ভূতের উপদ্রব
আমাদের বাড়িতে ইদানীং ভূতের উপদ্রব হয়েছে।
নিচতলার ভাড়াটে নেজাম সাহেবের মতে একটি অল্পবয়েসী মেয়ের ছায়া নাকি ঘুরে বেড়ায়। গভীর রাতে উঁ উঁ করে কাঁদে। রাতবিরাতে সাদা কাপড় পরে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
নেজাম সাহেব লোকটি মহা চালাবাজ। ছোট ছোট ধূর্ত চোখ। মাথা নিচু করে এমনভাবে হাঁটেন যে দেখলেই মনে হয় কিছু একটা মতলব আছে। এই লোকের কথা বিশ্বাস করার কেনোই কারণ নেই, তবু আমি তাঁকে ডেকে পাঠালাম। গলার স্বর যতদুর সম্ভব গম্ভীর করে বললাম, কী সব আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছেন?
নেজাম সাহেব এমন ভাব করলেন, যেন আমি একটি দারুণ অন্যায় কথা বলে ফেলেছি। মুখ কালো করে বললেন, আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছি? আমি? বলেন কি ভাই সাহেব?
ভূত-প্রেতের কথা বলে বেড়াচ্ছেন লোকজনদের, বলছেন না?
ভূত-প্রেতের কথা তো বলি নাই। বলেছি। একটি মেয়ের ছায়া আছে এই বাড়িতে।
ছায়া আছে মানে?
বাড়ির মধ্যে আপনার, ভাই, দোষ আছে।
বলতে বলতে নেজাম সাহেব এমন একটি ভঙ্গি করলেন, যেন চোখের সামনে ছায়াময়ী মেয়েটিকে দেখতে পেয়েছেন।
বাড়ি-বন্ধনের ব্যবস্থা করা দরকার। বুঝলেন ভাই।
আমি কঠিন স্বরে বললাম, যা বলেছেন, বলেছেন। আর বলবেন না।
নেজাম সাহেবকে বিদায় করে ঘরে এসে বসতেই আমার নিজের খানিকটা ভয়-ভয় করতে লাগল। রান্নাঘরে কিসের যেনে খটখট শব্দ হচ্ছে। বাথরুমের কলটি কি খোলা ছিল? সরাসরি করে পানি পড়ছে। রান্নাঘরে কেউ যেন হাঁটছে। কাদের কি ফিরে এসেছে নাকি? আমি উঁচু গলায় ডাকলাম, এই কাদের। এই কাদের মিয়া।
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। সাড়া পাওয়ার কথাও নয়। কাদের গিয়েছে সিগারেট আনতে। রাস্তার ওপাশেই পান-বিড়ির দোকান, তবু তার ঘণ্টাখানিক লাগবে ফিরতে।
রান্নাঘরে আবার কী যেন একটি শব্দ হল। তার পরপরই কারেন্ট চলে গিয়ে চারদিক হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে গেল। আমি বারান্দায় এসে দেখি ফাকফকা জোৎস্না উঠেছে। নিচতলার নীলু বিলুদুবোন ঘরের বাইরে মোড়া পেতে বসে আছে। নেজাম সাহেব উঠোনে দাঁড়িয়ে গুজগুজ করে কী যেন বলছেন তাদের! আমাকে দেখে কথাবার্তা থেমে গেল। নেজাম সাহেব তরল গলায় বললেন, কেমন চাঁদনি দেখছেন ভাই? এর নাম সর্বনাশ চাঁদনি।
আমি জবাব দিলাম না। এই জাতীয় লোকদের সঙ্গে কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। নেজাম সাহেব গুনগুন করে বিলুকে কী যেন বললেন। বিলু হেসে উঠল খিলখিল করে। এ রকম জ্যোৎস্নায় ভরা-বয়সের মেয়েদের খিলখিল হাসি শুনলে গা বিমঝিম করে। আমি নিজের ঘরে ফিরে কাদেরের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রান্নাঘর থেকে আবার খটখট শব্দ উঠল। বিলু নীলু দু জনেই আবার শব্দ করে হেসে উঠল। আমি ধরা গলায় ডাকলাম, কাদের, কাদের মিয়া।
কাদের ফিরল রাত দশটায়, এবং এমন ভাব করতে লাগল যেন এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে দু ঘণ্টা লাগাটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে গম্ভীর হয়ে হারিকেন ধরাল। তার চেয়েও গম্ভীর হয়ে বলল, অবস্থােডা খুব খারাপ ছোড ভাই।
আমি চুপ করে রইলাম। কথাবার্তা শুরু করলেই আমার রাগ পড়ে যাবে। সেটা হতে দেওয়া যায় না!
ছোড়া ভাই, দিন খারাপ।
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, ভাত দে, কাদের।
আর ভাত! ভাত খাওনের দিন শেষ ছোড ভাই। মিত্যু সন্নিকট। যে-কোনো গুরুগম্ভীর আলোচনায় কাদের মিয়া সাধু ভাষা ব্যবহার করে। এই অভ্যাস আগে ছিল না। নতুন হয়েছে।
সব্বমোট তের লাখ ছয়চল্লিশ হাজার পাঁচ শ পাঞ্জাবী এখন ঢাকা শহরে বর্তমান। আরো আসতাছে।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, খাওয়াদাওয়ার পর কাদেরকে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলব, ভবিষ্যতে সে যদি ফিরতে পাঁচ মিনিটের বিসমিল্লাহ্ বিদায়।
ভাত খাওয়ার সময় কাদের মিয়া আবার তার পাঞ্জাবী মিলিটারির গল্প ফাঁদতে চেষ্টা করল।
বাচ্চু ভাই দরবেশ কইছে এই দফায় বাঙ্গালির কাম শেষ।
আমি জবাব দিলাম না। কাদেরের অভ্যাস হচ্ছে, যে-সব বিষয় আমি পছন্দ করি না, খাওয়ার সময় সেইসব বিষয়ের অবতারণা করা। গতরাত্রে খাওয়ার সময় সে তার মামাত ভাইয়ের গল্প শুরু করল। সেই মামাত ভাইটিকে কে যেন খুন করে একটা গাবগাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। পনের দিন পর সেই লাশ আবিষ্কার হল। আমি যখন ভাতের সঙ্গে ডাল মাখছি, তখন কাদের মিয়া সেই পচাগলা লাশের একটি বীভৎস প্রত্যক্ষদশীর বর্ণনা দিয়ে ফেলল। খাওয়া বন্ধ করে বাথরুমে গিয়ে বমি করতে হল আমাকে। আজকেও যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে—জন্যে আমি কথা বলার ইচ্ছা না থাকা সত্বেও বললাম, বাচ্চু ভাই দরবেশটা কে?
চায়ের দোকান আছে একটা। সুফি মানুষ। তাঁর এক চাচা হইলেন হয়রত ফজলুল করিম নকশবন্দি।
নকশবনিব্দ জিনিসটা কি?
পীর ফকিরের নামের মইধ্যে থাকে ছোড়া ভাই।
নকশাবন্দির ভাতিজার কাছে ভবিষ্যতে আর যেন না যাওয়া হয়! কাদের মিয়া উত্তর দিল না। আমি ঠাণ্ডা; গলায় বললাম, এই সব লোকজন আমি মোটেই পছন্দ করি না।
দরবেশ বাচ্চু ভাই এক জন বিশিষ্ট পীর।
পীর মানুষ চায়ের দোকান দিয়ে বসে আছে, এটা কেমন কথা?
আমাদের নবী— এ! করিম রসূলাল্লাহ নিজেও তো ব্যবসাপতি করতেন ছোড ভাই।
আমি সরু চোখে তাকালাম আকাদেরের দিকে! মুখে মুখে কথা বলাব এই অভ্যাসও কন্দেরের নতুন হয়েছে। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তোমার সঙ্গে আমার কথা মাছে কাদের।
কাদের সঙ্গে আমি তুই-তুই করে বলি। কোনো কারণে বিশেষ রেগে গেলেই শুধু তুমি সম্বোধন করি। কাদের তখন দারুণ নাৰ্ভাস বোধ করে।
কী কথা ছোড ভাই?
কি কথা বলবার আগেই নিচতলার তিন নম্বর ঘর থেকে কানার শব্দ শোনা যেতে লাগল। আজ এক মাস ধরে এই বাড়ির মেয়েটি কাঁদছে। এপ্রিল মাসের তিন তারিখ জলিল সাহেব বাড়ি ফেরেন নি। তাঁর স্ত্রী হয়তো রোজ আশা করে থাকে আজ ফিরবে। রাত এগারটা থেকে কাফিউ। এগারটা বেজে গেলে আর ফেরবার আশা থাকে না। মেয়েটি তখন কাঁদতে শুরু করে। মানুষের শোকের প্রকাশ এত শব্দময় কেন? যে-মেয়েটির কোনো কথা কোনো দিন শুনি নি, গভীর রাতে তার কান্না শুনতে এমন অদ্ভুত লাগে!
ছোড ভাই, জলিল সাবের এক ভাই আসছে আইজ।
তবে যে শুনলাম জলিল সাহেবের কোনো ভাই নেই।
চাচাত ভাই। মৌলানা মানুষ। বউ আর পুলাপানিটিরে নিতে আইছে।
কবে নেবো?
বউট যাইতে চায় না।
কেন যেতে চায় না?
কি জানি। মাইয়া মাইনসের কি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু আছে?
আমি চুপ করে রইলাম। কাদের মিয়া বলল, সময়ডা খুব খারাপ। কেয়ামত নজদিক।
ঘুমুতে গেলাম অনেক রাতে। বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূরে কোথায়ও গুলীর শব্দ শোনা গেল। গুলীর শব্দ দিয়ে এখন আর ভয় দেখানর প্রয়োজন নেই। তবু ওরা কেন রোজ গুলী ছেড়ে কে জানে!
কাদের আমার পাশের ঘরে শোয়। তার খুব সজাগ নিদ্রা। সামান্য খটখট শব্দেও জেগে উঠে বিকট হাক দেয়–কেডা, কেডা শব্দ করে?
আজকেও গুলীর শব্দে জেগে উঠল। ভীত স্বরে বলল, শুনতাছেন ছোড় ভাই? কাম সাফ।
আমি জবাব দিলাম না। আমার সাড়া পেলেই ব্যাটা উঠে এসে এমন সব গল্প ফাঁদবে যে ঘুমের দফা সারা।
ছোড ভাই ঘুমাইছেন?
আমি গাঢ় ঘুমের ভান করলাম। লম্বা নিঃশ্বাস ফেললাম।
ছোড ভাই, ও ছোড ভাই।
কি?
মিত্যু সন্নিকট ছোড ভাই।
ঘুমা কাদের। বকবক করিস না।
আর ঘুম! বাঁচলে তো ঘুম। জীবনই নাই।
ঝামেলা করিস না কাদের, ঘুমা।
কাদের ঘুমায় না। বিড়ি ধরায়। বিড়ির কড়া গন্ধে বমি আসার যোগাড় হয়। চারদিক নীরব হয়ে যায়। জলিল সাহেবের স্ত্রীর কান্নাও আর শোনা যায় না। কিছুতেই ঘুম আসে না আমার। বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করি। এক বার বাথরুমে গিয়ে মাথা ধুয়ে এলাম। মাথার নিচে তিনটি বালিশ দিয়ে উঁচু করলাম। আবার বালিশ ছাড়া ঘুমুতে চেষ্টা করলাম। কিছুতেই কিছু হয় না। এক সময় কাদের মিয়া বলল, ঘুম আসে না ছোড ভাই?
না।
আমারো না। বড়ো ভয় লাগে।
ভয়ের কিছু নাই কাদের।
তা ঠিক। মৃত্যু হইল গিয়া কপালের লিখন। না যায় খণ্ডন।
কাদেরের সঙ্গে আমার কিছু কিছু মিল আছে। সে আমার মতোই ভীরু এবং আমার মতো তারও কঠিন অনিদ্রা রোগ।
সাড়ে তিনটার দিকে ঘুমের আশা বাদ দিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। কাদের মিয়া চায়ের জন্য কেরোসিনের চুলা ধরাল। চুলাটাও সে নিয়ে এসেছে বারান্দায়। আমার দিকে পিঠ দিয়ে আবার বিড়ি ধরিয়েছে।
নিচতলায়ও কে এক জন যেন সিগারেট ধরিয়েছে, বসে আছে জামগাছের নিচে–অন্ধকারে।
গাছ তলায় ওটা কে বসে আছে, কাদের?
কাদের কিছু না দেখেই বলল, নেজাম সাহেব।
বুঝলে কী করে নেজাম সাহেব?
নেজাম সাহেবেরও রাইতে ঘুম হয় না।
বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি ধরে গেল। ঝিমুনির মধ্যে মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, ভোরবেলা এক জন ডাক্তারের কাছে যাব। রাতের পর রাত না ঘুমানটা ভালো কথা নয়। বড়ো আপার বাসায়ও যেতে হবে। বড়ো আপা এর মধ্যে তিন বার খবর পাঠিয়েছে। জলিল সাহেবের ভাইয়ের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। তারাও যদি সত্যি সত্যি চলে যায়, তাহলে ভাড়াটে দেখা দরকার। ভাড়াটে পাওয়া যাবে না, বলাই বাহুল্য। শহর ছেড়ে সবাই এখন যাচ্ছে গ্রামে। কিন্তু বড়ো আপা এই সব শুনবে না। তাঁর ধারণা–ঢাকা শহরের চার ভাগের এক ভাগ লোক থাকার জায়গা পাচ্ছে না। রাত দিন টু লেট খুঁজে বেড়াচ্ছে।
চা হয়েছে চমৎকার। চুমুক দিয়ে বেশ লাগল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। চাঁদের স্নান আলো। শীত শীত হিমেল হাওয়া দিচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে দূরে কোথায়। মনটা হঠাৎ দারুণ খারাপ হয়ে গেল।