Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সারগুনা পাখি ও ঝিঞ্চিটি মাতাজী || Buddhadeb Guha

সারগুনা পাখি ও ঝিঞ্চিটি মাতাজী || Buddhadeb Guha

ছোটোনাগপুরের যে অখ্যাত শহরে লেখার জন্যে কয়েকদিন হল এসেছি, সে শহরের নাম নাই ই-বা বললাম। নাম বললেও কম লোকই চিনবেন। নামটি অবান্তরও বটে।

শহরের চার পাশে ঘন জঙ্গল। এখনও জঙ্গল আছে, যদিও পাতলা হয়ে গেছে আগের থেকে।

উঠেছি বন-বাংলোতেই। একটি আদিবাসি ছেলে রান্নাবান্না করে দেয়। শীত এখনও তেমন জাঁকিয়ে বসেনি, তবে সকাল ও সন্ধ্যের পরে ভালোই ঠান্ডা থাকে।

সকালে উঠে জঙ্গলে বেড়িয়ে আসি একা একা। পুজো সবে শেষ হয়েছে। কালীপুজো সামনে। কুয়াশায় ঘেরা থাকে সকালের শাল জঙ্গল, পথের পাশের লিটপিটিয়া, রাহেলাওলা আর পুটুসের ঝোপ। স্কার্লেট মিনিভেট আর ওরিওলের দেখা পাওয়া যায় তখন। শীতের কুয়াশার একটা আলাদা গন্ধও আছে। বাজরা খেতে বাজরা ভরে উঠেছে। একজন চাষি কোদাল দিয়ে মাটি তুলছিল পাশের নালা থেকে। মাটির সঙ্গে কুয়াশাও তুলছিল যেন কোদাল কোদাল। কুয়াশা যখন জঙ্গলের গায়ে বালাপোষের মতো জড়িয়ে থাকে, অথবা দিগন্তে বাঁধা জালের মতোঞ্জ, তখন দিনে ও রাতে তার রং বিভিন্নতায় প্রতিভাত হয়ে থাকে। কিন্তু কোদালে করে কুয়াশা চেঁচে নেওয়ার সময় রং সাদা দেখায়।

বিকেলেও হাঁটতে যেতাম জঙ্গলেরই পথে। আদিবাসী ছেলে-মেয়েরা গাঁইতি-কোদাল হাতে ফিরে আসত জঙ্গলের গভীর থেকে। বনবিভাগ সহেলি নদীতে বাঁধ বাঁধছে একটা। সেখানেই কাজ করে ফেরে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি ওরা। ঠিকাদারের ক্যাম্পও পড়েছে। আমার বাংলো থেকে জায়গাটা মাইলখানেক হবে। রাতের বেলা মাদল বাজিয়ে যখন ওরা গান গায় আর নাচে, তখন ওদের ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।

লোকজন বলতে বিশেষ কেউ নেই। ছোট্ট ঘুমন্ত স্টেশনে দিনান্তে দুটি গাড়ি আসে, দু-টি যায়ঞ্জ, তাদের খেয়ালখুশিমতো। এবং এমন গতিতে যায় যে, একটু জোরে দৌড়ে গেলে ট্রেন ফেল। করলেও পিছন থেকে তাড়া করে গিয়ে তাতে চড়া যায়।

স্টেশনমাস্টার আছেন একজন। সমস্তক্ষণ টক্কাটরে টরে-টক্কা করেন তিনি। সন্ধ্যের পর মালগুদামের মাল এবং মহুয়ার মালের বোতলের সঙ্গে এমনই একাত্ম হয়ে যান যে, তখন তাঁর আর কোনো আলাদা অস্তিত্ব থাকে না।

দুপুরে ও সন্ধ্যের পর আমি লেখা নিয়ে বসি। ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হচ্ছে এখন একটি মাসিক পত্রিকায়। একেবারে উপন্যাসের পুরো কপি দিয়ে দেব সম্পাদককে এমন মনে

করেই এসেছি। দেখি, কী হয়। তার মধ্যেই কুঁদ হয়ে থাকি। লেখার নেশার মতো ভালো নেশা। আর কিছু নেই। আমার উপন্যাসের নায়ক, নায়িকা, পটভূমি, সমস্তই আমাকে, আমার জাগতিক সমস্ত সুখ ও দুঃখ, আরাম ও কষ্ট, আনন্দ ও অভিমানকে ছাপিয়ে উঠে আমাকে এক তাৎক্ষণিক নান্দনিক জগতে পৌঁছে দেয়। সেখানে আমি আর আমি থাকি না। আমাকে তখন আমার নিকটতম আত্মীয়-পরিজনের প্রেম ভালোবাসাও ছুঁতে পারে না। শত্রু-কন্টকিত ও ঈর্ষাজর্জরিত পৃথিবীর কোনোই সাধ্য থাকে না তখন আমার কাছে আসে। বড়োই আনন্দের মধ্যে সময় কাটে। সেই সময় আমি, একজন সাধারণ ক্ষিদে-তৃষ্ণার কামনা-বাসনার মানুষ হয়েও পরম অবলীলায় ও অবহেলায় অবচেতনে অতিক্রম করে যাই। আমি তখন সন্ধ্যেবেলার সুগন্ধি কুয়াশারই মতো মগ্নচৈতন্যর মধ্যে স্তব্ধ, লুপ্তপ্রাণ হয়ে বেঁচে থাকিঞ্জ, ভবিষ্যতে জেগে উঠব বলে।

এমনিভাবেই কেটে গেল চার পাঁচটা দিন।

একদিন সকালে যখন গিগু হেমব্রম চা আর লেড়ো বিস্কুট নিয়ে এসে জানালা দিয়ে ডেকে আমার ঘুম ভাঙাল তখন তার চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল সে আমাকে কিছু বলতে চায়। ছেলেটি ভারি প্রাণবন্ত। একেবারে পাগল। বয়স হবে আঠারো-উনিশ।

বাজার করার পয়সা চাই?

সে তো চাই-ই। তার জন্যে নয়। বলছিলাম, তুমি যাবে না?

কোথায় রে? ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি জিজ্ঞেস করি ওকে।

মাতাজি এসেছেন। যাবে না?

মাতাজি? কে মাতাজি?

বাঃ মাতাজির নাম শোনোনি? যে বছর সারগুনা পাখিরা আসে এ জঙ্গলে, সে বছরে মাতাজিও তো আসেন। তাঁর আসাটা লোকে জানতে পায়, কিন্তু চলে যাওয়াটা কখনোই নয়। সারগুনা পাখিরাও জানতে পায় না। মাতাজি চলে গেলে ওরাও চলে যায়।

সকালের প্রথম কাপ চায়ে শরীরের রক্ত, সবে সঞ্চালিত হতে শুরু হয়েছিল। জড়তা কেটে উঠছিল। ইতিমধ্যে মাতাজির উত্তেজনাকর আগমনের খবরে খুব তাড়াতাড়িই শীতের ভোরের আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠলাম। মাতাজির বয়স কত? কোথায় থাকেন? কোথা থেকে আসেন, জানিস গিগু? মাতাজির বয়স?

আজীব আদমী আপনি? সাধু-সন্তদের বয়স থাকে না কি আবার? এক-শদু-শোও হতে পারে, আবার বিশ-পঁচিশও হতে পারে। আর যখনই আসেন, থাকেন সহেলী নদীর সঙ্গে দূরছাঁইয়া নদীর যেখানে মিল হয়েছেঞ্জ, তার সঙ্গমে কালাকাট্টি পাহাড়ের গুহায়।

হুঁ। চা খাওয়া আরেক কাপ।

গিগুকে বললাম।

মাতাজি সম্বন্ধে আমার যতখানি উত্তেজনা গিগু আশা করেছিল ততখানি দেখতে না পেয়ে,

মনে হল ও বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হল। চা বানাতে চলে গেল ও।

চা বানিয়ে এসে মাতাজি প্রসঙ্গ আর আদৌ না তুলে নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, আজ কী খাবে বলো? এক্ষুনি চান করে বানিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। নিজেই গরম করে নিয়ে খেয়ে নিও। কারণ দুপুরে সহেলী আর দূরছাঁইয়া নদীর সঙ্গমের চরে আজ মস্ত মেলা বসবে। আমি সেই মেলায় যাব। মাতাজিকে দর্শন করতে। সময় নেই, সময় নষ্ট করবার। কী খাবে? বলে ফেলো তাড়াতাড়ি। নাস্তা কী করবে, তাও।

দুটো ডিম ভেজে দে মুড়ির মধ্যে ফেলে। আর দুপুরের জন্যে তোর ঝামেলা করতে হবে না। হোটেলেই খেয়ে নেব আজ।

হোটেল? বিদ্রুপাত্মক গলায় বলল গিগু। হোটেল-ফোটেল সবই বন্ধ আজকে। সারা বাজারই যাবে মেলায়। শহরে কেউই থাকবে না। সকলেই যাবে।

ওর মুখ দেখে মনে হল, বলতে চাইছে. তোমার মতো অবিশ্বাসী ইডিয়ট তো আর নয় সকলে।

-গেলে আঙুল কামড়াবে তুমিই।

ওঃ। হোটেলও বন্ধ থাকবে? তাহলে খিচুড়ি করে রেখে দিয়ে যা। গরম করে খেয়ে নেব।

ঠিক আছে।

গিগু নাস্তার বন্দোবস্ত করতে চলে যাচ্ছিল।

আমি বললাম, দাঁড়া দাঁড়া, হেঁটে আসি একটু চান করি। নাস্তা পরে তৈরি করিস। আগে বরং খিচুড়ির বন্দোবস্তটা করে ফেল, তাহলে নাস্তা দিয়েই ছুটি পেয়ে যাবি।

বাথরুমে যেতে যেতে ওকে বললাম, আচ্ছা! সারগুনা পাখি কীরকম দেখতে রে? তুই নিজে কখনো দেখেছিস? কত বড়ো পাখি?

আমি কখনো দেখিনি। তবে অন্য অনেকে দেখেছে।

আমার চেনা এমন কেউ?

হ্যাঁ। মুগা দেখেছে, চেঙ্গা দেখেছে। যে কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে তুমি স্টেশন থেকে এলে সেই খিটংঞ্জ, সেও দেখেছে।

কেমন দেখতে? নীলের ওপর সাদা-ডোরা। পায়রার মতো পাখি। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে।

অবাক গলায় স্বগতোক্তি করলাম, এমন পাখি তো কোথায়ও দেখিনি। এর কথাও শুনিনি।

তোমার কথা ছাড়ো। তুমি একটি আজীব আদমী।

অনুকম্পার সঙ্গে বলল গিগু।

তারপর কাঠের আগুনের সামনে উবু হয়ে বসে ফুঁ দিতে লাগল।

২.

কোনো মাতাজি-পিতাজি সম্বন্ধেই আমার কোনো ঔৎসুক্য বা দুর্বলতা বা ভক্তি নেই। কখনো ছিল না। কিন্তু একথার মানে এই নয় যে, অন্য যাঁদের ঔৎসুক্য, দুর্বলতা বা ভক্তি আছেঞ্জ,। তাঁদের আমি ছোটো করে দেখি। কারণ, আমার আত্মীয়-পরিজন, চেনা-জানা অনেক মানুষকে

আমি জানি যাঁরা বিদ্যা-বুদ্ধিতে আমার চেয়ে অনেক বড়ো এবং শ্রদ্ধেয়। এবং তাঁদের কোনো কোনো মাতাজি-পিতাজির প্রতি বিশ্বাস আছে খুব গভীর। নিশ্চয়ই কিছু কিছু মাতাজি পিতাজি আছেন, যাঁরা অনেক শিক্ষিত বুদ্ধিমান ভক্তদের কাছেও যেন সাক্ষাৎ অবতার। অন্তত আমার চেয়েও সবদিক দিয়ে বড়ো এমন বহু লোকেই তা যখন বিশ্বাস করেন, তখন সব মাতাজি পিতাজিকে সকলকেই কখনোই একাসনে বসানো যায় না।

হেঁটে ফিরে এসে, তখনও খুঁয়ো ওঠা কুয়োর টাটকা জলে চান করে নাস্তা করে গিগুকে ছুটি করে দিয়ে আমি লিখতে বসলাম।

ঘন্টাখানেক লিখেছি। চোখটা ধরে এসেছে। জানালা দিয়ে দূরের লাল মাটির পথ আর তার পেছনের পাহাড়টির দিকে চেয়ে পাইপটা ধরালাম। নজরে পড়ল, দলে দলে লোক চলেছে। হরজাই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পায়ে পায়ে লাল ধুলো উড়িয়ে। শিশু, বৃদ্ধ, যুবা, নারী ও পুরুষ সকলেই নদীর দিকে।

নীরব বিস্ময়ে আমি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম ওদের। বেলা যত বাড়তে লাগল ততই মিছিল বড়ো হতে লাগল কলকাতার মনুমেন্টের তলায় জমা-হওয়া মিছিলেরই মতো। আমার গিগু একা নয়, পুরো শহরটাই সত্যিই চলেছে মাতাজি-সন্দর্শনে।

দুপুরে খিচুড়ি খেয়ে একটু জিরোবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আইঢাই করতে লাগল শরীর। শেষে, পায়জামা-পাঞ্জাবি চড়িয়ে, শালটা কাঁধে ফেলে স্টেশনের দিকেই এগোলাম।

দেশলাইয়ের কাঠি ফুরিয়ে গেছিল। কিন্তু আজ দেশলাইয়ের দোকান পর্যন্ত বন্ধ। পথের উপর শালপাতার ঠোঙা, পোড়া বিড়ি, বাচ্চাদের খুলে পড়ে-যাওয়া ছোট্ট প্যান্টালুন, আরও নানা টুকিটাকি জিনিস। মাস্টারমশাইকেও পাব তো? ব্যাপার দেখে ভয়ই মনে হল। স্টেশনের কাছাকাছি গিয়েই বুঝলাম, আজ আপ-ডাউনের গাড়িতে অন্তত দশগুণ যাত্রী বেশি এসেছে। এখানে।

মাস্টারবাবু টেবিলের উপর দু-পা তুলে বসে একটি ঢাউস উপন্যাস পড়ছিলেন।

আমাকে দেখে পা নামিয়ে নিয়ে বললেন, কী লেখে মশাই! আপনারাও ন্যাদেন আর তিনিও ন্যাদেন।

লক্ষ করে দেখলাম শংকরের বই।

শংকরের উপর বাঙালি লেখকমাত্রই ঈর্ষা আছে। কিন্তু তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং একজন অতি অমায়িক ভদ্রলোক বলে জানি বলেই তাঁর সফলতাকে ঈর্ষা করি না আমি। বরং তাতে বিস্মিতই হই। বাংলা বই বিক্রি হয় না, এ অপবাদ অন্তত একজন বাঙালি লেখক তো খণ্ডন করেছেন!

মাস্টারমশাই এর ফ্রন্টাল-অ্যাটাক এড়িয়ে গেলাম ট্যাক্টফুলি।

বললাম, কার সঙ্গে কার তুলনা।

মাস্টারমশাই খুশি হলেন।

বললেন, মানছেন তাহলে।

ডাকলেন, গিরধারী।

ডেকেই বললেন, আজ কোনো শালাই কি আছে? সবাই হাওয়া। তারপর তাচ্ছিল্য ও ঠাট্টার গলায় বললেন, মাতাজি এসেছেন। যত্ত সব…। এদের কত মাতা-পিতাই যে আছে! কিন্তু। গিরধারী যায়নি।

মাস্টারমশাই বললেন, আরে এ গিধধড়, দু-কাপ চা লাও জলদি।

তারপর একসঙ্গে এতখানি হিন্দি বলে ক্লান্ত হয়ে গিয়েই বললেন, কাপ দুটো ভালো করে ধুয়ে নিস বাবা। রাইটার সাহেব বলে কতা।

গিরধারী দেখলাম একটুও রাগ করল না, তাকে গিধধড় বলাতে।

একটা সিগারেট ধরালেন মাস্টারমশাই। তারপর পোড়া কাঠিটা দিয়ে চোখ আধ-বোঁজা করে কান চুলকোতে লাগলেন। সেই ফাঁকে দেশলাইটা চেয়ে নিয়ে পাইপ ধরালাম আমি।

সিগারেটে মস্ত এক টান লাগিয়ে মাস্টারমশাই তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার মুখে তাকিয়ে রইলেন।

অনেকক্ষণ। তারপর ফৌজদারি আদালতের উকিলের মতো জেরা করার সুরে বললেন, আপনি যে বড়ো গেলেন না!

কোথায়?

মাতাজি সন্দর্শনে!

কথা ঘুরিয়ে বললাম, সন্দর্শনেই তো এলাম। আপনার সন্দর্শনে।

মাস্টারমশায়ের ভুরু কুঁচকে উঠল। ওই শীতের দুপুরেও কপাল ঘেমে উঠল। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে

আমার মুখে কী যেন খুঁজতে লাগলেন। অস্বস্তি হতে লাগল। পাইপের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে আমাদের মধ্যে ক্ষণিকের ব্যবধান সৃষ্টি করে দিলাম।

মাস্টারমশায়ের ব্যবহারে কীরকম একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিলাম। রহস্যটা যে মাতাজিকে ঘিরে এমনও মনে হল।

আপনিও তো যাননি দেখছি। সকলেই তো গেল!

আমার প্রশ্নে মাস্টারমশাই চমকে উঠলেন। বললেন, কোনোদিনই সকলে যা করে, আমি তা। করিনি। তা ছাড়া আমার হাতে এত বড়ো স্টেশনের ভার। স্টেশন ছেড়ে গেলেই হল? আমি কি হাটে ফুলুরি আর বগারি বেচি?

মাস্টারমশাই কথা ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্যে বললাম, মাতাজিকে আপনি দেখেছেন?

আমার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মাস্টারমশাই হাঁক ছাড়লেন, গিরধারী, চা কেয়া হুয়া?

আভভি লায়া বাবু।

গিরধারী বলল।

আমাকে আর কোনো প্রশ্ননা করতে দিয়ে বইতে মুখ-ডুবিয়ে উনি বললেন, একটু পরে কথা বলব আবার। ভারি ইন্টারেস্টিং জায়গায় এসেছি। ডোন্ট মাইন্ড।

একজন লেখকের লেখার ইন্টারেস্টিং জায়গায় কোনো পাঠক এসে পৌঁছেলে, অন্য লেখকের মাইন্ড করার কথা নয়। খুব খুশিই হবার কথা।

চুপ করে পাইপ খেতে লাগলাম। গিরধারী বলে ছোকরাটি চা নিয়ে এল। শালবনের মধ্যে নীচু লালমাটির প্ল্যাটফর্মে একটি ছাগল এবং একদল পায়রা চরছিল। তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চা খেলাম তারিয়ে। লক্ষ করলাম আর একজনও খঞ্জ, অন্ধ বা সুস্থ ভিখারি পর্যন্ত নেই প্ল্যাটফর্মে।

মাস্টারমশাই বই থেকে মাথাই তুললেন না। আর কোনো কথাও বললেন না।

বললাম, চলি।

মাথা না তুলেই বললেন, ভারি ইন্টারেস্টিং জায়গাতেই রয়েছি। কিছু মনে করবেন না স্যার। পরে আসবেন আবার। মাতাজির ভুজুং শেষ হলে।

ফিরে আসার পথে একটি মাড়োয়ারি বানিয়ার দোকান পড়ে। একদিকে চাল-ডাল মসলা-পাতি, অন্যদিকে কাপড়-চোপড়। একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি প্রায়ই। মালিকের বোধ হয় উদরস্থ বায়ু উধ্বগামী। সবসময়েই দেখি, গেঞ্জিটাকে গুটিয়ে নাভির উপর তুলে রাখেন। মাঝে মাঝে। খামচে খামচে নাভির কাছে চুলকান ডান অথবা বাঁ, যে কোনো হাত দিয়ে। যে হাত যখন খালি থাকে। যখনি দোকানের সামনে দিয়ে যাই আসি তখনই হাত তুলে বলেন রাম রাম বাবুজি। কোনো দিন সাহেবও বলেন। তার দোকানে আমি কখনো কিছুই সওদা করিনি। করার সম্ভাবনাও নেই। তবু পোটেনসিয়াল কাস্টমারকে রাম রাম বলে রাখেন। একেই বলে ব্যবসাদার।

কিন্তু দেশলাই না-থাকায় দেশলাই কেনবার জন্যে ঢুকলাম দোকানে সেদিন।

তিনি একটা দেশলাই-এর বাক্স এগিয়ে দিলেন। একেবারে এক ডজনই।

মনে মনে বললাম, রামফল।

ডান হাতে দেশলাই দিতে দিতে বাঁ-হাতে নাভি খামচাতে খামচাতে দোকানি বললেন, সাহাব, আপ গ্যায়ে নেহী? কিতনা বড়া সৌভাগ আপকা ছুট গয়া। যানা চাহিয়েথা জরুর। লিখনা চাহিয়েথা ঝিঞ্চিটি মাতাজিকা বারেমে। আপ রাইটার আদমী হেঁ, কিতনা পড়ে লিখে!

আপকো কৈসে মালুম?

মালুম বাবুজি। সব কুছ মালুম। হামলোগ রহতা হ্যায় আন্ধারমে ঔর দিখতা হরওয়াক্ত উজলাকা তরফ। জীন্দগি ভর ওহি তো কাম হ্যায় হামলোগোঁকা। কওন আয়া, কওন গ্যায়া ইয়ে সব কুছই মালুম, হামলোগোঁকা। বরাবর।

আপনে খুদ কিঁউ নেহী গ্যয়া!

হাম? অররে হ্যাম? ঝিঞ্চিটি মাতাজিকো যো লোক দেখনে আয়ে হেঁ সবকো সেবামে লাগা হুয়া হ্যায়। চারমন আট্টাকা পুরী ঔর আধামন আলুকা চোকা বন রহা হ্যায় ঘরমে। আমলাকা আঁচার এহিসাই বাটুঙ্গা। পুন হামারা ভি তো কুছ চাহিয়ে।

একটু থেমে হাসতে হাসতে বললেন ঔরতি হাজারো আদমী হামারা দুকানসে সিধা লেকর আপনা বানায়েগা। খানা খায়গা মজেমে। সবহি মাতাজি কী কৃপা। ঔর ক্যা? যযা দেখতা হ্যায় উসকো ভি পুন, ঔর যো দিখনে ওয়ালোকা সেবামে লাগা হুয়া হ্যায় উসকাভি পুন।

গিগু রাতের বেলা ফিরল। যাবার আগে আমার কাছ থেকে কুড়ি টাকা চেয়ে নিয়ে গেছিল। এসেই আরও তিরিশ টাকা চাইল। পনেরো দিনের জন্যে খাওয়া-দাওয়া ছাড়া ওকে পঞ্চাশ টাকা দেব বলে কথা হয়েছিল। বললাম, এত টাকা কী করলি? একদিনে?

বাঃ। পুজো দিলাম। ভুখা লোকদের খাওয়াবে আর কম্বল দান করবে বলে মাতাজি সেবা-ভাণ্ডার করেছেন। তাতে সকলকে দান করতে বললেন ঝিঞ্চিটি মাতাজি। দেব না? আমার কী? বাবা তো এখনও কামায়। মাও জঙ্গল থেকে আমলকী কুড়িয়ে কিছু কামায়। আর আমি তো একই সন্তান।

বাবা যায়নি?

যায়নি আবার। মা, বাবা। বললাম নাঞ্জ, সারা শহরই। বাবাই তো বলল, এমন ভাগ্য রোজ রোজ হয় না। বাবা দিল এক-শো। আমি দিলাম পঞ্চাশ। মাতাজীর দোয়া থাকলে সব থাকবে।

তোরা তো সাঁওতাল। তোদের তো কত দেবতা আছে নিজেদেরই। মাতাজীর প্রতি এত ভক্তি কেন তোদের?

দুস। তুমি যে কী বল। ভগবানের আবার জাত আছে নাকি? মাতাজীকে এখানের সকলেই মানে। হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, মুমু সক্কলে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, এক তুমি ছাড়া। আজীব আদমী!

৩.

মাস দুই পরে পাটনাতে গেছি একজন অ্যান্টিকুয়ারিয়ান বুক-ডিলারের কাছে কিছু বইয়ের খোঁজে। আমার ছোটোবেলার বন্ধু অরিন্দম ফোন করে সামনের শনিবার খেতে বলল। ও এখন সিডিউল্ড কাস্ট অ্যান্ড সিডিউল্ড ট্রাইবসদের ওয়েলফেয়ার দেখে। অরিন্দম আই-এ-এস। সেক্রেটারি, বিহার সেক্রেটারিয়াটে।

যেতেই, ওর সুন্দরী স্ত্রী, নীপা বলল, আসুন। আসুন। আপনার বন্ধু আপনাকে একটি দারুণ গল্পের প্লট দেবে। আপনি যান, ও শোবার ঘরেই আছে, পায়ে একটু চোট লেগেছে টেনিস খেলতে গিয়ে। আমি চীজপাকৌড়া ভেজে নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের জন্যে। আর চা।

অরিন্দম বলল, আয়। আয়।

ঘরে ঢুকতেই দেখলাম, অরিন্দমের একমাত্র ছেলের নাম রাজা। তাই আমার স্ত্রী শ্রী এবং নীপা এ নিয়ে রসিকতা করে।

অরিন্দম বলল, বাংলা সাহিত্যের যে কী দুরবস্থা, তা তো আমরা সকলেই জানি। নইলে তুইও শালা লেখক হয়ে উঠিস। সত্যি! কী হল দেশটার। যাই-ই হোক, তোকে একটা প্লট দেব বলে বসে আছি। লেখার মতো প্লট।

আমি পরের প্লট নিয়ে লিখি না। নিজে যা দেখেছি, বা যা নিয়ে ভেবেছি বা যা পড়েছি, তাই-ই বোধহয় এক জীবনে লিখে উঠতে পারব না। তোর প্লট তোরই থাক।

অরিন্দম একটু ক্ষুণ্ণ হল।

বলল, তোর প্লটের দরকার নেই? তাহলে অন্য কাউকে দেব।

ভারী লোক হয়েছিস!

তা দিতে পারিস।

আমি বললাম।

খাট থেকে উঠে, আলমারী থেকে রাম-এর বোতল বের করে রাম ঢেলে দিতে দিতে বলল, একটু রামই খা। তোর চরিত্র নষ্ট হবে না এতে। পাটনাতে ঠান্ডাটা এবার জববর পড়েছে। তারপর নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, আচ্ছা, বিটু, তুই তো বনে জঙ্গলে অনেক ঘুরিস, একটা কথা বল, দেখি। সারগুনা পাখি দেখেছিস কখনো?

আমার মাথার মধ্যে ঝিলিক মেরে উঠল। বললাম, দেখিনি, তবে শুনেছি। এবং চাক্ষুষ দেখেছে, নিজের চোখে এমন লোকও আছে বলে শুনেছি।

শুনেছিস?

অরিন্দমের চোখে কৌতুকের আভাস দেখলাম।

কোথায়? অনিবার্য কারণবশতঃ জায়গাটার আসল নাম পাঠকদের বলতে পারছি না। কিন্তু অরিন্দমকে বললাম।

উত্তেজিত অরিন্দম খোঁড়া পা নিয়েই বিছানাতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে যেতেই উঃ উঃ উঃ করে আবার থিতু হয়ে বসল। তুই ওখানে গেছিস? থেকেছিস কখনো?

হ্যাঁ। দু-মাস আগেই তো গেছিলাম। পুজো আর কালিপুজোর মাঝামাঝি সময়ে। ছিলাম কিছুদিন।

অরিন্দমের চোখ আরও বড়ো হয়ে উঠল। বলল, মানে, ঝঞ্চাটি মাতাজী যখন…?

ঝঞ্চাটি নন ঝিঞ্চিটি। আমি বললাম।

এমন সময় নীপা ঘরে ঢুকল চীজ-পাকৌড়া নিয়ে। আর চা। বলল, এ মাঃ! আমি চা নিয়ে এলাম আর তোমরা…

অরিন্দম নীপার কথায় কান না দিয়ে বলল, একেই বলে কো-ইন্সিডেন্স। শুনেছনীপা! দিস বাগার ওজ রাইট অ্যাট দ্যা রং প্লেস হোয়েন ইট লে হ্যাপেনড।

কেন? মাতাজী তো প্রায়ই ওখানে যান বলে শুনেছি। মানে, যখনই সারগুনা পাখিরা আসে। আমি বললাম।

তাতে যেতেনই। কিন্তু আর যাবেন না। দ্যাট মাতাজী অফ ইওরস। দ্যাট মাতাজী, বীরভূমের লাভপুরে যার বাড়ি, কনক বাঁড়ুজ্যে, একটা জোচ্চোর নাম্বার ওয়ান, স্টেশনমাস্টার এবং একজন লোকাল মাড়োয়ারী বানিয়া মিলে ওখানকার সব সিধা-সরল লোকেদের বলতে

গেলে এভরি অলটারনেট ইয়ারে সর্বস্বান্ত করে। কুল, ক্যালকুলেটেড ওয়েতে। বুঝেছিস! তবে, যা করেছে করেছে। আর পারবে না।

এবার আমার সোজা হয়ে বসার পালা। সোজা হয়ে বসে বললাম, মাতাজীর আগমনে ওখানের। অবস্থাটা কী হয় তা আমার দেখা আছে। সারগুনা পাখির ব্যাপারটা কি বলত? এই নামের কোনো পাখি আছে বলো-তো আমি পড়িনি, বা শুনিনি অন্য কোথাওই।

দুর। দুর। সারগুনা বলে কোনো পাখিই নেই। স্টেশনমাস্টারের পোষা পায়রা ওগুলো। সাদা পায়রা। তিনি এবং তাঁর সাগরেদ গিরধারী মিলে তাদের গায়ে নীল-ডোরা বসিয়ে বার্জার পেইন্টস কোম্পানীকে বড়োলোক করে দিল।

বলিস কী রে?

ইয়েস স্যার! মাতাজী যেখানে থাকতেন তার চার পাশের জঙ্গলে মাসখানেক আগে থেকে ওই বানিয়ার লোক গিয়ে চাল গম ঢেলে দিয়ে আসত বস্তা বস্তা রাতের অন্ধকারে। যাতে পায়রাগুলো ওখানে গেলে আর ওখান থেকে না নড়ে।

মাতাজিটি কে?

ফুঃ। মাতাজি! কলকাতার সোনাগাছির একটি মেয়ে। নাম হাসনুহানা। ক্লাস নাইন অবধি পড়েছিল। মাতাজি হিসেবে ওয়েল-কোয়ালিফায়েড। দেখতে শুনতেও ভালো। বয়স পঁচিশ। স্টেশনমাস্টার এবং বানিয়ার কনফেশন অনুযায়ী শুতেও ভালো। ভেরি গুড ইন বেড।

বলেই, নীপার দিকে চেয়ে বলল সরি নীপা।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে নীপা বলল তোমরা তো শুধু ওই সবই জান। কিন্তু মোটিভটা কী!

আমি শুধোলাম।

মোটিভ? মাই গুডনেস। উ্য স্টুপিড ইডিয়ট। বিটউইন দেম অ্যান্ড দেয়ার অ্যাসোসিয়েটস প্রতিবার মাতাজির আগমন উপলক্ষ্যে ওরা সাতদিনে এক-একজনে দু থেকে আড়াই লাখ কামাত। হাজার হাজার সরল গরিব লোকের সারা বছরের রোজগার। হাসনুহানাও তার শেয়ার এত পেত যে সে এখন সতীলক্ষ্মী হয়ে গেছে। সোনাগাছি ছেড়ে দিয়ে সাঁতরাগাছিতে পাকা বাড়ি করেছে। এবারে বিয়ে-থাও করবে। টাকাওয়ালা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার লোকের তো অভাব নেই এ দেশে।

হঠাৎ বটমস-আপ করে টকাস করে রাম এর গ্লাসটা শেষ করে বললাম, শিগগির আর একটা দে।

অরিন্দম বলল, কী হল রে?

আগে আরেকটা দে। পরে কথা। পুওর গিগু। আর ওর বাবা-মা। ইস। আর সারগুনা পাখি! তখনই শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। স্টেশনমাস্টারের ব্যবহারও অবাক করেছিল। অথচ

এমন ভাবে থাকে যে, কে বলবে লোকটার এত টাকা।

অরিন্দম বলল, আরে সেইটাই তো বিউটি! আমি বিহার গভর্নমেন্টের সার্ভিসে এমন এমন লোককে জানি যে, তারা ছেড়া জামা পরে, মাসের শেষে বেয়ারার কাছ থেকে টাকা ধার নেয় সংসার চলছে না বলে, অথচ দিনে পাঁচ-হাজার ঘুষের রোজগার। অবশ্য যারা অনেস্ট তাদের অবস্থা এই ইনফ্লেশানে সত্যিই ওই রকমই হয়ে গেছে। তাই ঘুষখোরেরাও অন্যদের মতো থেকেই দেখায় যে, তারাও গরিব।

আমি বললাম, এতই যদি জানিস তো এই সব নিয়ে তুই লিখছিস না কেন? ইংরিজি বাংলাতে তো আমার চেয়ে অনেকই ভালো ছিলি। এমন একটা র‍্যাকেট বাস্ট করা তো তোর উচিতই।

চুপ কর তো। বোকার মতো কথা বলিস না। ইংরিজি বাংলা জানলেই কেউ লেখক হয় না। তা ছাড়া, এই সেট-আপে, তাদের ধরা মানে, বুঝলি, নেক্সট টু ইমপসিবল। অন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দেন প্রাইভেট সেক্টরে ভালো দেখে, ভালো মাইনে, ভালো পার্ক, সব লিখব ইন সাইড আউট করে।

একটু চুপ করে থেকে ও বলল, জানিস, আমার এই না-পারাটাও একটা গল্প। যে গল্প আমি তো লিখতে পারিইনি তুই লিখলেও চটে যাব। নিজের অক্ষমতা, অপারগতাঞ্জ, কে আর স্বীকার করতে চায় বল? সত্যি! এই ফালতু সিসটেমটা, এই দেশ স্বাধীনতার এত বছর পরও যেভাবে চলছে তাও একটা গল্প। কত মাস্টারবাবু আর বানিয়ারা যে গ্যাঁট হয়ে দেশের মধ্যে বসে আছে। কত ঝিঞ্চিটি মাতাজিরা! আসলে ভূত ঢুকে গেছে সর্ষেরই মধ্যে।

আমি চুপ করে রইলাম।

অরিন্দম বলল, নীপা বিরিয়ানি বেঁধেছে। তোর প্রিয় খাবার। সঙ্গে বটি-কাবাবও আছে। আরেকটা রাম নে।

অ্যারেস্ট করলি না ওদের?

অন্যমনস্কর মতো বললাম আমি।

পুলিশ ধরেছে। তবে কেস কি আর টিকবে শেষ পর্যন্ত।

কেন? এমন কেস টিকবে না কেন?

তুই সেরকমই আছিস অরিন্দম! সেই কলেজের দিনেরই মতো। যে-কেস যত ভালো, সে-কেস তত কম ট্যাঁকে। উকিল, ব্যারিস্টার কত আছে বাঘা বাঘা। আইনের মতো বড়োলোকি তামাশা এদেশের মতো আর কোথায় আছে?

রাম-এর গ্লাসে চুমুক দিয়ে অরিন্দম বলল, জয় ঝঞ্চাটি মাতার জয়।

ঝঞ্চাটি নয়, ঝিঞ্চিটি কি কম ঝঞ্চাট?

কি করছিস তুই এ ব্যাপারে? দোষীরা যদি শান্তি নাই-ই পেল তাহলে র‍্যাকেটটা ব্লাস্ট করিয়ে লাভ কি হল?

রাখতো!

বলে, বালিশে পিঠ দিয়ে পিঠটা সোজা করে বসল ও। কিন্তু পিঠটা সোজা হল না। মেরুদণ্ডটা বেঁকেই রইল।

ও বলল, কাগজে কাগজে ব্যাপারটা ফ্ল্যাশড হয়েছে। আমার ইন্টারভিউও বেরিয়েছে সব কাগজে। ছবিও বেরিয়েছে। আমার মিনিস্টার নিজের ঘরে ডেকে চা খাইয়েছেন। চিফ সেক্রেটারি কনগ্রাচুলেট করে চিঠি পাঠিয়েছেন। আমার আর কী করার আছে?

চুপ করে রইলাম আমি।

অরিন্দম বলল, কী রে? খা!

গ্লাসটার দিকে হাত না বাড়িয়েই আমি বললাম, ব্যাপারটার পেছনে লেগে থাকা উচিত নয় কি তোর? শেষ পর্যন্ত দোষীদের শাস্তি যাতে হয়। তোকে নিয়ে পারি না অরিন্দম! পোলিটিকাল ইনফ্লুয়েন্স-এর রকম জানিস? ম্যানইটার বাঘের মতো তাদের চলা-ফেরা। হাওয়া বুঝতে আমাদের মতো সিভিল সার্ভেন্টসদের একটু অসুবিধে হলেই ভিক্টিম বনে যেতে হবে। এর পেছনে কোনো ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আছে কী নেই তা জানব কী করে? কোনো নেতা যদি পয়সা বানাতে চায় ওই কেসে? তুই বাধা দিবি। নইলে তুই কীসের সিভিল সারভেন্ট?

রাখ। চাকরি করেই তো খেতে হবে। তা ছাড়া বাধা দিতেই বা যাব কেন? কী বলিস তুই! দিস ইজ দ্যা সিসটেম। অর্ডার অফ দা ডে। পুরো দেশটাই করাপ্টেড হয়ে গেছে। আমি একা হাতে

কী করব?

তা বলে, জেনেশুনেও মেনে নিবি?

বিয়ে করেছি, রানিকে মানুষ করে তুলতে হবে, অনেক ঝক্কি। তুইও তো ম্যারেড লোক। বুঝিস না?

বুঝি। আমি বললাম। আমি ভাবছিলাম আমাদের দেশকে চালাবার ভার, দেশের প্রশাসনের ভার এমনই অসংখ্য অরিন্দমের উপরে। এদের মধ্যে কেউ কেউ শেক্সপিয়ারের উপর অথরিটি। কাফকা-কামু-সাঁর্তর এদের ঠোঁটস্থ। পিকাসো, মোজার্ট, মকবুল ফিদা হুসেন এদের। আলোচনার বিষয়। এরাই অধুনা ভারতবর্ষের ধারক এবং বাহক। অরিন্দম! আমার মেধাবী বাল্যবন্ধু। যাকে নিয়ে আমার গর্বের শেষ ছিল না শিশুকাল থেকে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাতে কোনো বড়ো গলদ আছে বোধহয়। অরিন্দম অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু শিক্ষার যে শেষ গন্তব্য, চরিত্রঞ্জ, তা-ই গড়ে ওঠেনি অরিন্দম-এর। শিক্ষাকে যদি জীবনে সত্যিকারের কাজেই না লাগানো গেল তবে সে শিক্ষার দাম কী?

গিগুর মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমার চেঁচিয়ে বলে উঠতে ইচ্ছে করল অরিন্দম। তোর উপরে এই দেশের কোটি কোটি গিগুরা নির্ভর করে আছে। তুই, তোরাই ওদের রক্ষক। তোর মেরুদণ্ডই বেঁকে গেছে। তুই সিভিল সারভেন্ট, না বানিয়া, না স্টেশনমাস্টার তাতে কিছুই যায় আসে না। কিছু একটা কর অরিন্দম! তোর মুখের দিকে সমস্ত দেশ, আমার ছেলে রাজা, তোর মেয়ে রানি সকলে চেয়ে বসে আছে। গিগুর কথা ছেড়েই দে। ওদের দুজনের ভবিষ্যৎ রাজা-রানির ভবিষ্যৎও তোর হাতে, তোর মতো অগণ্য অরিন্দমদের হাতে। ওদের বাঁচা অরিন্দম। মানুষের মতো, সম্মানের সঙ্গে ওরা যাতে বাঁচতে পারে তেমন।

পরিবেশ তৈরি কর। চাইলে তোরাই পারিস। তুই একা মেরুদণ্ড টান-টান করে দাঁড়া, দেখবি তোর কত কলিগ তোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু সাহস করে দ্যাখ, অরিন্দম! সামান্য। সাহসও সামান্য সামান্য করে জমতে জমতে তার স্নো-বলিং এফেক্ট হয়ই। সেই সুন্দর বিপুল হিমবাহর তোড়ে তোরা ভাসিয়ে নিয়ে যা এই নেতাদের জঞ্জালকে। দেশকে বাঁচা তোরা এদের হাত থেকে। প্লিজ! অরিন্দম! প্লিজ।

অরিন্দম বলল কীরে! কী হল তোর?

বললাম, কিছুনা। ভাবছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress