Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সুখীজীবন লাভের উপায় || Moti Nandi

সুখীজীবন লাভের উপায় || Moti Nandi

সুখীজীবন লাভের উপায়

ক-দিন খটাং খটাং করে অবশেষে পাখাটা মাঝরাতে বন্ধ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণটা বুঝে সুধীন খিঁচিয়ে উঠল, মনে করে একটা পাখা মিস্ত্রিও ডাকতে পারনি? সারারাত এখন ছটফট করি!

মিস্ত্রি কি আমি গিয়ে ডেকে আনব? পাঁচ দিন আগে বলেছি পাখাটা কীরকম বিদঘুটে শব্দ করছে, এক বার দ্যাখো। যতটা চাপা স্বরে নিঝুম রাতে ঝাঁঝ দেখানো যায়, সুধা দেখাল।

খোকাকে দিয়েও তো ডাকাতে পারতে, না সেটাও আমার জন্য তুলে রেখেছ! বিড়বিড় করতে করতে সুধীন মেঝেয় নেমে শুল। হুল ফুটিয়ে পাশের ঘরের টেবল পাখাটা বোলতার মতো শব্দ করে যাচ্ছে। ওটাকে নিয়ে এলে খোকার কষ্ট হবে এই ভেবে সুধা রান্নাঘর থেকে হাতপাখা এনে সুধীনকে বাতাস শুরু করল। বাইরে ফটফটে জ্যোৎস্না, সুধার মনে হল এর বদলে হু-হু হাওয়া দিলে দুর্ভোগ কত কমে যেত।

সকালে বাজার থেকে ফিরে সুধীন বলল, ইলেকট্রিক দোকানটা এখনও খোলেনি, কলেজ যাবার আগে খোকা যেন অবশ্যই মিস্ত্রিকে খবর দিয়ে আসে।

ওরা দুজন বেরিয়ে গেলে সুধার আর কিছু করার থাকে না। খাওয়া সেরে দিন রাতের ঝি বন্ধুর মা দুপুরটা মেয়ের বাড়ি কাটাতে যায়। সুধা দরজা-জানলা বন্ধ করে পাখা চালিয়ে মেঝেয় শুয়ে থাকে, আজ শুয়েছে খোকার ঘরে। ঘুমটা সবে জমে উঠছে, তখনই কড়া নাড়ার শব্দ হল।

দরজা খুলে দেখল শীর্ণদেহ আধবুড়ো একটা লোক, পরনে খাকি ট্রাউজার্স আর নীল হাওয়াই শার্ট—দুটোই ময়লা। কানের পিছন দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। জামায় ঘাম মুছে বলল, পাখা খারাপ হয়েছে বলে কি দোকানে খবর দিয়েছিলেন?

আমার ছেলে দিয়ে এসেছে, আসুন। মিস্ত্রিকে ঘরে নিয়ে এল সুধা। গায়ে ব্লাউজ না থাকায় খুব অস্বস্তি হচ্ছে, তবে লোকটা মিস্ত্রি আর ছেলেছোকরা নয়, সুতরাং আঁচলটা শুধু এপার-ওপার টেনে দিল।

মিস্ত্রি সুইচ টিপল, পাখা ঘুরল না। সেলাই কলের টুলটা টেনে নিয়ে বলল, একটা চেয়ারও লাগবে।

খোকার ঘর থেকে নিজেই চেয়ার আনবে কি না ভেবে সুধা ইতস্তত করল। এসব কাজ তো মিস্ত্রিদেরই করার কথা।

পাশের ঘরে আছে।

সুধা সঙ্গে করে মিস্ত্রিকে নিয়ে এল। খোকা কলমটলম ফেলে যায় টেবলে। চেয়ার এনে তার উপর টুলটা রাখল। রাখার জায়গা নেই বললেই হয়। একচুল সরে গেলেই টুলটা পড়ে যাবে। সুধা অবাক হয়ে গেল, অদ্ভুত কায়দায় মিস্ত্রিকে উপরে উঠতে দেখে। তাড়াতাড়ি সে টুলটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরল। মিস্ত্রি পাখার ব্লেড খুলতে খুলতে বলল, আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনি ছেড়ে দিন।

তবু যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়!

সুধার ভয় হল, তাহলেই তো পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করবে। অবশ্য অ্যাকসিডেন্ট মানেই অনিচ্ছাকৃত, তাতে দোষ নেই। মিস্ত্রি পাখার ব্লেডগুলো খোলে আর সুধা সেগুলো নিয়ে মেঝেয় রাখে, তারপর সিলিং-এর আংটা থেকে হাঁড়িটা চাড় দিয়ে তুলে খুলল। কাঁধে রাখল, সিধে অবস্থায় উবু হয়ে বসল, একটা পা সাবধানে টুলের নীচে চেয়ারে রাখল, তারপর অন্য পা। মেঝেয় নামল টুক করে লাফিয়ে। সুধা সারাক্ষণ টুল আঁকড়ে রইল।

পাখার হাঁড়িটা দেখে সুধার মনে হল—ব্লেডসমেত যখন ঘোরে তখন বোঝা যায় না, কিন্তু এখন দেখাচ্ছে ঠিক সুধীনের মুন্ডু। দুটো চোখ, একটু গোঁফ, টাক মাথা। শুধু যা টিকিটাই সুধীনের নেই। এটা ওরই কেনা, খোকা হবার দু-মাস পর। মিস্ত্রি স্ক্রগুলো খুলে মুভুর খুলিটা ফাঁক করল। বাসি রক্তের মতো চিটটিটে কালো তেল, ভুসি ইত্যাদি। সুধীনের মাথার মধ্যেটাও এরকম কি না-এই ধরনের একটা সন্দেহ সুধার মনে দেখা দেওয়ার উপক্রম করতে-না-করতেই মিস্ত্রি বলল, এখানে সারানো যাবে না, নিয়ে যেতে হবে।

কেন!

কম্যুটেটারের মাইকা গেছে। বলে মিস্ত্রি একটা জায়গা দেখাল, সুধার যেটাকে দাঁতের পাটি মনে হল।

ক-দিন লাগবে?

চার-পাঁচ দিন। মিস্ত্রি খুলিটাতে স্ক্রু আঁটতে আঁটতে বলল।

এই গরমে অ্যাদ্দিন পাখা ছাড়া। তাহলে তো মরেই যাব।

মিস্ত্রি হাসল, খুব গূঢ় ধরনের। শিশুরা আপন মনে যেভাবে হাসে বা শিশুদের হাসি দেখে

বয়স্করা।

হাতে এখন প্রচুর কাজ। পাঁচ দিনেও হয় কি না কে জানে।

কত লাগবে?

আঠারো টাকা।

বলল যেন হিসাব কষে, কিন্তু সুধার মনে হল, আগেই যেন ঠিক করে রেখেছিল। তবে পাখা হাতছাড়া করা চলবে না। লোকটা চোরছ্যাঁচড় কি না কে জানে। মিস্ত্রি সেজে এরকম তো অনেকেই আসে। তা ছাড়া আঠারো টাকার মতো ব্যাপার, সুধীনকে না জানিয়ে কী করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

উনি বরং আসুন, পরে জানাব। দু-দিক রেখে সুধা বলল।

পাখার মুন্ডুটা ঘরের একধারে সরিয়ে চেয়ারটা পাশের ঘরে রেখে মিস্ত্রি বেরিয়ে যাচ্ছে। সুধা সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। দরজাটা পার হয়েই মিস্ত্রি হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাকে প্রথমে চিনতেই পারিনি। বেশ মোটা হয়ে গেছেন। গলার জড়লটা দেখে চিনলাম আপনি প্রফুল্লর বউ।

সুধার একটু সময় লাগল মাথাটা ঘুরে উঠতে। ঝাপসা হয়ে গেল দেয়াল, সিঁড়ি এবং সামনের লোকটি। অস্ফুটে বলল, আপনি কার কথা বলছেন? আপনি কে?

আমার নাম হরিশংকর দাঁ। আপনার বিয়েতে আমি একজন সাক্ষী ছিলুম। এতদিন হয়ে গেল, আমাকে অবশ্য চিনতে না পারারই কথা। কতক্ষণই-বা দেখেছেন। আমি আর বলাই চন্দ সাক্ষী ছিলুম। আপনি ট্যাক্সি করে এলেন, চটপট সই করলুম আমরা। বাড়ি থেকে লুকিয়ে এসেছিলেন তাই তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতেই চলে গেলেন। আমার বউ কাগজে মুড়ে সিঁদুর দিয়েছিল। মনে আছে, আপনার সিঁথিতে একটুখানি লাগিয়ে দিয়েছিলুম তাইতে আপনি খুব ভয় পেলেন!

সুধা একদৃষ্টে হরিশংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখে যে অবিশ্বাসটুকু ছিল তা ঘুচে গেছে।

কিন্তু এতদিন পর কীভাবে কোথা থেকে লোকটা হাজির হল! এটা যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়, তা ছাড়া আর কী, তাহলে ওর আসাটা ইচ্ছাকৃত নয়। সুতরাং ওর কোনো দোষ নেই। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী সুধীনের মুন্ডুর মতো পাখাটা। কেন যে খারাপ হয়, কোম্পানিটাই জোচ্চোর। কিন্তু কী আশ্চর্য, দড়াম করে সুধা দরজাটা বন্ধ করে দিল। এতদিন পর ও চিনতে পারল আর আমি পারলাম না! লোকটা তাহলে মনে করে রেখে দিয়েছে, তার মানে মতলব আছে।

অস্থির হয়ে খুব পায়চারি করল সুধা ঘর বারান্দা দালান ঘুরে। শেষে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। বুকটা ভার হয়ে আসছে। কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করল। খুলতেই সিলিং পাখার আংটা দেখল। জায়গাটা খালি খালি লাগল। তাইতে ওর মনে পড়ল এইরকম খালি কিংবা আর একটু বেশিই হবে, লেগেছিল প্রফুল্লর মৃত্যুর খবর পেয়ে। তার আগে অবশ্য বিয়ের ব্যাপারটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় দো-তলা থেকে এক-তলায় নামা বন্ধ হয়ে গেছল। খুব খুশি হয়েছিল বাড়ির সবাই। একে বেজাত, তায় চটকলের সামান্য কেরানি, ইউনিয়ন করে, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, মেসে থাকে, এমন ছেলের সঙ্গে বিয়েতে কে অখুশি না হয়! খোকা যদি মেয়ে হত, আর অমন একটা ছেলেকে যদি ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে বসত! এই পৃথিবীতে, ব্যাপারটাকে বিরাট এবং জোরালো করার জন্য সুধা ভাবল—কোন বাপ-মা রাজি হবে? ধানবাদের কাছে জিটি রোডে প্রফুল্ল লরি চাপায় মারা গেল বিয়ের পনেরো কি যোলো দিন পরই। প্রফুল্ল ভেঁকুর তুলত, অম্বল ছিল। মাকুন্দও ছিল। বেশ কচি কচি একটা ভাব ছিল ওর মুখে। ছোটোকাকা বলল, যে গেছে তার জন্য দুঃখ করতে হয় কর, আমরা বুঝতেই পারছি। পাঁচ মাস ছ-মাস যত সময় চাস নে। কিন্তু কতবড়ো ভবিষ্যৎ তোর সামনে, বয়স তো মোটে বাইশ। একটা ভালো পাত্তর হাতে এসেছে, বিধবা হয়ে না থেকে বিয়ে করে ফ্যাল। আমরা চার জন ছাড়া কেউ জানতেও পারবে না। চার-জন মানে বাবা-মা কাকা-কাকি।

বাবা মারা গেছেন, তা হলে রইল তিন জন। হঠাৎ এই সাক্ষীটা এসে আবার চার জন হয়ে গেল। তাই-বা কী করে হয়? সুধা বিরক্ত হয়ে উঠল। বলাই চন্দ নামে একটা লোকের নাম করল, সেও তো জানে। তা হলে পাঁচ জন। কোনদিন দরজি কিংবা ছাতাসারাইওলা কিংবা বাস-কণ্ডাক্টর বলবে, আপনি মোটা হলেও, রংটা ময়লা হলেও গলার জড়লটা দেখে ঠিকই চিনেছি। আপনার বিয়েতে আমি সাক্ষী ছিলুম, চিনতে পারছেন না, আমি বলাই চন্দ। এই যে একটা চিহ্ন—শরীরের এত জায়গা থাকতে ভগবান কেন যে গলায় দেগে দিল!

সুধা গলায় হাত বুলোতে লাগল। জীবনের প্রথম চুমুটা এখানেই। প্রফুল্লই দিয়েছিল বেলুড়ে গঙ্গার ধারে বসে। এর কোনো সাক্ষীটাক্ষি নিশ্চয় হাজির হয়ে বলবে না আপনিও তো চুমু দিয়েছিলেন। বলা যায় না, কে ভেবেছিল এতদিন পর এই লোকটা হাজির হবে!

এটাও অ্যাকসিডেন্ট, অতএব সুধা একটু অসুবিধা বোধ করল—কাউকেই তো দোষ দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এই হরিশংকর যদি সুধীনকে বলে দেয়, মশাই আপনার বউয়ের আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, তা জানেন কি? শোনামাত্রই রগচটা সুধীন হাতের কাছে যা পাবে দমাস করে কষিয়ে দেবে। যদি হরিশংকরকে কষায় তাহলে ও মরে যাবে।

সুধা মৃত হরিশঙ্করকে ভেবে ভয় পেল। এর জন্য সুধীনের নিশ্চয় ফাঁসি হবে। তবে সুধীন এমএ পাস, একটা ব্যাঙ্কের সাড়ে ন-শো টাকার দায়িত্ববান কর্মচারী। বি এসসি পড়া ছেলের বাবা, বউয়ের নামে সল্ট লেকে তিন কাঠা জমি কিনেছে, সে কি এমন হঠকারিতা করবে! নিশ্চয় প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যাবে। কাতর হয়ে পড়বে। একটা আঘাত তো বটে! শয্যাশায়ীও হতে পারে। সুধার মনে পড়ল, পাঁচ দিন কি চার দিন সে শুয়েছিল। চোখ দিয়ে খালি জল ঝরত। সুধীন যদি ওইভাবে কাঁদতে শুরু করে। আর একটা সম্ভাবনার কথাও ভাবা যায়। তখন মরতে ইচ্ছে করেছিল। এক্ষেত্রে সুধীনের এই খবরটা স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ তুল্যই। সুতরাং সে আত্মহত্যা করলেও করতে পারে। তবে যতদূর মনে হয়, সুধা আশা করল, তা করবে । তা হলে কী করতে পারে? অর্থাৎ এই কথাটা শোনার পর?

ভেবে ভেবে সুধা গোটা দুপুরটাই নাজেহাল হয়ে গেল।

শোনামাত্র সুধীন চিৎকার করে উঠল।

পাঁচ দিন গরমে পচতে হবে? আঠারো টাকা গচ্চা দিতে হবে যখন দিয়ে দিলেই পারতে। কালকে দেওয়া মানে দু-দিন গরমে পচা! সাধে কি আর বলি… পাশের ঘরে খোকা আছে তাই থেমে গেল।

লোকটা খাঁটি কি না না-জেনেই দিয়ে দোব? যদি ঠগ-জোচ্চোর হয়। এই বলেই সুধার মনে হল, সাক্ষী ছিলুম বললেই তো হয় না, প্রমাণ দিতে হবে। সুধীন যখন বলবে, মুখের কথায় এত বড়ো একটা ব্যাপার কি মেনে নেওয়া যায়। হরিশংকর তখন কীভাবে প্রমাণ করবে? সেই বলাই চন্দকে ডেকে আনবে? ওরকম সাক্ষী তো ভাড়া করেও আনা যায়। আসলে অকাট্য প্রমাণ চাই।

খোকাকে বলে দিয়ে মিস্ত্রিকে যেন বলে আসে পাখাটা নিয়ে যাবার জন্য। আর, একটা পাখা যেন ভাড়া করে আনে। এই বলে সুধীন বাসি খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল। এই তো কত সহজেই ভাড়া করা যায়, সুধা ভাবল। মানুষ ভাড়া করা কি এর থেকেও শক্ত?

রাত্রে ঘুম এল না। সুধা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কাল পূর্ণিমা গেছে। খুব জ্যোৎস্না হয়েছে। হাতটা সে বাড়িয়ে দিল। বেলুড় থেকে নৌকোয় পার হওয়ার সময় এইরকম জ্যোৎস্না ছিল। হাতটা এগিয়ে ধরে প্রফুল্ল বলেছিল, ঠিক যেন বৃষ্টির মতো হাতে পড়ছে।

কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে সুধা টেনে নিল। বৃষ্টি না আর-কিছু, হলে তো বেঁচে যাই। তারপর ঘরে এসে গা আদুড় করে সুধীনের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন দুপুরে হরিশংকর একটা পুরোনো কালো পাখা নিয়ে এল। হাঁড়িটা মস্ত বড়ো। তাতে গোটা দশ-বারো গর্ত। সুধা মিষ্টি গলায় ওকে ভেতরে আসতে বলল। খুব ঘেমে গেছে দেখে আরও মিষ্টি করে বলল, এত ভারী একটা জিনিস বয়ে এনেছেন, আগে একটু জিরিয়ে নিন।

তাইতে নিরাসক্ত পেশাদারি গলায় হরিশংকর বলল, এসব অভ্যেস আছে। এবং তাইতে সুধার মনে হল, লোকটা সুবিধের নয়।

হরিশংকর পাশের ঘর থেকে চেয়ার আনল। টুলটা তার উপর রেখে কালো পাখাটা কাঁধে নিয়ে উঠতেই কালকের মতো সুধা আঁকড়ে রইল টুল।

আপনি খুব এক্সপার্ট, কতদিন এ কাজ করছেন? সুধা আলাপ জমাবার চেষ্টা শুরু করল।

অনেক দিন।

আগে তো কারখানায় কাজ করতেন।

হ্যাঁ।

তাহলে!

ঘাড় নীচু করে হরিশংকর তাকাল। গায়ে ব্লাউজ আছে, তবুও কেমন যেন করে উঠল। সুধার সর্বাঙ্গ।

আপনি জানেন না? হরিশংকর নিথর গলায় প্রশ্ন করল।

কী?

প্রফুল্লের জন্য আমরা ছাঁটাই হই।

না তো, কেন?

ব্লেডগুলোর দিকে আঙুল দেখাল হরিশংকর। সুধা এক-এক করে সেগুলো ওর হাতে তুলে দেবার সময় আবার বলল, কেন?

আমাদের স্ট্রাইকটা ভেঙে গেল ওর জন্যই। কোম্পানি ওকে ভালো চাকরি দিয়ে বদলি করে দেবে বলেছিল। ও টোপ গিলল। আমি, বলাই আরও দুজন ছাঁটাই হয়ে গেলুম। হরিশংকরের ভঙ্গি বা স্বরে রাগ নেই। কাজ করতে করতেই বলল, তখনকার দিনে এত কলকারখানা তো ছিল না। ভগ্নীপতির ইলেকট্রিকের দোকান ছিল, ঢুকলুম। তারপর নিজে এক মুসলমানের সঙ্গে দোকান করলুম। আড়াই বছর আগে যে দাঙ্গা হল তাতে দোকানটা লুঠ হয়ে গেল। সেই থেকে এই দোকানে কাজ করছি।

আর সেই ভদ্রলোক! সুধা বলতে যাচ্ছিল সেই সাক্ষী। শেষ মুহূর্তে ভদ্রলোক বেরিয়ে এল।

বলাই? সে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।

অ্যাাঁ। সুধা বজ্রাহত হল পুলকে, মরে গেছে?

টুল থেকে নেমে এল হরিশংকর। সুইচ টিপল। পাখা ঘুরতে লাগল।

কে চাকরি দেবে বলুন। বড়ো সংসার ছিল। বহু চেষ্টা করেও কিছু পারল না। একদিন বলল, হরিদা, কারুর উপর আর আমার বিশ্বাস নেই। সবাইকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে করে। আমি তবে বাঁচব কী করে? দু-দিন পর শুনলুম ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে।

সুধা ধীরে ধীরে খাটে বসল। তাহলে পাঁচ নয়, চার জনই রয়েছে। একটা দুশ্চিন্তার হাত থেকে রেহাই পেয়েই তার মনে হল বলাই লোকটা বোধ হয় সৎ। বিশ্বাস, ঘেন্না এসব নিয়ে মাথা ঘামানো কি আর বাজে লোকের কর্ম? এই লোকটা বাজে তাই গলায় দড়ি দেয়নি। দিলে চার নয়, তিন জন হয়ে যেত। মা-কাকা-কাকি। মা বুড়ি হয়েছে শিগগিরই মারা যাবে, তাহলে থাকবে দুই। ওরা দুজনই তো বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল। সুতরাং জীবনে মুখ খুলবে না। কাজেই এক্ষেত্রে ওরাও মৃত। শুধু জ্যান্ত রয়েছে এই হরিশংকরটা।

প্রফুল্ল ছেলে খারাপ ছিল না। হরিশংকর সান্ত্বনা দিচ্ছে কি না সুধা বুঝে উঠতে পারল না। লোকটার হাবভাব এখন মোটেই মিস্ত্রির মতো নয়। এটা তার পছন্দ হচ্ছে না।

ওর পতন ঘটে আপনার সঙ্গে মেলামেশা হয়ে। অন্তত আমাদের তো তাই ধারণা। বিয়ে করে বউকে সুখে রাখবে, বোধ হয় সেইজন্যই…।

না না, আমি তো ওরকম কিছু চাইনি। আমি তো বলেছিলাম তুমি যেভাবে রাখবে সেইভাবেই থাকব। সুখে রাখবে এমন ছেলে কি তখন আমি পেতাম না? এই তো নিজের চোখেই এখন দেখুন-না। তবুও তো প্রফুল্লকে বিয়ে করেছিলাম। সুধা কিছুটা ব্যস্ত হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করল। লোকটা যেন তাকেই দায়ী করতে চাইছে। এটা খুবই অন্যায়। আসলে প্রফুল্লকে তো আর পাচ্ছে না তাই দোষটা এখন আমার ঘাড়ে চাপাতে চায়। সুধা দুঃখও বোধ করল। কতখানি ত্যাগ সে করেছিল, লোকটা তা নিয়ে একটা কথাও বলল না। সুধা রেগেও উঠল। কৃতকর্মের জন্য প্রফুল্লর নিশ্চয়ই অনুশোচনা হয়েছিল। নয়তো আত্মহত্যা করবে কেন? অথচ প্রফুল্লের এই মহৎ দিকটা একদমই দেখছে না লোকটা। দেখিয়ে দেওয়া উচিত বিবেচনায় সুধা বলল, কত অন্যায় কাজ করে কত লোক বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রফুল্লও তো আত্মহত্যা না করে থাকতে পারত!

আত্মহত্যা? অদ্ভুতভাবে হরিশংকর তাকাল ওর দিকে। স্বরে চিড় ধরিয়ে বলল, কে বলল আপনাকে?

কে আবার বলবে? শুধু প্রফুল্লরই পতন হয়েছিল আর আপনাদের কারুর হয়নি কতটা সত্যি যে অকাট্য কোনো প্রমাণ তো আর এখন পাওয়া যাবে না?

পাখাটা তাহলে নিয়ে যাচ্ছি।

হঠাৎ হরিশংকর আলোচনায় ছেদ টেনে পেশাদারি গলায় বলে উঠল, দিন পাঁচেক পরে পাবেন।

দরজার কাছে এসে আগের দিনের মতো ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার বিয়ের অকাট্য প্রমাণ ম্যারেজ সার্টিফিকেটটা কিন্তু আমার কাছে রয়ে গেছে। প্রফুল্ল আমার কাছে রেখেছিল আর ফেরত দেওয়া হয়নি।

সুধা দাঁড়িয়ে রইল আর পাখাটাকে মেরামত করার জন্য নিয়ে চলে গেল হরিশংকর। অন্যের বিয়ের অকাট্য প্রমাণটা আজও রেখে দিয়েছে! কেন? নিশ্চয়ই মতলব আছে। সুধার এই চিন্তায় সারা দুপুর-বিকেল তোলপাড় হয়ে গেল।

খুশি হল সুধীন। এই পাখাটায় হাওয়া যেন বেশিই লাগছে। চটপট সে ঘুমিয়ে পড়ল। সুধার ঘুম এল না। না আসারই কথা, কেননা বুকে পাষাণভার চেপে বসেছে। সার্টিফিকেটটা খুবই সর্বনেশে হয়ে উঠতে পারে। এই বয়সে যদি ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায় তাহলে—সুধার মনে হল পাখাটা সুধীনের ঠিক পেটের উপর পড়বে। বেশ দুলছে মুন্ডু নাড়িয়ে। গর্তগুলো দিয়ে বিদ্যুৎ চিড়িক দিচ্ছে। যদি খুলে পড়ে! নির্ঘাত মৃত্যু ঘটবে। অ্যাকসিডেন্টই বলা হবে, কিন্তু হরিশংকরকে কি পুলিশে ধরবে না? যদি ধরে তাহলে বাঁচা যায়। তাহলে অবশ্য টেনে সংসার চালাতে হবে। একশো তিরিশ টাকা বাড়িভাড়া আর দেওয়া চলবে না। অফিস ইনশিওরেন্স মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক, সেদিনই তো হিসেব করে সুধীন কত যেন বলল, পাওয়া যাবে। খোকার না দাঁড়ানো পর্যন্ত ওইতেই চলে যাবে। তা ছাড়া জমিটাও আছে। খোকার চাকরি হলে মেয়ে দেখতে হবে। ভালো মেয়ে পাওয়াও মুশকিল।

এই সময় বিড়বিড় করে সুধীন পাশ ফিরল। সুধা আন্দাজে হিসেব করে দেখল পাখাটা যদি পড়ে, ঠিক পেটে নয়, পিঠ ঘেঁষে পড়বে। তাতে মারাত্মক কিছু নাও ঘটতে পারে। এতে সে খুব আশ্বস্ত বোধ করল। গ্লানিও হল। সুধীন একটু রগচটা, খিটখিটে, কিন্তু মানুষ ভালো। এত বছর বিয়ে হলে কোন স্বামী-স্ত্রীর না ঝগড়াঝাঁটি হয়! সুধা হাত বাড়িয়ে সুধীনের পিঠে বোলাতে লাগল। একটা-দুটো ঘামাচিও মেরে দিল। এখন তার মায়া হচ্ছে।

দুপুরে দরজায় তালা দিয়ে সুধা বেরোল। বাস স্টপের কাছেই ইলেকট্রিকের দোকান। রাস্তা থেকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কাউন্টারের পিছনে বসে লাটাইয়ের মতো একটা জিনিসে হরিশংকর তার জড়াচ্ছিল। সুধা বলল, পাখাটা একটু তাড়াতাড়ি করে দিন।

বলেছি তত দিন পাঁচেক লাগবে। রুক্ষ স্বরে হরিশংকর বলল। হঠাৎ পিছন থেকে সুধার গলা শুনে চমকে উঠেছিল। সেই অপ্রতিভতার জন্যই যে রেগেছে সুধা তা বুঝতে পেরে, কাকুতি করে বলল, ইচ্ছে করলেই আপনি তাড়াতাড়ি পারেন। যেটা লাগিয়ে দিয়েছেন স্বরটা আদুরি করে— এমন বিচ্ছিরি দেখতে আর এমন দুলছে, বিদ্যুত চমকাচ্ছে যে ভয় হয় বুঝি খুলে পড়বে। উনি আবার ঠিক পাখার নীচেই শোন।

ওসব পাখা একটু দোলেই। হরিশংকরের নিস্পৃহ ভঙ্গি লক্ষ করে সুধা আহত হল। ভাবল, একটু পাষাণভার চাপিয়ে দিই।

ধরুন, যদি খুলেই পড়ে, তাহলে কাজে অবহেলার জন্য তো আপনাকেই পুলিশে ধরবে!

আমাকে? হরিশংকর ঘাড় বেঁকিয়ে তীব্র চোখে তাকাল। পুলিশ আমার কী করবে? তা ছাড়া… সিনেমার খল চরিত্রাভিনেতার মতো ঠোঁট মুচড়ে, চোখ সরু করে—পাখাটা যে আপনিই আলগা করে রাখেননি তার প্রমাণ কী?

যৎপরোনাস্তি চমকে উঠে সুধা বলল, কেন?

তাতে তো আপনারই লাভ।

কিছুক্ষণ দুজনে তাকিয়ে রইল।

প্রমাণ?

সার্টিফিকেট।

ওটা আপনার কাছে কেন? যার জিনিস তাকে ফেরত দেননি কেন?

সে তো মরে গেছে।

আমি তো বেঁচে আছি।

আপনি তো এখন আর প্রফুল্লর বউ নন।

হ্যাঁ, আমি ওর বউ, আমিই।

প্রমাণ?

সার্টিফিকেট।

ওটা কি আপনি ফেরত চান?

নিশ্চয়। আমার জিনিস আমি রাখব না? আপনি কেন রেখেছেন? নিশ্চয় কোনো মতলব আছে।

ওরা দুজন চাপা হিংস্রস্বরে কথা বলে যাচ্ছে যেহেতু দোকানটা রাস্তার উপর আর পথচারীরা কয়েক হাত দূরেই। হরিশংকর মুঠো-করা হাতটা কাউন্টারে আঘাত করে বলল, কী মতলব? যদি তাই-ই থাকত তাহলে ওটা ভাঙিয়ে আপনার কাছ থেকে টাকা কি আদায় করতে পারতাম না?

হরিশংকর অতঃপর অট্টহাসি করল না অর্থাৎ সে অভিনয় করছে না। সুধার ক্রোধ ভেস্তে গেল এই শুনে। এরকম হয় বলেই সে শুনেছে। যদি টাকা চেয়ে বসে, তাহলে? সোজা পা জড়িয়ে ধরব। নিশ্চয় দয়া হবে। বলব আমি অবুঝ, না ভেবেই বিয়েটা করেছিলাম। আসলে প্রফুল্লই ফুসলেছিল। খবরের কাগজে মামলার খবরে দেখেন-না?

তা ছাড়া আর যে-মতলব থাকতে পারে তা আপনার মতো থলথলে মুটকি আধবুড়িকে। দেখে মোটেই ইচ্ছে হয় না।

সুধা হাঁফ ছাড়ল। বয়স হওয়ার এই এক সুবিধা। কিন্তু সুধীনকে যদি প্রমাণটা দেখায়। এখনও তো অনেক দিন বাঁচব। সুধার মনে হল অনেক দিন বাঁচার লোভ আগে হয়নি, এখন হচ্ছে। ওই সার্টিফিকেটটা পেলেই আয়ু বেড়ে যাবে। কিন্তু পাওয়া যায় কী করে? হরিশংকর একদৃষ্টে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। কিছু-একটা গভীর হয়ে ভাবছে। সুধা গলাখাঁকারি দিল। হরিশংকর নিথরভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমি জানি আপনি এখন কী ভাবছেন। ভাবছেন লোকটা মরে গেলেই আপদ চোকে।

সে কী, মোটেই তা ভাবিনি। সুধা ক্ষুব্ধ তো বটেই, বিস্ময়ও বোধ করল।

ভাবছেন যদি না-মরে তাহলে খুন করব। এইরকমই মনে হয়। আপনি অস্বীকার করবেন করুন কিন্তু প্রফুল্লর জন্য আমাদের অনেকের সর্বনাশ হয়েছে, তাদের পরিবার ছারখার হয়েছে, এক-আধ জন তো নয়। ওই কাগজটা চাইছেন প্রফুল্লর বউ এই দাবিতে, তাই না?

না না, আমার স্বামী প্রফুল্ল নয়। এই দেখুন, আপনি খোকার বাবার কথাটা ভুলেই যাচ্ছেন। আসলে ওটা রেখে আপনার কী লাভ? দিয়ে দিলে একটি মেয়ের… শুধরে নিয়ে একই স্বরে একটি মায়ের যদি উপকার হয়, তাহলে দিয়ে দেওয়াই উচিত।

কথাগুলো হরিশংকর শুনল কি না কে জানে, তবে অন্যমনস্কর মতো বলল, আপনি এখন যান। পাখাটা সারানো হলেই দিয়ে আসব।

সুধা দু-চার বার কথা বলে জবাব না পেয়ে বাড়ি ফিরে এল রাগ নিয়ে। লোকটা কীভাবে বলতে পারল ওকে খুন করব ভাবছি! তাই কি সম্ভব?

বিছানায় শুয়ে অনেকরকম করে ভাবল তার পক্ষে হরিশংকরকে খুন করা আদৌ সম্ভব কি না। যেদিন পাখা লাগাতে আসবে এক কাপ চা দেব বিষ মিশিয়ে। গন্ধ পাবে না এমন বিষ। তবে বিষটা জোগাড় করতে হবে। ছোটোকাকার বন্ধুর এক ডাক্তার ছেলে আছে। ভালো ভালো বিষ নিশ্চয় তার কাছে থাকে। কিন্তু চাইলেই তো সন্দেহ করবে। আর হয় গলা টিপে মারা। তা পারা যাবে না, ওর গায়ের জোর বেশিই হবে। গঙ্গার ধারে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে যদি ঠেলে দেওয়া যায়? সাঁতার জানে কি না কে জানে! আর এক হয় দরজা খুলে পাশে দাঁড়াব। যেই ঢুকবে কয়লাভাঙা লোহাটা দিয়ে মাথায় কষাব। তিন-চার ঘা দিলেই মরবে। কিন্তু লাশ কীভাবে পাচার করা যায়?

সারা দুপুর সুধা ভাবল। রাতে এবং পরদিন দুপুরেও ভাবল। প্রায় বারো-তেরোটি উপায় পেল খুন করার। গুণ্ডা দিয়ে বোমা মারার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু কোনোটিই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না বুঝে খুব বিমর্ষ হয়ে বিকেলেও বিছানা থেকে উঠল না। বন্ধুর মাকে বলল, শরীর খারাপ। শুনে বন্ধুর মা মুচকি হাসল।

সন্ধ্যার পর সুধীন বাড়ি ফিরল মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায়। জামায় রক্তের ছিট। দেখামাত্রই সুধা হাউমাউ করে উঠল, ও মা কে মারল, কী করেছিলে?

বাস থেকে পড়ে গেছি। সুধীন পাত্তা দিল না সুধার উদবেগকে।

কী করে পড়লে, নামতে গিয়ে না ওঠার সময়? যদি বাসের তলায় যেতে! বলেই সুধার মনে হল, তাহলে হরিশংকরের জারিজুরি আর চলত না।

ওই এক কথা। পড়ে গেলেই যেন বাসের তলায় যেতে হবে। কেন, গেলে কি তোমার সুবিধে হয়?

এই শুনে সুধা বিনিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বিরক্ত হয়ে সুধীন একটু পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাতে বিছানায় সুধা অভিযুক্ত করল সুধীনকে, তখন ওকথা বললে কেন! তুমি মরলে আমার কী সুবিধে হবে শুনি?

সুধীন নিরুত্তর রইল। নাড়া দিয়ে সুধা পুনরাবৃত্তি করতেই সুধীন উত্তেজিত হয়ে বলল, সব আগে ওই কথাটাই-বা তোমার মনে এল কেন যে আমি বাসের তলায় যেতুম! নিশ্চয় মনে মনে তাই ভাবছিলে।

শুনে সুধার মাথাটা গরম হতে শুরু করল। আমি কী ভাবছি তাই নিয়ে সকলেই ভাবছে দেখছি। কেন, এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি তা কি হরিশংকর বা সুধীন মনে করে না? এতই কি আমি খারাপ।

আমার সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?

কী আবার, কিছুই না।

ভালো-মন্দ কিছুই না?

না।

আমি মরে গেলে তোমার দুঃখ হবে না?

সুধীন মিনিট খানেক চুপ থেকে বলল, কী জানি।

সুধার মনে হল সুধীন সত্যি কথাই বলছে। তবে খুবই কম সময় নিল এত বড় একটা কথার জবাব দিতে।

তোমার কি মনে হয় আমাকে বিয়ে করে জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে? ভেবে উত্তর দাও। ভাবাভাবির আর কী আছে? সুধীন ক্লান্ত স্বরে বলল, যেমন বরাবর ছিলুম তেমনই আছি।

যদি বলি তোমাকে ভালোবাসি না, শুনে কষ্ট হবে না?

জবাব না দিয়ে সুধীন পাশ ফিরল।

যদি বলি, কোনোদিনই বাসিনি।

জবাব পেল না।

যদি বলি, অন্য একজনকে ভালোবাসতুম।

তাকেই বিয়ে করলে না কেন, তাহলে একটু ঘুমোতে পারতুম এখন। সুধীন পাশবালিশটাকে আরও জোরে আঁকড়ে ঘুমের মহড়া দিল। অপ্রতিভ হয়ে সুধা সরে এল নিজের জায়গায়। আজ দেরিতে চাঁদ উঠেছে। মেঝেয় অল্প একটু জ্যোৎস্না পড়ে। সুধার ইচ্ছা হল হাত বাড়াতে, বাড়িয়ে দিল। তারপর অনেক কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে যত বার মনে পড়ল রাতের কথাবার্তা, সুধার মন ভার হয়ে উঠল, অভিমান হল। ভালো করে কথা বলল না কারুর সঙ্গে। অবশ্য তার জন্য কেউই ব্যস্ত হল না, কারণও জিজ্ঞাসা করল না। শেষে সুধা ভাবল—কী দরকার ছিল এই বয়সে ওইসব কথা তোলার। দিব্যি তো চলে যাচ্ছে। তারপর মনে পড়ল, চলার উপায় নেই হরিশংকরের জন্য। অকাট্য প্রমাণ নিয়ে ও হাজির হয়েছে।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুধা উপায় ভাবতে ভাবতে ঠিক করল একবার হরিশংকরের বাড়িতে যাবে। দরকার হলে কেঁদে ওর বউয়ের পা জড়িয়ে ধরবে। সিঁদুর পাঠিয়েছিল যখন, নিশ্চয় ভালো লোক। চাপ দিয়ে সার্টিফিকেটটা আদায় করিয়ে দেবে, মেয়েমানুষ হয়ে কি সে আর এক জনের বিপদে-সুধা সংশোধন করে ভাবল দুঃখ শব্দটা ব্যবহার করতে হবে, ওতে মনটা অনেক গলিয়ে দেয়। একটি মেয়ের দুঃখে বা একটি মায়ের দুঃখে কি আর এক মা পাশে এসে দাঁড়াবে না!

দুপুরে সে ইলেকট্রিকের দোকানে গেল। হরিশংকর জরুরি ডাক পেয়ে বেরিয়েছে, এখুনি আসবে। একটা অল্পবয়সি ছেলে দোকান আগলাচ্ছে। তার কাছ থেকে জানল হরিশংকরের বাড়ি কাছেই মিনিট পাঁচেকের পথ।

ঠিকানা এবং নির্দেশ নিয়ে সুধা রওনা হল। মিনিট দুয়েক পর পৌঁছোল খালধারে। এইবার ডান দিক। একটুখানি গিয়েই কাঠের ব্রিজ। এপারে এসে দু-ধারে শুধু কাঠের গোলা আর কাঁচা কাঠের চড়া গন্ধ। তাতে মাথা ঝিমঝিম করে, নেশার মতো লাগে। দুটো গোলার ফাঁকে একটা সরু রাস্তা আছে, তাই দিয়ে কিছুটা এগোলেই দোতলা মাঠকোঠা। কিন্তু সরু রাস্তাটাই সুধা বার করতে পারছে না। ওকে খোঁজাখুঁজি করতে দেখে অনেকেই তাকাচ্ছে, তাতে অস্বস্তি হতে লাগল। শেষে ঠিক করল একজনকে জিজ্ঞাসা করা যাক। জীবনের এত বড়ো একটা ব্যাপারে লজ্জা করলে চলে না।

ছুতোর শ্রেণির তিন জনকে সে জিজ্ঞাসা করল। কেউ বলতে পারল না, কারণ তারা এই অঞ্চলের লোক নয়। তখন ভাবল বিড়ির দোকানদার নিশ্চয় জানবে। মাঝবয়সি লোকটা বিড়ি বাঁধছিল দুলে দুলে। লুঙ্গিটা তাড়াতাড়ি হাঁটুর নীচে নামিয়ে বলল, কালো, রোগাপানা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি তো!

হ্যাঁ, ওপারে দোকানে কাজ করে।

বুঝেছি, এই গলিটা দিয়েই ওর বাড়ি। কিন্তু ওকে কী দরকার আপনার?

সুধা বিরক্ত হল, তা দিয়ে তোমার কী দরকার! এই লোকগুলোর কৌতূহল বড়ো বেশিই হয়।

ওর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব।

বিড়িওয়ালা তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকল। সুধা বুঝল, সম্ভ্রান্ত কেউ যে এমন জায়গায় আসতে পারে তা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।

কিন্তু ওর বউ তো বেরিয়ে গেছে।

অ! কখন আসবে?

বেরিয়ে গেছে মানে বছর খানেক আগে এখানকারই এক ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেছে।

সুধা বিমূঢ় হয়ে বলল, মিস্ত্রির বউয়ের বয়স তো কমপক্ষে পঞ্চাশ হবেই।

কী যে বলেন! ওর তো দ্বিতীয় পক্ষের বউ। জোর পঁচিশ বয়স।

প্রথম বউ কি মারা গেছল?

হ্যাঁ, শুনেছি গলায় দড়ি দিয়ে।

ফিরে চলল সুধা। কাঠের ব্রিজে উঠেই দেখল হন্তদন্ত হয়ে হরিশংকর আসছে।

আমার বাড়িতে গেছলেন, কেন কী দরকার?

উত্তেজিত তো বটেই, চোখে ভয়ের ছাপও।

আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। বাড়িটা ঠিক চিনতে পারছি না।

কী দরকার অ্যা, তার খুব অসুখ, দেখাটেখা হবে না। আর তার কাছে গিয়েও খুব সুবিধে হবে না বলে রাখছি। হরিশংকর রীতিমতো শাসাল।

কেন, সুবিধে হবে না কেন? আপনি ভেবেছেন আমায় খুব জাঁতাকলে ফেলেছেন, আর আমি বুঝি আপনাকে ফেলতে পারি না? থেমে গেল সুধা, কারণ একটা লোক ওদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। হরিশংকর বিস্ময়াহত! লোকটা কণ্ঠস্বরের পাল্লা ছাড়াতেই সুধা শুরু করল, আপনার বউকে গিয়ে বলব আপনি নাম ভাঁড়িয়ে আমায় বিয়ে করেছিলেন। অল্প বয়স ছিল, অতশত বুঝতে পারিনি। এখন এতদিন পরে সেই দাবিতে আপনি আমায় ফেরত চাইছেন।

সুধা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল, লোকটা নিশ্চয় বলবে, যান বলুন গিয়ে। আমার বউই নেই তো কাকে বলবেন।

খুবই আশ্বস্ত দেখাল হরিশংকরকে। মিথ্যে কথা, কেউ বিশ্বাসই করবে না। প্রমাণ আছে, অকাট্য প্রমাণ। আপনার কাছেই সেই বিয়ের সার্টিফিকেট রয়েছে। নিজের না হলে কেউ কি ওটা রেখে দেয়?

কিন্তু ওতে প্রফুল্লর নাম লেখা!

আপনি তো নাম ভাঁড়িয়েছিলেন, প্রমাণ করতে পারবেন আপনি নাম ভাঁড়াননি? আমি ছোটোকাকাকে সাক্ষী মানব।

ফ্যাকাশে হয়ে গেল হরিশংকর। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সুধা ভাবল, এইবার নিশ্চয় বুক চিতিয়ে বলবে, কাকে ভয় দেখাচ্ছেন? আমার বউ মরে গেছে, আবার বিয়ে করেছিলুম, সে-বউ পালিয়ে গেছে। কাকে বলবেন ওসব কথা?

কিন্তু ক্রমশ কুঁজো হয়ে গেল হরিশংকর। অবশেষে ব্রিজের রেলিং ধরে তাকে দাঁড়াতে হল। এসব কথা মিথ্যে হলেও ওকে বলবেন না, খুব আঘাত পাবে। বড়ো ভালোমানুষ। হয়তো গলায় দড়ি দিয়ে বসবে। আমার তো আর কেউ নেই ও ছাড়া।

সুধা আর কথা বলার দরকার বোধ করল না। বাড়ি ফেরার সময় খুব হালকা লাগল নিজেকে। মানুষ যে কতরকম মনের বাতিক পুষে রাখে আর তাইতেই কীভাবে আটকা পড়ে। সুখী হতে হলে এসব বাতিক থাকা উচিত নয়, সুধা মনে মনে পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোল। অতঃপর, পাখি হয়ে এখন আকাশে উড়তে পারি, এমন কথাও সে ভেবে ফেলল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress