সহধর্মিণী : 1-4
প্রথম পরিচ্ছেদ
হরকুমার বাবু পশ্চিমে ওকালতী করতেন। ওকালতী করিয়া তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি নিতান্ত বৃদ্ধ না হইলেও দুইটী কারণে ওকালতী ছাড়িয়া দিয়া কলিকাতায় লোয়ার সার্কিউলার রোডে একখানি সুন্দর বাড়ী কিনিয়া তথায় বাস করিতেছেন।
এই দুইটী কারণের প্রথম কারণ—তাঁহার স্ত্রী চিরুরুগ্না, বহুকাল হইতে একরূপ শয্যাগতা। পশ্চিমের অত্যধিক গরমে থাকিলে তাঁহার পীড়া বৃদ্ধি পাইবে, বড় বড় ডাক্তারগণ এই কথা বলায় তিনি তাঁহাদের পরামর্শে পশ্চিম-বাস ত্যাগ করিয়া স্ত্রীকে লইয়া কলিকাতায় আসিয়াছেন। দ্বিতীয় কারণ তাঁহার একমাত্র কন্যা হেমাঙ্গিনী প্রাপ্তবয়স্কা হইয়াছে, এক্ষণে তাহার বিবাহ দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন।
হরকুমার বাবু চিরকালই ব্রাহ্মভাবাপন্ন, হিন্দুয়ানীর বড় একটা ধার ধারিতেন না। পশ্চিমে তিনি ঠিক সাহেবের ন্যায় বাস করিতেন। এখানেও তিনি পুরা সাহেব—তিনি বাল্য-বিবাহের একেবারেই পক্ষপাতী ছিলেন না। সেই কারণে কন্যাকে বাল্যকালে অল্প বয়সে বিবাহ দেন নাই—হেমাঙ্গিনীকে যতদূর সুশিক্ষিতা করিতে হয়, তাহা করিয়াছেন। হেমাঙ্গিনী চারুসর্বাঙ্গী—অনিন্দ্যসুন্দরী, তাহার রঙ-টুকুও যেমন ফুটফুটে, গড়নটুকুও তেমনি পরিপাটি। আবার সে যেমন সুন্দরী, তেমনই গুণবতী—লিখিতে পড়িতে গাই ে বাজাইতে, সে সৰ্ব্বপ্রকার সর্ব্বগুণে গুণান্বিতা। এক্ষণে তাহার বয়স ষোড়শবর্ষ উত্তীর্ণ হইয়াছে। এইব হরকুমার বাবু তাঁহার কন্যার বিবাহ দিবেন স্থির করিয়াছেন।
তাঁহার স্ত্রী কোন্ দিন আছেন, কোন্ দিন নাই। তিনিও কন্যার বিবাহের জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন, এবং সর্ব্বদা তাহারই জন্য স্বামীকে পীড়াপীড়ি করিয়া থাকেন।
হরকুমার বাবুর বিশেষ বন্ধু অনন্তবাবু কালীপুরের জমিদার। তাঁহার পুত্র সতীশচন্দ্র সুপুরুষ সুশিক্ষিত যুবক। বহুকাল হইতে হরকুমার বাবুর ইচ্ছা সতীশচন্দ্রের সহিত তিনি তাঁহার কন্যার বিবাহ দেন। সতীশচন্দ্র প্রায়ই তাঁহার বাড়ীতে আসিতেন; তাঁহারাও সকলেই সতীশচন্দ্রকে বিশেষ স্নেহ করিতেন; হেমাঙ্গিনীর সহিতও তাঁহার বিশেষ সৌহাৰ্দ্দ জন্মিয়াছিল। হেমাঙ্গিনী যৌবন-সুলভ ভালবাসায় তাঁহাকে না ভালবাসিলেও সে তাহার পিতা মাতার ভাব-ভঙ্গীতে বুঝিয়াছিল যে, এক সময়ে তাহাকে সতীশচন্দ্রের গৃহশোভিনী হইতে হইবে। কিন্তু হরকুমার বাবু বা তাঁহার স্ত্রী কখনও এ পর্য্যন্ত কন্যার সম্মুখে এ কথা উত্থাপন করেন নাই; তথাপি হেমাঙ্গিনী বেশ বুঝিয়াছিল যে তাহার মাতাপিতা উভয়েরই এই ইচ্ছা। সতীশচন্দ্রও ইহা জানিতেন, কিন্তু তিনি এ পর্যন্ত হেমাঙ্গিনীকে এ সম্বন্ধে কিছুই বলেন নাই। কেহ কিছু না বলিলেও হেমাঙ্গিনী ইহা বেশ জানিত, এবং মোটের উপর সে ইহাতে অসন্তুষ্ট ছিল না।
সতীশচন্দ্রের পিতা নাই, তিনিই এক্ষণে তাঁহার পিতার অতুল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারী, মস্ত বড় জমিদার। সুশিক্ষিতা হইলেও বড় ঘরের ঘরণী হইবার জন্য বরাবরই হেমাঙ্গিনীর একটা নৈসর্গিক প্রবল স্পৃহা জাগরিত ছিল। অদৃশ্য ভবিষ্যতের অনন্ত তিমির-গর্ভে কি নিহিত আছে, তাহা কে বলিতে পারে! ভবিতব্যতা দেবতারও অজ্ঞাত, মানুষে কেমন করিয়া জানিবে! হেমাঙ্গিনী তাহা জানিত না, তাহার পিতামাতাও জানিতেন না।
হেমাঙ্গিনী সতীশচন্দ্রকে ঠিক ভালবাসিত কিনা, সে কথা সে কোন দিন তাহার মনের নিকট জিজ্ঞাসা করে নাই, কিন্তু সে কখনও সতীশচন্দ্রকে অযত্ন করিত না; তবে সতীশচন্দ্র যে তাহাকে হৃদয়ের সহিত ভালবাসেন এটুকু সে বেশ বুঝিয়াছিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
হরকুমার বাবু ওকালতী ছাড়িয়া একটু খেয়ালী হইয়াছিলেন। কাজকর্ম্ম না থাকিবার জন্যই হউক, অথবা তাঁহার স্ত্রীর নানা ব্যাধিবশতই হউক, যে কারণেই হউক, তাঁহার শরীরে কোন পীড়া না থাকা সত্ত্বেও তিনি সর্ব্বদাই মনে করিতেন যে, তাঁহার দেহ ব্যাধির আকর হইয়াছে। তিনি কারণে ও বিনা কারণে ডাক্তার ডাকাইতেন ও ঔষধ খাইতেন। যখন ঔষধ খাইতেন না তখন চা পান করিতেন। তাঁহার এই খেয়ালের জন্য ডাক্তারগণ বেশ দুই পয়সা পাইতেন, ভৃত্যগণও প্রভুর চা- পানের জন্য কিছু যে লাভবান্ হইতেন না, তাহা নহে।
হরকুমার বাবুর স্ত্রী যখন শয্যাশায়ী থাকিতেন না, তখন একখানা আরাম কেদারায় বালিশে একরূপ মণ্ডিত হইয়া বসিয়া থাকিতেন। আজও তাহাই ঠিক ছিলেন। হেমাঙ্গিনী তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া মোজা বুনিতেছিল। তখন পশ্চিম গগনকে লালে লাল করিয়া, সমস্ত আকাশে আবির ছড়াইয়া, সূৰ্য্য ঢলিয়া পড়িতেছিল।
সহসা জননী কন্যার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হেম, কে এল?”
একখানা গাড়ী আসিয়া দরজায় দাঁড়াইল, সেই শব্দ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল। কিন্তু কেহ আসিল না, সে শব্দের কথাও আর তাঁহার মনে আসিল না।
হরকুমার বাবুর চা পানের সময় হইল, ভৃত্য সেই ঘরে এক ক্ষুদ্র টেবিলের উপর চা-এর সরঞ্জাম সকল রাখিয়া গেল; কিন্তু হরকুমার বাবু আসিলেন না। তাঁহার চা-পান সম্বন্ধে সময়ের ব্যতিক্রম কখনও ঘটে নাই, সুতরাং তাহার স্ত্রী বিস্মিত হইলেন। আরও কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিয়া তিনি বেশ একটু চঞ্চল ভাবে কন্যাকে বলিলেন, “তিনি বাহিরের ঘরে হয় তো ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। হেম, যাও না, দেখে এস।”
হেমাঙ্গিনী মোজা বোনা বন্ধ করিয়া উঠিল এবং পিতার অনুসন্ধানে বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে বলিল, “বাবা, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল—তুমি এখনও—”
হেমাঙ্গিনীর মুখের কথা ঠোটেই মিলাইয়া গেল। হরকুমার বাবুর পার্শ্বে উপবিষ্ট একটী ভদ্রলোক, সুপুরুষ যুবক। তিনি হেমাঙ্গিনীকে দেখিবামাত্র সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। হরকুমার বাবু বলিলেন, “রমেন্দ্র বাবু, এটা আমার কন্যা।”
হেমাঙ্গিনী কোন কথা কহিল না, তাহার বিশাল, নীলোৎপলতুল্য, আকর্ণবিশ্রান্ত নয়নযুগল সহসা নত হইল। সে তৎক্ষণাৎ চঞ্চল চরণে তথা হইতে ছুটিয়া পালাইল।
রমেন্দ্রনাথ দরিদ্র-সন্তান, তাঁহার পিতা নাই, মাতা আছেন। তিনি নিজ অধ্যবসায়ে বৃত্তি পাইয়া এক্ষণে মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারী পড়িতেছেন। আর কিছুদিন পরেই তিনি পাশ করিয়া ডাক্তার হইতে পারিবেন।
হরকুমার বাবু ডাক্তার দেখিলেই তাঁহার বিশেষ আদর আপ্যায়ন করিতেন। রমেন্দ্রর সহিত তাঁহার পরিচয় হওয়ায় তিনি তাঁহার নম্রভাব, তাঁহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তাঁহার চিকিৎসা-বিদ্যায় পারদর্শিতা দেখিয়া তাঁহার প্রতি বিশেষ প্রীত হইয়াছিলেন। রমেন্দ্রনাথ কলেজ বন্ধ হওয়ায় দেশে যাইতে ছিলেন, কিন্তু হরকুমার বাবু তাঁহাকে দিন কয়েক তাঁহার বাড়ীতে থাকিবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করিয়াছিলেন, তাই রমেন্দ্রনাথ তাঁহার বাড়ীতে আসিয়াছেন।
তিনি চারি দিন মাত্র থাকিবেন মনে করিয়া আসিয়াছিলেন, কিন্তু ক্রমে এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ, এক মাস কাটিয়া গেল, তবু তাঁহার যাই যাই করিয়াও যাওয়া ঘটিল না। ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কথা সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহার কারণ ছিল। হরকুমার বাবু প্রথম হইতেই রমেন্দ্রর উপর প্রীত হইয়াছিলেন। রমেন্দ্র এক্ষণে পাশকরা ডাক্তার না হইলেও শীঘ্রই হইবেন। তিনি নিজ স্ত্রীর ব্যাধির কথা সমস্তই রমেন্দ্রকে বলিয়াছিলেন, রমেন্দ্রও সকল শুনিয়া নূতন ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন। এই ঔষধ ব্যবহারে তাঁহার স্ত্রীর বিশেষ উপকার দৃষ্ট হইল, ইহাতে তিনি রমেন্দ্রকে দিন কতক তাঁহাদের বাড়ীতে থাকিবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করিতে লাগিলেন, হেমাঙ্গিনীর মাতাও স্বামীকে অনুরোধ করিতে বলিলেন। রমেন্দ্ররও ছুটি ছিল, কাজেই তিনি রহিয়া গেলেন।
প্রত্যহ হরকুমার বাবু ও তাঁহার স্ত্রী রমেন্দ্রের উপরে অধিকতর আকৃষ্ট হইতে লাগিলেন। রমেন্দ্রও একজনের উপর আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন, বলা বাহুল্য, সে হেমাঙ্গিনী।
আর হেমাঙ্গিনী—সে প্রকৃত পক্ষে সতীশচন্দ্রকে কখনই ভালবাসিতে পারে নাই। এক্ষণে তাহার সদ্যোবিকসিত লাবণ্য ঢল ঢল উচ্ছ্বসিত যুবতী-হৃদয় নম্র সুন্দর সুপুরুষ রমেন্দ্রকে দেখিয়া ভুলিয়া গিয়াছিল। এই এক মাস রমেন্দ্রর সহিত একত্রে বাস করিয়া তাঁহার মূর্ত্তি হেমাঙ্গিনীর হৃদয়ে অঙ্কিত হইয়া গেল।
তিনি কে, কোথায় বাড়ী, এ সকল হেমাঙ্গিনী একবারও তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করে নাই, ধীরে ধীরে তাঁহাকে যে ভালবাসিতেছে, তাহাও সে নিজে ভালরকম বুঝিতে পারে নাই, এক মুহূর্তের জন্য চিন্তাও করে নাই। তাঁহার সঙ্গে থাকিতে ভাল লাগে, তাঁহার সহিত কথা কহিলে মন আনন্দে ভরিয়া উঠে, এই পৰ্য্যন্ত সে জানিত আর কিছু ভাবিবার তাহার সময় বা অবসর ছিল না।
কিন্তু রমেন্দ্রনাথ সব বুঝিলেন। হেমাঙ্গিনীর হৃদয়খানি যে আর একটী হৃদয়ের সহিত মিলিত হইবার জন্য ক্রমে ক্রমে অগ্রবর্ত্তী হইয়া উঠিয়াছে তাহা তাঁহার নিকট অজ্ঞাত রহিল না। তাঁহার সমস্ত প্রাণটা কি যেন একটা নব আশা লইয়া নব ভাবে সজ্জিত হইবার জন্য নব আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল!
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সুখের স্বপ্ন চিরকাল থাকে না। ছয় সপ্তাহ অতীত হইয়া গিয়াছে, রমেন্দ্রের বিদায় লইবার সময় আসিয়াছে। তিনি একদিন গৃহমধ্যে নিৰ্জ্জনে হেমাঙ্গিনীকে পাইয়া তাঁহার বিদায়ের কথা বলিলেন। হেমাঙ্গিনী অবনত মস্তকে তাহার হাতের পশমগুলি গুছাইতে গুছাইতে বলিল, “এত শীঘ্র যাইতেছেন কেন, আর দু’এক দিন থাকুন না?”
রমেন্দ্রর বুকের ভিতরটা স্পন্দিত হইতেছিল, তিনি মৃদুস্বরে বলিলেন, “এত শীঘ্র কই, আমি এখানে কেবল দু’ তিন দিন থাকিব বলিয়া আসিয়াছিলাম, আর আজ এই দেড় মাস রহিয়াছি!”
“আপনার ঔষধে মার অনেক উপকার হইয়াছে।”
“ভগবান করুন, তিনি শীঘ্র আরোগ্য লাভ করুন।”
“মার অসুখ কত দিনে সারিবে?”
ইহার উত্তরে রমেন্দ্র কি বলিবেন? তিনি মনে মনে জানিতেন, হেমাঙ্গিনীর মাতার জীবন ক্রমে সঙ্কীর্ণ হইয়া আসিতেছে, এই জন্য সে কথার কোন উত্তর না দিয়া বলিলেন, “এখন আবার কালেজের সেই দারুণ খাটুনিতে লাগিতে হইবে—এখানে বড়ই সুখে দিনগুলি কাটিল, এ সুখ-স্মৃতি আমার হৃদয় হইতে জীবনে কখনও যাইবে না।”
হেমাঙ্গিনী অন্যমনষ্কে দুই হাতে পশম আরও টানিতে টানিতে বলিল, “আপনি কি এখান হইতে কলেজে যাইবেন?”
“না—এখনও সাত দিন ছুটি আছে, দেশে গিয়া মাকে একবার দেখিয়া আসিব।”
হেমাঙ্গিনী মুখ তুলিল, বলিল, “আপনার মা! কই তাঁহার কথা তো এক দিনও বলেন নাই। আপনাদের বাড়ী কোথায়?”
“যশোহর জেলায়, আমাদের অবস্থা বড় ভাল নয়।”
হেমাঙ্গিনী কোন কথা কহিল না।
রমেন্দ্রের স্বর গম্ভীর হইয়া আসিল “ডাক্তারি পাশ করিতে পারিলে বোধ হয়, তাঁহার দুঃখ ঘুচাইতে পারিব, সেই জন্য প্রাণপণে পরিশ্রম করিতেছি। মা আমাকে ওকালতী পাশ দিতে বলিয়াছিলেন।”
“তাহাই দিলেন না কেন? আমার বাবা উকিল ছিলেন।”
“ডাক্তারী আমি নিজে ইচ্ছা করিয়াই লইয়াছি, উকিলের অবস্থা এখন বড়ই খারাপ, ডাক্তারিতে যাহা হউক কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
“যা—পশমগুলা জড়াইয়া গেল!”
পশমের দোষ না হেমাঙ্গিনীর নিজের দোষে পশম জড়াইয়া গেল, তাহা বলা যায় না।
রমেন্দ্র বলিলেন, “আচ্ছা আমি দেখি—আমি ছাড়াইয়া দিতে পারি কি না।”
হেমাঙ্গিনীর মুখ আরক্ত হইল। রমেন্দ্র পশমের এক দিক্ ধরিয়া পশমের পাক ছাড়াইবার চেষ্টা পাইলেন, অপর দিক হেমাঙ্গিনীর হাতেই রহিল, কাজেই তাঁহার মুখ অনেকটা হেমাঙ্গিনীর সন্নিকটবর্ত্তী হইল। ইহাতে হেমাঙ্গিনীর সুন্দর মুখখানি আরও রক্তাভ হইয়া গেল;রমেন্দ্রেরও ঘাড় পর্যন্ত লাল হইয়া উঠিল। শেষে উভয়ের মস্তক পরস্পরের এত সন্নিকটবর্ত্তী হইল যে, বোধ হইতেছিল তাঁহাদের মৃদু নিক্ষিপ্ত নিশ্বাস মিলিত হইয়া একসঙ্গে বাহির হইতেছে।
তাঁহারা উভয়ে এতই অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, এই সময়ে যে আর এক ব্যক্তি সেই গৃহের ভিতরে প্রবেশ করিলেন, তাহা কেহই লক্ষ্য করিলেন না।
সতীশচন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন।
সহসা হেমাঙ্গিনী ও রমেন্দ্র চমকিত হইয়া মুখ তুলিলেন। হেমাঙ্গিনীর রক্তাভ মুখখানি যেন সহসা শাদা হইয়া গেল, কিন্তু সে আত্মসংযম হারাইল না, অতি শীঘ্রই নিজেকে সামলাইয়া লইল। সতীশচন্দ্র অগ্রসর হইলেন।
রমেন্দ্র ও সতীশ উভয়ে মুখ-মুখি হইয়া দণ্ডায়মান হইলেন; উভয়ের এই প্রথম সাক্ষাৎ। এই ছয় সপ্তাহ শতীশ দেশে গিয়াছিলেন।
হেমাঙ্গিনী প্রায় অস্ফুট স্বরে বলিল, “সতীশবাবু, ইনি রমেন্দ্রবাবু।”
উভয়ে উভয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিলেন। উভয়েই উভয়কে ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী বলিয়া স্থির করিলেন। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, “কখন আসিলেন? বাবার সঙ্গে দেখা হইয়াছে?”
“না। বেহারা বলিল, তিনি এই ঘরে আছেন।”
রমেন্দ্র ভদ্রতার হিসাবে বলিলেন,—”তিনি একটু আগে বাহির হইয়া গিয়াছেন, এখনও ফিরেন নাই।”
সতীশ তাঁহার কথার কোন উত্তর না দিয়া হেমাঙ্গিনীর দিকে ফিরিলেন। ইহাতে রমেন্দ্রের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল। তিনি ধীরে ধীরে সে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
সতীশ হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হেম, এ লোকটী কে?” হেমাঙ্গিনী মনে মনে রাগিয়াছিল, বলিল, “এইমাত্র ত বলিলাম রমেন্দ্রবাবু।”
স্বরটা একটু ঝঙ্কারের মত শুনাইল। নিজের স্বরে হেমাঙ্গিনী নিজেই চমকিত হইয়াছিল, বেশ একটু অপ্রস্তুতও হইয়াছিল। মনে মনে তৎক্ষণাৎ আত্মসংবরণ করিয়া সহজকণ্ঠে কহিল, “ইনি ডাক্তারী পড়িতেছেন, বাবার সঙ্গে আলাপ হওয়ায় বাবা দিন কতক এখানে ইঁহাকে থাকিতে বলেন, তাই আছেন। বাবা ইঁহাকে খুব ভালবাসেন, আমরাও—” বলিতে বলিতে থামিয়া গিয়া একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, “ইনি বেশ ভাল লোক।”
সতীশচন্দ্র ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিলেন, গাঢ় স্বরে বলিলেন, “এস, তোমার মার সঙ্গে দেখা করি। তিনি ভাল আছেন ত?”
হেমাঙ্গিনী সতীশের কোন কথাই এ পর্য্যন্ত অমান্য করে নাই। কেবল আজ এই প্রথম তাহার হৃদয়ে বিদ্রোহাচারণ উপস্থিত করিল। সতীশের সহিত মাতার নিকট যাইতে তাহার প্রাণ চাহিতেছিল না—সে যাইতে অস্বীকার করিতে যাইতেছিল, কিন্তু এবারও আত্ম-সংবরণ করিল, কোন কথা না কহিয়া তাঁহার সঙ্গে চলিল।
.
পরদিন রমেন্দ্র হরকুমার বাবুর বাড়ী হইতে চলিয়া গেলেন।
সেই দিন হইতে সতীশের সহিতও হেমাঙ্গিনীর মনোবাদ ঘটিল, একদিন প্রায় কলহের মত হইল। সতীশ ও হেমাঙ্গিনী দুই জনেই বুঝিলেন, তাহাদের উভয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান আসিয়া পড়িয়াছে। রমেন্দ্রের নাম উভয়ের কেহই করিলেন না সত্য, তবে উভয়েই বুঝিলেন যে, রমেন্দ্র না আসিলে কখনও এ অবস্থা ঘটিত না।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
দুই বৎসর অতীত হইয়াছে। এই দুই বৎসর হেমাঙ্গিনীর জীবনের অনেক পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে।
তাহার চিররুগ্না মাতা এখনও তদবস্থায় জীবিতা আছেন, কিন্তু হরকুমার বাবু আর নাই। ছয় মাস হইল, তিনি তাঁহার পত্নী ও কন্যাকে চির শোক সাগরে ভাসাইয়া মহাপ্রস্থান করিয়াছেন।
তাহার মাতা এখন একেবারে শয্যাগতা, সুতরাং হেমাঙ্গিনীর স্কন্ধেই সংসারের সকল ভার পড়িয়াছে। সে বালিকা বই ত নহে, চিরকাল পিতামাতার আদরের পাত্রী ছিল, দুঃখ কষ্ট চিন্তা কাহাকে বলে, তাহা সে একেবারেই জানিত না। এখন সংসারের নানা ভাবনা-চিন্তায় সে উৎপীড়িতা হইয়া উঠিয়াছে, তাহার জীবনে সুখ-শান্তি কিছুই আর নাই। জননী পীড়িতা, পিতা নাই, কোন নিকট আত্মীয় স্বজনও নাই—কে দেখে, কে শুনে!
বহুকাল আর সে রমেন্দ্রের কোনই সংবাদ পায় নাই। তিনি কোথায়, কি করিতেছেন, তাহাও সে জানে না।
সতীশ আর পূর্ব্বের ন্যায় আসেন না, সৌজন্য রক্ষার জন্য আসা নিতান্ত প্রয়োজন, কালে ভদ্রে একবার করিয়া আসিয়া থাকেন মাত্র। তিনি আর কখন পূর্ব্ব কথা উত্থাপন করেন নাই। এইরূপে বড়ই কষ্টে হেমাঙ্গিনী দিনের পর দিন কাটাইতেছিল।
এই সময়ে একদিন সতীশচন্দ্র তাহাদের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। তিনি ইদানীং যখনই আসিতেন হেমাঙ্গিনীর জননীর সংবাদ লইবার অজুহাতে আসিতেন, আজও সেইরূপ আসিয়াছিলেন।
হেমাঙ্গিনীকে নিতান্ত বিষণ্ণ দেখিয়া তিনি তাহার সম্মুখে বসিলেন। কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “হেম, আমি বুঝিতেছি তুমি যে অবস্থায় পড়িয়াছ, তাহাতে সংসারের ভাবনা চিন্তা একাকী বহন করিতে পারিবে না।”
হেমাঙ্গিনী চমকিত হইয়া মুখ তুলিল, তাহার হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। সতীশচন্দ্র বলিলেন, “তুমি একেবারে বালিকা নও, আমার উদ্দেশ্য বুঝিতেই পারিতেছ। ইচ্ছা করিলে আমি অনেক দিন পূর্ব্বে বিবাহ করিতে পারিতাম। হেম, তুমি কিন্তু জান আমি তাহার অপেক্ষা তোমায় কত ভালবাসি।”
হেমাঙ্গিনী রুদ্ধকণ্ঠে কহিল “কাহার অপেক্ষা?”
হেমাঙ্গিনীর কণ্ঠ যেন একটা দানব অলক্ষ্য হস্তে কঠিনভাবে চাপিয়া ধরিল;অতি কষ্টে হেমাঙ্গিনী কহিল, “আপনি তাঁহার কথা তুলিতেছেন কেন? তিনি আমার কে?” স্বরটা যেন ক্রমে আড়ষ্ট হইয়া অসিল।
“হেম, তাহা হইলে সম্মত হও—আমি বিবাহের আয়োজন করি। তুমি ত জান, তোমার বাবার কি ইচ্ছা ছিল।”
হেম কি উত্তর দিবে? সে তাহার হৃদয়ের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করিল, দেখিল, সেখান হইতে রমেন্দ্রের মূর্ত্তি তখনও বিলুপ্ত হয় নাই। কিন্তু সে তাহাকে বিবাহ করিতে পারে না; গরীব অজ্ঞাত কুলশীল ডাক্তারকে সে কিরূপে বিবাহ করিবে? সতীশ জমিদার, হেমাঙ্গিনীও সুখে লালিতা পালিতা। হেমাঙ্গিনী স্পন্দিতকণ্ঠে বলিল, “কাল পৰ্য্যন্ত আমায় ভাবিতে সময় দিন।”
সতীশ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “বেশ তাই, না বলিও না, তুমি জান আমি তোমায় কত ভালবাসি। আমি তোমারই জন্য এ পর্য্যন্ত বিবাহ করি নাই, তোমাকে যদি না পাই—কখনও বিবাহ করিব না। আর এখন তোমার মাকে—তোমাদের সকলকে, দেখিবার একজন লোক আবশ্যক, তুমি লেখাপড়া শিখিয়াছ, তুমি বুদ্ধিমতী, তোমাকে বেশী কি বলিব?”
.
বহুক্ষণ হেমাঙ্গিনী নীরবে বসিয়া রহিল। তাহার পর সে ধীরে ধীরে তাহার শয্যাগতা জননীর নিকটে উপস্থিত হইল। জননী তাহার দিকে একবার মাত্র চাহিয়া আবার চক্ষু মুদ্রিত করিলেন।
হেমাঙ্গিনী জননীর পার্শ্বে বসিয়া অনেকক্ষণ ইতস্ততঃ করিল; কিন্তু যাহা বলিতে চাহিতেছিল, তাহা বলিতে পারিল না। বহুক্ষণ পরে হৃদয়ে সাহস বাঁধিয়া বলিল, “মা!”
মাতা চক্ষুরুন্মীলন করিয়া কন্যার দিকে চাহিলেন; কিন্তু হেমাঙ্গিনী কোন কথা বলিতে পারিল না, তখন মাতা ধীরে ধীরে বলিলেন, “কি বলিতেছিলে মা, বল! “
“মা!”
“বল, কি।”
“সতীশ বাবু—”
“সতীশ বাবু কি?—ছি মা, আমার কাছে আর তোমার লজ্জা কি? বল মা।”
“তিনি বলিতেছিলেন যে—” হেমাঙ্গিনী চুপ করিল।
জননী ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “কি বলিতেছিলেন—বুঝি বিবাহের কথা! তা ভালই ত—তুমি কি বলিয়াছ?”
“এখনও কিছু বলি নাই—তোমাকে না জিজ্ঞাসা করিয়া কি বলিব?”
“সতীশের মত জামাই পাইতে কাহার না ইচ্ছা হয়? তুমি ত জানই তোমার পিতার তাহাই ইচ্ছা ছিল—আমারও ইচ্ছা।”
“তবে মা-“
“কি মা—এমন বিবাহে আপত্তি কি?”
“আমি সতীশ বাবুকে ঠিক সে রকম ভালবাসিতে পারি নাই।”
“ও সব ছেলে মানুষের কথা, স্বামীকে স্ত্রীমাত্রেই ভালবাসিয়া থাকে, ইহাতে না বলিও না—এমন স্বামী দুর্লভ—আর সতীশকে পাইলে আমাদের সংসারের ভাবনা থাকিবে না।”
তাহাই হইল। পরদিন সতীশচন্দ্র হেমাঙ্গিনীর সম্মতি লাভ করিলেন। তিনি যথার্থই হেমকে প্রাণের সহিত ভাল বাসিতেন। হেমাঙ্গিনীর সম্মতি পাইয়া সতীশচন্দ্র আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া বিবাহের বন্দোবস্ত করিতে নিযুক্ত হইলেন। এত দিন পরে শত ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করিয়া দুইটী হৃদয় এক হইতে চলিল।