফিরছে সত্যেন। কিন্তু ঘোর অবাস্তবতায়। ট্রাংকুলাইজড ঘুম চট করে সত্য চিনতে পারে না। ঘরখানা টলমল করছে। সামনে একটি অলৌকিক মূর্তি। ছোটোবেলার সরস্বতীপুজো? ভূমিকম্প! অঞ্জলি দেবে? পল্টন…পল্টন…আজ সরস্বতীপুজো…বেলা হয়ে যাচ্ছে। ওঠ। ওঠ বলছি শিগগিরই। তুই-ই ফাঁকে পড়বি…আমার কী…
মাথাটা জোরে ঝাঁকিয়ে চোখ কচলে উঠে বসল সত্যেন। তাকে নিয়ে স্প্রিং ফোম একটু দুলে উঠল।
কী হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি? আমি তো তোমাকে বিকেলের আগে…
এত আশ্চর্য হবার কী আছে? একটু বিরক্ত গলায় সত্যেন বলল, তুমি কখন ফিরলে?
এই তো আজ প্রাইজ-লিস্ট করার ছিল। একটু দেরিই হয়ে গেছে। আমি ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে আসবার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি তুমি…এসেছ।
হঠাৎ সত্যেন বুঝতে পারল, তার মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে। সে নাও ফিরতে পারত। কাঁপা গলায় বলল, আর বোলো না গাড়িটা চুরি হয়ে গেল।
গাড়ি? চুরি? কোথা থেকে? কখন?
কখন কি জানি? পার্কিং লট থেকে, বর্ধমান সরকারি গেস্ট হাউস…তেমন কিছু ভেবেই বলে গেল সত্যেন।
বলো কী? এনকোয়ারি করলে না? পুলিশ? নোটিফাই করেছ?
মণি প্লিজ তুমি আমাকে একটু কম প্রশ্ন করো। আমার মাথার ঠিক নেই।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কাটল কী করে?
ও কিছু না। অন্ধকারে টয়লেটে যেতে গিয়ে…
খেয়েছিলে?
সে তো একটু…
একটু নয়, খুব। ভোগো! …মণিমালা পেছন ফিরল,এক্কেবারে নতুন গাড়িটা! ইশশশ। ওখানে থানায় ডায়েরি করেছিলে!
সেটাই ভুল হয়ে গেছে। ঠোঁট কামড়াল সত্যেন, আমার মাথার ঠিক ছিল না, তখন শান্তিনিকেতনে কনফারেন্স মাথায়, গণদেবতা ধরে…। যাই হোক, এখানে ডায়েরি করে তবে বাড়ি…ওহ মণি, আমি—হা-ক্লান্ত-হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মণিমালার কোমর জড়িয়ে মাথা রাখল। হু হু করে কাঁদতে লাগল।
এ কী! তুমি কাঁদছ? কাঁদছ কেন?
গাড়িটা নতুন…
বদারেশন, কিন্তু ইনশিয়োর করা জিনিস…অমন উতলা হবার কী আছে। তাই বলে তুমি কাঁদবে? অপার বিস্ময় মণিমালার গলায়।
চট করে নিজেকে সামলে নিল সত্যেন। ভারী গলায় বলল, একটু চা খাওয়াবে? ঋত কোথায়?
এই তো এসে পড়বে।
মণিমালা চলে গেল। সত্যেন টয়লেট গিয়ে মুখেচোখে জলের ঝাপটা দেয়। এটা তো মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। বর্ধমানে চুরি যাওয়া গাড়ির ডায়েরি বালিগঞ্জ থানায়? বর্ধমানে শনিবার রাতটা রেস্ট নিয়েছিল তারা। রবিবার সকালেই শান্তিনিকেতন স্টার্ট করে গেছে। শ্রীনিকেতনের রাস্তায় চমৎকার রিসর্ট। কলকাতা থেকে এত কাছাকাছি যাওয়াটা বিপজ্জনক। কিন্তু করবেই বা কী! অত অল্প ছুটি! তবে বুকিংটা দেখলে কারও সাধ্য নেই সন্দেহ করে! সত্যেন চ্যাটার্জি একা এসেছে, আলাদা রুম। সন্তোষ গিদওয়ানি আলাদা। পরে। আলাদা রুম। স্টেশনে পৌঁছেই গাড়ি থেকে নেমে রিকশ ভাড়া করে চলে গেছে সন্তোষ গিদওয়ানি। শান্তিনিকেতনেও তাই। নামটা আবার পালটে নিয়েছে।
চা খেতে না খেতেই কাঁধে ভারী স্কুলব্যাগ ঋতম এসে গেল? পাঁচটা বাজছে টিকটিক করে। শীতের ম্যাড়মেড়ে বিকেল, সন্ধেয় মেশবার আগে বা ক্রমশই আরও আরও মন খারাপ করা হয়ে যেতে থাকে। সে সেন্টিমেন্টাল ধাতের মানুষ নয়। শীত-বিকেলের এই প্রকৃতি সে লক্ষ করেনি বহু বহু দিন। এ সময়ে সে অফিসে থাকে কাজে ব্যস্ত, মিটিংয়ে, কনফারেন্সে এ হোটেল থেকে ও হোটেলে ভ্রাম্যমাণ। ছুটির দিনে বেশিরভাগই বেরিয়ে পড়ে, হু হু করে নীল ইন্ডিকা চালিয়ে, পাশে লিজ সন্তোষ গিদওয়ানি বা মণিমালা চ্যাটার্জি যে-ই থাক। পিছনে একটি দশ-এগারো বছরের দুধ-ধোওয়া-মুখ তার নিজস্ব রক্তের ঝলক থাক বা না থাক। এ কথাটা বলত মণিমালা। সকাল সকাল কচিৎ বাড়ি ফিরলে দেখত মণিমালা বারান্দায় বসা, আলুথালু, মুখে বিষাদের ভার। ঋত খেলতে বেরিয়ে গেছে। এ-ঘর ও-ঘর খুঁজতে খুঁজতে বারান্দা।
এ কী মণি! এখানে! আলো জ্বালোনি?
জ্বালালেই বা কী, না জ্বালালেই বা কী!
মানে?
দূর, এরকম সন্ধে হলে মনে হয় আলো আর জ্বলবে না।
ওহ তোমার সেই বেদনাবিলাস?
মণিমালার ভেতরের এই অন্ধকারকে ভালো চেনে না সত্যেন, যেমন চেনে না মণিমালাও সত্যেনেরটা। দু-জনের অন্ধকারের প্রকৃতি আলাদা।
বাবা, তুমি এসে গেছ? খুশির হাসিতে কলকলাচ্ছে ঋতম।
কেমন একটা অস্বস্তি হয় তার। জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে বলে, কাজ হয়ে গেল, এসে গেলাম!
কী মজা!—মা খেতে দাও! …পিঠে ব্যাগ, মুখে হাসি, নাচতে নাচতে বেরিয়ে যাচ্ছে একমাত্র সন্তান কিন্তু তাকে যেন সে পুরোপুরি চিনতে পারছে না। তার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক স্থির করতে পারছে না। হাত বাড়িয়ে অনিশ্চিত ডাকছে, বালক, তুমি আমার কে? তুমি কোথায়? আমি তোমার কে? ঋতম আমি…আমি কোথায়?
সন্ধে সাতটা। ঋতম পড়ছে নিজের ঘরে। মণিমালা বারান্দায়, সত্যেন বারান্দায়, মুখে অনভ্যস্ত সিগারেট। বাড়িতে ধূমপান করে না সে। স্ত্রী-পুত্রের প্যাসিভ স্মোকিং এর কারণ হবে না, খুব সচেতন। মণিমালার চোখে প্রশ্ন। সত্যেন পড়তে পেরেছে। বারান্দায় তো! উড়ে যাবে। ভীষণ অস্থির-অস্থির লাগছে।
তাই তো দেখছি, বর্ধমানে ডায়েরির কী হবে?
আরে বাবা ওসব আমাদের লোকাল থানাই করে দেবে। জাস্ট একটা ফোন।
প্রসেসটা কি তাই? তোমার মনে নেই মেজদাদুর অ্যাকসিডেন্ট হল ল্যান্সডাউনে। ডায়েরি করানো হল ভবানীপুরে। তার পরে বলল, অ্যাকসিডেন্ট কেস সব লালবাজার।
অ্যাকসিডেন্ট কেস! অ্যা ক সি ডেন্ট…
সে বলল, কাল ফার্স্ট থিং খোঁজ করব। আজকের দিনটা, জাস্ট আজকের দিনটা আমাকে রেহাই দাও।
অন্ধকারেও মণিমালার মুখের বিস্ময়, আহত অভিব্যক্তি বোঝা যায়। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকা।
স্যরি মণি, প্লিজ।
ঠিক আছে। কিন্তু গাড়ি ছাড়াও…তোমার আরও কিছু প্রবলেম আছে মনে হচ্ছে। অফিসে কিছু গণ্ডগোল…? এত অস্থির?
ইয়েস। ঠিকই, কিন্তু এগুলো তো ডিসকাস করে কোনো লাভ নেই! লেট মি থিংক!
সাড়ে আটটা, মা!–ঋত ডাকছে।
মণিমালা উঠে গেল। এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। আর অভিমান প্রকাশ করেনি। স্বামীর ভাবনায় সে যথেষ্ট ভাবিত। কিন্তু এসব বিষয়ে সে যদি ভাবনা-চিন্তা করবার সময় চায়। একা একা, তো ভাবুক। তাতে অবশ্য মণির ভাবনা কমে না। কেননা সে যে কর্পোরেট জগতের কিছুই বোঝে না এটা ঠিক নয়। তেরো-চোদ্দো বছর বিয়ে হয়ে গেছে, ঘনিষ্ঠ বসবাস। আপনা-আপনিই অনেক কিছু চুইয়ে চুইয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে।
খাবে এসো।
প্রচুর অনিচ্ছা নিয়ে সত্যেন ওঠে। হাত-মুখ ধোয় সময় নিয়ে। খিদে যে পায়নি তা নয়। কিন্তু ইচ্ছে নেই। মনে হচ্ছে খেতে গেলেই উঠে আসবে।
ধোঁয়া-ওঠা মাটন। রুটি বেতের ঝাঁপিতে। একটা দুটো করে সেঁকে দিয়ে যাচ্ছে পূর্ণিমা। আলু-ফুলকপির ডালনা, স্যালাড।
মাটনের বাটি সরিয়ে দেয় সত্যেন, কালকেও খেয়েছিল। গন্ধেই বমি আসছে।
রেজালা করেছে আজকে, সরিয়ে রাখছ যে!
ভালো লাগছে না মণি। আমি যা হয় দিয়ে ঠিক খেয়ে নিচ্ছি প্লিজ ডোন্ট বদার।
খেতে খেতে মণিমালা ডাকল, পূর্ণিমা টি, ভিটা অন করে দিয়ে যাও তো।
একেবারে অন্যমনস্ক ছাঁদে খাচ্ছে সত্যেন। মগ্ন খাওয়ায় ভাবনায়। যেন সে একটা গ্রহে একলা মানুষ। কোথায় কেউ নেই। চারপাশে খালি বাতাস। তা-ও আছে কী?
ও মা, দ্যাখো দ্যাখো, কী ভয়ংকর অ্যাকসিডেন্ট!–ঋতম চেঁচিয়ে বলে।
ওরে বাবা, ঠিক গাইসালের মতো, না?
গতকাল মধ্যরাতে দিল্লি রোড বম্বে রোডের সংযোগস্থলে একটি ট্রাক ও একটি প্রাইভেট কারের মুখোমুখি সংঘর্ষে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাকটি মোটরগাড়িটির উপর উঠে যায় সংঘাতে। ট্রাকের চালক ও খালাসি মৃত। গাড়িটি একেবারে পিণ্ডাকৃতি হয়ে গেছে। আগুন লাগেনি কেন—সেটাই আশ্চর্য! গাড়ির চালক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছেন। তাঁকে শনাক্ত করা যায়নি। তবে কোনো কোনো প্রমাণ অনুযায়ী চালক একজন মহিলা।
হৃৎপিণ্ডের ধুক ধুক ধুক…হঠাৎ একটা ফসকে গেল।
দ্যাখো বাবা-দ্যাখো…! মুখ তুলে চায় সত্যেন রক্তহীন, দৃষ্টিহীন।
তদন্ত হচ্ছে। খবর এখনকার মতো শেষ হল। পরবর্তী খবর…
ও কী? উঠে পড়লে!
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সত্যেন, অস্পষ্ট স্বরে বলে, হয়ে গেছে। তারপর তাড়াতাড়ি শোবার ঘরের বাথরুমে বেসিনের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে। আজকের রুটি, ফুলকপি, মটরশুটি গোটা গোটা উঠে আসে, তারপর গতকালের মাটন তার শেষবিন্দু পর্যন্ত পাকযন্ত্র আলোড়িত করে উঠে আসতে থাকে। ঝাঁঝরির ওপর তর্জনী দিয়ে সমস্ত ঘষে ঘষে পাতালে পাঠায় সে, খুনি যেভাবে খুনের প্রমাণ লোপ করে, তারপর ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। জ্বর আসছে। ঘনঘটা করে জ্বর আসছে…
কাজকর্ম শেষ। ঋত ঘুমিয়ে পড়েছে। এত বড় হল ছেলে তবু শোবার সময়ে মাকে চাই। হয় মা গল্প বলে, কিংবা ছেলে, কিংবা গল্প হয়…প্রণীত কী বলেছে, ঝুমুরের সঙ্গে চৈতালির কী রকম ঝগড়া হয়ে গেল শুধু শুধু। জানো মা, অভিষেক মোবাইল নিয়ে স্কুলে আসে। আমাকে একটা দেবে?
তুমি তো বুদ্ধিমান ছেলে ঋত? জানো না ক্লাস সিক্সের ছাত্রের মোবাইল কেন, ঘড়ি ব্যবহার করাও ঠিক নয়। দরকারই তো নেই, তুমিই বলো। সারেরা জানতে পারলে বকবেন কিন্তু।
উচিত নয় কেন মা?
অ্যাডাল্টরা যা যা করে মাইনরদের তা তা করতে নেই সব সময়ে। তুমি কি বাবার মতো চাকরি করতে পারবে? সেই জ্ঞান বুদ্ধি এলে তখন…
ঠিক বাবার মতো! ঘুম-ঘুম গলায় বলল ঋত-নীল ইন্ডিকা গাড়ি…ক্রেডিট কার্ড,,,টাকার ব্যাগ…টুর…মা…।
আলতো করে ছেলের মাথায় হাত রাখে মণি-হ্যাঁ। বিচক্ষণ… কাজপাগল…লাভিং অ্যান্ড কেয়ারিং…
সেই একই হাত সত্যেনের গায়ে রেখেছে মণিমালা। জাগাতে নয়, মানুষটা ভীষণ চিন্তিত, সেই চিন্তার ওপর আশ্বাসের হাত। হাতে তাপ উঠে এল। বেশ জ্বর। তাই অখিদে, অনিচ্ছা, খারাপ লাগা, কিছু ভালো না লাগা…বিরক্তি! বেশ করে ঠান্ডা লাগিয়ে এসেছেন।
শুনছ! শুনছ!–ওষুধটা খেয়ে নাও।
লাল চোখ মেলে সত্যেন। কোথায় আছে, কে বলেছে, ঠিক করতে পারছে না।
তোমার খুব জ্বর। এখন দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে নাও-মণি এক হাতে তার ঘাড়টা তুলে রেখেছে। আর এক হাতে ট্যাবলেট দিচ্ছে দুটো, জল।–শুয়ে পড়ো।
দুদিন অফিস কামাই হল। মণিমালারও। একটা জ্বররা রোগী, অতি দুর্বল, অতি অস্থির, মাঝে মাঝে এমনকি বিড়বিড় করে বকছেও। ডাক্তার দেখে গেছেন। সাধারণ ঠান্ডা লাগা জ্বর বলেই মনে হচ্ছে, তবে আর একদিন থাকলে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। কী করে যাবে মণিমালা? সে মেপে ওষুধ দেয়, জ্বর মাপে, স্পঞ্জ করিয়ে দেয়। নাঃ, তৃতীয় দিনে জ্বর ছেড়ে গেছে। সত্যেনকে অফিস যেতেই হবে। দুর্বলতা? তেমন কিছু না। জোরালো সুপাচ্য পথ্য দিয়ে গেছে মণিমালা সমানেই।
অফিসে জ্বরের কথা জানানো হয়েছে, কিন্তু গাড়ি চুরির কথা নয়। সত্যেন একটা নীল মারুতি ভাড়া করেছে হঠাৎ দূর থেকে দেখলে কারও কিছু মনে হবে না। ইনশিয়োরেন্স ক্লেম এখনও পাঠায়নি। কেন? সে জানে না।
আস্তে আস্তে পুরো দমে কাজকর্ম আরম্ভ হয়ে যায়। একটা মেরুন রঙের এস্টিম কিনেছে সত্যেন। স্যাট্রো, জেন, এসব গাড়ির গড়ন একদম পছন্দ করতে পারছে না সে আজকাল। তাই দীর্ঘপুচ্ছ এস্টিম। নতুন টাকা দিয়ে নতুন লোনে। ইনশিয়োরেন্সের টাকাটা পাওয়া গেলে মণি আর ঋতের জন্য সে আর একটা গাড়ি কিনবে। এটা আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু মণিমালা খুব উৎসাহী নয়। তার জন্যে গাড়ি কেনার কথা উঠলেই কথা ঘুরিয়ে ফেলে।
একদিন…মাত্র একদিন বলেছিল—
আমার কেমন…খারাপ লাগে।
কেন?
কী দরকার? এত কাছে স্কুল! ঋতও কী সুন্দর বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করতে করতে যায় স্কুল বাসে। বাজার-হাট? বিশেষ দরকার হলে তা তোমার গাড়িই পাই!…
মণি কিন্তু বেশ সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। তার বাবা দাদা দু-জনেই ডাক্তার। স্বভাবতই তাদের বাড়িতে দুটো গাড়ি আছে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে মণিমালা অতিরিক্ত পছন্দ করে না, এবার বোধহয় একটু জোরই করতে হবে।
ইনশিয়োরেন্স থেকে ফোন আসছে। চুরি যাওয়া গাড়ির কোনো কিনারা হল না। সুখের কথা, বর্ধমান গেস্ট হাউজ জানিয়েছে, চ্যাটার্জি খুব ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, গাড়ির খবর তারা জানে না। কিন্তু স্যার তক্ষুনি পুলিশে ডায়েরি করলেন না কেন?
আমার মাথার ঠিক ছিল না। কর্পোরেট হাউজের ব্যাপার তো বোঝেন। শান্তিনিকেতনে ছুটতে হবে তক্ষুনি, জরুরি কাজ। ওখানে কনফারেন্স করে হন্যে হয়ে ফিরেছি। তারপর ডায়েরি করি। গাড়ির মেক, নাম্বার, ডেট অব পারচেজ, ইনশিয়োরেন্সের তারিখ। টার্মস।
একটাই বিপদ। অফিসে যদি খোঁজখবর করে কার সঙ্গে মিটিং করতে উইক এণ্ডে বর্ধমান, তারপর শান্তিনিকেতন ছুটতে হয়েছিল তাকে। তবে, অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার হিসেবে অনেক প্রজেক্ট তাকে একাই হ্যান্ডল করতে হয়, একাই প্ল্যানিং করতে, ডিসিশন নিতে হয়। যেটা শুরুতেই গুবলেট হয়ে গেল তারজন্য ডিটেল্ড রিপোর্টও দেওয়াটা জরুরি নয়। এই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি নতুন বাজারে নেমেছে। কমপিটিটিভ মার্কেট। টাকাটা শেষ পর্যন্ত চুকিয়েই দেবে বোধহয়। কেননা বলল—যদি নাম্বার প্লেট পালটে ভিন্ন রাজ্যে পালিয়ে গিয়ে থাকে, ফিরে পাবার কোনো আশাই নেই। সাধারণত কোনো অপরাধমূলক কাজ করলে গাড়িটা ব্যবহার করে এরা অকুস্থল থেকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে যায়। যখন এত দিনেও বার হল না তখন গাড়িটা ইতিমধ্যেই চোরাই মাল, দু-তিন হাতফেরতা হয়ে গেছে।
একটা মারুতি এইট হানড্রেড ডিলাক্স কিনে সোজা বাড়ি ফিরে এল সত্যেন। ধবধবে সাদা। মণিমালার হাতে চাবি দিয়ে বলল, নাও এটা তোমার।
কী আশ্চর্য!
আশ্চর্যের কী আছে? গিফট! বিবাহবার্ষিকীর, অল রাইট? তোমার লাইসেন্স আছে, কিন্তু কলকাতার রাস্তায় আমি তোমাকে ড্রাইভ করতে দেব না।
ন্যাশনাল হাইওয়েতে রাত্তিরে একটি মেয়ে একা গাড়ি চালাতে পারে আর এই কলকাতার রাস্তায় দিনের বেলা আর একটি মেয়ে একটু পারবে না?
কোথায় আবার পেলে এ রকম?
কেন? ওই যে গাড়িটা সেদিন অ্যাকসিডেন্ট করল না? সেই তুমি যেদিন ফিরলে!
গায়ের চামড়ার খোল থেকে রক্তমাংসের মানুষটা প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল। কী বলছে মণি? ও কি কিছু সন্দেহ করেছে? কী করে? কেন? অনেক কষ্টে সে শুধু বলতে পারল, ততাই ওরকম অ্যাকসিডেন্ট হয়।
কেন? ট্রাক ড্রাইভারটা? সে তো আর মেয়ে নয়! তার বেলা?…
সব মেয়েদের পারংগমতা প্রসঙ্গে কথাটা বলেছিল মণি। মেয়েরা পাইলট হচ্ছে, অ্যাস্ট্রোনট হচ্ছে…ইত্যাদি ইত্যাদি।
ট্রাক ড্রাইভার? রাত্তিরে ওরা একেবারে বেহেড হয়ে গাড়ি চালায়।
সে তো জানি! সেই জন্যেই তো বারণ করি, ধরো ওইটা যদি তোমার ইন্ডিকা হত? ওই মেয়েটির জায়গায় যদি তুমি…উহহ। শিউরে উঠল মণিমালা, আর তার চেয়েও বেশি শিউবোলো সত্যেন নিজে। তার গা ছমছম করছে। এবং বেশ কয়েকদিন যাবৎ শান্ত, শ্রীমতী মণিমালাকে কেমন ভীতিপ্রদ মনে হচ্ছে। যতবার দেখছে লিজের মুখে মনে পড়ছে। যতবার দেখেছে দুর্ঘটনার দৃশ্যটা হু হু করে চলে আসছে চোখের সামনে। ঋত! ঋত দেখা দিচ্ছে অদ্ভুত অদ্ভুত ভোরের স্বপ্নে। ঋত বাবা বলে ডাকতে চেষ্টা করছে, পারছে না, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে তবু পারছে না। আতঙ্কিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে নিজের গলাটা আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। একটা নীল গাড়ি চড়ে ঋত হুশশ করে চলে গেল। কাঁচের ভেতর থেকে দেখা যায় তার আবছা বাই-বাই।
তার বিমর্ষ ভাব লক্ষ করেছে মণি। বলল, চলো না, আমরা ক-দিন একটু কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। সামনেই ২৬ জানুয়ারি সাতাশে পড়েছে শনিবার। তিন দিন ক্লিন ছুটি পাওয়া যাচ্ছে।
কোথায় যাবে এই ক-দিনে? ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেলে তো!
ট্রেনে কে যেতে চাইছে? নতুন এস্টিমটা করে, ড্রাইভার নিয়ে…কথা শেষ হল না চিৎকার করে উঠল সত্যেন—না-আ-আ।
তুমি এত আপসেট হয়ে পড়ছ কেন? আশ্চর্য তো!
ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের একটা ছোটো প্যাকেজ নেওয়া যায়—শান্ত গলায় বলল সত্যেন।
ঠিক বলেছ। ধর জয়রামবাটি কামারপুকুর!
ঠিক ঠিক। এই রকম, এই রকম কিছুই একটা দরকার এখন। শ্রীরামকৃষ্ণ মা সারদা, শ্রীচৈতন্য, যাঁরা যাঁরা এ পৃথিবীতে ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছেন—গেছেন তাঁদের দরকার তার। অন্য কিছু ভাবতে পারছে না সত্যেন। বার বিস্বাদ, অফিস বিরক্তিকর, মানুষের সঙ্গ ভীতিপ্রদ, এমনকি যাদের সঙ্গে এই ছোট্ট ভ্রমণে যাওয়া সেই একান্ত নিজের সষ্টি পরিবারকেও তার ভালো লাগছে না। ইতিমধ্যেই তারা যেন অনেক যোজন দূরে চলে গেছে।
অথচ ঋত ঠিক তেমন করেই বাবার ট্রাউজার্স-এর সঙ্গে লেপটে প্রশ্ন করছে, বাবা, এইগুলো সারদা মায়ের জীবন নিয়ে কমিকস?
প্রদর্শশালার কক্ষে ঋত কমিকস দেখছে তার বাবা দেখছে ট্রাজিকস। হে মা, হে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, যদি সত্যিকারের ঠাকুর হও তো এই অধম, নীচাশয়, ক্লিন্ন, বিশ্বাসঘাতক পাপী, হ্যাঁ পাপীকে রক্ষা করো। একবার। আর কখনও এমন হবে না। দীক্ষা নেব, মাছ-মাংস ছেড়ে দেবে, বিশাল ডোনেশান দেব মঠে। মাতৃমন্দিরের চৌকাঠে সে এতক্ষণ ধরে প্রণাম করে সে অন্য অভ্যাগতদের অসুবিধে হয়, মণিমালা সামান্য হেসে মন্তব্য করে, তোমার যে এত ভক্তি তা তো জানা ছিল না!
কে কাকে কতটুকু জানে মণিমালা? তুমি কি আদৌ সত্যেনকে জানো? জানো, দিনের পর দিন সে কীভাবে তোমাকে ঠকিয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট করে অকুস্থল থেকে নিজের সমস্ত চিহ্ন লোপাট করে পালিয়ে এসেছে খুনির মতো! মেয়েটি একেবারে সর্বাংশে মৃত ছিল। কিন্তু তার যদি একটুও প্রাণ অবশিষ্ট থাকত সত্যেন কি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করত? না। রূঢ় সত্য হল—না। মেয়েটি প্রমাণ তার আইডেনটিটির, যেমন নাম্বার প্লেটটা ছিল প্রমাণ–তার গাড়ির আইডেনটিটির। তার মানসম্মান, তার ঘর, বার সব ভেঙে যেত।
আবার সেই ভয়াবহ শহর। বাইরে থেকে এ শহরে ঢুকলেই একটা গুমগুম চাপা গর্জন শোনা যায়, যেন অন্ধকার হিমেল রাতে হাইওয়ে দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ট্রাক চলেছে। শহর ভরতি নীল ইন্ডিকা, শহর ভরতি লিজ, লম্বা অনাবৃত পা, সোনালি হাই-লাইট চুল, মডেল চেহারার স্মার্ট মেয়ে লিজ, যে রিসেপশনিস্টের কাজও করে আবার প্রয়োজন হলে ক্ষুধিত পুরুষকে শান্তও করে, ইচ্ছা হলে, পছন্দ হলে, অপাপ পুরুষকেও বহু বাসনায় প্রাণপণে চায়। চতুর্দিকে লিজের প্রেত। পথ-চলতি কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে পারে না সত্যেন। কেননা লিজ টুকরো টুকরো হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে। ভালোবাসা নয়, আকাঙক্ষা নয়, এক প্রবল, দুর্দম ভয়
শুনেছ চ্যাটার্জি, লিজ গ্লো নামে মুখার্জি ইন্টারন্যাশনালের সেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা। তুমি তো ভালোই চিনতে! শি ইজ মিসিং ফর দা লাস্ট ওয়ান মানথ। খেলুড়ে মেয়ে ছিল যাই বল—দ্যাখো কোথায় ফেঁসেছে…কী হল?
সত্যেন চ্যাটার্জি অ্যাসোসিয়েট ম্যানেজার এফ. আর. ইন্ডাস্ট্রিজ টেবিলের ওপর তার পি. সি-র কি-বোর্ডে ঢলে পড়েছে।
প্রেশার দ্রুত ফল করছে। এঁকে নার্সিংহোমে শিফট করতে হবে।
তাই কিছুদিন ধরেই ওকে কেমন কেমন লাগছিল। তাই বলো!
লিজের ছবিটা কাগজে ফ্ল্যাশ করছে, কাগজে, টি. ভিতে। যদি কেউ হোয়্যার অ্যাবাউটস বলতে পারো। হ্যাঁ…না…..ও তো থাকত হস্টেলে…ঠিক হস্টেল নয়…পি, জি বলতে পার। দেয়ার ওয়্যার সেভার্যাল। অফিস থেকে তো তলব গেছেই, ফেলো পি. জিরাও নোটিশ করেছে।…ওরকম নাকি ও প্রায়ই যেত। মোস্ট প্ৰব্যাবলি নষ্ট টাইপের। গোড়ায় পার্ক সার্কাস এরিয়ায়…মা মারা যাবার পর থেকে রিপন স্ট্রিটে ওই গেস্ট হাউজ…এনি ওয়ে শি ইজ নাও দ্য টক অব দা টাউন। আজকাল মেয়েদের যখনতখন তুলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে…যা হচ্ছে দিনদিন দেশটা…হোপলেস।
চোখের সামনে বিন্দু বিন্দু হলুদ। অণুপরিমাণ, কিন্তু সব মিলিয়ে পরিব্যাপ্ত। মাইলের পর মাইল ছাওয়া। সেখানে আস্তে আস্তে নেমে আসতে থাকে, ধোঁয়া, কালো, কালির অন্ধকার।
একটু মাপা খাওয়া-দাওয়া বুঝলেন! ওষুধ তো যা দেযার দিলামই। হালকা করে চিকেন, মাটনও কচি দেখে, রোজ নিয়ম করে আড়াইশো গ্রামের মতো খাওয়াবেন। না, হার্টে কিছু নেই। বোধহয় খুব টেনশনে ছিলেন। এসব জবের এই-ই রীতি।
মাংস কিন্তু একদম খেতে চাইছে না, মাছও…হঠাৎ ভীষণ অরুচি…
এমনিতে খেতেন?
ওরে বাবা, যথেষ্ট না হলে খাওয়াই হত না…অথচ হঠাৎ…
কী জানি তার থেকেই হয়তো প্রেশারটা…..
ডক্টর, সম্প্রতি ওঁর আধ্যাত্মিক দিকে খুব ঝোঁক হয়েছে। বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা মার ছবি এনে শোবার ঘরে টাঙিয়েছেন। মঠে যাচ্ছেন সময় করে!
ইনটরেস্টিং! তারপর থেকেই কি এই মাছ মাংসে অরুচি?
মোর অর লেস!
ডাক্তার হেসে বললেন, শ্রীরামকৃষ্ণ অর্ডারের শিষ্যসামন্ত মহারাজরা কিন্তু মাছটাছ যথেষ্ট খেয়ে থাকেন। একেবারে চচোষ্যলেহ্য-পেয়। এটা ওঁর মাথায় ঢোকান। আমিষ খেয়েও ঈশ্বর হয়।
তা কিন্তু না। ইচ্ছে করে যে সংযম করছেন তা নয়। আপনা আপনিই…
ঠিক আছে। আমি একটা পাউডার প্রোটিন লিখে দিচ্ছি। দুধের সঙ্গে সকাল সন্ধে। অন্তত সাত দিন কমপ্লিট রেস্ট। তারপর সেটা একটু বাড়াতেও হতে পারে।
লিজ গ্লো, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চান, দৈর্ঘ্য—৫ফুট ৭ইঞ্চি, ফরসা রং, সোনালি স্ট্রিক দেওয়া চুল, সাত নম্বর রিপন স্ট্রিট, কলকাতা। গত একত্রিশে ডিসেম্বর থেকে নিরুদ্দেশ। কেউ যদি খোঁজ দিতে পারেন যোগাযোগ করুন-ভবানীভবন, আলিপুর।
শুকনো মুখে, রুগণ হাতে কাগজটা নামিয়ে রাখল সত্যেন।
হ্যালো চ্যাটার্জি! আছ কেমন! ছবিটা দেখলে? এ তো আমাদের লিজ গ্লো-ই। আমি শনাক্ত করে ভবানীভবনে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি।
তোমারও দেওয়া উচিত—মণিমালা বলল—একটা অন্তত ফোন করে দাও।
ভবানীভবন! আমি এফ, আর, ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সত্যেন চ্যাটার্জি বলছি।
লিজ গ্লো নামে নিরুদ্দিষ্ট মেয়েটিকে আমি, আমাদের অফিসের অনেকেই চিনত।
ইয়েস। ভালো কি মন্দ কী করে জানব বলুন। মেয়েরা রিসেপশনিস্ট, পি. এ-র কাজ করলে তাদের একটু-আধটু বদনাম হয়েই থাকে।
এটা তুমি একেবারে ঠিক বলছ,–মণিমালার মুখ গনগন করছে, রিসেপশনিস্টরা একা একাই মন্দ হয়, আর যেসব উচ্চপদস্থ ব্যক্তি এদের ব্যবহার করে তারা সব নিষ্পাপ বালক… ও কী! তুমি অত ঘামছ কেন? একটু গরম দুধ নিয়ে আসছি…দাঁড়াও ঘামটা মুছিয়ে দিই!
চাঞ্চল্যকর খবর। ই, টিভি বাংলা। লিজ গ্লো নামে নিরুদ্দিষ্ট মেয়েটিকে গত একত্রিশে ডিসেম্বর বর্ধমান সরকারি গেস্ট হাউজের ম্যানেজার দেখেছেন। তবে ওই নামে রেজিষ্টারে নেই। জনৈক সন্তোষ গিদওয়ানি রুমটি নেন। শান্তিনিকেতনের রুদ্রপলাশ হলিডে রিসর্টের মালিকও মেয়েটিকে চিনেছেন। তিনি নিশ্চিত নন, তবে মেয়েটি সম্ভবত মেরিয়ান সিম্পসন নামে রেজিস্ট্রি করায়।
খবর শুনতে শুনতে মণিমালার হাতের কলম থেমে গেল। কী অদ্ভুত কাকতালীয়…ওই দুটো দিন তো সত্যেনও ওইখানে ছিল। দু জায়গাতেই কোনো পার্টির সঙ্গে ওর কথাবার্তা ছিল।
খবর সাধারণত এড়ায় সত্যেন। কিন্তু মণিমালার যে কী খবরতৃষ্ণা!
চ্যানেল সার্ফ করে করে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সব চ্যানেলের খবর দেখবে।
দ্যাখো দ্যাখো, বুশকে কী রকম ঘোড়েল শয়তানের মতো দেখাচ্ছে…
…ইশশ কী বলছে শুনেছ…গোধরা হলে গুজরাতও হবে। এদের হাতে আমরা রাজদণ্ড দিয়েছি।…সত্যেন হরিবল…চা বাগান দেখাচ্ছে… এ লোকগুলো স্রেফ না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে! অনাহার না অসুখ এই নিয়ে তদন্ত কমিটি… সত্যেন এর পরেও আমরা দ্বিতীয় গাড়ি কিনি। আমাদের ছেলে নিজস্ব সেলফোনের বায়না ধরে!
কী অদ্ভুত কো-ইনসিডেন্স সত্যেন, তুমিও ওই দু-দিন ওখানেই ছিলে। দ্যাখোনি ওকে?
না।
আশ্চর্য তো!
আশ্চর্যের কী আছে? গিয়েছিলাম পার্টির সঙ্গে ডিপ্লোম্যাটিক মারপ্যাঁচ কষতে। গেস্ট হাউজে কে এল, কে এল না নজর রাখতে নয়। ঘর থেকে বেরোইনি পর্যন্ত। তার ওপর গ গাড়ির ভাবনাটা…
কিন্তু… কিন্তু পুলিশ যদি দুটোকে যোগ করে? যদি বলে…। মণিমালার চোখ। দুটো বড়ো বড়ো হয়ে যাচ্ছে।
বালিশের ওপর মুখ উপুড়, সত্যেন থরথর করে কাঁপছে। পুলিশ যোগ করবে কি না জানা নেই। কিন্তু মণি, মণিমালা যোগ করছে।
ফান, ওনলি ফান, বিশ্বাস করো মনি, লিজ গ্লো আমার কেউ না। আমিও তার কেউ না। খেলার সঙ্গী, বাস। আমি লোকলজ্জা থেকে বাঁচতে, আমার সংসার বাঁচাতে নিজের পায়ের ছাপ মুছে মুছে এসেছি। আসতে কি পারতাম, যদি তিনি আমাকে না বাঁচাতেন? কী হত, যদি আমি ওইরকম অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে না যেতাম। দুঃসংবাদ তোমাদের কাছে পৌঁছত, সঙ্গে নিহত একটি মেয়ের নাম জড়িয়ে থাকত, উভয়ের পরিচয় বার হত, তার পর সবাই সব বুঝত, তুমি বুঝে যেতে। তিনি বাঁচালেন বলেই আমি বাঁচবার জন্যে আর যা-যা করার করলাম। নইলে কী? মৃত্যু, তার চেয়েও বেশি দুশ্চরিত্র দুর্নাম, তার চেয়েও বেশি নিকটতম মানুষটির কাছে বিশ্বাসঘাতক…কিন্তু আমাকে সেসব দেখতে শুনতে ভোগ করতে হত না।
ফোন।
আমি মিসেস চ্যাটার্জি বলছি।—মণিমালা ধরেছে।
উনি ক-দিন অসুস্থ, ছুটিতে আছেন, ঘুমোচ্ছেন।
সামান্য কতকগুলো রুটিন এনকোয়ারি ম্যাডাম, হ্যাঁ ওই মেয়েটি সম্পর্ক, বেশি বিরক্ত করব না আসছি।
সত্যেন ঘুমোয়নি। সে কখনও পুরোপুরি ঘুমোয় না। ঘোরে থাকে।
শুনছ। দ্বিধাগ্রস্ত কন্দ্র স্বর মণিমালার-লালবাজার থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসছে।
আসুক।
তুমি একটু রেডি হয়ে নাও।
ঠিকই তো আছি।
চুলে একটু চিরুনি, কেমন বিধবস্ত লাগছে।
দু হাত মাথার মধ্যে চালিয়ে নিল সত্যেন—ঠিক আছে। ঠিকই…
ঘরটি অবাস্তব। যেমন স্বপ্নে দেখা যায়। অচেনা, আধোচেনা বস্তু সব। ওগুলোর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ কেউ ভেতর থেকে বলে যাচ্ছে—আছে, আছে।
স্টেডি, আপনি টলে যাচ্ছেন…।
ওঁর প্রেশার ভীষণ নেমে গেছে তো! ঘুমোচ্ছিলেন।
স্যরি টু ডিসটার্ব য়ু। জাস্ট কয়েকটা প্রশ্ন। মিসেস চ্যাটার্জি আপনি যেতে পারেন।
সত্যেন হাত বাড়িয়ে মণিমালার হাত ধরল, বলল—উনি থাকবেন।
অ্যাজ য়ু প্লিজ…আচ্ছা মি. চ্যাটার্জি আপনি মেয়েটিকে কতদিন চিনতেন?
অনেক দিন। তা বছর পাঁচ-ছয় তো বটেই!
কী সুত্রে চেনা, বলবেন?
সতর্ক গলা। সত্যেন বলল, বিদেশ থেকে ক্লায়েন্ট এলে আমাদের কাছ থেকে লোকাল কোনো পি. এ. চান। এই মেয়েটি সে রকম ফ্রি-লানস পি. এ. ছিল।
কতবার এভাবে ও আপনাদের কাজ করেছে?
একটু ভাবতে দিন…হ্যাঁ, চার-পাঁচবার হবে!
আপনি শিওর যে ও শুধু পি. এ.-র কাজই করত!
হঠাৎ মণিমালা বলে উঠল, আপনি ও করত বলছেন কেন? উনি করতেন বলতে কী অসুবিধে! একজন মহিলা তো!
সামান্য, খুব সামান্য একটু ব্যঙ্গের হাসি ভদ্রলোকের মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।—মি. চ্যাটার্জি, আপনি আমার কথার উত্তর দিন।
দেখুন, আমার কাজ হল কোম্পানির তরফ থেকে অ্যাভেলেবল কোনো পি. এ. পাঠানো। তারপর আমি কী বলতে পারি!
পারেন, কিন্তু বলবেন না। এই ভ্রাম্যমান ক্লায়েন্টদের সবরকম চাহিদার দিকে আপনাদের লক্ষ রাখতে হয়, হয় না?
সত্যেন চুপ করে রইল।
এতবার আপনি মেয়েটিকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন, অথচ তাকে দু-দুটো জায়গায় দেখেও চিনতে পারলেন না?
দেখুন, ফার্স্ট থিং অ্যাপয়েন্ট করা আমাদের কাজ না। ওটা সাবর্ডিনেটরাই করে দিতে পারেন। তবে পার্টির সঙ্গে কথাবার্তার সময়ে মেয়েটি যখন পি. এ. হিসেবে উপস্থিত থেকেছে, নিশ্চয়ই দেখেছি। তবে ওসব জায়গায় আমি গেছি জরুরি কাজে। নিশ্চয় খেয়াল করিনি।
মেয়েটি কলকাতায় ফিরতে আপনার ও আপনার ইন্ডিকার সাহায্য নেয়নি বলছেন! মি, চ্যাটার্জি আপনার চুরি যাওয়া গাড়িটা নীল ইন্ডিকা, সেকেন্ড জানুয়ারি দুর্ঘটনার গাড়িটাও নীলই ছিল, সম্ভবত ইন্ডিকাও। শান্তিনিকেতনেও আপনাকে ওই গাড়িতে দেখা গেছে। আপনার গাড়ি চুরির গল্পটা স্যরি, বানানো। এখন যদি বলি মহিলাটি আপনার সঙ্গেই ফিরছিলেন পথে মারত্মক দুর্ঘটনা ঘটে, আপনি সামহাউ বেঁচে যান। তারপর এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে ভেবে সমস্তটাই চেপে গেছেন।
বলুন!
যদি বলি মেয়েটি কাকতালীয়ভাবে আপনার সঙ্গে ফিরছিলেন না, এঁর সঙ্গে আপনি অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন, ফেরবার পথে দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা!
বলতেই পারেন।
আপনি এর প্রতিবাদ করবেন না? বিপক্ষে প্রমাণ দেখাতে চেষ্টা করবেন না?
লাভ?
যদি বলি, ওটা একটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, সুপরিকল্পিত মার্ডার! আপনি ক্রমশই মেয়েটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিলেন, ছাড়া পেতে চাইছিলেন, পারিবারিক শান্তি মানসম্মান বিপন্ন হবার ভয় পাচ্ছিলেন, সুযোগ খুঁজছিলেন, গাঁ গাঁ করে লরিটাকে ছুটে আসতে দেখে আপনি ওস্তাদ ড্রাইভার নিজের দিকে দরজা খুলে লাফ মারেন। গাড়িটা আপনার অস্বস্তি, আপনার লজ্জা সমেত গুড়িয়ে যায়!
সত্যেন একটু চমকাল, তারপর স্থির চোখে চেয়ে বলল, বলতেই পারেন।
আপনি প্রতিবাদ করবেন না? আপনার স্বপক্ষে প্রমাণ-ট্রমান…
লাভ?
দূর মশাই। আই, বি-র অফিসারটি হঠাৎ খোলা গলায় হেসে উঠলেন, আমি আপনার সঙ্গে রসিকতা করছিলাম, স্যরি। ওই প্রথম থিয়োরিটাই ঠিক। মেয়েটি দৈবাৎ আপনার গাড়িতে আসে। জাস্ট আ লিফট! মিসেস চ্যাটার্জি প্লিজ একটু চা বা কফি…গলা শুকিয়ে গেছে।
ভারী পায়ে মণিমালা চলে গেল। যেন নিজেকে টেনে টেনে।
তখন অফিসার পকেট থেকে একটা খাম বার করলেন। তবে ভেতরে একটি মাত্র ফটো। কোয়াটার সাইজ। সত্যেন, পেছনে লেখা—সত্যেন মাই লভ, মাই লাইফ। চকিতে ফটোটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন অফিসার।
এ ফটো আপনি ওকে দিয়েছিলেন?
নো, নেভার।
কোনো গ্রুপ ফটো থেকে আলাদা করে স্ক্যান করে ছবিটা বানিয়েছে ও। স্টুডিয়োর নাম রয়েছে। আমরা এনকয়ারি করে তাই জেনেছি। অ্যাকচুয়ালি এই ফটোটাই আপনাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে মি. চ্যাটার্জি। আপনি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, রুদ্রপলাশ রিসর্ট। ও ছুটতে ছুটতে এসে বলল, মি. চ্যাটার্জি না? আপনি কি কলকাতা ফিরছেন? আমাকে প্লিজ একটা লিফট দিন। আমি ট্রেন মিস করেছি অর হোয়াটেভার…এই ডায়ালগটা স্পষ্ট মনে কষতে পেরেছে রুদ্রপলাশ-এর এক কর্মী, ছবিটা ও-ই পায়, তাড়াতাড়িতে মেয়েটার ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েছিল। ডু য়ু সি? এই নষ্ট মেয়েটা সামহাউ আপনাকে ভালোবেসেছিল। ছায়ার মতো অনুসরণ করত, যদি কখনও সুযোগ আসে…যদি কখনও…। সেই সুযোগই ও পেয়ে গেল রুদ্রপলাশ-এ। তো এই হচ্ছে ব্যাপার। টোট্যালি নষ্ট, বার্ট ডেডলি সিরিয়াস ইন লভ। স্ট্রেঞ্জ!
এখন এখানে কেউ নেই, কিছু নেই, অনর্থক ভিড়, আলো অথবা অন্ধকার। মাথাটা ঘোর, অথচ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার চিন্তা করতে পারছে এখন। সত্যেন। স্ট্রেঞ্জ! স্ট্রেঞ্জ! কফি আর স্ন্যাকস-এর ট্রে নিয়ে মণিমালা ঢুকে আসছে। না অফিসার—সে থেমে থেমে পরিষ্কার উচ্চারণ করল-ব্যাপারটা এই নয়। ব্যাপারটা হল আমাদের একটা অ্যাফেয়ার চলছিল। আমার কাছে ওটা ফান জাস্ট একটা ফান।…বাট…অ্যাজ য়ু সে… শি ওয়াজ ডেডলি সিরিয়াস। সো…ইউ সি…আই কিলড হার। ওর মৃত্যুর দায় আমার।